ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-২৫+২৬

0
164

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-২৫+২৬

সোহরাব এসে অকপটে আমার পাশে বসল। জমে স্থির হয়ে রইলাম আমি। এতটুকু নড়াচড়া করলাম না। শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম যেন! সে বলল,

‘কান্না করছো কেন? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখের কী হাল করেছ!’

তার বলার ভঙ্গি খুবই আন্তরিক। মনে হয় বহুদিনের চেনা। বহু আগের পরিচয়। কিঞ্চিৎ অবাক হলাম আমি। তার কণ্ঠে কেমন অধিকার বোধ ফুটে উঠেছে। মোটা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে নিতে বাঁধা দিল সে। চোখের ইশারায় অপেক্ষা করতে বললো। উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে টিস্যু বক্স নিয়ে এলো। আস্ত বক্সটা কোলের উপর দিয়ে বলল,

‘আগে থেকে কিনে রেখেছিলাম। আমি জানতাম কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলবে। ধরো, আজ রাতের জন্য আমার পক্ষ থেকে এটাই উপহার।’

বক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে সে নিজেই গাল মুছে দিল। নিজেকে আড়ষ্ঠতায় আরো গুটিয়ে নিলাম। সোহরাব ফের বলল,

‘কি আশ্চর্য! কখন থেকে শুধু আমি বকবক করছি। তুমি কিছু বলো! তোমার কণ্ঠ শুনে ধন্য করি নিজেকে।’

হ্যাঁ। আমার কিছু বলা দরকার। তার সাথে কথার আদান প্রদানের দরকার। সুস্থ একটা সম্পর্কের দরকার। কথাবার্তা না এগোলে তা হবে কী করে? দুজন দুজনকে বুঝবো কী করে! চিনব কী করে! কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। আমি বিচলিত হয়ে বললাম,

‘কিছু মনে পড়ছে না!’

সোহরাব সশব্দে হেসে উঠলো। দৃষ্টি নত আমার। কান খাড়া করে তার হাসির শব্দ শুনলাম। বুঝতে পারলাম এই মানুষটা আকাশ ভাইয়ার মতো। কারণে অকারণে হাসে!

‘আমার নামটা জানো নিশ্চয়ই!’

‘জানি।’

বলে চুপ হয়ে গেলাম। সে বসে আছে আমার খুব কাছে। শরীরে স্পর্শ না করেও খুব করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তার গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। হাসির ঝংকার শরীরে মৃদু আলোড়ন তুলছে। অন্য এক আবহে আকৃষ্ট করে তুলছে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। ক্ষীণ আওয়াজ তুলে বললাম,

‘ঘুমিয়ে পড়ি আমি? মাথা ব্যথা করছে!’

‘হ্যাঁ অবশ্যই! কেন নয়?’

সোহরাব সহজ ভঙ্গিতে রাজি হয়ে গেল। নিজে উঠে বিছানাপত্র ঠিক করলো। শিথানে বালিশ সাজানো ছিল। একটার উপর আরেকটা। সে বালিশ দুটো দুই পাশে রাখলো। ফিটফাট করে বলল,

‘ওকে! দেয়ালের ওপাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। এপাশ থেকে রাতের বেলা নিচে পড়ে হাত পা ভাঙলে আরেক মুশকিল হয়ে যাবে।’

কেমন সহজ সাবলীল কথা বলার ভঙ্গি। মন অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। জড়োসড়ো হয়ে দেয়ালের পাশটাতে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজতে সোহরাব প্রশ্ন করলো,

‘লাইট বন্ধ করে দেই জুঁই? নাহলে আলো চোখে লাগবে।’

‘জ্বি, ঠিক আছে।’

মুখে বললাম ঠিক আছে! কিন্তু ভয়ে দুরুদুরু বুক কাঁপতে লাগলো। মনকে প্রবোধ দিলাম। এই মানুষটা আমার স্বামী। তার সাথে এক জনমের বন্ধন পড়ে গেছে। অনিবার্য নিয়তিতে বাঁধা পড়ে গেছি দুজন। চাইলেই সে সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করতে পারবো না। যত সহজ হওয়া যায় তত ভালো। হয়তো এটাই আমার জন্য উত্তম।

সে বাল্ব বন্ধ করলো। তবে রুম সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো না। জিরো বাল্বের ক্ষীণ সবুজ আলো জ্বলছে। তাতে বেশ খানিকটা অন্ধকার দূর হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। মাথার ভেতর ধপ ধপ করছে। কপালের শিরদাঁড়া যন্ত্রণা দিচ্ছে। চোখ মুখ কুঁচকে পড়ে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত গত হতে আচমকা কপালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ধপ করে চোখ খুললাম। শরীরে বারংবার কাঁটা দিয়ে উঠলো। লাফিয়ে উঠতে নিতে সোহরাব বাঁধা দিল। মুখ খুলে বলল,

‘উঁহু! ঘুমিয়ে পড়ো। মাথা ব্যথা করছে না? ঘুমিয়ে যাও।’

