ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-২৯+৩০

0
168

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-২৯+৩০

আমারো কী এমন হবে? আপার মতো কপাল পুড়বে? ডুকরে কেঁদে উঠলাম। জীবনের হিসাব-নিকাশ বড্ড জটিল। এতোশত জটিলতা আমায় বয়সের তুলনায় অত্যধিক বাস্তবিক করে তুলেছে। আমি জানি এই থাপ্পড় খাওয়ার পরও সোহরাবের সাথে সংসার করতে হবে। তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হবে। দিন কাটাতে হবে। যুগ যুগ ধরে মা চাচীরা সেটাই করে আসছে। দুদিন গেলে সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। তবুও আমার ক্ষুদ্র মনে প্রশ্ন জাগলো এই ব্যথা কী কোনোদিন ভুলতে পারবো? এই আঘাত কি চিরতরে মুছে যাবে? আমিও তো আশাকে ভালোবাসি। তার খেয়াল রাখি। প্রায়ই ভাগের মাছটা কাঁটা বেছে ওকে খাইয়ে দেই। তবুও সোহরাব এই কাজ কি করে করলো?

চোখে মুখে পানি দিয়ে বের হলাম। ঘরে আর গেলাম না। গায়ের ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ফেললাম। সোহরাবের খাওয়া হয়েছে কি না কে জানে। আমি তার জন্য ভাত টেবিলে সাজিয়ে ফেললাম।

সোহরাব ঘরে রয়েছে। এতক্ষণ আশার কান্নার আওয়াজ শোনা গেলেও এখন থেমে গেছে। আমি থমথমে মুখে এগিয়ে গেলাম। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘ভাত বেড়ে দিয়েছি। এসে খেয়ে যান।’

সোহরাব কিঞ্চিৎ চমকে গেল। অপরাধী মুখে তাকালো। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। আশা বিছানায় বসে রয়েছে। হাতে পুতুল। আমি এগিয়ে যেতে সোহরাব তাকে রেখে রুম ত্যাগ করলো। আমি আর খাবারের ওখানে গেলাম না। আশার পাশে বসে পড়লাম। কাছে টেনে দেখি ঠোঁট আরো বেশি ফুলে গেছে। চোখ ছলছল করে উঠলো। আমি ব্যথাতুর কণ্ঠে শুধালাম,

‘খুব বেশি ব্যথা করছে আশা?’

আশা ডানে বায়ে মাথা নাড়লো। আমি মনে শান্তি পেলাম না। পিচ্চিটাকে ভীষণ ভালোবাসি। এতখানি ব্যথা পেয়েছে আমার নিজের গাফিলতির জন্য। ভীষণ কষ্ট হলো। যদি কোলে থেকে না নামাতাম তাহলেই হতো।

সোহরাব টেবিলে খেতে বসেছে। দরজা দিয়ে সামান্য উঁকি দিলাম। গোগ্রাসে খাচ্ছে। সারাদিন খায়নি হয়তো। অন্যের ফরমায়েশ খাটা সুখকর নয়। অনেক কিছু নিজের ইচ্ছানুযায়ী করা যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সোহরাবের থেকে দূরে দূরে রইলাম। এ বেলা সে আর বের হয়নি। ঘরে শুয়ে আছে। আমি আশাকে নিয়ে বসার ঘরে রইলাম। নাহার আপা এলো আসরের পর পর। আমি প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তার ভাই আশার ঠোঁট কেটে যাওয়ার জন্য থাপ্পড় মারলো। সে আবার কি না কি করে! কিন্তু আপা কিছু বললো না। আশার কাঁটা ঠোঁটে মলম লাগিয়ে দিল। শুধু জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথায় পড়ে গেছিল? বিছানা থেকে নাকি?’

ছাদে পড়ার কথা বললাম। আপা মাথা নাড়ল। আমি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে রান্নাবান্না শুরু করলাম।

সারা সন্ধ্যে আড়ালে আড়ালে থাকলেও রাতের বেলা রুমে ঢুকতে হলো। ড্রয়িং রুম, রান্নাঘরের বাল্ব বন্ধ করে রুমে আসলাম। সোহরাব অনেক আগে খেয়ে শুয়ে পড়েছে। আমি আড়চোখে এক পলক তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ বন্ধ। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গেলেই ভালো। তার সাথে কথা বলার রুচি নেই। মাত্র একমাসের পরিচয় থেকে একটা ছেলে আমাকে চ’ড় মেরে বসলো। অথচ আমি সোহরাবকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মনে করেছিলাম। একটু আলাদা মনে করেছিলাম।

দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলাম। বিছানার পায়ের কাছে জানালা। সেই জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। রাজ ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। কেমন আছে সে? সামান্তা আপু, ফাইজান ভাই তারা কেমন আছে? রাফি ভাই? সে হয়তো এতদিনে বিদেশ চলে গেছে। সেখানে নতুন জীবন শুরু করেছে। আমার ভালোবাসা তাকে ছুঁতে পারলো না। টুকরো মেঘের মতো তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সে অভিমানী ভালোবাসা ফের আমার দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সে ভালোবাসা বন্দি করে দরজায় খিল দিয়েছি।

দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে উঠে পড়লাম। সাবধানে সোহরাবকে ডিঙিয়ে ওপাশে শুয়ে পড়লাম। আচ্ছা আমার জায়গা অন্য কোনো মেয়ে থাকলে কী করতো? বরের পাশে ঘুমাতো নাকি অন্তত আজকের রাতটা অভিমান করে দূরে থাকতো? আমার দূরে থাকার উপায় নেই। মূলত আমার দূরে না কাছে! কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

সোহরাবের থেকে দূরত্ব রেখে শুয়েছিলাম। একেবারে দেয়াল সেটে। চোখের পাতা বন্ধ করার পরও দুচোখে ঘুম আসছিলো না। চারপাশ রাতের অন্ধকারের মতো ভারী হয়ে উঠতে গায়ে হাত পড়লো। সোহরাব এগিয়ে এসে কাছে টানলো আমায়। মুহূর্তে জিদ চেপে গেল। তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দেয়াল ঘেঁষে গেলাম। সোহরাব ছাড়লো না। জোরালো হাতে চেপে ধরলো। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘দূরে যান।’

সোহরাব দূরে গেল না। বলল,

‘সরি! আগে থেকে মাথা গরম ছিল অনেক। বাসায় ফিরে দেখি পুরো ফ্ল্যাট খালি। কেউ নেই। যদি কিছু চুরি হয়ে যেতো? এরমধ্যে আবার আশার অবস্থা দেখে…..সরি!’

কিছুক্ষণ নিজের অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করে গেলাম। অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণ আটকে রাখা সব কান্না বেরিয়ে এলো। সোহরাব বুকে টেনে নিল আমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তবুও শান্তি পেলাম না। বুকের গহীনের দহনটা ক্রমশ বেড়ে চললো।

_________

নাহার আপার ঘর থেকে চাপা শব্দ ভেসে আসছে। ঝগড়ার শব্দ। দুজন দুজনকে গালিগালাজ করছে। দুলাইভাইয়ের কণ্ঠ বেশি রাগান্বিত মনে হচ্ছে। পাশের ঘর থেকে ভীষণ লজ্জায় পড়লাম। এ বাড়িতে থাকা আমার পছন্দ না। আপা তার নিজের মতো অনেক কিছু করতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে লজ্জায় পড়তে হয়। এমন ফ্ল্যাটে না থেকে যদি ভাঙাচোরা কোনো টিনের ঘরে থাকতাম তবুও ভালো লাগতো। শুধু আমি আর সোহরাব। তবুও ঢের ভালো ছিল। সোহরাবকে একবার বলবো বলে ভেবে রেখেছি। কিন্তু কী মনে করে ভেবে বলা হয় না। যদি রেগে যায়? বলে যে মাস ঘুরতে না ঘুরতেই তোমার আলাদা বাসা চাই? এতো লোভী মেয়ে কেন তুমি?

আচমকা ও ঘর থেকে ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ এলো। সাথে জিনিসপত্র ভাঙ্গার শব্দ। আশা চিৎকার করে উঠতে আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। লজ্জার মাথা খেয়ে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি দুলাভাই আপাকে মারছে। আপাও থেমে নেই। সে-ও প্রতিরোধের ভঙ্গিতে কিল, ঘুষি দিচ্ছে। ভয়ার্ত গলায় তাদের থামতে বললাম। কেউ থামাথামির মধ্যে গেল না। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর আপাকে ছাড়াতে সক্ষম হলাম। তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে আসলাম। দুলাভাই রাগে ফুঁসতে লাগলো। আপাকে আমার ঘরে টেনে নিয়ে আসলাম। কান্না করছে সে। আমি চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কী হয়েছে আপা? হঠাৎ করে দুলাভাই এতো রেগে গেল কেন?’

