ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১৯+২০

0
928

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৯

আদ্রিশ ভাইয়ার এ সুপ্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ চেহারায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি।আশেপাশে এমন সব ঘটনা দেখার ভিত্তিতে আন্দাজ করলাম আদ্রিশ ভাইয়া এ মূহুর্তে ঠিক কি করতে পারে।কিন্তু উনি যা করতে চাইছেন তা আমি উনাকে মোটেও করতে দিতে পারবো না।কারন এসব কথাবার্তা এখন পর্যন্ত শুধু এই জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া রাগের বশে কিছু করে ফেললে এ ঘটনা আশেপাশের গ্রামে রটিয়ে যেতে খুব একটা সময় নিবে না।আর আমি চাইনা এসব কেউ জানুক।

আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে এসে আদ্রিশ ভাইয়াকে বললাম,
“প্লিজ চলুন এখান থেকে।”
এটুকু বলতেই আমি অনুভব করলাম আমার গলার কাছে কান্নার দলা পাক খেতে শুরু করলো।মন বলছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করি।কিন্তু চাইলেও এখানে কান্না করা সম্ভব নয়।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথা শুনলো নাকি জানা নেই।হয়তো শুনেননি।এজন্যই হয়তো আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার পাশে দাঁড় করালেন।এরপর আমাকে একপ্রকার জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে ছেলেগুলোর সামনে দাঁড় করালেন।
ছেলে দুটো আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।আদ্রিশ ভাইয়া তা দেখে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“যা যা বলেছিস ওকে তার জন্য সরি বল।”

উনার এ কথা ছেলে দুটোর উপর কোনো প্রভাবই ফেললো না।উল্টো তারা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই একে অপরের উদ্দেশ্যে বললো,
“বন্ধু,এরা দুইজন কি স্বামী স্ত্রী?নাকি প্রেমিক প্রেমিকা?”

“না রে বন্ধু।আমি যদ্দুর জানি।এরা স্বামী স্ত্রী না।পাশের গেরামেই তো এই সুন্দরীর আশিক থাকে।ঢাকা থেইকা ডাক্তারি পইড়া আইছে।এজন্যই তো এমন সুন্দরী সুন্দরী মাইয়ারা ওর পিছে ঘুরে।আর এই সুন্দরীও ডাক্তার দেইখা লোভে পরে পিছে পিছে ঘুরতেছে।কি লোভী মাইয়া রে!আমরা টাকা কামাইলে আমাদের পিছোনেও ঘুরবো এই মাইয়া।ঠিক না?”
আবারও ছেলে দুটো ক্রুর হাসি দিলো।

আমার মস্তিষ্ক যেন জমে গিয়েছে।বুকের উপর ভারী আর শক্ত কিছুর ভার অনুভব করতে পারছি আমি।বুঝতে পারছি কষ্ট হচ্ছে খুব।কখনও এতো কটু কথা শুনিনি আমি যতটা আজ শুনছি।
আমি আর না পেরে আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরলাম।চোখজোড়া শক্ত করে বন্ধ করে রইলাম।আর সাথে সাথেই চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পরতে লাগলো।অনবরত আমার চোখ দিয়ে পানি পরে যাচ্ছে।কান্না তো করতে পারছি।পারছি না শুধু চিৎকার করতে।
নিজেকে খুব দূর্বল মনে হচ্ছে।শরীর আর দাঁড়িয়ে থাকতে সায় দিচ্ছে না।মনে হচ্ছে এখনই পরে যাবো।কিন্তু আমি নিজেকে শক্ত রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম।চোখ বন্ধ রেখেই আদ্রিশ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
“প্লিজ চলুন এখান থেকে।আমার ভালো লাগছে না তো।এক কথা এতোবার কেনো বলবো?”

এই বলে আমি একটু একটু করে চোখ খুলে সামনে তাকালাম।দেখি আদ্রিশ ভাইয়া ছেলে দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।দূরে দাঁড়িয়ে আছে গুটিকয়েক মানুষ।যারা সবাই মুরুব্বি।
আদ্রিশ ভাইয়া ছেলে দুটোকে ধমকাচ্ছেন। তবে নিচু স্বরে।যাতে আশেপাশের মানুষজন বেশি শুনতে না পারে।

আদ্রিশ ভাইয়ার ধমকানোর একপর্যায়ে ঐ ছেলে দুটোর মধ্যে একটা ছেলে এগিয়ে এসে উনার শার্টের কলার চেপে ধরে উচ্চস্বরে বললো,
“তুই আমাদের সামনে এতো মুখ নাড়াইবার সাহস পাইলি কেমনে।আমরা দলবল নিয়ে তোরে মারলে কি তুই জ্যান্ত থাকবি?ঐ মাইয়ারে যা বলার বলমু।আমাদের মন চাইছে আমরা বলমু।তুই ওর কে রে।স্বামী তো আর না।”

