বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-৩৬+৩৭

0
438

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৬

অভয় অফিসে গিয়েছে অনেকক্ষণ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। ঐশানী হাতে ফোন নিয়ে বসে রয়েছে। অভয়কে দুপুরে কল দিয়েছিল সে। কিন্তু অভয় ফোন ধরেনি। একবার ঘড়ি দেখে ঐশানী আবারও অভয়কে কল করল। কিছুক্ষণ বাজতেই অভয় কলটা রিসিভড করে ওপাশ থেকে ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠে…..
–“হ্যালো, ঐশানী! আই এম সরি। মিটিং কনফারেন্স রুমে ছিলাম তোমার কল ধরতে পারিনি। সবে বের হলাম।”
–“না না। এতটুকুর জন্য সরি বলার কোনো দরকার নেই। বলছিলাম যে, আপনি কি খেয়েছেন নাকি শুধু কাজই করে চলেছেন?”

–“হ্যাঁ হালকা খেয়ে নিয়েছি। ঐশানী শোনো তোমায় একটা কথা বলার আছে।”
–“কি কথা?”
অন্তত উৎসাহের সঙ্গে বলে ঐশানী। অভয় ফিচেল গলায় বলে…..
–“খুব সিরিয়াস কথা!”
ঐশানীর চোখমুখও গম্ভীর হয়ে যায়। উৎসুক হয়ে বলে…..
–“কি কথা বলুন?”
–“বলব?”
–“আরে বলুন না!”
নিজের আগ্রহকে দমাতে না পেরে তড়িঘড়ি করে বলে ঐশানী। অভয় ফট করে বলে দেয়…..
–“আই লাভ ইউ।”

বলেই শব্দহীন হাসে অভয়। ওপাশ থেকে ঐশানীর বড়সড় দম ফেলার শব্দ পায় সে। হয়ত মেয়েটা অতিরিক্তই সিরিয়াস হয়ে পড়েছিল।
–“আপনি এটা বলার জন্য এতোক্ষণ আমাকে আগ্রহ নিয়ে রেখেছিলেন? টেনশনে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল জানেন?”
ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল ঐশানী। অভয়ের হাসির আওয়াজ শোনা গেল। অতঃপর সে উত্তর দিল…..
–“ওহ হো ঐশানী! কোথায় আমি এতো সুন্দর করে আই লাভ ইউ বললাম। তুমি আই লাভ ইউ টু বলবে। তা না করে আমাকে কথা শোনাচ্ছো। ইউ আর সো আনরোমান্টিক। (একটু থেমে) যত রোমান্টিক সব রাতেই দেখাও নাকি?”

–“আই লাভ ইউ টু!”
অদম্য উচ্ছাসের সঙ্গে বলে ফেলে ঐশানী। অভয় কাছে শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে সেই তিনটে শব্দ। চোখজোড়া মূহুর্তেই স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে সে বলে…..
–“আচ্ছা আমার বেবি হওয়ার পর তুমি কি ওর সামনেই আমাকে আই লাভ ইউ টু বলতে পারবে তো? নাকি আমাদের বেবির সামনেও একদম লজ্জায় এতোটাই মিইয়ে যাবে যে তোমায় দেখাও যাবে না?”
দুষ্টুমির সুরে প্রশ্নগুলো করে অভয়। তবে ওপাশ থেকে উত্তর আসে না। ওপাশটা সম্পূর্ণ নিরব। ঐশানী কি কল কেটে দিল? অভয় ফোনটা ভালোভাবে দেখে নেয়। সে কল কাটেনি। তবে কথা বলছে না কেন?

–“ঐশানী শুনতে পাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ বলুন। আসলে এখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
–“কিন্তু তোমার গলার সুর এমন লাগছে কেন?”
ঐশানী আমতা আমতা করে বলে…..
–“ঠিকই তো আছে। ওইযে বললাম নেটওয়ার্ক প্রবলেম। সেকারণে হয়ত এমন শোনাচ্ছে। আমি রাখছি হ্যাঁ?”
অভয় তাড়াহুড়ো করে বলে…..
–“ওয়েট ওয়েট। তোমায় কিছু জানানোর আছে আমার।”
–“হ্যাঁ বলুন।”

–“আজ আমার অনিন্দিতার কথা হয়েছিল সকালে। ও আমায় সায়রার সত্যিটা জানিয়েছে। সত্যি আমি এমন কিছু কল্পনাও করিনি। এটা তো আমি অস্বীকার করতে পারব না একসময় আমি ওকে পছন্দ করতাম। কিন্তু প্রথম থেকেই আমায় ঠকিয়ে আসছে। ও ওর বাবার কথায় আমার সাথে এক্টিং করেছে। শুধু তাই নয় ও বউ হয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে চেয়েছিল সবটা ধ্বংসই করতে। সায়রা কয়েকদিন ধরে আমার দেখা করবে বলে বিরক্ত করছে অনিকে। তাই আমি আজ ওর সাথে শেষবারের মতো বোঝাপড়া করতে যাব।”

ঐশানী বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সত্যিটা জেনে সেও অত্যন্ত বিস্ময়ে মাঝে পড়ে গিয়েছে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘যেই সম্পর্কের ভিত ছলনা দিয়ে তৈরি হয় সেই সম্পর্ক কি সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে?’
কিন্তু ঐশানীর মনে হয়েছিল সায়রা সত্যিই অভয়কে ভালোবাসে। ওর কান্না ঐশানীর কাছে এক মূহুর্তের জন্য মিথ্যে মনে হয়নি। তাহলে সত্যিটা কি?”
–“ঐশানী? শুনতে পাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ। আপনার কি ওর সাথে দেখা করতে না গেলেই নয়?”

