ভালোবাসারা ভালো নেই পর্ব-১৭+১৮

0
155

#ভালোবাসারা ভালো নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব-১৭+১৮

চাচাকে বার বার জিজ্ঞেস করলাম আব্বার কী হয়েছে। চাচা ঠিকঠাক উত্তর দিলো না। শুধু জানালো ভোরবেলা আমাকে নিয়ে গ্রামে রওনা দিবে। ট্রেনে করে! আমি যেন তৈরি থাকি।

প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ছোট্ট এক ব্যাগে ভরে রাখলাম। বড় মায়ের থেকে অনুমতি নিলাম। বড় মা এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। বরঞ্চ তাকে একটু বেশি খুশি মনে হলো। খুশি হওয়ার কথা! বছর দুইয়ের অধিক হলো এ বাড়িতে আছি। একটা রাতের জন্যও তাদের চোখের আড়াল হইনি। আমার এই পরিচিত মুখটা দেখতে দেখতে হয়তো বিরক্ত হয়ে গেছে!

সে রাতে ঘুম হলো না আমার। চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ভোরের আলো ফোটার আগে আগে রওনা করলাম। বাড়ির সবাই তখন গভীর ঘুমে। আমি যে গ্রামে যাচ্ছি কেউ জানলো না। দুঃখ পেল না। লোক দেখানো মন খারাপ করলো না! শুধু মন খারাপ করলো সালেহা খালা। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল সে। মঈন চাচাকে বার বার করে সাবধান করলো। আমায় যেন দেখেশুনে নিয়ে যায়!

কাছে ফোন নেই আমার। প্রয়োজন পড়ে না বলে কেনা হয়নি। খালা তার ফোনটা নেওয়ার জন্য জোর করলো। রাজি হলাম না। তাকে ফেরার প্রত্যাশা দিয়ে পথে নেমে পড়লাম। স্টেশনে আসার পথে মঈন চাচা বলল,

‘আমি কিন্তু থাকতে পারবো না মা। তোমারে রাইখা চলে আসবো। আজকের ছুটি নিছি। বড় স্যারের গাড়ির প্রয়োজন পড়ে সবসময়। আজ অন্যজন ডিউটি করবো।’

‘আচ্ছা! কিন্তু আব্বার কী অসুখ হয়েছে চাচা?’

‘গেলে দেখতে পারবা। আমি ভালো মতো জানি না। ফোনে শুনছি।’

আমি কথা বাড়ালাম না। স্টেশনে পৌঁছাতে চাচা কিছু খেতে বললো। আমার রুচি নেই। না করে দিলাম। প্ল্যাটফর্মে ভিড়। অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের একেকজনের জীবনে একেক রকম গল্প। সবাই ভিন্ন ভিন্ন গল্পের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। তবুও আমার মনে হলো প্রতিটা গল্পে কিছু একটা মিল রয়েছে। দুঃখ বোধের একটা ব্যাপার রয়েছে। এই মিল টুকুর জন্যই দিনশেষে প্রতিটা মানুষ এক!

হুইসেল বাজিয়ে অতঃপর ট্রেন এলো। সেই ভোরের ট্রেনে উঠে পড়লাম আমরা। মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন ছাড়লো। পেছনে এক শহুরে জীবন ফেলে রেখে ট্রেন ছুটে চললো। দুরন্ত গতিতে!

________

মাটির বিছানায় শয্যাশায়িত ব্যক্তিটিকে দেখে চেনার উপায় নেই যে এটা আমার আব্বা। আব্বা অসুস্থ। ভয়ানক অসুস্থ। সেই সুঠাম দেহ আর নেই। দুই-আড়াই বছরের ব্যবধানে বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে। শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আব্বার এহেন অবস্থা দেখে বুকে তীব্র জ্বলুনি অনুভূত হলো। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে রইলো। এই মানুষটার উপর যে আমার পাহাড়সম রাগ ছিল তা এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

যখন মা বোনকে হারিয়েছিলাম তখন আব্বার উপর অভিমান হয়েছিল। রাগ হয়েছিল। একটু একটু করে ঘৃণা জমতে জমতে আকাশ চুম্বি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটু বড় হওয়ার পর বুঝলাম এসব কিছু ভাগ্যের লিখন। একটা জীবন খেলার অংশ। নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিশাপ। কিছু জিনিস জীবনে আপনা-আপনি ঘটে যায়। ইচ্ছে করে ঘটাতে হয় না। চেইন বিক্রিয়ার মতো একের পর এক ঘটতে থাকে। আমার জীবনের ঘটনা গুলো তেমনি ভাবে ঘটে গেছে।

আমি হালকা পায়ে আব্বার দিকে এগিয়ে গেলাম। দু-চোখে তখন উপচে পড়া অশ্রু। শিয়রের কাছে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লাম। কতগুলো দিন পর তাকে ডাক দিলাম।

‘আব্বা!’

আব্বা চোখ তুলে তাকালেন। চিনতে পেরে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলেন! উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আব্বার মুখ ডানদিকে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকানো মুখ থেকে অস্পষ্ট সুরে শুধু আ আ শব্দ বের হলো। কথা বলতে না পেরে তার চোখ ভিজে উঠলো। কি যে কষ্ট হলো আমার। আমি হাত চেপে ধরে ভরসা দিলাম। আব্বার শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ শরীর অচল প্রায়। মুখ একপাশে বেঁকে গেছে। হাঁটাচলা, কথা বলার শক্তি সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে ফেলেছে। এতো করুণ অবস্থা!

ছোট মা মুখ গোমড়া করে দূরে বসে ছিল। আকস্মিক ধাক্কা সামলে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো আমার। উঠে ছোট মায়ের কাছে এলাম। থমথমে সুরে জানতে চাইলাম,

‘কদিন হলো এই অবস্থা?’

