ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-২৭+২৮

0
178

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-২৭+২৮

কলিজা কেঁপে উঠলো আমার। সোহরাব হঠাৎ বলল,

‘তুমি দেখতে যাবে? গেলে ঝটপট কাপড় পাল্টে নাও।’

‘আমি সত্যি সত্যি যাবো?’

সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। গেলে ও বাড়ির সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে। কেমন বিতি-কিচ্ছিরি ব্যাপার। সোহরাব কাজের ফাঁকে উত্তর দিল,

‘হ্যাঁ যাবে। তোমার আপনজন তো। তাছাড়া কতগুলো দিন ছিলে ও বাড়িতে।’

‘আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’

তাড়াহুড়ো করে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসলাম। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আঙ্কেল অ্যাকসিডেন্ট করলো কীভাবে? আচমকা অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মনে অন্য এক প্রশ্ন উদয় হলো। গাড়িসহ অ্যাকসিডেন্ট করেনি তো? মঈন চাচা? চাচা আজাদ আঙ্কেলের গাড়ি চালায়। চাচা সুস্থ আছে? ড্রয়িং রুম থেকে দৌঁড়ে সোহরাবের কাছে এলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে জিজ্ঞেস করলাম,

‘শুনছেন? উনি অ্যাকসিডেন্ট করেছে কীভাবে? রাস্তা পারাপারের সময় নাকি গাড়িতে করে কোথাও যাওয়ার পথে?’

সোহরাব টানা ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। একজনের কল কেটে আবার আরেকজনকে কল করছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে খাপছাড়া ভাবে বলল,

‘গেলে জানতে পাবে। তৈরি হয়ে নাও। বেরিয়ে পড়বো।’

কিছুক্ষণ পর দুজন বেরিয়ে পড়লাম। বিয়ের পর সোহরাবের সাথে প্রথম বের হওয়া আমার। কিন্তু আহামরি বিশেষ কিছু অনুভূত হলো না। দুঃসংবাদ ভেতরের ভালো লাগার অনুভূতি গুলো মেরে ফেলেছে হয়তো। এখন ভেতর জুড়ে শুধু উদ্বিগ্নতা।

নারায়ণগঞ্জ থেকে পুরাণ ঢাকা মোটামুটি দূর। অনেকখানি পথ যেতে হবে। কিছুদূর রিক্সায় গিয়ে বাসে উঠলাম আমরা। পথে সোহরাবের সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না। সে অতিশয় ব্যস্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গা ফোন করে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ খবর কাদের যেন জানিয়ে দিচ্ছে। তার চোখেমুখে অস্থিরতা। কপাল জুড়ে চিকন ঘাম। হুট করে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, আমি অসুস্থ হলেও কী সোহরাব এতটা বিচলিত হয়ে পড়বে? এতটা অস্থির হয়ে পড়বে?

__________

নামিদামি এক প্রাইভেট হাসপাতালে আজাদ আঙ্কেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতালের গেট থেকেই আঙ্কেলের জনপ্রিয়তা টের পেলাম। গেটের কাছে, এখানে সেখানে প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে। সোহরাব ইশারায় তাদের সাথে ভাব বিনিময় করে আমায় নিয়ে এগিয়ে চললো। তবে দুর্দিন বলে আমাকে নিয়ে কেউ কৌতূহল প্রকাশ করলো না।

হাসপাতালের ভেতরেও অসংখ্য নে’তারা দাঁড়িয়ে আছে। সোহরাবের মুখ চুপসে গেছে। আমার জন্য সে তাদের সাথে ঠিকমত ভাব বিনিময় করতে পারছে না। হয়তো মনে মনে এখন নিজেকে গালি দিচ্ছে। কেন নিয়ে এলো আমাকে? তাকে অস্বস্তি থেকে উদ্ধার করলাম। বললাম,

‘আপনি উনাদের সাথে কথা বলেন। আমি একা যাচ্ছি। উপরে অপেক্ষা করবো।’

‘খুব ভালো বুদ্ধি। ঠিক আছে। সোজা উপরে চলে যাও। ইমারজেন্সি ইউনিটে দেখো সবাই আছে। তোমার পরিচিত আর কাছের সবাই।’

সোহরাব যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওকে রেখে আমি হাঁটা ধরলাম। ইমারজেন্সি ইউনিট কোথায় জানা ছিল না। একজনকে জিজ্ঞেস করে এগিয়ে চললাম। মঈন চাচার কথা ভেবে মন কু ডাক গাইছে। খুব করে চাইলাম চাচা যেন সুস্থ থাকে।

জরুরী বিভাগের সামনে ভিড়। লিফটের আশপাশে, সিঁড়ির কাছে সবাই দলে দলে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্তর আলোচনা চলছে। আমি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতে একে একে সবাইকে নজরে পড়লো। বড় মা অস্থির হয়ে কাঁদছিল। সালেহা খালা অনেক কষ্টে তাকে ধরে রেখেছে। কাছে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে বড় মায়ের বিলাপ বেড়ে গেলো। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। ছোটবেলা থেকে অন্যের কান্না দেখলে আমার চোখে অশ্রু চলে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। ক্ষণিকের মধ্যে আরো একটা নিষ্ঠুর সত্য আবিষ্কার করলাম। সালেহা খালার থেকে জানতে পারলাম মঈন চাচারো মারাত্মক অবস্থা। সে-ও জরুরী বিভাগে ভর্তি আছে।

