বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-১০

0
540

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১০
দীর্ঘ নিকশ কালো আধার কাটিয়ে চোখ মেলে তাকায় আরাবী।জ্ঞান ফিরতেই সারা শরীরে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে ও।হঠাৎ সেই বিভৎস ঘটনার কথা মস্তিষ্ক স্মরন করতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো আরাবী।হৃৎপিন্ডটাকে মনে হচ্ছে কেউ শক্ত চাপের সাহায্যে গেলে ফেলবে একদম।চোখ দিয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।সাথে মুখ হতে বেড়িয়ে আসলো অস্পষ্ট গোঙ্গানির স্বর।ঠিক তখনি অস্থির এক কন্ঠস্বর কানে এসে লাগলো।

-‘ কি হয়েছে আরাবী?এখন কেমন আছিস তুই?কি হচ্ছে আমায় বল?কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’

আরাবী বহু কষ্টে তাকালো।ইফতিকে দেখে যেন কান্নাগুলো ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।আরাবী ইফতিকে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু শত চেষ্টা করেও গলা দিয়ে একটা টু শব্দও করতে পারলো না।বার কয়েক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো আরাবী।কন্ঠনালিতে অসহনীয় ব্যাথা অনুভব হলো।করুন চাহনী নিক্ষেপ করলো আরাবী ইফতির দিকে।ইফতি বোধহয় বুঝতে পারলো আরাবীর মনের ভাব।তাই ইফতি করুন গলায় বলে,

-‘ চিন্তা করিস না।দুই একদিনে তুই ঠিক হয়ে যাবি।তোর কন্ঠনালিতে প্রচন্ড চাপ লাগায় তুই দু তিনদিন কথা বলতে পারবি না। তবে এটা কিছুই না।আমি জানি তুই অনেক স্ট্রোং।এতো সহজে ভেঙ্গে পরবি না।ঠিকঠাকভাবে মেডিসিন খেলেই দ্রুত সেরে যাবি।’

আরাবীর কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না।শুধু মূর্তির মতো পরে রইলো বিছানায়।ইফতি চলে গেলো রুম থেকে।একটুপর হাতে করে খাবার নিয়ে আসলো আরাবীর জন্যে।গরম গরম স্যুপ।কয়েকদিন আরাবীকে স্যুপ খেয়েই কাটাতে হবে। কারন গলার ব্যাথা চিবানো যায় এমন কিছুই আরাবী খেতে পারবে নাহ। খাওয়ানো শেষে ইফতি আরাবীকে ওষুধ খাইয়ে দিলো।আরাবীকে নানানভাবে বুঝালো যে চিন্তার কিছু নেই আরাবী জলদি ঠিক হয়ে যাবে।এর মাঝে মিলি বার দুয়েক এসে দেখে গিয়েছে আরাবীকে।নয়টার দিকে ইফতি চলে গেলো। অফিসে যেতে হবে তাকে।মিলিকে ভালোভাবে আরাবীর খেয়াল রাখতে বললো।আরাবী সারাদিন সুয়ে সুয়েই কাটিয়ে দিলো।এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে ঘটনাটা ভাবলে।কি বিভৎস ছিলো সময়টা।কিন্তু ও তো গাড়ির সামনে রাস্তায় পরে গিয়েছিলো৷তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো এইজন্যে কিছু মনে নেই আরাবীর।কার থেকে জিজ্ঞেস করবে? কিভাবে ও এখানে আসলো?ও কি নিজেকে বাচাতে সক্ষম হয়েছে? নাকি? নাকি ওকে…। ভাবলো না আর আরাবী।কান্নায় ভেঙ্গে পরলো ভীতরে ভীতরে।সারাদিন একা একা কাটিয়ে দিলো আরাবী।বিকেলের দিকে নূর আসে আরাবীর কাছে।মেয়েটা কাল রাতে এতোই কান্না করেছে যে।সারারাত মাথা ব্যাথায় কাতরিয়েছে।ভোরের দিকে চোখ লেগে আসায় একঘুমে এইযে একটু আগেই উঠেছে।ফ্রেস হয়েই ছুটে চলে এসেছে আরাবীর কাছে।
নূর আরাবীকে বলে,

-‘ এখন কেমন লাগছে তোমার?’

