ভয় পর্ব-০২

0
255

গল্পঃ #ভয় ( ২য় পর্ব )

আজ অভ্র কাছে আসতে চাওয়া মাত্র আঁতকে উঠলাম, তাহলে কি এই রাতটাই অভ্রর জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে?!

দাদী বলেছিল আমার বিয়ের পরে ফুলশয্যা রাতে দুজন দুজনের একান্ত কাছে আসার পরে নাকি বরের মৃত্যু হবে। কিন্তু আজ তো ফুলসজ্জা রাত নয়। ফুলশয্যা ফেলে এসেছি সেই কবে। তারপরও কি আজ একান্ত কাছাকাছি গেলে অভ্রর মৃত্যু হবে!

এসব ভাবতেই আমার শরীরের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে যেন। আজ কীভাবে ফেরাবো অভ্রকে, ও আবার ভুল বুঝবেনা তো!

এসব চিন্তায় আমার আমার অবস্থা নাজেহাল। টেবিলের ওপর জগ থেকে পারাপার দুই গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম।

অভ্রর সামনে যতই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছি ততই অস্বাভাবিকতা বেড়ে যাচ্ছে আমার। অভ্র কিন্তু এসব এতক্ষণ ঠিকই খেয়াল করেছে কিন্তু কিছু বলেনি।

এবার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো– আর কতদিন এভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে বলো তো, আমার যে ভীষণ ইচ্ছে হয় তোমাকে কাছে পেতে, আদরে আদরে তোমায় ভরিয়ে দিতে। আচ্ছা তুমি কি ভয় পাও এসবে?

আমি মজার ছলে বললাম– আদরে আমার এলার্জি আছে তাই।

আমার কথা শুনে অভ্র হেসে ফেলে বললো– জীবনে এই প্রথম শুনলাম আদরেও এলার্জি থাকে।

আমি ইচ্ছে করেই একটু ফান করলাম স্বাভাবিক হবার জন্য এবং মোটামুটি সাকসেস।

অভ্র বললো– আচ্ছা তাহলে ফার্মেসী থেকে ঘুরে আসি।

: এত রাতে ফার্মেসীতে কি তোমার?

: এলার্জির অষুধ আনতে যাবো তোমার জন্য।

: মানে?

: মানে হলো আগে তোমাকে এলার্জির ওষুধ খাইয়ে তারপর আদর করবো।

এবার অভ্রর কথা শুনে আমার হেসে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা।

হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বললাম– আচ্ছা অভ্র ওসব ছাড়া কি ভালোবাসা হয়না?

অভ্র স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো– কেন হবেনা, কিন্তু ওসবও তো ভালোবাসার একটা অংশ, ভালোবাসা আরও মধুর করে তোলে। আর এটা তো এখন অবৈধ বা পাপ নয়, আমরা স্বামী স্ত্রী এখন।

: তবুও যদি বলি আমাদের ভালোবাসা বন্ধন ওসবের বাইরে হোক।

: আরে পাগলী তাহলে তো তুমি আম্মু ডাক আর আমি আব্বু ডাক থেকে বঞ্চিত হবো।

অভ্রর যুক্তির কাছে আমি পরাজিত, আম্মু ডাকটাই তো একজন নারীর জীবনের পরিপূর্ণতা, এখানেই আমরা দূর্বল।

আমি যে কেন এবং কোন ভয়ে দূরে সরে থাকছি সেটা আমি ভালো জানি। নয়তো অভ্রকে আমারও একান্ত কাছে পাবার ভীষণ ইচ্ছে যাকে, অভ্রর আদরে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। প্রাপ্তবয়স্ক একটা মেয়ে আমি কিন্তু ভয়টা তো প্রিয়জনকে হারানোর। একান্ত কাছাকাছি এবং আদর সোহাগের ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে হলেও অভ্রর প্রাণে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরী। আমি কিছুতেই ওকে হারিয়ে বাঁচতে পারবোনা।

আমার ডান পায়ের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি জোড়া, ওটাই নাকি এসবের কারণ। আমার ওপর নাকি অদৃশ্য শক্তির নজর আছে।