ছোট মা উত্তর দিল,

‘তিন দিন!’

‘হঠাৎ এমন হলো কি করে?’

‘আমি কেমনে বলবো? দুপুর বেলা বাজার থেইকা ফেরার পথে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পইড়া ছিল। গ্রামের লোকজন ধরাধরি কইরা বাড়ি আনছে। তারপর থেইকা কত চিকিৎসা হইতাছে। কিচ্ছু ঠিক হইতাছে না।’

ছোট মায়ের চিকিৎসা মানে কবিরাজি চিকিৎসা। সারা দেহে গাছ, লতাপাতা আর গোবর মিশিয়ে চিকিৎসা! এতে আব্বার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আব্বাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। যত দ্রুত সম্ভব তাকে সদরে নিতে হবে। নিজেকে সামলে নিলাম। আব্বাকে হারাতে চাই না আমি। আব্বাকে সুস্থ করে তুলতে হবে।

মঈন চাচা বাহিরে বসে ছিল। আব্বার অবস্থা দেখে তারও তীব্র মন খারাপ। আমাকে রেখে আজই ঢাকা ফেরার কথা বলেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ফেরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

‘ঘরে গিয়ে বসেন চাচা। ছোট মা ভাত রান্না করেছে।’

‘তুমিও খাইয়া নেও। আসো।’

‘আসতেছি। আপনি যান।’

কলপাড়ে বসে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। চারপাশে তাকালাম। রাস্তার ধারে ছোট্ট এক ভিটে। গ্রামের করিম হাজীর। ভাড়া খুব কম! নেই বললেই চলে। সেখানে আব্বা ছোট মাকে নিয়ে সংসার পেতেছে। শুনলাম বেশিদিন হয়নি। মাস ছয়েকের মতো। তার মানে ছোট মা যাত্রাপালা ছেড়ে দিয়েছে। মনে মনে কিছুটা প্রসন্ন হলাম।

ছোট্ট এক টিনের খুপড়ি। চালার টিন ঝকঝকে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এর বয়স বেশিদিন হয়নি। সেখান থেকে উত্তর দিকে তাকালাম আমি। উত্তরে বিস্তীর্ণ মাঠ। এই মাঠ পেরিয়ে মিনিট বিশেক হাঁটলে আমাদের আগের বাড়ি পাওয়া যাবে। যেখানে আমার কতশত ভঙ্গুর স্বপ্ন ফেলে রেখে এসেছি। আস্ত এক সংসার ফেলে রেখে এসেছি। ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কলপাড় থেকে চোখে মুখে পানি দিয়ে সরে আসলাম।

খাওয়ার সময় ছোট মাকে বললাম,

‘আব্বাকে সদরে নিয়ে যেতে হবে। ডাক্তার দেখাতে হবে।’

ছোট মা মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলল,

‘ডাক্তার কী মাগনা দেখবো? টাকা পয়সা কিছু লাগবো না?’

‘টাকা কি আব্বার নাই? আব্বা এতগুলো দিনে কি এক পয়সা জমায়নি? সে টাকা কই?’

‘আমারে জানায় তো জমায় নাই। তোমার বাপ রে গিয়া জিগাও।’

আমি অবাক হয়ে ছোট মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মহিলার জন্য আমাদের সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দুঃখে ভরা সংসার ছিল। তবুও সবাই জীবিত হয়ে একত্রে তো ছিলাম। খাবার আর গলা দিয়ে নিচে নামলো না। প্লেট সরিয়ে আমি বাইরে বের হয়ে এলাম। সামনের দেড় দুই হাত ফাঁকা জায়গায় কয়েক জন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতিবেশী। আমাকে দেখে তারা ফিসফিস করলো। আমি সরে ঘরের পেছন দিকটাতে গিয়ে বসলাম।

___________

সেদিন বিকেলে আব্বাকে ডাক্তার দেখানো হলো। লাভ হলো না কোনো। অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে আমার। আব্বার এতো কষ্ট মানতে পারছিলাম না। বার বার ভয় হচ্ছিল। যদি তাকে হারিয়ে ফেলি? আব্বা আমার খোঁজ নিক বা না নিক, তিনি যে এই পৃথিবীতে কোথাও বেঁচে আছেন তাতেই শান্তি পাই আমি। ভরসা পাই। শক্তি পাই! আব্বার কিছু হলে সেই শক্তি কোথায় পাব!

মঈন চাচার সেদিন ঢাকা ফেরা হলো না। আব্বার অসুস্থতার জন্য দুদিন আটকে পড়লো। আজাদ আঙ্কেল কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিল বিষয়টা। এই দুদিন আব্বাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে ছুটোছুটি করলাম। তেমন উন্নতি না হলেও আব্বা জড়ানো গলায় কিছু বলতে সক্ষম হলো।

চাচা পরদিন ভোরে রওনা দিল। তার সাথে বড় সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। চাচা বড় সড়ক থেকে রিকশা নিল। আমি রাস্তার ধারে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তা পুবদিকে চলে গেছে। এই রাস্তা ধরে হাঁটলে রাফি ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছানো যাবে। খুব করে যেতে ইচ্ছে করছে। কতগুলো দিন, কতগুলা বছর হলো তাকে দেখি না! দোমনা করতে করতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেখান থেকে আর বাড়ি না ফিরে পুবদিকে পা বাড়ালাম।

বড় সড়ক থেকে কিছুদূর এসে বাম দিকে বাঁক নিতে হলো। এদিকে মাটির কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। সেখান দিয়ে হাঁটছিলাম। মাথা যথাসম্ভব নিচু করে। পরিচিত কারো নজরে না পড়ি যেন! তবুও গ্রামের কৌতূহলী লোকজন গভীর দৃষ্টিতে দেখছিল আমায়। তারা কি চিনতে পারছে আমায়? অস্বস্তি হলো ভীষণ। তবে চেনার কথা না! আড়াই বছর হলো গ্রাম ছেড়েছি। এরমধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে আমার। আগের থেকে হাতে-পায়ে লম্বা হয়েছি, মাথার চুল বড় হয়ে গেছে, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আরো কত পরিবর্তন! এতো পরিবর্তনশীল একজনকে চেনার কথা না!

আমাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। প্রথম দিকে বুঝতে কষ্ট হলো যে এটা সেই আমাদের বাড়ি। আব্বা যার কাছে বাড়ি বিক্রি করেছে সে এলাকার নামী দামী ব্যক্তি। সরোয়ার মেম্বার! তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর জন্য জায়গা কিনে নিয়েছে। প্রচুর টাকা পয়সা মানুষটার। অল্পদিনে বাড়ির চেহারা ঘুরিয়ে এনেছে। ছবির মতো সুন্দর করে ফেলেছে। চারপাশে ইটের প্রাচীর। তার ভেতর টিনশেড বিল্ডিং। সুন্দর ডিজাইন করা। আমি থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।

ভেতরে ঢুকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাহস হলো না। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। গ্রামের মানুষজন উঠে পড়েছে। আমি হেঁটে রাফি ভাইয়ের বাড়িতে প্রবেশ করলাম।

বুকের ভেতর দুরুদুরু করে কাঁপছিল। এই বুঝি রাফি ভাই সামনে এসে পড়বে। এতগুলো বছর পর তাকে মুখ দেখাবো কি করে! অস্থিরতায় গলা শুকিয়ে এলো। আমি গিয়ে বারান্দার সামনে দাঁড়ালাম। রাফি ভাইয়ের মা ভাতের পাতিল হাতে ঘর থেকে বের হলেন। আমাকে দেখে চমকে উঠকেন। আমি হালকা স্বরে বললাম,

‘চাচী কেমন আছেন? আমি জুঁই।’

চাচী ভীষণ অবাক হলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। পরক্ষণে চিনতে পেরে দৌঁড়ে এগিয়ে এলেন। কাছে এসে গায়ে হাত ছুঁইয়ে বললেন,

‘আল্লাহ্! জুঁই তুই? কতগুলো দিন পর দেখছি। কেমন আছিস রে? একবার গ্রামে আসবি না? না আসলে অন্তত যোগাযোগ করতি। কত মনে পড়তো তোর কথা। ভালো আছিস?’

‘হ্যাঁ চাচী। ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন?’

‘আছি ভালো। তোর কাকা প্রায়ই তোর কথা বলে। মাঝে মধ্যে তোর আব্বার থেকে খবর নিয়ে বাড়ি এসে বলতো, মেয়েটা ভালো আছে। ঢাকায় বড় কোনো বাড়িতে আছে। একটু স্বস্তি পেতাম।’

চাচী আমায় হাত ধরে নিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। বারান্দায় চেয়ার পেতে দিল। আমি সংকুচিত হয়ে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

‘কাকা কই?’

‘তোর কাকার ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে। এজন্য রোজ হাঁটতে বের হয়। হাঁটা শেষ করে বাজারে গেছে হয়তো। আসবে এক্ষুণি! জানিস কি হয়েছে? গ্রামে একবার…..’

চাচী হড়বড় করে বলা শুরু করেছে। বিগত বছরে গ্রামে কোথায় কী হয়েছে, কে মারা গেছে, কার বিয়ে হয়েছে সব বলছে। আমি উৎসুক হয়ে শুনছি তার কথা। মনে মনে ভাবলাম হয়তো এই প্রসঙ্গে রাফি ভাইয়ের কথা আসবে। কিন্তু চাচী রাফি ভাইয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু বললো না। রাফি নামে তার যে একটা ছেলে আছে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে যেন! আমি আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারলাম না। চোখজোড়া বার বার ঘুরেফিরে রাফি ভাইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছিল। কর্ণারের রুমটা রাফি ভাইয়ের। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করা। রাফি ভাই কি বাড়িতে আছে?

চাচী কথা বলতে বলতে একসময় হাঁপিয়ে উঠলেন। দুঃখ নিয়ে বললেন,

‘তোর আব্বার অসুস্থতার কথা শুনে রাতের বেলা দেখতে গেলাম। কি করুণ অবস্থা! যা পাপ করছে দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি ভালোই শাস্তি পেয়েছে। আল্লাহ এখন সুস্থ করে দিক।’

আমি প্রতিত্তর করলাম না। চাচী নিজে থেকে বললেন,

‘কত বড় হয়ে গেছিস। কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস! ওহ্! তুই নাকি পড়াশুনা করিস জুঁই? তোর আব্বা বলছিলো।’

‘হ্যাঁ চাচী। কলেজে ভর্তি হয়েছি।’

‘ভালো। পড়াশুনা কর। বেঁচে থাকলে কত ধরনের দুর্যোগ আসবে! সেগুলো মোকাবেলা করতে হবে না? প্রত্যেকটা মেয়ের একটা নিজস্ব অবস্থান তৈরি করা খুবই জরুরি। একেবারে পাকাপোক্ত অবস্থান। যে অবস্থান সকল ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকূলতায় ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়াবে।’

‘হুঁ!’

