বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
825

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (প্রথমাংশ)

–“কিন্তু আমি তো ভরসা পাচ্ছি না মিস. ঐশানী। আগের বারের মতো আবার আমায় ছেড়ে চলে গেলে নিজেকে সামলানো বড় কষ্টকর হয়ে যাবে। এতো বড় রিস্ক নিতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
অভয়ের কথায় ঠোঁটজোড়া উল্টে অসহায় চোখে তাকায় ঐশানী। অভয়ের হাতজোড়া নিজের হাতে কোমলভাবে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে…..
–“আপনিও তো বুঝুন আমার সিচুয়েশন টা। আমি বুঝতে পারিনি আপনাকে কোন মুখে এতো বড় সত্যি বলব। উত্তেজিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর তার জন্য আমি মুহূর্তে মূহুর্তে ভুগতে থাকি।”
–“তাহলে ফিরে আসতে কি হয়েছিল?”

–“এই ভেবে আসিনি যে আপনি হয়ত আমায় ভুলে….”
পুরোটা না বলেই থেমে যায় ঐশানী। পিটপিট করে তাকায় অভয়ের দিকে। অভয় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
–“আমি তোমাকে ভুলে গেছি এই ভেবেই আসোনি তাই তো? আমি তো জানতাম ভালোবাসার মানে তুমি জানো ঐশানী! কিন্তু তুমি তা জানো না। ভালোবাসা প্রিয় মানুষকে ভুলতে যাওয়া শেখায় না। ভালোবাসা প্রিয় মানুষকে নিজের মাঝে খুঁজতে শেখায়।”
–“আই এম সরি!”
অনুতপ্ত হয়ে বলে ঐশানী। অভয় কি বলবে ভেবে পায় না। এতোকিছুর জন্য সরি? জাস্ট সরি? এটা মানতে পারছে না সে।

ঐশানী দেখে অভয় অন্যদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। ঐশানী মিনমিনিয়ে বলে…..
–“আপনি আমায় বিয়ে করবেন তো?”
–“ভেবে দেখব।”
ঐশানী এবার রেগে যায়। কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্র কুঁচকে চেঁচিয়ে বলে…..
–“আপনি আমায় বিয়ে করবেন না? তো কাকে করবেন? সায়রাকে? হ্যাঁ? ওকে করবেন বিয়ে? কালকেও দেখেছি আপনাদের হেসে কথা বলতে। সায়রাকে বিয়ে করবে….”
কথার মাঝখানে ঐশানীকে এতো জোরে কথা বলতে দেখে মুখটা চেপে ধরে অভয়। এতো জোরে কেউ কথা বলে?

–“এই এই চুপ! এতো চিল্লিয়ে কথা বলে নাকি? তাও আবার সায়রার সঙ্গে আমাকে জুড়ে দিচ্ছো! ওর সঙ্গে আমার কোনো লেনাদেনা নেই।”
ঐশানী শুধু ‘উম…উম…’ শব্দ করে চলেছে আর অভয়ের হাত নিজের মুখের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। অভয় ঐশানীর বড় বড় চোখ সহ পা থেকে মাথা পর্যন্ত সূক্ষ্ম চাহনি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিল। ঘোর লাগানো কন্ঠে বলল…..
–“লুকিং গর্জিয়াস…! আমার পছন্দ এতোটাও খারাপ না। কি বলো? নাকি তুমি মানুষটাই এমন সবেতেই মুগ্ধতাময়ী দেখায়?”
–“আরে ঐশু! কি করছিস এখানে? ঘর থেকে বের হতে মানা করলাম না?”
মেয়েলি গলায় অভয় ঐশানীকে ছেড়ে দুইহাত দূরে ছিটকে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হালকা কাশে।

ঐশানী বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে রিনির দিকে তাকায়। রিনি একবার ঐশানী আরেকবার অভয়ের দিকে তাকায়। বোধহয় সে একেবারেই ভুল সময়ে এসে পড়েছে। কি বলা উচিত তাও বুঝতে পারছে না। হাসতে চেয়েও যখন হাসি এলো না পাশ কাটিয়ে দিয়া গিয়ে ঐশানীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বলল…..
–“বিয়ের আগে নিজেদের সঙ্গে এতো পারসোনাল কথা কীসের? পারসোনাল কথা, পারসোনাল কাজ সব বাসর ঘরে হবে। চল এখন।”
ঐশানী দিয়ার সঙ্গে চলতে চলতে ভাবুক হয়ে উঠল। দিয়ার কথাবার্তায় পরিষ্কার বিয়েটা অভয় আর ঐশানীর হবে। মাথাটা একপাক চক্কর দিয়ে ওঠে তার। তাহলে কিছুক্ষণ আগে অভয় যা ভয় দেখালো তা কি ছিল? ঐশানী পেছন ফিরে তাকায়। অভয় বুকে হাত রেখে স্মিত হেসে দাঁড়িয়ে আছে। ঐশানীকে পেছন ঘুরতে দেখে চোখ টিপ দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ঢক গিলে ঘাড় সোজা করল ঐশানী। কি সাংঘাতিক লোক….!‌

ঘরে পায়চারি করছে ঐশানী। তা দেখে ঐশী হাতে বিরিয়ানির প্লেট হাতে নিয়ে এক চামুচ করে মুখে দিচ্ছে আর বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে বোনের দিকে। খাওয়ায় মূল উদ্দেশ্য হলো সে জনসম্মুখে খেতে পারবে না। তার চেয়ে আগেই একটু খেয়ে নাওয়া ভালো। কিন্তু ঐশানীর পায়চারি আর অস্থিরতা তাকে ভাবিয়ে তুলছে।
–“আপু? তোকে না আমার ঠিক সুবিধের লাগছে না।”
–“কেন রে? আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি? যে আমাকে সুবিধের লাগছে না?” (তেতিয়ে)