আপা উত্তর দিল না। আমি আর ঘাটালাম না। স্বামী-স্ত্রীর কত ধরনের সমস্যা হয়।মান অভিমান হয়। সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। দুলাভাই ও ঘর থেকে এখনো চেঁচাচ্ছে। আপা ফুঁসে উঠতে তাকে টেনে ধরে রাখলাম।

সোহরাবের বাবা নেই। মা আছে। তার মা যে বেঁচে আছে সেটা অনেক পরে জানতে পেরেছি। সোহরাবের স্কুল শিক্ষক ফুপির থেকে। কিছুদিন আগে ফুপি ঘুরতে এসেছিল। তিনি জানালেন সোহরাবের মা বেঁচে আছে। তার বাবার মৃত্যুর কয়েক বছর পর অন্য জায়গা বিয়ে করেছে। তারপর থেকে ছেলেমেয়ের সাথে যোগাযোগ নেই। বছর খানেক ধরে নাকি শুধু নাহার আপার সাথে টুকটাক কথা হয়। আশাকে দেখার অজুহাতে একটু আধটু সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

‘আপা কাঁদবেন না। ঠিক হয়ে যাবে সব।’

আমরা কত সহজে আরেকজনকে সান্তনা দেই। বলি ঠিক হয়ে যাবে সব। অথচ কিছুই ঠিক হয় না। হাজারো বেঠিক বুকে চেপে রেখে দিন কাটাতে হয়। আশা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ছলছল করছে। মায়ের কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে। আমি আপাকে বললাম,

‘আপা আর কাঁদবেন না। আপনার কান্না দেখে আশা কিন্তু যখন তখন কেঁদে দিবে।’

অবশেষে আপা থামলো। চোখ মুছে দুলাভাইকে গালি দিল। তারপর বলল,

‘সোহরাব কই?’

‘তার যা কাজ সেই কাজে গেছে।’

‘বাসায় আসলে এ ব্যাপারে কিছু বলিও না। অশান্তি বাড়বে আরো।’

‘আচ্ছা।’

রাতের বেলা সোহরাব এলো। তার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবুও কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। কোথায় যেন সূক্ষ্ম কাঁটার মতো কিছু একটা আটকে আছে। এখন সে বাড়ি না থাকলে আগের মতন মনে পড়ে না। দেরি করে বাড়ি ফিরলে আগের মতো চিন্তা হয় না। আরো অনেক কিছু আগের মতো নেই। প্রতিনিয়ত সোহরাবের পরিবর্তন হচ্ছে। আমারো পরিবর্তন হচ্ছে। দুজনই খুব করে টের পাচ্ছি। কিন্তু কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।

নিয়মমাফিক তার গোসলের জিনিসপত্র এগিয়ে দিলাম। কাপড়চোপড় হাতে ধরিয়ে দিলাম। খাবার বেড়ে দিলাম। আরো অনেক কিছু করলাম। এরমধ্যে মনে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের আলাদা সংসারের কথা বলতে গিয়ে পিছিয়ে এলাম বারংবার।

ঘুমাতে গিয়ে শেষমেশ বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। সোহরাব আধো ঘুমে ছিল। ক্ষীণ আওয়াজ তুলে ডাকলাম তাকে।

‘শুনছেন?’

‘হুঁ। বলো।’

‘আমাদের আলাদা বাসা নিলে হয় না?’

সোহরাব এমন ভাবে চমকে উঠলো যে অন্ধকারেও টের পেলাম। সে কিছু বলার আগে ঝটপট বললাম,

‘একদম অল্প ভাড়ার বাসা। ছোটখাটো
টিনের ঘর। অপরিচ্ছন্ন হলেও হবে।’

‘হঠাৎ আলাদা বাসায় থাকার কথা উঠছে কেন? এখানে শহরের মধ্যে এতবড় ফ্ল্যাট। এতো সুযোগ সুবিধা।’

‘কিন্তু আমার কেমন যেন লাগে।’

সোহরাব আমার কথা শুনতে পেল না হয়তো। সে জোর দিয়ে বলল,

‘আমরা আলাদা বাসা নিলে আশাকে দেখবে কে? বড় আপার চাকরি আছে না? তাছাড়া বাসার দেখ-ভাল করা, রান্নাবান্না করা, সবদিকে খেয়াল রাখা। এসব তো তুমি করছো। আমরা চলে গেলে এতসব দিক সামলাবে কে? কোনো আলাদা বাসা হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো।’

সোহরাবের কণ্ঠে বিরক্তির আভাস। সে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। তার বিপরীত পাশে আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বড় বড় চোখ দিয়ে অন্ধকার গিলতে লাগলাম। তবুও যদি জীবনের অন্ধকার একটু কমে।

সোহরাব কতকিছু বলে দিল। কত হিসাব করে রেখেছে সে। নিখুঁত হিসাব। শুধু আমার জীবন নিয়ে সচেতন নয় সে। কোনো হিসাব নেই। কোনো চিন্তা নেই। একবার কলেজ যাওয়ার ব্যাপারে বলেছিলাম। সে এমন আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছে যেন এর চেয়ে অবাক কিছু জীবনে শোনেনি। ও বাড়ি থেকে রেজাল্ট দেখে এসেছে। তিনটা বিষয়ে ফেল এসেছে। সোহরাব উল্টো সেটার খোটা দিল।