চাচীকে বলতে ইচ্ছে হলো। চাচী আমার ভীষণ ভয় হয়। এই বয়সে এতকিছুর সম্মুখীন হয়েছি যে আর নিতে পারছি না! কিছু বলা হলো না। নিশ্চুপ রইলাম। চাচী উঠে একবার ঘরে গেলেন। প্লেটে করে মুড়ি আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘সকালে তো নাস্তা করিসনি। খেয়ে নে। আমি রান্না করি। ভাত খেয়ে যাবি।’

‘চাচী বাড়িতে আর কেউ নাই?’

‘নাহ্ রে! আমি আর তোর চাচা থাকি। ও ভালো কথা! রাফি অনেকদিন হলো ঢাকাতে আছে। বিদেশ যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ইংলিশে কোর্স করেছে। ওর বিদেশে যাওয়ার কার্যক্রম চলছে। সব কাজ শেষের দিকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবে।’

মুড়ির প্লেটে হাত থেমে গেল আমার। বুক কেঁপে উঠলো অজানা আতঙ্কে। চাচী কী বললো এসব? রাফি ভাই বিদেশ চলে যাবে? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। চাচীর সেদিকে খেয়াল নেই। আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। বললেন,

‘ছেলেটাকে এতো বারণ করলাম। কিন্তু কিছুই শুনলো না। তার নাকি স্বপ্ন বিদেশ যাওয়া। এতো জিদ করলো! পরে আর বাঁধা দিলাম না। যাচ্ছে যাক। ওদের স্বপ্ন পূরণ করুক।’

চাচী থেমে গেল। আমি কথা বলার অবস্থায় নেই। রাফি ভাই গ্রামে আছে। একই দেশে আছে। বেঁচে থাকলে অন্তত দেখা হবে। এই আশায় ছিলাম এতদিন। কিন্তু মানুষটা বিদেশ চলে যাবে। এটা মানতে ভীষণ কষ্ট হলো। বুক ফেটে কান্না এলো। আমার আর খাওয়া হলো না। হাত ধুয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাড়া দিয়ে বললাম,

‘চাচী আমায় যেতে হবে। আব্বাকে দেখার কেউ নাই। একা রেখে আসছি।’

চাচী বাঁধা দিলো। ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলো। আমি থাকলাম না। প্রায় ছুটে চলে এলাম। রাস্তায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। দু চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ওড়নার ঝুলন্ত অংশ দিয়ে চোখ মুছে এগিয়ে চললাম। মস্তিষ্ক জুড়ে এলোমেলো চিন্তার বহর। সেই চিন্তার মাঝে একটা বড়সড় সত্যি ধরা দিল। বুঝতে পারলাম, রাফি নামক ছেলেটার উপর আমি ভয়ানক দূর্বল ছিলাম। ঠিক কতটা দূর্বল তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বুঝতে সক্ষম হলাম যে এই মানুষটাকে আমি সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে ফেলেছিলাম এবং এখনো ভালোবাসি।

সূর্য উঠে গেছে অনেক আগে। গ্রাম্য প্রকৃতি আলোয় ঝলমল করছে। গ্রাম জীবন্ত হয়ে উঠছে। সেই সাথে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে। আমি মাথার ঘোমটা বড় করে দিয়ে এগিয়ে চললাম। পরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় আমি নেই।

বাড়ি ফিরে কল পাড়ে বসে রইলাম। খুপড়ির দরজা বাহির থেকে আটকানো। আব্বা কাল সারারাত ঘুমায়নি। অনেক জ্বালাতন করেছে। চিৎকার, কান্নাকাটি করেছে। শেষরাতের দিকে একটু ঘুমিয়েছে। এখন খাবার খাইয়ে ওষুধ দিতে হবে। ছোট মাকে দেখা যাচ্ছে না। ঘরে অসুস্থ মানুষ রেখে কোথায় গেল!

ঘর থেকে হঠাৎ আব্বার গোঙানির শব্দ এলো। আমি দৌঁড়ে গেলাম। কাছে যেতে আব্বা অস্পষ্ট সুরে পানি চাইলো। গ্লাসে করে পানি খেতে পারে না সে। বাটিতে ঢেলে চামচ দিয়ে খাওয়ালাম। নত মুখে বললাম,

‘ছোট মা কই?’

আব্বা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো। আমি আশপাশে তাকাতে চমকে গেলাম। বিছানায় কাপড় ছড়ানো ছিটানো। জিনিসপত্র অগোছালো। কিন্তু মাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। ছোট মা কোথায়? উঠে গিয়ে ঘরের বাইরে খুঁজলাম। চারপাশ খুঁজলাম। ফের ঘরে এসে আব্বাকে বললাম,

‘সে কোথায়? বাড়িতে দেখছি না তো।’

আব্বা কিছু বলতে চাইছে। আমি বুঝার চেষ্টা করে বললাম,

‘হ্যাঁ বলো।’

আব্বার কণ্ঠ অপরিষ্কার। জিহ্বা ভারী হয়ে গেছে। কথা বোঝা যায় না। তবুও কিছুদিন হলো শুনতে শুনতে একটু বোধ গম্য হয়ে এসেছে। সেখান থেকে বুঝতে পারলাম আব্বা ছোট মায়ের ব্যাপারে বলছে। ছোট মা নাকি পালিয়ে গেছে। তার জিনিসপত্র, টাকা-পয়সা নিয়ে একেবারে চলে গেছে। বলে গেছে আর ফিরবে না কখনো।

_______

কয়েকদিন কেটে গেল। কি যে দুর্বিষহ দিন! ঘুম নেই। ঠিকমতো খাওয়া নেই, গোসল নেই। সারাক্ষণ আব্বার সেবা-যত্ন করা। একা একা সব দিক সামলাতে গিয়ে নাজেহাল দশা। ছোট মা আর ফিরলো না। আমি তবুও আশায় বুক বেঁধে রইলাম। সে হয়তো ফিরবে! সে ফিরলে একটু সাহস পাই। কিন্তু সে সত্যি সত্যি ফিরলো না। আশপাশের মানুষ কানাঘুষা করতে লাগলো তাকে নিয়ে। কেউ কেউ ছি ছি করলো। অসুস্থ স্বামী ফেলে রেখে চলে যাওয়ায় ধিক্কার জানালো। সেসবের কিছুই ছোট মা অবধি পৌঁছালো না।

প্রতিদিন দলে দলে লোক আসে। আব্বার কষ্ট দেখে হা হুতাশ করে। দুদণ্ড অপেক্ষা করে চলে যায়। কেউ কেউ কৃতকর্মের ফল বলে আফসোস করে। আমি নির্বাক হয়ে রই। আব্বার চিকিৎসা বাবদ জলের মতো টাকা খরচ করছি। গত দিনগুলোতে জমানো সব টাকা প্রায় শেষ। মঈন চাচা কিছু কিছু পাঠায়। এতো খরচ করার পরও স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে না।

একদিন দুপুর বেলা আব্বাকে দেখতে এলো তার দূর সম্পর্কের এক বোন। মোমেনা ফুফু।

(চলবে)

#ভালোবাসারা_ভালো_নেই
#অজান্তা_অহি
#পর্ব_১৮

একদিন দুপুর বেলা আব্বাকে দেখতে এলো তার দূর সম্পর্কের এক বোন। মোমেনা ফুপু। এসে অস্থির হয়ে উঠলো। আব্বার অবস্থা দেখে কষ্ট পেল। তার চেয়ে অবাক হলো যে এই মুহূর্তে আব্বা একা। তার কাছে কেউ নেই। পাশে কেউ নেই। ফুপু অতকিছু জানে না হয়তো। আব্বা যে কতো অন্যায় করেছে তার হিসেব রাখা কঠিন।

ফুপুর সেদিনই চলে যাওয়ার কথা। তাকে যেতে দিলাম না। অনুরোধ করে রেখে দিলাম। আমার বড্ড ভয় হয়। একা একা একদম পারছিলাম না। ফুপুকে রেখে দিতে একটু সাহস বাড়লো।

পরদিন আব্বাকে ভ্যান গাড়িতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সাথে ফুপু আছে। সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তার দেখাতে দেখাতে সারাটা দিন চলে গেল। বিকেল বেলা বাড়ি পৌঁছালাম। সমস্ত দেহ তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। ফিরে বসে রইলাম না। আব্বার হাত-মুখ ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিলাম। সেই সময়টা খুব করে মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা বেঁচে থাকলে আব্বার অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট পেতো। আব্বা যত দুঃখ দিক, কষ্ট দিক তবুও আমি বুঝতাম মা এই মানুষটাকে খুব সমীহ করে। মায়ের বড় দূর্বলতা আব্বা ছিল। টানাপোড়েনের সংসার। তবুও জ্ঞান হওয়ার প্রথম দিকে দেখতে পেতাম, আব্বা মায়ের জন্য লুকিয়ে কিছু কিছু উপহার নিয়ে এসেছে। যৎসামান্য! তবুও মা কি যে খুশি হতো!

মন খারাপ ভাব বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ মাকে দেখতে যাবো। ফুপুর কাছে আব্বার দায়িত্ব দিয়ে আমি বের হয়ে গেলাম। ফুপু বাঁধ সাধলো। সন্ধ্যা হবে হবে। কিন্তু আমার মন মানলো না! তার নিষেধ না শুনে বের হলাম।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে কবরস্থানে পৌঁছে যাই। গ্রামে আসার পর আরেকবার এসেছিলাম। দূর থেকে দেখে চলে গিয়েছিলাম। আজও দূর থেকে দেখলাম। মা বোনের কবরগুলো মাঝামাঝিতে। এতদূর থেকে দেখতে কষ্ট হয়। মেয়েদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। দূর থেকে অপলক চেয়ে রইলাম। কবরগুলো দেখে এখন চেনার উপায় নেই। জঙ্গল দিয়ে ভরে গেছে। কেউ পরিষ্কার করেনি। কবরের উপর নতুন করে কবর খোঁড়া হয়েছে কি না বোঝা গেল না।

মা, বোনের পরিণতি দেখে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়লো। মানুষের জন্ম একটাই। জীবন একটাই। একবার মৃত্যু হলে পৃথিবীতে দ্বিতীয় বার আসার সুযোগ নেই। অথচ এই একটা জীবন! একটা জনম এদের কত কষ্টে কাটলো। এই দুনিয়ায় কি রেখে গেল? কেউ মনে রাখেনি তাদের! আমারও আজকাল মনে পড়ে না। এতশত দুশ্চিন্তা, এতশত দায়িত্ব, প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই! সময় কোথায় তাদের স্মরণ করার। তবে মনে পড়ে। যখন কেউ দুঃখ দেয়, দুটো কটু কথা শোনায় বা গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যখন চারপাশ অন্ধকার দেখি তখন তাদের কথা মনে পড়ে। ভীষণ করে মনে পড়ে!