আরাবী মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ভালো।আরাবী সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। আরাবীর দিকে তাকাতেই আরাবী ওকে ইশারা করে টেবিলের দিকে।বার বার সেদিকেই ইশারা করছে আরাবী।নূর বুঝতে না পেরে বলে,

-‘ কিছু লাগবে আরাবী?’

আরাবী হ্যা বুঝালো নূরকে।নূর উঠে টেবিলের কাছে গেলো।বই দেখালে আরাবী না বুঝালো।গাইড দেখালেও না বুঝালো।খাতে হাত দিয়ে দেখালেই হ্যা বুঝালো আরাবী।নূর এইবার বুঝতে পারলো আরাবী নূরকে খাতায় লিখার মাধ্যমে কিছু বলবে।দ্রুত একটা কলম নিয়ে এসে আরাবীর পাশে রাখলো।তারপর আরাবীকে উঠে বসতে সাহায্য করে।আরাবী খাতা আর কলমটা নিয়ে অনেক কষ্টে লিখলো।হাতগুলোও ছিলে গিয়েছে তাই লিখতে কষ্ট হচ্ছে।লিখা শেষে নূরের দিকে খাতাটা বাড়িয়ে দিলো।নূর লিখাটা পড়লো সেখানে লিখা,

‘ আমাকে বাড়িতে কে এনেছে? কে আমাকে হেল্প করেছে?বলতে পারো তুমি?’

নূর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।হ্যা জায়ানকে কাল রাত নূর জিজ্ঞেস করেছিলো আরাবীর সাথে কি হয়েছে।জায়ান প্রথমে বলতে না চাইছিলো না।এতে বেশ কয়েকবার ধমকও খেয়েছে নূর।তবে নূরের জোড়াজুড়িতে বলে দেয় নূরকে। তারপর নূর সবাইকে বলে দেয় যে আরাবীর সাথে কি হয়েছিলো।নূর শান্ত কন্ঠে এইবার আরাবীকে বলে,

-‘ তোকে ছেলেগুলো তারা করছিলো ধরার জন্যে।তখন তুই যখন দিগবেদিগ হারিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটা গাড়ির সামনে পরেছিলি। সেটা আর কারো না জায়ান ভাইয়ার গাড়ি ছিলো।জায়ান ভাইয়া ওতোগুলো ছেলের সাথে পারতো কোনভাবেই।এইজন্যেই ভাইয়া দ্রুত তোকে নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে।জায়ান ভাইয়াই তোকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছে।আর হ্যা কোন চিন্তা করিস না।তোর সাথে ওই বাজে লোকগুলো কিছু করতে পারেনি।জায়ান ভাইয়া তার আগেই তোকে সেফ করে নিয়ে এসেছে।’

আরাবীর চোখ দিয়ে পানি পরছে অঝোরে।জায়ানের প্রতি যেই চাপা একটা রাগ ছিলো তা যেন এক নিমিষে ধুয়ে মুছে ফেলে দিলো আরাবী।লোকটা যেমন হোক।তবে আরাবীর জন্যে যা করেছে আরাবী মরে গেলেও ভুলবে না কোনদিন।মনে মনে কয়েকশবার, কয়েক কোটিবার জায়ানকে ধন্যবাদ জানালো। লোকটা সময় মতো না আসলে কি হতো আরাবীর সাথে ভাবলেই মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে পরে।নূর আরাবীকে কাঁদতে দেখে আরাবীর চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।তারপর আরাবীকে বলে,

-‘ মুভি দেখবে আরাবী?’

আরাবী নূরের কথায় হাসলো মেয়েটা যে ওর মন ঘুরানোর জন্যে এই কথা বলছে তা বেশ বুঝতে পারলো আরাবী। তাই মাথা নাড়িয়ে বুঝালো হ্যা দেখবে।নূর এক দৌড়ে চলে গেলো রুম থেকে।তারপর অনেকক্ষন পর হাতে ল্যাপটপ নিয়ে হাজির হলো আরাবীর কাছে। আরাবীর পাশে বিছানায় বসে ল্যাপটপে ইউটিউব চালু করে বিভিন্ন মুভি সার্চ করে খুজতে লাগলো।কিন্তু ভালো কিছুই পাচ্ছে না।নূর বিরক্ত হয়ে বলে,

-‘ ছোটবাবার ল্যাপটপ এটা ইউটিউবে সব নিউজ চ্যানেলগুলো সাব্সক্রাইব করা।খালি নিউজ আর নিউজ আসে।একটু ভিন্ন কিছু দেখলেই তো পারে।মুভি না দেখে আমরা অন্যান্য কন্টেন্টগুলোও ইঞ্জয় করতে পারতাম।ধুরু!’

