বেলির কথা পর্ব-০৪

0
270

#বেলির_কথা (০৪)
.
.
‘বেলিফুল?’
‘আব্বা।আপনি এসেছেন?আমি জানতাম আপনি আমারে ছেড়ে যেতে পারেন না।’
‘আচ্ছা আমার মেয়ে রাগ করেছে?’
‘হ্যা করেছি তো রাগ খুব করে রাগ করেছি।’
‘আচ্ছা আর যাব না আমি।চল আমরা ঘুরতে যাই?’
‘সত্যি?’
‘হ্যা চল?’

বেলি বাবার সাথে হাটা শুরু করে।হাটতে হাটতে একটা সুন্দর ফুলের বাগানে চলে আসে।এত সুন্দর বাগান দেখে বেলি খুশি হয়ে দৌড় দেয়।সেখানে বড় রাজপ্রাসাদ ও আছে।
‘এত সুন্দর এটা কোন জায়গা আব্বা?’ বেলি প্রশ্ন করে।

কিন্তু খেয়াল করে তার আব্বা নেই।বেলি ডাকা শুরু করে,
‘আব্বা।’
তারপর ডাকে,
‘আম্মা, ভাই?’

অথচ কেউ সাড়া দেয় না।বেলি কেঁদে উঠে,
‘এত সুন্দর বাগানে আমি একা কি করবো?তোমরা কেউ আমার কথা শুনছো না?কোথায় চলে গেলে?আব্বায়া’
.
ঘুম ছুটে যায় বেলির।স্কুল থেকে ফিরে এসে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল তাহলে।বেলি কাঁপতে থাকে।বেলির মা বাহির থেকে এসে বেলির হাত ধরে,
‘কি হলো খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?’
‘না আব্বাকে স্বপ্নে দেখেছি আজ।’

বেলির মা মেয়ের মাথায় বুলিয়ে বলে,
‘তোর আব্বার জন্য এত না কেঁদে যেখানে আল্লাহ নিয়ে গেছেন সেখানে ভাল থাকার জন্য বেশি বেশি দোয়া কর।বুঝলি?’
‘জানো আজকে আব্বার বন্ধু জলিল কাকার সাথে দেখা হয়েছিল।’

জলিল নামটা শুনতেই বেলির মায়ের চেহারা বদলে গেলো।বেলি আগেও যতবার এ নাম বলেছে ততবার মায়ের চেহারা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেছে।
‘তোকে কতবার বলেছিলাম,অই মানুষটার সাথে কথা বলবি না,তার ধারেকাছে ও যাবি না?’
‘কিন্তু কেন?উনি ত আমার আব্বার বন্ধু ই।উনাকে দেখলে আব্বার মতো মনে হয়।’
‘বেলি ই?’
‘আচ্ছা আম্মা আর বলব না উনার কথা।’

বেলি মাকে জড়িয়ে ধরে।
‘তবে জানো মা কাকার এক্সিডেন্ট হয়েছিল।হাত একটা কেটে ফেলেছে।আরেকটা দিয়ে কিছুই করতে পারেনা।বড় দুঃখে আর অভাবে সংসার চলছে।’

বেলির মা চুপ করে থাকে।
_____
বেলি এখন টুকটাক ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে।রান্নাবান্না প্রায় শিখেই ফেলেছে।তবের বেলির রান্না করতে একদম ই মন চায় না তখন মা বলে,
‘মেয়ে যখন হয়েছিস ঘরোয়া কাজে যত পটু হবি ততই ভালো।সারাজীবন তো আর আমার কাছে থাকবি না?’

বেলি মন খারাপ নিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,
‘খবরদার বিয়ের কথা বলছো তো আমি কিছুই খাবনা।’

বেলির মা হাসে।আর বলে,
‘এখন মা আছে বলে বিয়ে করবি না বলছিস।মা না থাকলে তখন কিভাবে সব উলটপালট লাগে বুঝতি।’


গ্রামের অনেক মহিলা আসে বেলির মায়ের কাছে কাপড় সেলাইয়ের জন্য।সংসারের কাজের পাশাপাশি বেলির মা কাপড় ও সেলাই করেন।

আজকে একজন কাপড় নিতে এসে বেলির মাকে বেলির বিয়ের সম্পর্কে বুঝায়।
‘শোনো বেলির মা! এখন থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য চেষ্টা করো তোমার মেয়ের গায়ের রঙ যে চাপা।’

