ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতি পর্ব-০১

0
2275

#ভালোবাসার_রঙিন_প্রজাপতি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১.

“এটা কি ঠিক হচ্ছে!!তুমি ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিয়েছ তো?”

“তোর কি মনে হয় আমি অবুঝ? ”

“উফ…তোমার মতলব আগে থেকে জানলে কখনোই আসতে চাইতাম না এখানে।”

“কেনো,তোর না ঘুরার শখ।এবার শখ মিটা।”

আম্মুর এ কথা শুনতেই আমি ধরা গলায় বললাম,
“আম্মু,প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো।অপরিচিত জায়গায় আমি কতদিন থাকবো একা!”

আম্মু আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে থেকে আবারো ব্যাগ গুছাতে লাগলো।ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলল,
“অপরিচিত কোথায়।তিনদিন আমার সাথে এখানে থাকলি।সবাইকেই চিনে ফেলছিস তাহলে অপরিচিত হলো কিভাবে।”

“তাও….কোনোদিন আসেনি এখানে।আর তুমি আমাকে একমাসের জন্য রেখে যাচ্ছ! ”

“তোরই তো ইচ্ছা ছিল আমার মামা খালা বাসায় বেড়ানোর।তো এখন সুযোগ পেয়েছিস, কাজে লাগা।”

“কিভাবে কাজে লাগাবো।আমাকে কে নিয়ে ঘুরবে শুনি।তুমি থাকলে নাহয় একটা কথা হতো।আর আমি তো সব চিনিও না যে একা একা ঘুরবো।”

“নদী আছে না…ও তোকে ঘুরাবে।ও সব চিনে।”

আম্মুর কথা শুনে আমি ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
“আচ্ছা,আমি কোথাও ঘুরবো না।আমার শখ মিটে গিয়েছে। এবার তোমার সাথে বাসায় নিয়ে চলো।আমি তোমাদের ছাড়া একা একা থাকবো কি করে?”

আম্মু আমার কথা শুনে ব্যাগ গুছানো রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
“আর কয়দিন পর যে একা একা হোস্টেলে থাকতে হবে,তো এখন থেকেই একটু অভ্যাস কর।আর আমি এখন চাইলেও তো তোকে নিয়ে যেতে পারবো না।মেজ খালা আর ভাবী আমার কাছে কত করে বলল তোকে যেন কয়েকদিনের জন্য এখানে রেখে যাই।খুব করে বলল।আমি আর মানা করতে পারিনি।এখানে থাক কয়দিন।তারপর বড় মামা, বড় খালা বাসায় গিয়ে একদিনের জন্য থেকে পরে নানুবাড়ী চলে যাস।”

আমি কাঁদোকাঁদো চেহারা নিয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম।কিন্তু আম্মু এদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না।আমি আর কিছু না বলে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াই।দৃষ্টিজোড়া চলে যায় দূরের সেই ধানক্ষেতের দিকে।অস্পষ্ট সবুজাভ একটা রঙ।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে এই অস্পষ্ট সবুজাভ রঙটাই কেমন স্নিগ্ধতায় ছেয়ে দিচ্ছে মনটাকে।

.

আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল আম্মুর সব মামা,খালাদের বাড়ীতে বেড়ানোর।কিন্তু কখনো সে সুযোগটা হয়নি।এবার সুযোগ পেলাম।সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই আম্মুকে জোর করলাম আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে।বাসায় আভা আর আব্বুকে রেখে আম্মু আমাকে নিয়ে চলে আসলো আম্মুর মেজ খালা বাসায়।আমাদের বাসা থেকে মাত্র দুঘণ্টার পথ।২দিনের উদ্দেশ্য নিয়ে আসলেও আজ দিয়ে ৩দিন থাকা হয়ে গেলো।
মেজ নানু বাড়ী এর আগে আমি কখনও আসিনি।হয়তো ছোট থাকতে এসেছিলাম।কিন্তু আমার মনে পরছে না।এ বাড়ীতে দুজন বাদে আমি কাউকে চিনি না।কখনো দেখিনি।শুধু মেজ নানু আর ইদ্রিস মামার বড় ছেলে পলাশ ভাইয়া বাদে কাউকে চিনতাম না।তবে এখানে আসার পর সবার ব্যবহারে মোটেও এমন মনে হয়নি যে আমি কাউকে চিনিনা।সবার অমায়িক ব্যবহারে আমার বারবার মনে হয়েছে এ বাড়ীতে আমার আসা যাওয়া বহুদিনের।