আরাবী হাসলো নূরের বাচ্চামো কথায়।নূর আবারও রিফ্রেস করলো ইউটিউব।সাথে সাথে লোড হয়ে একটা নিউজ চালু হয়ে গেলো।অটো প্লেয়ার চালু ছিলো।মানে ইউটিউবের নিউজফিডেই ভিডিও আপনা আপনি চালু হয়ে যায়।নূর ডিডিওটি বন্ধ করতে যেতে নিতেই আরাবী নূরের হাত খামছে ধরে ওকে আটকায়।আরাবী চোখ বড়বড় করে ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে আছে।সেখানে বলছে,

‘ এই প্রথম কোন আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।ক্রিমিনালরা নিজেরা এসেই পুলিশদের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করেছে।এতে গুলশানের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট প্রচন্ড অবাক হয়েছে।এই ক্রিমিনালরা পাঁচজন মেয়েকে গ্যাং রেপ করেছে আর অসংখ্য মেয়েদের ইভটিজিং করেছেন তা তারা নিজেরাই স্বিকার করেছেন।ক্রিমিনালগুলোর অবস্থা খুবই বাজে ছিলো।তাদের সারাশরীরে মারের দাগ। পুলিশ কর্মকর্তরা সবাইকে হাসপাতালে এডমিট করিয়ে দিয়েছেন। তাই এখন অব্দি আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।বিস্তারিত জানতে হলে সাথে থাকুন নিউজ টুয়েন্টি ফোরের সাথে।’

আরাবী স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।নড়াচড়া করতে যেন পুরো দমে ভুলে গিয়েছে।শ্বাসটাও গলায় আটকে।আরাবীকে এমন করতে দেখে নূর ঘাবড়ানো গলায় বললো,

-‘ কি হয়েছে আরাবী?এমন করছো কেন?’

আরাবী নূরের কথায় সম্ভিত ফিরে পায়।দ্রুত খাতা কলম হাতে নিয়ে আবার কিছু একটা লিখে নূরের দিকে বারিয়ে দেয়।সেখানে লিখা,

-‘ এই ছেলেগুলো সেই ছেলেরাই যারা কাল রাতে আমার সাথে উল্টাপাল্টা করার জন্যে আমাকে তাড়া করছিলো।’

নূর বেশ অবাক হলো লিখটা পড়ে।পরক্ষনে আরাবীকে শান্ত করতে বললো,

-‘ তা এতে এমন রিয়েকশন দেওয়ার কি হলো?ভালোই তো হয়েছে শয়তানগুলো ধরা পরেছে।হয়তো তোকে না পেয়ে অন্য কোন মেয়ের পিছনে গিয়েছিলো সেখান থেকে ক্যালানি খেয়ে ভয়ে নিজেরাই আত্মসমর্পণ করেছে।এটা তো খুশির সংবাদ।’

নূরের কথায় আরাবী আর কোন রিয়েকশন দিলো না।শুধু চুপচাপ নিজের মতো গভীর চিন্তায় আটকে রইলো।কে হতে পারে?কে এইভাবে ওই ছেলেগুলোকে মারলো?আর ছেলেগুলোই বা এইভাবে আত্মসমর্পণ করলো কেন পুলিশের কাছে?আর তখনই এসব হলো যখন ওর সাথে যেই ইন্সিডেন্টটা হলো।এর আগে কেন কেউ এসব ছেলেদের ধরতে পারলো নাহ?অনেকক্ষন ভাবলো আরাবী নিজ মনে ভেবেও কোন ক্লু পেলো না।তাই ওতোশতো চিন্তা বাদ দিলো।শয়তানগুলো শাস্তি পেয়েছে এটাই অনেক।আপাততো নূরের সাথে সময়টা উপভোগ করা যাক।

#চলবে____________

ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।