ভোরবেলা নাকি মঈন চাচা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল। সাথে আজাদ আঙ্কেল আর নওশাদ আঙ্কেল ছিল। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে দুপুরবেলা ফেরার পথে গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়। গাড়িতে মঈন চাচা আর আজাদ আঙ্কেল ছিল। নওশাদ আঙ্কেলকে কোনো একটা কাজে অন্য একটা জায়গা যেতে হয়েছিল। যার জন্য তিনি সুস্থ আছেন। বাড়ি ফেরার পথে বাসের সাথে অ্যাকসিডেন্ট ঘটে আজাদ আঙ্কেল আর চাচা আহত হয়েছেন। মঈন চাচার জন্য প্রাণ ছটফট করে উঠল। চাচার কিছু হয়ে গেলে তার ছেলেমেয়ে গুলোর কী হবে! ওদের একটু সুখের জন্য পরিবার ফেলে রেখে দিনের পর দিন শহরে পড়ে থাকা। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম আমি। খুব করে চাইলাম চাচা সুস্থ হয়ে উঠুক।

জুলি আন্টি আশপাশে ছিল। সামান্তা আপু এলো খানিক পরে। এসে বিচলিত হয়ে পড়লো। বড় মাকে সামলানোর চেষ্টা করলো। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে রাজ ভাইয়াকে খুঁজলাম। কোথাও চোখে পড়লো না। জাবির, ফাইজান ভাই কেউ এখনো এসে পৌঁছায়নি। আকাশ ভাইয়াসহ আরো কয়েকজন ছুটোছুটি করে জিনিসপত্র কিনে আনছে। কখনো ইনজেকশন লাগছে, কখনো ওষুধপত্র লাগছে, কখনো বা অন্যকিছু।

সামান্তা আপুর সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। আপু বড় মাকে সামলাচ্ছে। জুলি আন্টি আমায় দেখে চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখেমুখে অপরাধবোধ। এই অপরাধবোধের কারণ জানা নেই। সে কি কোনোভাবে আঙ্কেলের এই অবস্থার জন্য আমায় দায়ী করছে? আমার অভিশাপ কে? কারো প্রতি অভিযোগ নেই আমার। নেই কোনো অভিশাপ। নিজের সন্তানের ভালো কে না চায়? আঙ্কেলও সেটাই করেছেন। তিনি তো আমার জীবন নিয়ে আরো খারাপ কিছু করতে পারতেন। মেরে ফেললেও কিছু করার ছিল না। সেটা না করে তার অত্যন্ত প্রিয় একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। শুনেছি সোহরাব তার অনেক কাছের একজন। দ’লের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় একজন।

বেলা গড়াচ্ছে। দুপুর থেকে কারো খাওয়া হয়নি। এতগুলো মানুষ সবাই না খেয়ে জরুরী বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ আঙ্কেল এসে হুকুম দিল। বাড়ি গিয়ে রান্না করে খাবার নিয়ে আসার জন্য। আরো কিছু জিনিসপত্র লাগবে। রাতে কয়েকজনকে এখানে থাকতে হবে। কখন কী লাগে।

রান্নার ভার পড়লো আমার উপর। সোহরাবের থেকে অনুমতি নিয়ে আমি রাজি হলাম। সালেহা খালা বড় মায়ের কাছে থেকে গেল। আমি আর সামান্তা আপু বেরিয়ে পড়লাম।
__________

ফের এ বাড়িতে পা রাখলাম। কখনো ভাবিনি এই বাড়িতে আবার পা রাখতে পারবো। আবার আসার সুযোগ হবে। অথচ মাসখানেক হওয়ার আগেই আসা হলো। জীবনে কখন কী ঘটে যায় তা একমাত্র উপরওয়ালা ছাড়া বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।

কলিং বেল বাজাতে দরজা খুললো রাজ ভাইয়া। তাকে এমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বাড়ি দেখে ভীষণ অবাক হলাম। সামান্তা আপু তো বলে ফেলল,

‘ওদিকে আঙ্কেলের এই অবস্থা। আর তুমি এভাবে বাসায় ঘাপটি মেরে বসে আছো?’

রাজ ভাইয়া প্রতিত্তর করলো না। অবশেষে তার মুখোমুখি হলাম। অথচ আমি সারাটা পথ খুব করে চাচ্ছিলাম তার সাথে যেন দেখা না হয়। চোখে চোখও পড়লো। কিন্তু কোনো ধরনের নাটকীয়তা হলো না। হয়তো আমার বিয়েটা মেনে নিয়েছে। এছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না। রাজ ভাইয়া অবাধ্য হলেও কিছু ক্ষেত্রে তার হাত-পা বাঁধা। সামাজিক পদমর্যাদার কথা ভেবে চাইলেই সব করতে পারে না। আজ আমায় দেখে বিস্মিত হলেও দ্রুত সামলে নিল। সামান্তা আপু চেঁচিয়ে বলল,

‘ভাইয়া তুমি সত্যি সত্যি আঙ্কেলকে দেখতে যাওনি? একটা মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি অথচ তুমি?’