বেলির মা চুপ থাকে।তবু ও মহিলা বলে,

‘বেলির জন্য পাত্র আছে আমার কাছে।মেয়ের বয়স অল্প থাকতে বিয়ে দিয়ে দেয়া দরকার।’

বেলির মা তবুও চুপচাপ কাজ করেন।এমন পরিস্থিতি বেলির মায়ের জীবনে ও এসেছিল এসব নতুন বিষয় না।
এসব গ্রামের মানুষ দের কথা।তাদের মতে কুড়ি পার হয়ে যাওয়া মানে মেয়ে বুড়ি।আর বুড়িকে কেউ পছন্দ করেনা।

বেলির মাকে চুপ থাকতে দেখে মহিলা বলেন,
‘একদিন খুবই পস্তাবা।’

বেলির মা জবাব দেয়,
‘মেয়েকে আমি পড়াবো।তাছাড়া ওর বয়স এখন পনেরো ও হয়নি, এখন কিসের বিয়ে?’

মহিলা মুখ ভেঙ্গায়।বেলির মা আবারো চুপ থাকেন।আর নিজের কাজে মন দেয়।
মহিলাটি কাপড় নিয়ে চলে যায়।

মহিলা যাওয়ার পর বেলিকে ডাক দেয়,
‘বেলি এদিকে আয়?’
‘আসছি আম্মা।’

বেলি আসতেই বেলির মা একটা খাতা বের করেন।সেখানে সেলাই কাজ শেখার পদ্ধতি লিখা আছে।

বেলির হাতে দিয়ে বলে,
‘মেয়েদের সব কাজ শিখে রাখা ভালো।কার জীবন কেমন যায় কেউ ই বলতে পারেনা।আমি তোকে কিভাবে সেলাইয়ের কাজ করতে হয় শিখিয়ে দিবো।সুন্দর সুন্দর নকশা করা শিখিয়ে দিবো।’

মায়ের কথায় রাগ স্পষ্ট কিন্তু কার উপর এত রাগলো বুঝা আসলো না বেলির।
.
বেলি এখন বড় হয়েছে।বেলির মায়ের চিন্তার শেষ নেই।বেলি স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো।তখন মা কাছে টেনে বলে,
‘সাবধানে যাস?আর পারলে ছেলেদের সাথে তেমন কথা বলিস না।’

বেলি একবার ভাবছে রামিম এর কথা বলে দিবে।আবার ভাবলো না থাক।
.
স্কুলে পৌছতেই দেখে রামিম দাঁড়িয়ে।দেখে বুঝা ই যাচ্ছে বেলির জন্য অপেক্ষা করছে।
বেলি নিজের ক্লাসে ডুকতেই রামিম পথ আটকায়।বেলি ভয় পেয়ে বলে,
‘কি হয়েছে ভাইয়া এমন করে দাঁড়ায় আছেন কেন?’
‘কেন তুমি জানোনা?আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি যে?’
‘কি প্রশ্ন?’
‘বুঝোনা?’
‘আমি এখানে পড়ালেখা করতে এসেছি।তাছাড়া আমি আমার আম্মাকে ভাইকে ভালবাসি,কিন্তু আপনাকে কেন ভালবাসতে যাবো?’
‘তুমি তো দেখছি বাচ্চাদের মতো কথা বলছো?’

বেলি চুপ করে থাকে।
‘কি হলো?’
‘আমি পড়তে এসেছি।আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।’
‘প্লিজ বেলি আমার কষ্ট টা বুঝো?’
‘আপনি ও পড়তে এসেছেন, পড়ায় মন দেন।’

বেলি চলে যায়।দূর থেকে রিয়া দাঁড়িয়ে ছিল।সে এসে রামিমকে বলে,
‘বেলি কখনো আপনার চোখের ভাষা বুঝবে না।ও কতটা হিংসুটে আমি জানি।আসলে কালো মেয়েদের মন ও কালো হয়।’

রামিম চুপ করে থাকে।রিয়া কিছু একটা বলতে গিয়ে ও থেমে যায়।
.
ক্লাস শেষে বেলি চুপচাপ বাড়ি চলে আসে।মন খারাপ করে আছে।বিছানায় গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে আর ভাবে,
রামিমকে কি কষ্ট দিয়ে ভুল করছে?কিন্তু এখন সে প্রেমে জড়াতে চায় না।

বেলির মা বেলিকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দেখে বেলি চুপচাপ। মেয়েকে মনমরা থাকতে দেখে বলে,
‘খাবিনা?’
‘খাব আম্মা।আসছি?’
‘মন খারাপ?আমাকে বলা যায় না?’

বেলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
‘হ্যা আম্মা আমার মন খারাপ।’

বেলির মা বলে,
‘আমি তোর মা তোকে দেখে সব বুঝতে পারি।আয় আগে খেয়ে নে?সেই কবে সকালে খেয়ে গেছিস?মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।এতবেলা না খেয়ে পারিস ও বটে।’

বেলি মুচকি হাসে।
‘ও হ্যা তোর ভাই আম পেড়েছে।তুই পাকা আম পছন্দ করিস বলে লাল লাল দেখে ই পেড়েছে।’

পাকা আমের কথা শুনে বেলির মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।
‘ভাই কোথায়?’
‘বাজারে গেছে।ও খেয়েই গেছে।তুই তাড়াতাড়ি আয়?’

বেলি ও তার মা খেয়ে তারপর দুজনে বারান্দায় বসলো।
‘বল কেন মন খারাপ করেছিলি?’
‘তোমাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলবো বলবো বলে ভাবছি।’
‘কি কথা?’
‘চেয়ারম্যান চাচার ছেলের আছে না?অই যে আমি গোবর…?’

বেলির মা হাত দিয়ে বেলিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘তারপর?’
‘তার নাম রামিম।সে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে?কিন্তু আমি বলেছি এখন পড়ালেখার বয়স?আমি প্রেম না বুঝার ভান করেই থাকি।আমি নাকি ওকে কষ্ট দিই?তবে কি আমি ভুল করছি?’

বেলির মা হাসে।
‘হাসো কেন আম্মা?’
‘তুই কি প্রেম করতে চাস?’
‘আম্মা?আমি চাই সমাধান আর তুমি?’
‘বল না?’
‘নাহ।’

বেলির মা মেয়ের হাত ধরে বলে,
‘ওরা গরীবদের ভালবাসতে জানেনা রে?’
‘মানে?’
‘ওরা বড়লোক আমরা গরীব।এমন কি হতে পারে না একদিন তোকে গরীব বলে অবহেলা করবে?’
‘কিন্তু ওর ভালবাসা খাটি।’
‘তাহলে সে খাটি ভালবাসা কোথায় যায় যখন পরিবারের দোহাই দিয়ে ছেড়ে যায়?রামিমের বাবা মা কেউ জানে?তাদের রাজি করিয়েই কি ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছে?কি নিশ্চয়তা তোকেই বিয়ে করবে?তোরা বোকা বলেই এদের মনপ্রাণ দিয়েই বিশ্বাস করিস।আর ওর কষ্ট।কিসের কষ্ট ওর,এখন সে আবেগ থেকে এসব বলছে।সময়ের উপর ছেড়ে দে সব।সত্যি ভালবাসলে সঠিক সময়ের জন্য সে অপেক্ষা করবে।
দেখ ভাগ্য কি থাকে?ভাগ্য থাকলে ও তোকে পাবে বউ হিসেবে,তবে প্রেমিকা হিসেবে কখনো নয়।’

বেলি চুপ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।বেলির মা বলে,
‘পড়ালেখায় মন দে?তোকে অনেক বড় হতে হবে,শিক্ষিকা হতে হবে তোকে।যদি ভালবাসা মনে এসে থাকে,যদি ভালবাসা বেশি হয়ে থাকে জমিয়ে রাখ।নিজের স্বামীর জন্য জমিয়ে রাখ। স্বামীকে ভালবাসবি অন্যকোনো পুরুষদের নয়।’

বেলি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলে,
‘যে মেয়ের মা বন্ধুর মতো।যে মেয়ে তার মাকে মন খুলে কথা বলতে পারে?সে মেয়ের আর যাইহোক মন খারাপ থাকতে পারেনা।সে কি অভাগ্যবতী হতে পারে?নিঃসন্দেহে সে ভাগ্যবতী আম্মা।’

চলবে….

#তাহরীমা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে থাকা উচিৎ)