আমার একটা অভ্যাস খুব খারাপ। বলা যায় একটু বেশিই খারাপ। আর তা হলো, আমি কারোর সাথে খুব সহজে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারিনা।হাই,হ্যালো,কেমন আছ এ বলার পর আমি আর কোনো কথা খুঁজে পাইনা।অগত্যা নতুন সখ্যতা গড়ার সে ইচ্ছাটাকে বিসর্জন দিতে হয়।তবে আমার সামনের মানুষটা খুব মিশুক প্রকৃতির হলে শেষমেশ একটু বেশি কথাবার্তা হয়ে যায়।এই যেমন এ বাসায় নদী আর রাইসা ভাবী খুব মিশুক প্রকৃতির।তারা একদিনেই আমাকে আপন করে নিয়েছে।তাদের বকবকানিও বেশ মজাদার সব টপিক নিয়ে।তবে রাইসা ভাবীর বকবকানির অভ্যাসটা বেশি থাকলেও প্রেগন্যান্সির জন্য এ অভ্যাসটা বেশিক্ষন চলমান রাখতে পারেনা।অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠে সে।
রাইসা ভাবী এ বাড়ীর বড় বউ।মানে নাতবৌ।অর্থাৎ পলাশ ভাইয়ার বউ তিনি।চেহারায় মিষ্টি আর মায়াবী ভাবের ছড়াছড়ি। দেখতে অতিরিক্ত মিষ্টি আর সুন্দর। অবশ্য তার এ অতিরিক্ত সৌন্দর্যতার পেছনের রহস্য হলো সে আট মাসের প্রেগন্যান্ট।অন্তত এটা আমার মনে হয়।আবার এমনও হতে পারে যে সে পহেলা থেকেই এমন।হতেই পারে…..

.

একরাশ মন খারাপের মেঘ নিজের মনের মধ্যে জমিয়ে আমি ড্রইংরুমে একা বসে টিভি দেখছি।এ বাড়ীর ছোট মামা অর্থাৎ ইলিয়াস মামার একমাত্র মেয়ে নদী যে আমার থেকে বছর তিনেকের ছোট, সে আপাতত গিয়েছে তার এক বান্ধবীর বাসায়।প্রথমে আমাকে জোর করেছিল তার সাথে যাওয়ার জন্য।কিন্তু আমি মানা করে দিয়েছি।রাইসা ভাবীও গভীর ঘুমে।দুপুর ১২টার সময় সে গিয়েছে ঘুমাতে।এদিক রাইসা ভাবী ঘুম ওদিক নদী তার বান্ধবীর বাসায়।সব মিলিয়ে আমি এখন একদমই একা।
দুই মামিও আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত।

পলাশ ভাইয়া আম্মুকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে মাত্রই বাড়ীতে ঢুকলেন।এক গ্লাস পানি নিয়ে বসলেন আমার সামনে।আমার উদাস চেহারা দেখে জিজ্ঞাস করলেন,
“ফুপি চলে গিয়েছে বলে মন খারাপ?”

আমি ততক্ষণে টিভিটা বন্ধ করে মাথায় ওড়না ভালোমত টেনে নিলাম।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালাম।
পলাশ ভাইয়া এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন,
“মন খারাপের কি আছে।আমরা সবাই আছি না।আমার যেদিন অফিসের কাজ কম থাকবে সেদিন তোমাকে আশেপাশে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবো।আর তোমার মন খারাপের কোনো কারনও দেখছি না।দুটো বকবকানি মেশিন প্রায় সবসময় তোমার সাথেই থাকে।সো মন খারাপ হওয়া উচিতও না।”

পলাশ ভাইয়ার কথা শুনে আমি হালকা হেসে দিলাম।আমার হাসির প্রতিউত্তরে উনিও হালকা হেসে নিজের রুমে চলে গেলেন।আমিও উঠে চলে আসলাম নদীর রুমে।আম্মুর সাথে এ কয়দিন নদীর রুমেই ঘুমিয়েছিলাম।
বিছানার কোনায় রাখা তোয়ালে নিয়ে আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম শাওয়ার নিতে।শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে থপ করে বিছানায় বসে পরলাম।মনে মনে হাজারো কথা শোনালাম সেই লোকটাকে।যার জন্য জমিজমার এই ব্যাপারটা এতো সিরিয়ালি নিয়েছে আম্মু।লোকটা আর সময়ও পেলো না জমি রেজিস্টার করার।আর কয়টা দিন পরে করলে আম্মু আর আমি একসাথেই বাসায় যেতে পারতাম।শুধু শুধু এখানে পরে থাকা।