–“তুমি কি আমাকে হারানোর ভয় পাচ্ছো?”
সন্দিহান হয়ে বলে অভয়। ঐশানীর নিরবতা তাকে বলে দেয় ঐশানীর উত্তর। অভয় আবারও বলে….
–“আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। আমি আমাদের ভবিষ্যত সুন্দর করার জন্যই আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভবিষ্যতে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির ছায়া যেন না পড়ে সেকারণেই ওর সাথে দেখা করতে চাই।”
সবটা শুনে অবশেষে ঐশানীও অভয়কে সম্মতি দিয়ে স্মিত হেসে বলল….
–“ঠিক আছে। রাখছি তাহলে। সাবধানে বাড়ি ফিরবেন।”
অভয়ের কথা শুনে ফোন কান থেকে নামিয়ে নেয় ঐশানী। ঘড়ির দিকে তাকায়। চারটা বেজে দশ মিনিট। আস্তে ধীরে উঠে আসে সে। নিজের খাতা এবং কলম নিয়ে বসে।

–“হ্যাঁ। আমি রেডি হয়ে নিয়েছি। আমি আসছি। তোরা ওখানে পৌঁছা। আমি জয়েন হয়ে নেব।”
ফোন কানে কোনোমতে ধরে হাতে চুড়ি পড়তে পড়তে বের হচ্ছে অনিন্দিতা। ফোন কানে রেখেই চিৎকার করে মিসেস. তনয়ার উদ্দেশ্যে বলেন…..
–“মা, আমি বাইরে বের হচ্ছি। বন্ধুদের সঙ্গে হাতিরঝিল যাব ঘুরতে। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসব।”
মিসেস. তনয়া বারান্দা থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে আসেন। তবে শুধু তিনি নন সিঁড়ি থেকে হম্বিতম্বি করে নামে ইশান। আজ ওর একটু তাড়াতাড়িই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই সুবাদে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে সে।

–“কিরে কোথায় যাচ্ছিস একা একা? ফুপি! তুমি ওকে একা ছাড়ো কেন? তুমি জানো বাইরে গিয়ে কতটা বদ হয়ে যাচ্ছে?”
ইশানের কথায় ফোন কেটে দিয়ে হালকা ভ্রু কুঁচকায় অনিন্দিতা। ছেলেটাকে মায়ের কান না ভাঙালেই নয়! কোন কুক্ষণে যে অনিন্দিতা ছেলেটার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায় অনিন্দিতা নিজেই জানে না। মিসেস. তনয়া রয়েসয়ে বললেন…..
–“হ্যাঁ রে অনি! ইশান আমাদের বাড়িতে আর কয়েকদিনই তো আছে। তারপর নিজে ফ্লাটে উঠে যাবে। কোম্পানি থেকে ওকে ফ্লাট দেওয়া হবে। যেই কয়দিন আছে তুইও ওকে নিজে সঙ্গে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।”

–“তা আমাকে নিয়ে যাবে কেন? আমি গেলে তো ওর প্রেমালাপের ব্যাঘাত ঘটবে না?”
মিসেস. তনয়ার কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে ইশান। তা শুনে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে মিসেস. তনয়া অনিন্দিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে…..
–“তুই প্রেম কবে থেকে করছিস? আমায় তো বলিসনি!”
–“আরে মা, ইশান ভাইয়া অযথা বাড়িয়ে বাড়িতে কথা বলে। আমি গেলাম।”
বলেই দ্রুত পায়ের ধাপ ফেলে বেরিয়ে আসে অনিন্দিতা। পেছন পেছন আসে ইশানও। সে রেডি হয়েই বেরিয়েছে।

ইশানের সঙ্গে হাতিরঝিল পৌঁছায় অনিন্দিতা। প্রথমে ইশানের কথাবার্তায় রাগ লাগলেও অনিন্দিতার মন ভালো হয়ে গেল সেখানে গিয়েই। প্রিয় মানুষ, ঝিলের পাশ দিয়ে হাঁটা, দমকা হাওয়া। আর কি লাগে? এর আগেও একবার এখানে এসেছিল অনিন্দিতা। কিন্তু এই অদ্ভুত আনন্দটা তখন হয়নি। প্রিয় মানুষটা পাশে থাকার কারণে জায়গাটা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। অনিন্দিতার খোলা চুল অগোছালো হয়ে এদিকসেদিক উড়ছে। পরনে তার হলুদ রঙের কামিজ সঙ্গে হলুদ ওড়না। হাতে হলুদ চুড়ি আর ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেশ। ইশান হাঁটতে হাঁটতে অনিন্দিতাকে পর্যবেক্ষণ করে ফেলল গভীরভাবে। মাঝে মাঝে বাতাসের তীব্র বেগে চোখের পাতা বন্ধ করছে আর খুলছে অনিন্দিতা। বিষয়টা ইশানের কাছে বেশ লাগল। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকল সেদিকে।

–“খোলা চুলে বের হলি কেন? যতই নায়িকার মতো সাজতে চাস। খোলা চুলে তোকে পেত্নীই লাগছে।”
ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে ইশান। অনিন্দিতার হেলদোল হয় না। সে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ইশান যা বলল সেটা মোটেও ঠিক নয়। সে শুধুমাত্র অনিন্দিতাকে ক্ষেপাতে কথাটি বলেছিল। কিন্তু মেয়েটার কোনো রিয়েকশনই নেই। ইশানের আজ ইচ্ছে জাগল অনিন্দিতার কানের পিঠে অবাধ্য চুলগুলোকে গুঁজে দিতে। ঢক গিলে নিজের ইচ্ছেকে দমন করে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল সে।

হাতে পার্স নিয়ে মিসেস. তনয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো ঐশানী। তার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে। মিসেস. তনয়া তখন রেনুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ঐশানীকে দেখতেই উনার মনে হলো সে কোথাও বের হবে। নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন….
–“কোথাও যাচ্ছো?”
ঐশানী শুকনো মুখে জবাব দিল…..
–“হ্যাঁ আম্মু। সামনে তো পরিক্ষা। তাই আমার একটা বান্ধবীর কাছে যাচ্ছি। সেদিন সব নোটস কালেক্ট করা হয়নি। আজ সেগুলো করতে হবে।”
–“তুমিও বাইরে যাচ্ছো? অনি আর ইশানও গেল। তুমি একা কি করে যাবে? মানে সেদিনের মতো যদি কোনো কান্ড হয়?”