_______

শেষরাতের দিকে একটুখানি চোখ বুজে এসেছিল। আচমকা ধাড়াম করে কিছু পড়ার আওয়াজ কানে এলো। সাথে মৃদু চিৎকার। লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। অন্ধকারে ফোনের আলো জ্বালাতে চমকে গেলাম। আব্বা চৌকির উপর নেই। নিচে পড়ে ছটফট করছে। ধাক্কা দিয়ে পাশ থেকে মোমেনা ফুপুকে তুলে দিলাম। দৌঁড়ে আব্বার কাছে গিয়ে ডাকলাম। আব্বা কোনো প্রতিত্তর করলো না। ফুপুর সাহায্য নিয়ে তাকে বিছানায় তুললাম। ঘরে একটা মাত্র চৌকি। সেখানে আব্বাকে ঘুমাতে দিয়েছিলাম। আমি আর ফুপু মাটিতে বিছানা করে শুই। আব্বা হঠাৎ বিছানা থেকে পড়ে গেল কি করে? মাটিতে কিছুদিন থেকে তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। যার জন্য বিছানায় নিয়েছি।

কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করলাম। নতুন ঘর তোলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাতির লাল আলোতে দেখলাম আব্বা কেমন যেন করছে। ছটফট করছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। ভীত হয়ে গেলাম আমি। আব্বাকে ডেকে বললাম,

‘আব্বা কষ্ট হচ্ছে? কথা বলো। কিছু বলো।’

আব্বার শরীর কুঁকড়ে আসছে। ফুপু বললো হাতে পায়ে তেল দিতে। ছুটে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে তেল নিয়ে এলাম। কালোজিরা মিশ্রিত পড়া তেল। ঈমান কবিরাজের দোয়া দরুদ পড়ে ফু দেওয়া। আমি তেল হাতের তালুতে নিয়ে আব্বার পায়ে মালিশ করলাম। ফুপুকে বললাম,

‘আব্বা এমন করছে কেন ফুপু?’

‘বুঝতেছি না। ডাক্তার ডাকতে হইবো মনে হয়।’

‘এতো রাতে ডাক্তার ডাকতে যাবো কি করে?’

‘হেইডাই তো! ডাক্তার থাকে গাঙের ওপার। একা মাইয়া মানুষ কেমনে যাবি! ভালো কইরা তেল মালিশ কর। একটু আলো ফুটুক।’

‘হুঁ!’

ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। রাজ্য সমান ভয় নিয়ে ভোরের অপেক্ষায় রইলাম। কখন একটু আলো ফুটবে, আর কখন একটু ডাক্তার ডাকতে পারবো। কিন্তু বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে পারলাম না। আব্বার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা নির্গত হচ্ছে। চেঁচিয়ে কিসব বলছেন তিনি। নড়চড় বিহীন দেহ টা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,

‘ফুপু পাশের বাড়ির কাউকে ডাক দাও। মদিনার মাকে ডাকো।’

‘যাইতাছি।’

ফুপু দৌঁড়ে বাইরে গেল। আশপাশের মানুষ ডাকতে। বাড়ির কাছে কেউ নেই। এজন্য চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পারছে না। একমাত্র মদিনাদের বাড়ি একটু কাছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই এলো। দুজন ছুটলো গ্রাম্য ডাক্তার ডাকতে। কেউ কেউ কালিমা পড়তে লাগলো। আমি ভয়ার্ত চোখে দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। শরীর কাঁপছে থরথর করে। আর পারছি না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। আমি দরজায় ভর ছেড়ে দিলাম।

ছোট গাঙের ওপার থেকে ডাক্তার আসতে আসতে আব্বা মারা গেল। আমার চোখের সামনে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। আব্বার মরণ সময় কি যে যন্ত্রণা হলো! মনে হলো কারো অভিশাপ লেগেছে। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। ছুটে পালানোর জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পা নাড়াতে পারলাম না। একচুল সরতে পারলাম না। চেয়ে চেয়ে আব্বার যন্ত্রণা দেখলাম। একসময় আব্বা স্থির হয়ে এলো। তার সব যন্ত্রণার অবসান ঘটলো। চোখজোড়া বন্ধ। ওই নেত্রদ্বয় এ জীবনে আর খুলবে না।

মৃত্যুর গন্ধ দ্রুত ছড়ায়। আব্বার খবর বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়লো। অনেকে এলো। বাড়ির কয়েক হাত উঠানে ভিড়। তবে মরা বাড়ি হলেও কান্নার আওয়াজ নেই। কে কাঁদবে? আব্বার আপনজন কেউ নেই। আব্বা কখনো কারো উপকার করেনি। দুটো ভালো কাজ করেনি যে কেউ তার জন্য চোখের জল ফেলবে। গাল ভিজাবে। কেউ কাঁদলো না।

এক সময় মোমেনা ফুপু গুনগুন করে কাঁদা শুরু করলো। আমি বাইরে বের হয়ে আসলাম। ভোরের আলো ফোটার সময় হয়ে গেছে। ওড়নার আঁচল থেকে খুলে ফোনটা হাতে নিলাম। আব্বার ফোন। কল লিস্টে গিয়ে মঈন চাচাকে ফোন দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চাচা ফোন ধরলো। চিন্তিত মুখে বলল,

‘কি হইছে জুঁই? এতো ভোরবেলা ফোন দিছো?’

‘আব্বা বেঁচে নাই চাচা।’

বলতে গিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। বুকে তীব্র জ্বলুনি। দম আটকে আসছে। আব্বা আর বেঁচে নেই। এই অমোঘ সত্যটা টের পেলাম। ফোন রেখে দিলাম আমি। চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করলো। দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললাম।

________

মরা বাড়ি! অথচ কি নিঃশব্দ। নিদারুণ নিস্তব্ধ! কান পাতলে মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। আব্বাকে খুপড়ির ঘরের মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে। তাকে ঘিরে দু-চারজন অল্প বয়সী মেয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আমি বেড়ার সাথে থিতু হয়ে বসেছিলাম। মোমেনা ফুপু ঘন ঘন চোখ মুচছে। আর আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই। জীবনে এর চেয়ে কত বড় বড় দুঃখ পেয়েছি! পরক্ষণে মনে হলো, দুঃখে ছোট বড় বলতে কিছু নেই। দুঃখ তো দুঃখই! সব দুঃখে ব্যথা অনুভূত হয়। কষ্ট অনুভূত হয়।