জোহরের নামাজ পরার পর খাওয়াদাওয়া শেষে নদীর রুমে এসে রেস্ট নিলাম আমি।নদী এখনও বাসায় ফিরেনি।প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ বুজলাম ঘুমানোর জন্য।কিন্তু ঘুম আসেনা।এই না আসার কারনটা কি তাও জানি না।যখন ঘুমটা খুব করে চাই তখন সে চোখে এসে ধরা দেয়না।কিন্তু যখন একদমই ঘুম চাইনা তখনই রাজ্যের যত ঘুম এসে হানা দেয় আমার চোখে।

অনেকক্ষণ ছটফট করার পরও যখন ঘুম এলো না তখন বিরক্তি নিয়ে আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম।নানা চিন্তাভাবনা শেষে হাজির হলাম মেজ নানুর রুমে।এই রুমে ছোটখাট একটা লাইব্রেরি আছে। যেখানে লোভনীয় সব বইয়ের সমাহার রয়েছে। প্রথমদিন থেকেই এখানকার বইগুলো পড়ার তীব্র ইচ্ছা জাগে আমার।কিন্তু সুযোগ পায়নি কোনো বই পড়ার। আজকে একটা সুবর্ণ সুযোগ পেলাম।
রুমে এসে দেখলাম মেজ নানু বসে বসে কোরআন তিলাওয়াত করছে।আমি ধীর পায়ে হেঁটে নানুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমার উপস্থিতি টের পেয়ে একটি আয়াত পড়া শেষে নানু আমার দিকে তাকালো।তা দেখে আমি বিস্তৃত হেসে বললাম,
“নানু?আমি কি এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারি?”

মেজ নানু হাসিমুখে বললো,
“এটা আবার জিজ্ঞাস করার কি হলো।পড়তে মন চাইছে, তো পড়ো।”

“ওকে নানু।”
এই বলে আমি বুল শেলফের কাছে গিয়ে বই খুঁজতে লাগলাম।সবার উপরের লাইনের “ত্রাতিনা” বইটার উপর আমার চোখ আটকে গেলো।অতি আনন্দে বইটা বের করে নিয়ে নানুর রুমের প্লাস্টিকের টুলে বসলাম।বইয়ের উপরেই দেখলাম ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী’ লেখা।আহ…এটাই তো আমার চাই।বরাবরই আমি সায়েন্স ফিকশন ভক্ত। সাথে গোয়েন্দা, ভ্যাম্পায়ার এসব বিষয়ের উপরও বই পড়তে ভালো লাগে।তবে লাভ স্টোরি যে বোরিং তা নয়।লাভ স্টোরিও ভালো।তবে এটা পড়ার কুফল হলো শুধু প্রেম করতে মন চায়।যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।আর আমি করতেও ইচ্ছুক নই।

সময়ের কোনো খেয়াল নেই আমার।হয়তো ২ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় পার হয়ে গিয়েছে।কিন্তু তাতে আমার যায় আসে না।খুব মনযোগ সহকারে বইটি পড়ছি আমি।

হঠাৎ কেউ হ্যাচকা টানে আমার হাত থেকে বইটি নিয়ে নিলো।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থ বনে গেলাম।
রাগে ক্ষোভে সাথে সাথে আমি মাথা তুলে সামনে তাকালাম, বইটি কে নিলো তা দেখার জন্য।
মাথা তুলে যাকে দেখলাম তাকে এর আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পরছে না। এ বাড়ীতে গত তিন দিন যাবত আছি।তবে সামনে দাঁড়ীয়ে থাকা ছেলেটাকে আমি এই তিন দিনের একদিনেও দেখিনি।
ক্যাজুয়াল ড্রেসআপের সে ছেলেটি
খানিকটা রাগী দৃষ্টিতে বইটি হাতে নিয়ে দাঁড়ীয়ে আছে।তার রাগী আর বিরক্তিমাখা সে দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ।
এভাবে না বলে কাহিনির শেষ পর্যায়ে এসে আমার কাছ থেকে বই নেওয়ায় প্রচন্ড রাগ হলো।আমি রাগে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেটির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে শান্ত স্বরে বললাম,
“এটা কোন ধরনের ভদ্রতা!”