–“তুই ঠিক তখনই এভাবে পায়চারি করিস যখন তোর মাথায় গন্ডগোলের বাত্তি জ্বলতে থাকে।”
–“গন্ডগোল তো তুই শুরু করেছিলিস। করিসনি? আমার আবার বিয়ে দেওয়ার প্লানিং অভয়ের সাথে তুই করেছিস? ঠিক বলছি না?”
ঐশীকে কটাক্ষ করে বলে ঐশানী। ঐশী খাওয়া বাদ দিয়ে শুকনো ঢক গিলে তাকায়। তার আপু সব ধরে ফেলল? এখন কি বিয়ের দিনে তার ওপর ঠাটিয়ে থাপ্পড় পড়বে? প্লেট সাইডে রেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে ঐশানীর কাঁধ ধরে মিষ্টি করে বলে….
–“ও আপু, রাগ করিস না প্লিজ। আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো জাস্ট ভাইয়াকে বলেছিলাম তোর একটা ইচ্ছে আছে সেটা হলো তোর আর আমার বিয়ে একই দিনে করার ইচ্ছে।”

–“ওহ তুই এটাও বলে দিয়েছিস?” (ঝাঁঝালো কন্ঠে)
–“আমি কি করব? তুই তো ভাইয়ার অবস্থা দেখিসনি। আমি দেখেছি। সবাই দেখেছে। তুই ভাইয়াকে পাগল বানিয়ে রেখে গিয়েছিলি। আর তুইও তো ভালো ছিলি না। আমি সত্যি বলছি তো?”
ঐশানী নিরব হয়ে গেল। কারণ ঐশীর কথাগুলো ঠিক। সেও ভালো ছিল না। এখনও ভালো নেই। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে চোখের সামনে থেকে, নিজের হয়েও নিজের না হওয়ার যন্ত্রণা অনেকটা! ঐশী বলে ওঠে….
–“তুই জানিস আমি ঠিক বলছি। তাই চুপ করে আছিস। তুই যদি সত্যিই চলে যেতে চাস আমরা আর কেউ তোকে আটকাবো না। কিন্তু ভাইয়া সহ ওই বাড়ির প্রত্যেকে এখনো তোকে চায়। এখন বাকি সিদ্ধান্ত তোর।”

–“বড্ড পাকনামি শিখেছিস ঐশী!”
শান্ত সুরে বলে ঐশানী। ঐশী একটু হেসে বড়দের মতো করে বলে…..
–“যদি নিজের বোনের সংসার বাঁচাতে এতোটুকু করতে হয় আমি করতে রাজি। তুই আমার বড় বোন। আমার দ্বিতীয় মায়ের মতো। তোকে কষ্টে দেখতে পারা অসম্ভব আমার কাছে।”
ঐশানীর চোখে অশ্রু চলেই আসে। তার বোনটাকেও কত বোঝে তাকে। বোনেরা তো এমনই হয়!

বাইরে থেকে হট্টগোলের আওয়াজ আসে। বর এসেছে। ঐশানী তা শুনে বিদ্রুপ করে বলে….
–“কিরে ঐশী? তোর বফ মানে বর্তমানে হবু বর কি এখনো পেন্সিলের মতো আছে নাকি একটু হলেও পরিবর্তন ঘটেছে।”
–“এই আপু দেখ আমার বরকে পেন্সিল মোটেই বলবি না। ওর ওজন ৬৩ কেজি।”
–“তুই কি করে জানলি?”
–“তুই এতো পেন্সিল, পেন্সিল বকিস তাই শুনে নিয়েছি।”
ঐশানী হেহে করে হেসে দেয়। ঐশী মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকে।

আকাশে অর্ধচাঁদ দেখা যাচ্ছে। ঐশীকে কিছুক্ষণ আগেই ঘরে দিয়ে গেছে ওর ননদ। সকলের ভীড়ে থেকে থেকে গরমে হাঁপিয়ে গেছিল সে। ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে হালকা আলো টিমটিম করছে। ঐশী গরমের চোটে মাথার ওপর থেকে কাপড় ফেলে দিল।
–“কি গরম!! জানালাটাও লাগিয়ে রেখেছে।”
বলেই উঠে যায় জানালা খুলতে। জানালা খুলে দাঁড়াতেই দমকা হাওয়া উপভোগ করে সে।

–“গরম লাগছে বুঝি?”
পুরুষের গলা শুনে হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকায় ঐশী। রিত্তিক দরজা লাগিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে এসে ঐশীর গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ঐশী মাথা নাড়ায়। রিত্তিক চুপ করে থাকে। ঐশীও বলার মতো কিছু পাচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক পর ঐশী গলা খাঁকারি দিয়ে বলে….
–“চুপ করে আছো যে?”
–“আসলে জীবনের প্রথম বাসর রাত তো একটু নার্ভাস লাগছে।”
কথাটি বলে নিজেই বোকা বনে গেল রিত্তিক। ঐশীর রিয়েকশন দেখার জন্য ওর দিকে তাকাতেই ঐশীর বড় বড় চোখজোড়া দেখে ভড়কে গেল সে। ও ঐশীকে বেশ ভালোভাবে চেনে। মেয়েটা দিনে আগে একশবার ব্রেকআপ ব্রেকআপ বলে চেঁচাত।

–“এই তুমি কি বললে? প্রথম বাসর রাত? এর মানে কি? তুমি এরপর কি আরো বাসর রাত করার প্লানিং নিয়ে বসে আছো?”
–“এমা না না। আমি আসলে সেভাবে বলতে চাইনি।”
–“তুমি সেভাবেই বলতে চেয়েছো। আজ থেকে তোমার সাথে আমার ব্রেকআপ।”
রিত্তিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে দিয়ে বলে….
–“তুমি একরকমই রয়ে গেলে। আমাদের বিয়ে হয়েছে ঐশী। ব্রেকআপ বললেও লাভ হবে না। বলে নাও যত পারো।”

