বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব- ৩৮+৩৯

0
448

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৮

খোলা বারান্দায় ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করছে অভয়। বেতের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে ফোনের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ঐশানীর হাসিমাখা একটি ছবি। ছবিতে ঐশানীর পরনে সবুজ রঙের একটা জরজেট শাড়ি। বরাবরাই অভয়ের কাছে সবথেকে বিরক্তির রঙ ছিল সবুজ। তার মতে সবুজ রঙ প্রকৃতি ছাড়া কারো গায়ে মানানসই নয়। তবে যেদিন ঐশানীকে সবুজ রঙের শাড়িতে দেখেছিল স্থির হয়ে গিয়েছিল অভয়ের দুটো চোখ। যেই রঙটা অপছন্দ করত সেই রঙটা তার হুট করেই পছন্দের হয়ে উঠল। আচ্ছা, ভালোবাসার মানুষকে যেকোনো রঙেই আলাদা আলাদা সুন্দর লাগে? হয়তবা!

–“ভাইয়া, তোর মাথায় কি চলছে?”
অভয় ভাবনা ছেড়ে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। অনিন্দিতা নিঃশব্দে হেঁটে এসে অভয়ের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। অভয় ছোট্ট করে গম্ভীরতার সঙ্গে জবাব দেয়…..
–“আমার মাথায় আবার কি চলবে?”
–“সেটাই তো জানতে চাইছি। (একটু থেমে) আর কেউ না জানুক আমি জানি ভাবির খবর তুই জানিস।”
অভয় ফোনের দিকেই তাকিয়ে থাকে। এমন ভাব করে থাকে যেন ও কিছু শোনেই নি। অনিন্দিতা হতাশ চোখে তাকায়।

–“ভাইয়া? আমার কথা শুনছিস?”
–“হুমম শুনছি বল।”
–“তুই তো জানিস ভাবি কোথায় থাকে। আমি এটাও জানি ভাবি কি করে না করে সব খবর তুই রাখিস।”
–“হুমম তো?”
অনিন্দিতা অভয়ের যুক্তিহীন প্রশ্নে চোখমুখ জড়িয়ে তাকায়।
–“তো মানে কি? তুই কেন আমাদের ওর কথা বলিস না? কেন গিয়ে নিয়ে আসিস না ভাবিকে? তুই তো ভাবিকে ভালোবাসিস।”

–“আমি ওকে গিয়ে নিয়ে আসব না। ও যেভাবে নিজের ইচ্ছায় গেছে সেভাবেই নিজের ইচ্ছায় আসতে হবে। ও অনেক বড় ভুল করেছে। আমাকে ভালোবাসা শিখিয়ে পালিয়ে গেছে। আর অবশ্যই এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। হ্যাঁ আমি ওর খবর গত এক বছর ধরে রাখি। ওর কাছে যাই না। আমারও তো একটা আত্মসম্মানবোধ আছে! নেই কি? সেই আত্মসম্মানবোধ থেকেই ওকে আমি গিয়ে নিয়ে আসিনি। ওর ভুল শুধু এবং শুধুমাত্র ওকেই শুধরাতে হবে। ওকে নিজ থেকে আমার কাছে আসতে হবে।”

অনিন্দিতা হতভম্ব হয় অভয়ের এইরূপ কথা শুনে। সেও জানতো না অভয় ঐশানীর খবর এতোদিন ধরে জানে। এক আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে বলে….
–“ভাইয়া তুই ভাবির খবর এতোদিন ধরে জানতিস? তাহলে তো ওর পরিবারকে জানানো উচিত ছিল! আর তুই একটু বেশিই করে ফেলছিস না? ভাবি তো ভেবেছিল যে, অন্য সবার মতো তোরও বাবা হবার ইচ্ছে রয়েছে। আর…..”
–“ওরা জেনে কি করবে? আমার ফাদার ইন লো ঐশানীর ওপর এতোটাই ক্ষুব্ধ ওর কর্মকান্ডে যে ওর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উনি ঐশানীকে খোঁজার
চেষ্টা অবধি করেননি। উনার মতে ঐশানী উনার প্রিয় বন্ধু আই মিন আমার বাবার কাছে উনার মাথা নিচু করিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আমি বেশি বেশি করছি? ঐশানী করেনি? আর বাবা হওয়ার ইচ্ছে থাকলেই ওর কি মনে হয়েছিল? ওকে আমি ছেড়ে দিতাম?”

ক্রোধের সাথে কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল অভয়। হাফ ছেড়ে সে আবার বলে…..
–“ও বোঝেনি আমায়। ও কখনো বোঝেনি। ও এটা বোঝেনি যে বেলা শেষে শুধু আমি ওকেই চেয়েছিলাম।”
অনিন্দিতারও এবার খারাপ লাগতে শুরু করে। ধীর গলায় বলে…..
–“তোর কেন মনে হচ্ছে ও ফিরে আসবে? এতোদিন যখন আসেনি। আজ কি করে আসবে?”
–“আসবে, আসবে। বোনের বিয়ে আর ও আসবে না?”

অনিন্দিতা উৎসুক হয়ে তাকায়। অভয়ের মাথায় যে কখন কি চলছে তার অজানা। কেউ আন্দাজও করতে পারে না। অভয় কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থেকে ফোনটা অন করে কারোর নম্বরে কল করে কানে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হওয়ায় স্তম্ভিত হয়ে বলে……
–“আরেহ বাহ শালিকা! মনে হচ্ছে আমার কলের আশায় বসে ছিলে?”
ওপাশ থেকে কিটকিটিয়ে হাসার আওয়াজ আসে। হাসি থামিয়ে ঐশী বলে ওঠে……
–“হ্যাঁ ভাইয়া ঠিকই ধরেছেন। আমি আমার কাজ করে দিয়েছি। আপনার শালিকা এক্টিং এ বড্ড পাকা। আপু আমার বিয়েতে আসছে।”

–“আসতে তো হতোই। নয়ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দিতে কি না!”
অভয়ের কথায় ফিক করে হাসে ঐশী।
–“আচ্ছা আপনি কবে আসছেন তাই বলুন।”
–“তোমার বোন যখন বিয়ে বাড়িতে পা রাখবে। তখনই ধরে নিও আমি এসে গেছি।”
–“কিন্তু সমস্যা তো একটাই ভাইয়া!!” (অসহায় কন্ঠে)
অভয়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। কি সমস্যার কথা বলতে চায় ঐশী? ফিচেল গলায় প্রশ্ন করে…..
–“কি সমস্যা?”

