ভয় পর্ব-০৪

0
222

গল্পঃ #ভয় ( ৪র্থ পর্ব )

আয়নায় তাকাতেই এক পলকের জন্য আমার ঠিক পেছনে ভয়ঙ্কর একটা মুখচ্ছবি দেখে আঁতকে উঠে একনজর অভ্রর দিকে তাকিয়ে আবার আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম না কেউ তো নেই।

আমাকে বিচলিত দেখে অভ্র জিজ্ঞেস করলো– কি হয়েছে?

আমি মিথ্যা হাসি হেসে বললাম– না কিছু হয়নি।

রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা।

সারা বিকেল ঘুরে শপিং করে ফিরতে রাত হলো।

দুজনেই ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে টিভি দেখছি। অভ্র বললো– বউয়ের হাতের এককাপ চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব।

আমি উঠে কিচেনে চলে এলাম। গ্যাসের চুলোয় ছোট পাতিল বসিয়ে পানি ঢেকে চুলোয় আগুন ধরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই লাফিয়ে উঠলাম আমি। অভ্র কখন এসে দাড়িয়েছিল টেরই পাইনি।

অভ্র মুচকি হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে কয়েকটি চুমু খেয়ে বললো– ভীতু একটা।

আমি পুরো অবাক, অভ্র এভাবে কখনও ঘাড়ে চুমু খায়নি এর আগে কোনদিন।

আমি বললাম– বউকে আদর করা শেখার নতুন কোনো কোর্সে ভর্তি হলে নাকি মিস্টার জামাই?

অভ্র মুচকি হেসে বললো– এমন বউ থাকলে নতুন নতুন আদর আবিষ্কার করতে কোথাও যেতে হয়না, মন থেকে এসে যায়।

– বাব্বাহ কত্ত রোমান্টিক আমার জামাই – বলে আমি ঘুরে দাড়িয়ে গ্যাসের পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে অভ্রকে বললাম– এখানে দাড়াও আমি ড্রইং রুম থেকে মোবাইলটা নিয়ে আসছি।

অভ্রকে কিচেনে রেখে আমি ড্রইং রুমে এসে ভীষণ শক খেলাম। অভ্র তো ড্রইং রুমে বসেই টিভি দেখছে, যেখানে দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই সেভাবে বসে আছে।

আমার বুকের ভেতর ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিচেনে যে অভ্র ছিল তাহলে সে কে? আমার আগেই বা কীভাবে আবার ড্রইং রুমে আসবে? দৌড়ে আসতে হলেও তো আমার পাশ কাটিয়ে আসতে হবে।

আমার হার্টবিট এতটাই বেড়ে চলেছে যেন এক্ষুনি ফেটে যাবে। গলা শুকিয়ে কথা বলার অবস্থা নেই। শরীরটা কেমন কাঁপছে।

অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে বললো– কি ব্যাপার কি হয়েছে তোমার?

আমি নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে অভ্রকে জিজ্ঞেস করলাম– আমি কিচেনে যাবার পরে থেকে তুমি এখানেই ছিলে?

অভ্র উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো– হ্যা এখানেই ছিলাম তোমার অপেক্ষায়, বউ চা নিয়ে ফিরবে তারপর আমি খাবো সেই অপেক্ষায়।

আমার কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে অভ্র আমাকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে বেডরুমে যেতে যেতে বললো– তোমার শরীরটা মনে হয় দূর্বল, এখন আর কিচ্ছু করতে হবেনা চলো ঘুমাবো।

আমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে অভ্র লাইট অফ করার জন্য সুইচ টিপবে এমন সময় মনে পড়লো চুলোয় তো পানি গরম হচ্ছে, চুলা নেভানো হয়নি তখন।

আমি উঠে বসে বললাম– দাড়াও আমার কিচেনে যেতে হবে অভ্র।

অভ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো– আবার কেন?

বললাম– চুলো নেভানো হয়নি এবং কিচেনের লাইটও অফ করা হয়নি।

– তোমার কষ্ট করে যেতে হবেনা, আমি যাচ্ছি – বলে অভ্র রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

শরীরটা একদম ভারী লাগছে। রুম থেকে অভ্র বেরিয়ে যাবার সময় দরজা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে গিয়েছে। হঠাৎ দরজাটা মৃদু আওয়াজ করে অনেকখানি খুলে গেল। বুকশেলফের ওপর থেকে ফুলদানিটা ঠাস করে নিচে পড়তেই ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠলো।

জানালা বন্ধ থাকায় ঘরে বাতাস চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার কথা থাকলেও বাতাসে জানালার পর্দা সেরে গিয়ে আবার স্ব স্থানে আসলো। রুমের দরজাটা মৃদু আওয়াজ করে আবার একাএকা বন্ধ হয়ে গেল।

দরজার ওপাশ থেকে অভ্র দুষ্টুমি করছেনা তো! চেক করার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ক্যাচ করে দরজা খুলে যেতেই আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, অভ্র রুমে ঢুকে অবাক হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো– হঠাৎ কি হলো তোমার, এমন ভয় ভয় কেন করছো?

– এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাড়িয়ে তুমি দরজা খুলছিলে এবং বন্ধ করছিলে – আমি কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।

অভ্র অবাক হয়ে বললো– আমি এমন কেন করতে যাবো? আমি তো এই কিচেন থেকে আসলাম।

কথা শেষ করে আমার হাত ধরে টেনে এনে খাটে বসিয়ে অভ্র আমার পাশে বসে বললো– ইদানীং তুমি ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছো, কোন কারনে কি তোমার মন খারাপ? অথবা কোনো দুশ্চিন্তা থাকলে আমায় বলো।

– আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি অভ্র – আমি বললাম।

অভ্র বললো– তুমি নিজেই চুলা এবং কিচেনের লাইট অফ করে এসে বললে যে ওসব বন্ধ করা হয়নি, এসব কি তোমার অস্বাভাবিক মনে হয়না? আগে তো তুমি এমন ছিলেনা।

অভ্রর কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। আমিতো চুলা নিভাইনি এবং লাইটও অফ করিনি, তাহলে এসব কীভাবে হলো।

আর এতদিন তো সবকিছু ঠিকঠাক ছিল হঠাৎ আজই কেন এসব অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তির মাত্রা বেড়ে গেল।

বারবার আমার মনে হচ্ছে কি যেন একটা নেই আমার কাছে। কিন্তু এসব পরে, আগে অভ্রকে কিছু একটা বলে বুঝ দিতে হবে।

আস্তে করে অভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বললাম– আসলে কেমন একটা হাঁপিয়ে উঠেছি অভ্র, হঠাৎ করে মা বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকছি, যখন মনে পড়ে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। তবুও ব্যপার না, আমার তুমি এবং তোমার যত্ন ও ভালোবাসা হলেই চলবে।

অভ্র আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো– আমি সবই বুঝি, এবং চেষ্টা করবো খুব জলদি আবার আমরা সবাই একত্র হবার।

রুমের লাইট অফ করে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি, অভ্র আমাকে তার বুকে পরম আদরে শিশুর মতো করে জড়িয়ে ধরে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এভাবে চুপচাপ দীর্ঘ সময়। আমি চোখ বন্ধ করে আছি আর অভ্র আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

ধীরে ধীরে রুমের ভেতর একটা দুর্গন্ধ তীব্র হতে লাগলো। অভ্র মনে করেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।অভ্র ধীরে ধীরে উঠে বসলো। বোঝার চেষ্টা করছে দুর্গন্ধটা কোথা থেকে আসছে।

আমি চোখ খুলে জানালার দিকে তাকালাম। মৃদু বাতাসে জানালার পর্দা দুলতে দুলতে হঠাৎ অনেকখানি সরে যেতেই আমি জানালার স্বচ্ছ কাচের ওপাশে ভয়ঙ্কর সেই বিশ্রী মুখটা দেখেই ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কি ভয়ংকর সেই মুখ আর কি ভয়ঙ্কর তার চাহনি। চোখদুটো যেন জ্বলন্ত আগুনের গোলক।

আমি পুনরায় চোখ মেলে তাকানোর আগেই জানালার পর্দা আবার স্ব স্থানে এসেছে। তাই চোখ খুলে আর জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারলাম না।

অভ্র উঠে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে আবার খাটে এসে বললো– কেমন একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ, পেয়েছো তুমি?

আমি ঘুম ঘুম ভান করে উঠে বসে বললাম– কৈ না তো।

অভ্র হিসাব মেলাচ্ছে কিসের দুর্গন্ধ হতে পারে। আর আমি ভাবছি আজ হঠাৎ করে কেন এসব হচ্ছে। আর বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা আমার কাছে নেই।

হঠাৎ গলায় হাত দিতেই চমকে গেলাম! ছোটবেলায় হুজুরের দেয়া সেই তাবিজটা কোথায় গেল আমার গলা থেকে।

তাহলে কি গলার হার খোলার সময় হারের সঙ্গে তাবিজটাও খুলে রেখেছি?!

উঠে গিয়ে আলমারি খুলতেই প্রাণে পানি ফিরে পেলাম। তাবিজটা হারের সঙ্গে পেচিয়ে আছে। তাবিজটা গলায় পরে লাইট অফ করে এসে অভ্রকে টেনে শুইয়ে ওর গলা ধরে শুয়ে পড়লাম।

তারপরে আর তেমন কোনকিছু টের পাইনি, এক ঘুমে সকাল।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল সুন্দর ভাবে।

এই কদিনে অভ্রও আর আমার একান্ত কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেনি।

আজ ভরা পূর্ণিমা রাত, চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় স্বর্গীয় রূপ ধারণ করেছে পৃথিবী। পুকুরের পানিতে চাঁদের প্রতিফলন যেন হাত ইশারা করে ডাকছে আমায়। এমন রাতে নিজেকে ঘরে আটকে রাখা যে দায়।

আমাকে জানালার পাশে দাড়িয়ে আনমনে আকাশ পানে চেয়ে থাকতে দেখে অভ্র পেছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো– প্রকৃতির এই মায়াবী রূপের সবটুকু উপভোগ করতে চাইলে ঘর থেকে বের হতে হবে তো। চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।

আমি আগেপিছে ভাবার আর অবকাশ পেলামনা, অভ্রর এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। অভ্র আমাকে পাজাকোলা করে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

কিন্তু আজকের রাতটা যে সর্বনাশের রাত হবে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি…

চলবে…

লেখিকাঃ সাদিয়া ইসলাম কেয়া।