রাজ ভাইয়া দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। চড়া গলায় বলল,

‘আমি গেলেই কী সে একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়বে? সুস্থ হয়ে হাঁটা শুরু করবে?’

‘তুমি এভাবে বলছো কেন?’

‘ঠিকভাবেই বলছি।’

সামান্তা আপু প্রায় কেঁদে দিয়েছে। আপু তার বড় আব্বুকে ভীষণ সমীহ করে। আমি তাকে সামলে নিলাম। টেনে সোফায় বসিয়ে দিলাম। গ্লাসে পানি এনে সামনে রাখলাম। রাজ ভাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উপরে চলে গেল। আমি বুঝি না এই ছেলের সমস্যা কী! এতটুকু যদি পরিবর্তন হয়।

রাজ ভাইয়ার সমস্যা টের পেলাম সন্ধ্যার পর। হাসপাতালে খাবার নিয়ে যেতে হবে। একা আমরা দুজন মেয়ে মানুষ কি করে যাব। রাজ ভাইয়াকে বলার জন্য সামান্তা আপুকে জোর করলাম। কিন্তু আপু অভিমান করে রইলো। সে রাজ ভাইয়ার সাথে আর কথা বলবে না। অগত্যা আমি নিজে তাকে ডাকতে গেলাম।

ঘরের দরজা খোলা ছিল। আমি বাইরে থেকে ডাকলাম। সে উত্তর দিলো না। দরজার সামনে জুতা রয়েছে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। দ্বিতীয় বার একটু জোরে ডাকলাম। রাজ ভাইয়া এবারে উত্তর দিল। বলল,

‘ভেতরে এসো জুঁই ফুল।’

বুকে ধাক্কার মতো খেলাম। রাজ ভাইয়ার মুখের জুঁই ফুল ডাকটা প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করলাম। কেমন আবেগ মাখা ডাক। সমস্ত শহরের সব বিষন্নতা ছুঁয়ে আছে সে ডাকে। কই? সোহরাবের ডাকে তো এতো গভীরতা পাই না? এতো অতল স্পর্শ করে না!

রাজ ভাইয়া ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিল। আমি ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিলাম। এ ঘরে আগে বহুবার আসা হয়েছে। সে যখন বাড়ি থাকতো না তখন একফাঁকে ঢুকে রুম গোছগাছ করে বেরিয়ে যেতাম। রুমের আলো জ্বালানোর পর ভাইয়া উঠে বসলো। আমি দূরে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘হাসপাতালে যেতে হবে একটু। আমাদের সাথে চলুন। রাত হয়ে গেছে। একা যেতে পারবো না আমরা।’

‘ওতো দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছো কেন জুঁই ফুল? এখনো ভয় পাও আমাকে? অথচ দেখো, তোমাকে আমি দিতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। নির্ভয়ের স্থান।’

বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এই ছেলেটার উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্য কখনো মনোযোগ দেওয়া হয়নি। আজ মনোযোগ দিয়ে দেখে বুঝলাম তার মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে। রাজ ভাইয়ার চোখে গভীর দুঃখ। এই গভীর দুঃখের উৎস কী? বাবা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তার জন্য? আমি তাড়া দিয়ে বললাম,

‘তাড়াতাড়ি চলুন। কারো খাওয়া হয়নি। আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে হবে।’

‘জানো আজ আমার সবচেয়ে সুখের দিন। আবার সবচেয়ে দুঃখের দিন! এখন সুখের জন্য আনন্দ করবো নাকি দুঃখের জন্য কষ্ট পাবো বুঝতে পারছি না। তুমি একটা উপায় বলে দাও তো। আমার আনন্দিত হওয়া উচিত নাকি কষ্ট পাওয়া উচিত?’

কিসব আবোল তাবোল বলছে? কপাল কুঁচকে এলো আমার। একে রেখে আমাদেরকে যেতে হবে। বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতে রাজ ভাইয়া বলল,

‘তোমাকে একটা গোপন কথা বলি জুঁই ফুল। বহু বছর হলো যেটা নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ কাউকে জানানো দরকার। আর পারছি না।’

‘কী গোপন কথা?’

কৌতূহল নিয়ে দু পা এগিয়ে গেলাম। ভয়ে বেশি কাছে যেতে পারছি না। যা স্বভাব! কী না কী করে বসে। রাজ ভাইয়ার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। সে নিজের দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,

‘আমার বাবা! আমার বাবা মানুষটা এ জীবনে ভয়ানক এক পাপ করেছে। রাজ’নীতিতে যারা যুক্ত থাকে তারা মোটামুটি অনেক পাপ করে। কিন্তু আমার বাবা তার চেয়ে জঘন্য পাপ করেছে। মানুষ হ’ত্যার মতো পাপ। তাও আবার খুবই আপন কাউকে। কাছের কাউকে!’

পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। বিস্ফারিত কণ্ঠে বললাম,

‘পাগলের মত কী বলছেন এসব?’

‘তুমি তো নিশ্চয়ই শুনেছ বাবা দুই বিয়ে করেছিল। বাবার কাছে তার সন্তানেরা খুবই আপন। তাদের উপর কেউ নেই। সন্তানকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টা। সেই চেষ্টায় বলি হলো ফাইজানের মা। খুবই নিরীহ একজন।’

মুখ দিয়ে অস্পষ্ট এক শব্দ বের হলো। রাজ ভাইয়ার চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। হাত পা ক্রমাগত কাঁপছে। সে কম্পিত গলায় বলল,

‘বাবার প্রচন্ড ক্ষমতার লোভ। ছোটবেলা থেকে সে তার সন্তানকে নিজের মতো করে বড় করতে চেয়েছিল। নিজের মতো অনিশ্চয়তা ভরা নোংরা রাজ’নীতিতে যুক্ত করতে চেয়েছিল। নিজে বিশাল ক্ষমতার মালিক হবে। তার গড়ে তোলা সেই ক্ষমতার সাম্রাজ্যের অধিকারী হবে তার ছেলে। আমাকে দিয়ে তার মনোভাব পূর্ণ হয়নি। ছোটবেলা থেকে এসবের প্রতি আমার চরম অনীহা। তার উপর উগ্র আর অবাধ্য ছিলাম। যার জন্য বাবা ফাইজানকে টার্গেট করলো।

ফাইজান ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হয়েছে। যেটা বাবার পছন্দের ছিল না। তিনি অনেকবার শুধুমাত্র ফাইজানকে শহরে আনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফাইজানের মা রাজী হয়নি। তিনি সন্তানকে ছাড়া একা গ্রামে থাকতে পারবেন না। বাবার শহরে স্ত্রী-পুত্র আছে। তাদের সাথে গিয়ে কোনো ঝামেলা করতে চান না। তাছাড়া বাবার মনোভাব বুঝে গিয়েছিলেন বলে কখনো শহরে পা রাখেননি। ফাইজানকে শহরে আসতে দেননি। তিনি অসুস্থ ছিলেন। বাবা ভেবেছিল খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবেন। মারা গেলে ফাইজানকে শহরে নিয়ে আসবে। কিন্তু তিনি মারা যাচ্ছিলেন না। এজন্য তার অসুস্থতার সুযোগে একদিন গ্রামে গেলেন। তারপর তিনি নিজেই মে’রে ফেললেন।’

রাজ ভাইয়ার কণ্ঠ কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। শরীর ভেঙ্গে আসছে আমার। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। কোনো রকমে বললাম,

‘আপনি এসব জানলেন কী করে? দেখেছেন আপনি?’

‘দেখি নি। কিন্তু ফাইজান এ বাড়িতে আসার পর মা আর বাবার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। কিছু একটা নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল বিদ্বেষ লেগে থাকতো। একদিন আড়াল থেকে তাদের ঝগড়ার কিছু অংশ শুনে সব বুঝে গেলাম।’

মাথা ভনভন করে ঘুরছে। কিছু বলার মত পেলাম না। রাজ ভাইয়া নিজে থেকে বলল,

‘প্রকৃতির প্রতিশোধ এটা। যার জন্য বাবা শাস্তি পাচ্ছে। নাহলে একদম ফাঁকা রাস্তায় বাস এসে বাবার গাড়িটাকে পিষে দিবে কেন?’

‘মঈন চাচা কী দোষ করেছিল? এটা প্রকৃতির কেমন বিচার?’

‘প্রকৃতির নিয়ম অতো হিসাব নিকাশ করে হয় না। খারাপকে শায়েস্তা করতে গিয়ে দু চারটে ভালো ফুলও দুঃখ পায়। অবেলায় ঝড়ে যায়।’

স্তব্ধ হয়ে রইলাম। অনেক্ষণ হলো নিচে নামছিলাম না বলে সামান্তা আপু এলো। দরজার বাইরে থেকে বলল,

‘জুঁই বের হ। কেউ না গেলে না যাক। চল আমরা একা যাই।’

‘আসতেছি আপু।’

আপু চলে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। একটা প্রাণ মে’রে ফেলা এতো সহজ? ধনীদের জন্য হয়তো সহজ। উঠে দাঁড়াতে রাজ ভাইয়া বলল,