রিত্তিক এসে বসে পড়ে খাটে বালিশ নিয়ে। ঐশীর রাগমাখা মুখ দেখতে বেশ মজা পাচ্ছে সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে দৃষ্টিপাত করছে লাল বেনারসি ও গয়না পরিহিত নিজের স্ত্রী এর দিকে। ঐশীও কড়া চোখে রিত্তিক কে দেখে চলেছে। রিত্তিক গোল্ডেন শেরওয়ানী পড়েছে। তার ওপর লাল রঙের ভারি কাজ করা। রিত্তিক নজরকাড়া সুন্দর নয়। তবে দেখতে ফর্সা, নাক খাঁড়া। শরীরের গঠন চিকন তবে খুব বেশি চিকন নয়। যেমনটা সে তেমনটাই তাকে মানায়। ঐশীর রাগ পড়ে যাচ্ছে রিত্তিক কে দেখে। নিজের রাগ বজায় রেখে সে ধুপধাপ শব্দ করে এসে রিত্তিকের সামনে দাঁড়ায়।

–“ব্রেকআপ হবে না। ডিভোর্স তো হবে। যাও তোমার সাথে ডি….”
ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রাখতেই থেমে যায় ঐশী। রিত্তিক মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে…..
–“ইয়েস। এরপরেও বাসর রাত করার প্লানিং ভেবে রেখেছি আমি।”
ঐশী রেগে লাল হয়ে যায়। কিছু বলতে উদ্যত হতেই রিত্তিক আবারও বলে ওঠে…..
–“কিন্তু তোমার সাথে…।”
প্রথমে রাগে ঐশীর চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করলেও বর্তমানে লজ্জায় গোলাপী বর্ণ ধারণ করছে ঐশী। তবে চোখে রিত্তিকের জন্য অজস্র ভালোবাসা। এতো বছরেও তার প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি। তারা আজ নিজের অন্য জীবন শুরু করবে। ভালোবাসা শুরু হবে ভিন্ন আঙ্গিকে।

মিসেস. তনয়ার সামনে বসে আছে ঐশানী। মিসেস. তনয়ার মুখটা ভার। উনি ভীষণই অসন্তুষ্ট ঐশানীর ওপরে। মেয়েটাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছিলেন অথচ মেয়েটা তার ছেলেকে রেখে চলে গেল। তাই উনার অভিমানের রেশ কাটেনি। বড় শ্বাস নিয়ে উনি ঐশানীর উদ্দেশ্যে বললেন…..
–“আমি জানতাম না আমার ছেলে আবার তোমায় বিয়ে করে আনবে। তাই বিশেষভাবে আয়োজন করতে পারিনি। কিছু মনে করো না।”
ঐশানী কিছু না মনে একধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে। অভয় সোফার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এককথায়, সবটা শুনেও না শোনার ভান করছে। সেটা খেয়াল করলেন রাহাত সাহেব। তাকে ধমক দিয়ে বললেন….

–“এইযে আমার হতভাগা ছেলে! আগে জানাবি না তুই আবার বিয়ে করতে চলেছিস? তাহলে আরেকবার অনুষ্ঠান করতাম। তোকে তো আর বিয়েতে বাঁধা দিতাম না। যা করিস সব একা একা। খুব বড় হয়ে গেছিস না?”
–“এতো আয়োজন করে কি হবে বাবা? তোমার বউমার নজর লেগে যাবে। তাছাড়া আগের বার যা ভীড় ছিল বউ দেখার জন্য। এবারও একই কান্ড করতে চাইনি।”
ফোনের দিকেই মগ্ন হয়ে বলল অভয়। রাহাত সাহেব আর কিছু বললেন না। ঐশানীর দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বললেন…..

–“দেখো ঐশানী মা, তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কিন্তু এই বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়নি। তোমায় আমি আরেক মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। এখনো তোমায় মেয়ের মতোই মানি। আশা করছি আর এমন কিছু করবে না। তোমার সমস্যার জন্য আমরা কেউ বিভ্রান্ত নই। আজকাল তো অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চা এডাপট করে নেওয়া হয়। এর অনেক সমাধান ছিল। শুধু শুধু জীবনের দুটো বছর নষ্ট করলে তুমি।”

ঐশানীর ভীষণ খারাপ লাগে। এবার বুঝতে পারছে সে ভীষণ বড় ভুল করে ফেলেছে। এমনটা করা তার সাজে নি। মাথা নুইয়ে সে বলল….
–“আমি দুঃখিত বাবা। আর আম্মু!”
কথাটা বলেই মিসেস. তনয়ার বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে হাতটা চেপে ধরে ঐশানী। অনুনয়ের সাথে বলে…..
–“আম্মু, তুমি তো আমাকে অনিন্দিতার মতোই ভাবো তাই না? তাহলে ভেবে নাও যে তোমার মেয়ে একটা ভুল করেছে। ক্ষমা করে দাও এবারের মতো। আমি আর কখনো তোমাদের ছেড়ে যাব না।”

মিসেস. তনয়া বেশিক্ষণ মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারেন না। তাকিয়ে ফেলেন ঐশানীর দিকে। ওর মতো মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা যায় নাকি? চাপা সুরে বলে….
–“ঠিক আছে। মনে থাকে যেন। এবারের মতো মাফ করে দিচ্ছি। পরের বার এসব কথা মাথায় আনলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। মনে থাকবে?”
ঐশানী ছলছল চোখে তাকিয়ে হেসে মাথায় দুলায়। তখনই সিঁড়ি থেকে ছুটে নেমে আসে অনিন্দিতা। ঐশানীর হাতে ধরে ঐশানীকে তুলে বলে…..
–“অনেক বলেছে ভাবি তোমাদের সাথে কথা। আরে এভাবে কথা বলতে থাকলে তো রাত পার হয়ে যাবে। গতবারের কথা মনে আছে তোমাদের? ভাবি আর ভাইয়াকে বের করে দিয়েছিলে।”