–“বাবা। বাবা খুব রেগে আছে আপুর ওপর সেটা তো আপনি জানেন। আমি বুঝতে পারছি না বাবা যদি বিয়ে বাড়িতে আপুকে দেখে ওভার রিয়েক্ট করে বসে তো?”
–“আই ডোন্ট থিংক সো! বাবা বরাবরই বুদ্ধিমান মানুষ। উনি সকলের সামনে এমন ওভার রিয়েক্ট করবেন না। আমি রাখছি ওকে?”
–“ঠিক আছে।”
অভয় ফোন কেটে দিয়ে অনিন্দিতার দিকে তাকায়। অনিন্দিতা হা করে তাকিয়ে আছে। অভয় ওর মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে হাই তুলে বলে…..

–“হা করে থাকলে মশা ঢুকে যাবে। ডিনার টাইম হয়ে গেছে আর তোর বর এবং আমার একমাত্র দুলাভাই হয়ত এতোক্ষণে পেটে হাত দিয়ে বসে গেছে। যা রান্নাঘরে। আমিও আসছি।”
–“কিন্তু ভাইয়া তুই কি করতে চাইছিস? তুই যে বলেছিলি ভাবিকে নিজে থেকে তোর সামনে আসতে হবে নয়ত তুই যাবি না।”
অভয় হঠাৎ করেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। তবে তা অনিন্দিতার থেকে লুকিয়ে।
–“আমি তো যাচ্ছি না। ঐশানী আসছে। হ্যাঁ এটা ঠিক আমি ওকে নিয়ে আসছি। কি করব? ওকে ছাড়া আমার একটা মূহুর্তও ভালো কাটছে না। মাঝে মাঝে সেলফিশ হতে হয়। আমিও না হয় হবো। এতো ভাবিস না।”
অনিন্দিতার পাশ কাটিয়ে চলে আসে অভয়।

হতাশ চোখেমুখে বসে আছে ঐশানী। ভ্রুযুগল তার হালকা কুঁচকানো। পাশেই আধশোয়া হয়ে আছেন রমিলা বেগম। অনেকক্ষণ ধরেই ঐশানীকে পর্যবেক্ষণ করছেন উনি। ঐশানী এমন উদ্ভট মুখভঙ্গি দেখে বললেন…..
–“এমন ভূতের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিস বল তো?”
–“আন্টি, কালকে সকাল, দুপুর বা বিকেলের কোনো বাসের টিকিট নেই। একবারে রাত বারোটার বাস ফাঁকা।”
–“তো সমস্যা কি? ট্রেনে যা না!”

–“ট্রেনে গেলে আরো দুইদিন আগে থেকে বুকিং করিয়ে রাখলে ভালো হয়। তাছাড়া সিট পাবো না তো। আর ট্রেনে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কালকের পরের দিনই ঐশী গায়ে হলুদ।”
–“তাহলে তোর বরকে ফোন দিয়ে বল গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে।”
ব্যঙ্গ করে বলেই ফিক করে হেসে ফেলেন রমিলা বেগম। ঐশানী সরু চোখে তাকায়। এটা তার কাছে নতুন কিছুই না। রমিলা বেগম কথায় কথায় অভয়ের কথা টেনে আনেন। কেন অভয়ের প্রসঙ্গ বারে বারে তোলেন তা জানা নেই ঐশানীর।

ঐশানী সরু চোখে তাকাতে দেখেই রমিলা বেগম ওর কাঁধ হালকা ঝাঁকিয়ে বলেন…..
–“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি তোকে ভয় পাই না হুমম….!”
–“তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভয় দেখানের জন্য এভাবে তাকাচ্ছি?”
রমিলা বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলেন…..
–“কি জানি! তা কয়টার বাসের সিট বুকিং করলি তুই?”
–“ওই রাত বারোটা। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যাবে।” (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)

–“সেকি রে! রাত বারোটার দিকে বাসে উঠবি মানে তো অনেক রাত। একা মেয়ে যাবি কি করে এতো রাতে?”
হতভম্ব হয়ে বলেন রমিলা বেগম। ঐশানী মুচকি হেসে বলে…..
–“এটা নিয়ে আমিও চিন্তায় ছিলাম কিন্তু রাহিদ ভাই(স্কুলের সহকর্মী শিক্ষক) আমায় পৌঁছে দেবেন বলেছেন। আর শোনো আমি লতাকে বলে দিয়েছি ও শুধু কাজই করবে না তোমার সঙ্গে এসে থাকবেও কয়েকদিন আমি যতদিন না আসছি ততদিন।”

রমিলা বেগম মুখে হাত দিয়ে হেসে বিড়বিড়িয়ে বলেন….
–“ওকে বরং তুই পারমেন্টলি এখানে রেখে দে। তুই আর ওখান থেকে ফিরতে পারবি না।”
ঐশানী রমিলা বেগমের অস্পষ্ট কথা শুনে চাপা সুরে বলে…..
–“কিছু বললে? শুনতে পেলাম না। আবার বলো।”
–“তোর ওতো শুনতে হবে না। বাংলার খবর একবাই হয়। যাহ নিজের ঘরে যা। ঘুমিয়ে পর। রাত কম হয়নি।”
একনাগাড়ে কিছুক্ষণ রমিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকে উনাকে শুইয়ে লাইট ওফ করে দিয়ে চলে আসে ঐশানী। কালকের পরের দিন আবারও দুই বছর পর সেই শহরে ঐশানী প্রবেশ করবে তার দুরুদুরু মন নিয়ে।