আদ্রিশ ভাইয়া প্রতিউত্তরে কিছু না বলে ঐ ছেলেটার হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিয়ে ছেলেটাকে ধাক্কা দিলেন।এতে ছেলেটা কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।আদ্রিশ ভাইয়াও ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন।প্রচণ্ড রাগ নিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“আমি ওর কি হই তা তোদের মতো কু**দের জেনে লাভ নেই।ওর কাছে সোজা কথায় সরি বলতে বললাম, বললি না।উল্টা আমার সাথে মুখ চালাচ্ছিস! আমাকে ধমক দিচ্ছিস তোর দলবল নিয়ে আমাকে মারবি!আরে আমার দলবলের কাছে তোরা কিছু না।আমরা সব মিলে তোদের দুইটাকে এমন ধোলাই দিবো যে রাস্তার কুকুররাও তোদের দিকে মুখ তুলো তাকাবে না।আমি……”
আর বলতে পারলেন না আদ্রিশ ভাইয়া।উনার পিছন থেকে আরেকটা ছেলে উনাকে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিলেন।
এতোক্ষণে দূরের মসজিদের কাছ থেকে কয়েকজন মুরুব্বি এদিকটায় চলে এসেছেন।

আদ্রিশ ভাইয়া দ্রুততার সহিত উঠে গিয়ে ঐ ছেলেটার কলার চেপে ধরে মারতে লাগলেন, যে ছেলেটা উনাকে ধাক্কা দিয়েছিলো।
আদ্রিশ ভাইয়া কয়েকবার ঐ ছেলেকে ঘুষি মেরেই অপর ছেলেটাকে ঘুষি মারতে লাগলেন। মুরুব্বিরা এসে উনাকে থামাতে চেষ্টা করলেন।কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না।সে মূহুর্তে নির্বাক আমি সজাগ হলাম।এতোক্ষণ সবকিছু শুধু দেখেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।তবে এখন বুঝতে পারছি।
আমি তটস্থ হয়ে চোখের পানি মুছে দ্রুত পায়ে রাস্তায় চলে এলাম।এতো মানুষের মধ্যে গিয়ে আদ্রিশ ভাইয়াকে কথার মাধ্যমে আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।কিন্তু লাভ হলো না।

এসব দেখে কিছুক্ষণ আগে থেমে যাওয়া অশ্রুধারা আবারো বইতে শুরু করলো। কারন আমি এসব সহ্য করতে পারি না।খুব কষ্ট হয়।খারাপ অনুভূত হয়।এখনও খারাপ লাগছে।

আমি আদ্রিশ ভাইয়াকে থামতে বলছি তবে তিনি থামছেন না।ওদিকে ছেলেগুলো উনাকে মারছেন আবার উনিও ছেলেগুলো মারছেন।আশেপাশের মুরুব্বিরাও কিছু বলতে পারছেন না।
আমার এসব কথাও যখন আদ্রিশ ভাইয়ার উপর কোনো প্রভাব ফেললো না, তখন আমি এগিয়ে গিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার দু হাত ধরার চেষ্টা করলাম।কয়েকবারের প্রচেষ্টায় উনার হাত ধরতে সক্ষম হলাম।তবুও যেন উনার থামার নাম নেই।এক পর্যায়ে আমি রেগে উনার হাত ধরে ছিটকে উনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললাম,
“হয়েছে তো…আর কত মারবেন?ওদেরকে মেরে কি লাভ হলো?শুধু শুধু এমন করে পুরো গ্রামে এ ঘটনা রটিয়ে দিলেন।কেনো করলেন এমনটা?আমার এসব ভালো লাগে না।প্লিজ এখন চলুন।আমি আর সহ্য করতে পারছি না এসব।”
আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবারো কান্নায় ভেঙে পরলাম।গলার কাছে আটকে আসা কান্নাগুলোকে চোখের পানির মাধ্যমে বের করে দিলাম।তবে চিৎকার করে নয়,ঠোঁট চেপে কান্না করতে লাগলাম।

ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়ার থেকে ছাড়া পেয়ে ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে যেতে লাগলো।তবে যাবার আগে আমাদের দুজনের উদ্দেশ্য অকথ্য ভাষায় কিছু গালাগালি করে গেলো।যা আমি সহ্য করতে পারলাম না।ফলস্বরূপ আমার কান্নার গতি আগের চেয়ে আরোও বেড়ে গেলো।এতগুলো মানুষের সামনে এসব শোনার দূর্ভাগ্য হবে আমার তা জানা ছিলো না।
জীবনে কখনও এতোটা ভেঙে পরিনি যতটা আজ ভেঙে পরেছি। এতোগুলো মানুষের সামনে আমার ইজ্জতসম্মান কি রয়ে গেলো!তুচ্ছ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা যা হলো তাতে আর কারোর ক্ষতি হোক বা না হোক আমার ক্ষতি অবশ্যই হবে।এমন ঘটনায় কারোর কিছু হয়না।যা হয় একজন মেয়ের হয়।তাকে নিয়ে হাজারো কথাবার্তা হয়।তার দোষ খোঁজা হয়।গ্রামের মানুষজন এসব ঘটনাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলে।সব দোষ দেয় মেয়েকে।এবার আমাকেও সবাই দোষী ভাববে।এখন আশপাশের কয়েকটা গ্রামে আমাকে নিয়ে চর্চা হবে।আমি পারবো না এসব সহ্য করতে।পারবো না এদের কথা শুনতে।তাহলে কি করবো আমি?