শান্ত হয়ে এলাম আমি। শীতল হাতের স্পর্শ কপাল জুড়ে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কখনো বা তৈলাক্ত চুলের ভাঁজে বিচরণ করলো। আবেগে কণ্ঠ বুজে এলো আমার। এই পৃথিবীতে আমার একান্ত আপন কেউ ছিল না। কাছের কেউ ছিল না। অবশেষে শুধু আমার বলে কেউ এলো? বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে সরু এক জলধারা গড়িয়ে পড়লো। ভাগ্যিস আবছা অন্ধকার বলে সোহরাব টের পেল না।
___________

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। এতক্ষণে অবসর পেয়ে ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুপুরবেলা থেকে কিছু পেটে পড়েনি। জিদ ধরে না খেলেও এখন ঘুম আসছে না। আচমকা মস্তিষ্ক খোলাসা হলো। চোখ খুলতে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ পেলাম। আবছা আলোয় অষ্পষ্ট এক পুরুষ অবয়ব। বিস্ময় নিয়ে তার পানে তাকিয়ে রইলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময় ভাব কেটে গেল। মনে পড়লো আমি বিবাহিত। বুকের গহীনে ঝড়ের সৃষ্টি হলো। সংবিৎ ফিরতে পুরুষ স্পর্শ গুলো শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। সমস্ত কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা গলায় এসে আটকে গেল যেন। দমবন্ধ অবস্থা। শ্বাস আটকে আসছে। উসখুস করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে সোহরাব মুখ খুললো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

‘নড়াচড়া করছো কেন জুঁই? এভাবেই থাকো।’

‘আপনি ঘুমান নি?’

অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। কথা বলা ঠিক হয়নি। সোহরাব মুখের সাথে সাথে এবারে চোখ খুললো। আবছা অন্ধকারে তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আমার আঠারো-উনিশ বছরের জীবনে এত কাছে কেউ আসেনি। এমন অনুভূতি হয়নি। এভাবে কারো বাহুডোরে থাকা হয়নি। নিজেকে গুটিয়ে নিতে সোহরাব বলল,

‘মাথা ব্যাথা আছে এখনো?’

আমি ডানে-বায়ে মাথা নাড়লাম। ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘না!’

সে কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলো। তারপর গাঢ় অন্ধকার মেখে হঠাৎ বলল,

‘ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি অদ্ভুত টান আমার। কবিতার পংক্তিগুলো ভীষণ করে টানতো। সেই ভালো লাগা থেকে স্কুল, কলেজে প্রায়ই আবৃত্তি করতাম। একটা কবিতা শুনবে?’

মাঝরাতে কবিতা শোনার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তার আগ্রহ দেখে চুপিসারে মাথা নাড়লাম। সে আবেগ ভরা সুরে বলল,

‘তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।

না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায় না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়!

সুসজ্জিত ঘরবাড়ি
সখের বাগান
সভামঞ্চে করতালি
জয়ধ্বনি পুষ্পার্ঘ্য ইত্যাদি
সব ফেলে
তোমার পায়ের কাছে অস্তিত্ব লুটিয়ে দিয়ে
তোমাকে না পেলে, জানি
যে পায়, সে পায়
কি অমূল্য ধন।’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম। সোহরাব কখন থেমে গেছে টের পাইনি। কবিতা শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেছে চারপাশে। সে প্রশ্ন করলো,

‘এটা কার লেখা জানো?’

কখনো কবিতা পড়া হয়নি। বলতে গেলে সময় হয়নি। কবিতার প্রতি ভালোবাসা সবার আসে না। যারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যায় তাদের কবিতা পড়ার সময় হয় না। কবিতার প্রতি ভালো লগ জন্মায় না। তবে সোহরাবের বলা কবিতা ভালো লেগেছে। মুগ্ধতা এখনও কাটেনি। আমি বিমুগ্ধ সুরে বললাম,

‘জানি না। কার লেখা?’

‘আহসান হাবীব। আমার পছন্দের একজন।’

আমার দৃষ্টি তার আবছা অবয়বের পানে ছিল। আচমকা সে নড়ে উঠলো। বাহুডোর শক্ত করে আরো কাছে টেনে নিল। চমকে যাওয়া ছাড়া কিছু করতে পারলাম না আমি। চোখের পলক ফেলার আগে সোহরাব অঘটন ঘটিয়ে ফেললো। তার অধর যুগল আমার তেল চিটচিটে কপাল স্পর্শ করলো। দ্বিতীয় চুমুটা ঠোঁটে পড়লো। কিয়ৎক্ষনের জন্য বোধবুদ্ধি হারালাম। মনের পর্দায় রাজ ভাইয়ার চেহারা ভেসে উঠলো। এক সন্ধায় সে ঝড়ো হাওয়ার মতো কাছে এসে চুমু খেয়েছিল। এমন লুকোনো চুমুর ক্ষত কী সবার থাকে? সবাই কী এমন দু চারটে গোপন অনুভূতি, গোপন দুঃখ এভাবে লুকিয়ে রাখে? হয়তো!

সোহরাবের স্পর্শ গুলো গভীর হচ্ছে। বাঁধা দেওয়ার অবকাশ পেলাম না। চোখজোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো আমার। বন্ধ হতে দু চোখের কিনার বেয়ে সরু এক জলের ধারা কান স্পর্শ করলো।

____________

এর মধ্যে দুদিন কেটে গেছে। সোহরাব আজ সকাল সকাল কাজের জন্য তৈরি হয়ে গেল। স্যুট-বুট পরে। কিন্তু সে কী কাজ করে তা অজানা আমার। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে পিছিয়ে এলাম। তার সাথে সহজ করে কথা বলা হয়ে উঠেনি। সে আমার চারপাশে স্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। তবুও আমি সহজ হয়ে উঠতে পারি না। এতগুলো দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সবার হুকুম মেনে চলতে চলতে নিজেকে অনেক ছোট করে ফেলেছি। সংকীর্ণ করে ফেলেছি। সবকিছুতে এখনও তার ছাপ রয়ে গেছে। সারাক্ষণ তটস্থ থাকার অভ্যাস যায়নি। সোহরাব সামান্য নাম ধরে ডাক দিলেও সতর্ক হয়ে যাই। চমকে উঠি। মনে হয় এই বুঝি ধমক দিবে।

মানিব্যাগ পকেটে পুড়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো সোহরাব। হঠাৎ কাছে এসে বলল,

‘ফেরার পথে কিছু নিয়ে আসবো?’

ফোনের জন্য একটা সিম লাগবে। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কিন্তু বলার সাহস হলো না। সোহরাব নিজে থেকে যখন ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে তখন নিশ্চয়ই বলবে। আমি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,

‘লাগবে না।’

‘জানো জুঁই! পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ একটা প্রশ্ন আছে। পরিচিত, অপরিচিত সচরাচর সবাই জিজ্ঞেস করে। অথচ এতো সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ কখনো সহজ করে দিতে পারে না। সারাক্ষণ মিথ্যে বা ভুল উত্তর দেয়! বলো তো কী প্রশ্ন?’

কিছুক্ষণ ভাবলাম আমি। মাথায় খেললো না।

‘জানি না!’

‘কেমন আছো বা কেমন আছেন! এই সহজ প্রশ্নের উত্তরে মানুষ সবসময় মিথ্যে বলে। তোমায় যদি কখনো এই প্রশ্ন করি কখনো মিথ্যে বলবে না। অন্তত আমার কাছে না।’

মাথায় হাত ছুঁইয়ে সোহরাব বের হয়ে গেল। ভালো লাগার স্নিগ্ধ এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো দেহ জুড়ে!

রুমে কাপড় গুছিয়ে রাখছিলাম। নাহার আপা ডাক দিল। আমি ড্রয়িং রুমে এগিয়ে গেলাম। আপা মাথার চুলে চিরুনি করছিল। বলল,

‘আজ জিমনেশিয়ামে যাবো আমি। কয়েকদিন যাওয়া হয়নি। আশাকে রেখে যাচ্ছি। দেখে রেখো।’

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার দুলাভাই পানি চাইলে বা কিছু লাগলে দিয়ো।’

‘আচ্ছা আপা।’

নাহার আপা একটা চাকরি করে। মেয়েদের জিম শেখানোর চাকরি। এ ব্যাপারে এতকিছু জানি না। শুধু জানি ব্যায়াম শেখায় মেয়েদের। তবে তার বেশভূষা অতি আধুনিক! এমন মানুষ চাক্ষুষ দেখিনি কখনো। মাঝে মধ্যে টিভির পর্দায় দেখতাম। এখন একত্রে বসবাস করতে হচ্ছে। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় তার বলা মুশকিল।

আপা চুল খোঁপা করে ক্লিপ দিয়ে আটকালো। কাঁধে ব্যাগ চেপে অবশেষে বের হলো। দরজার কাছে এসে আমি নত সুরে বললাম,

‘আশা কাঁদবে না তো আপা?’

‘কাঁদবে না। ওর আব্বু আছে তো। ভীষণ বাবা ভক্ত মেয়ে। তুমি শুধু সময় মতো খাইয়ে দিয়ো!’

‘হুঁ!’