একদিন পর……
চারিদিকে লাইটিংয়ে ঝলমলিয়ে উঠছে। চারিদিকে খুশির আমেজ। ঐশীর গায়ে হলুদ বলে কথা! চারিদিকে গমগমে পরিবেশ। এই ঝলমলে পরিবেশে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে ঐশানী। পরনে তার হলুদ রঙের শাড়ি। ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। ইমতিয়াজ সাহেব গাম্ভীর্যের সঙ্গে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। একসময় মুখ খোলেন তিনি।
–“কেন এখানে এসেছিস তুই? এতোদিন পর হঠাৎ করে নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ল যে!”
–“আসলে বাবা…..”

ইমতিয়াজ সাহেব হাত নাড়িয়ে ঐশানীকে থামিয়ে দেন।
–“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। তুই যখন নিজের ইচ্ছেতে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলি তখন আমি কিছু বলিনি। আমার মানসম্মান আমার প্রিয় বন্ধুর সামনে ডুবিয়ে দিয়েছিলি সেদিন আমার কাছে বলার মতো কিছুই ছিল না। আজ বোনের বিয়ে তাই চলেও এলি। তুই কি ভেবে রেখেছিস? তোর যা ইচ্ছে তাই করবি? তোর এসব ইচ্ছেতে বাকিদের ওপর কতটা ইফেক্ট পড়ে সেটা ভেবে দেখেছিস?”
–“আই এম সরি বাবা। আমি তখন অনেক ভেবে দেখেছিলাম। কিন্তু এর চেয়ে সঠিক রাস্তা আর আমার কাছে জানা ছিল না।”

–“সঠিক রাস্তা? তুই এখনো এতোটাও বড় হসনি যে সঠিক আর ভুল রাস্তা তুই একাই যাচাই করতে পারবি। যখন এখানে এসেই পড়েছিস তোকে যেতে বলব না। হাজার হোক নিজের রক্ত তো! মায়া লাগে। বিয়ে শেষ হলে ফিরে যাবি। সেদিনই ফিরে যাবি। যাগগে আর বেশি কথা বলব না। বিয়ের পরিবেশ। আমার কথা মাথায় রাখবি।”
ঐশানীর কোনোরকম কথা না শুনে অনুষ্ঠানে গিয়ে যোগ দেন ইমতিয়াজ সাহেব। ঐশানী সেভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ করেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বলে ওকে কেউ লুকিয়ে দেখছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায় ঐশানী। এমন কাউকে তার চোখে পড়ে না। সেই সময় ঐশী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার পরনে হলুদের সাজ। গায়ে ফুলের গয়না। ঐশানীর নিজের গায়ে হলুদের কথা মনে পড়তেই মুখটা হাসোজ্জল হয়ে আসে তার।

–“এই আপু। এটা কি পড়েছিস?”
–“কেন কি পড়েছি? হলুদ শাড়ি পড়েছি। যেটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পড়ে সেটাই পড়েছি। আর তুই এভাবে ছুটছিস কেন? বিয়ের কনে তুই। এমনভাবে ছুটাছুটি করতে আছে?”
ঐশী সেসবে পাত্তা না দিয়ে ঠেস মেরে বলে….
–“নিজের বিয়েতে কি করেছিলি মনে আছে? জ্বরের ঘোরে সরাসরি ভাইয়াকে কিস….”
বলেই নিজের মুখ চেপে ধরে হাসতে থাকে ঐশী। ঐশানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে। তবে তারও হাসি পাচ্ছে। হাসিটা চেপে রেখেছে সে। অজান্তেই চোখজোড়া বড়ই অশান্ত হয়ে এলো অভয়কে এক পলকের জন্য দেখার জন্য। অভয় আদোও কি এসেছে? এলে তো একবার হলেও সে দেখতে পেতো। তবে কি অভয় আসেনি?

ঐশী ঐশানীর হাত ধরে টানতেই ঐশানীর ধ্যান ভাঙে।
–“আপু চল না আজ সুন্দর করে সাজবি!”
বায়না ধরে বলে ঐশী। ঐশানী ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওর সাজ কি খারাপ হয়েছে নাকি? জোর গলায় বলে….
–“এটা তো ঠিকই আছে। চল তোকে হলুদ অনুষ্ঠানের আসরে নিয়ে যাই।”
–“তুই আগে আমার হাতে সাজবি তারপর আমি গায়ে হলুদে বসব!”
জেদ নিয়েই বলে ওঠে ঐশী। ঐশানী পড়ে যায় বিপাকে। তার উত্তরের অপেক্ষা না করে আরো কয়েকজন মেয়ে এসে হানা দেয়। তারা হলো ঐশানী বান্ধবীরা। ঐশানী মনে মনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কতদিন পর সেই চেনা মুখগুলো!

–“মহারানীর দেখা অবশেষে পাওয়া গেল।”
ভেংচি কেটে বলল মেঘনা। দিয়াও মুখ বাঁকিয়ে বলে…..
–“হ্যাঁ হ্যাঁ। অবশেষে দেখা পেলাম। কবে যে আমাদের মহারানী এতো স্বার্থপর হয়ে গেল কে জানে! আমরা তোর মতো এতো স্বার্থপর নয়। দেখ তোর সঙ্গেই স্পেশালি দেখা করতে ছুটে এসেছি।”
ঐশানী দিয়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলে…..
–“আমি এখনো সেই উদার। নয়ত…..”
–“হয়েছে হয়েছে। তোর লেকচার শুনতে আমরা আসিনি। চল তোর গায়ে হলুদের থুক্কু ঐশীর গায়ে হলুদের জন্য তৈরি হতে হবে।”
রিনি টেনে ঐশানীকে নিয়ে যায় ঐশীর রুমে।

এতোটুকু অবধি ঐশানী কিছু না বললেও ঐশানীর চোখে কাপড় বেঁধে দেওয়ায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল সে। চোখের কাপড় টানার চেষ্টা করে বলল…..
–“কি করছিস তোরা? আমার চোখের মেকআপ ঘেঁটেঘুঁটে গেল। পেত্নী সেজে ঘুরে বেরাবো তোদের সামনে? ভয়ে তো উল্টে পালাবি। ঐশী….! রিনি….!”
–“আপু চুপ কর না। তোকে রেডি করাচ্ছি। এটা তোর জন্য সারপ্রাইজ। সো যতক্ষণ না রেডি হচ্ছিস চোখের কাপড় খুলবি না।”
–“কিন্তু….!”
কিছু বলতে চেয়েও বলল না ঐশানী। বোনের বিয়ে তাই আবদার মেনে নিচ্ছে নয়ত কতগুলো চড় পড়ত ওর গালে সেটা ঐশানী নিজেও গননা করতে পারছে না।

ঐশানীর ঘাড়ে হাত দেয় একজোড়া হাত। এক অদ্ভুত কাঁপুনি দিয়ে ওঠে তার শরীর। সে অনুভব করে কেউ তার পড়া গয়না খুলে নিচ্ছে। ঐশীই খুলছে হয়ত এই ভেবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঐশানী। আস্তে আস্তে সেই হাতজোড়ার মালিক তাকে তৈরি করে। ঐশানী অনুভব করা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না। কেউ তার হাত স্পর্শ করে চুড়ি পড়িয়ে দেয়। এই স্পর্শ তার ভীষণই চেনা মনে হয়। ঢক গিলে সে। ও কি ভুলভাল ভাবছে? ভ্রম হচ্ছে? হঠাৎ তার কাঁধে কারো গরম নিঃশ্বাসের উত্তাপ পেয়ে নিঃশ্বাস ওঠানামা শুরু করে তার।
–“মাই বিউটিফুল ওয়াইফ….!”

ফিসফিসিয়ে বলা সেই চেনা পুরুষালী গলা শুনে ধড়ফড়িয়ে নিজের চোখের কাপড় সরানোর চেষ্টা করে ঐশানী। তবে সে চোখের কাপড় খুলতে খুলতে দরজার খটখট শব্দ হয়। চোখ থেকে কাপড় সরাতেই দেখে ঐশী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
–“তুই ছিলি এখানে??”
–“হ্যাঁ আপু। আমি ছাড়া কে থাকবে?”
–“মনে হলো অন্যকেউ।”
আনমনে বলে ওঠে ঐশানী।

নিজের পরনের লেহেঙ্গা ধরে হেঁটে চলেছে ঐশানী। ও বুঝতে পারছে না এতো ভারি লেহেঙ্গা আর গা ভর্তি ফুলের গয়না ওকে পড়ানোর কারণ কি? যেন ওর মনে হচ্ছে ঐশীর সঙ্গে সেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের কনে। অদ্ভুত…!
একমনে হেঁটে গায়ে হলুদের আসরের দিকে যেতেই দূরে নারীকে দেখে পা থেমে যায় তার। সরু চোখে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে….
–“সায়রা….!!”
ও এখানে কি করছে? হঠাৎ করেই ওর মনে হলো অভয়ের কথা। তবে কি অভয় সত্যি সত্যি সায়রাকে….? ভাবতেই বুক ছ্যাত করে ওঠে ঐশানীর। সায়রা কারো সঙ্গে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।

ঐশীও সেইসময় সবার সঙ্গে আসরে যাচ্ছিল। ঐশানী ঐশীকে ডেকে প্রশ্ন করে…..
–“এই শোন, দূরে ওই সুন্দর মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ওটা কে রে?”
ঐশী সায়রার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে….
–“ওহ ওটা? কে আবার ভাইয়ার বউ।”
হৃদকম্পন এক মূহুর্তের জন্য হলেও থেমে যায়। ঐশানী মাথাটা ভনভন করে ওঠে। ঐশী তো অভয়কে ভাইয়া বলে ডাকে। তবে কি ঐশানীর ধারণা সত্যি? সে চেয়েছিল সায়রার সঙ্গে অভয়ের বিয়ে হক কিন্তু অভয় যে তার নিজের স্বামী। ঐশী আরেকটু হেসে বলে ওঠে….
–“আরে ইমন ভাইয়ার বউ।”

বড় নিঃশ্বাস ফেলে তাকায় ঐশানী। ইমন তার মামাতো ভাই। যেন তার ওপর থেকে কত বড় পাথর নেমে গেল। অস্পষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে…..
–“ইমন ভাইয়ার বউ?”

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯

–“হ্যাঁ ইমন ভাইয়ার বউ। সুন্দর না? সাথে খুবই মিশুক। কয়েকদিন আগে তো শুনলাম সায়রা ভাবি প্রেগন্যান্ট। তোকে বলাই হয়নি এসব ব্যাপারে। তুই তো ফোনে কথা বললে সময়ই দিস না। তাই বলতে পারিনি। যাই হোক তুই আয় আমি যাচ্ছি।”
বলেই ব্যস্ত পায়ে আসরের দিকে বাকি সকলের সঙ্গে এগিয়ে গেল। ঐশীর কথাগুলো ঐশানীর মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি এনে দিল। তার মনটা বলে উঠল…..
–“আমার শ্যামলা ঘোড়া কি এখনো আমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে?”

