ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১৭+১৮

0
892

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৭

সবসময় অবাস্তব কিছুর আশায় থাকা আমার মন বলছে আদ্রিশ ভাইয়ার হাতে হাত রাখা উচিত।কিন্তু বাস্তবতা জানা আমার মস্তিষ্ক বলছে উনার হাতে হাত না রাখতে।
খানিক সময় চিন্তা করে বাস্তবতা মেনে নেওয়া আমার মস্তিষ্কের সাথে তাল মিলাতে আমি হাত গুটিয়ে নিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।ওদিকে আদ্রিশ ভাইয়ার চাহনি কেমন তা জানতে পারলাম না।এমনটা করায় আমার মনের মধ্যে একটুখানি কষ্ট হচ্ছে। বেশি হতে দেয়নি আমি।এমনটা হওয়ার আগেই বাঁশের সাথে ঠেকিয়ে রাখা ব্যাটটা হাতে তুলে নিলাম আমি।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়াও চলে এসেছেন।উনার চেহারার হাবভাব স্বাভাবিক। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি।অবশ্য এমন স্বাভাবিক ভাবই আমি দেখতে চাইছিলাম।

আদ্রিশ ভাইয়া আমার পিছনে এসে উইকেট কিপারের পজিশনে দাঁড়িয়ে পরলেন।আগে থেকেই বল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ একদম আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পরলো।প্রথমে ভেবেছিলাম আদ্রিশ ভাইয়া হয়তো বোলিং করবে।কিন্তু উনি উইকেট কিপারের জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলেন।

সবুজ আমার দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছে।সবার অবস্থা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার অবস্থা অস্বাভাবিক, বেগতিক। ক্রিকেট খেলতে না পারা আমি ময়দানে ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলতে নেমেছি।সবুজের দিক থেকে আসা বলটা হবে আমার মানসম্মান।আর সেই মানসম্মানকে নিজ হাতে ব্যাট দিয়ে মেরে আকাশে উড়াবো আমি।ব্যাপারটা দারুণ হাস্যকর না?

চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম আমি।আমার প্রস্তুতি নিতে দেরি হলো,কিন্তু সবুজ ছুঁড়ে মারতে দেরি হলো না।
প্রথম বলটা সে বেশ জোরেসোরেই মারলো।ফলে তা ব্যাটে না লেগে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।সবুজের বল ছুঁড়ার গতি দেখে আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
“ভাইয়া বলটা একটু আস্তে ছুঁড়ো।আমি প্রফোশনাল খেলোয়াড় না।এভাবে বল ছুঁড়লে আমার নাক মুখ ফাটতে সময় লাগবে না।”

সবুজ বিস্তৃত হেসে বললো,
“আচ্ছা আপু।”

সবুজ আবারো দু হাত দিয়ে বল ঘুরিয়ে নিতে লাগলো।তার বল ছুঁড়ার আগেই আমার পিছন থেকে আদ্রিশ ভাইয়া বললো,
“নাক মুখ ফাটলেও সমস্যা নেই।দৌড়ে হসপিটালে যেতে হবেনা।বাড়িতে জলজ্যান্ত এক ডক্টর বসে আছে। যে টোয়েন্টি ফোর সেভেন কারোর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে একবারো ভাববে না।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি থ বনে গেলাম।মানে কি!উনি কি চাইছেন আমার নাক মুখ ফেটে যাক!
উনার কথায় আমার বেশ রাগ হলো।আমি রাগান্বিত কণ্ঠে ব্যাট হাতেই পিছনে ফিরে বললাম,
“আপনি কি চাইছেন আমার নাক মুখ ফেটে যাক!”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথায় শব্দ করে হেসে বললেন,
“আমি ওভাবে কিছু বলেনি।তোমার যদি এমনটা মনে হয় তো মনে করতে পারো।বাঁধা নেই।কিন্তু আপাতত ম্যাচটা খেলে জিতে নাও।তারপর সব দেখা যাবে।অলরেডি দুটো বল মিস করে ফেলেছো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
“দুটো বল কোথায়!মাত্রই তো একটা বল মিস হলো।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার কথায় এবার মুখ লুকিয়ে শব্দ করে হেসে ফেললেন।আমাকে সামনের দিকে তাকাতে ইশারা করে বললেন,
“এই মাত্রই তোমার সেকেন্ড বল মিস গিয়েছে মিশমিশ।আমার সাথে কথা বলায় এতোই ব্যস্ত ছিলে যে এটা দেখোইনি!!”
এই বলে উনি এবার হো হো করে হেসে উঠলেন।এদিকে আমার ভেতরটা অপমানে জ্বলেপুড়ে উঠলো।মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে এলো।
এ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি দ্রুত সামনে ফিরে তৃতীয় বলের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সবুজ আমার দিকে আগের মতোই তৃতীয় বল ছুঁড়ে মারলো।এবারের বলটা ব্যাটে একটুখানি লেগে সামনের দিকে গড়িয়ে সবুজের কাছেই আবারো চলে গেলো।অর্থাৎ আমার রান নেওয়া হলো না।পরপর তিন বল মিস হয়ে গেলো।অবশ্য খেলা না পারলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাভাবিক বিষয়টা এখানে উপস্থিত জনগনকে বোঝাবে কে?

সবুজ চতুর্থ বল ছুঁড়ার প্রস্তুতি নিতেই একটা ছেলে বলে উঠলো,
“আপু কি ক্রিকেট খেলতে পারেন না?পরপর তিনটা বল মিস হয়ে গেলো যে?আর মাত্র তিনটা বল বাকি আছে। খেলতে পারবেন তো?”এই বলে সে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে এলো আমার।আজ ক্রিকেট খেলতে না পারাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।এ পরিস্থিতিতে এখন চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে আমার।কিন্তু এখানে চাইলেও কান্না করা সম্ভব নয়।
নিজেকে সামলে নিয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,
” হুম।খেলতে পারবো।”
আমার এ মিনমিনে গলার আওয়াজ কেউ শুনতে পারলো বলে মনে হলো না।

সবুজ আমার দিকে চতুর্থ বল ছুঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এদিকে আমি বলের সাথে আধাত্মিক কথাবার্তা বলার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম।বলের উদ্দেশ্যে বললাম সে যেন ব্যাটের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে।অন্তত শেষ তিন বলে যেন সে আমার হাতে থাকা ব্যাটে নিজের মূল্যবান স্পর্শ দেয়।
ওদিকে সবুজ বল ছুঁড়লো আর এদিকে আমি মনে মনে বলতে লাগলাম,’প্লিজ বল,এবার অন্তত ব্যাটের সাথে লেগে যা।আমার মানসম্মান বাঁচাতে তিন চার রান করে দে।’
এটা বলায় যেন কাজ হলো।চতুর্থ বলটা একদম ব্যাটে লেগে সবুজকে ডিঙিয়ে ওপাশে চলে গেলো।তা দেখে অতিরিক্ত খুশির চোটে আমি দৌড়ে রান নিতেও ভুলে গেলাম।আমার হুঁশ এলো নদীর চিৎকারে।সে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
“আপু,জলদি জলদি রান নিয়ে ফেলো।”

নদীর কথা কানে আসতেই আমি দেরি না করে অপর পাশে দৌড় লাগালাম।আমার এক রান নেওয়া শেষ হতেই সবুজের হাতে বল চলে এলো।সুতরাং এই বলে আরেকটা রান নেওয়ার ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হলো আমাকে।

চতুর্থ বলে রান নেওয়ার খুশির স্রোতে এতোই ভেসে গেলাম যে পঞ্চম বলে রান নিতে পারলাম না।আমার এ বেআক্কল ধরনের কাজে যে পিচ্চিবাচ্চারা বেশ মজা পেলো তা তাদের মুখ লুকিয়ে হাসি দেওয়া দেখেই বুঝতে পারলাম।
এতে প্রচুর অপমানিত বোধ করলাম আমি।তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ষষ্ঠ বলের অপেক্ষা করতে লাগলাম।আমার মন তীব্রভাবে চাইছে এই ষষ্ঠ বলে ভুলবশত একটা ছয় বা চার মারতে।ভুলবশত বলছি কারন, যে আমি ক্রিকেট খেলতে পারি না সে আমি’কে দিয়ে একমাত্র ভুলবশতই ছয় চার মারা সম্ভব।

চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আমি নিজেকে প্রস্তুত করলাম। ব্যাটটা শক্ত হাতে ধরে চোখজোড়া খুলে সামনে তাকাতেই দেখলাম সবুজ আমার দিকে বল ছুঁড়ে দিলো।এ বলটা একদম প্রথম বলের মত দ্রুতগামীভাবে এগিয়ে এলো আমার দিকে।
এ ঘটনা আমাকে তীব্রভাবে বিপদের সংকেত দিচ্ছে।মস্তিষ্ক এ বিপদ টের পেয়ে দিগ্বিদিক শূণ্য হয়ে পরলো যেন।এ ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত থাকায় আমার মস্তিষ্ক তখন একটাই সংকেত দিতে পারলো। তা হলো,চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করা।
আগেপিছে কি হবে তা না ভেবেই আমি তৎক্ষনাৎ সে অবস্থাতেই চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম।এরপর ধীরেধীরে অনুভব করলাম আমার হৃদপিন্ডের গতি।প্রচণ্ড গতিতে সে লাফিয়ে চলছে।এ আওয়াজ এতো জোরে যে আমার কান অব্দি তা একদম স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

আমি চোখজোড়া এখনও বন্ধ করে আছি।ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এতোক্ষণে আমার শরীরের কোনো একটা অংশে বলের আঘাত লাগার কথা।কিন্তু আমি নিজেকে অক্ষত আবিষ্কার করলাম। তখন মনে মনে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো পথ রইলো না।

চারপাশে আসলে কি চলছে তা দেখার জন্য আমি পিটপিট করে চোখজোড়া মেলে তাকালাম।
চোখ খুলতেই আমার মুখের সামনে কারোর হাতের উপস্থিতি টের পেয়ে বেশ অবাক হলাম।এ দেখে দ্রুতগতিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।তার হাতেই বলটা রয়েছে।
পুরো ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে আমি ঠিকঠাকমতো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।কতক্ষন আগে সবুজ বল ছুঁড়ে দিলো,কতক্ষণের জন্য আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম আর কতক্ষণ আগে আদ্রিশ ভাইয়া বল ধরে ফেললেন তা আমার অজানা।তবে এটুকু জানি যে সবুজ বল ছুঁড়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম এবং সাথে সাথেই আদ্রিশ ভাইয়া বলটা ধরে ফেলেছিলো।

আমি আমতাআমতা করে বললাম,
“আপনি বল ক্যাচ করলেন কি করে?”

আদ্রিশ ভাইয়ার চোখেমুখে রাগের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো।তিনি আমার প্রশ্ন শুনে হাতে থাকা বলটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“কিভাবে ক্যাচ করেছি সেটা জানার বিষয় না।তুমি বোকার মতো ঐ অবস্থায়ই দাঁড়িয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে ছিলে কেনো?”

আদ্রিশ ভাইয়ার এমন কণ্ঠস্বর এই প্রথম শুনলাম আমি।বেশ রেগে আছেন তিনি।চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে এসেছে উনার।এতোদিনে এই প্রথম উনার এ হাবভাব দেখে আমি খানিকটা ভয় পেলাম।
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে বললাম,
“হঠাৎ ওভাবে বল আসায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম আমি।”

আদ্রিশ ভাইয়া এবার ধমকের সুরে বললেন,
“জায়গা থেকে সরে গিয়েও কাজটা করা যেতো।এখন যদি কিছু একটা হয়ে যেতো তখন?টোয়েন্টি ফোর সেভেন তোমার সেবায় আমাকে রাখতে এই প্ল্যানিং করছিলে তাইতো?”

আমি আমতাআমতা করে বললাম,
“এমন কিছু না।বিপদ এগিয়ে আসতে দেখে ওভাবে চোখ বন্ধ করা স্বাভাবিক বিষয়।”
এই বলে আমি মাথা তুলে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবারো বললাম,
“বিপদে ওভাবে চোখ বন্ধ করে রাখলে মন বলে যে বিপদ কেটে যাবে বা বিপদ কেটে গিয়েছে।আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই কাজ করতো।আর আপনি কি জানেন না বিপদে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়?আমার মাথাও তখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।এজন্যই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম।”
এই বলে আমি নিজের ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে চোখ অবনত করে রাখলাম।আশায় ছিলাম আমার কথাবার্তা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া ফিক করে হেসে ফেলবেন।কিন্তু এমনটা মোটেও হয়নি।উল্টো উনার রাগ আরো বেড়ে গেলো।তিনি আবারো ধমকের সুরে বললেন,
“আমার দিকে তাকাও।মাথা নিচু করে আছো কেনো?”