আপা জুতা পায়ে গলিয়ে হাঁটা ধরলো। সিঁড়ি দিয়ে যতক্ষণ নামার শব্দ কানে এলো ততক্ষণ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শব্দ মিলিয়ে যেতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছিটকিনি লাগিয়ে সরে আসলাম। ঘরে এসে আবার কাপড় গুছানোতে মনোযোগ দিলাম। ও ঘরে আশা খেলছে। খানিক বাদে বাদে খিলখিল করে হেসে উঠছে। তার হাসির ঝংকার ফ্ল্যাটে আলোড়ন তুলেছে। আশার বয়স চার চলছে। শান্ত স্বভাবের মেয়ে। সোহরাব খুবই ভালোবাসে পিচ্চিকে। সে যতক্ষণ বাড়ি থাকবে আশা মামা মামা বলে গলা জড়িয়ে ধরে থাকবে। দেখতে বড্ড ভালো লাগে।

ঘন্টা খানেক পরেই বাহিরের কলিং বেল বেজে উঠলো। এখন তো কারো আসার কথা নয়। নাহার আপা দুপুরের পর আসবে। আর সোহরাব বলেছে তার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতে ওপাশের মানুষটিকে দেখে ভয়ানক চমকে গেলাম। সামান্তা আপু দাঁড়িয়ে আছে! লম্বা শাড়ির আঁচলে তাকে কেমন বউ বউ লাগছে। বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে এলো আমার। বিস্ফারিত কণ্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে এলো,

‘আপু!’

আপু হাসলো। হেসে উবু হয়ে পায়ের জুতা খোলার চেষ্টা করলো। আমার দুচোখে ততক্ষণে অশ্রুরা ভিড় জমিয়েছে। আপু সোজা হয়ে দাঁড়াতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম।

‘আহা! কান্নাকাটি কেন? ভেতরে চলো তো।’

এতক্ষণে মঈন চাচার উপর নজর গেল। চাচা দু হাত বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাস্যোজ্বল মুখ। আমি আপুকে ছেড়ে দিলাম। চোখের জল মুছে বললাম,

‘চাচা কেমন আছেন?’

‘আমি বেশ ভালো আছি। ভেতরে চলো।’

সামান্তা আপুর হাত ধরে ভেতর ঘরে এলাম। বসতে দিলাম তাদের। আপুর দৃষ্টি ছলছল করছে। স্বযত্নে নিজেকে লুকিয়ে মুখ খুললো সে। বলল,

‘কেমন আছিস রে জুঁই?’

সোহরাব এই প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলতে বারণ করেছে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম। সত্যি সত্যি কেমন আছি আমি? মনে হয় ভালোই আছি। পরিবার পরিজন ছাড়া ইয়াতিম একটা মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! মানুষ কত দুঃখে কষ্টে রয়েছে। এই শহরের অলিতে গলিতে কত অসহায় মানুষ পড়ে আছে। কারো পেটপুড়ে খাবার নেই, মাথার উপর চালা নেই, পরণে ঠিকঠাক কাপড় নেই। আরো কতশত অপূর্ণতা! সেখানে আমি বলতে গেলে রাজরানীর মতো আছি। একটা কাজের মেয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো কখনই হতে পারে না। আমি আপুর পাশ ঘেঁষে বসে পড়লাম। বললাম,

‘ভালো আছি আপু! আপনার কথা বলেন। ও বাড়ির সবার কী খবর? সালেহা খালা ভালো আছে? খালা আসলো না কেন?’

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__২৬

‘আমি ভালো আছি। আপনার কথা বলুন আপু। ও বাড়ির সবার কী খবর? সালেহা খালা ভালো আছে? খালা এলো না?’

আমার একগাদা প্রশ্নে সামান্তা আপু মজা করে বলল,

‘আহা, বলবো সব। এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? তোর এই বিচলিত স্বভাব কখনো গেল না জুঁই।’

মঈন চাচা হাতের ব্যাগপত্র নামিয়ে রেখেছে। মিষ্টি সহ আরো অনেক রকমের জিনিস দেখা যাচ্ছে। চাচা বলল,

‘বাসায় আর কেউ নাই মা?’

‘আছে চাচা। আমার ননদের স্বামী আছে।’

চাচাকে নিয়ে দুলাভাইয়ের রুমে গেলাম। দুলাভাই বিছানায় শুয়ে ছিল। চাচাকে দেখে সালাম দিল। আশা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। আমি পরিচয় করিয়ে দিয়ে সরে এলাম। আশাকে টানলাম কোলে নেওয়ার জন্য। সে এলো না। বসার ঘর থেকে সামান্তা আপুকে রুমে নিয়ে এলাম।

‘এটা তোদের ঘর?’

‘হ্যাঁ আপু।’

আড়ষ্ট গলায় বলে মাথা নত করে নিলাম।
কেন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে। নতুন বিয়ে হওয়া সবাই কী এমন লজ্জা পায়? লজ্জায় তাদের সবার চক্ষুর অন্তরালে লুকাতে ইচ্ছে করে? আপু শাড়ির আঁচল টেনে বিছানায় বসে পড়েছে। আমি বললাম,

‘সত্যি করে বলুন তো আপনি কেমন আছেন? সব ঠিক আছে?’

আপু মুখের পানে তাকালো। চোখে চোখ রেখে বলল,

‘হ্যাঁ রে। ঠিক আছে সব। তবে বাসায় ফিরে যখন তোর ঘটনা শুনলাম ভারী অবাক হয়ে গেছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম অনেক। না জানি কী করছিস, কেমন আছিস! চিন্তায় অস্থির দশা। বড় আব্বুর উপর রাগ হয়েছিল। আকাশ তো আমার অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজ তোকে প্রাণবন্ত দেখে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। ভালো লাগছে।’

কণ্ঠ বুজে আসছে আমার। ও বাড়ির সবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। খুব আপন করে নিয়েছিলাম সবাইকে। প্রকৃতি এমনই। সে ভীষণ একা বলে প্রিয় মানুষদের সঙ্গ সইতে পারে না। আপন মানুষদের সাথে বেশিক্ষন থাকতে দেয় না।

‘বড় মা ভালো আছে?’