রাহাত সাহেব আর মিসেস. তনয়া হেসে দেন। অনিন্দিতা ঐশানী কাঁধ জড়িয়ে বলে…..
–“আর ভাবি আমারও রাগ নেই তোমার ওপর। তুমি আবার এই বাড়ি এসেছো শুনে সব রাগ ভ্যানিশ। এখন চলো দেখি ওপরে চলো।”
ঐশানীকে ধরে ওপরের ঘরে নিয়ে যায় অনিন্দিতা।

দীর্ঘ দুই বছর পর নিজের ঘরে ঢুকতেই ঐশানী সেই চেনা গন্ধ উপলব্ধি করতে পারে। সেই মানুষটার গন্ধ পুরো রুম জুড়ে থাকে সেই মানুষটাকেও এই রুমে উপলব্ধি করতে পারে। ঘরের আশপাশটা দেখে নেয় সে। সবটা আগের মতোই আছে। কোনোকিছু পাল্টাইনি। আচমকা ইশানের গলা শুনে ঐশানী চমকে পেছন ফিরে তাকায়। ইশানকে অনিন্দিতা টেনেহিঁচড়ে বের করছে খাটের নিচ থেকে।
–“উফফ…..অনি ছাড়ো বলছি। আমার সব প্লান ফ্লপ করে দিলে। প্রথম বাসর রাতে কানটা খারাপ হয়েছিল এই বাসর রাতে অন্তত কিছু রোমান্টিক কথোপকথন শুনতে পেতাম। তুমি তা হতে দিলে না।”

–“তোমার অন্যের ঘরে কান পাতার স্বভাব গেল না। বের হও বলছি।”
ইশানের মুখ হয় দেখার মতো। নিচ থেকে বেরিয়ে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। অনিন্দিতা তাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যায়। ইশান ফিসফিসিয়ে বলে….
–“অন্যের রোমান্স সিন তো দেখতে পারলাম না। নিজেই রোমান্স করি আর দেখি। কি বলো?”
অনিন্দিতা ইশানের বুকে কিল দিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বলে…..
–“তুমি একটা যা তা!!”

ঐশানী এসে বেডে বসে। বেডে দুটো বালিশ রাখা। বামদিকে ঐশানী ঘুমাতো। তার মুখে হাসি ফোটে। দরজা বন্ধ করার শব্দে গুটিশুটি মেরে যায় সে।
–“পুরোনো স্মৃতি মনে করছো বুঝি?”
–“ওই আরকি!”
অভয় আর কিছু বলে না। এসে ঐশানীর সামনে দাঁড়াতেই ঐশানীও দাঁড়িয়ে পড়ে। অভয়ের চোখজোড়া লাল। আজ সকল রাগে-অভিমান ঐশানীর ওপর ঝাড়বে সে। এতোদিন একটু একটু করে নিজের সবটা মনের মাঝে রেখে দিয়েছে।

ঐশানী মাথা নিচু করে নখ কাটতে থাকে। তারপর হন্তদন্ত হয়ে কিছু বলতে নিতেই অভয় হাত মুখের ওপর হাত রাখে। গম্ভীর গলায় বলে…..
–“উঁহু না। দুই বছর আগে তুমি চিঠিতে শুধু বলেছো। আমি পড়েছি। আজ আমি বলব তুমি শুনবে। কোনো কথা বলবে না। নো মোর ওয়ার্ডস।”
ঐশানী উৎসুক হয়ে চেয়ে থাকে। অভয় তার মুখ থেকে তার সরিয়ে তার বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে…..
–“তোমার কি মনে হয় ঐশানী? আমি পরিণতি, ফলাফল দেখে তোমায় ভালোবেসেছি?”
একটু থেমেই সে আবার বলে….
–“না ঐশানী। আমি লাভ-ক্ষতি দেখে তোমায় ভালোবাসিনি। ভালোবাসায় কেউ ফলাফল দেখে ভালোবাসে না। তাকে ভালোবাসা বলে না। তুমি আমার সাথে অন্যায় করেছো।”

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
শেষ পর্ব (শেষাংশ)

–“আই এম সরি।”
একদমে বলে ফেলল ঐশানী। অভয় ধমক দিয়ে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে বলল….
–“তোমায় চুপ করে থাকতে বলেছি। কথা বলছো কেন? আর কি সরি সরি লাগিয়ে রেখেছো? সরি কি ব্যাথার ট্যাবলেট?”
–“আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি যে আপনি এতোটা ভেঙ্গে পড়বেন আমায় ছাড়া। অন্য সব স্ত্রী এর মতো আমিও চেয়েছিলাম আমার স্বামী পরিপূর্ণতা। কিন্তু আমি তো তা দিতে পারতাম না তাই….!”
কথাটা বলে থেমে গেল ঐশানী। মাথাটা নুইয়ে ফেলল।

–“আমি তোমাতেই পরিপূর্ণতা পাই ঐশানী!”
ঐশানীকে দুটো হাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিজের মাঝে আবদ্ধ করল অভয়। ঐশানীর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কানে বাজতে লাগল অভয়ের মোহময় কন্ঠে বলা সেই কথাটা। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই অভয় ঐশানীকে ছেড়ে দেয় বেশ রুডলি ভাবে। একরকম ধাক্কা দিয়ে বেডে বসিয়ে দেয়। কড়া গলায় বলে উঠলে……
–“কিন্তু তুমি তা বুঝলে না। নিজের সমস্যা নিজের মাঝে চেপে রাখলে আর চলে গেলে ওই চট্টগ্রাম। আরে আমায় একবার মুখ ফুটে বলতে পারতে। একটা না একটা সলিউশন বের করে নিতাম। দূরে চলে যাওয়া কোনো সমাধান? আমার লাইফটাকে প্রাণহীন, রঙহীন করে হারিয়ে গেলে।”

ঐশানী চুপচাপ হাত মুঠো করে সোজা হয়ে বসে থেকে অভয়ের কথা শুনতেই থাকল। অভয়ের তিক্ত ব্যবহারগুলো স্বাভাবিক। কেননা সে খুব বড় আঘাত পেয়েছে ঐশানী তা ভালো করেই জানে। কিন্তু আচমকা তার মনে হয় অভয় কি করে জানল সে চট্টগ্রাম ছিল? চট করে অভয়ের দিকে কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে বসে…..
–“আপনি কি করে জানলেন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম?”
–“আমায় কি মনে তোমার? আমার স্ত্রী কোথায় এই সামান্য খবর আমি লাগাতে পারব না? তার মধ্যে তুমি দেশেই ছিলে। তোমায় খোঁজা তো আমার কাছে পানির মতো সহজ ছিল। এই দুই বছর তুমি চট্টগ্রামের একটা ছোট শহরে গোল্ডেন এপার্টমেন্টে থাকতে।”

ঐশানী বিস্ময়ের চোটে চোখের পলক ফেলা বন্ধ করে দেয়। অভয় একবার তার দিকে তাকিয়ে ঐশানীর পরের প্রশ্ন কি হতে পারে বুঝে ফেলে। সে নিজ থেকে বলে…..
–“তুমি যখন ঢাকা থেকে বিদায় নাও তখন আমি তোমার প্রতি এতোটাই রাগান্বিত ছিলাম যে তোমার খোঁজ আমিও নেয়নি। তোমায় সর্বদা মনে মনে ঘৃণার করার চেষ্টায় থাকতাম। ‘ভালোবাসা’ শব্দটাকেও ঘৃণা করতাম। প্রায় আট মাস আমি এভাবেই কাটিয়ে দিই। একদিন হঠাৎ চট্টগ্রামে ডিল করতে যেতে হয় আমার। সেই শহরে যেখানে তুমি থাকো। সেইসময় স্কুলে যাচ্ছিল একটি বাচ্চা। বেশ ছোট ছিল। রাস্তা পার হতে পারছিল না। তোমার হয়ত মনে আছে। তুমি হঠাৎ আসো। তাকে রাস্তা পার করিয়ে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে যাও।”

ঐশানী স্পষ্ট মনে করতে থাকে ঘটনাটি। হ্যাঁ তার মনে আছে। তৎক্ষনাৎ অদম্য আগ্রহের সাথে বলে…..
–“তাহলে আসেন নি কেন দেখা করতে?”
–“তোমার পিছু আমি তখনই নিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি স্কুল পর্যন্ত আসি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারিনি। পরে গাড়িতেই তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু স্কুল থেকে যখন তুমি বের হও তখন অন্য ছেলের সাথে বের হয়েছিলে। আমি তবুও তোমার পিছু নিই। সামনে যাইনি কারণ তোমার প্রতি রাগটা আমি তখনও পুষে রেখেছিলাম। কিন্তু তোমার পিছুও ছাড়তে পারছিলাম না। মাঝরাস্তায় তোমরা হারিয়ে যাও। তোমাদের খুঁজে পাইনি।”

বলেই থেমে যায় অভয়। ঐশানী হকচকিয়ে বলে…..
–“আন্টি সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেই খবরটা আমি পাই। আমি একা কিছু করতে পারব না তাই রাহিদ ভাইকে নিয়ে গেছিলাম।”
–“আন্টি মিনস রমিলা আন্টি?”
অভয়ের মুখে রমিলা বেগমের নাম শুনে মুখটা হয় হয়ে গেল। লোকটা যেন একের পর এক কারেন্টের শখ দিয়ে চলেছে।
–“আপনি আন্টির কথাও জানেন? কি করে?”

–“সিম্পল! সেদিন যখন তোমায় খুঁজে পাই না তোমার স্কুলে যাই। কিন্তু প্রিন্সিপাল তোমার ডিটেইলস দিতে রাজি ছিলেন না। ব্যর্থ হয়ে আমাকে ঢাকায় ফিরতে হয়। তবে হাল ছাড়িনি। তোমার খোঁজ পেতেই আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম কিন্তু তোমার সামনে যেতে নয়। এরই মাঝে ঐশী আমায় জানায় তুমি নাকি মাঝে মাঝে ওকে ফোন করো। আমি সকল নম্বর নিই। লোকেশন চেক করি। তারপর জানতে পারি তোমার ফ্রেন্ড সীঁথির আসল গ্রামের বাড়ি সেখানে ছিল। ওর নম্বর যোগার করে ওকে কল করি। ও তো রাজিই ছিল না তোমার ঠিকানা বলতে। শেষমেশ যখন জানলো যে আমি তোমার জন্য কতটা ডেস্পারেট আর তুমি আমায় ছেড়ে এভাবে চলে গেছো ও আমায় বলে তোমার কথা। আর রমিলা আন্টির সঙ্গে তো আমার এক বছর ধরে যোগাযোগ। তোমার খবরাখবর তো উনিই দেন।”

ঐশানীর ঠোঁটজোড়া আরো প্রসারিত হলো। হা হয়ে গেল। এটা তো এক কথায় ষড়যন্ত্র! এতোদিন এসব চলছিল তার পেছনে? অথচ সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি? এবার সে মেলাতে পারছে রমিলা বেগমের কথায় কথায় অভয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনার ব্যাপারটা।
–“এভাবে ঠোঁটজোড়া হা করিয়ে রেখো না। ঠোঁট যেন আমায় ডাকে ছুঁইয়ে দিতে।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করে অন্যদিকে ফিরে বসল ঐশানী। মনে মনে বলল…’অসভ্যতা আগের মতোই আছে। এক ইঞ্চিও কমেনি।’

–“একটা কথা বলো! আমি যদি ঐশীকে বলিয়ে তোমায় এখানে না ডাকতাম তাহলে কি তুমি কখনো আমার কাছে ফিরতে?”
ঐশানীর হৃদয়ে গিয়ে লাগে কথাগুলো। অভয়ের ভারাক্রান্ত গলার সুর। সে কষ্টের আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়েছে এই দুইবছর। ঐশানী ঢক গিলে বলল….
–“হয়ত আসতাম।”
–“মিথ্যে। তুমি আসতে না। আমার যে তোমায় ছাড়া চলে না। সেকারণে শেষমেশ আমাকেই তোমায় টানতে হলো। তুমি তো আমার কথা ভাবোও না। ভাবলে এতোটা দিন দূরে থাকতে না।”

কয়েক সেকেন্ড থেমে অভয় আবারও অন্তত ধীর গলায় বলে….
–“তুমি আদোও কখনো ভালোবেসেছিলে ঐশানী?”
অভয়ের এমন ভয়ঙ্কর প্রসঙ্গে ঘুরে তাকায় ঐশানী। অবশেষে কিনা ভালোবাসার ওপর প্রশ্ন উঠল? ওঠা টা অস্বাভাবিক কিছু না। অস্ফুটস্বরে ঐশানী বলল….
–“অভয়…!”
–“এখন কি অযুহাত দেবে তুমি?”
ঐশানী দাঁড়িয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। তবুও কান্নারা বেরিয়ে আসছে। চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ে যাচ্ছে। সে কান্নারত সুরে বলে…..

–“আপনাকে আমি এতোটাই ভালোবেসেছি যে সায়ানের প্রতি আমার ভালোবাসাও ফিকে পড়ে যাবে। সায়ানকেও আমি এতোটা ভালোবাসিনি যতটা আপনাকে বেসেছি। আপনাকে যেমন ভালোবেসেছি ঠিক তেমনই এই পরিবারকেও আমি ভালোবাসি। আমি কখনো চাইনি আমার এই সন্তাম না হওয়ার সমস্যার কারণে আমার পরিবার আর আপনি অপমানিত হন। মেয়েদের কাছে সন্তান না হওয়ার সমস্যা সব থেকে বড় সমস্যা। যার কারণে শুধু তাকে না তার সঙ্গে জনিত সকলকে অপমান সহ্য করতে হয়। আর এই অভিশপ্ত জীবন আমি আপনাদের দিতে চাইনি। তাই আমি চলে গেছিলাম। এতে আমার ভুল আছে। কিন্তু এতোটাও ভুল নেই।”

ঐশানী কান্না আর কথা শুনে অভয় দুর্বল হয়ে পড়ে। রাগ তৎক্ষনাৎ মোমের মতো গলে যায়। ঐশানীর এক ফোঁটা অশ্রু তার ভেতরটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে ঐশানীর কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় সে। ঐশানীর থুঁতনি ধরে মুখ ওপরে তুলে নিজের অন্যহাত দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। আচমকা নিজের ঠোঁট দিয়ে ঐশানীর ঠোঁটজোড়া আলতো করে ছুঁইয়ে দেয়। কোমল সুরে বলে…..
–“তোমার ভুল এখানেই যে তুমি কাউকে নিজের সমস্যার কথা বলো নি। কে করবে আমাদের অপমান? চুলোয় যাক সেসব অপমান। আমি শুধু তোমায় চাই ঐশানী। শুধু তোমায়ই চাই।”

ঐশানী তবুও ফোঁপাতে থাকে। অভয় তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। প্রশ্ন করে…..
–“কি সমস্যা রয়েছে তোমার মাঝে যার কারণে আমরা বেবি নিতে পারব না?”
–“এন্ড্রোমেন্ট্রোসিস্টের কারণে মা হতে পারব না আমি।”
–“তাতে সমস্যা কি? তোমার ট্রিটমেন্ট হবে। এই দেশে না হলে অন্য দেশে হবে। তাও যদি না হয় আমরা বাচ্চা এডাপড করব। এতোগুলো উপায় ছিল। কিন্তু তুমি চলে গেলে। দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেল।”

–“তার জন্য সরি বলছি তো আমি। আই এম সরি। আই এম রিয়েলি সরি।”
অভয় গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের ভাবভঙ্গি গম্ভীর করে বলে…..
–“জাস্ট সরি? এটা দিয়ে কি হবে?”
–“তো? কি করতে পারি আপনার জন্য?”
অসহায় নয়নে চেয়ে বলে ঐশানী। অভয় একটু ভেবে একরোখা মনোভাব নিয়ে বলে…..
–“দুটো জিনিস লাগবে আমার। দেন আই উইল এক্সেপ্ট ইউর সরি।”
–“কি বলুন?”

ঐশানীর দুটো কাঁধে সটান করে দুটো হাত রেখে অভয় ভ্রু কুঁচকে বলে…..
–“আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়া তো দূর আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববেও না। আর তোমার জীবনে যত সমস্যা আসুক না কেন! আমাকে সবটা বলবে। কখনো একটা শব্দও আমার কাছে লুকাবে না।”
ঐশানী স্মিত হেসে হাত দুটো অভয়ের পিঠে রেখে বুকে মাথা গুঁজে বলে…..
–“এই ভুল আমি কখনো করব না। আর আমি নিজের মনের কোনো কথা আপনার কাছে লুকাবো না।”

অভয় ঐশানীকে উঠিয়ে ওর হাতটা নিজের বুকের বাম পাশে দিয়ে বলে…..
–“আমাকে ছুঁয়ে বলো!”
ঐশানী হেসে দেয় অভয়ের এমন কান্ডে। তবুও হাসি হাসি মুখে বলে…..
–“আপনাকে ছুঁয়ে বলছি আমি আপনার থেকে দূরে হওয়ার কথা ভাববোও না। আমি নিজে আমার জীবন সম্পর্কে কিছু জানার আগে সেটা আপনি জানবেন।”
অভয় আশ্বস্ত হয়। ঐশানী কপাল কুঁচকে বলে…..
–“আর দ্বিতীয় জিনিস কি?”
–“আমাকে ভালোবাসতে হবে এবং আমার ভালোবাসা নিতে হবে তোমায়। এতোটা ভালোবাসা নিতে হবে। যেটা তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি হবে।”

ঐশানীকে কোলে তুলে নেয় অভয়। আচমকা অভয়ের এই কান্ডে ঐশানী হকচকিয়ে গিয়ে ভীতু চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে এক হাতে ওর শেরওয়ানির কলার আরেকহাত ওর ঘাড় খামচে ধরতেই অভয় চেহারা হালকা খিঁচে বলে…..
–“উফফ….রাক্ষসী বউ আমার।”
ঐশানীর চোখ সরু হয়ে তাকে। তাকে কোন দিক থেকে রাক্ষসী লাগে? প্রশ্নটা আর করা হয় না। অভয় তাকে বিছানায় আধশোয়া করে ছেড়ে দেয়। অভয় একহাতে ভর দিয়ে ঐশানীর দিকে নিচু হয়ে ওর নাকের সঙ্গে নিজের নাক ঠেকিয়ে দেয়। ঐশানী কিছু বলতে নিলেই অভয় তার ঠোঁটে আবারও নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে থামিয়ে দেয়। সে ঐশানীর দিকে মোহনীয় ভাবে চেয়ে থেকে বলে…..

–“উঁহু না! কোনো কথা না। এতোদিন দূরে থেকেছো সহ্য করেছি। এবার কোনো কথা শুনছি না।”
অভয়ের তৃষ্ণার্ত চোখ ঐশানীকে গ্রাস করতে থাকে। ঐশানীকে নিজের ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে। আজ সকল রাগে-অভিমানের পর্দা সরিয়ে কাছাকাছি আসতে থাকে তারা। আর কোনো দূরত্ব নয়, আর কোনো লুকোচুরি নয়। শুধু থাকবে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা!!

সময় নিজ গতিতে অনেকটা বয়ে গেছে। এই বয়ে যাওয়া সময়ে কিছুই পাল্টায় নি। কেটেছে প্রায় দেড় বছর!

রুমে লাউড মিউজিক চলছে। বেডের ওপর নাচছে দুই মেয়ে। বালিশ থেকে শুরু করে চাদরের একাকার অবস্থা! দুজনের পরনে ছেলের শার্ট এবং প্যান্ট। চোখে সানগ্লাস। এই চঞ্চল দুজন আর কেউ নয় ঐশানী এবং অনিন্দিতা। তাদের মুখে হাসি ধরে না।
অন্যদিকে ইশানের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে ঢোকে অভয়। ঘরে ঢুকতেই মিউজিকে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম তাদের। কানে দুজন হাত দিয়ে বেডের দিকে তাকায়। তাদের দুজনেরই চোখ কপালে উঠে যায়। উম্মাদের মতো ঐশানী ও অনিন্দিতাকে নাচতে দেখে ইশান ও অভয় দুজন দুজনের দিকে তাকায়।

ইশান নিজের চোখ চেপে ধরে। অভয়ও নিজের চোখ চেপে ধরে। এভাবে কিছুক্ষণ থেকে রিমোট দিয়ে মিউজিক ওফ করে দেয় অভয়। ইশানও চোখ থেকে হাত নামিয়ে বেডের কাছে এগিয়ে এসে অনিন্দিতার পাশে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে আস্তে করে নিচে নামিয়ে কড়া গলায় বলে…..
–“অনি? এটা কি করছো? এই অবস্থায় লাফালাফি করা মানায় হ্যাঁ?”
–“আমি অনিকে অনেক বার বারণ করেছিলাম। কিন্তু ও আমায় বলল এই অবস্থায় যত খুশিতে থাকবে তত ভালো। তাই কিছু বলিনি।”
বলেই ফিক করে হেসে দেয় ঐশানী। অনিন্দিতা প্রেগন্যান্ট। প্রেগন্যান্ট হয়ে মেয়েটার বাচ্চামি বেড়ে গিয়েছে। সেকারণে ইশান চোখের আড়ালে করে না তাকে।

অভয় চোখ গরম করে তাকায়। ঐশানীকেও টেনে নামায় বেড থেকে। হিসহিসিয়ে বলে…..
–“এসব কি পড়েছো তুমি?”
–“আপনার শার্ট আর জিন্স।”
স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ঐশানী। মেয়েটার দুষ্টুমি কখনোই যাবার নয়। এটাও অভয়ের ভালোই লাগে। ইশান বকতে বকতে অনিন্দিতাকে নিয়ে যায়। অনিন্দিতা যাবার আগে চিল্লিয়ে বলে…..
–“অল দ্যা বেস্ট ভাইয়া আর ভাবি। জলদি আমার পুচকু বেবির খেলার সাথি আনো হ্যাঁ? আমি ওয়েট করে থাকব।”
ঐশানী হেসে মাথায় নাড়ায়। তারপর অভয়ের দিকে তাকায়। অভয় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

–“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খেয়ে টেয়ে ফেলবেন নাকি?”
অভয় ঐশানীর শার্টের কলারে হাত দিয়ে অন্যহাতে শার্টের ওপরের বোতাম খুলতেই দূরে ছিটকে যায় ঐশানী। শার্টের ওপরে হাত লাগিয়ে ধড়ফড়িয়ে বলে….
–“ছি এসব কি করছেন?”
–“কি করছি আবার? এই রুপে প্রথম দেখছি তোমায়। আসো চেঞ্জ করিয়ে দিই।”
–“আমি করে নিতে পারব।”
অভয় বাঁকা হাঁসে। ঐশানী শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

অভয় ঐশানীর অপেক্ষা করতে থাকে। আজ তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। অনাথ আশ্রমে যাবে ওরা বেবি এডাপটেশনের জন্য। ঐশানীর সমস্যাটা থাকলেও অভয়ের কিছুই যায় আসে না। সে ঐশানী বলতেই পাগল। ওকে ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়েছিল অভয় কিন্তু লাভ হয়নি। তবুও অভয় ওকে হতাশ হতে দেয়নি। আশ্বাস দিয়েছে।
ঐশানী ওয়াশরুম থেকে বের হলে অভয়ের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। মিসেস. তনয়া ও রাহাত সাহেব হাসিমুখে তাদের সাবধানে যেতে বললে বেরিয়ে পড়ে ওরা। ঐশানীর বুক ধড়ফড় করছে। ইতিমধ্যে ঐশী সহ তার বন্ধুরাও কল করেছিল। তারাও বিষয়টাকে ভীষণ খুশি।