‘একটা জিনিস খেয়াল করেছ? বাবার স্বপ্ন কিন্তু পূরণ হয়নি। ফাইজানকে তার পছন্দ মতো গড়ে তুলতে পারেনি। আমিও হইনি। তাকে অশান্তিতে রাখার জন্য যা করা দরকার, যা না করা দরকার সব করেছি। আমার জন্মদাত্রী মায়ের প্রতিও তীব্র বিদ্বেষ। সে সারাজীবন একটা অপরাধকে লালন করে আসছে। অবশ্য এছাড়া আর কোনো পথ নেই। ধনীদের সুখের উল্লাসের নিচে এমন হাজারো অপরাধ লুকিয়ে থাকে। তাদের পদতলে নিষ্পেষিত হয় হাজারো জীবন। অসংখ্য অপরাধ পায়ে পিষে তারা ফুলের মালা গলায় জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার আজন্ম দুঃখ আমি কোনো ধনী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম। এমন কোনো পরিবারে বেড়ে উঠেছিলাম। জানো, বাবা-মায়ের কাছে কখনো দুঃখের কথা বলতে পারিনি। তাদের খুব কাছে যেতে পারিনি।কখনো গলা জড়িয়ে তাদের পাশে ঘুমানো হয়নি। টুকরো টুকরো আবদার রাখা হয়নি। কখনো একত্রে বসে খাওয়া হয়নি। আরো কতশত অপূর্ণতা। সবসময় তাদের সাথে দূরত্ব থেকে গেছে। মন খুলে দুটো কথা বলতে পারিনি। একটু স্বস্তির জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি তারা। এর চেয়ে দুঃখের কিছু আছে?’

আমি বিমূঢ় হয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়ার কণ্ঠ জুড়ে হাহাকার। এতদিন লুকিয়ে রাখা সমস্ত কষ্টগুলো একে একে বের হয়ে আসছে। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়লো। কাছাকাছি এসে বলল,

‘বাবা কেমন আছে জুঁই ফুল? দেখো না, আমি এতদিন চেয়েছি বাবা দুঃখ পাক। কষ্টে থাকুক। তার ভালো থাকা গুলোকে একদম সহ্য করতে পারতাম না। অথচ আজ যখন বাবা কষ্ট পাচ্ছে আমার অন্তর পুড়ছে কেন? ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি কেন? এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? বাবা ভালো আছে জুঁই ফুল? বাবা বাঁচবে তো ….’

রাজ ভাইয়া দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। যেন তেন কান্না নয়। বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্না। তার কান্নার শব্দ শুনে সামান্তা আপু দৌঁড়ে এলো। এসে কয়েক সেকেন্ড বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণে দৌঁড়ে গিয়ে রাজ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলো। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘ভাইয়া কাদঁছো কেন? কী হয়েছে? জুঁই? ভাইয়া কাদঁছে কেন?’

আমি উত্তর দিতে পারলাম না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমারো চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

___________

মাঝরাতের দিকে মঈন চাচা মারা গেল। হঠাৎ করে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা ঢাকা মেডিকেলে পাঠানোর পরামর্শ দেন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে গাড়িতে তার মৃত্যু হয়। এই খবর আমি শুনে ফের পাথর হয়ে গেলাম।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__২৮

এখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল নাকি কয়েক মিনিটের রাস্তা। সেই সময়টুকু মঈন চাচা বেঁচে রইলো না। অভিমান করে চিরতরে চলে গেল। চাচা গাড়ির সম্মুখে ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল। চলন্ত বাস সামনে থেকে ধাক্কা মেরেছে। যার দরুণ তার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

চাচাকে নিয়ে গাড়ি উল্টো পথে ঘুরল। নওশাদ আঙ্কেলের কাছে ফোন এলো। চাচার লাশ কী করবে? আঙ্কেল গ্রামে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দিল। বড় মা তখন বাঁধা দিলেন। জানালেন, তিনি শেষবারের মতো চাচাকে দেখতে চান। সালেহা খালা জানালো, সে-ও দেখতে চায়। আমিও চাচাকে দেখতে চাই। সপ্তাহ তিনেক আগে তাকে শেষবার দেখেছিলাম। সামান্তা আপুর সাথে আমায় দেখতে এসেছিল। সেদিন আমার নতুন সংসার দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিল। প্রায় কেঁদে দিয়েছিল। এতো ভালো একজন মানুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল? ভালো মানুষেরা, আপন মানুষেরা বুঝি বেশিদিন কাছে থাকে না? পাশে থাকে না?

নওশাদ আঙ্কেল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলল। পরে জানালো চাচাকে এখানে আনা হবে না। দেখার মতো কিছু নেই। উল্টো সবাই আরো কষ্ট পাবে। চাচার আঘাত মাথা আর মুখের দিকে বেশি লেগেছে। এটা শুনে সালেহা খালার কান্নার গতি বেড়ে গেলো। আমি সরে গিয়ে বারান্দার পাশে দাঁড়ালাম। কষ্টে বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফের প্রিয়জন হারানোর বেদনা আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। চাচার পরিবারের কী হবে এখন? ছেলেমেয়ে গুলোর মাথার উপরের শেষ আশ্রয় হারিয়ে গেল। ওরা কঠিন জীবনযুদ্ধ পাড়ি দিবে কী করে? শুনেছি চাচার বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে। তার জীবনটা কী আমার মতো হবে? তবে কী দুঃখে ভরা আরেকটা জুঁইফুলের জন্ম নিল?

হুঁ হুঁ করে কাঁদছিলাম আমি। সোহরাব কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। সে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘মঈন চাচাকে দীর্ঘদিন হলো চিনি। বড় ভালো মানুষ ছিল।’

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলাম না। আলগোছে চোখ মুছে নিলাম। হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে দৃষ্টি সুদূর প্রসারী করলাম। রাতের শহর অন্যরকম লাগছে। শহুরে বাতিগুলো কোথাও জ্বলছে। কোথাও কোথাও আবার নিভে গেছে। আমি সে বিষণ্ণ শহরে দৃষ্টি রেখে বললাম,

‘বাড়ি যাবেন না?’

