বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-২+৩

0
731

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০২ ও ০৩
উচুঁ দুতলা বিষিষ্ট এক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।বাড়ির গেট’টা বেশ সুন্দর। একদম চোখ ধাধানো।কি সুন্দর করে সকাল সন্ধ্যা ফুল গাছ দিয়ে গেটটা জুড়ে আছে।আর তাতে অসংখ্য ফুল। বাড়িটা অনেক বড়।এখানে দুটো দুতলা ভবন আছে আরাবী ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো। আর দুটো বাড়ি ঘেরাও করে চারদিকে দেয়াল টানা।আরাবী আবার গেটের দিকে তাকালো।সেখানে গেটের পাশেই নেমপ্লেটে বাড়ির নাম লিখা ‘সাখাওয়াত ভিলা!’ প্রাহি হাতে থাকা ঠিকানাটা আরো একবার পরখ করে নিলো।যদি পাছে আবার ভুলটুল বাড়িতে এসে পড়ে।নাহ,ঠিক আছে একদম।এদিকে বাড়ির দারোয়ান এতোক্ষন ভ্রু-কুচকে দেখছিলো আরাবীকে।কিন্তু আরাবী কতোক্ষন যাবত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।এইবার প্রশ্ন করলেন তিনি,

-‘ কে তুমি?কি চাই গো মা তোমার?’

দারোয়ান লোকটির বয়স বেশি হলে পঞ্চাশোর্ধ্ব হবে।লোকটার বিনয়ী আচড়নে বেশ মুগ্ধ হলো আরাবী। মাথা নিচু করে বলে উঠলো,

-‘ জি আংকেল।এটা কি মিহান সাখাওয়াত এর বাড়ি?’

দারোয়ান জবাবে বলেন,

-‘ হো গো মা।এইডা মিহান সাখাওয়াতের বাড়ি।’

আরাবী মুখটা কাচুমাচু করে বলেন,

-‘ আসলে আমি গ্রাম থেকে এসেছি উনার সাথে দেখা করতে।উনার সাথে কি দেখা করা যাবে?’

দারোয়ান হাসলেন।আরাবীকে তার বসার সিট’টা দেখিয়ে দিয়ে বলেন,

-‘ তুমি এইহানে বসো মা।আমি স্যারের থেকে জিজ্ঞেস করে আসি। ওহ হ্যা তোমার নাম কি মা?’

আরাবী চেয়ারে বসেছিলো মাত্র।দারোয়ানের প্রশ্নে ধীর কন্ঠে বললো,

-‘ আরাবী। ইনসিয়া জাহান আরাবী।’

নামটা শোনা মাত্রই দারোয়ান চলে গেলো বাড়ির ভীতরে।বেশখানিক সময় পেরোলো।আরাবীর মনটা কেমন যেন খচখচ করছে।ভয়ও লাগছে।একা একা এতোদূর কখনো আসেনি আরাবী।আর সাথে এইভাবে অচেনা অজানা কারো বাসায় তো একদমি না।মায়ের কথায় তো এসে পরলো এখানে।কিন্তু লোকগুলো যদি ওকে এখানে থাকতে না দেয়?কি করবে প্রাহি?কোথায় যাবে?মায়ের কথায় ভরসা পেয়েই তো এখানে এসেছে ও? প্রাহি ভেবে নিয়েছিলো।এখানে ও এমনিতেও বেশিদিন থাকতো না।যেহেতু ইন্টার পাশ করেছে বেশ ভালো গ্রেডে।তাই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একটা ভালো চাকরি পেলেই এখন থেকে মেসে উঠে যেতো আরাবী। আনমনে এসব ভাবছিলো আরাবী।হঠাৎ ঝড়ের গতিতে একজন মহিলা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।বিষ্ময়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আরাবী।হঠাৎ আকস্মিক এমন করায় হৃৎপিন্ড’টা এতো জোড়ে লাফাচ্ছে যে মনে সেটা এই একটু পরেই বুক চিরে বেড়িয়ে আসবে।প্রায় অনেকক্ষন পর মহিলাটি ছেড়ে দিলো আরাবীকে।আরাবী এইবার চোখ তুলে তাকালো।বয়সটা ওর মায়ের মতোই হবে।সর্বাঙ্গে আভিজাত্যের ছোঁয়া।গায়ে মেরুন রঙ্গের শাড়ি জড়ানো।এতে যেন আরো সুন্দর লাগছে তাকে।মহিলাটি এইবার আরাবীর গাল স্পর্শ করলো।ভেজা কন্ঠে বললো,

-‘ তুমি লিপি আর জিহাদ ভাইয়ের মেয়ে আরাবী?’

