ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০২

0
585

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#দুই

যখন আমার হুস ফেরে তখন তাকিয়ে দেখি আমার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। প্রথমে মেয়েটাকে চিনতে পারিনি। পরে মনে পড়ল কাল মাহিদ হয়তো এই মেয়েটার কথাই বলেছিল।

আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বলল, “ভাবী আমার নাম জরিনা। এ বাড়িত কাম করি৷ ভাইজানের রান্নাবান্না আমিই কইরা দিয়া যাইতাম। আইজকা সকালে আইসা দেহি বাসার দরজা বেজানো। ভেতর থাইক্যা বন্ধ করা নাই। ভাইবলাম হয়তো কাইলকা বাসর রাইত আছিল আপনাগো, তাই দরজা দিতেই ভুইল্যা গেছেন। কিন্তু ঘরে আইসা দেখি ওমা একি কাণ্ড! নতুন বউ মেঝেতে পইড়া আছে। পুরা রুমে জিনিসপত্র ছড়ানো। তারপর বুইঝা নিলাম কাইলকা বাসর রাইত না। আপনার লাইগ্যা কাল রাইত আছিল।
ভাইজান যে অতিব রাগী মানব এ আমি আগে থেইক্যাই জানতাম। কিন্তু বাসর ঘরে এমন করব এটা ভাবতে পারি নাই। আইচ্ছা যাওক গা। এহন আপনে উইঠ্যা বসেন নাস্তা বানাই আনছি খাইয়া নেন।”

এটুকু সময়ে যা বুঝলাম জরিনা মেয়েটা অত্যন্ত বাচাল। এবং তার সাথে বুদ্ধিমতী। আমি বললাম, “তোমার ভাইজান আসছে?”

“না ভাবী আসে নাই। দেখেন কোন বন্ধুর বাসায় গিয়া আরামে ঘুমাইতাছে। আর এদিকে আপনে কষ্টে জ্বর বাধাইয়া বইসা আছেন। এই হইছে গিয়া পুরুষ মাইনষের আর মাইয়া মাইনষের ভিতর তফাৎ। পুরুষ মানুষ যাই করুক তার লাইগ্যা মাইয়া মাইনষে চিন্তা করবোই। আমার মনে অয় কী ভাবী জানেন?”

কোনো উত্তরের আশা না করে জরিনা আবার বলল, “পুরুষ মাইনষে, মাইয়াগোরে কষ্ট দিয়া মজা পায়। হালারা বজ্জাতের দল। কোনো মানুষ কী কোনোদিন কারো কষ্টে শান্তি পাইতে পারে কন? একমাত্র বজ্জাতরাই পারে। ঠিক কইছি মা আফা?”

আমি অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে বললাম, “আহ জরিনা চুপ করো। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আর জলপট্টি দিতে হবে না। তুমি গিয়ে অন্য কাজ করো।”

“হক কথা ভালা লাগে না ভাবী, এইডা তো পুরানা কথা। তয় দেখবেন গরীবের কথা বাসি অইলে ফলে। আচ্ছা আমি তাইলে অন্য কাম করি।”

যাওয়ার জন্য দুই কদম বাড়িয়ে জরিনা আবার ফিরে এসে বলল, “হুনেন ভাবী আপনে আমারে জরিনা কইয়া ডাকবেন না। আপনি আমারে ডাকবেন জারিনা কইয়া। জরিনার হিন্দি ভার্সন জারিনা বুঝছেন। এহন এসব জরিনা টরিনা চলে না। হিন্দি সিরিয়াল দেখেন না। ওইখানে একটা নায়িকার নাম জারিনা আছিল। কইতে শরম করে। তাও ক, মাইনষে কয় আমি নাকি সেই নায়িকা জারিনার মতো দেখতে। অহন আসি ভাবী কথাটা মনে রাইখেন।”

আঙুলে ওড়নায় পেছাতে পেছাতে মেয়েটা যেভাবে কথা বলল তা দেখে এই শারিরীক ও মানসিক যন্ত্রণায়ও আমার হাসি চলে আসল৷ মেয়েটা চলে গেলে ওয়াশরুমে গিয়ে কল ছেড়ে মাথায় পানি দিলাম। মনে হলো কিছুটা ভালো লাগছে। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগতেই মনের মেঘ অনেকটাই কেটে গেল। বর্ষাকাল আকাশ মেঘলা। পরিবেশটা ভীষণ মিষ্টি। মনে হলো এক কাপ কড়া লিকারের চা খেলে ভালো লাগবে। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। জরিনা বেসিনে থালা বাসন ধুতে ধুতে গান গাইছে গুনগুন করে। মেয়েটার গানের গলা খারাপ না। তখন ভালো করে না খেয়াল করলেও এখন মনে হলো মেয়েটা দেখতে ভালো। বললাম, “আমাকে এক কাপ চা করে দেবে জরিনা?”