‘এখন? কিভাবে যাবো? সকাল হোক। তোমায় রেখে আসবো।’

‘আচ্ছা।’

সোহরাব চলে গেল। আমি তীব্র মন খারাপ নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বুকের ভেতর কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে সোহরাব টের পেলো না। সে আজাদ আঙ্কেলের স্বাস্থ্য নিয়ে অতিশয় ব্যস্ত। আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মঈন চাচার পরিবার এই সংবাদ নিশ্চয়ই শুনেছে। তারা সহ্য করবে কিভাবে? রোগ শোকে ভুগে মৃত্যু ঘটলে তবুও মনকে প্রবোধ দেওয়া যায়। এমন মৃত্যু কারো কাম্য? আহারে জীবন! ঝরা ফুলের মতন। ঝরে পড়তে কতক্ষণ!

লম্বা বারান্দার দক্ষিণ দিকের কেবিনের সামনে ভিড়। ওখানেও কেউ একজন অসুস্থ। তার পরিবার স্বজন ভিড় করে আছে। হাসপাতালে আসার পর থেকে দেখছি। হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এলো। কেঁদে উঠলেন মা বয়সী এক মহিলা। তার সাথে সাথে আরো অনেকগুলো কন্ঠ আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো। বুঝলাম অসুস্থ ব্যক্তিটি আর নেই। সবাইকে অপেক্ষায় রেখে পরপারে চলে গেছে। ওনাদের কান্নার শব্দ বুকে তীরের মতো বিঁধছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। পাশ থেকে কেউ নাম ধরে ডাক দিল।

‘জুঁই?’

ঝাপসা চোখে তাকিয়ে জাবিরকে দেখতে পেলাম। ছেলেটাকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। বুঝতে পারলাম আঙ্কেলের সংবাদে মুষড়ে পড়েছে। সে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়লো। বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘তুই হাসপাতালে রয়ে গেছিস কেন? কত মানুষ রয়েছে। তোর কী কাজ এখানে?’

‘সালেহা খালা যেতে দিচ্ছিল না।’

জাবির কিছু বললো না। তার কন্ঠের সেই পুরোনো অধিকার বোধ এখনো রয়ে গেছে। আমি যে অন্য কারো বউ সেটা হয়তো ভুলে গেছে। আমি বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। একেবারে নারায়নগঞ্জ। আমার নতুন ঠিকানায়। কিন্তু খালা আর সামান্তা আপু যেতে দিল না। কতদিন পর আমায় দেখছে। আমি সাথে থাকলে নাকি ভরসা পায়। তাছাড়া মঈন চাচার অবস্থা ভালো ছিল না বলে আমিও জোর করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাড়ি যাওয়া উচিত ছিল। এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে। উঠে দাঁড়ালাম। জাবির হঠাৎ আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বলল,

‘শাড়িতে তোকে কেমন বড় বড় লাগছে জুঁই। সত্যি সত্যি বউ বউ লাগছে।’

বলার মত কিছু পেলাম না। জাবিরকে রেখে হাঁটা ধরলাম। সোহরাব দেখতে পেলে আবার কী না কী মনে করে। কেবিনের সামনে এলাম। দুপুরের মতো অতটা ভিড় নেই। মোটামুটি সবাই চলে গেছে। দাদী এসেছিল রাতে। কিন্তু তাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। ডাক্তার ঢুকতে দিচ্ছে না। দুয়েকজন জরুরী ব্যক্তি ছাড়া কারো ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। ঢাকা মেডিকেলের একজন নামিদামি ডাক্তার সার্বক্ষণিক রয়েছে। দেখাশোনা করছে। তবুও আঙ্কেলের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

ফাইজান ভাই সন্ধ্যারাতে চলে এসেছে। এক কোণায় মাথা নত করে বসে আছে। তার সাথে আমার এখনো কথা হয়নি। চাচার অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু তিনি সব উদ্বিগ্নতা ছাড়িয়ে চলে গেল।

কোনরকমে রাতটুকু পেরুলো। অস্থিরতা নিয়ে একটা নতুন ভোর দোরগোড়ায় উঁকি দিল। সবাই ভয়ে ভয়ে ছিল সমস্ত রাত। ভেতর থেকে কোনো দুঃসংবাদ আসে কিনা! রাতের অন্ধকার দূর হয়েছে। আঙ্কেলের অবস্থা আগের মতই। কোনো উন্নতি হয়নি। আমার আর ভালো লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে। ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। হাসপাতালের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সোহরাবকে ইশারায় কাছে ডাকলাম। বললাম,

‘বাসায় ফিরবেন না? ভালো লাগছে না আমার।’

‘থাকো আরেকটু। দুপুরে বের হই।’

‘না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

বলে মাথা নিচু করলাম। কণ্ঠ বুঁজে আসছে আমার। চোখে পানি টলটল করছে। সোহরাব বুঝতে পারল। বলল,