বেশ বুঝতে পারছি আমার জীবনে আর কোনো পরিবর্তন আসবে না। রোজ যা করি তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। দিনরাত এই বাড়ির মধ্যে কেটে যাবে। কাটতে থাকুক! তবুও বেঁচে আছি আমার জন্য এই বুঝি ঢের।

__________

আজ নি’র্বাচনের দিন। সোহরাব দুদিন হলো বাসায় ফেরে না। ঢাকাতে থাকে। আজ এই উপলক্ষে নাহার আপাও ঢাকা গেছে। একেবারে ভোরবেলা। ভো’টের সময় নাকি মানুষ লাগে। আপার রা’জনীতিতে ঝোঁক অনেক। নিজে সরাসরি যুক্ত নেই। কিন্তু ভাইয়ের কাজকে সমর্থন করে। আমি ইতোমধ্যে টের পেয়েছি তাদের প্রচুর ক্ষমতার লো’ভ। কতদ্রুত বড় হবে, নামডাক করবে এই প্রবণতা। আমার চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

আশাকে আমার কাছে রেখে গেছে। ওকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছি। নড়াচড়া তেমন করে না। তবুও বাচ্চা মানুষ। কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে! সর্বদা তটস্থ থাকি।

সারাটা দিন চিন্তায় চিন্তায় কেটে গেল। ভো’টের ফলাফল কী জানি না। কাছে ফোন না থাকায় কল করে জেনে নেওয়ার উপায় নেই। অবশেষে বেলা গড়ানোর সময় নাহার আপা ফিরলো। বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে। আমি আর প্রশ্ন করলাম না। আপা গোসল করে খেতে বসলো। খাওয়ার ফাঁকে বলল,

‘আজাদ ভাই জিতেনি। তার প্রতি’দ্বন্দ্বী প্রার্থী জিতেছে।’

আমার সোহরাবের কথা মনে পড়লো। মানুষটা নিশ্চয়ই বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে। এই নি’র্বাচন নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার। আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,

‘আশার মামা কোথায়?’

‘ওকে ফেরার সময় দেখিনি। আছে কোথাও। পরে আসবে হয়তো।’

‘আজাদ আঙ্কেলের শরীর কেমন এখন?’

‘আগের মতই। ভোটের জন্য এতদিন দেশে রেখেছিল। এখন ফলাফল বের হয়ে গেছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিয়ে যাবে হয়তো।’

আমি নিশ্চুপ রইলাম। আপা সন্দেহ নিয়ে বলল,

‘কেন্দ্রে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তা না হলে এমন হওয়ার কথা না। সবাই জানতো আজাদ ভাই জিতবে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো বিপরীত।’

আমি সরে এলাম। এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। আমার চিন্তা অন্য জায়গায়। সোহরাব ঠিক আছে তো?

সোহরাব ফিরলো গভীর রাতে। রাত বিরেতে আসা যাওয়া করে বলে নিচের গেটের একটা অতিরিক্ত চাবি বানিয়ে নিয়েছে। ফ্ল্যাটের দরজা আমি খুলে দিলাম। সে ভেতরে ঢুকে সোজা বাথরুমে গেল। আমি কাপড়-চোপড় রেডি রেখে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করলাম। নিঃশব্দে সেগুলো গরম করলাম। সোহরাব গোসল শেষ করে টেবিলে খেতে বসলো।

সোহরাব ধীর গতিতে খাচ্ছে। মুখে খাবার নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিবুচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। তার দুঃখে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। প্লেটে একটা মাছ তুলে দিলাম। সে অবশেষে মুখ খুললো। খেতে খেতে বলল,

‘তুমি খেয়েছ জুঁই?’

সোহরাবের এতটুকু প্রশ্নে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। মানুষটার দুঃখ আমায় আরো গভীর ভাবে স্পর্শ করলো। খুব কষ্ট হলো তার জন্য। উচিত অনুচিতের বাছ-বিচার আসলো না। মন বলল, আজাদ আঙ্কেল ভো’টে জিতে গেলে কী খুব ক্ষতি হতো? ইশ! জিতলেই পারতো। আমি নিচু গলায় বললাম,

‘হ্যাঁ খেয়েছি। আপনি খাওয়া শেষ করেন। তরকারি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

বলে পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব__৩০

সোহরাবের পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। এই প্রথম গাঢ় দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে রইলাম।
__________