–“না আম্মু। আর হবে না। তাছাড়া আমার ফোনে ফুল চার্জ দিয়ে নিয়েছি। টেনশন করো না। আমি সাবধানে যাব।”
–“কখন ফিরবে?”
প্রশ্নটা মিসেস. তনয়া করতেই থমকে গেল ঐশানী। ঢক গিলে বলল…..
–“খুব তাড়াতাড়ি ফিরব।”
–“ঠিক আছে যাও। আর লেট হলে অবশ্যই ফোন করে জানাবে।”
ঐশানী মাথা দুলায়। বাইরের দিকে যাওয়ার বদল সে মিসেস. তনয়ার দিকে এগিয়ে আসে। একটু নিচু হয়ে হঠাৎ করেই মিসেস. তনয়াকে জড়িয়ে ধরে।

আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে ওঠেন মিসেস. তনয়া। অপ্রস্তুত হয়ে এক হাত ঐশানীর পিঠে রেখে অন্য হাত ঐশানীর রেখে রেখে বুলিয়ে দেন উনি। ক্ষীণ সুরে বলেন….
–“কি হয়েছে তোমার?”
ঐশানী সরে আসে। কাঁচুমাচু হয়ে বলে…..
–“কিছু না। আসলে মাকে খুব মনে পড়ছে। আর তুমিও তো আমার আরেক মা। তাই তোমায় জড়িয়ে ধরে নিজের মায়ের কষ্ট টা নিবারণ করতে চাইছি।”
–“পাগলি মেয়ে একটা!”
ঐশানী উত্তরে হাসে। রেনুর দিকে এক পলক তাকিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

ঝিলের পাড়ে ঘাসে একমনে বসে ছিল অনিন্দিতা। তার এক হাত দূরে বসে আছে ইশান। তার দৃষ্টি পানির দিকে মগ্ন। বিকেলে সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় ঝিলের পানি চিকচিক করছে। হাওয়া মন ফুরফুরে করে দিচ্ছে। অনিন্দিতা আঁড়চোখে ইশানকে দেখছিল। সে আজ ভেবেছে ইশানকে নিজের মনের কথা বলবে। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না সে। মুখ থেকে কথায় বের হতে চাইছে না। বুকটা দুরুদুরু করছে তার। আচ্ছা ইশান ভাইয়াকে ভালোবাসি বললে তার রিয়েকশনটা কি হবে? টেনে থাপ্পড় মারবে না তো? ভেবেই ঢক গিলে অনিন্দিতা।

–“অনিন্দিতা তুমি এখানে?”
আচমকা পুরুষালী গলায় মাথা তুলে পাশে তাকায় অনিন্দিতা। সামনে একজন লম্বা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। মুখে অসাময়িক হাসি। অনিন্দিতা উঠে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে ইশানও উঠে দাঁড়ায়। কপাল তার কুঁচকানো। অনিন্দিতাও একটা হাসি দিয়ে বলে…..
–“কৌশিক আপনি? হোয়াট এ কোয়েন্সিডেন্স!”
–“ইয়াপ। কিন্তু তোমার ফ্রেন্ডদের দেখলাম ওইদিকে হাঁটতে। তুমি এখানে?”
হাত বাড়িয়ে দেয় কৌশিক। অনিন্দিতা হাত বাড়াতে গেলেই ইশান হুট করেই কৌশিকের সাথে হাত মিলিয়ে বলে…..
–“ও একা না। আমি আছি ওর সাথে। ওর কাজিন। ইশান।”

–“ওহ হো! নাইস টু মিট ইউ।” (হাত ছাড়িয়ে)
–“মি টু। অনি, ওইদিকে চল তো। অনেক লেট হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। অ্যান্ড বাই কৌশিক।”
বলেই ইশান অনিন্দিতার হাত ধরে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে আসে মেইন রাস্তার ধারে। অনিন্দিতা জোর গলায় বলে…..
–“এটা কি করছো? কৌশিক কি মনে করল?”
–“ও যা মনে করার করুক। তোর এতো ইচ্ছে কেন ওর সঙ্গে হাত মেলানোর? আর ও-ই বা কেমন তোর সামনে হাত বাড়িয়ে দেয়? যত্তসব টাচ করার ধান্দা।”
অনিন্দিতা অবাক হয়। মনের মাঝে একটা সূক্ষ্ম সন্দেহের বীজ জন্মে। ইশানের মাঝে উত্তেজনা আর রাগ দেখে সরু চোখে তাকায় সে।

–“রিল্যাক্স। এতো ওভার রিয়েক্ট করার কি আছে?
ও আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করুক তাতে তোমার কি?”
–“আমার কি মানে? আমার ছাড়া কার যাবে আসবে? অন্যকারোর যদি না যায় আসে তাহলে আমার যায়আসে। কারণ আমি…….”
রাগের বশে গড়গড় করে কথা বলতে বলতে নিজেকে সময়মতো সামলে নেয় ইশান। তবে অনিন্দিতা অনেক কিছুই বুঝেছে। চোখেমুখে আনন্দের উৎফুল্ল উতলে পড়ছে।
–“তুমি কি ইশান ভাইয়া?”
–“কিছু না।”

এই সময় ওদের পাশ দিয়ে একটা বাস শাঁই করে চলে গেল। সন্দেহের দৃষ্টিতে বাসের দিকে তাকায় ইশান। তা দেখে অনিন্দিতা বলে…..
–“কি হলো?”
–“আমার মনে হলো ঐশানী ভাবিকে বাসে দেখলাম।”
–“হোয়াট? ভাবি বাসে থাকবে কেন? তোমার চোখটা নির্ঘাত গেছে।”
ইশানও তাই ভাবে। ঐশানী কেন থাকবে বাসে? সে হয়ত ভুলই দেখেছে। অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে ওঠে…..
–“অনেক হয়েছে। বাড়ি চল।”
অনিন্দিতা বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে থাকে। আসল কথাটা তার শোনাই হলো না।

সন্ধ্যা হতে না হতেই বাড়ি ফিরল অভয়। ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই দুচোখ খুঁজল ঐশানীকে। কিন্তু সে হয়ত ড্রয়িংরুমে নেই। ড্রয়িংরুমে শুধু ইশানই আছে। তাও সোফায় বসে থেকে ফোনে গেম খেলতে মগ্ন। গলা খাঁকারি দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে সোফার পাশ কাটিয়ে যায় অভয়। গেম খেলতে খেলতেই ইশান তাকে খোঁচা মেরে বলে ওঠে…..
–“লাভ নেই। লাভ নেই। ঘরেও তোর বউ নেই। ঘরে রোমান্স করার লোভে তাড়াতাড়ি ঢুকছিস তো?”
ইশানের লাগামছাড়া কথাবার্তারই ভয় করছিল অভয়।
–“তুইইই…..”
–“হ্যাঁ আমি। তোর বউ বাইরে গেছে নোটস কালেক্ট করতে। এখনো আসেনি। ফুপিকে বলে দিয়েছে লেট হবে আসতে।”

অভয় ঘড়ি দেখে। সন্ধ্যার যা আলো ছিল তাও নিভে গেছে। ঘড়ির কাটা প্রায় সাতটা ছুঁইছুঁই। দ্রুত ঘরের উদ্দেশ্য চলে আসে অভয়। নিজের পোশাক খুলে ফোনটা বের করে ঐশানীকে কল লাগাতেই ফোন বন্ধ পায়। বিরক্তির শব্দ করে পানির গ্লাস হাতায় সে। গ্লাসের বদলে হাতে চলে আসে একটা কাগজ। ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে কাগজের ভাঁজ খুলে ফেলে। কাগজের মাঝে গুটিগুটি লিখাগুলো জ্বলজ্বল করছে। অভয় পড়তে শুরু করে।

–“প্রিয় আপনি……
আমিও ছিলাম আপনার ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম। লোকে বলে, দ্বিতীয়বার ভালোবাসার অনুভূতি জন্মানো অসম্ভব। আমিও তাই মানতাম। কিন্তু আমার কাছে তা সম্ভব হয়ে গেল। সায়ানকে আমি ভালোবাসি। তবে ও আমার স্মৃতির পাতা। আপনি হঠাৎ করেই হয়ে উঠলেন আমার জীবনের সঙ্গী। আমি খুব খুশি ছিলাম। আপনার প্রতি আমার এই অনুভূতিটা আমার অনেক পুরোনো। বিয়ের পরপরই এই অনুভূতি অনুভব করি আমি। কিন্তু তাকে পাত্তা দিইনি। যেদিন জানলাম আপনিও আমায় ভালোবাসেন সেদিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম তবে মেনে নিতে পারিনি। নিজের দোষের কথা ভুলতে পারিনি। আমি প্রথম থেকে চাইতাম আপনাকে এই কথাগুলো বলতে কিন্তু পারিনি। আজ বলতেই হচ্ছে আমায়। আপনার আর আমার ভালোবাসার কোনো পরিণতি নেই অভয়। আমি কখনো আপনাকে পূর্ণতা দিতে পারব না। আমি অক্ষম। আমি মা হতে পারব না কোনোদিন।”

এতটুকু পড়ে থমকে যায় অভয়। ঘামতে শুরু করে সে। ও কি স্বপ্ন দেখছে? অনুভূতিহীন চোখে আবারও কাগজে চোখ বুলায়।
–“আপনি বলেছিলেন, আমি রহস্যময়ী। আসলেই তাই। আমার জীবনের এতো বড় কথা কেউ জানে না একমাত্র সীঁথি ছাড়া। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আপনার সঙ্গে একটা ছোট্ট পৃথিবী সাজানোর। যেখানে আপনি, আমি আর আমাদের সন্তান থাকবে। কিন্তু সেটা অসম্ভব। আর মা না হতে পারা আমার কাছে একটা বড় অপমান ও বোঝা। আপনার চোখে এইকারণে দিনদিন ছোট হয়ে যেতে পারব না আমি। সেদিন মনে আছে? নোটস কালেক্ট করার বাহানায় আমি অনেক দেরি করে ফিরেছিলাম? আসলে আমি নোটস কালেক্ট করতে যাইনি। আমি ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম। যদি কোনো উপায় পাওয়া যায় মা হওয়ার? কিন্তু আমি সত্যিই ব্যর্থ একটা স্ত্রী হিসেবে। এই অপূর্ণতা নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াতে পারব না আর। আমি গতকাল আপনার ল্যাপটপে বাসের টিকিট বুক করেছিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি এটা কেউ জানবে না। আপনিও না। গতকাল আপনার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারিনি। ভেবেছিলাম সেই ভালোবাসাময় মূহুর্তের স্মৃতিটা আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবো। পারলে আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন। অন্তত পূর্ণতা পাবেন। সায়রা আপনাকে হয়ত সত্যিই ভালোবাসে। তাকেও সুযোগ দিয়ে দেখতে পারেন। আর একটা কথা অনিন্দিতা ইশানকে ভালোবাসে। এটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। ওদের মিলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। আর হ্যাঁ, আমাকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করবেন না। ভালো থাকবেন।

ইতি
আপনার ব্যর্থ স্ত্রী।”

অভয়ের হাত থেকে চিঠিটা পড়ে যায়। মূর্তির মতো বসে থাকে সে। নিজের হাতজোড়া দেখে নেয়। এই হাতজোড়া দিয়ে সে ঐশানীকে কি কখনো ছুঁতে পারবে না?

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৭

বেশ কিছুক্ষণ ধরে স্তব্ধ হয়ে ফ্লোরের দিকে একমনে চেয়ে আছে অভয়। ঐশানীর এভাবে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাওয়া এবং ঐশানীর এতো বড় গোপন সত্যিটা জানার পর সে এতোটাই স্তম্ভিত এবং ব্যথিত যে সে নড়াচড়া করার ক্ষমতা কিছুক্ষণের জন্য হারিয়েছে। তার যন্ত্রণায় ভরা চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ভালোবাসা পেয়েও হারানো এর থেকে যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি যেন আর হয় না। অভয়ের চোখে দেখা যাচ্ছে অশ্রু। কতটা অসহায় এবং তীব্র ব্যথিত হলে একটা পুরুষের চোখেও অশ্রুর দেখা মেলে? কিন্তু অশ্রু চোখেই রয়ে গেল। নিচে তা গড়িয়ে পড়তে দিল না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতেই তার মনে হয় ঐশানী তার বাড়িতে যায়নি তো? সে নিজের মনকে আশ্বাস দেয় যে, ঐশানী নিশ্চয় নিজের বাড়িতেই গিয়ে থাকবে। আর অভয় গিয়ে তাকে বকতে বকতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।

এতটুকু আশা পেতেই সে নড়াচড়া করে ফোনটা হাতে নেয়। ঐশীকে কল করবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোনের লক খুলতেই তার রিংটোন বেজে ওঠে। অভয় যাকে কল করতে চাইছিল সে নিজে থেকে তাকে কল করছে। ঐশীর কল রিসিভ করে তড়িঘড়ি করে কানে ধরে অভয় বলে ওঠে…..
–“হ্যালো, ঐশী? বলছিলাম যে ঐশানী তো……”
কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ঐশী কথা বলা শুরু করে। তার কন্ঠে রাজ্যের অস্থিরতা।
–“ভাইয়া আপু কি আপনার বাসায় আছে? জানেন? আপু আমাকে আর বাবাকে কি সব উল্টাপাল্টা মেসেজ করেছে।

–“ঐশানী ওই বাড়িতে যায়নি?”
হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল অভয়। ঐশী উত্তেজনা নিয়ে উত্তর দেয়…..
–“না। ও কি তাহলে সত্যিই কোথাও চলে গেল?”
–“কি লিখেছে ও মেসেজে?”
–“লিখেছে যে, ও সবার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তার খোঁজ যেন কেউ না করে। কেন যাচ্ছে, কি কারণে যাচ্ছে সব নাকি আপনি জানেন। ও বেশিকিছু বিস্তারিত লিখেনি। আর আমাকে সকলের খেয়াল রাখতে বলেছে। আচ্ছা, আপুর সঙ্গে কি আপনার কোনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হয়েছে?”

ঐশীর আর কোনো কথা অভয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। ওর মন শুধুমাত্র ঐশানীকে চাইছে নিজের চোখের সামনে। ওপরদিকে ঐশী হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছে। একসময় অভয়ের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। সেভাবেই বসে থাকে অভয়। ঠোঁটজোড়া বিরবির করতে থাকে একই নামে। তা হলো ঐশানী।
–“কোথায় গেল ঐশানী? কোথায় গেল? কেন চলে গেল আমায় এতো ভালোবাসা দিয়ে? কোথায় গেল?”
গলা ধরে আসছে অভয়ের। তবে তার এভাবে বসে থাকলে চলবে না। ঐশানীকে খুঁজতে হবে। মনটা এখনো কোথাও বলে চলেছে যে ঐশানী নিশ্চয় তার কাছে ফিরবে। সে মজা করছে।

রোবটের মতো উঠে দাঁড়ায় সে। এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ড্রয়িংরুমে আড্ডার আসর বসেছে। রাহাত সাহেব, ইশান ও অনিন্দিতা মিলে ক্যারাম খেলছে মজা করে। মিসেস. তনয়া তা বসে বসে দেখছে। ক্যারামের গুটি নিশানা করতে করতে অভয়কে শুকনো মুখে নিচে নেমে আসতে দেখতে পান রাহাত সাহেব। একগাল হেসে উনি বলেন…..
–“হেই মাই সন, সারাদিন কাজ অনেক করলি। আয় খেলতে বস। অনেকদিন তোর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় না।”
–“বাবা, তুমি চিটিং করো। সেকারণেই ভাইয়া তোমার সাথে খেলতে চায় না।”

ফিক করে হেসে বলে অনিন্দিতা। অভয় কারো কথায় তোয়াক্কা না করে সামনে এসে দাঁড়ায়। মিসেস. তনয়া অভয়কে পর্যবেক্ষণ করে বলেন…..
–“কিরে? কিছু হয়েছে? দেখে তো মনে হচ্ছে এখনো ফ্রেশও হসনি। এতোক্ষণ হয়েছে অফিস থেকে এসেছিস। এখনো ফ্রেশ হসনি কেন?”
–“মা ঐশানী কোথায় জানো?”
থেমে থেমে কথাগুলো বলে অভয়। মিসেস. তনয়া সাধারণ ভঙ্গিতে বলেন…..
–“হ্যাঁ। ওর বান্ধবীর বাড়িতে। মেয়েটার সামনে পরিক্ষা। একে তো এমন সময় ওর বিয়ে হলো পড়াশোনা করার চান্সই পাচ্ছে না। তাই থাক নিজের মনমতো….”

–“ও আর কখনো আসবে না মা। চলে গেছে। সব ছেড়ে চলে গেছে।”
হঠাৎ চিৎকার করে কথাটা বলে উঠল অভয়। সকলেই তার চিৎকারে কেঁপে উঠল। সেই সঙ্গে বিস্ময়ের সীমিনা রইল না কারো। অনিন্দিতা ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়। অভয়ের সামনে বরাবর দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল…..
–“কি বলছিস ভাইয়া? ভাবি চলে গেছে? কোথায় গেছে?”
অভয় কিছু না বলে তার হাতে থাকা দুমড়ানো মোচড়ানো ঐশানীর চিঠি অনিন্দিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। আর কোনো রকমের শব্দ না করেই কারো কোনোরকম কথা না শুনে হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

রাতের বাতাস বড্ড জোরালো। গাড়ি নিয়ে এক নির্জন রাস্তায় মনে আছে অভয়। সে বসে আছে গাড়ির ওপরে। চেষ্টা করছে যদি এই বিষাদ ভরা মন থেকে একটু হলেও বিষাদ কমিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এই বিষাদ কমানোর জন্য সেই বিষাদ ভরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিতেই প্রয়োজন তার। সে হলো ঐশানী। ফোনের স্ক্রিনে বারবার জ্বলে উঠে তার। অনিন্দিতা বার বার ফোন দিয়ে চলেছে। একসময় ফোনটা পা দিয়ে লাথি মেরে ফেলে দেয় সে। বিষাদ মাখা কন্ঠে অভয় বলে ওঠে…..

–“ভালোবাসা! ভালোবাসা শব্দটাই যত নষ্টের মূল। না আমি ঐশানীকে ভালোবাসতাম আর না এভাবে আমায় ঠকতে হতো। ঐশানী ঠকিয়েছে আমায়। ভালোই ছিলাম ভালোবাসা ছাড়া। ঐশানীকে ভালোবাসা বড্ড ভুল হয়েছে আমার। আজ যদি ওকে ভালো না বেসে থাকতাম ও কোথাও চলে গেলেও আমার কিচ্ছু যায় আসতো না। বাট আনফরচুনেটলি আই লাভ ঐশানী।”

দিন পাল্টেছে। সময় পাল্টেছে। নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। নতুন দিন, নতুন মানুষের হারিয়ে গেছে আগের সময়। শুধু অপরিবর্তিত রয়ে গেছে ভালোবাসা, সেই ভালোবাসা মানুষগুলো।

জায়গাটি চট্টগ্রাম। একটি সুন্দরতম শহর। সকাল হতে না হতেই শুরু হয়েছে নানানরকম মানুষের আনাগোনা। শহরের একপ্রান্তে রয়েছে একটা এপার্টমেন্টে ব্যস্ত হয়ে ছুটছে এক নারী। খোলা চুলগুলোও তাকে শান্তি দিচ্ছে না। জানালার পর্দা মেলে না দেওয়ায় ঘরটাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে। তড়িঘড়ি করে পর্দা টেনে দিয়ে জানালা খুলে দিতেই চোখমুখ কুঁচকে যায় তার। হঠাৎই তার ডাক আসে।
–“ঐশানী! একটু ওষুধটা দিয়ে যা। খাওয়ার আগে খেতে হবে।”
পিছু ফিরে তাকায় ঐশানী। ব্যস্ত পায়ে ছুট লাগায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে ঔষুধ দিতে।

কানের পিঠে চুল গুঁজে ঔষুধের বক্স ও পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ঐশানী রমিলা বেগমকে।
–“এই নাও আন্টি। তাড়াতাড়ি করো। কাল রাতে দেরি করে ঘুমানোতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে। জানি না আজ স্কুলে টাইমলি পৌঁছাতে পারব নাকি!”
–“রয়েসয়ে কাজ কর। নিজেকে ব্যস্ত রেখে কি প্রমাণ করতে চাস তুই? তুই খুব ভালো আছিস?”
–“কেন ভালো না থাকার কি আছে?”

–“আমার বয়স হয়েছে। তাই বলে এতোটাও চোখের দৃষ্টি লোপ পায়নি যে কিছু দেখতে পাবো না। তোর বরকে মনে পড়ে না?”
ঐশানী থমকে তাকায়। মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে….
–“আন্টি, তুমি এই এক কথা বলে আসছো পুরো দুই বছর ধরে। দুই বছর মানে (একটু ভেবে) সাতশো সত্তর দিন একই কথা জিজ্ঞেসা করো। প্রতিদিন একই কথা শুনিয়ে কি পাও বলো তো?”
–“প্রতিদিন করি কারণ কোনোদিনই তোর কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাই না। পেলে আর করতাম না।”
–“তুমি ঔষুধ খাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