‘হ্যাঁ। ভালো!’

উসখুস করছি আমি। রাজ ভাইয়া, ফাইজান ভাই, জাবির তাদের কী খবর? আমার আকস্মিক বিয়েতে ধাক্কা খায়নি তারা? হয়তো সামলে নিয়েছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষমেশ প্রশ্ন করলাম,

‘রাজ ভাইয়া শুনেছে? আমার বিয়ের কথা?’

আপু যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল। বলল,

‘হ্যাঁ শুনেছে। আমি বাসায় ফিরে তোর খোঁজ করছিলাম। কেউ ঠিকমত উত্তর দিচ্ছিলো না। সালেহা খালা টানা কান্না করছিল। তখন বড় আম্মু বলে দিল। রাজ ভাইয়া শুনে হতভম্ব। সাথে আমরাও। জাবির তো বিশ্বাসই করছিল না। দৌঁড়ে গিয়ে সারা বাড়ি খুঁজলো। ভেবেছে হয়তো মজা করছে। তখন বড় আব্বুর ধমকানি শুনে বিশ্বাস করেছি। রাজ ভাইয়ার ছোড়াছুড়ি স্বভাব। সে ডাইনিংয়ের কয়েকটা গ্লাস, প্লেট ছুঁড়ে মেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। আর ফেরেনি।’

‘এসব কী আকাশ ভাইয়ার সামনে হয়েছে?’

সামান্তা আপু অপ্রস্তুত হাসলো। বলল,

‘আরে হ্যাঁ রে! এসব ঘটনা ওর সামনে। ও বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল। পরে একসময় ফাঁকা পেয়ে আমার কাছে তোকে দেখার কৌতূহল প্রকাশ করলো। বাড়ির কাজের মেয়ের বিয়েতে এতগুলো মানুষের উদ্বিগ্নতা দেখে ও তো খুব অবাক।’

আপু ঠিক বলেছে। অবাক হওয়ার কথা। সে ফের বলল,

‘আসলে আমরা ছোটবেলা থেকে অন্যভাবে বড় হয়েছি। আর দশ জন বড়লোকদের মতো করে নয়। ছোটবেলা থেকে সবার সাথে বিনয়ী হওয়া শিখিয়েছে। আমার এখনো মনে আছে। এক মহিলা বাসায় প্রতি শুক্রবার কাজ করতে আসতো। একবার সে তার পাঁচ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে এলো। জাবির তখন বাচ্চা। কী কারণে যেন মেয়েটাকে মেরেছিল। বড় মা এতে খুব রেগে গেল। শাস্তিস্বরূপ সারাদিন জাবিরকে খেতে দিল না।’

‘আপু জাবির আসলো না?’

‘ও হোস্টেলে চলে গেছে। তোর বিয়েতে কষ্ট পেয়েছে খুব। আসলে জাবির ছোটবেলা থেকে একটু চাপা স্বভাবের জুঁই। তেমন করে কারও সাথে মিশতে পারে না। কথা বলতে পারে না। কিন্তু তোর সাথে স্বস্তি নিয়ে কথা বলতে দেখেছি। এজন্য আমি কখনো বাঁধা দেইনি। একটা কথা কী জানিস? আমাদের সবসময় বর্তমানটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ঠিক বর্তমানে, এই মুহূর্তে আমি কার সাথে ভালো থাকবো, কী করলে ভালো থাকবো তাই করা উচিত। ভবিষ্যৎ! সেটা তো ধোঁয়াশাময়। কী হবে না হবে কে জানে। কিন্তু ঠিক বর্তমানে আমি একটু হাসিখুশি আছি কি না, ভালো আছি কি না এটাই প্রধান। এটাই দেখার বিষয়। এজন্য জাবিরকে আমি কখনো বাঁধা দেইনি। যদিও জানতাম তোদের এই বন্ধুত্ব অল্প সময়ের। তবুও এই অল্প সময়টা খুব গুরত্বপূর্ণ।’

বেশ কিছুক্ষন নিরব রইলাম দুজন। এক সময় উঠে দাঁড়ালাম আমি। খাবার দাবার কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।

‘আপু বসেন আপনি। আমি আছি।’

আপু যেতে দিল না। হাত টেনে আবার বসিয়ে দিল। বলল,

‘কিছু খাবো না আমি। রুচি নেই। একদম নষ্ট হয়ে গেছে।’

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সে বলল,

‘বিয়ের সময় ফাইজান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলি?’

‘করেছিলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল।’

‘কত ভয় পায় আমাকে দেখেছিস। সামান্তা মানেই তার কাছে আতঙ্ক। কিন্তু আমি তার আতঙ্ক হতে চেয়েছিলাম না। অন্যকিছু হতে চেয়েছিলাম।’

ফাইজান ভাইয়ের ফোন খোলা ছিল। হলুদের দিন রাতের বেলা আপু যখন আমার ফোন দিয়ে কল করে কান্নাকাটি করেছিল তখন হয়তো ফোন বন্ধ করেছে। সেই বন্ধ ফোন বিয়ের পরদিন পর্যন্ত ছিল। আচমকা মস্তিষ্কে অন্য একটা প্রশ্ন এলো। ফাইজান ভাই সিম পাল্টে ফেলেনি তো? তার নাম্বার সামান্তা আপুর অন্তরে গাঁথা। সহজে ভুলতে পারবে না সে সংখ্যাগুলো। সিম পাল্টে ফেলা আহামরি কিছু নয়।

‘ফাইজান ভাই আমার বিয়ের খবর জানে আপু?’

‘জানে হয়তো। এতোবড় ঘটনা অজানা থাকার কথা না।’

মনঃক্ষুণ্ণ হলো আমার। ফাইজান ভাই জেনেও একটিবার খোঁজ নিল না? ইতোমধ্যে তিনদিন হয়ে গেছে। সামান্তা আপু বুঝতে পারলো। আমার ধরে রাখা হাতে চাপ দিয়ে বলল,

‘নিজে ভালো থাকলে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। কিন্তু নিজে যদি ভালো না থাকি? সুখে না থাকি? তখন কী করে অন্যের কথা ভাববো বল। কী করে তার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াব? আমরা সাধারণ মানুষ। কোনো মহানুভব বা মহাপুরুষ না যে নিজে যাতনা সহ্য করেও আরেকজনের দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়বো। ফাইজান ভাইয়ের তেমন হয়েছে। সে হয়তো ভালো নেই। সেজন্য তোর খোঁজ নিচ্ছে না। কিংবা এমনও হতে পারে। দূর থেকে একটু আধটু খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে তুই ভালো আছিস। জল আর ঘোলা করেনি তখন।’

‘হতে পারে।’

খারাপ লাগছে। আপুর কথাবার্তা থেকে অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে ফাইজান ভাই ভালো নেই। কিন্তু তার তো প্রেমের বিয়ে বলা চলে। তাহলে ভালো নেই কেন? সুখে নেই কেন? আপু একসময় নিজে থেকে বলল,

‘ভালোবাসা স্নিগ্ধ সুন্দর। কিন্তু সংসার জীবন স্নিগ্ধ সুন্দর নয়। এর পথ অমসৃণ, বন্ধুর। এ পথে হাঁটার জন্য অপর ব্যক্তিটির হাত শক্তপোক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরতে হয়। অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। ছোটখাট অনেক শখ, আহ্লাদ স্যাক্রিফাইস করতে হয়। সংসার জীবনে দুজন মানুষের স্বপ্ন এক হতে হয় নাহলে ছোটবেলা থেকে লালন করা স্বপ্ন ভেঙ্গে নতুন স্বপ্ন দেখতে হয়। তেমন করে নিজেকে গড়তে হয়। তবে হয়তো একটু সুখে থাকা যায়।’

‘হুঁ!’

‘তবে অদ্ভুত কী জানিস জুঁই? সম্প্রতি একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি। এই শহরে কিছু মানুষ ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পেয়ে দুঃখে আছে। আর কিছু মানুষ ভালোবাসার মানুষটাকে না পেয়ে দুঃখে আছে। দিনশেষে সবাই দুঃখে আছে। কষ্টে আছে। এটাই স্বাভাবিক। দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা এসব জীবনের ধর্ম। জীবনের নিজস্ব অর্থ!’

জীবনের ধর্ম নিষ্ঠুর। এই নিষ্ঠুরতার জন্য এত যাতনা। এতো বেদনা। দুজনের কেউ আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। আপু নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। আমিও নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। কেন কাঁদছি জানি না। কার জন্য কাঁদছি তা-ও অজানা।

_________

দিন কে দিন সোহরাবের ব্যস্ততা বাড়ছে। সকাল হতে হতে বেরিয়ে পড়ে। ফিরে রাত করে। কোনো কোনো দিন তো মাঝরাত হয়ে যায়। আমার জীবন কাটছে পানসের মতো। বাইরে বের হওয়া নেই, কলেজে যাওয়া নেই। সারাদিন ঘরবন্দী। দিনটা বাড়ির কাজ করতে করতে চলে যায়। ভোরবেলা উঠে নাস্তা রেডি করি। সবাই খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি ততক্ষনে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে, মুছে ফেলি। দুপুরের আগে আগে আবার রান্না করি। আশাকে চোখে চোখে রাখি। এসব করেই দিন যাচ্ছে।

দুলাভাইয়ের শরীর সুস্থ হয়ে উঠছে। পায়ের প্লাস্টার খোলা হয়েছে। তবে আগের মতো ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করে। সেই অবস্থায় দুদিন হলো অফিসে যাওয়া শুরু করেছেন। বেসরকারি এক ব্যাংকে কর্মরত তিনি। সকাল হতে অফিসে চলে যায়। সারাদিন আমি আর আশা বাড়ি থাকি। আশা আর আমার মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। সে এখন মামার চেয়ে মামী প্রিয়। প্রায় রাতে আমার সাথে ঘুমানোর বায়না ধরে। সন্ধার পর পর এসে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে যায়। সোহরাব তা নিয়ে কপট মিথ্যে রাগ দেখায়। একসময় নিজে গিয়ে আশাকে নাহার আপার রুমে রেখে আসে।

মাঝে মাঝে সোহরাবের পাগলামি দেখে হাসি পায়। অবুঝ মনে হয়। এতোবড় একটা মানুষ। ঠিক তার ভেতর লুকোনো বাচ্চা সুলভ মনোভাব। সেটা একমাত্র আমার সামনে প্রকাশ পায়। আমি খুব কাছে থেকে অবাক নয়নে একজনের বাচ্চামো দেখি।

রাতের বেলা আশাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলাম। সিদ্ধ ডিম দিয়ে ভাত। ডিমের কুসম আশার পছন্দ না। কিন্তু ছোটবেলা কুসুমের জন্য একদম পাগল ছিলাম আমি। ছোটবেলা বললে ভুল হবে। বড় বেলাতেও পাগল ছিলাম। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় আস্ত একটা ডিম কখনো খাওয়া হয়নি। তখন বাজারে আলুর দাম কম থাকতো। সব সবজির আকাশচড়া দাম। কিন্তু আলুর দাম হাতের নাগালে থাকতো। যার জন্য আব্বা ব্যাগ বোঝাই করে ছোট, বড়, মাঝারি সব আকারের আলু কিনে আনতো। মা সেই আলু দিয়ে বিভিন্ন পদ করতো। প্রায়ই আলুর ডাল হতো বাড়িতে। রান্নার সময় সে ঘন তরল পদার্থের মধ্যে মা একটা কাঁচা ডিম ভেঙ্গে দিতো। তরকারির স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যেতো।

কখনো বা আলু দিয়ে ডিম রান্না হতো। একটা ডিম চারভাগ করে ঝোলের মধ্যে ছেড়ে দিত। এতগুলো মানুষ। এক টুকরো করে ডিম সবার হতো না। আমি আড়চোখে খেয়াল করতাম মা শুধু ঝোল দিয়ে খেয়ে উঠতো। আব্বার পাতে যে ছোট্ট এক টুকরো দেওয়া হতো সে চুপিসারে সেটা তরকারির বাটিতে রেখে দিতো। মা দেখতো কিন্তু প্রতিবাদ করতো না। সন্তানেরা আরেকবার খাবে এই আশায় চুপ হয়ে থাকতো।

বোনদের মধ্যে সেজো আপা ছিল সবচেয়ে বুঝদার। চোখের পলক ফেলার আগে সব বুঝে যেতো। বড় আপা যেখানে বাচ্চাদের মত বড় মাছটার জন্য বায়না করতো সেখানে সেজো আপা শুধু তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠে যেতো। কখনো মা মাছ তুলে দিলে সে বার বার বলতো, ওরা সবাই খেয়েছে? বাকি সবার হবে তো?

কত দায়িত্বশীল, বুঝদার বোন আমার। এখন কোথায় রয়েছে? কেমন রয়েছে? চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে জল আটকালাম।

কলিং বেল বাজছে। আশার খাওয়া শেষ হয়নি। উঠলাম না আমি। নাহার আপা বোধ হয় খুলে দিল। কিছুক্ষণ পরেই সোহরাব ঘরে ঢুকলো। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালাম। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। গায়ের শার্ট ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। সে এক পলক আমার পানে চেয়ে বিছানায় বসলো। পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বলল,

‘আশামনি কী করে?’

আশা পুতুল নাড়াচাড়া করছে। পুতুলটা দুদিন হলো নাহার আপা এনে দিয়েছে। আশার এতো পছন্দ হয়েছে যে হাত থেকে নামাচ্ছে না। ঘুমানোর সময়ও পাশে নিয়ে ঘুমায়। সে কিন্নর কণ্ঠে বলল,

‘আশা মনি ভাত খায়।’

‘তার খাওয়া কতদূর?’

আশা কিছু বললো না। সে মনোযোগ দিয়ে পুতুলের চুল বাঁধার চেষ্টা করছে। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম,

‘খাওয়া শেষ। আসছি আমি।’

আশাকে নিয়ে বসার ঘরে এলাম। পানি খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছে দিলাম। সে দৌঁড়ে তার মায়ের রুমে গেল। আমি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ধুয়ে বের হলাম।

ঘরে ঢুকতে চোখেমুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সোহরাব খালি গায়ে বসে আছে। অর্ধভেজা শার্ট আলনার উপর ছড়ানো। প্রায় প্রায়ই সে এই কাজ করে। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। সোহরাব টের পেল হয়তো। কাছে টেনে বলল,

‘একি অবস্থা! লজ্জা কেন পাচ্ছো? মনে হচ্ছে খালি গায়ে আমি নয়। তুমি বসে আছো।’

ঠোঁটের কিনারায় অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আমি মাথা আরো নত করলাম। সে বলল,

‘এতগুলো দিন হয়ে গেল বিয়ের। এখনো এতো লজ্জা পেলে চলে?’