অন্যদিকে তার মস্তিষ্ক তাকে বলে আরেক কথা। মস্তিষ্ক তার মনকে ঠেস মেরে বলে…..
–“থাকলে বা তোর কি? এমন মনে হচ্ছে তুই নিজের সংসারে আবার ফিরে যাবি! বিয়ে শেষে আবার তো সেই ফিরে যাবি চট্টগ্রামে। দেন তোর শ্যামলা ঘোড়াকে একাই জীবন কাটাতে হবে। তুই মস্ত বড় মাছ বিক্রেতা ঐশানী! নিজেও সুখে থাকছিস না আবার নিজের বরকেও সুখে থাকতে দিচ্ছিস না।”
এভাবেই চলতে থাকল মন আর মস্তিষ্কের ঝগড়া। মনের যুক্তি আর মস্তিষ্কের যুক্তি একত্রে মিলানো অসম্ভব তবে তিক্ত হলেও সত্যি যে মস্তিষ্ক সবসময় সঠিক কথা বলে। আর মন সবসময় আবেগ দিয়ে বিচার করে। তাই মস্তিষ্কের কথা শোনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পেছনে কোনো অন্য ব্যক্তির উপস্থিতি টের পায় ঐশানী। চট করে পেছন ফিরে তাকাতেই চোখটা স্থির হয়ে যায় মানুষটার দিকে। দুই বছর পর অভয়কে দেখছে ঐশানীর চোখজোড়া। তার চোখজোড়াকে কি আর সরাতে পারবে? সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় ঐশানীর। সারা রাজ্যের অস্বস্তি ভর করে তার মাঝে। মাথা নোয়াতে চেয়েও পারছে না সে। মানুষটা ঠিক আগের মতো নেই। বড় ঘন দাঁড়ির কারণে ঢেকে গিয়েছে অভয়ের থুঁতনির মাঝখানে খাঁজকাটা দাগ। যেটা ঐশানীর সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় লাগতো। ওই থুঁতনি যে ঐশানীর ওষ্ঠদ্বয় কতবার ছুঁয়েছে তার হিসেব নেই। লোকটার পরনে হলুদ শেরওয়ানি তার ওপরে সাদা রঙের কটি। কটিতে গোল্ডেন সুতো দিয়ে কাজ করা। পারফেক্ট ম্যান লাগছে তাকে।

–“আ…আপনি এখানে?”
অস্ফুটস্বরে কথাটা বলতেই অভয়ের বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল…..
–“আশা করোনি নিশ্চয়! তবে সম্পর্কটা এখনো ছিন্ন হয়নি। কাগজে কলমে এখনো আমি এই বাড়ির জামাই। হয়ত মনের দিক থেকেও সম্পর্কটা এখনো ছিন্ন হয়নি।”
ঐশানী কথা আঁটকে আসছে। অভয় তা দেখে ভীষণ মজা পাচ্ছে। তবে সে হাসছে না। ঐশানীর নিরবতা দেখে সে আবার বলল…..
–“আগে তো কথা চালু করলে আর শেষ হবার নাম নিতো না। আর এখন তোমার পেট থেকে কথা বের করা দুর্দায় হয়ে পড়েছে।”

–“আমি আসছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই তাড়াহুড়ো করে অন্যদিকে যাওয়ার জন্য পা ফেলে ঐশানী। সঙ্গে সঙ্গে পথ আঁটকে দাঁড়ায় অভয়। শয়তানি হাসি দিয়ে বলে….
–“আরে দাঁড়াও। এতো তাড়া কীসের? প্রেমে পড়ার ভয় পাচ্ছো?”
–“প্রেম? কীসের প্রেম?”
ইতস্ততবোধ করে বলে ঐশানী। অভয় নিজের হাসি প্রসারিত করে বলে…..
–“যেই প্রেমের জগত থেকে উঠে আমার পরোয়া না করে দূরে চলে গিয়েছিলে আবারও যেন সেই প্রেমে না পড়ো তার ভয় পাচ্ছো? নাকি তুমি ভুল করেছো বলে পালিয়ে যাচ্ছো?”

–“আমি কোনো ভুল করিনি। আর না আপনার প্রেমে পড়ার ভয় পাচ্ছি। যেই প্রেমময় ভালোবাসায় আমি আগেই নিজের সর্বাঙ্গ আপনাকে দিয়ে দিয়েছি সেই প্রেমে পড়ার ভয় আর নেই আমার।”
–“তাহলে কেন চলে গিয়েছিলে?”
থমথমে গলায় প্রশ্ন করে অভয়। ঐশানী মিনমিন করে বলে…..
–“এর উত্তর আপনিও জানেন আর আমিও জানি।”
ঐশানীর ডাক পড়ে তখনই। চলে যায় সে একপ্রকার পালিয়ে। অভয় তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
–“পালিয়ে যাওয়ার অভ্যেস তোমার অনেক পুরোনো। তবে পালিয়ে গিয়ে ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসার অভ্যেসটাও সেই পুরোনোই!”

রাত আটটা বেজে পার হয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠান জমজমাট হয়ে উঠেছে। আশ্চর্যজনক ভাবে ঐশীর পাশে বসা ঐশানীকেও যে পারছে গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সে বারণ করা সত্ত্বেও মানছে না। হলুদ লাগিয়ে একেবারে যেনতেন অবস্থা তার। নিজের বিয়েতেও এভাবে কেউ হলুদ লাগায়নি তাকে। অবশ্য অভয় যা কান্ড করেছিল! যেভাবে দুধে-হলুদে ওকে গোসল করিয়েছিল অন্য কাউকে আলাদা করে হলুদ লাগানোর দরকারই ছিল না।
ঐশানীকে হলুদ লাগানো দেখে দূরে এক কোনায় দেওয়াল ঘেঁষে মিটিমিটি হাসছে অভয়। নিজের বিয়েতে ঐশানীকে ঠিকঠাক লক্ষ্য করেনি অভয়। হলুদের সাজে মেয়েটাকে এতোটা সুন্দর লাগে জানলে হয়ত ওর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের দিনই উম্মাদ করে ফেলত তাকে। ফুলের গয়না মোড়ানো মেয়েটাকে সদ্য লাল গোলাপের মতোই লাগছে!!

অভয়ের পাশে এসে এক নারী দাঁড়ানোতে ঐশানীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকায় সে। সায়রাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। সায়রা হাসিমুখে ঐশানীকে ইশারা করে বলে…..
–“অবশেষে ও এসেছে। অভয় মনে হচ্ছে লাইফ আমাকে একটা চান্স দিয়েছে তোমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক করানোর জন্য। আমার মনে হয় না এই সুযোগটা আমার মিস করা উচিত! কি বলো?”
–“না সায়রা। আর তোমায় আগেও বলেছি ঐশানী তোমার জন্য আমায় ছেড়ে যায়নি। নিজের বোকা মাথায় বোকা যেই বুদ্ধি এসেছে সেই কাজটা করেছে। তুমি সেকারণে দায়ি নও। ঐশানী আমার কাছে ফিরবে। নিশ্চয় ফিরবে। তুমি চিন্তা করো না।”

সায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের আগের পাগলামির জন্য সে সত্যিই অনুতপ্ত। সে মনেপ্রাণে চায় ঐশানী ফিরে আসুক অভয়ের জীবনে। আগের ন্যায় আলোকিত করে তুলুক অভয়ের জীবন।
–“কিন্তু তবুও কোথাও না কোথাও নিজেকে আংশিক দায়ি বলে মনে হয়।”
–“তুমি এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। শুনলাম তোমার সংসারে জুনিয়র আসতে চলেছে? কংগ্রাচুলেশনস…! এভাবেই ভালো থেকো।”

–“অল ক্রেডিট গজ টু ইউ অভয়। সেদিন তুমি যদি আমার সঙ্গে বোঝাপড়া না করতে সুন্দর ভাবে লাইফের স্বপ্ন না দেখাতে হয়ত আমি একই জায়গায় পড়ে থাকতাম।”
অভয় সায়রার জবাবে নিঃশব্দে হেসে ঐশানীর দিকে তাকায়। সায়রাও ঐশানীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে….
–“আমি তো জানতাম ঐশীর গায়ে হলুদ হচ্ছে। কিন্তু ঐশানীর এমন অবস্থা কেন? আচ্ছা অভয় এটা কি তোমার প্লান?”
অভয় শুধু মাথা নাড়ায়। সায়রা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে….
–“রিয়েলি? তাহলে যাই দুই বধূকে হলুদ মাখিয়ে আসি।”
–“ওকে গো।” (একগাল হেঁসে)

হলুদ মাখা মুখে একপ্রকার জুবুথুবু হয়ে বসে ছিল ঐশানী। এতো ভীড়ের মাঝে না চাইতেও তার চোখ গেল হেসে হেসে কথা বলা অভয় আর সায়রার দিকে। দুজনকে এভাবে কথা বলতে দেখে চোখজোড়া সরু হয়ে এলো তার। হঠাৎ করেই রাগ হতে শুরু করল তার। তার এতো রাগ হচ্ছে কেন? রাগে কটমট করে পাশেই ঐশীর হাত জোড়ে চেপে ধরে বসে সে। ঐশী হকচকিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। তার হাতের হার মাংস বোধহয় একাকার হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে সরিয়ে নেয় নিজের হাতটা। ঐশানীকে ধাক্কা দিয়ে ধীর গলায় বলল….
–“আপু তুই কি বাইরে গিয়ে রেসলিং শিখেছিস নাকি বক্সিং? এভাবে আমার তুলোর মতো সফট হাতকে চেপে ধরলে বিয়ের আগেই হাত ভেঙে বসে থাকব।”

কথাগুলো যেন ঐশানীর কান পর্যন্ত পৌঁছালোই না। তার তীক্ষ্ণ নজর সায়রা আর অভয়ের দিকে। সে নিজমনে বিড়বিড় করে বলে…..
–“সায়রার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? তাহলে ও শ্যামলা ঘোড়ার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? আর ওই অসভ্যটাও দাঁত কেলিয়ে কথা বলছে। এতো কথা কীসের হু?”
সায়রাকে নিজের দিকে আসতে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকায় ঐশানী।

সায়রা এসে প্রথমে ঐশীকে আর তারপর ঐশানীর গালে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়। ঐশানী অবাক নয়নে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে বলল….
–“আমায় কেন হলুদ ছোঁয়াচ্ছ? আমার বিয়ে নয়। ঐশীর বিয়ে।”
–“হ্যাঁ কিন্তু সবাই যখন দুই বোনকেই হলুদ মাখাচ্ছে আমি বাদ যাই কেন বলো?”
ঐশানী আর কোনো কথা বলল না। ওর রাগ হচ্ছে। কপাল কুঁচকে বসে থাকল। সায়রাকে বুঝিয়ে দিতে চাইল সে তার প্রতি বিরক্ত। কিন্তু সায়রা সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই ইমনের ডাকে অন্যদিকে চলে গেল।

এরপর আসল অনিন্দিতা আর ইশানের পালা। অনিন্দিতা ঐশানীর পাশে বসে শুধুমাত্র ঐশীকে হলুদ ছোঁয়ালো। সে বড্ড অভিমান করেছে নিজের ভাবির ওপর। তার ভাইকে একা ফেলে যাওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল? ঐশানীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সে শুধু গম্ভীর কন্ঠে বলল….
–“এমন কাজ না করলেও পারতে। তুমি যাওয়ার পর নিজের ভাইকে সবচেয়ে বেশি অসহায় দেখেছি। এতোটা অসহায় করা খুব প্রয়োজন ছিল কি? আমি এটা অন্তত তোমার থেকে এক্সপেক্ট করিনি।”
বলেই হাফ ছেড়ে উঠে গেল অনিন্দিতা। ঐশানী নির্বাক হয়ে রইল। তার দিকটা কেউ বুঝতেই চাইছে না। যেখানে নিজের পরিবারকে ঐশানী এতো বড় বিষয় জানায়নি সেখানে কি করে নিজের স্বামীকে এই খবর দিতো যে, সে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না?

নিজের গালে এক চেনা ছোঁয়ায় চমকে তাকায় ঐশানীকে। অভয়কে ভ্রু উঁচিয়ে বসে থাকতে দেখে রাগটা যেন দপ করেই বেড়ে যায়। লোকটা হেঁসে হেঁসে কথা বলেছে সায়রার সাথে। অভয় বাঁকা হেসে আরেক গালে হলুদ ছোঁয়াতেই ঐশানী আচমকা একটা ভয়ানক কাজ করে বসে। তার সামনে থাকা হলুদের বাটিটা তুলে সরাসরি অভয়ের মুখে ছুঁড়ে মারতেই সব হৈচৈ থেমে যায়। রাগের বশে ঐশানী এমন কাজ করবে সে নিজেও জানতো না। অথচ সে একদিন নিজেই চিঠি লিখে জানিয়েছিল অভয়কে সায়রাকে বিয়ে করে নিতে। আজ নিজেই সামান্য সায়রার হেসে কথায় বলায় অভয়কে সবার সামনে এভাবে হলুদের বাটি ছুঁড়ে মারায় নিজেই হতভম্ব ঐশানী। অভয়ের চোখমুখে গাঢ় হলুদের প্রলেপ। ঠোঁটেও হলুদ লেগে রয়েছে। ভীতিকর চোখে তাকায় ঐশানী।

মিসেস. দিশা এসব দেখে ছুটে আসতেই মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা টিস্যু মায়ের হাতে ধরিয়ে বোকা হাসি দিয়েই বলে….
–“উনাকে দিয়ে দিও।”
বলেই জিহ্বা কেটে মুখচোখ ঢেকেই নেমে যায়। ছুটে রুমের দিকে যায় সে। অভয় নিশ্চয় এখন রাগে জর্জরিত একটা সিংহ হয়ে রয়েছে! তার সামনে গিয়ে নিজে কিছুতেই বলি হবে না ঐশানী। রুমে এসেই দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় ঐশানী। আয়নায় চোখ লাগিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। চোখ বড় বড় করে বলে…..
–“তোর সাহস দেখে জাস্ট অবাক ঐশানী। কবে থেকে এতো বড় সাহস হলো তোর? তোর চেহারার তো পরিবর্তন হয়নি! কিন্তু সাহসিকতার এতো পরিবর্তন হবে ভাবিনি।”

কথাগুলো শেষ হতে না হতেই রুমের লাইট ওফ হয়ে গেল। থতমত খেয়ে অন্ধকারে আশেপাশে তাকায় ঐশানী। লাইট বন্ধ হলো নাকি কারেন্ট গেল? আশেপাশে হাতাতে হাতাতে দরজার কাছে যেতেই যখনই বেরোতে নেবে ঝড়ের গতিতে একজন ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিল। আগন্তুক ব্যক্তিটার সাথে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিল ঐশানী। তবুও নিজেকে সামলে নেয় সে। এভাবে অসভ্যের মতো কে তার ঘরে ঢুকল ভেবেই পাচ্ছে না সে।
–“এই কে? কে এলো আমার ঘরে আমার পারমিশন ছাড়া?”
ঘরে থাকা মানুষটা জবাব দিল না। ঐশানীর কাঁধে কারো হাত পড়তেই লাফিয়ে ওঠে সে। সরে যেতেই মানুষটা তার কোমড় টেনে কাছে আসে।

বর্তমানে মানুষটাকে মোটেও আগন্তুক মনে হচ্ছে না তার। লোকটা তার চেনা। কেঁপে উঠতেই লোকটা নিজের গালের সঙ্গে ঐশানীর গাল চেপে ধরে। নড়াচড়া করেও ছাড় পেলো না ঐশানী।
–“দুইবছরে সাহস ভালোই বেড়েছে তোমার। ভালোবেসে হলুদ মাখাতে পারতে। কিসের ক্ষোভ প্রকাশ করলে এভাবে হু? রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করার কথা আমার। আর উল্টে তুমি রাগ ঝাড়ছো? দ্যাটস নট ফেয়ার! আজকে এই পর্যন্তই থাক। বাড়ি ভর্তি মেহমান। এই হিসেব তোলা রইল। কাল রাতে গুনে গুনে শোধ তুলব বউ।” (থুঁতনি জোরে চেপে ধরে)

ঐশানীর বুঝতে দেরি হয় না ব্যক্তিটা কে। ঢক গিলে কিছু বলতেই ব্যক্তিটা তাকে ছেড়ে ঝড়ের বেগেই বেরিয়ে যায়। ঐশানী হা করে তাকিয়ে থাকতেই লাইট চলে আসে। আয়নার দিকে তাকায় সে। তার গলায়, গালে আর ঠোঁটের পাশে হলুদের ছোঁয়া। না চাইতেও সুখকর অনুভূতি খেলে যায় তার মনে। সে কি পুনরায় ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছে?

সকাল হতে না হতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। কোনোরকমে সকালের নাস্তা করেই হুড়মুড় করে ঐশানী ঢুকে পড়ে ঐশীর ঘরে। সেখানে ঐশীকে রেডি করানো হচ্ছে। রেডি করানো হচ্ছে বললে ভুলই হবে। কেননা ঐশী ঐশানীর জন্যই বসে ছিল। ঐশানীর আসতে দেরি হলো কারণ সে মন দিয়ে অভয়কে খুঁজেছে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু পায়নি। লোকটা কোথায় কে জানে!
–“তোর এতোক্ষণে সময় হলো আসার? জানিস কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি? আয় তোরে বউ সাজা….”
ঐশী রিনির হাতে চিমটি দিতেই মুখে কুলুপ এঁটে দেয় রিনি। সে মাঝেমধ্যেই বেফাঁস কিছু বলে ফেলে।

ঐশানী ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সন্দিহান হয়ে বলে…..
–“আমাকে বউ সাজিয়ে দিবি মানে? বিয়ে তো ঐশীর তাই না?”
–“আরে বান্ধবী, রিনির মুখের ব্যালেন্স নেই। ওর কথা কেন বিশ্বাস করিস বল তো? আয় ঐশীকে তৈরি করায় সবাই মিলে।”
দিয়া বলেই বোকা হাসি দিয়ে শাড়ি তুলে ধরে। সকলে মিলে ঐশীকে তৈরি করাতে শুরু করে। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে ওকে রেডি করানোর এক পর্যায়ে ঐশী মেঘনাকে ইশারা করতেই মেঘনা মাথা নাড়িয়ে আলমারি থেকে আরেকটা বেনারসি বের করে। তা খেয়াল করে ঐশানী ব্যস্ত কন্ঠে বলে….
–“এটা কার জন্য?”

–“তোর জন্য। আয় তোকে তৈরি করিয়ে দিই।”
ঐশানীকে টেনে বলে রিনি। ঐশানী হাত ছাড়িয়ে বলে…..
–“আমার জন্য মানে? আমি বেনারসি পড়ে কি করব?”
–“আরে পড় না। আজ আমরা সবাই বউ সাজব। আজ আমরা ঐশীর হবু বর মানে রিত্তিক জিজুর পরিক্ষা নেব। ঐশীকে উনি চিনতে পারেন কিনা সেটাই টেস্ট নেব।”
দাঁত কেলিয়ে বলে দিয়া। ঐশানী মানা করলেও সকলে মিলে জোর করেই ওকে তৈরি করিয়ে দেয়। জোরাজুরিতে ঐশীও বাদ ছিল না। ঐশানীর বোঝার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু।

ঐশানীকে রেডি করানোর পরে বাকি সকলে রেডি হতে বাইরে চলে যায়। ঐশীর ঘুম পাচ্ছে। সে ভাবছে তার বোনের মতো অবস্থা আবার না হয়! ঐশানীকে সে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল….
–“আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি থাক।”
ঐশী গিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। ঐশানী কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাবে তার বোনের বিয়ে সে যদি এভাবে বসে থাকে তবে কি তার চলবে? বাহির থেকেও কয়েকবার তার ডাক এসেছে। এই ভেবে বেরিয়ে বাইরে বের হয় সে। দ্বিতীয় ফ্লোরে তেমন কোনো লোকের আনাগোনা নেই। সামনে এগোতেই রিনি আর দিয়াকে দেখতে পায় সে। কানে আসে ওদের কথোপকথন।
–“হায় আমাদের বান্ধবীর কি ভাগ্য! ওর সেকেন্ড বিয়ে হতে চলেছে নিজের বোনের সাথে। আর আমার একবারও হলো না।”

–“আমার তাও একবার হয়েছে। একটা কাজ করি তুই তোর পছন্দমতো পাত্র ধরে নিয়ে আয়। আমিও আমার বরকে নিয়ে আসি। সবাই একসাথে বিয়ে করে ফেলি। আইডিয়াটা কেমন?”
দিয়ার জবাবে রিনি দাঁত কেলিয়ে বলে। অন্যদিকে ওদের কথোপকথনে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় ঐশানীর। সেকেন্ড বিয়ে মানে? আবার কার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায় সবাই? অভয়ের সঙ্গে তো তার বিয়ে হয়েছিল এখনো তাদের ডিভোর্সও হয়নি। অভয়কে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে দেওয়া প্লানিং করছে না তো? মাথাটা ভনভন করে ওঠে ওর। দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে অন্যপ্রান্তে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে।

–“আমি অন্যকারো সাথে বিয়ে করতে পারব না। আমি উনাকে এখনো ভালোবাসি। আমি সেকেন্ড বিয়ে করব না। তার থেকে ভালো আমি পালিয়ে যাব।”
কথাগুলো বলতে বলতে করিডোরের শেষপ্রান্তে এসে কারোর সঙ্গে ধাক্কা খায় ঐশানী। মুখ তুলে চেয়ে অভয়কে দেখেই আগপাছ না ভেবে জড়িয়ে ধরে সে। অভয় কয়েকধাপ পিছিয়ে গিয়ে ঐশানীর কর্মকান্ডে মুচকি হাসে।
–“কি ব্যাপার? হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না।”

ঐশানী অভয়ের শেরওয়ানি খামচে ধরে কান্নারত অবস্থায় বলে…..
–“ওরা আমাকে আবার বিয়ে দেবে। আমি বিয়ে করব না। আমি তো এখনো আপনার স্ত্রী বলুন? আমি অন্যকাউকে বিয়ে করব না। সবাইকে বলে দিন না প্লিজ।”
অভয় ঐশানীর কথা শুনে মুচকি হাসে। মেয়েটা হয়ত কারো অল্প কথোপকথন শুনে ভুলভাল বুঝে ফেলছে। অভয়ের প্লানই তো ছিল এটা। ঐশানীকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায় সে। কিন্তু ঐশানী ভাবছে তার সঙ্গে অন্যকারো বিয়ে হচ্ছে। এই বিষয়টার সুযোগ উঠালে মন্দ হবে না।

অভয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলে….
–“আমি কি করে? তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছ। বিয়ে করে ফেলো।”
–“না না। আমি করতে পারব না। আপনি ছাড়া অন্য কাউকে নিজের বর রুপে দেখতে পারব না।”
অভয় বাঁকা হেসে বলে…..
–“একটা শর্তে অন্যের সঙ্গে বিয়েটা আটকাতে পারি।” (চাপা হেসে)
–“সব শর্ত মানব আপনি বলুন।”
উত্তেজিত হয়ে বলে ঐশানী। অভয় থমথমে গলায় বলে…..
–“আবার বিয়ে করতে আমাকে। পারবে?”
–“হ্যাঁ পারব পারব। আপনাকে দুইবার কেন দুহাজার বার বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু অন্য কাউকে কখনোই নয়। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি রাজি।”

চলবে…..