দুপুরবেলা মঈন চাচা এলো। তার সাথের ব্যক্তিটিকে দেখে ওই অবস্থায়ও কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম। রাজ ভাইয়া এসেছে।

চাচা আসতে বাড়ি আর নিরব রইলো না। হইচই করে কান্না শুরু করল সে। আমি বুঝতে পারলাম আব্বা অন্তত একজন মানুষের কাছে মহানুভব। আব্বা মঈন চাচার কি উপকার করেছিল বা তাদের মধ্যে ঠিক কিসের বন্ধুত্ব সঠিক জানি না। মঈন চাচাকে কয়েক বার জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাইনি। কিন্তু এটা বুঝি যে চাচা আব্বাকে ভীষণ মান্য করে। ভালোবাসে! চাচার কান্না আর আহাজারি দেখে নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো।

রাজ ভাইয়া কাছে এসে বলল,

‘কান্না করে না জুঁইফুল। কেউ মারা গেলে কাঁদতে নেই।’

আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। অনুভব করলাম এই এতোবড় দুনিয়ায় আমার আপনজন কেউ নেই। আমার রক্তের কেউ নেই। একা একা বাকি পথ পাড়ি দিবো কি করে! আমি ভীষণ অসহায়।

সন্ধ্যার পর পর আব্বাকে কবর দেওয়া হলো। লোকমুখে শুনলাম জানাযায় তেমন মানুষ হয়নি। এটা জানা ছিল আমার। সাধারণ মানুষদের জানাযায় মানুষ হয় না। সবাই যার যার জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত। চরম ব্যস্ত। একজন মরা মানুষের পিছনে সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয়? হয় না! ওই সময়টুকু পরিশ্রম করে, রিকশা চালিয়ে দু পয়সা আয় করা যাবে। ছেলের জন্য পছন্দের খেলনা কেনা যাবে। বা অন্যকিছু করা যাবে।

তবে ধনীদের হিসাব আলাদা। তাদের মৃত্যুতে সবাই দুঃখ প্রকাশ করে। লোক দেখানো যাওয়া হলেও তাদের জানাযায় গাদা গাদা মানুষ হয়। পুতুলের জন্মের সময় এ গ্রামের মেম্বার মারা গেল। সবার মধ্যে সে কি আহাজারি! তার জানাযায় কয়েক গ্রাম লোক হলো।

নির্জন রাতের বেলা আব্বাকে রেখে এলো। বাড়ি তখন খালি। সেই রাতের বেলা আমার ভয় হলো। তীব্র ভয়। আমি এক সেকেন্ডের জন্য মোমেনা ফুপুর হাত ছাড়লাম না। তাকে বাথরুমে যেতে দিলাম না। ভয়ে, আতঙ্কে জমে রইলাম। মনে হলো আব্বার চিৎকার কানে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে আব্বা একা। তার সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু কিছু করতে পারলাম না।

__________

আব্বা নেই তিনদিন হয়ে গেছে। আমি এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেছি। আর ছুটে চলার ইচ্ছে নেই, শক্তি নেই। ভেতরে বেঁচে থাকার উচ্ছ্বাস নেই। আপনজন ছাড়া, ভালোবাসার মানুষ ছাড়া, কাছের মানুষ ছাড়া বেঁচে থাকা কি যে যন্ত্রণার!

বিকেল বেলা ঘরের বাইরে বসে ছিলাম। মাটিতে পা মেলে। মঈন চাচা এলো। বলল,

‘কাল ভোরে ঢাকা রওনা দিবো। জিনিসপত্র গুছায় রাইখো। আর হয়তো কখনো গ্রামে ফেরা হবে না।’

শেষের কথাটা চাচা নিচুস্বরে বললো। চাচা এখানকার সব হিসাব মিটিয়ে দিয়েছে। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, আমি আর ঢাকা ফিরবো না। এখানে থাকবো। এই গ্রামে থাকবো। এই গ্রামে আমি প্রাণ খুঁজে পাই। আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আমি আর ওই যন্ত্রের শহরে ফিরবো না।

বলা হলো না। আমি নিরূপায়। ঢাকা ফেরা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। ক্ষীণ সুরে বললাম,

‘ঠিক আছে।’

চাচা চলে যেতে রাজ ভাইয়া এলো। গত তিনদিনে তার সাথে আমার কথা হয়নি। সে নিজের মতো কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেরিয়েছে। এসে বলল,

‘কাল তো ঢাকা ফিরবে। আজ একটু বের হবে নাকি? গ্রাম দেখার জন্য?’

আমি উত্তর দিলাম না। শহুরে মানুষকে গ্রাম দেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার উত্তর না পেয়ে সে বলল,

‘কাল ঢাকা ফিরলে কিন্তু আর সহজে গ্রামে ফেরা হবে না জুঁইফুল। শেষবারের মতো তোমার আপনজনদের দেখবে না?’

চমকে তার মুখপানে তাকালাম। আমি জানি এইবার ঢাকা গেলে আর কোনোদিন এখানে ফেরা হবে না। অথচ এই গ্রামে আমার কতকিছু রয়ে গেছে। জীবন এমন নিষ্ঠুর কেন?