আমি মুখ চেপে কান্না করতে লাগলাম।বারবার ঐ ছেলে দুটোর কথা কানে ভেসে আসতে লাগলো।কানের কাছে বাজতে লাগলো তাদের অকথ্য ভাষায় করা গালিগালাজগুলো।

বেশকিছুক্ষণ পর নিজের কাঁধের কাছে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে ধীরেধীরে মুখ তুললাম আমি।দেখতে পেলাম আদ্রিশ ভাইয়ার চেহারা।রাগ আর কষ্টের সংমিশ্রণে তৈরী এক ভাব ফুটে উঠেছে উনার চেহারায়।ফুটে উঠেছে অসহায়ত্বের এক ছাপ।
আদ্রিশ ভাইয়া ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“মিশমিশ,এভাবে ভেঙে পরো না প্লিজ।যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।নিজেকে শক্ত করো দয়া করে। ”

আমি এবার ফোঁপাতে লাগলাম।কয়েক সেকেন্ড পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম,
“আপনি জানেন না,কি করেছেন আজ।আপনি কেনো ওদের মারতে গেলেন?তখন চলে আসলেই ব্যাপারটা এতদূর গড়াতো না।এখন আপনাকে নিয়ে তেমন কথাবার্তা হবে না।হবে আমাকে নিয়ে।এরা সবাই আমাকে নিয়ে খারাপ খবর ছাড়াবে।বুঝতে পারছেন কিছু?আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন আমি কি ফিল করছি।কিছু না করেই সবকিছুর দায়ভার আমাকে নিতে হবে।যেসব হয়নি সেসব কথাও এরা বানিয়ে বলবে।হয়তো ঐ ছেলেগুলোও গ্রামে এসব ছড়াবে।ভাবতে পারছেন আমার মানসম্মানের কি হবে?আমি কয়দিন পর চলে যাবো কিন্তু আমাকে নিয়ে এসব কথাবার্তা চলতেই থাকবে।
তারপর ছেলেগুলোর সেসব গালিগালাজ!আমার কানকেই আমি বিশ্বাস করাতে পারছি না।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি তো এসব বুঝবেন না।বুঝলে সেখান থেকে চলে যেতেন। মারতেন না ওদের।”
আমি আবারো কান্নায় ভেঙে পরলাম।অশ্রুভরা চোখে সামনে তাকিয়ে দেখলাম মুরুব্বিরা দাঁড়িয়ে আছেন।তারা হা করে সব দেখছেন।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কাছে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।ধীর পায়ে সেই মুরুব্বিদের কাছে গেলেন।
আমি সেখানে বসে বসে আদ্রিশ ভাইয়া আর ঐ মুরুব্বিদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।মুরুব্বিদের চেহারায় হাজারো প্রশ্নের খেলা।ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়ার চেহারায় সুক্ষ্ম এক অসহায়ত্বের ছাপ।

আমি নিরবে সেদিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছি।আদ্রিশ ভাইয়া কি কারনে উনাদের সামনে গিয়ে ওভাবে দাঁড়ালেন তা জানা নেই আমার।

কয়েক সেকেন্ড পর আমাকে অবাক করে দিয়ে একদম হুট করে আদ্রিশ ভাইয়া ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দু হাত একত্রে করে বললেন,
“চাচা, আজ এখানে যা যা হয়েছে তা দয়া করে কাউকে বলবেন না।শুধু আপনাদের মধ্যেই এ ঘটনা সীমিত থাকতে দিন।নিজের পরিবারের মধ্যে এমনকি নিজেদের মধ্যেও এসব নিয়ে আলোচনা করবেন না দয়া করে। আমার কথা রাখবেন চাচা।আপনারা আমাদের বড়।আমি আপনাদের ছেলের বয়সী।নিজের ছেলের কথা রাখবেন চাচা?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠে তীব্র অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ মূহুর্তে উনার চেয়ে অসহায় আর কেউ নেই এ পৃথিবীতে।
আমি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে।নিজের কান আর চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না এ কথাগুলো শুনাতে,এ দৃশ্যগুলো দেখাতে।
আমি চোখে জমা পানিগুলো শক্ত হাতে মুছে নিয়ে সামনে তাকালাম।
আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে মুরুব্বিগুলো একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন তো আরেকবার আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছেন।উনার হয়তো এ মূহুর্তে দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে আছেন।হয়তো উনারা এ বিষয় পুরো গ্রামে প্রচার করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ার এমন মিনতি দেখে এখন কি করবেন তা হয়তো বুঝতে পারছেন না উনারা।

আদ্রিশ ভাইয়া চাতক পাখির মতো উনাদের দিকে চেয়ে রইলেন।হয়তো ভাবছেন এখনই এই মুরুব্বিদের মধ্যে কেউ বলবেন,’আচ্ছা বাবা,এসব কথাবার্তা আমাদের মধ্যেই থাকবে।’ এমনটা আমার মনে হলো কারন আমারও মন ঠিক এটাই চাইছে।এ বিপদ থেকে উনারাই তো আমাদের দূরে রাখতে পারবেন।কিন্তু উনারা আদৌ কি তা করবেন?

আদ্রিশ ভাইয়া কিছুক্ষণ উনাদের দিকে চেয়ে থাকার পর আরেকটা বিস্মিত কাজ করে বসলেন।
হুট করে উনাদের সামনে হাঁটু করে বসে পরলেন তিনি।হাত দুটো আগের মতোই করে রাখলেন।উনার এ কাজে আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে এলো আমার।চলমান কান্নাও হুট করে বন্ধ হয়ে গেলো।
আমার সাথে সেই মুরুব্বিরা এমনকি মুদি দোকানদারও অবাক হয়ে গেলো।তারা সবাইও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো এ ঘটনায়।
আদ্রিশ ভাইয়া মাথা নিচু করে হাত জোর করে বললেন,
“দেখুন চাচা,এ ঘটনা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পরলে মেয়েটার মানসম্মানের কিছুই থাকবে না।ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানাজন নানা কথা বানাবে।মেয়েটা কত ভেঙে পরেছে দেখেছেন চাচা?ওর ভয় হচ্ছে যে এই মারামারি আর ওকে নিয়ে বলা উল্টাপাল্টা কথা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পরলে সবাই ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলবে।আমি তা চাইনা চাচা।আপনারাও তা চাইবেন না নিশ্চয়ই?আপনাদেরও তো মেয়ে আছে তাইনা?ওর জায়গায় আপনাদের মেয়ে থাকলে আপনারা এ ঘটনা যেভাবেই হোক লুকানো চেষ্টা করতেন।ওর ক্ষেত্রেও তা করবেন প্লিজ।আপনাদের পায়ে পরি,আপনারা এ কথা ভুলে যান।কারোর সাথে এসব কথাবার্তা বলবেন না দয়া করে।এখানে ঐ একটা বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি নেই।মানুষজনও নেই তেমন।যা জানার আপনারাই জানেন।তাই আপনাদেরই দায়িত্ব এ ঘটনাকে এখানেই শেষ করা।চাচা দয়া করে আমার কথা রাখুন।মেয়েটার মান সম্মান সব আপনাদের হাতে।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠে প্রকাশ পেলো আকুতি মিনতি।প্রকাশ পেলো অসহায়ত্ব। প্রকাশ পেলো কোনো কিছু হারানোর ভয়।
আমার খুব অদ্ভুত লাগলো এসব দেখে।উনি আমার জন্য এসব করবেন তা কখনও চিন্তা করেনি আমি।উনার বলা প্রতিটা কথা আমার মনকে অন্যকিছু ভাবতে জোর করলো।উনার এ কাজ এ কথায় আমার মনে উনার প্রতি সম্মান বেড়ে গেলো।অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো আমার মন।

আমি অবাক চাহনিতে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।কিছুক্ষন পর সেই মুদি দোকানদার নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে দাঁড়ালেন।উনার কাঁধ ধরে উনাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললেন,
“আমরা সব কিছু ভুলে যাবো ভাইজান।এ ঘটনা আমাদের বাইরে যাবো না।আসলে আমারই ভুল ছিলো ভাইজান।তখনই যদি ঐ দুইডার কানের নিচে দুইডা থাপ্পড় বসাইতাম তাহলে ঘটনা এতো দূর গড়াইতো না।আমারে মাফ কইরা দেন ভাইজান।”

আদ্রিশ ভাইয়া এই শোনার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন হয়তো।মুদি দোকানদারের কথা শুনে তিনি মৃদু হেসে দিলেন।উনি কিছু বলতে চাইছেলেন হয়তো তার আগেই সেই মুরুব্বিদের একজন আদ্রিশ ভাইয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুমি চিন্তা করো না বাবা।আমরা কাউকে কিছু বলবো না।নিজেদের মধ্যেও এ নিয়ে কথা বলবো না।আমাদের মেয়েটার মানসম্মান আমাদের হাতে।আমরা যথাযথভাবে এর রক্ষা করবো।ওয়াদা রইলো আমাদের। ”

সেই চাচার কথায় আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিলেন।উনার চোখেমুখে প্রকাশ পেলো স্বস্তি। যেটার অপেক্ষায় উনি অনেকক্ষণ ধরে ছিলেন।

আদ্রিশ ভাইয়া সেই মুরুব্বিদের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ধীরপায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরলেন।মায়াভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার চোখের নিচে জমে থাকা পানি মুছে দিয়ে বললেন,
“এখন কিচ্ছু হবে না মিশমিশ।সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।তুমি একদম চিন্তা করো না।চাচারা ওয়াদাও করেছে তো।আর ঐ ছেলেদের কথা একদম চিন্তা করবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো,তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো আমি।”

®সারা মেহেক

#চলবে

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২০

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
“আর কান্না করো না প্লিজ।অনেক কান্না করেছো।এখন ঐ টিউবওয়েল পার থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসো চলো।”

আমি শুকনো মুখে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম।হুট করে আমার মনটা আদ্রিশ ভাইয়াকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে চাইছে। আমার মনটা জানতে চাইছে এ মানুষটার চেহারায় কি লেখা আছে যে তার ব্যবহার এমন?তার আচরণ এমন?সে আমার মান সম্মান বাঁচানোর জন্য এমন কাজ করে বসবে?
কয়েক সেকেন্ডের পর্যবেক্ষণে বুঝতে পারলাম উনার চেহারায় এসবের ছিঁটেফোঁটাও নেই।আসলে কারোর চেহারায় তার চরিত্র, তার আচার ব্যবহার সম্পর্কে কিছু লেখা থাকে না।এসবের পরিচয় পাওয়া যায় কিছু পরিস্থিতিতে।
আর আজ এ পরিস্থিতিতে আমি আদ্রিশ ভাইয়ার চরিত্র সম্পর্কে খুব ভালো একটা ধারণা নিয়ে নিতে পারলাম।না চাইতেও এ মানুষটার প্রতি আমার ভালোলাগা আগের চেয়েও অনেক গুণ বেড়ে গেলো।

আদ্রিশ ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলেন।আমি কোনোমতে আদ্রিশ ভাইয়ার হাত ধরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম।অনুভব করলাম প্রচণ্ড দূর্বল হয়ে গিয়েছে শরীর।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার হাত ধরে সেই টিউবওয়েলের কাছে নিয়ে এলেন।উনি টিউবওয়েল চাপ দিলে আমি আস্তেধীরে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম।
হাতমুখ ধুয়ে মাথা তুলে চেয়ে দেখলাম ঐ বাড়ির মধ্যবয়স্কা এক মহিলা এসে দাঁড়িয়ে আছেন।আমাকে আর আদ্রিশ ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন।আমি প্রথমে নিষেধ করলেও আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে জোর করে ভিতরে নিয়ে যান।হয়তো আমার শারীরিক আর মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছেন উনি।

মধ্যবয়স্কা সে মহিলার বাড়ির বসার ঘরে গিয়ে বসলাম আমি আর আদ্রিশ ভাইয়া।আমাদের দুজনকে দেখে ১৭/১৮ বছর বয়সের একটা মেয়ে দুটো পানির গ্লাসসহ একটা ট্রে নিয়ে এলো।মেয়েটি টেবিলে ট্রে রাখতেই আমি আদবকায়দা ভুলে দ্রুত একটা গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে ফেললাম।প্রচণ্ড গলা শুকিয়ে এসেছিলো বলে সে মূহুর্তে ভদ্রতা বলে কোনো শব্দ আমার মাথায় এলো না।এলো তখন যখন আমার পানি খাওয়া শেষ।

আমার এহেন কাজে খানিকটা লজ্জিত বোধ করলাম আমি।ফলে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।আমার এ কাজ দেখে ভদ্রমহিলা হালকা হেসে বললেন,
“আরেক গ্লাস পানি খাবা মা?”

আমি মাথা তুলে শুকনো মুখে বললাম,
“না আন্টী। এতেই হয়েছে।”

ভদ্রমহিলা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন হয়তো।কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া উনাকে বলতে দিলেন না।তার আগেই তিনি উঠে গিয়ে উনার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“চাচি আপনার সাথে কথা আছে।একটু ওদিকটায় চলুন।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে ভদ্রমহিলা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন।কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“আচ্ছা চলো বাবা।”

ভদ্রমহিলা আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
দুজন কি কথা বললো জানা নেই।প্রায় দশ মিনিট পর তারা ঘরে চলে আসলেন।ঘরে আসতেই আদ্রিশ ভাইয়া আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“চলো বেরিয়ে পরি,বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে।”
এই বলে আদ্রিশ ভাইয়া দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।আমিও বসা থেকে উঠে উনার পিছুপিছু চলে এলাম।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে ভদ্রমহিলা আমার মাথায় হাত রেখে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,
“আমার বাড়িতেও মেয়ে আছে।আমি নিজেও একজন মেয়ে।তাই একজন মেয়ের মানসম্মানের মূল্য বুঝি আমি।তুমি চিন্তা করবে না মা।এসব বিষয়ে কেউ কিছু জানবে না।তুমি নিশ্চিন্তে বাসায় যেতে পারো।”

আমি ভদ্রমহিলার কথায় শুধু মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে এলাম।

.

আমি আর আদ্রিশ ভাইয়া সামনাসামনি অটোতে বসে আছি।অটোতে উঠার পরই উনি অটোওয়ালাকে বলেছিলেন, যেন ঘুরেঘুরে লম্বা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরা হয়।কারন এতোক্ষণে আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো।চেহারায় ভেসে উঠা কান্নার ছাপ মুছে নিতে পারবো।এতে করে কেউই এ বিষয়ে বুঝতে পারবে না।কারন আমি নিজেই উনাকে বলেছি, বাড়ির কেউ যাতে এসব ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আমি আদ্রিশ ভাইয়াকে নিচু গলায় বললাম,
“থ্যাংক ইউ।”

আদ্রিশ ভাইয়া চমকে গিয়ে বললেন,
“থ্যাংক ইউ কেনো?”

আমার ঠোঁটে হাসির রেখা আসতে চাইলো না।তবুও জোরপূর্বক হেসে বললাম,
“আমার মানসম্মান বাঁচাতে এতো কিছু করার জন্য।আপনি যে ওভাবে উনাদের সামনে হাত জোর করবেন তা কখনও ভাবিনি আমি।শুধু শুধু আমার জন্য উনাদের সামনে নিজের মাথা ঝুঁকালেন।”

আদ্রিশ ভাইয়া মাথা নিচু করে হালকা হেসে দিলেন।এরপর মাথা তুলে দৃষ্টি বাইরের দিকে দিয়ে বললেন,
“সে মূহুর্তে আমি হাত জোর করছি নাকি মাথা নিচু করেছি,তার কিছুই ভাবিনি আমি।শুধু ভাবছিলাম তোমার মানসম্মানের কথা।যে করেই হোক,তোমার মানসম্মান আমাকে রক্ষা করতেই হবে।সে হোক,মানুষকে কেটে ছিঁড়ে বা হোক মানুষের সামনে হাত জোর করে।”

আমি প্রতিউত্তরে আর কিছু বললাম না।নির্বাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর কি মনে করে হুট করে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম উনার উদ্দেশ্যে।
“এদিকটায় তো সব সামলে নিলেন।সবকিছু ঠিকঠাকও হয়ে গেলো।কিন্তু ঐ ছেলেগুলোর কি হবে?ওরা নিশ্চয়ই সুযোগ বুঝে সবকিছু রটিয়ে দিবে পুরো গ্রামে।”

আদ্রিশ ভাইয়ার দৃষ্টি ছিলো বাইরে।হয়তো কিছু চিন্তা করছিলেন। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি একনজর আমার দিকে চেয়ে আবারো বাইরে দৃষ্টি রাখলেন।ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
“এ বিষয়ে তোমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।এদিকটায় যখন সামলে নিয়েছি ওদিকটাও ঠিকই সামলে নিবো।”

উনার এ কথার প্রতিউত্তরে আমি আর কিছু বললাম না।

.

বাড়িতে পৌঁছেই বড় মামি,ছোট মামি,মেজ নানু, রাইসা ভাবী আর নদী আমাকে ঘিরে ধরলো।আমার চোখমুখের ফোলা ফোলা ভাব দেখে সবাই মিলে নানা প্রশ্ন করে বসলো।তাদের প্রশ্নের উত্তর বানিয়ে বানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে রুমে চলে যেতে বললেন।এতেই স্বস্তি ফিরে পেলাম আমি।

আমি দ্রুত নদীর রুমে চলে এসে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। নদী রুমে আসার আগেই বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।কারন এখন কারোর সম্মুখীন হওয়ার বা তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার।

হঠাৎ কিছু পরার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেলো।চমকে চোখ মেলে তাকাতেই রুমে থাকা ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেলো।ঝাপসা চোখে কিছু দেখতে না পেরে বালিশের কাছে রাখা চশমাটা পরে নিলাম।ঘড়ির দিকে তাকাতেই চক্ষুচড়াক গাছ আমার।ঘড়ির কাঁটা ঠিক ঠিক পাঁচে এসে আটকে আছে। এর মানে বিকেল পাঁচটা বাজে!কখন এতো সময় পেরিয়ে গেলো!টেরই পায়নি।বুঝলাম বেশ কড়া ঘুম ঘুমিয়েছি আমি।
আমি মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম।কি মনে করে চোখ বুজে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি।আড়মোড়া ভাঙতেই দৃষ্টি চলে গেলো বালিশের দিকে।সেদিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারন আমি যে পাশে মুখ দিয়ে শুয়ে ছিলাম সে পাশে অনেকাংশ বালিশই ভেজা।এই দেখে আনমনে আমার হাত চলে গেলো চোখের কোনে।
আঠালো অনুভব করলাম সে জায়গাটা।এবার বুঝলাম কি কারনে বালিশ ভেজা।ঘুমের মধ্যে যে বেশ কান্না করেছি তা আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার।কিছুক্ষণের জন্য এ কান্নার কারনও বেমালুম ভুলে বসেছিলাম আমি।কিন্তু মস্তিষ্কে একটু জোর দিতেই এ কান্নার কারনসহ পুরো ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
বুকটা ধ্বক করে উঠলো আমার।এ দুঃসহ স্মৃতি পুরোপুরি ভুলে যেতে কত সময় লাগবে জানা নেই আমার।হয়তো জীবনেও এটা ভুলতে পারবো না আমি।মাঝেমধ্যে হয়তো সুখকর কিছু স্মৃতিতে কাঁটা হয়ে দেখা দিবে এ দুঃসহ স্মৃতি।
নিজেকে খুব ভালোমতো চেনার দরুন এটা জোর দিয়ে বলতে পারি যে এ ঘটনা শুধু আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।বছরের পর বছর।কারন আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানি।সবার দৃষ্টির অগোচরে নিজের হাবভাব, অনুভূতি যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। আমার উপর দিয়ে বড় কোনো ঝড় বয়ে গেলে তা যতক্ষণ আমি নিজে থেকে প্রকাশ করতে চাইবো না ততক্ষণ এ বিষয়ে কেউ অবগত হতে পারবে না।আর আমি জানি,এ ঘটনা আমার পরিবারের কেউ জানতে পারবে না যতক্ষণ না আমি মুখ ফুটে কিছু বলবো।তবে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছ থেকে জানার সম্ভাবনা আছে।কিন্তু এ সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।অমনি নদী হুড়োহুড়ি করে রুমে ঢুকে কণ্ঠে স্বস্তি প্রকাশ করে বলল,
“যাক আপু,অবশেষে তোমার ঘুম ভাঙলো।আম্মু সেই কখন থেকে তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় ছিলো।কখন তোমার মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিবে সে আশায় ছিলো।কারন ছোট ভাইয়া বলেছে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় তোমার শরীর বেশ দূর্বল হয়ে গিয়েছে। চাচি তো তোমাকে জাগিয়েও দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু তাতেও ছোট ভাইয়ার আপত্তি।ভাইয়া বললো বললো তোমার দূর্বল শরীরের জন্য বিশ্রাম প্রয়োজন।অবশেষে তুমি এখন উঠলে।আমি আম্মুকে গিয়ে বলে আসি।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম ফেললো নদী।আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে চলে গেলো সে।
নদী চলে যেতেই তার বলা কথাগুলো চিন্তা করলাম।তার কথায় বুঝলাম আদ্রিশ ভাইয়া আমার মিথ্যা অসুস্থতার কথা বলেছে সবাইকে।এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে।আমার এ অবস্থা দেখে ঐ ঘটনার ধারের কাছেও কেউ আন্দাজ করতে পারবে না।

কিছুক্ষণের মাঝেই ছোট মামি এক প্লেট ভাত এনে আমার পাশে বসলেন।অত্যন্ত স্নেহ সহকারে প্রতিটা ভাতের লোকমা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে মামি।মামির এ স্নেহপরায়ণ আচরণ আম্মুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে।কতদিন দেখি না আম্মুকে!এক মাস হতে চললো প্রায়।ব্যাপার না….আর তিন চারদিন পরেই তো দেখা হবে!

খাওয়ার মাঝে হঠাৎ গলায় ভাত আটকে যেতে পাশের টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে নিলাম।খাওয়া শেষে গ্লাস আবারো টেবিলে রাখতে আমার দৃষ্টি চলে গেলো নদীর রুমের দরজার দিকে।আদ্রিশ ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সেখানে। দু হাত বুকে গুঁজে রেখে মাথা দরজার সাথে একটু হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।উনার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা তবে চোখের কোনে কিছু আবদারের খেলা।আমার মন বলছে উনি আমার কাছে কিছু আবদার নিয়ে এসেছেন।কিন্তু কি আবদার?

এ ব্যাপারে আর না ভেবে উনার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে আবরো মামির দিকে ফিরে তাকালাম।মামি আমার গালে ভাতের শেষ লোকমা তুলে দিয়ে চলে গেলো।দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়াও চলে গিয়েছেন।

.

রাতের খাবার খেয়ে যে যার রুমে ঘুমাতে চলে গেলো।আমি আর নদীও শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু হুট করে বিদ্যুৎ চলে গেলো।সুতরাং ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হলো সেসময়।

মৃদু চাঁদের আলোয় চারপাশ অস্পষ্ট এক রূপালি রং ধারন করেছে।এই আঁধারে সবকিছু অস্পষ্ট, ঝাপসা।বাইরে দাঁড়িয়ে কান্না করলে নিশ্চয়ই কেউ টের পাবে না!
অনেকক্ষণ ধরে একা একা কাঁদতে মন চাইছে আমার।মনের ভেতরে জমা সেই ক্ষত,সেই কষ্টকে চিরতরে মুছে ফেলতে পারবো না জানা আছে। কিন্তু চোখেরজল ফেলে একটু কম তো করতে পারবো।এতেই হবে আমার।

নদীকে বলে বাইরের উঠোনে চলে আসলাম আমি।ভাগ্যিস সে আমার সাথে আসতে চায়নি।রুমে বসে বসে ফোনে ফানি ভিডিওস দেখতে ব্যস্ত সে।
পা টিপে টিপে বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে পরলাম আমি।চারদিকে নিস্তব্ধ নিরবতা।মাটিতে পরে থাকা শুকনো পাতাগুলোয় আমার পা পরায় মরমর আওয়াজ তুলে জেগে উঠলো চারপাশ।মূহুর্তেই নিরবতা কেটে এ মরমর ধ্বনি আমার কানে মৃদু বেদনা সৃষ্টি করলো।আমি নিরবতা চাইছি।কোনো আওয়াজ শুনতে চাইছি না।

ধীর পায়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলাম আমি।এখানে চাঁদের আলো স্পষ্ট নয়।বলা যায়, আজ কোথাও চাঁদের আলো স্পষ্ট নয়।অস্পষ্ট সব।চারপাশের গাছগাছালির জন্য এ পরিবেশ গা গা ছমছম করা এক পরিবেশে পরিণত হয়েছে।আশ্চর্য আমার একটুও ভয় লাগছে না!হয়তো মনের কষ্ট এখানে বড় বলে এসব ভয় আমার উপর কোনো প্রভাব ফেলছে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ চাঁদের দিকে চেয়ে থাকতেই আমার দুচোখ ভরে জল চলে এলো।এতক্ষণ এরই অপেক্ষায় ছিলাম আমি।
নিরবে চোখেরজল বিসর্জন দিচ্ছি এ মৃত্তিকাকে।আচ্ছা?এ শুষ্ক ধরণী কি আমার চোখেরজলে একটু হলেও সিক্ত হয়েছে?নাকি গ্রীষ্মের এ খরতাপে সে এখনও শুষ্ক প্রাণহীন রয়েছে? কি অদ্ভুত সব প্রশ্ন!!

হঠাৎ আমার মনটা কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাইছে।কারোর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে চাইছে।কিন্তু বৃহৎ এ পৃথিবীতে এ মূহুর্তে আমি এমন কাউকে পেলাম না যাকে জড়িয়ে ধরে মন খুলে কাঁদতে পারবো আমি।যার কাঁধে মাথা রেখে মনের সব দুঃখকষ্ট ভাগাভাগি করে কাঁদতে পারবো আমি।এ বৃহৎ পৃথিবীতে আমি একা।চরম কষ্টের এ মূহুর্তে আমি একা।আসলে এমন কষ্টের মূহুর্তগুলো মানুষ একাই উপভোগ করে।’কেউ একজন’কে পাশে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার।আফসোস সে ভাগ্য আমার নেই।কিন্তু তাই বলে আমি কাউকে জড়িয়ে ধরবো না?কারোর কাঁধে মাথা রাখবো না? অবশ্যই রাখবো।নিজের কাঁধে নিজে মাথা রাখবো।নিজেকেই নিজে আলিঙ্গন করবো।এ বৃহৎ পৃথিবীতে আমার জন্য আমিই যথেষ্ট। আমার কারোর প্রয়োজন নেই।নিজেই নিজের দুঃখের ভাগিদার হবো,নিজেই নিজের কষ্ট কমাবো।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে কষ্টের এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের দুহাত দু বাহুতে রেখে চেপে ধরলাম।এরপর নিজের কাঁধে নিজেই মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে হৃদয় ছেয়ে গেলো।

“নিরবে না কেঁদে চিৎকার করে কাঁদো।এতে হৃদয়ে শান্তি অনুভব করবে। ”

হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠে চমকে উঠলাম আমি।উনার কণ্ঠটা চিনতে একটুও সময়ের প্রয়োজন হয়নি আমার।এ কয়দিনে উনার কণ্ঠ একদম চেনা হয়ে গিয়েছে আমার।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে উনার দৃষ্টির অগোচরে চোখেরজল মুছে নিলাম।বার কয়েক ঢোক গিলে উনার দিকে ফিরে মলিন হেসে বললাম,
“আপনি এখানে যে?”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার প্রশ্নে হালকা হেসে উঠলেন।দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি নিজের মধ্যে অনেক কিছু লুকাতে পারো ঠিক না?”

আদ্রিশ ভাইয়ার এহেন প্রশ্নে আমি খানিকটা অপ্রস্তত হয়ে পরলাম।কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বললাম,
“ঠিক ধরেছেন।আমি নিজের মধ্যে অনেক কিছু লুকাতে পারি।নিজের কষ্ট,নিজের খুশি,নিজের ভালোলাগা,নিজের খারাপ লাগা সব লুকাতে পারি আমার মধ্যে।যতক্ষণ না আমি এসব নিয়ে মুখ খুলে কাউকে কিছুু বলছি বা ইচ্ছাকৃতভাবে চেহারা এসবের ভাব না ফুটিয়ে তুলছি ততক্ষণ কেউ আমার মনের কথা জানতে পারবে না।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথা শুনে শব্দ করে হেসে বললেন,
“কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তুমি!!কারোর খুন করার পরিকল্পনা করলেও দেখি কেউ ধরতে পারবে না।”

উনার কথায় আমি ফিক করে হেসে দিলাম।গর্বিত হওয়ার ভান করে বললাম,
“এটা আমার সুপ্ত এক প্রতিভা।লুক্কায়িত একটা গুণ।বুঝতে পেরেছেন মিস্টার ডক্টর?”
এই বলেই আমি মুখে হাত দিয়ে হেসে দিলাম।

“এভাবেই হাসতে থাকো।নিজের এ মায়াবী হাসি কখনো হারাতে দিও না।তোমার এ হাসি হারিয়ে গেলে কেউ নিজের ভালো থাকার কারণও হারিয়ে ফেলতে পারে।”

®সারা মেহেক

#চলবে