আরাবী মাথা নিচু করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।মহিলাটি আবার বললো,

-‘ মাশাল্লাহ্।দেখতে পুরো জিহাদ ভাইয়ের মতো হয়েছো।’

অনেকদিন পর বাবার কথা এইভাবে বলায় চোখ ভরে আসে আরাবীর।তাও নিজেকে সামলে নিলো।মহিলাটিকে আবারও পরখ করলো।আস্তে আস্তে মহিলাটিকে চিনতে পারলো আরাবী।ধীরকন্ঠে ডাকলো,

-‘ মিলি আন্টি!’

মিলি বেগম যেন অবাক হয়ে তাকালো বললো,

-‘ তুমি আমায় চিনতে পেরেছো?’

আরাবী বললো,

-‘ হ্যা! ওই ভালোভাবে একটু তাকিয়েই চিন্তে সক্ষম হয়েছি।’

মিলি বেগম অত্যন্ত খুশি হলেন।পরক্ষনে কিছু একটা ভেবে বলেন,

-‘ এই দেখো তোমাকে বাহিরে দার করিয়ে রেখেছি।আসো আসো ভীতরে আসো।’

মিলি বেগম আরাবীকে টেনে বাড়ির ভীতরে নিয়ে আসলেন।মিলি বেগম থাকেন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়।আরাবীকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই আরাবী পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো।ভীষন সুন্দর বাড়িটা।আরাবী তো চোখই সরাতে পারছে না।এদিকে আরাবীকে নিয়ে সোফায় বসাতেই।হঠাৎ কারো ডাকে চমকে উঠে,

-‘ মিলি মা?কেমন আছিস?’

আরাবী চমকে তাকালো।পরক্ষনে হুইল চেয়ারে বসা ব্যাক্তিটিকে চিনতে বিন্দুমাত্র সময় নিলো না।আরাবী দ্রুত পায়ে হেটে লোকটির সামনে বসে পরলো।বললো,

-‘ মিহান আংকেল।’

মিহান অনেক খুশি হলো যেন। খুশি হয়ে বলেন,

-‘ চিন্তে পেরেছিস আমাকে?’

আরাবী মাথা নাড়ালো।মিহান আরাবী’র মাথায় স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দিলেন।এদিকে মিলি বেগম ট্রেভর্তি নাস্তা নিয়ে এসে বলেন,

-‘ কি গো মেয়েটা সবে আসলো।আগে কিছু একটা খেয়ে নিতে দেও।এতোটা পথ পারি দিয়ে এসেছে।নিশ্চয়ই খুব ক্ষুদা পেয়েছে ওর।’

মিহান আরাবীকে সোফায় বসতে বললেন।মিহানের দুটো পা নেই।প্রাহির বাবার যেই এক্সিডেন্ট হয়েছিলো সেই গাড়িতে তিনিও ছিলেন।আর এক্সিডেন্টে উনার পা দুটো নষ্ট হয়ে যায়।আরাবীর অনেক কিছুই মনে আছে ছোটবেলার।
মিলি আর মিহান এর সাথে টুকাটাকি কথা বলে হালকা নাস্তা করছে আরাবী।এর মাঝে হঠাৎ মিলি জিজ্ঞেস করলেন,

-‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মা?’

আরাবী মিষ্টি হেসে বলে,

-‘ জি করুন আন্টি?’

-‘ তোমার সাথে কি কিছু হয়েছে?না মানে তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তোমরা তোমাদের নানাবাড়ি চলে যাও।আমি আর তোমার আংকেল গিয়ে দেখা করে আসতাম তোমাদের সাথে।হঠাৎ একদিন গিয়ে দেখি তোমরা সেখানে নেই।আমি আর তোমার আংকেল তোমার মামাদের অনেক জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমরা কোথায় কিন্তু তারা কেউ তোমাদের ঠিকানা দিচ্ছিলো না।তোমার মামারা আমাদের অপমান করে সেখান থেকে পাঠিয়ে দেন।অতঃপর গ্রামের মানুষ থেকে জানতে পারি তোমার মা’কে আবার বিয়ে দেওয়া হয়েছে।কিন্তু কোথায় সেটা কেউ জানেনা।কারন তোমার মামারা চুপিসারে তোমার মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।সেই থেকে তোমাদের কোন খোজ আমরা পায়নি।তো আজ হঠাৎ এতো বছর পর তুমি এখানে। আবার তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে।কি হয়েছে মা আমায় খুলে বলো?কোন সমস্যা?আমাকে বলতে পারো।আমি তো মা বল আমার সন্তানের কষ্ট আমি তাদের দেখেই বুঝে যাই।তোমাকে তো ছোট থাকতে আমার কাছেই আমি বেশি রাখতাম।তুমি আমার কতো আদরের ছিলে জানো তুমি?প্লিজ আরাবী কি হয়েছে আমায় সব বলো মা।’

আরাবী মিলির এমন স্নেহমাখানো কথায় আর নিজেকে সামলাতে পারেনা।মিলিকে জড়িয়ে ধরে ধুকরে কেঁদে উঠে।কিছু বলে না মিলি।কাঁদতে দেয় আরাবীকে।কান্না থামতেই আরাবী আসতে আসতে সবটা বলে মিলি আর মিহানকে।সব শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে যায়।মানুষ কতোটা খারাপ হলে কারো সাথে এমন করতে পারে।কি নিষ্ঠুর মানুষ।
মিহান সব শুনে বলে,

-‘ তোমার মা’কে কেন আনলে নাহ?তাকেও নিয়ে আসতে।ওই লোকটা যদি তোমার মায়ের কোন ক্ষতি করে দেয়?’

আরাবী চোখের জলগুলো মুছে বলে,

-‘ আমি অনেক বলেছি আংকেল।কিন্তু মা আসলো না।আমার দাদু ওখানে আছে।মানে ওই লোকটার মা।সে খুব ভালো মনের মানুষ।প্যারালাইজড তিনি।মা তাকে ফেলে যেতে চান না।বুড়ো মানুষ একা বাড়িতে কিভাবে থাকবেন?তাই এতো বলা সত্তেও মা আসিনি আমার সাথে।’

মিলি আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।মায়া মাখা কন্ঠে বলেন,

-‘ থাক মা কান্না করো না।আমরা আছি না।আমরা ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নিবো তোমার মা’র জন্যে।আর তুমি কোন চিন্তা করবে না।তুমি আমার মেয়ে।আমাকে ছোট থাকতে তুমি মাম্মাম আর মিহানকে পাপা বলে ডাকতে।এখনো তাই ডাকবে এতে আমি আর মিহান অনেক খুশি হবো।তুমি কোন জড়তা করবে না।আজ থেকে তোমার সকল দায়িত্ব আমার।ইফাত আসুক আমি ইফাতকে বলে তোমায় এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি করানোর জন্যে কথা বলবো নেহ।তুমি উপরে চলো আমার সাথে।তোমার রুম দেখিয়ে দিয়ে আসি।ফ্রেস হয়ে রেস্ট নেও।ভালো লাগবে শরীরটা।’

আরাবী সব শুনলো।কিন্তু ইফতার নামটা শুনে মনটা ব্যাকুল হয়ে গেলো।ইফতি ওকে ছোট থাকতে অনেক আদর করতো।কতো শতো চকলেট, পুতুল,টেডি গিফ্ট করতো ওকে।আর ও কান্না করলেই কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা বাড়ি।আরাবী রিনরিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ ইফতি ভাইয়া কোথায় আন্টি?’

মিলি হাসলেন।বলেন,

-‘ ও এখন অফিসে।এই রাতেই আসবে। ও যে তোকে দেখলে কতোটা খুশি হবে।তোকে দেখলেই না জানি আমার ছেলেটা খুশিতে কি করে।আজ আমার পরিবারটা পূর্ণ আমার একটা মেয়ের খুব ইচ্ছা ছিলো কিন্তু ইফতি হওয়ার পর আমার আর কোন সন্তান হয়নি।কিন্তু তুমি যখন জন্ম নিকে সেদিন থেকে যেন আমার এই আফসোসটাও মিটে গিয়েছিলো।তারপর হারিয়ে গেলে তুমি।কিন্তু আজ আবার আমার মেয়ে আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।এইবার আর তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।কোথাও নাহ!’