সন্ধ্যার পর বের হলাম। সাথে রাজ ভাইয়া। চাচার কাছে সব জেনে গেছে সে। আমার মা বোনের হারিয়ে যাওয়া অতীতসহ সব। প্রথম শুনে রাগ উঠলেও পরক্ষণে রাগ পড়ে গেছে। অন্তত একজন তো আমার নিষ্ঠুর অতীত জানে! অন্তত এই একজনের কাছে তো আমার নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে না। আড়ালে রাখতে হবে না।

চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের রাস্তায় ঝলমলে আলো নেই। চারপাশ অন্ধকার। রাস্তা দিয়ে দীর্ঘ সময় পর পর একটা করে রিকশা যাচ্ছে। কখনো বা সাই করে একটা বাইক ছুটে যাচ্ছে। রাজ ভাইয়া আর আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। তাকে নিয়ে রাতে বের হয়েছি যাতে পরিচিত কারও নজরে না পড়ি। রাজ ভাইয়া নিশ্চুপ হেঁটে চলেছে। এই ছেলেটা এক সন্ধায় আমার জীবনের প্রথম চু’মুটা কেড়ে নিয়েছে। তাকে যে ঢাকায় থাকতে প্রচন্ড ভয় পেতাম, তার থেকে দূরে দূরে থাকতাম সেটা ভুলিনি। তবুও আমার মনে হলো কোথায় যেন কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। অদ্ভুত রহস্যময় হলেও ছেলেটাকে আমি আর ভয় পাচ্ছি না। গ্রামের নির্জন রাস্তা ধরে সম্মুখে হাঁটছি। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। রাজ ভাইয়াকে নিশ্চুপ দেখে বললাম,

‘আপনি গ্রামে এসেছেন বাড়ির কেউ জানে?’

‘জানে না! লুকিয়ে এসেছি। চাচার সাথে ট্রেনে উঠার পর বাড়িতে ফোন দিয়েছি। বলেছি যে আমি সিলেট যাচ্ছি। এক বন্ধুর বাড়ি।’

‘ওহ্!’

এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে থেমে গেলাম। মনে হলো রাজ ভাইয়া যে উত্তর দিবে তা শুনতে চাই না আমি। বুকের ভেতর প্রচন্ড খালি খালি লাগছে। এই গ্রাম, এই পথ, এই পরিচিত ঘ্রাণ আর কখনো পাবো না। এই রাস্তা ধরে রাফি ভাইকে দেখতে দেখতে কত হেঁটেছি। সে রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটতে থাকতো। আমি ওপর পাশে। পিছিয়ে যেতাম তার থেকে। যাতে দেখতে সুবিধা হয়। তার হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন, হাসি সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। এতশত স্মৃতি ভুলবো কি করে! হঠাৎ করে বলে উঠলাম,

‘জানেন, আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম। নিজের অস্তিত্ব ভুলে এই গ্রামের এক ছেলেকে ভালোবেসে ছিলাম। ছেলেটা নিজের ভাবনার সাথে এতটা মিশে গিয়েছিল যে প্রায়ই তাকে নিয়ে হ্যালুসিনেশন হতো।’

রাজ ভাইয়া কিছু বললো না। তবে তার হাঁটার গতি কমে গেল। আমিও ধীরে ধীরে পা ফেলতে লাগলাম। বললাম,

‘এইবার আড়াই বছর পর গ্রামে এসেছি। তার সাথে আমার দেখা হয়নি। গ্রামে ফেরার পর এক বিকেলবেলা হঠাৎ দেখি সে হেঁটে এসে উঠানে দাঁড়ালো। খুপড়ি দরজা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম আমি। গায়ের ওড়না ঠিক করে দ্রুত বের হয়ে দেখি সে নেই। উঠোন সম্পূর্ণ ফাঁকা। দৌঁড়ে রাস্তায় গেলাম। এদিক ওদিক খুঁজলাম। তার দেখা পেলাম না। কোথাও সে নেই। পরদিন তার বাড়ি গিয়ে শুনি সে গ্রামেই নেই। ঢাকাতে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নাকি সে বিদেশও চলে যাবে।’

বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। রাজ ভাইয়া বুঝতে পারল হয়তো। বলল,

‘কষ্ট পেয়ো না। জীবন অসংখ্য দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি। না পাওয়ার বেদনা, হারিয়ে ফেলার কষ্ট নিয়ে তবুও রোজ ভালো থাকার যুদ্ধ করে যেতে হয়। এই পৃথিবীতে কেউ সুখে নেই। সবারই কিছু গোপন দুঃখ রয়েছে। কিছু একান্ত ব্যক্তিগত হাহাকার রয়েছে। কুড়েঘরে থেকে কেউ সুখে নেই। বিশ তলার উপর ঘুমিয়েও কেউ সুখে নেই। দিনশেষে সবাই অসুখী। পৃথিবীর আনাচে কানাচে কেউ ভালো নেই। এটা নির্মম সত্য!’

‘আগে আমি বুঝতাম শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয়। দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসলে সংসার করা যায়। কিন্তু এখন বুঝি তা হয় না!’

‘শুধু ভালোবাসা দিয়ে কখনো সংসার হয় না। সংসার একটা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো। বিক্রিয়া পরিপূর্ণ রূপে সম্পন্ন হওয়ায় জন্য অসংখ্য প্রভাবক লাগে। তা না হলে সেটা মাঝপথে থেমে যায় বা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংসার করার জন্যও তেমন টাকাপয়সা, ধৈর্য্য, দায়িত্ব-কর্তব্য, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, বড়দের আশীর্বাদ সহ অসংখ্য প্রভাবক লাগে। শুধু ভালোবাসা দিয়ে স্থায়ী সংসার হয় না।’

আমি আর কিছু বললাম না। বুকের কোণে চেপে রাখা কষ্টগুলো দাপাদাপি করছে। আমি জানি রাফি ভাইয়ের সাথে আমার কখনো সংসার করা হবে না। তার সাথে সংসার না করতে পারার আফসোস আমার এই জীবনে শেষ হবে না।

কবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। রাজ ভাইয়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সম্মুখে এসে বলল,

‘সামান্তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। শুনেছ?’

(চলবে)