‘খিদে পায়নি? হাতমুখ ধুয়ে আসুন। ভাত বেড়ে দিচ্ছি।’

‘খাবো। একটু চুপচাপ বসো তো পাশে।’

বসে রইলাম তার পাশে। সোহরাব তার মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে হাত চেপে রইলো। আমি সন্তর্পনে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। দরজা সামান্য ভেড়ানো। যখন তখন যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। সতর্ক দৃষ্টি সেদিকে রেখে বললাম,

‘আপনি ইদানিং কী কাজ করেন? অনেক ক্লান্ত মনে হয় আপনাকে।’

‘হুঁ। অনেক ক্লান্ত। সারাদিন মি’ছিল, সমাবেশ আর ছুটোছুটি উপর দিয়ে যায়।’

বুকের গহীনে সূক্ষ্ম এক ব্যথার উপস্থিত টের পেলাম। সোহরাব আজাদ আঙ্কেলের হয়ে কাজ করে। এখনো সে কাজ চলমান। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সোহরাব নিজে থেকে বলল,

‘তুমি তো ঠিকমত খবর রাখো না। টিভি দেখো না। এ মাসের একুশ তারিখ নি’র্বাচন। সেজন্য দৌঁড়াদৌঁড়ি বেড়ে গেছে। নি’র্বাচন শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন একদম রিলাক্সে থাকতে পারবো।’

সোহরাবের অতিশয় ক্লান্ত স্বর। কথা শেষ করে হাই তুলল সে। আমার বড্ড মায়া হলো। মানুষটা কত পরিশ্রম করছে। একবার মনে হলো এই কাজ থেকে সরে আসতে বলি। পরক্ষণে বুঝলাম এটা কখনো সম্ভব নয়। সোহরাব তার কাজে যেই পরিমান দায়িত্বশীল সে কখনো সরে আসবে না। রা’জনীতিতে একবার কেউ জড়িয়ে পড়লে, ভালোবাসা জন্মে গেলে তারা আর পিছু ফিরতে পারে না। পিছু ফেরার অবকাশ পায় না।

দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সোহরাবের চুলের ভাঁজে হাত রাখলাম। এই ছেলেটার প্রতি আমার মায়া জন্মে গেছে। একটা সংসার করার জন্য যতটুকু মায়ার প্রয়োজন তার থেকে একটু বেশি। না! একটু নয়, অনেকখানি বেশি মায়া জন্মে গেছে।

__________

শুক্রবারের বিকেল। সোহরাব আজ সারাদিন বাড়ি ছিল। একবারও বের হয়নি। আজ কোনো কাজ নেই। যার দরুণ বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমালো সে। রান্নাবান্না শেষ করে তাকে ডাকতে এলাম। তার ঘুম ভাঙাতে অনেক বেগ পেতে হলো। শেষমেশ আমার জোরাজুরিতে উঠে বাথরুমে গেল।

সে বাথরুমে ঢোকার পর ফোন বেজে উঠলো। প্রচুর ফোনকল আসে সোহরাবের। আমি না দেখলেও বুঝতে পারি সে দলের মধ্যে মোটামুটি জনপ্রিয়। আজও সমানে ফোন বেজে উঠছে। একবার কল কেটে দু সেকেন্ড অতিক্রম করতে না করতেই আবার কল বেজে উঠছে। রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুম নেই। সোহরাব ড্রয়িং রুমের পাশের বাথরুমে ঢুকেছে। আমি দরজায় চাপড় মেরে বললাম,

‘ফোন বাজে আপনার। তাড়াতাড়ি বের হোন।’

‘বের হচ্ছি।’

কিয়ৎক্ষণ বাদে টিশার্ট পরে বের হলো সে। ভেজা চুল ভালো মতো না মুছে ফোন কানে ধরলো। ওপাশে কী কথাবার্তা হলো জানি না। কিন্তু সোহরাব চমকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে কল কাটলো। কাঁধের তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে রেখে দিল। হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজলো। আমি পেছন থেকে বললাম,

‘কিছু হয়েছে? এমন করছেন কেন?’

আমার কথা শুনে তার খেয়াল হলো যেন। দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে তাকালো। চিন্তিত মুখে বলল,

‘আজাদ ভাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। মারাত্মক অবস্থা। আইসিইউতে ভর্তি আছে।’

কলিজা কেঁপে উঠলো আমার। সোহরাব হঠাৎ বলল,

‘তুমি দেখতে যাবে? গেলে ঝটপট কাপড় পাল্টে নাও।’

(চলবে)