মিলির কথায় প্রানটা জুরিয়ে যায়।কতো ভালো এই মানুষগুলো।আরাবী মিহান থেকে বিদায় নিয়ে মিলির সাথে রুমে চলে গেলো।ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দিলে শরীরটা ভালো লাগবে।কিন্তু তার আগে মায়ের সাথে কথা বলে নিবে।না জানি ওর মা কেমন আছে।ওই নিষ্ঠুর লোকটা না জানি কি করেছে ওর মায়ের সাথে।মায়ের কথা মনে পড়তেই বুকটা ভার হয়ে আসে আরাবীর। জানা নেই উপরওয়ালা ওর ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন।

#চলবে_______

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ।গল্পটা কেমন লাগছে জানাবেন সবাই প্লিজ।

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৩
মায়ের সাথে দীর্ঘক্ষন কথা শেষ করে ঘুমিয়েছিলো আরাবী।মাত্র উঠলো ঘুম থেকে।বেশ ভালোই লাগছে এখন।আরাবী ফ্রেস হয়ে রুমের বাহিরে বের হলো।নিচ থেকে শোরগোলের আওয়াজ আসছে।এতো মানুষ কোথাথেকে আসলো?এই বাড়িতে তো শুধু মিলি,মিহান, ইফতি আর দুটো মেইড আছে।আর আজ থেকে ও বারলো।আরাবী আস্তে ধীরে নেমে আসলো নিচে। নিচে আসতেই দেখে মিলি আর মিহানের সাথে আরো দুজন আছে।এরা কারা চিনলো না আরাবী।তারা কথা বলছে।আরাবী তাদের কথার মাঝে যাবে কি না তা নিয়ে ভাবছে।না যাওয়াটাই ঠিক মনে করলো আরাবী।হয়তো তারা কোন দরকারি কথা বলছে।তাই আরাবী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো।তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না।মিলি আরাবীকে দেখেই উঠে আসলো।আরাবী হাত ধরে সবার সামনে টেনে নিয়ে আসলো।বললো,

-‘ ওখানে ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?আমি বলেছিলাম নাহ?এখন থেকে এটা তোমারও বাড়ি।তাই নির্দিধায় সব করবে এখানে।’

আরাবী কিছুই বললোনা।চুপচাপ মাথা নিচু করে সোফায় বসে রইলো।মিলি হেসে বাকি দুজনের উদ্দেশ্যে বললো,

-‘ সাথি আপা আর নূর।তোমরা তো ওকে চিনতে পারছো না তাই নাহ?আরে এটা আরাবী।লিপি আর জিহাদ ভাইয়ের মেয়ে।সেই ছোট্ট আরাবী।উফ আমিও না চিনবে কিভাবে তোমরা।তোমরা তো শুধু দু একবার ওর ছবি দেখেছো আর মাঝে মধ্যে ভিডিও কলে দেখেছো।তোমরা তো তখন এখানে থাকতে না।আমিও না কিসব ভুলভাল বলি। জানো আপা আরাবী এখন থেকে এখানেই থাকবে।আমার মেয়ে ও। আর আরাবী ইনি হলেন আমার বড় জা আর নূর হলো উনার মেয়ে।’

এদিকে মিসেস সাথি এতোক্ষন তীক্ষ্ণ নজরে আরাবীকে পরখ করছিলো।আরাবী মিসেস সাথির এমন তীক্ষ্ণ নজরে ভয় পেলো।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,

-‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি!’

মিসেস সাথি গম্ভীর কন্ঠে সালামের জবাব দিলেন।তার মিলির কথা মোটেও ভালো লাগলো না।যে আরাবী এখন থেকে এখানেই থাকবে।এদিকে নূর আরাবীকে দেখে তৎক্ষনাৎ আরাবীর পাশে এসে বসলো দুম করে।এতে খানিক চমকে উঠলো আরাবী।আরাবীকে এমন চমকাতে দেখে খিলখিল করে হাসলো নূর।তারপর মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘ ছোট মা।ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে।একদম পুতুলের মতো দেখতে। যাক এখন থেকে আমার আর একা থাকা লাগবে না।আমি একটা সঙ্গি পেয়ে গেলাম।’

বলেই একপাশ হতে জড়িয়ে ধরলো আরাবীকে।আরাবী অবাক হলো নূরের আচড়নে।এইভাবে অচেনা একটা মেয়েকে এমন এক ঝটকায় কিভাবে কেউ এতো সুন্দর করে আপন করে নিতে পারে।ভীষন ভালো লাগলো নূরকে আরাবী’র।নূরের কথায় মিলি বললেন,

-‘ হ্যারে আরাবীর জন্যেও ভালো হলো।আচ্ছা নূর এক কাজ কর।তুই যা আরাবীকে নিয়ে আমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।’

-‘ ছোট মা,ওকে আগে আমি আমাদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবো তারপর বাগান। ঠিক আছে?’

-‘ আচ্ছা যা!’

নূর আরাবীকে নিয়ে চলে গেলো।এদিকে নূরের এমন আচড়নে বেশ বিরক্ত হলেন সাথি।এই মেয়েটা এমন চঞ্চল হলো কিভাবে যেখানে তিনি অনেক গম্ভীর।পুরোই বাবার মতো হয়েছে।মেয়েটার এই স্বভাবটা তিনি মোটেও পছন্দ করেন নাহ। এইভাবে হুটহাট অচেনা মানুষদের সাথে মেয়েটা তার এক দেখাতেই মিশে যায়।মিসেস সাথি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-‘ তা জিহাদ ভাইয়ের মেয়ে এখানে কেন থাকবে?আর শুনেছিলাম তো জিহাদ ভাই মারা গেছেন।তারপর আর এদের খোঁজ পাসনি।তো হঠাৎ এই মেয়ে কোথা থেকে আসলো?আর ওর পরিবার কোথায় যে এই মেয়ে এখানেই থাকবে?’

মিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

-‘ আসলে আপা হয়েছে কি…….! ‘

তারপর আস্তে আস্তে সবটা বললো মিলি সাথিকে।সব শুনে সাথি’র একটু খারাপ লাগলো আরাবীর জন্যে।পরক্ষনে আবার বললেন,

-‘ বেশ খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্যে।কিন্তু এখানে একেবারে থাকার কথাটা কেমন যেন লাগলো না? এইভাবে মানে?’

মিলি অবাক হলো সাথির কথায় বলেন,

-‘ কি বলো আপা।এই মেয়েটা আমার মেয়ের থেকে কম না।ওকে আমি অনেক স্নেহ করি।ও আমার কাছেই থাকবে।আর তাছাড়া এই অচেনা ঢাকা শহরে ও একা একা কিভাবে থাকবে আপা?’

সাথি উঠে দাড়ালেন।তারপর রুক্ষ কন্ঠে বলেন,

-‘ হুম। যা ভালো মনে করিস কর তুই ছোট।আমার যা বলার ছিলো আমি বললাম।বাকিটা তোদের মর্জি।আসি আমি।অনেক কাজ আছে। ‘

এই বলে গট গট পায়ে চলে গেলেন সাথি।মিলি আর মাহিন একে-অপরের দিকে করুনভাবে তাকালো।তারা বুঝলো সাথি’র আরাবীর এখানে থাকাটা মোটেও পছন্দ হয়নি তাদের।
————
নূর আরাবীকে নিয়ে ওদের বাড়ি পুরো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।কার রুম কোনটা সেটা বলছে।আর আরাবী সব দেখছে চুপচাপ।এতো সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখেও আরাবী ভীতরে কোনপ্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই।আসলে ওর জীবনে তো কোন রঙের ছোঁয়াই নেই।যেখানে ওর জীবনটাই সাদা কালা সেখানে এতো রঙিন চাকচমকপূর্ন জিনিস ওর কাছে কিছুই মনে হয়।এইগুলো দিয়ে ও কি করবে?ওর তো চাই একটা রঙ্গিন জীবন।যেখানে ও চারপাশ উপভোগ করবে মুগ্ধ হয়ে।মুক্তো পাখির মতো উড়ে বেড়াবে স্বাধীনভাবে।শান্তির শ্বাস নিবে ওই নির্মল প্রকৃতিতে।কিন্তু হায় আফসোস।চাইলেও যে সব আশা পূর্ণ হয়না।এদিকে নূর আরাবীর কোন সারাশব্দ না পেয়ে।আরাবীর কাধে হাত দিলো।তারপর মুখ লটকিয়ে বলে,

-‘ কি গো?তোমার কি কিছু ভালো লাগছে না?কথা বলছো না কেন?’

নূরের কথায় ধ্যান ভঙ্গ হয় আরাবী’র।তারপর হালকা হেসে বলে,

-‘ নাহ আমি শুনছি তো তোমার কথা।ভালো লাগছে।তুমি বলো?’

নূর খুশি মনে আরাবীর হাত টেনে নিয়ে গেলো একটা রুমের সামনে তারপর বলে,

-‘ এটা হলো আমার বড় ভাইয়ার রুম।ভাইয়ার রুমটা এই বাড়িতে সবচেয়ে বড় রুম।আর অনেক সুন্দরও।কিন্তু আমি তোমাকে ভীতরে নিয়ে দেখাতে পারছি না তার জন্যে দুঃখিত।কারন ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া কেউ ওর রুমে ঢুকতে পারে না।তাহলেই ভাইয়া রেগে যায়।ভাইয়াটা ভারি বজ্জাত আমাকেও ঢুকতে দেয়না।’

বলেই মুখ গুমড়া করে নিলো নূর।এদিকে আরাবী বিরসমুখে চাইলো রুমটার দরজার দিকে। এ কেমন লোক যে নিজের পরিবারের মানুষদেরও রুমে প্রবেশ করতে দেয়না।মনে হয় নিশ্চয়ই লোকটা অনেক বদরাগি।আরাবী নূরের গুমড়ো মুখ দেখে বলে,

-‘মন খারাপ করো না আপু।চলো আমরা বাগানে যাই।বাগানটা আমার ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করছে।সকালে দেখেছিলাম।অনেক ফুল গাছ আছে বাগানে।’

মুহূর্তেই নূরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।আরাবীকে নিয়ে চললো বাগানে।এদিকে বাগানে আসতেই আরাবীর মনটা ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো।এতো এতো ফুল গাছ।যে আরাবীর চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।মৃদ্যুমন্দ বাতাস বইছে।পাশেই কাঠগোলাপ গাছটা দেখে আনন্দে নেঁচে উঠলো আরাবীর মন।ছোট থেকেই কাঠগোলাপ ফুল ওর অনেক পছন্দ।কেন যেন কাঠগোলাপ ফুলগুলো দেখলো সেই ফুলের মাঝে এক স্নিগ্ধ ভালোবাসা খুঁজে পায় আরাবী।ঠিক এই স্নিগ্ধ শুভ্র ফুলগুলোর মতো।আরাবী আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো ফুলগুলো।তারপর মুখটা এগিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফুলের স্পর্শগুলো অনুভব করলো।দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে দিলো আরাবীর চুল।শুভ্রতায় লেপ্টে থাকা এই মানবীকে যেন মনে হলো কোন পরির রাজ্যের রাজকন্যা।হঠাৎ কিছু একটা আলো এসে লাগলো আরাবীর চোখে।প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।এই অন্ধকারের মাঝে একটুখানি আলোর ঝলকানিটা যেন খুব ভালোভাবে টের পেলো আরাবী।চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালো।কিন্তু না কিছুই দেখতে পেলো না ও।এদিকে হঠাৎ নূর এসে আরাবীর হাত টেনে ধরলো।ওকে নিয়ে বাড়ির মিহানদের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলছে,

-‘ আরে আব্বু,বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া এসে পরেছে অফিস থেকে।চলো চলো আমরা ঘরে যাই।তোমাকে আগে ছোট ভাইয়ার সামনে নিয়ে যাই।কারন ছোট ভাইয়ার সাথেই তো তোমার বন্ডিংটা ভালোছিলো ছোটবেলায় আমি শুনেছি।ভাইয়া প্রায় তোমার কথা বলতো আমাকে জানো।চলো ভাইয়া তোমাকে দেখলে চমকে যাবে।’

এদিকে নূরের কথা শুনতে শুনতে আরাবীও পুতুলের মতো নূরের পিছে পিছে চললো।

#চলবে_______
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।