ছোটবেলায় একবার– ছোটবেলা বলতে তখন বয়স নয় বছর হবে। দুপুরবেলা আব্বুর জন্য চালভাজা নিয়ে রাস্তায় যাবার সময় জবা ফুলগাছের নিচে বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর বেশ কয়েকদিন নাকি আমি অস্বাভাবিক ছিলাম। এরপর একজন নামডাকওয়ালা হুজুরকে বাড়িতে আনে আব্বা। হুজুর আমাকে একটা তাবিজ দিয়ে যায় এবং আব্বাকে বলে উঠোনের কোণের তেঁতুলগাছটা কেটে ফেলতে, ওখানেই নাকি তেনাদের আস্তানা।

আব্বা সেইদিনই তার শখের গাছটা কেটে ফেলে।

ভূত প্রেত এসবে আমি বিশ্বাস করিনা কিন্তু মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু বিষয়ও লক্ষ্য করেছি কয়েকবার আমাদের বাড়িতে। রাত গভীরে হঠাৎ শরীর ভারী হয়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া। ঘুমের মধ্যে ফিসফাস শব্দ শোনা। তাছাড়া এমনিতেই আমার সবসময় কেমন মনে হতো আশেপাশে কেউ রয়েছে। সেই কারণে মুরব্বিদের বলা কথা একেবারেও ফেলে দিতে পারিনা।

আমাকে চুপচাপ দেখে অভ্র আমাকে জড়িয়ে ধরতেই রুমের জানালার কপাট খটাস করে আচানক খুলে গিয়ে হুহু করে রুমের মধ্যে হাওয়া ঢুকে আমাদের দুজনকেই ছুয়ে গেল যেন।

আমি আর অভ্র দুজনেই অবাক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছি।

অভ্র পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুচকি হেসে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো– ভয় পেয়োনা আবার, বাতাসের তোড়ে জানালার কপাট খুলে গেছে। দাড়াও বন্ধ করে আসছি।

অভ্র উঠে গিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে এসে আমার পাশে বসলো।

বাইরে হঠাৎ করে বাতাসের তান্ডব বাড়তে শুরু করছে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে সেই সাথে মেঘের গর্জন। ক্ষাণিক আগের মেঘমুক্ত আকাশ এখন কালো মেঘের কাছে বন্দি। ঝড় শুরু হয়েছে, বাতাসে গাছের শুকনো ডালপালা মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিকে।

এই বাড়িটা শহরের কাছাকাছি হলেও বাড়ির মালিক গ্রামের বাড়ির মতো করেই সাজিয়েছে। সামনে বিশাল পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট, পেছনে বিশাল বাগান। বাড়ির চারপাশে নানারকম ফলের গাছে ঘেরা। বাড়ির ডানপাশে আরেকটা বাড়ি। ঐ বাড়ির লোকজনকে কখনও এবাড়িতে আসতে দেখিনি।

আমি আর অভ্র যখন পালিয়ে এসে বিয়ে করে থাকার জন্য ভাড়া বাসা খুজছিলাম তখন একজন আমাদের এই বাড়ির সন্ধান দিয়েছিল। সুন্দর সাজানো গোছানো পরিপাটি বাড়ি, আবার ভাড়াও কম।

এই বাড়িতে আসার পরে আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয় এক বৃদ্ধ চাচা। বয়স প্রায় সত্তর পচাত্তরের মাঝামাঝি। চুলদাড়ির সাথে পাকা ভ্রুতে বেশ অদ্ভুত লাগছিল চাচাকে। চাচা আমাদের জানায়– এ বাড়ির মালিক স্ব পরিবারে অনেক বছর আগে লন্ডন চলে গেছে বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্ব তাকে দিকে। সেই থেকে সে এই বাড়ির দেখাশোনা করে আসছে। এই বাড়ি থেকে চাচার বাড়ি প্রায় দুই কিলোমিটার, পায়ে হেটে আসতে যেতে হয়। এই বয়সে এখন এটা কষ্টকর। তাই তিনি চান বাড়িটা কারো কাছে ভাড়া দিতে যারা এখানে থাকবে এবং বাড়িটার দেখাশোনা করবে।

আমি প্রশ্ন করলাম– তাহলে আপনি কেন আপনার পরিবার নিয়ে এতসুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িতে থাকছেননা?

