ভালোবাসার উল্টোপিঠে পর্ব-০১

0
1011

ভালোবাসার_উল্টোপিঠে
#এক
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

বাবাকে যেদিন আমার ভালোবাসার কথা জানালাম, তিনি বলেছিলেন,” এ ছেলেকে আমার পছন্দ নয়। তাই বলে তুমি তাকে বিয়ে করবে না, এটা বলছি না। তুমি চাইলে তাকেই বিয়ে করতে পারো, তবে এতে আমার মত থাকবে না। তোমাকে আমি জীবনের শুরু থেকে কখনো মেয়ে হিসেবে ভাবিনি, আমার ছেলেকে যেভাবে ভেবেছি তুমিও আমার কাছে তাই। তোমার জীবনের স্বাধীনতা শুধু তোমার। তুমি এখন নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো জায়গায় এসেছো। তুমি যে কাউকেই বিয়ে করতে পারো।”

বাবার এটুকু কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম, শুধু অবাক বললে ভুল হবে খুশিও হয়েছিলাম। বাবা যা বলেছেন সব সত্য। আমি কখনো মেয়ে হয়েছি বলে আলাদা সহানুভূতি পাইনি বাবার কাছ থেকে বরং নিজেকে সামলে নেয়ার, জীবনে প্রতিটি মুহূর্তে সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার শক্তি নিজেই তৈরি করেছি। সে সুযোগটা বাবাই আমায় করে দিয়েছেন। এবং এটার জন্য আমি বাবাকে পৃথিবীর সেরা বাবা উপাধিতে ভূষিত করব।

কিন্তু বাবা এরপর যেটা বললেন তাতে শুধু অবাক নয়, আমি ভেঙেচুরে গেছি। বাবা বললেন, “রিদ্ধিমা তুমি যদি চাও তবে মাহিদকে বিয়ে করতে পারো। তবে তাতে তোমায় এ বাড়ি ছাড়তে হবে। আমি দোয়া করব তুমি যেন ভালো থাকো। আর হ্যাঁ তোমার জন্য এ বাড়ির দরজা সারাজীবন খোলা থাকবে। কিন্তু ওই ছেলের জন্য আমার বাড়ি বা মনের দুয়ার কখনো খুলবে না।”

বাবার কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম । দাঁড়ানো থেকে বসে পড়েছিলাম। এ কেমন শর্ত দিলেন বাবা! মাহিদের জন্য দরজা বন্ধ মানে তো আমার জন্যও। ছোটবেলা থেকে বাবাকে আমি বন্ধুর মতো পেয়েছি। সেই বাবা আজ এমন কথা বলবেন ভাবতেই পারিনি।

দরজায় শব্দ হলো এটুকুনি লিখে রেখে দিলাম ডায়েরিটা। দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত এগারোটা বাজে, পেছনে ফিরে দেখলাম মাহিদ ঘরে ঢুকেছে। পরনে মেরুন রংয়ের পাঞ্জাবি। নিজের দিকে তাকালাম একবার। আজ আমার বিয়ের প্রথম রাত। আমিও মেরুন রঙের শাড়ি পরেছি। চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপিস্টিক দিয়েছি। এরচেয়ে বেশি সাজ মাহিদের পছন্দ নয়, তাই এর বেশি সাজিনি। যার জন্য সাজব সে যদি পছন্দ না করে তবে অতিরিক্ত সেজে কী হবে বলুন তো?

মাহিদ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আমার জন্য সব ছাড়তে হলো তোমায় রিদ্ধি। আমায় ক্ষমা করো।”

আমি তার হাত দুটো ধরে বললাম, “প্লিজ এভাবে বোলো না। আমি স্বেচ্ছায় তোমার কাছে এসেছি। এর জন্য তুমি কেন ক্ষমা চাইছো?”

মাহিদ আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি কখনো তোমাকে কষ্ট দেব না।আমার জন্য যে ত্যাগ তুমি করেছো তা আজীবন মনে রাখব।”

মাহিদ কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার ফোনে টুক করে একটা শব্দ হলো, হয়তো মেসেজ এলো। সেটা সে চেক করতে করতে বিছানায় দপ করে বসে গেল। আমি ক্রমশ তার মুখের রঙ বদলে যাওয়া দেখছি। প্রায় মিনিট তিনেক সে কিছু একটা ফোনে করে আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল। আমার ভয় করল তার সেই চাহনিকে। এমন ভয়ংকর চোখ আমি জীবনে দেখিনি। কিন্তু এমনভাবে তাকানোর হলোটা কী!

মাহিদ রাগত স্বরে বলল, “আমি ভাবতে পারিনি তুমি এতটা নিচ হতে পারো রিদ্ধি! তুমি তো আমায় বলেছিলে সাহিলের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এসব কী?”