“দিতাছি ভাবী। আমার নাম জারিনা।” কথাটা বলেই সে চায়ের পানি বসাল। আমি চুপচাপ তার কাজ দেখছিলাম। ভালোই লাগছিল।

চা খেয়ে বাসায় ঘুরলাম। এ বাসায় বিয়ের আগে আসা হয়নি। মাহিদ অনেকবার বললেও আমার ইচ্ছে হয়নি। শ্বশুরবাড়ি আগে থেকে দেখে ফেললে মজা থাকে না। বিয়ের পর সব নতুন দেখতে আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করে। বেড রুম দুটো, একটা কিচেন, দুটো বাথরুম। একটা বেডরুমের সাথে এটাচ। আমার খুব ভালো লাগল। জরিনা পেছনে এসে বলল,”ভাবী আপনার রুম গুছামু? ফুল-টুলে কেমন হইয়া আছে।”

“গুছাও আর শোনো ছেড়া ফুলগুলো কুড়িয়ে একটা কাঁচের জারে রেখে দাও।”

জরিনা চলে গেল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম বারোটা বাজে। এখনো মাহিদের আসার খবর নেই। কোথায় যেতে পারে ভাবতে লাগলাম। হয়তো কোনো বন্ধুর বাসায় গেছে। শরীরটা এখন বেশ ভালো লাগছে। খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে একটা কল দিতে বারবার বাবার নম্বরে ডায়েল করে আবার কেটে দিলাম। কল দিলাম রিয়নকে। রিসিভ হলো।

“কেমন আছিস ভাই?”

“ভালো আপুনি। তুই কেমন আছিস?”

“খুব ভালো আছিরে।” কথাটা বলতে গিয়ে কেন গলা কেঁপে উঠল কে জানে।

“রিয়ন?”

“বলো আপুনি?”

“বাবার মন কী খুব খারাপ?”

“হু।”

“কী করছে?”

“দেখে আসি।”

“দেখতে হবে না গাধা। মা কী করছে?”

“তোর জন্য কাঁদছে।”

“আচ্ছা রাখি রিয়ন পরে কথা বলব।”

“আপুনি শোন?”

“হুম, বল?”

“আচ্ছা কিছু না। ভালো থাকিস।”

রিয়ন কল কেটে দিল। বুঝতে পারলাম ও কাঁদছে। বুকের ভেতর ধক করে ওঠল। এমন সময় জরিনা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,”কী রান্না করমু ভাবী?”

“ফ্রীজে কী আছে?”

“মুরগী, মাছ।”

“ঘরে আতপ চাউল আর ডিম আছে?”

“আছে।”

“চলো মোরগ পোলাও, ডিমের কোরমা করব।”

“আপনার শরীর ভালা না। রেস্ট নেন আমি করি।”

“কিছু হয়নি আমার। চলো তো।”

রান্না শেষ হতে হতে তিনটা বেজে গেল। গোসল সেরে খাবার নিয়ে মাহিদের অপেক্ষায় বসে রইলাম। মাহিদের ফোনে কল দিলাম একজন মেয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল “আপনার ডায়েল করা নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে।”

জরিনাকে বললাম খেয়ে নিতে সে খেতে চাইল না। জোর করে তাকে সামনে বসিয়ে খাওয়ালাম। খেতে খেতে সে কাঁদল। তার মতে অনেক বাড়ি কাজ করলেও কেউ কোনোদিন তাকে টেবিলে বসিয়ে এত যত্ন করে খাওয়ায়নি। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষ কত অল্পতেই খুশি হয় তাই না! জানি না কেন জ্বর, গায়ে ব্যথা নিয়ে রান্না করাটা স্বার্থক বলে মনে হলো।