গাড়িটা চলতে থাকে। অভয় ঐশানীর হাত শক্ত করে ধরে থাকে। এক পর্যায়ে সে বলে…..
–“আজ আমরা আমাদের বেবি নিতে যাচ্ছি ঐশানী। আমি কখনোই ওকে অন্যের সন্তান ভাববো না। ও আমাদেরই সন্তান হবে। আমাদের অংশ হবে।”
ঐশানী শুধু মুচকি হাসে। লোকটা কতটা ভালোবাসে ওকে। অভয় কখনোই ঐশানীর অসম্পূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এটাই হয়ত ভালোবাসা! অভয় ঐশানীকে নিজের কাছে টেনে তার কপালে চুমু একে দেয়। ঐশানী তার অনুভব করেন গভীর ভাবে।

ফোনটা বেজে ওঠে হঠাৎ ঐশানীর। ফোনের স্ক্রিনে নামটা দেখে তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে ঐশানী। ওপর পাশ থেকে সায়রা বলে ওঠে…..
–“হ্যালো ঐশানী? কেমন আছো?”
–“ভালো। তুমি কেমন আছে? ইরা(সায়রার মেয়ে) কেমন আছে? আর ভাইয়া?”
–“হুম সকলে ভালো আছে। শুনলাম আজ তোমরা বেবি এডাপটেশনের জন্য যাবে?”
প্রশ্ন করে সায়রা। ঐশানী জবাব দেয়….
–“হ্যাঁ।”
–“খুব ভালো কথা। আমার সত্যি তোমাদের জন্য ভালো লাগছে আমার। কংগ্রাচুলেশনস!”
–“থ্যাংকস।”

সায়রা হেসে বলে…..
–“জলদি আমার ইরার জন্য খেলার সাথি আনো। অপেক্ষা করছি।”
–“ঠিক আছে।”
ঐশানী বিদায় জানিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। অভয় কাঁধে মাথা রাখে।

প্রায় আধঘন্টা ধরে সকল ফর্মালিটিস পূরণ করল ঐশানী ও অভয়। তারা দুজনই বেশ উদ্বিগ্ন বেবি দেখার জন্য। কিছুক্ষণ ধরে বসে থাকতেই একটা মহিলা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে আসে। বাচ্চাটার বয়স মাত্র সাত মাস। বাচ্চাটা ছেলে বাচ্চা। ঐশানীর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। অজান্তেই মুখে হাসি চলে আসে। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দেয় ঐশানীর কাছে। কিন্তু প্রথমে সে কোলে আসতে না চাইলেও ঐশানীর সুন্দর হাসি দেখে বাচ্চাটাও হেসে দিয়ে তার কোলে চলে আসে। ঐশানীর হাসি আরো প্রসারিত হয়। অভয়ও বাচ্চাটার হাত ধরে। যেন এক অন্যরকম জীবন পেলো ঐশানী। সেখানকার মহিলা বলল…..

–“ওর নাম……”
অভয় উনাকে থামিয়ে বলে….
–“আমরা ওকে নতুন নাম দেব। কারণ আজ থেকে আমরা ওর বাবা-মা।”
মহিলাটি সম্মতি জানায়। ঐশানী তখন থেকেই বাচ্চাকে দেখতে ব্যস্ত। ছোট ছোট চোখ, ছোট ছোট হাত-পা বড়ই মায়াবী! সব থেকে মনোযোগ দিয়ে ঐশানী দেখল আশ্চর্যকর ভাবে বাচ্চাটার থুতনিতে অভয়ের মতোই খাঁজকাটা দাগ রয়েছে। সে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে…..
–“অভয় দেখুন! ও কিন্তু আপনার মতো দেখতে।”
–“ঠিক বলেছো।” (বাচ্চার দিকে তাকিয়ে)
ঐশানী বাচ্চার কপালে চুমু খেতেই সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।

নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছে অভয় ও ঐশানী। বাতাস তাদের ছুঁইয়ে দিচ্ছে। ঐশানীর কোলে সেই বাচ্চাটা। সেও যেন নতুন মা পেয়ে মাকে দেখতেই ব্যস্ত। একসময় অভয় বলে ওঠে…..
–“এই বছর আমার জার্মানিতে যাব। সেখানে তোমার ট্রিটমেন্ট হবে।”
–“আচ্ছা শুনুন, আমাদের কোনো বেবি হলেও এই বেবিকে আমরা মা-বাবার মতো ভালোবাসবো।”
–“তা তো বাসতেই হবে। ও তো ওই পরিবারের বড় ছেলে।”
মুগ্ধ নয়নে তাকায় ঐশানী।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অভয় বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর ঐশানীকে ডেকে আকাশের দিকে ইশারা করল। ঐশানী তাকিয়ে দেখল আকাশের চাঁদ। অভয় শীতল কন্ঠে বলল…..
–“আকাশে ওই চাঁদ দেখছো? বেলা শেষে আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে? ঠিক যেমনটা তুমিও আমার জীবন আলোকিত করে রেখেছো। ভালোবাসি তোমায়। প্রচন্ড ভালোবাসি। যেই ভালোবাসা সীমা নেই। বেলা শেষে আমি তোমায় চেয়েছি। আর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমায় চাইবো। #বেলা_শেষে_শুধু_তুমি।”

ঐশানী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। অভয় তাকে জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। ঐশানীও বলে ওঠে…..
–“ভালোবাসি আপনাকে। চাঁদ যেমন আকাশের বুকে থাকে। আমিও সেভাবেই চিরদিন আপনার বুকে রয়ে যাব।”
তাদের কথা শুনে বাচ্চাটা কি বুঝল জানা নেই। তবে সেও মিষ্টি হাসল। তা দেখে অভয় ও ঐশানী হেসে দিল। ভালোবাসা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর! এই সৌন্দর্য ফুরানোর নয়!

——–সমাপ্ত———