আদ্রিশ ভাইয়ার ধমকে আমি একটু কেঁপে উঠলাম।কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে উনার দিকে চোখ তুলে তাকালাম।আদ্রিশ ভাইয়া আবারো আগের সুরে বললেন,
“ক্রিকেট আদৌ খেলেছো কখনো? ”

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম।তা দেখে উনি বললেন,
“তো প্রথমে সোজাসুজি নিষেধ করে দিলেও তো পারতে।কিন্তু না…তা না করে বীর বাহাদুরের মতো মাঠে নেমে এলে খেলতে।মাথায় চলে কি তোমার হুম?”

আমি কিছু বলতে মুখ খুললাম।কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হওয়ার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া আবারো বললেন,
“নদী যদি তখনই আমাকে চিৎকার করে না বলতো যে তুমি চোখ বন্ধ করে আছো তখন কি হতো জানো?চোখ,নাক,মুখ ফেটে এ চেহারাটা বিগড়ে যেতো একদম।মাথায় কি এসব কাজ করে না?”

আমি এবার অবাক চাহনিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।নদী ঠিক কখন চিৎকার করলো তা আমি শুনতেই পায়নি।আজব!তখন আমার কানও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো!

আদ্রিশ ভাইয়া আবারো নিজের ভাঙা রেডিও চালু করলেন।
“সবুজের বল ছোঁড়ার গতি আর তোমার নিশ্চুপ ভঙ্গিমা দেখে সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলাম কি হতে চলেছে।এতোটা কেয়ারলেস কেনো তুমি?একদিকে আমার মাথা এতো দ্রুত চললো আর অন্যদিকে তোমার মাথাই চললো না।দ্যাটস গ্রেট।” এই বলে উনি দু হাত শূন্যে তুলে হাত তালি দিলেন।আর আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর আমি জিজ্ঞাস করলাম,
“আপনি এতো দ্রুত সব বুঝতে পারলেন কি করে?”

“স্কুল লাইফ থেকে ক্রিকেট খেলি।দু’বার ক্যাপ্টেন হিসেবেও সিলেক্ট হয়েছিলাম।সো এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমার জন্য তেমন বড় বিষয় না।এমনিতে এর আগেও এমন একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।সে’বার একটুর জন্য বলটা ধরতে পারিনি।কিন্তু আজ সময়মতো ধরতে পেরেছি বলেই বেঁচে গিয়েছো।এরপর থেকে মাথাটা একটু দ্রুত চালানোর ট্রাই করবে।সবসময় আমি থাকবো না। নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নিতে শিখো।”
এই বলে আদ্রিশ ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।উনার নিশ্চুপ ভঙ্গি দেখে আমি ধীরেধীরে মাথা তুলে উনার দিকে তাকালাম।স্পষ্ট দেখতে পেলাম উনার ডান পাশের কপালে রগ ফুলে গিয়েছে।চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে আছে এখনও।মোট কথা উনি এখনও রেগে আছেন।হয়তো আবারো কারোর উপর নিজের রাগ বর্ষনের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমার এ ‘হয়তো’ কে সত্য প্রমাণিত করতেই যেন আদ্রিশ ভাইয়া ধমকের সুরে সবুজকে ডাকলেন।উনার এ ধমকে যে বেচারা সবুজ বেশ ভয় পেয়েছে তা তার চালচলন দেখে বুঝতে পারলাম।
সবুজ আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে আদ্রিশ ভাইয়া শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“ও যেহেতু বলেই দিয়েছিলো বল আস্তে ছুঁড়তে,তারপরেও তুই এতো জোরে বল ছুঁড়লি কেনো?”

সবুজ মিনমিনে গলায় বললো,
“এভাবে জোরে বল ছোঁড়ার অভ্যাস আছে তো তাই।”

“কয়েক মিনিটের জন্য সে অভ্যাস ভুলে যেতে পারলি না?মাঝের চারটা বল তো ঠিক ভাবেই দিয়েছিলি।তাহলে শেষের বল এভাবে দিলি কেনো?”

“ভুল হয়ে গেছে ভাইজান।অভ্যাসবশত এমন হয়ে গেছে।আর কোনোদিনও এমন হবে না।সরি আপাজান।”
এই বলেই সবুজ আর এক মূহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো।বেচারা যে বেশ ভয় সাথে কষ্টও পেয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না আমার।

আমি আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“ওভাবে ওকে না বকলেও পারতেন।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া আবারো এক ধমক দিয়ে বললেন,
“হুম….যখন নাক মুখ ফাটিয়ে নিয়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বসে থাকতে তখন এই ডায়লগ কিভাবে বলতে তা দেখতাম।কেয়ারলেস মেয়ে কোথাকার।”
এই বলে আদ্রিশ ভাইয়া আর এক মূহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন।আর আমি সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।

.

রাতের খাবারের পর নদী এসে পড়তে বসলো।আর আমি গিয়ে তার পাশে রাখা অপর চেয়ারটায় বসলাম।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর খেয়াল করলাম নদী অন্যান্য দিনের মত পড়ছে না।বরং আনমনে কিছু একটা ভাবছে।বেশকিছুদিন ধরে চলা তার এ চিন্তা ভাবনার কারন জানতে উদ্যত হলাম আমি।আজ যে করেই হোক নদীর এমন খামখেয়ালি ভাবের কারণটা জানবোই।

আমি গলা পরিষ্কার করে বললাম,
“নদী।তোমাকে কিছু জিজ্ঞাস করবো।প্রশ্ন দিবে তো?”

আমার প্রশ্নে নদী খানিকটা ভড়কে গেলো।আমতাআমতা করে বললো,
“হুম আপু।কি প্রশ্ন করার করতে পারো।”

আমি নদীর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“তোমার কি হয়েছে বলো তো।এতো উদাস থাকো কেনো মাঝেমাঝে?আবার হঠাৎ করেই একদম চিন্তার সাগরে ডুব দাও।ব্যাপারটা কি?
এসব আমার সাথে শেয়ার করার প্রয়োজন মনে করলে করবে।না হলে করবে না।”
এই বলে তাকে দেখিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
এতে করে কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেলো।নদী হাতে থাকা কাগজের টুকরো ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো,
“আপু,আমার মনে হয় আব্বু আম্মু আমার বিয়ে দেওয়ার প্ল্যানিং করছে।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“বলো কি!!বুঝলে কি করে?”

“কয়েকদিন আগে আম্মু আমাকে একটা ছেলের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাস করলো, ছেলেটা কেমন দেখতে।আমার এতে খটকা লাগে।আম্মু তা বুঝতে পেরে বলল যে আমার খালাতো বোনের জন্য ছেলে দেখছে। তাই আগে আমার পছন্দ দেখবে তারপর ওর পছন্দ দেখবে।এমনটা করার কারন, আমার খালাতো বোন আর আমার অনেক মিল বলে।”

“তো এতে তো এটা বুঝা গেলো না যে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।যেহেতু তোমার খালাতো বোনকে বিয়ে দিবে সেহেতু ছেলের ছবি দেখিয়ে তোমার পছন্দ জানতেই পারে।এতে নিজের বিয়ে বুঝার কোনো মানে হয়না।

” হয় আপু হয়।নিজের বিয়ে,এমনটা কেনো বুঝছি তার কারন হলো,আমার খালাতো বোন আমার চেয়ে বয়সে ছোট।মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে।খালা খালুকে আমি যতটুকু চিনি তাতে কেয়া’র এখনই বিয়ে দেওয়ার কথা না।এটা গেলো প্রথম কারন।দ্বিতীয় কারন,আজ দুপুরেই আব্বু আম্মুর কথাবার্তা লুকিয়ে শুনলাম।তাতে জানতে পারলাম ছেলের খোঁজখবর বেশ পাকাপোক্তভাবে নেওয়া হয়ে গিয়েছে।এমন মনে হচ্ছিলো যেন কেয়া’র না আমারই বিয়ে।এতোকিছুর পরও তুমি কি বলবে আমার বিয়ে দিতে চাইছে না এরা?”

এবার আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পরলাম।ঠিকই তো।সব লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে নদী’রই বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
“তো তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?না করলে মামা মামি যেখানে বিয়ে দিতে চায় সেখানেই বিয়ে করে ফেলো।সমস্যা কোথায়?”

নদী আমার কথা শুনে কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে বলল,
“আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না আপু।কারন এটা না যে আমি কাউকে পছন্দ করি।কারন এটা যে আমি পড়ালেখা করতে চাই।”

“বিয়ের পর পড়ালেখা করবে। ”

“যদি তারা না করায় তবে?”

নদীর এ প্রশ্নের কি জবাব দিবো তা বুঝতে পারলাম না।তাই এ প্রসঙ্গ এখানেই বন্ধ করতে বললাম,
“আরে দেখে নিও,ঐ ছেলে তোমার জন্য দেখছে না।তোমার কাজিনের জন্য দেখছে।এতো চিন্তা করো না।শুধু শুধু ‘মনে হয়’র উপর ভিত্তি করে টেনশন বাড়ানোর কোনো মানে হয়না।এসব বিষয়ে ভুলে পড়ায় মনযোগ দাও।”

আমার এসব কথাবার্তা নদী’র উপর কতোটুকু প্রভাব ফেললো না বুঝতে পারলাম না।সে আবারো আনমনে কিছু ভাবতে শুরু করলো।তবে দৃষ্টি দিয়ে রাখলো বইয়ের পাতায়।

®সারা মেহেক

#চলবে

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৮

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আম্মুর কল এলো আমার ফোনে।বেশ কিছুক্ষণ আম্মুর সাথে কথা বলার পর আব্বুর সাথে কথা বললাম।তারপর আভার সাথে কথা বললাম।প্রতিদিনই আমার প্রিয় এই তিনজনের সাথে কথা হয়। কিন্তু প্রতিদিনই তারা এমনভাবে কথা বলে যেন শত শত বছর পর কথা হচ্ছে।
সবার সাথে কথা বলা শেষে আমি ফোন রাখতে নিলেই আম্মু বললো,আর তিন চারদিন পর আব্বু অথবা আম্মু আমাকে নিতে আসবে।
এ খবর শুনে একদিকে যেমন খুশি হলাম তেমনি অপরদিকে কষ্টও পেলাম।এ কষ্টের কারনটা খুব একটা ভালো নয়।আমার মনমস্তিষ্ক জানে এ কষ্টের কারন।কিন্তু এ কষ্টের কারনকে বেহুদা মনে হয় আমার। অকারণ মনে হয়।অপরাধ মনে হয়।

আমি খুব করে চাইছি আমার খুশির কাছে এ কষ্টকে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর রূপে প্রকাশ করতে।কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় এটা করতেও সফল হলাম। তখন সারা শরীরে বয়ে গেলো স্বস্তির এক ছোঁয়া।

আজকে নদী প্রাইভেট পড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসেছে। বড় মামি তার হাতের স্পেশাল গরু ভুনা রান্না করবে বলে নদীকে ব্লেন্ডারে কিছু মশলা পিষতে দিয়েছে।আমিও কিছু কাজ করতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু নানুর ফোন আসায় রুমে চলে আসি।কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে মনে পরলো ব্যাগ গুছানোর কথা।আজ থেকেই টুকটাক করে গোছানো শুরু করলে যাওয়ার দিন তাড়াহুড়ো করতে হবে না। এজন্যই রুমে থাকা আমার দুসেট থ্রিপিছ ব্যাগে ঢুকানোর জন্য ভাঁজ করতে লাগলাম।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো এই দেখে যে ব্যাগের প্রায় প্রতিটা কাপড়চোপড় অগোছালো হয়ে আছে।এতোটা অগোছালো কবে হলো তা বুঝতে পারলাম না।

অগোছালো কাপড়চোপড় দেখে আলনার কাছ থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে বিছানার কাছে আনলাম আমি।এরপর একে একে অগোছালো কাপড়চোপড় গুছিয়ে আবারো ব্যাগে ভরলাম।
বাড়িতে পরা এক সেট থ্রিপিছ ব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে পরলাম আরেক দুশ্চিন্তায়।এই সেটের ওড়না খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষন নদীর রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও সে ওড়না পেলাম না।তাই ভেবে রাখলাম, পরে গিয়ে রাইসা ভাবী আর দুই মামির রুমে ওড়না খুঁজবো।এখন আপাতত যা গোছানো হয়েছে তাতেই এই অলস আমি বেশ ক্লান্ত।

ব্যাগ গোছানো শেষে তা টেনে নিয়ে গিয়ে আলনার পাশে রাখলাম আমি।
এককালে গোয়েন্দাগিরির একটু শখ থাকায় অভ্যাসবশত আমার চোখ চলে গেলো ওয়ারড্রব এর পিছনের খালি জায়গায়।চোখ ছোট ছোট করে দেখতে পেলাম একটা সাদা কাগজ সেখানে পরে আছে। ব্যাগ গুছানোর আগেও এ কাগজ চোখে পরেছিলো। কিন্তু তখন গুরুত্ব দেয়নি।কিন্তু এখন এ কাগজকে আর গুরুত্ব না দিয়ে পারলাম না।
মুভি,সিরিয়াল দেখে দেখে বেশ কিছু জিনিসের উপর আমার এক অজানা কৌতুহল জন্মায়। এই অভ্যাসটা আমার অনেক আগে থেকে। মানে যখন থেকে টিভি সিরিয়াল দেখা শুরু করেছে তখন থেকে আর কি। বাসায়ও যদি এমন কোন কাগজ পাই তাহলে আমি কৌতুহলবশতঃ সেই কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি। মনে বলে সে কাগজে কিছু লেখা নেই কিন্তু তারপরও খুলে দেখার মধ্যে একধরনের গোয়েন্দাগিরি গোয়েন্দাগিরি ভাব চলে আসে। আর এই গোয়েন্দাগিরি ভাব আমি খুব উপভোগ করি।আজ সেই গোয়েন্দাগিরির মন থেকেই কাগজটা ওয়ারড্রবের পিছন থেকে হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম।

কাগজটা হাতে নিয়ে যে আমাকে এত বড় একটা ঝটকা পেতে হবে তা আমি কখনো ভাবি নি। কাগজে স্পষ্ট অর্ণব ভাইয়ের নাম সহ কয়েকটা লাইন লেখা। অর্ণব ভাইয়া লিখেছেন,” মিম আমি কি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি?শুধু বন্ধুত্বই করতে চাইছি।এতে করে তোমার সাথে কথা বলতে আমি দ্বিধাবোধ করবো না।আশা করি আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে কোনো সমস্যা নেই তোমার।”
এই লাইনগুলো পড়ে আমার মাথার মধ্যে অনেক প্রশ্ন এসে জমা হতে শুরু করলো।
এ চিঠি উনি কবে পাঠালেন?আমাকে তো এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি উনি। আমাকে তো মাত্র একটা চিঠি….. তাহলে সেদিন কি অর্ণব ভাইয়া আমাকে ফোন করেছিলে এ চিঠি না দেখার জন্য?যদি এমনটাই হয় তাহলে আমাকে ওই দুইটা চিঠি কে পাঠালো?
নাহ,অর্ণব ভাইয়াই পাঠিয়েছে হয়তো। আমিই বেশি চিন্তাভাবনা করে ফেলছি। কিন্তু এর মধ্যেও আরো প্রশ্ন থেকে যায়।অর্ণব ভাইয়া যদি ঐ দুটো চিঠি পাঠিয়েই থাকে তাহলে কোন জায়গায় উনার সম্বোধন নেই কেন?এই একটা চিঠিতে তো উনার নাম আছে কিন্তু ওই দুটো চিঠিতে উনার নাম নেই কেন? তাহলে কি ধরে নিব ওই দুটো চিঠি উনি পাঠায় নি?
চিঠি পাঠানোর পর যে কয়বার উনার সাথে কথা হয়েছে তাতে উনার কথাবার্তার ধরন শুনে মনে হচ্ছিলো দ্বিতীয়বার উনি চিঠি পাঠাননি। কিন্তু উনি চিঠি না পাঠালে চিঠি পাঠাবেই বা কে?সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।এদিকে যে উনাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাস করবো তারও উপায় নেই।কি এক মহা ঝামেলায় পরলাম আমি!
এত চিন্তা করতে করতে আমার একটু একটু করে এবার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি বিছানায় বসে পড়লাম।

মাথার মধ্যে প্রশ্নের এক বিশাল মেলা বসেছে। আমি সেই মেলার মধ্যে থেকে যেকোন একটা প্রশ্ন বাছাই করতে পারছিনা।
চিন্তাশক্তি আমার লোভ পেয়ে বসেছে। অতিরিক্ত চিন্তা করলে হয়তো এমনই হয়। কিন্তু এখন আমার মনের মধ্যে এই ভয় চেপে ধরল যে,ঐ চিঠিগুলো যদি অর্ণব ভাইয়া নাই পাঠায় তাহলে এখানকার কে আমাকে চিঠি পাঠাবে!কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছি না আমি।

আমার মন এখন দুদিকে চলছে। একদিক বলছে অর্ণব ভাইয়া চিঠি পাঠিয়েছে। অন্যদিকে বলছে অর্ণব ভাইয়া চিঠি পাঠায় নি।কিন্তু অর্ণব ভাইয়া যদি চিঠি পাঠিয়েই থাকে সেক্ষেত্রে আবারও একটা প্রশ্ন এসে যায়, তা হলো যদি উনিই চিঠি পাঠিয়ে থাকে তাহলে উনার নাম নেই কেন? এই একটা বিষয় আমার মনের মধ্যে খটকা তৈরি করছে।আমাকে এটার জন্যই মন চিন্তা করতে বাধ্য করছে অর্ণব ভাইয়া চিঠি দুটো পাঠায়নি।অন্য কেউ পাঠিয়েছে।কিন্তু এই ‘অন্য কেউ’টা কে?
মন এত প্রশ্ন তৈরি করতে পারলেও এর একটারও উত্তর সে এখন দিতে পারছে না। কি বেয়াদব মন আমার!
এসব চিন্তা করতে করতে যে বুকের মধ্যখানে এর ধুকপুকানি আওয়াজ বেড়ে চলছে তা বেশ টের পাচ্ছি আমি।আমার বেয়াদব মন কি আদৌ এসব টের পাচ্ছে?হয়তো না।তাই তো সে আমার কাছে এত এত প্রশ্নে লিস্ট খুলে নিয়ে বসেছে।

মহা চিন্তায় মাথার উপর চলমান ফ্যানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। এরপর হাতে থাকা চিঠিটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। খেয়াল করে দেখলাম, চিঠিতে বেশ ধুলো ময়লা পরে আছে। তার মানে এটা অনেকদিন আগে পাঠানো হয়েছে।

“মিম আপু….বাইরে এসো।এক জায়গায় যাবো তোমাকে নিয়ে। ”

নদীর কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই আমার চিন্তায় ছেদ ঘটলো। আমি দ্রুত চিঠিটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম।
নদী ডাইনিং এ বসে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি ব্যাপার নদী? এখানে এভাবে বসে আছো কেন? আর আমাকে ডাকছো কেন?”

নদী আমার কথা শুনে দ্রুত উঠে এসে আমার হাত ধরে বলল,
” আপু আমার বান্ধবীর বাসায় যেতে হবে। এখনই চলো। ”

আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এখনি কেন যেতে হবে? কি কাজ আছে? ”

নদী আমার প্রশ্ন শুনে একটু হেসে বলল,
“আমার কিছু নোটস ওর বাসা আছে। ও হঠাৎ করে ফোন করে বলল, কয়েকদিনের জন্য নানুবাড়ি যাবে। তাই এটা এখনই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ”

আমি নদীর কথা শুনে হালকা হেসে বললাম,
” ও আচ্ছা। চলো তাহলে।”
.

নদী আর আমি বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে ধানক্ষেতে আইলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম।বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার কিছু দূর পরেই দেখলাম, আদ্রিশ ভাইয়া আমাদের পেছনে পেছনে আসছেন। পেছন থেকে নদীকে ডাক দিয়েছিলেন বলেই বুঝতে পারলাম যে উনি আসছেন।
উনার ডাক শুনে নদী তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেল। সাথে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম।আমাদের দাঁড়িয়ে পরতে দেখে আদ্রিশ ভাইয়া এক প্রকার দৌড়ের উপরে এসে আমাদের পিছনে দাঁড়ালেন।

আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আমাদের কে পাশ কাটিয়ে আমাদের সামনে চলে এলেন।
দৌড়ে আসার ফলে তিনি হয়তো একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই হাঁপানো কণ্ঠে বললেন,
“নদী তুই এখানে কি করছিস? ”

নদী উনার প্রশ্ন শুনে উল্টো প্রশ্ন করল,
” তুমি এখানে কি করছো ছোট ভাইয়া? ”

“আমি বাজার থেকে পিছনের গেট দিয়ে মাত্রই বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিলাম।এদিকে তাকিয়ে দেখলাম তোরা এদিক দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিস।এই রোদে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”

নদী ভেংচি কেটে বললো,
“আমি আমার বান্ধবীর বাড়িতে নোটস আনতে যাচ্ছি।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
“ওহ,তাহলে চল।আমিও তোদের সাথে যাচ্ছি।”

নদী ভ্রু কুঁচকে বললো,
” তুমি কেন আমাদের সাথে যাবে? ”

আদ্রিশ ভাইয়া নদীর কথা শুনে তার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,
” তোকে এত প্রশ্ন করতে বলিনি।আমি যা বলেছি তাই করবো। তোদের সাথে যাবো মানে তোদের সাথেই যাবো।আর প্রশ্ন করলে কানের নিচে দু চার ঘা বসিয়ে দিবো একদম। ”

নদী তা শুনে কণ্ঠে রাগ প্রকাশ করে বলল,
” আচ্ছা চলো চলো। আমাদের সাথে চলো।কি হবে আমাদের সাথে গিয়ে আল্লাহ জানে।
আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দিবে তা না।হুহ।কোথায় ভেবেছিলাম আমি আর আপু একসাথে মজা করবো। কিন্তু না আমাদের মজায় ভাং মারতে এলে।”
এই বলে নদী আমার হাত ধরে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগুতে থাকলো। পিছনে পড়ে রইলেন আদ্রিশ ভাইয়া।অবশ্য আমরা কিছুদুর এগিয়ে আসার পর উনি আমাদের পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে এলেন।

নদীতে বাড়ি থেকে তার বান্ধবীর বাড়ির দূরত্ব সবদিয়ে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। আমরা তিনজন তার বান্ধবীর বাড়ি পৌঁছাতেই সে আমাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলো।নদীর নোটস তো নেওয়াই হলো সাথে আমাদের বেশ খাতিরযত্নও করা হলো।

অনেকক্ষণ যাবত আমি আর আদ্রিশ ভাইয়া ঐ বাড়ির বসার রুমে বসে আছি।নদী গিয়েছে তার বান্ধবীর রুমে।দুজনে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে।এদিকে যে আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছি তা তার খেয়ালে নেই।সে তো ব্যস্ত আড্ডা মারতে।
যখন অস্বস্তির মাত্রা বেশি বেড়ে গেলো তখন আর না পেরে নদীর বান্ধবীর রুমে চলে এলাম।আমাকে দেখে দুজনে কথা বলা থামিয়ে দিলো।
আমি কোনোদিকে তোয়াক্কা না করে নদীর কানে ফিসফিস করে আমার সমস্যার কথাগুলো বললাম।নদী কিছু একটা ভেবে তার বান্ধবীর সাথে চোখের ইশারায় কিছু কথা বলে আমার হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে এলো।
আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললো,
“ছোট ভাইয়া,মিম আপুর এখানে ভালো লাগছে না।তুমি আপুকে বাড়িতে দিয়ে আসো।”

আদ্রিশ ভাইয়া ফোন চালাচ্ছিলেন এতোক্ষণ। নদীর কথা শুনে তিনি ফোন থেকে দৃষ্টি তুলে বললেন,
“তুই যাবি না?”

“এখন না।জয়ার সাথে কিছু কথা আছে।তুমি আপুকে নিয়ে চলে যাও। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসছি। ”

আদ্রিশ ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
এই বলে উনি বসা থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে,”চলো আমার সাথে।”

উনার এ ইশারা বুঝতে পারলাম ঠিকই।তবে উনার ইশারা মোতাবেক কাজ করতে মন চাইছে না।চাইবেই বা কেনো।যে আমি উনার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাইছি, সে আমাকেই যদি উনার সাথে এভাবে পাঠানো হয় তাহলে মনের অবস্থা কি হয় তা বুঝানো সম্ভব নয়।
এখন আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে চলে যাওয়া ছাড়া আর উপায়ও পেলাম না।দুই ভাইবোন আমাকে এমনভাবে ফাঁসিয়েছে যে এর থেকে বের হওয়ার আর কোনো পথই নেই।অবশ্য একটা পথ ছিলো।তা হলো একা একাই বাড়িতে চলে যাওয়া।কিন্তু এতে রিস্ক হলো,আমি এ পথে একদম নতুন।এক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার বদলে অন্য রাস্তা দিয়ে গেলে হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত ছিলো।তাই অগত্যাই আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে বের হতে হলো।

.

আগে যে পথ দিয়ে এসেছিলাম সে পথ দিয়ে না এনে আদ্রিশ ভাইয়া আমাকে অন্য পথ দিয়ে নিয়ে এলেন।উনার মতে এ পথটা দীর্ঘ।তবে শান্তির পথ।শান্তির কেনো?কারন এ পথটুকু বেশিরভাগই বাগানের মধ্যে দিয়ে।আর বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পথে রোদ নেই বলেই তা শান্তির। এ গরমে তীব্র রোদ থেকে বাঁচতেই আদ্রিশ ভাইয়ার কথা মোতাবেক চললাম।
নদীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে প্রথমে ছোট্ট একটা বাগানের পথ ধরেছিলাম।তারপর পথ ধরেছিলাম ধানক্ষেতের আইলের মধ্যে দিয়ে।তারপর আবারও বাগান।এবং এখন আবারও ধানক্ষেত। এই দুই ধানক্ষেতের পরিসর বেশ ছোট বলে বেশি রোদে থাকতে হয়না।এতেই শান্তি আমার।

আইলটা বেশ সরু হওয়ায় আদ্রিশ ভাইয়া আমার সামনে দিয়ে হাঁটছেন।আর আমি উনার পিছু পিছু হাঁটছি।
আদ্রিশ ভাইয়া ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন।এজন্য আমার থেকে একটু এগিয়ে গিয়েছেন।আমি ধীরেধীরে উনার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে চলছি।
হঠাৎ পায়ের কাছে বরফ শীতল কিছু একটার উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে উঠলাম। দ্রুততার সাথে চোখ নামিয়ে দেখলাম, আমার পা ঘেঁষে একটা সাপ এ পাশের ধানক্ষেত থেকে ওপাশের ধানক্ষেতে চলে যাচ্ছে।
আমি শুধু সাপটার লেজের অংশ দেখতে পেলাম।তাতে মনে হলো সাপটার আকার তুলনামূলক ছোট।তবে ছোট হলে কি হবে,সাপ তো! এই ‘সাপ’ শব্দটা আমার অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম।সাপের উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।হয়তো হৃদপিণ্ডটাও খানিক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।অথবা তার চলার গতি কিছুক্ষণের জন্য স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো।

আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেই সাপটার চলে যাওয়া দেখলাম।অদ্ভুত হলেও সত্যি, এই বিপদে পরেও মস্তিষ্ক আমাকে সে জায়গা থেকে সরে যাওয়ার কোনো সংকেতই দিলো না।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর সে সংকেত দিলো, ‘এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে চলে যেতে’।আমি সে সংকেত পেয়ে যত দ্রুত পারি দৌড়ে আসলাম।ওদিকে যে ভয়ে আমি চিৎকার করবো তাও পারছি না।ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে আমার।কারন জীবনে এই প্রথম এতো কাছ থেকে সাপ দেখলাম।দেখলাম বললে ভুল হবে। সাপের উপস্থিতি টের পেলাম।যা কখনও কল্পনাও করিনি।
কিন্তু ভাগ্য ভালো,সাপের কামড় খায়নি। তবে সাপের স্পর্শ তো পেয়েছি।তাতেই আমার মস্তিষ্ক আর হৃদপিণ্ডের গতি থমকে গিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।

আমি যত দ্রুত পারলাম দৌড়ে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে দৌড়ে চলে আসতে চাইলাম
আমার মনমস্তিষ্ক কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।আমার ভয়ার্ত মন বলছে এখনই সেই সাপ আমার পিছু পিছু চলে আসবে।নাহয় আবারো আমার পা ঘেঁষে এপাশ থেকে ওপাশে যাবে।এসব ভেবেই গায়ে কাঁটা দিয়ে এলো আমার।

আমি দ্রুত ধানক্ষেত পেরিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে বাগানে চলে এলাম।উনি আমার চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাগানের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলেন।

আদ্রিশ ভাইয়ার একদম পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি ফোন রেখে আমার দিকে ফিরে তাকালেন।উনাকে দেখে এতক্ষণ পর আমি নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। টের পেলাম হৃদপিণ্ডের লাফানো।তুমুল জোরে সে লাফিয়ে চলছে।টের পেলাম আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি।স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক দ্রুত আমার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে।
অনুভব করছি আমার শরীরের কাঁপন। বুঝতে পারছি আমার গলার আওয়াজ ফিরে এসেছে যা ভয়ের জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছিলো।

আমার এ করুন অবস্থা দেখে আদ্রিশ ভাইয়া হতবাক হয়ে আমার ডান গালে হাত রাখলেন।চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,
“কি হয়েছে মিশমিশ?”

উনার এ সামান্য ছোঁয়া আর সামান্য এক প্রশ্ন আমাকে ছোট বাচ্চা বানিয়ে দিলো যেন।উনার সামনে আমার এ ভয় প্রকাশ করতে না চাইলেও তা প্রকাশ করে ফেললাম।জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
“স-সাপ। সাপ পিছনে। ”
এই বলে আমি চুপ করে রইলাম।অনুভব করলাম আমার শরীরের কাঁপন আগের আরো বেড়ে গিয়েছে।গলা ধীরেধীরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।।আর কথা বলার মত অবস্থাও নেই আমার।

আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাইয়া বিস্ময় নিয়ে আমার কাঁধ ছাপিয়ে পিছনের দিকে তাকালেন।বার কয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললেন।এরপর আমার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে আস্বস্ত প্রকাশ করে বললেন,
“এখন কোনো সাপ নেই। তুমি হয়তো ভুল দেখেছো।”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি জেদি কণ্ঠে বেশ কষ্টেসৃষ্টে বললাম,
“আ-আমি সাপ দেখেছি। আমার পায়ের কাছ থেকে চলে গিয়েছে।তাড়াতাড়ি চলুন না এখান থেকে।এক্ষুণি সাপটা যদি চলে আসে?প্লিজ প্লিজ দ্রুত চলুন এখান থেকে।”
এই বলে আমি আমার গলায় হাত বুলাতে লাগলাম।প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পেয়ে গিয়েছে।

আদ্রিশ ভাইয়া ততক্ষণে আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছেন।আমার কথাবার্তার ধরণ দেখে উনি নিঃশব্দে হেসে বললেন,
“এখানকার এসব সাপ দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।এরা বিষাক্ত সাপ না।বিষাক্ত হলে তোমার পায়ের কাছ দিয়ে এমনি এমনি চলে যেত না।বরং পায়ে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে যেত।”

আমি এবার অধৈর্য হয়ে বললাম,
“যাই হোক।চলুন না এখান থেকে।আমার একটুও ভালো লাগছে না।খুব ভয় করছে।আমি ছোট থেকে এসবে খুব ভয় পাই। ”

আদ্রিশ ভাইয়া মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা চলো। ”

“হুম।তার আগে আমার পানি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন?খুব পানির তৃষ্ণা পেয়েছে।ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে।”

আদ্রিশ ভাইয়া এই শুনে এদিকে ওদিকে তাকালেন।বাগান থেকে একটু দূরে মেইন রোডের কাছে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে বললেন,
“ঐ বাড়িতে গিয়ে দেখি টিউবওয়েল আছে কি না।সেখান থেকেই পানি খেয়ে নিও।”
এই বলে উনি হাঁটা ধরলেন।আমিও উনার পিছুপিছু হাঁটা ধরলাম।
পথে চিন্তা করলাম কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা।কি দরকার ছিলো এতো ভয় পাওয়ার!এক সাপ-ই তো!হুম,এই সাপ-ই তো মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম। তো একে দেখে ভয় পাবো না তো কি পাবো..অবশ্য সাপটা তো বিষধর সাপ ছিলো না।কিন্তু তখন কি আমার মাথা এতো কাজ করেছিলো নাকি!সাপ দেখেই সবকিছু উল্টেপাল্টে গিয়েছিলো যেন।
আচ্ছা,সব ভালো হলো।কিন্তু ভালো হলো না একটা জায়গায়।আমি কেনো ওভাবে দৌড়ে গিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।আর কেনোই বা আমার ভয়কে প্রকাশ করতে গেলাম উনার সামনে!আর কেনোই বা নিজের গালে উনার হাতের স্পর্শ পরতে দিলাম।সেসময় আমার উচিত ছিলো উনার হাতটা ছিটকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার।

আমি যে পরিস্থিতিতে এখন আছি সে পরিস্থিতিতে উনার সামান্য ছোঁয়া আমার মনকে আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনা করিয়ে দিতে সক্ষম।আমি চাইনা আমার মন উনার প্রতি বারংবার আকৃষ্ট হোক।চাইনা আমার মনে উনার জন্য কোনো অনুভূতি সৃষ্টি হোক।কারন এ একতরফা পছন্দ যে আমাকে খুব পোহাবে তা জানা আছে।আর এ একতরফা পছন্দ,ভালোবাসার সাক্ষী আমি হতে চাইনা।তখন উনার সামান্য এক হাতের ছোঁয়া আমি নিজেকে কেমন করে বহিঃপ্রকাশ করলাম তা ভাবতেই রাগে গা শিউরে উঠলো আমার।তখন হাতটা দূরে সরিয়ে দিতে হতো।

হুম,এসবই করা উচিত ছিলো।কিন্তু আমার সেসময় হয়তো বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।তাইতো উনার ছোঁয়া পেতেই আমি হড়বড় করে সব বলে দিলাম।এমনটা করা মোটেও উচিত হয়ন।নিজেকে তখন শক্ত রাখা উচিত ছিলো।তখন নিজেকে শক্ত রাখতে পারলে আদ্রিশ ভাইয়া আমার গালে ওভাবে হাত রাখতো না।

“মিশমিশ,আমি টিউবওয়েল চেপে দিচ্ছি। তুমি পানি খেয়ে নাও।এ বাড়ির মানুষের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে এসেছি।”

হঠাৎ আদ্রিশ ভাইয়ার কণ্ঠ কর্নপাত হতেই আমি তটস্থ হয়ে গেলাম।মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে চলা সব প্রশ্ন উত্তর আর যুক্তিবিদ্যার খেলা সেখানেই সমাপ্ত হলো।নিজেকে আমি এই বলে বুঝালাম যে,যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করার কোনো মানে হয়না।এসব ভুলে যাওয়াই উত্তম।

আদ্রিশ ভাইয়া টিউবওয়েল চেপে দিতেই একটু ঝুঁকে নিয়ে হাতের আঁজলা ভরে পানি খেয়ে নিলাম আমি।তৃপ্তি সহকারে পানি খাওয়া শেষে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে উনার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেলো।এতে খানিকটা বিব্রতবোধ করলাম আমি।তবে উনি একদম স্বাভাবিক রইলেন।

আমি হালকা একটু কেশে বললাম,
“আপনিও একটু পানি খেয়ে নিন।এই গরমে আপনারও পানির তৃষ্ণা পেয়েছে হয়তো।আমি টিউবওয়েল চেপে দিচ্ছি।আপনি পানি খেয়ে নিন।”

আদ্রিশ ভাইয়া আমার দিকে একনজর তাকিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে চলে আসলেন।আমিও নিজের জায়গা ছেড়ে টিউবওয়েলের চাপ দিতে সেখানে দাঁড়িয়ে পরলাম।
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে টিউবওয়েল চাপ দিচ্ছি।আর উনি পানি খাচ্ছেন।শুধু পানি খাচ্ছেন বললে ভুল হবে।পানি খাওয়ার ফাঁকে আমার দিকে একটু একটু করে তাকাচ্ছেন।কি কারনে উনি কাজটা করছেন তা জানা নেই আমার।

উনার এ কাজ আমার ভেতরে অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগিয়ে তুললো।তবুও আমি নিজেকে সামলে নিলাম।

আদ্রিশ ভাইয়ার পানি খাওয়া শেষে উনি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমি টিউবওয়েল ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম।হঠাৎ অপরিচিত এক কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম।

“ও সুন্দরী…..আমাদেরকেও একটু পানি খাইতে সাহায্য করো।শুধু নিজের আশিককে পানি খাওয়াইলেই চলবো নাকি?”

কে এসব বললো জানা নেই।যেই বলুক,তার কথাবার্তার ধরন আমাকে ছোটখাটো একটা ধাক্কা দিয়ে গেলো।
আমি তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম রাস্তার পাশের মুদিখানার দোকানের কাছে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।চেহারায় বখাটে বখাটে একটা ছাপ।এসব কথা যে তাদের মধ্যেই একজন বলেছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার।
আমি তাদের দিকে ফিরতেই তাদের মধ্যকার একজন ক্রুর হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
“সেই দূর থেকে এদের প্রেমপিরিতি দেইখা আসতেছি বন্ধু।পোলাডা কি সুন্দর কইরা সুন্দরীর গালে হাত রাখলো।আহা,আমার মন চাইতেছে আমিও একটু ওর গালে হাত রাখি। কি বলিস?”

এসব কথাবার্তা শুনে আমার ভেতরটা ঘৃনায় ভরে উঠলো।রাগে কষ্টে চোখের কোনে পানি টলমল করতে লাগলো।যেকোনো সময় টুপ করে পরে যাবে হয়তো।
এতে বাজে কথাবার্তা কখনও শুনিনি আমি।এসব আমার ভেতরটা মূহুর্তেই দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গেলো। নাহ,এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব না আমার পক্ষে।
আমি উল্টো পথে পা বাড়াতেই কে যেন আমার হাত চেপে ধরলো।এতে চমকে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলাম আদ্রিশ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের সে চেহারায় গোলাপি এক আভা দেখতে পেলাম আমি।দেখতে পেলাম উনার চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে এসেছে।আরও খেয়াল করলাম উনার শরীর অল্পবিস্তর কাঁপছে।
আদ্রিশ ভাইয়ার এমন হাবভাব দেখে আমার মন একদিকেই ইশারা করছে।তা হলো,উনি প্রচণ্ড রেগে আছেন।মাত্রাতিরিক্ত রেগে আছেন ।

®সারা মেহেক

#চলবে