বলেই উঠে যায় রান্নাঘরের দিকে ঐশানী। রমিলা বেগম জানেন ঐশানী প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতেই চলে গেল। মেয়েটা বাহানা বানাতে খুব ভালো পারে। গত দুইবছর ধরে ঐশানী রমিলা বেগমের সঙ্গে থাকেন। রমিলা বেগম হচ্ছেন সীঁথির মা। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে একাই থাকতে হয় উনাকে। তাই সীঁথিকে বলে ঐশানী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উনার সঙ্গেই থাকবে। ঐশানী এখন কাজও করে। একটা প্রাইমারি স্কুলে ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ায়। সামান্য টাকা বেতন পেলেও সে ওটাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু আদোও স্বামী নামক মানুষটা হুট করেই কড়া নাড়ে তার মনের গভীরে।

প্লেটে খাবার নিয়ে ক্যালেন্ডারের দিকে নজর যায় ওর। আজ প্রায় দুইমাস হয়ে গেল পরিবারের সঙ্গে কথা বলেনি সে। ঐশানী প্রতি দুইমাস পর পর তার বাড়িতে কল করে। তাও সর্বোচ্চ তিন মিনিটের ওপরে কথা বলে না। প্রতিমাসে বিভিন্ন নম্বর ওবিভিন্ন জায়গা থেকে কল করে। আজ সে ঠিক করে স্কুল থেকে ফেরার পথে সে বাড়িতে কল করবে। এই ভেবে তাড়াতাড়ি রমিলা বেগমকে খাবার এগিয়ে দিয়ে কোনোমতে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

–“মিস্টার চৌধুরী, আপনি কি জানেন আমি কতক্ষণ ধরে এখানে ওয়েট করছি? আপনারা টাইম মেইনটেইন করতে পারেন না তাহলে ডিল করতে আসেন কেন? আপনি পুরো সাতচল্লিশ মিনিট লেট। আর এমন লোকদের সাথে আমি ডিল করব না। সরি।”
বলেই উঠে পড়ে চকলেট কালার কোট পরিহিত অভয়। মুখে তার গম্ভীরতা ও রাগের ছাপ স্পষ্ট। সে রেস্টুরেন্টে এসেছিল ডিল করতে অন্য এক কোম্পানির সাথে। কিন্তু কোম্পানির মালিক এতোটাই দেরি করে উপস্থিত হন সে রেগে ডিল টাই ক্যান্সেল করে দেয় অভয়।

–“মিস্টার খান! প্লিজ এই সামান্য কারণে এতো বড় ডিল ক্যান্সেল করবেন না। আপনি বসুন না।”
মিস্টার চৌধুরীর কথায় অভয় কোনোরকম তোয়াক্কা না করে বলে…..
–“এক্সকিউজ মি!”
কোটের পকেটে থাকা সানগ্লাস চোখে পরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া জন্য পা বাড়ায় অভয়। পাশে অভয়ের পিএ রনিত মিস্টার চৌধুরীর উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে…..
–“আগেই আপনাকে পারসোনালি জানিয়ে দিয়েছিলাম না? যে স্যার একটুও এদিক-ওদিক হলেই সব সর্বনাশ হয়ে যাবে। কেন যে দেরিতে আসতে গেলেন? আপনাদের লাক খারাপ।”
ভেজা বিড়ালের মতো রনিতও বেরিয়ে যায় অভয়ের পিছু পিছু।

দুইবছর আগের অভয় আর বর্তমান অভয়ের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সে আমেরিকা থাকতে যেমন ছিল গম্ভীর, হাসিবিহীন ঠিক তেমনটাই হয়ে গিয়েছে। দিনে একশটা কথা বলে কিনা সন্দেহ। দরকার ছাড়া একটা কথাও তার মুখ থেকে বের করানো সম্ভব না। মুখভর্তি দাঁড়ি আর সবসময় শুকনো মুখে থাকে সে। এতোকিছুর পরেও তার মনে এখনো একজনের নামেরই বিচরণ সে হচ্ছে ঐশানী। এমন কোনোদিন নেই যে ও ঐশানীকে খুঁজেনি। সময় পেলেই জায়গায় জায়গায় ঐশানীকে খুঁজতে উঠেপড়ে লেগে পড়ে সে। দিনশেষে রেজাল্ট জিরো!!

–“এক ভয়ঙ্কর জাদু আমার ওপর করলে। তবে জাদুর প্রভাব না কাটিয়েই চলে গেলে। এ তোমার কেমন বিচার ঐশানী? এই জাদুর প্রভাব কি কোনোদিনও কাটবে না? কখনো না?”
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বিরহ নিয়ে ধীর গলায় বলে অভয়। সে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। আর কোনো কাজ নেই তার। ডিলও ক্যান্সেল হয়ে গেছে। বাড়িতে ফেরায় শ্রেয়।
বাড়িতে ফিরে সদর দরজায় পা রাখতে না রাখতেই রাহাত সাহেবের তিক্ততায় ভরা গলায় শুনতে পায় অভয়। যদিও সে জানতো তার বাবার গলায় প্রথমে শোনা যাবে।

–“এই হতচ্ছাড়া! তুই কি করে এলি? ডিলটা ক্যান্সেল করে দিয়ে আসলি?”
–“তোমায় কে বলল বাবা?”
পায়ের বোট জুতো খুলতে খুলতে বলল অভয়। রাহাত সাহেব তেতে ওঠেন।
–“কে বলল মানে? মিস্টার চৌধুরী আমায় ফোন দিয়ে নিজে যেতে বলেছেন। আমার শরীর ভালো নেই বলে তুই যা ইচ্ছে করবি নাকি? কেন করলি এই ডিল ক্যান্সেল?”
–“যারা টাইমকে রেসপেক্ট দেয় না। দেরিতে আসাটাকে ছোট ব্যাপার বলে মনে করে তাদের সঙ্গে ডিল করলে লসই হবে বাবা। টেনশন নিও না। ওরা গেছে আরো ইনভেস্টার আসবে।”

রাহাত সাহেবের আর কোনো কথায় না শুনে নিজের মনে চলে গেল অভয়।
ফ্রেশ হয়ে সবেমাত্র এসে জানালার পাশের বড় চেয়ারে সে বসেছে ওমনি কেউ ওর চোখজোড়া ধরে ফেলল। অভয় গম্ভীর গলায় বলল…..
–“অনি! এটা কেমন মজা?”
অনিন্দিতা মুখটা গোমড়া করে অভয়ের চোখ ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
–“মজা তো পেলামই না।”
–“তুই এলি কখন?”

–“এই যখন শুনেছে তোর বোন ঐশীর বিয়ে হবে তখন থেকে উঠেপড়ে লেগেছে বিয়েতে যাবে তাও তোকে সাথে করে নিয়ে। ওকে কতবার করে বললাম, দিবাস্বপ্ন দেখো না। তোমার ভাই যাবে না। কিন্তু তোর বোন শুনলে তো?”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা খোঁচা মেরে বলে ওঠে ইশান। অনিন্দিতা ইশানকে দেখিয়ে ভেংচি কাটে। অনিন্দিতার পরনে লেমন কালার শাড়ি। নাকফুল চকচক করছে। বিবাহিত বিবাহিত নারীর সকল বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। তার আর ইশানের বিয়ের প্রায় এক বছর হয়ে এসেছে। অভয় নিজ দায়িত্বে তাদের মিলিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে অনিন্দিতা আর ইশান সুখেই রয়েছে। ইশানের প্রমোশন হয়েছে। অনেকদূর এগিয়েছে সে।

–“এই ভাইয়া? ঐশীর বিয়ে। আমাদের ইনভাইট করেছে। তোকে কল করার সাহস পায়নি। কিন্তু পুরো পরিবারকে যেতে বলেছে। যাবি তো?”
বায়না ধরা কন্ঠে বলে ওঠে অনিন্দিতা। অভয় সোজাসুজি উত্তর দেয়….
–“না যাব না। গিয়ে কি করব? ওই বাড়ির তো আমি কেউ না। আর শোরগোল আমার পছন্দ না জানিস না?”
–“কেন যাবি না? ভাইয়া ভুলে যাস না তুই এখনো ওই বাড়ির জামাই।”
অভয় ওকে উত্তর না দিয়ে ইশানকে বলে ওঠে…..
–“ইশান? তোর বউকে সামলা।”
–“একবছরেও সামলাতে পারব না আর এক মিনিটে সামলাবো? এতো ক্ষমতা আমার নাই ভাই। তুই-ই সামলা।”
অনিন্দিতার অতিরিক্ত জেদের কাছে অভয় হার মানতে রাজি হয়। তবে শুধু বিয়ের দিনই সে উপস্থিত থাকবে।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে ঐশানী। গাড়ি থেকে নেমে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে সে। ফোনটা বের করে ঐশীর নম্বর ডায়াল করে কল করে সে। কল যেন সাথে সাথেই রিসিভ হয়।
–“হ্যালো হ্যালো হ্যালো। আপু বলছিস? ঠিক ধরেছি না?”
–“বাবাহ ঐশী? ফোনটা কি ধরেই বসে থাকিস সবসময়?”
–“আমি জানতাম তুই কয়েকদিনের মধ্যে কল করবি। তাই ফোনের আশায় বসে থাকতাম।”
ঐশানীর বড্ড ভালো লাগে ঐশীর কথাটা। তার বোন কত মিস করে তাকে। সে কিছু বলার আগে ঐশী ফট করে বলে…..
–“আপু আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার পেন্সিল মার্কা বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেটা জানিস?”

–“হ্যাঁ। তা তো জানি। দুইমাস আগেই মা তো বলেছিল।”
–“তুই এবার অন্তত বাড়ি আসবি তো আমার বিয়েতে?”
ঐশানীর হাসি গায়েব হয়ে যায়। সে কি করে যাবে?তবে নিজের বোনের বিয়েও তো ইগনর করা যায় না। সে গলা খাঁকারি দিতেই ঐশী উত্তেজিত হয়ে বলে…..
–“প্লিজ আর কোনো বাহানা করিস না। তুই কোথায় আছিস আমরা কেউ জানি না। তুই সেলফিশ হতেই পারিস। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছে তুই আমার বিয়ের ইভেন্টে আমার সাথে থাকবি।”
–“কিন্তু….. ”

–“কোনো কিন্তু না! আমার বিয়েতে না এলে ধরে নেব তুই আমাকে আর নিজের মনে করিস না। সারাজীবনের মতো আমায় বোন হিসেবে হারাবি।”
ঐশানী তবুও আমতা আমতা করতে থাকে। অবশেষে বোনের আবদার ফেলতে পারে না সে। সম্মতি দিয়ে বসে বিয়েতে যাওয়ার। ঐশী তা শুনে আনন্দে আত্মহারা! ঐশানীর ইচ্ছে করল জানতে অভয়ও কি সেখানে যাবে? সংকোচ বোধ করে বলেই ফেলল…..
–“এই শোন? তোর বিয়েতে কি উনিও যাবেন?”
–“উনি আবার কে? তুই এলেই হলো। কি উনি উনি করছিস?”
–“কেউ না। মাকে ফোন দে।
মিসেস. দিশার সাথে একটু কথা বলে কল কেটে দেয় ঐশানী। আনমনে ভাবে, তার পরিবার কি এতো তাড়াতাড়ি অভয়কে ভুলে গেল? অথচ কিছুদিন আগেও ঐশী তাকে বলতো ফিরে এসে অভয়ের সাথে সংসার করতে। এখন আবার তাদের কি হলো??

চলবে……