জরিনা পাঁচটা পর্যন্ত বসে ছিল। অনেক জোর করল যাতে আমি খেয়ে নি। ঘা গোলানোর অজুহাতে খেলাম না। মাহিদের জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। বিয়ের পরদিন স্ত্রী রান্না করে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে, এর থেকে রোমাঞ্চকর আর কী হতে পারে! কিন্তু স্বামী যে এলো না। এ-ও এক অদ্ভুত কাণ্ড। ভাবলাম এ পৃথিবীতে আমি কী প্রথম মেয়ে যার স্বামী বিয়ের রাতে তাকে মেরে ফেলে রেখে চলে গেছে! রান্না করে তার জন্য অপেক্ষা করছি সে আসছে না! শুনেছি নতুন নতুন বরেরা ঘর থেকে বের হতে চায় না। আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো হলো! এটাও একটা দারুণ ব্যাপার। আমার জীবন অন্যদের থেকে আলাদা!

বুঝতে পারছি জ্বর বাড়ছে। উঠে রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ড্রয়িংরুমে সোফায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছে নাকি জ্ঞান হারাচ্ছি বুঝতে পারলাম না। যখন ঘুম ভাঙে দেখলাম জরিনা আমার মাথায় পানি ঢালছে। পাশে বসে একজন চশমা পরা বয়স্ক লোক থার্মোমিটার চোখের সামনে ধরে তাপমাত্রা চেক করছে। ভদ্রলোকের চশমা নাকে এসে পড়েছে। উনি বোধহয় ডাক্তার।

একটু দূরে অন্যদিকে তাকিয়ে মাহিদ বসে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে ভালো লাগছিল। ডাক্তার বললেন,”শরীর খুব দূর্বল। খাবার খাওনি কেন মামণি?”

এমন সুন্দর বলার ভঙ্গি আমি উত্তরে হাসলাম। কেন খাইনি সেটা তাকে বলা যাবে না। এ পৃথিবীতে যে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না, তার বদলে হাসি দেয়াই ভালো। পজেটিভ, নেগেটিভ কিছু বুঝা যায় না এটাই হচ্ছে সুবিধা। কি বলেন তাই তো?

ভদ্রলোক অনেক উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। মাহিদ আমার পাশে এসে বসল। আমার কপালে হাত দিয়ে বলল, “বেশি খারাপ লাগছে?”

জানি না কেন আমার চোখে জল এসে গেল। সেটা গোপন করার জন্য বললাম,”এক গ্লাস পানি দেবে?”

ও পানি আনতে গেল। আমি চোখ মুছে স্বাভাবিক হলাম। কিন্তু জরিনার চোখাচোখি হতেই বুঝলাম সে দেখে ফেলেছে। তাকে ডেকে বললাম,”বাড়ি যাবে না?”

সে জানাল যাবে না। আজ সে থেকে যাবে। মাহিদ আমায় ধরে রুমে নিয়ে গেল। জরিনাকে বলল রুমেই খাবার দিতে। অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটা আমার জন্য চিকেন স্টু রান্না করেছে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে মাহিদ আমায় খাইয়ে দিল। তবে এখনো গম্ভীর। কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। বুঝতে পারলাম না এই রেখা আমার অসুস্থতার জন্য নাকি কাল রাতের ঘটনার জন্য। খাওয়া শেষ হতেই সে বলল,”ঘুমিয়ে যাও তোমার বেড রেস্টের প্রয়োজন।”

“তুমি আমার পাশে একটু বসবে প্লিজ?”

“ঘুমিয়ে পড়ো রিদ্ধিমা। পরে কথা হবে। ”

আমার তাকে অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু সে শুনতে চাইছে না। আচ্ছা আমার জীবনটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আমি কী ভুল করেছি? বাবাকে এত মনে পড়ছে কেন! আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? না কিছুতেই কাঁদা যাবে না। আমি এখন চোখের পলক ফেলব না। ফেললেই টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়বে। যা আমি চাই না।

মানুষের জীবনের সুন্দর সময় গুলো কেন অতীত হয়ে যায়! ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল। ফোনটা মাহিদের কাছাকাছি টেবিলে ছিল। সে ফোনটা হাতে নিয়ে অগ্নিমুখে আমার মুখের দিকে ছুড়ে মারল। অবাক হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম, “সাহিল ইজ কলিং!”

চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা