ভালোবাসার উল্টো পিঠে পর্ব-০৯

0
402

#ভালোবাসার_উল্টো_পিঠে
#নয়
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

গৌধূলী আকাশে সাদা পেজো তুলোর মতো মেঘ উড়াউড়ি করছে। ক্ষণে-ক্ষণে আকাশের রঙ পাল্টাচ্ছে। রিক্সায় থেকে নেমে রিদ্ধি মস্ত বড় আকাশটাকে দেখছে আর ভাবছে আমাদের জীবনটাও কী এরকম! প্রতি মুহূর্তে রঙ পাল্টায়। হরেক রকম রঙের ভিড়ে সঠিক রঙটা খুঁজে বের করা বড্ড কঠিন।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বাড়ির কাছে এসে গেছে। চারতলা সবুজে ঘেরা সেই বাড়িটা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই থমকে দাঁড়াল সে। জীবনের একুশটি বছর এখানে কাটিয়েছে সে। হেসেছে, খেলেছে, অভিমানে পুরো বাড়ি ঘুরেছে। কত-শত স্মৃতি ভেসে ওঠেছে দৃশ্যপটে। জীবনে প্রথম এতগুলো দিন নিজের বাড়ির বাইরে ছিল। হঠাৎ ভেতরটা বলে উঠলো এখন কী আর এই বাড়ি তোর আছে রে রিদ্ধি?

এখন কী তুই বাবা-মায়ের সেই আদরের রিদ্ধি আছিস! যার একটু অভিমানে পুরো বাড়ির শ্বাস আটকে আসত। এখনো কী তেমন জায়গা আছে তোর জন্য?

ভাবতে ভাবতে চোখে জলের ধারা নামতে লাগল। ভাবল কই গত একুশ বছরে কখনো তো মনে হয়নি এ বাড়িটা এতটা আপন! কখনো তো বিচ্ছেদে চোখে জল নামেনি! তবে কী দূরে গেলেই শুধু সবকিছুর কদর বাড়ে! কাছে থাকলে মানুষের জন্যও কষ্ট হয় না। কিন্তু দূরে গেলে ঝড় পদার্থের জন্যও অসম্ভব মায়া বেড়ে যায়।

একটু একটু করে এগুতে চাচ্ছে কিন্তু পা যেন জায়গা থেকে সরছেই না। মনে হচ্ছে অনেক ভারি কিছু একটা কেউ পায়ের সাথে বেঁধে দিয়েছে যার ধরুন সামনে যেতে পারছে না।

অজস্র ভয়, সংকোচ, অপরাধবোধ, লজ্জা সব মিলিয়ে তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। নিজের বাড়িতে যেতে এতটা সংকোচ হবে কোনোদিন ভাবেনি সে। নিজের মানুষদের মুখোমুখি হতে এতটা লজ্জা হবে তা তো ভাবনারও অতীত।

জীবন কীভাবে কীভাবে যেন পুরো নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে যায়। যা আমার, যার উপর আমার অধিকার সবকিছু কেমন করে যেন পর হয়ে যায়।

একটা কাজ! শুধু একটা কাজ কীভাবে যেন সবার কাছে আদরের মেয়ে থেকে অপরাধী বানিয়ে দিল! যাদের অনায়াসে জড়িয়ে ধরতে পারত। আজ তাদের সামনে যেতেই ভয় করছে! এসবকিছু শুধু মাত্র নিজের অপরাধের জন্য হয়েছে। যখন কেউ কোনো অপরাধ করে তখন সামনে থাকা মানুষগুলোকে ফেইস করতে এত কষ্ট হয়। এত যন্ত্রণা হয় যা বলে বুঝানো মতো নয়।

ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল গেইটে দারোয়ান চাচা তাকে দেখে দৌড়ে এসে বললেন, “আরে আম্মা আপনে আইছেন? আপনার লাইগ্যা মন আমার কান্দে। কতদিন আপনারে দেহিনাই। কতদিন চাইছি আপনারে দেইখতে যামু। কিন্তু সাহস করতে পারি নাই। যদি বড় সাহেব রাগ করেন?”

দারোয়ান চাচার চোখ জোড়া ছলছল করছে। রিদ্ধি আরও একটা বড় ধাক্কা খেল। দারোয়ান চাচা তাকে এত ভালোবাসে! তার জন্য কাঁদছে! কই কোনোদিন তো এমন মনে হয়নি! তবে কী জীবনে এমন সবকিছু ঘটে যা আমাদের ভাবনা থেকেও অনেক দূর এগিয়ে!

তারও খুব কষ্ট লাগল। কাঁদতে ইচ্ছে করল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “চাচা ভালো আছেন? আপনি গেলে আমি খুব খুশি হতাম।”

“আমি ভালা আছি আম্মা। আপানেরে অমন রোগা লাগতেছে ক্যান?”

“তেমন কিছু না চাচা। আমার তো আগে থেকে ওজন দু-কেজি বেড়ে গেছে। বাবার বাড়ি আসলে সব মেয়েকে পরিবারের কাছে রোগা লাগে চাচা। আসলে তারা তাদের মেয়েকে খুব ভালোবাসে তো তাই।”

চাচ হাসলেন। রিদ্ধির মনে হলো কখনো খেয়াল করে দেখা হয়নি চাচার হাসিটা ভীষণ সুন্দর! ভীষণ!

★★★

সামনের লনে রিদ্ধির লাগানো গাছগুলোতে ফুল ফুটেছে। সেগুলো ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখছে সে। আজ মনে হচ্ছে এ গাছগুলোও কতটা আপন! দারোয়ান চাচা ভেতরে গেছেন মনে হয় সবাইকে খবর দিতে গেছেন।

রিদ্ধির বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। এত জোরে ভেতরটা নাড়া দিচ্ছে যে নিজেকে সংযত রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। চোখের কোণ শাড়ির আঁচলে মুছে নিল। দোতলায় বাবার বারান্দার দিকে তাকাল। এমন সময় বাবা ওখানে বসে বই পড়েন। হঠাৎ মনে হলো পর্দার আড়ালে কেউ সরে গেল। ভালো করে তাকিয়ে বুঝল কেউ নেই। হালকা বাতাসে পর্দা নড়ছে।

দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। মুখটা হাসি-হাসি করার চেষ্টা করল। বাবা-মাকে কিছুতেই মাহিদের পরিবর্তন বুঝানো যাবে না। অনেক বড় মুখ করে বেরিয়েছে সে। এত তাড়াতাড়ি সেটা শেষ করে দিতে চায় না।

দরজা খোলাই ছিল। দরজার মুখোমুখি তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তড়িঘড়ি করে একদিকেই আসছিলেন। লজ্জায় রিদ্ধি তার দিকে এগুতে পারল না। তিনিই এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকটা সময় ধরে কাঁদলেন। সেও চুপ করে কেঁদে যাচ্ছে। আসার সময় ভেবে এসেছিল মা-বাবার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু কিছুতেই সেটা করতে পারছে না। কোনো একটা জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কতকিছু বলবে বলে এসেছিল! কিন্তু কী অদ্ভুত কিচ্ছুটি বলতে পারছে না!

রিয়ন নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে হাসছে! রিদ্ধি মায়ের কাছ থেকে সোজা ভাইয়ের দিকে এগিয়ে আসল। তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। রিয়ন বোনের কানে বলল, “আমি তোকে একটুও মিস করিনি কিন্তু।”

রিদ্ধি মুখ তুলে একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো রিয়নের চোখ দিয়েও জলের ধারা নামছে। রিদ্ধি এক হাত দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে তার বুকে কয়েকটি কিল বসিয়ে আবার জড়িয়ে ধরল। দুজনের চোখে জল ঠোঁটের কোণে হাসি।

হঠাৎ রিদ্ধিকে পেছন থেকে কারো দুটো হাত জড়িয়ে ধরল। পেছনে ফিরে দেখল রাইয়ান তার ছোট ছোট হাত দুটো দিয়ে তাকে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। রিদ্ধি সাথে সাথে ফ্লোরে বসে রাইয়ানের গালে অনেকগুলো চুমু দিল। রাইয়ান বলল, “আপুনি আমি তোমাকে অ নে – নে – নে-ক মিস করেছি। তুমি কেন এতদিন আসলে না।”

রিদ্ধির নিশ্চুপ কান্না যেন জোর পেয়ে শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসল। ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রাইয়ান সারাক্ষণ তার পিছুপিছু থাকত। আপুনিই তার সব। খাইয়ে দেয়া, পড়ানো, রাতে একসাথে বোনের সাথেই সে ঘুমাতো। তাই তো রিদ্ধি জানে ছোট্ট ভাই তাকে কতটা মিস করেছে।

শরিফা খালা সেই কখন থেকে মুখে আঁচল দিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন। শরিফা তাদের বাসার কাজে সাহায্য করেন।

“খালা আমাকে জড়িয়ে ধরবে না?”

রিদ্ধি তার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। আজ তার সত্যি খুব ভালো লাগছে। সবাই তাকে এত ভালোবাসে। এত আদর করে। এতটা কষ্টে ছিল তার জন্য! ভাবতেই পারেনি সে। ভেবেছে সব্বাই রাগ করে আছে। কিন্তু আসলে তো রাগের আড়ালে সবাই তাকে মিস করছিল। তারপর চারপাশে তাকিয়ে দেখল। কাউকে খুঁজল। যাকে ফেইস করা সবচেয়ে কঠিন।

মাকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু বাবা কোথায়?”

★★★

মাহিদ কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।

“হুম গেছে বাবার বাসায়।”

“কিছু বুঝতে পারছে না তো?”

“না, মাহিদ এত কাচা খেলোয়াড় নয় ডিয়ার।”

“ওকে। শেষ পর্যন্ত এমন দেখতে চাই।”

“এমনটাই হবে।”

ফোন কেটে মাহিদ হাসছে। অদ্ভুত সেই হাসি!

চলবে