নাহার আপা আর দুলাভাইয়ের আবার ঝগড়া লেগেছে। মারামারি পর্যায়ের ঝগড়া। তখন দুপুরের রান্না করছিলাম আমি। চেঁচামেচি বাড়তে এগিয়ে গেলাম। দরজা অবধি পৌঁছানোর আগে দুলাভাই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। আশাকে আগেই বাইরে বের করে দিয়েছে। ভয় পেয়ে গেলাম। ঘরের ভেতর চেঁচামেচি বেড়ে যাচ্ছে। আমি দরজায় ক্রমাগত চাপড় মারলাম। কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না। উল্টো লন্ডভন্ডের শব্দ কানে এলো। খানিক বাদে আপা কান্না করতে লাগলো। এপাশে বুক কেঁপে উঠলো আমার। বন্ধ দরজার ওপাশে কী হচ্ছে খুব সহজে আন্দাজ করতে লাগলাম। আপাকে দুলাভাই মারছে।

মায়ের কান্না শুনে আশা কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে অস্থির হয়ে গেলাম। ভয়ার্ত গলায় বার বার বললাম,

‘দুলাভাই দরজা খুলুন। দরজা খুলে দিন।’

কিছুক্ষন পরে দুলাভাই দরজা খুললো। রাগে তখনো হাঁফাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে বাইরে চলে গেল। আমি ছুটে আপার কাছে গেলাম। আপা মেঝেতে পড়ে আছে। গায়ের কাপড় ঠিক নেই। আশপাশে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দুলাভাই হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দিয়ে মেরেছে। আপাকে টেনে বিছানায় নিলাম। ব্যথায় গোঙাতে লাগলো সে। তার অবস্থা দেখে বুঝলাম কি’ল, চ’ড়, লা’থি কিছুই বাদ রাখেনি। ইতোমধ্যে চোখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। আপা প্রতিরোধ করতে পারেনি। পুরুষ মানুষের শক্তির সাথে পেরে উঠা সহজ কিছু নয়। আরো রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো এনে আ’ঘাতপ্রাপ্ত জায়গা চেপে ধরে রাখলাম। আশা দূরে দাঁড়িয়ে কাদঁছে। কেমন অসহায় লাগছে মেয়েটাকে। ভীষণ মায়া হলো আমার।

বেলা গড়াতে আপার অবস্থা বেগতিক হয়ে গেল। আ’ঘাতের জায়গা কালশিটে হয়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে একাকার। সন্ধার পর সোহরাব বাড়ি ফিরলো। আপার এই অবস্থা দেখে সে রেগে আগুন। দুলাভাইকে গালি গালাজ করে বের হয়ে গেল।

সে ফিরলো খুব তাড়াতাড়ি। কাছের এক দোকান থেকে কয়েক রকমের ওষুধ নিয়ে ফিরেছে। দুলাভাই ড্রয়িং রুমে বসে ছিল। তাকে দেখে সোহরাব ফের রেগে গেল। ছোট বড় পরিচয় না রেখে অকথ্য ভাষায় গালি দিল। দুলাভাই চুপ রইলো না। সে আরো দ্বিগুণ রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

‘খবরদার গলা উচুঁ করে কথা বলবি না সোহরাব। তোর বোন কী করেছে জানিস? ওকে তো মে’রে ফেলা দরকার।’

‘একদম চুপ। আপনি আপার গায়ে হাত তুলেছেন কোন সাহসে?’

‘মেরেছি বেশ করেছি। এমন নষ্টা মেয়েকে মারবো না তো আদর সোহাগ করবো? তোর বোন যে কাজের নামে বাইরে গিয়ে নষ্টামি করে বেড়ায় খবর রেখেছিস? একদম মায়ের মতো হয়েছে। এইজন্য বিয়ে করার সময় বংশ দেখতে হয়। চরিত্রহীন মেয়েছেলে একটা….’

সোহরাব হাতের ওষুধ ফেলে রেখে তেড়ে গেল। বিশ্রী কিছু বলে দুলাভাইকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো। দুলাভাইও থেমে রইলো না। কলার চেপে ধরে মারতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল যেন। আমি আকস্মিক ধাক্কা সামলে চিৎকার করে উঠলাম। নাহার আপা অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে এলো। দুজন মিলে তাদের ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।

সোহরাব হাত ঝাড়া দিয়ে বের হয়ে গেল। দুলাভাই নিজের জায়গা বসে পড়লো। কন্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। মুখ ক্রমাগত চলছে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো সোহরাবকে গালি গালাজ করে যাচ্ছে। বছরের পর বছর বোনের বাসায় পড়ে আছে। কোনো আত্মসম্মান নেই ইত্যাদি।