আমি অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দু’হাতে মুখ চেপে ধরলাম। এটা কী করে সম্ভব! এতটা বাস্তবিকভাবে কীভাবে কেউ ছবি এডিট করতে পারে। আমার মনে হলো এমন বাজে ছবি জীবনে দেখিনি। সাহিলের সাথে এত অন্তরঙ্গভাবে ছবি কোথায় থেকে আসল আমার মাথায় ধরছে না। আমি মাহিদের হাতটা ধরে কিছু বলতে যেতেই মাহিদ আমাকে এত জোরে ধাক্কা দিল যে সে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। সামনে থাকা চেয়ারের সাথে লেগে ঠোঁটের কোণ কেটে রক্ত বের হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে সেটা খেয়ালই নেই। আমি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছি মাহিদের দিকে। কী হচ্ছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগল আমার।

মাহিদ চিৎকার করে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সব ফেলে দিল। বিছানার চাদরটা নিচে ফেলে দিল, সাইড টেবিলের উপর রাখা দুধের গ্লাস, পানির জগ সব ফেলে তান্ডব শুরু করল। আমি অবাক হয়ে সব দেখছি। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। সে ঘোর থেকে বের হলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে। আমার মাহিদ এমনটা করতে পারে না। আজ তো আমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রাত। এমন কিছু হতেই পারে না।

মাহিদ চিৎকার করে বলল, “তোকে আমি সতীসাধ্বী মনে করেছি। কিন্তু তুই তো অন্যের সাথে এর আগে থেকেই শুয়েছিস। আমার সাথে প্রেমের নাটক করে অন্যকারো সাথে ছি! আমি ভাবতে পারছি না তুই এমন করতে পারিস!”

আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আজ নিজেকে বোবা মনে হচ্ছে। অধিক শোকে যেমন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, ঠিক তেমনই হয়েছে আমার। সামান্য একটা ছবি নিয়ে মাহিদ এমন করতে পারে ভাবতেই পারেনি। আমি জানি মাহিদ একটুতে রেগে যায়। রেগে গেলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। তাই বলে আজকের মতো দিনে। এ দিনটার জন্য কত স্বপ্ন দেখেছি দুজনে।

জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়। চেয়েও মন ও মস্তিষ্ককে কাজে লাগানো যায় না। মনে হয় এসব কিছু দুঃস্বপ্ন মাত্র। ঘুম ভেঙে গেলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে। আমার মাহিদ আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বরং আমার ভাবনায় জলে ঢেলে দিয়ে মাহিদের ছুড়ে ফেলা পারফিউমের বোতলটার এক টুকরো কাঁচ এসে আমার কপালে লেগে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য আমার এতটুকুও ব্যাথা লাগছে না কেন! আমার কী ভালো-মন্দ সব অনুভুতি লোভ পেয়ে গেল!

কেমন শূন্য লাগছে সবকিছু। মাহিদ শেষে একটা বাক্য বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাক্যটি হচ্ছে, “তোর মতো চরিত্রহীন মেয়ের মানুষের সাথে একসাথে এক ঘরে থাকা যায় না।”

জানেন এটা তো শুধু একটা কথা ছিল। কিন্তু, কিন্তু আমার কেন মনে হলো কেউ আমার কলিজাটা কুচিকুচি করে লবন-মরিচ মাখিয়ে দিয়েছে! যার যন্ত্রণায় ডাঙায় উঠা মাছের মতো আমি ছটফট করে যাচ্ছি। এক মিনিট আগে যে মানুষটা ভালো রাখবে বলে কথা দিল সে মানুষটা মুহূর্তেই দুঃশ্চরিত্রার ট্যাগ দিয়ে চলে গেল!

যে মানুষটা একটু আগে হাতে হাত রেখে আজীবন আগলে রাখার কথা দিয়েছিল সে মানুষটা সাথে সাথেই ছুড়ে ফেলে দিল? আমি তো জানতাম মানুষ বদলায়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কী বদলায়? এতটা বদলায়? ঠিক এতটাই! নাকি আমি কোনো দুঃস্বপ্নের চোরাবালিতে আটকে আছি৷ নাকি এসবকিছু আমার মস্তিষ্কের অতিরিক্ত চিন্তার ফল।

যদি এসবের কিছুই না হয়। যদি একটু আগের ঘটনাগুলো সত্যি হয় তবে আমি আমার আল্লাহর কাছে একটাই জিনিস চাইব। তিনি যেন আমাকে বধির করে দেন। যাতে আমি আমার প্রিয় মানুষের মুখ থেকে আর কোনো অপবাদ না শুনি। তিনি যেন আমাকে অন্ধ করে দেন। যাতে আমি যে চোখে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি, সে চোখে ঘৃণা না দেখি। হে আমার সৃষ্টিকর্তা আপনি আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনকে অকেজো করে দেন। যেন আমি আমার মাহিদের এমন ব্যবহার নিয়ে ভাবতে না পারি।

মাহিদের চলে যাওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল আমি হয় জ্ঞান হারাচ্ছি, নয়তো মরে যাচ্ছি। তখন একজন মানুষের ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠেছে। আচ্ছা এটা তাকে কষ্ট দেয়ার ফল নয়তো! আমার বাবাকে কষ্ট দেয়ার ফল নয়তো? আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন! আমি কী মরে যাচ্ছি? মৃত্যুর যন্ত্রণা কী এতটাই কঠিন? মরে যাওয়ার আগে কী বাবার মুখখানা একবার দেখতে পাব না?

চলবে।