‘আচ্ছা। চলো।’

খানিক বাদে বের হলাম। কাউকে বলে আসিনি। সালেহা খালা নেই। সকাল বেলা কাজ করার জন্য বাড়ি গেছেন। আর কাউকে বলার মত পেলাম না। সবার অগোচরে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ির কাছে রাজ ভাইয়ার চোখে চোখ পড়লো। আঁধার মুখে বসে আছে। কাল রাতে আমাদের সাথে হাসপাতালে এসেছে। এক সেকেন্ডের জন্য বের হয়নি। আবার আঙ্কেলকে যে দেখতে যাবে সেটাও করেনি। রাজ ভাইয়া আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সোহরাবের দিকে তাকালো। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আর তার পানে তাকানোর সাহস হলো না। সোহরাবের পিছু পিছু এগিয়ে চললাম।

আমায় বাসে উঠিয়ে দিয়ে সোহরাব চলে গেল। কিছু বলতে গিয়েও পারলাম না। তার নাকি হাসপাতালে থাকা জরুরী। আর কোনো পথ খোলা নেই। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে তার থেকে বিদায় নিলাম।

ফেরার পথে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম। একটা মানুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কোনদিন আর দেখতে পাবো না। দুটো কথা বলতে পারবো না। কি কষ্টকর। মানুষের মৃত্যুর চেয়ে নিষ্ঠুর কিছু দুনিয়াতে নেই।

_________

সোহরাব বলেছিল বাসায় ফিরে কল দিতে। তাকে জানাতে যে সুস্থ মতো ফিরেছি। কিন্তু কল দিলাম না। মনের কোনো কোণে জিদের সূক্ষ্ম এক স্রোত তোলপাড় করছিল। বাসায় ফিরে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

ঘুম আসছিল না। মাথার মধ্যে এলোমেলো চিন্তার বহর। মঈন চাচার লাশ এতক্ষণে গ্রামে পৌঁছে গেছে। তার পরিবারের কী অবস্থা? নিশ্চয়ই ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের কথা ভেবে বিছানায় অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলাম। নাহার আপা এলো একটু পরে। ফোনে কথা বলতে বলতে। আমি চোখ মুছে উঠে বসলাম। আপা ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে বলল,

‘হ্যাঁ আসছে তো। শুয়ে পড়েছে। এই নে, কথা বল।’

হাতে ফোন ধরিয়ে আপা বের হয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কানে ধরে হ্যালো বললাম। প্রতিত্তরে সোহরাবের উৎকন্ঠিত সুর শোনা গেল।

‘জুঁই ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছেছো? তোমায় বাসে তুলে দেওয়ার পর মনে হলো তোমার কাছে তো ফোন নেই। রাস্তায় যদি কোনো অসুবিধে হয়? চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।’

‘কোনো অসুবিধা হয় নি।’

‘ভেরি গুড। জীবনে প্রাকটিক্যাল হতে হবে। অনেক কিছু শিখতে হবে। রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানতে হবে। একা চলাফেরা করা শিখতে হবে। বুঝতে পেরেছো?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন গোসল করে খেয়ে নাও।’

কিয়ৎক্ষণ কথা বললাম না। বুকে অভিমান জমেছে। একটু একটু করে জমতে জমতে ইতোমধ্যে পাহাড় ছুঁই ছুঁই। কেন জানি মনে হচ্ছে সোহরাবের জায়গা অন্য কেউ হলে কখনো তার বউকে একা ছাড়তো না। এতটা পথ একা আসতে দিতো না। অভিমান চেপে রেখে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনি কখন আসবেন?’

‘বলতে পারছি না। রাতে ফিরতে পারি। আবার নাও ফিরতে পারি। আমার থাকার জায়গার অভাব নেই। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। রাখছি।’

সোহরাব ফোন রেখে দিল। উঠে গিয়ে ফোনটা নাহার আপাকে দিয়ে এলাম। আমার গোসল হলো না। খাওয়া হলো না। কেমন শীত শীত লাগছে। জ্বর জ্বর অনুভূত হচ্ছে। রুমে ঢুকে গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।

___________

বর্ষার মৌসুম এসে গেছে। আকাশ ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। কখনো রোদ ঝলমলে। আবার কখনো কালো মেঘে ছেয়ে আসে চারিদিক। আজ দুপুর বেলা আকাশ কালো হয়ে এলো। সূর্য তল্পিতল্পা গুটিয়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। এখন মেঘকন্যার অশ্রু বিসর্জনের অপেক্ষা।

ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে। আনতে যেতে হবে। কিন্তু যেতে পারছি না। ঘরে কেউ নেই। নাহার আপা আশাকে আমার কাছে রেখে কাজে গেছে। সোহরাবও ফেরেনি। ইদানীং সোহরাবের কাজগুলো বুঝে উঠতে পারি না। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সোহরাব তত ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। দিনরাত ঢাকাতে কাটাচ্ছে। সপ্তাহে দুদিন বা তিনদিন আসে। রাতটুকু থেকে ভোরবেলা আবার চলে যায়।

আজাদ আঙ্কেলের অবস্থা একটু ভালো। একটা সম্পূর্ণ সপ্তাহ আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এখন নরমাল কেবিনে নেওয়া হয়েছে। একেবারে সুস্থ হয়ে উঠেনি। এখনো কথা বলতে পারে না। হাঁটাচলা করতে পারে না। শোচনীয় অবস্থায় আছেন। সেটা নিয়ে সোহরাবের দুঃখের সীমা নেই। শুনেছি চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথাবার্তা হচ্ছে। অবস্থার আরেকটু উন্নতি হলে বিদেশ নিয়ে যাবে।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাথার উপরে ছাদ। কয়েকটা সিঁড়ি অতিক্রম করলে কাপড় গুলো আনা যায়। সোহরাবের নতুন কিছু শার্ট শুকাতে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি আশাকে কাছে টেনে বললাম,

‘আশা, ঘরের মধ্যে বসে থাকো। আমি কাপড় নিয়ে আসি। হুঁ?’

আশা রাজি হলো না। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আধো গলায় বলল,

‘আমিও ছাদে যাবো।’

ওকে নিয়ে ছাদে গেলে আবার ঘর খালি থাকে। পরক্ষণে মনে হলো কয়েক মিনিটের ব্যাপার। ছাদে যাবো আর আসবো! এইটুকু সময়ে কী আর হবে! আশাকে কোলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি মাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির ফোঁটা বড় হয়ে গেছে। গুড়ি বৃষ্টি আর নেই। আশাকে কোল থেকে নামিয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড় করালাম। বললাম,

‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। নড়চড় করবে না একদম? কেমন?’

আশা মাথা নাড়ল। ওকে রেখে বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়লাম। ছুটোছুটি করে কোনরকমে কাপড় গুলো হাতে জড়ো করতে আশার চিৎকার ভেসে এলো। পেছন ঘুরে দেখি মেঝেতে পড়ে গেছে। দৌঁড়ে গিয়ে টেনে তুললাম। মুখটা উচুঁ করতে মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। আশার ঠোঁটের কিনার কেটে গেছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরিয়েছে। বুকের ভেতরটা আঁতকে উঠল। কোলে জড়িয়ে ওকে নিয়ে সিঁড়ির কাছে এলাম। গায়ের ময়লা ঝেড়ে বার বার কান্না থামানোর চেষ্টা করলাম।

আশার কান্না থামলো না। অনেক ব্যথা পেয়েছে। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে আমার। প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। এই কাটা সহজে তো যাবে না। নাহার আপাকে কী জবাব দেবো? ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো।

ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। সামনে সোহরাবের কাঁদাযুক্ত জুতা দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তে চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সোহরাব দেখলে কী করবে? আশা তখনো কাদঁছে। ঘরে ঢুকতে সোহরাবকে নজরে এলো। ড্রয়িং রুমে পেছন ঘুরে বসে আছে। অর্ধ ভেজা শার্ট সোফায় খুলে রেখেছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,

‘ঘর খোলা রেখে কই গেছিলে?’

‘ছাদে কাপড় আনতে।’

ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম। সোহরাব দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন ঘুরে চোখমুখ কুঁচকে বলল,

‘আশা কাদঁছে কেন?’

‘ছাদের মেঝেতে পড়ে….’

অসমাপ্ত বাক্য শেষ করতে পারলাম না। সোহরাব রক্তচক্ষু নিয়ে ছুটে এলো। ঠাস করে গালে চ’ড় বসিয়ে দিল। আশাকে কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অশ্রাব্য এক গালি দিল। ঘরে যেতে যেতে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো সে। আমি বিমূঢ় হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেছে যেন। মনে হচ্ছে আমি শূন্যে ভাসছি। সোহরাব আমার গায়ে হাত তুললো? চ’ড় মারলো? এইতো সেদিন পরিচয় ছেলেটার সাথে। লজ্জায় কথা বলতে পারছিলাম না। সে কতো সহজ হয়ে কথা বলছিল। আশ্বাস দিচ্ছিলো। আজ ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে মারলো?

ধীরপায়ে বাথরুমে এগিয়ে গেলাম। দরজা বন্ধ করে কাঁদলাম। সংসার জীবনের মিষ্টি, মধুর সম্পর্ক গুলো কী এভাবেই নষ্ট হয়? হয়তো! বড় আপার যখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিল তখন আপা কতো সুখে ছিল। দুলাভাই আপার জন্য পাগলপ্রায়। চোখের আড়াল হয়ে দেয় না। দুদিনের জন্য আপা বাড়ি আসলে দুলাভাই এসে হাজির হতো। অনুনয় বিনয় করে নিয়ে যেতো। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে সেই মিষ্টি সম্পর্ক তেতো হয়ে গেল। যত দিন যেতে লাগলো দুলাভাই যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। একপর্যায়ে আপার কপাল পুড়লো। পেটে সন্তান নিয়ে ডিভোর্সের কাগজ হাতে পেল।

আমারো কী এমন হবে? আপার মত কপাল পুড়বে? ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

(চলবে)