আপাকে ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলাম। তাকে রেখে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমারো শরীর কাঁপছে থরথর করে। এতো অল্প সময়ে কতকিছু ঘটে গেল। মনের কোণে হঠাৎ প্রশ্নেরা উদিত হলো। দুলাভাই যা বললো তা কি সত্য? আমারো সামান্য সন্দেহ হচ্ছিল। আপা কাজে যাওয়ার আগে অনেকটা সময় নিয়ে সাজগোজ করে। ফোন কল আসলে আড়ালে চলে যায়। লাজুক মেয়ের মতো হেসে হেসে কথা বলে। সবকিছু সন্দেহ জনক। মেয়ে থাকা সত্ত্বেও এই কাজ কী করে করলো? প্রেমে পড়লে কী মানুষের বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়? কেমন গা গুলিয়ে উঠলো।

_______

সোহরাব বাড়ি ফিরলো পরদিন। বেলা দশটা বাজে তখন। দুলাভাই অফিসে গেছে। নাহার আপা বিছানাগত। সোহরাব এসে সোজা জিনিসপত্র গোছানো শুরু করলো। চমকে বললাম,

‘এসব কী করছেন? ভাত খাবেন না?’

‘আজই এই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।’

‘হ্যাঁ? কী বলছেন? পাগল হয়ে গেছেন?’

সোহরাব কেমন তাচ্ছিল্য ভরা চাহনি দিল। বলল,

‘তোমার তো বেশি খুশি হওয়ার কথা। কয়েক দিন ধরে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছিলে। আলাদা বাসার জন্য দিশাহারা হয়ে উঠছিলে। এখন এতো অভিনয় করছো কেন?’

সোহরাবের কথায় প্রচন্ড আঘাত পেলাম। সেই কবে একবার আলাদা বাসার কথা বলেছিলাম। তার উত্তর শুনে এই ব্যাপারে দ্বিতীয় বার কথা বলার রুচি উঠে গেছিল। অথচ সোহরাব সেটা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে। নিজেকে সামলে নিলাম। মানুষটা রাগের মাথায় এসব বলছে ভেবে মনকে প্রবোধ দিলাম। এটা সত্যি যে এখানে থাকতে চাই না। কিন্তু এই অবস্থায় কী করে যাবো? আপা অসুস্থ। দুলাভাই রেগে রয়েছে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক। তারপর সুন্দর একটা সম্পর্ক রেখে যাওয়া যাবে।

আমি শশব্যস্ত হয়ে আপার কাছে গেলাম। আপা দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

‘আপা! আশার মামা এসেছে। কাপড়চোপড় সব গুছিয়ে ফেলছে। একেবারে নাকি চলে যাবে। আপনি বাঁধা দিন। আমার কথা শুনছে না।’

আপা খানিক চমকালো। ঘুম ছুটে গেছে তার। তবে চট করে কিছু বললো না। একটু ভেবে বলল,

‘সোহরাব যা চাইছে তাই করুক। একত্রে থাকতে গেলে সমস্যা আরো বাড়বে। সোহরাব আর ওর দুলাভাই। দুজনই চরম রাগী আর জেদি।’

‘কিন্তু আপা হুট করে এভাবে যাওয়া যায়?’

‘সমস্যা নাই। চলে যাও তোমরা। সোহরাবকে একবার ঢাকার হোস্টেলে রাখছিলাম। ঠিকমত খেতে না পেরে অসুস্থ হয়ে গেছিল। সেজন্য একা রাখিনি। এতগুলো বছর নিজের কাছে রেখেছিলাম। এখন রান্নার মানুষ আছে। দেখাশোনার মানুষ আছে। আলাদা বাসায় থাকলে বেশি ভালো থাকবে।’

আমি স্থির হয়ে রইলাম। আপা এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে ভাবিনি। সোহরাব হঠাৎ দরকার ওপাশ থেকে হুংকার ছাড়লো। তুই তুকারি করে বলল,

‘তোকে বলেছি না জিনিসপত্র গোছাতে? আমার অবাধ্য হলে সারাজীবনের জন্য এখানে থাকতে হবে। আমার কাছে আর জায়গা পাবি না।’

বেরিয়ে এলাম। শরীর চলতে চাইছে না। কাল রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়নি। কোনো রকমে কাপড় চোপড় ব্যাগে পুড়তে লাগলাম। আশা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিচ্চিটাকে পুতুলের মতো আদর যত্ন করতাম। এখন আর হবে না। ব্যথিত হৃদয়ে কাছে ডাকলাম ওকে। আশা কাছে এলো না।

কাকে যেন ফোন করে সিএনজি ডেকে নিল সোহরাব। ব্যাগপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় আশা কেঁদে উঠলো। বায়না করলো আমাদের সাথে যাবে। কাউকে বাইরে যেতে দেখলে পিছু নেয়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। সোহরাব মেয়েটার কান্না পাত্তা দিল না। আমার হাতের ব্যাগ টেনে নিয়ে গটগট করে নিচে নেমে গেল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। অনেকগুলো দিন এই বাসায় ছিলাম। একসাথে ছিলাম। মায়া পড়ে গেছে। ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম।

বাইরে পা রাখতে আপা আশাকে কোল থেকে টেনে নিল। অসুস্থ শরীরে আশাকে আটকাতে কষ্ট হচ্ছে দেখে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার এপাশ থেকে আশার কান্না শুনতে পেলাম। সেই কান্নার সুর শুনতে শুনতে আমি নিচে নামলাম। মানুষ বড় অদ্ভুত। এতো সহজে সবকিছুর মায়ায় পড়ে যায়! অথচ সবকিছু আপেক্ষিক। ক্ষণস্থায়ী!

________

আমার জীবনের ঘটনা গুলো রাতারাতি ঘটে যায়। চোখের পলক ফেলতে যতটুকু সময় নেয় ততটুকু সময়ও নেয় না যেন! বড় বড় ঝড় গুলো আচমকা এসে হানা দেয়। এমন অকস্মাৎ ঝড়ের মধ্য দিয়ে সোহরাব আর আমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের এক কোণায় আমরা নতুন সংসার পেতেছি। সেই সংসারের মাসখানেক চলে গেছে।

শহর থেকে একটু দূরে বাসা নিয়েছে সোহরাব। তিনতলা ভবন। তার নিচ তলার বামপাশের ভাগে আমরা থাকি। সেই ভাগে ছোট ছোট দুটো শোবার ঘর। একটা রান্নাঘর। আর কয়েক হাত খাওয়ার জায়গা। তবুও আলাদা একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে থাকে। একা একা থাকতে গিয়ে প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও সেটা কাটিয়ে উঠেছি।

টুকিটাকি অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আমাদের সংসার চলছে। আমার নিজের জিনিস। নিজের সংসার। যত্ন দিয়ে, মমতা দিয়ে আগলে রাখতে লাগলাম। জিনিসপত্র আগলে রাখতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সোহরাবের পুরোনো অভ্যাসের পরিবর্তন হয়নি। সে এখনো গভীর রাতে ফিরে। কখনো কখনো আবার দুদিন চলে যায়। ফিরে না। একা একা ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে থাকি। একদিন তো বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করে বসলো সোহরাবের কথা। সে প্রতিদিন কোথায় যায়, কী কাজ করে ইত্যাদি। আমি কোনরকমে পাশ কাটিয়ে এসেছি।

হাতে ফোন পেয়েছি। নতুন ফোন নয়। পুরনো ফোনটাতে সিম সংযুক্ত করা হয়েছে। নাহার আপার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। তারা ঠিকঠাক ভাবে সংসার করছে। আপা তার কাজের জন্য অনুতপ্ত। দুলাভাইয়ের হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে। আশার ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুলাভাই সংসার ভাঙেনি। ক্ষমা করে দিয়েছে। তবে আপাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন বাসার কাজ করে। আর আশার দেখাশোনা করে। এটা ভালো লেগেছে আমার।

মাঝে মধ্যে সালেহা খালার সাথেও কথা হয়। খালা ভালো আছে। তার থেকে ও বাড়ির সবার খবর নেই। সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। সামান্তা আপুর সাথে যোগাযোগ নেই। খালার কাছে শুনেছি আপুর বিদেশ যাওয়ার কথাবার্তা হচ্ছে। কাগজ পত্র ঠিকঠাক করছে। খুব দ্রুত হয়তো চলে যাবে।

ফাইজান ভাইয়ের সাথে কথা হয় না বহুদিন। সে নিজে থেকে কখনো আমার খোঁজ নেয়নি। আমি আর আগ বাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করিনি। মনকে প্রবোধ দিয়েছি। রাজ ভাইয়া, জাবির, ফাইজান ভাই এরা সবাই আমার জীবনে ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য এসেছিল। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এদের আগমন ঘটেছিল। সে সময় শেষ। এখন চাইলেও কেউ কারো খোঁজ নিতে পারি না। কী অদ্ভুত জীবনের সমীকরণ!

তবে সালেহা খালা বাসার ঠিকানা নিয়ে রেখেছে। বলেছে সময় পেলে একদিন চলে আসবে। আমি আশা নিয়ে বসে আছি। হয়তো খালা আসবে। ও বাড়িতে যতটুকু ভালো মুহূর্ত কাটিয়েছি তার সবটা খালার জন্য। আমার কাছের একজন। আপন একজন।

________

সোহরাব আজও বন্ধু নিয়ে এসেছে। তার এই ব্যাপারটা একদম ভালো লাগে না। প্রায় প্রায়ই এই কাজ করে সে। দল বেঁধে বাসায় বন্ধু নিয়ে আসে। সাথে কয়েক ব্যাগ বাজার। চাল, ডাল, মাংস সহ রান্না করতে যা যা দরকার সব আনে। রান্নার কাজে অবশ্য আমায় ডাকে না। বন্ধুরা মিলে রান্নাবান্না করে খায়। আড্ডা দেয়। চেঁচামেচি আর হৈ-হুল্লোর করে। তবুও কী জঘন্য ব্যাপার! তারা আসলে পুরোটা সময় আমি দরজা ভিড়িয়ে ঘরে বসে থাকি। কেউ আমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। দরজা খোলার সময় হয়তো কেউ জিজ্ঞেস করে,

‘ভাবি কেমন আছেন?’

আমি কোনো রকমে উত্তর দিয়ে ছুটে রুমে আসি। দরজা ভিড়িয়ে লুকিয়ে পড়ি। সোহরাবকে কয়েক বার বারণ করেছি। বলেছি, আশপাশের মানুষেরা ভালো মনে করে না। এভাবে বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসা দৃষ্টিকটু লাগে। সোহরাব নিষেধ শোননি। উল্টো রেগে গেছে।

বাইরে থেকে বন্ধুদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। রুমের ভেতর বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি আমি। তার বন্ধুরা এলে বুক কাঁপে। ভয় হয়। পুরোটা সময় আতঙ্কে জমে থাকি। শহরের আনাচে কানাচে কত ধরনের ঘটনা ঘটছে। খুব ভয় হয়। এরচেয়ে নাহার আপার বাসায় থাকা ঢের ভালো ছিল।

এতশত চিন্তার মাঝে সোহরাব রুমে ঢুকলো। বলল,

‘মশলা কই রেখেছ? খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘রান্নাঘরে টেবিলের নিচে। সাদা রঙের বোয়ামের ভেতর আছে।’

‘খুঁজেছি। পাই না। বাইরে এসে দিয়ে যাও।’

‘পারবো না! বলেছি না আপনার বন্ধুদের সামনে যেতে পারবো না?’

কাঠ কাঠ গলায় প্রতিত্তর করলাম। সোহরাব বিশ্রী কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। দরজার পানে এক পলক তাকিয়ে রেগেমেগে বের হয়ে গেল। আমি উঠে গিয়ে ঠাস করে রুমের ছিটকিনি আটকে দিলাম। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। নাহার আপাকে কয়েক বার বিষয়টা অবগত করেছি। কোনো প্রতিকার হয়নি। বিপদ বলে কয়ে আসে? যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়?

সেদিন বেশি দেরি করলো না তারা। তেমন আড্ডা হলো না। দুপুরের পর পর খেয়ে সোহরাব বন্ধুদের নিয়ে বের হয়ে গেল। আমি ফ্ল্যাটের মূল দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে ঘরে বসে রইলাম। রাগে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। আজ সোহরাব ফিরুক। এর একটা বিহিত করে ছাড়বো। যা থাকে কপালে।

একটু বেলা পড়তে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। দেখি সালেহা খালার নাম্বার। মন নরম হয়ে এলো। কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল খালার সাথে কথা হয় না। উৎফুল্ল হয়ে ফোন ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

‘খালা কেমন আছো?’

ওপাশ থেকে আশ্চর্য জনক উত্তর এলো। খালা বলল,

‘আইসা বলতেছি। তোর বাড়ির কাছাকাছি আইছি। ছাই রঙ করা বিল্ডিংয়ের কথা কইছিলি না? রাস্তার কোনপাশে রে?’

‘হ্যাঁ খালা। রাস্তার ডানদিকে যে গলি গেছে। ওই গলি ধরে হেঁটে আসো। গলির ভেতরের তিন নাম্বার বিল্ডিং। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আসো। কতক্ষণ লাগবে?’

‘বেশিক্ষণ না। আসতাছি।’

ফোন রেখে ছুটোছুটি করে ঘরদোর পরিষ্কার করলাম। রান্নাঘরের অবস্থা যাচ্ছে তাই করে রেখে গেছে সোহরাব। কোনো রকমে গোছগাছ করলাম। হাতে বেশি সময় নেই। ঘর গুছিয়ে বাইরে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কয়েক মিনিট পর খালাকে দেখতে পেলাম। গলির মাথা দিয়ে হেঁটে আসছে। সে একা নয়। একা থাকার কথাও না। খালা রাস্তাঘাট চিনে না। পুরাণ ঢাকা থেকে এতটা পথ একা আসতে পারবে না। কিন্তু তার সাথের ব্যক্তিটিকে একদম আশা করিনি। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

(চলবে)