চাচার চোখেমুখে কেমন অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো, তিনি কথা ঘুরিয়ে বললেন– তোমরা যদি থাকতে চাও তাহলে এখানে নিরিবিলি থাকতে পারো। অল্প কটাকা ভাড়া দিলেই চলবে। আর হ্যা পুকুরপাড়ের ঐ রক্তজবা গাছের বাগানটার দিকে তেমন যেওনা।

রক্তজবার বাগানের কথা শুনে খটকা লাগলেও যেহেতু আমরা পালিয়ে এসেছি, অভ্রর পকেটেও তেমন টাকাকড়ি নেই তাই এতবেশী না ভেবে আমরা এই বাড়িতে বসবাস শুরু করলাম। চাচারও যেন কষ্ট লাঘব হলো। এখন মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যায়।

সেই থেকে আমরা এই নিরিবিলি অদ্ভুত বাড়িতে আছি দুজন।

বাইরের বাতাসের গতি যেন বেড়েই চলছে সেই সাথে তাল মিলিয়ে ঝুম বৃষ্টি।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। পুরো রুম জুড়ে মৃত্যুপুরীর অন্ধকার। অভ্র মোবাইলের ফ্লাস জ্বালিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে হারিকেনের ফিতায় আগুন ধরিয়ে চিমনি লাগাতে লাগাতে বললো– আজ এই রোমান্টিক ওয়েদার কিন্তু প্রকৃতি আমাদের উপহার দিয়েছে বউ, মিস করা যাবেনা। এই ওয়েদার কাছে আসার এবং ভালোবাসার।

এদিকে আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করেছে, সত্যি যদি অভ্র কাছে আসতে চায়।

হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় পুরো নব্বই দশকের ফিল পাচ্ছি, মনে হচ্ছে আমরা অনেকটা সময় পিছিয়ে সেই সোনালী যুগে চলে এসেছি। বেশ দারুণ লাগছে ব্যপারটি। এবাড়ির মালিক হয়তো খুব সৌখিন, পুরনো আমলের অনেক কিছুই বেশ যত্নে সংরক্ষিত আছে এ বাড়িতে।

হারিকেনর তেজ বাড়িয়ে মোবাইলের ফ্লাস জ্বালিয়ে অভ্র চলে গেল কিচেনে। বেশ কিছুক্ষণ পরে দুই হাতে দুই কাপ গরম গরম চা নিয়ে ফিরলো। আমি দেখে ভীষণ অবাক।

অভ্র মুচকি হেসে বললো– এরকম রোমান্টিক ওয়েদারে সবাই বউয়ের হাতের গরম গরম চা খেতে চায়। কিন্তু আমি আমার হাতে চা বানিয়ে বউকে খাওয়াচ্ছি। একটু তো ডিফরেন্ট হওয়া উচিৎ বলো। তোমার জামাই বলে কথা।

আমার এত আনন্দ অনুভব হলো বলে বোঝানো অসম্ভব, সবাই তো এরকম একটা কেয়ারিং হাসব্যান্ড এর সপ্নই দ্যাখে। সেই হিসেবে অভ্রকে পেয়ে আমি নিজেকে সবসময় ভাগ্যবতী মনে করি।

অভ্র খাটের পাশের জানালার কাছে গিয়ে বসে আমায় ডাকলো। আমি গিয়ে অভ্রর গা ঘেঁষে বসলাম। একটা পাতলা কাঁথা টেনে অভ্র আমাদের দুজনের গায়ে জড়িয়ে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো। তারপর জানালার কপাট খুলতেই হুহু করে বাইরের বৃষ্টি ভেজা শীতল হাওয়া ভেতরে এসে আমাদের শীতল স্পর্শে ছুয়ে দিতে লাগলো।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি অভ্রর দিকে, কত সুনিপুণ ভাবে প্রকৃতির সাথে নিজের অনুভূতি মিশিয়ে মুহূর্তগুলো স্বর্গ সুখের করে তুলেছে অভ্র।

আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে অভ্র আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো– মুহুর্ত গুলো গরম গরম ধোঁয়াওঠা চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে উপভোগ করো বউ, এত ভাবনায় ডুবলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।

বাইরে ঘোর কালো অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকানোর ক্ষণস্থায়ী আলোর লুকোচুরি, মেঘের গর্জনে পৃথিবী কেঁপে উঠছে ক্ষানিক বাদে বাদে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য আর ধোঁয়াওঠা চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই যে।

আমি খেয়াল করছি অভ্র ধীরে ধীরে আমাকে জড়িয়ে নিচ্ছে, ঠিক এমন সময় পেছনে টেবিলের ওপর রাখা হারিকেনটা হঠাৎ স্ব শব্দে মেঝেতে পড়ে চিমনি ভাঙ্গার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। আমরা দুজনেই লাফিয়ে উঠলাম। ভয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম…

চলবে…

লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।