ছেলেটি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো,তবে কিছু বললো না।তার এ নিশ্চুপ ভঙ্গি দেখে আমি আবারো প্রশ্ন করতে উদ্যত হলাম।কিন্তু প্রশ্ন করতে পারলাম না।তার আগেই সেই ছেলেটি আমাকে পাশ কাটিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে আমার পিছে থাকা বুক শেল্ফের কাছে চলে গেলো।সবচেয়ে উপরের যে লাইন থেকে আমি বইটি বের করেছি ঠিকঠাক সে জায়গায় ছেলেটি বইটি রেখে দিলো।বই রেখে দিয়ে সে আবারো আগের জায়গায় ফিরে এসে আমার সামনে দাঁড়ীয়ে পরলো।
শার্টের হাতা আগের চেয়ে আরেকটু উপরে গুটিয়ে নিতে নিতে বলল,
“পারমিশন বলে একটা শব্দ আছে তা জানো?”

ছেলেটির এমন অদ্ভুত প্রশ্নে আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।রাগটা আগের তুলনায় একটু বেড়ে গেলো।এভাবে উড়ে এসে আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে যে সে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করবে!তাও আবার এতো ভাব নিয়ে,ভাবতে পারিনি আমি।
ছেলেটির এটিটিউড আমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিলো।হাতের মুঠো শক্ত করে আবারো ধীরস্থির হয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলাম,
“আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।এভাবে না বলে বইটা নিয়ে নেওয়া কোন ধরনের ভদ্রতা!নিয়েছেন তো নিয়েছেন, আবার সেটা জায়গামতো রেখেও এসেছেন!কেনো?বই কি সাজিয়ে রাখার জন্য?”

আমার প্রশ্নে যে ছেলেটা বেশ বিরক্ত হলো তা তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখেই বুঝতে পারলাম।মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা আওয়াজ বের করে সে বলল,
“আমাকে ভদ্রতার প্রশ্ন করার আগে নিজের মধ্যে কোনো ভদ্রতা আছে কি না তা যাচাই করে নেওয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি।”

ছেলেটির এমন জ্ঞানী গুনি কথাবার্তা আমার বিরক্তকে আরো এক ধাপ উপরে নিয়ে গেলো।তার সামনে করা কোনো অভদ্রতা আমার মনে এলো না।আমি আগের মতোই জিজ্ঞাস করলাম,
“অভদ্রতা আপনি করেছেন। আমি না।”

ছেলেটি এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“ওহ রিয়েলি!উইদাউট এনি পারমিশন কারোর ব্যক্তিগত জিনিস নেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?এমনটা করা অভদ্রতার মধ্যে পরে না?”

আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“আজব তো!আমি কারোর ব্যক্তিগত জিনিস নিতে যাবো কেনো?আমি তো শুধু বইটা….”

“এক্সাক্টলি……বইটা আমার ব্যক্তিগত বই।বলা যায়,লাইব্রেরীর সব কয়টা বই আমার ব্যক্তিগত।ইসলামিক বইগুলো বাদে।”

ছেলেটির এ কথায় আমি এটুকু বুঝতে পারলাম যে ছেলেটি এ পরিবারের একজন সদস্য।তাহলে কি…..

ছেলেটিকে দেখেই দরজার কাছ থেকে এগিয়ে এলো মেজ নানু।নানু যে কখন রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে তা খেয়াল করিনি আমি।ছেলেটির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমাখা মুখে নানু বলল,
“কতোদিন পর দেখলাম তোকে।চোখদুটো জুড়িয়ে গেলো আমার।”
এই বলে মেজ নানু ছেলেটির কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,”কেমন আছিস আদ্রিশ?”

মেজ নানুর সম্বোধনেই বুঝে গেলাম সামনে দাঁড়ীয়ে থাকা সে ছেলেটি ইদ্রিস মামার ছোট ছেলে, আদ্রিশ।

আদ্রিশ ভাইয়া হালকা হেসে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি দাদু।তোমার অবস্থা কি?”

মেজ নানু আদ্রিশ ভাইয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“আগে যেমন তেমন ছিলাম।তোকে দেখার পর একদম ঠিক হয়ে গিয়েছি।”

“তো বলো….সারপ্রাইজটা কেমন লাগল?”

“আমি কখনো ভাবিওনি যে তুই এভাবে হুট করে চলে আসবি।আগে বলে আসলে তোর পছন্দের সব খাবার রান্না করতে বলতাম।”

“আহা…আগে বলে আসলে কি তা আর সারপ্রাইজ হতো।”

“আচ্ছা আচ্ছা। তুই এখন গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নে।”

আদ্রিশ ভাইয়া হাসিমুখে চলে গেলো।তার সাথে সাথে মেজ নানুও বের হয়ে গেল রুম থেকে।আর আমি সেখানেই দাঁড়ীয়ে রইলাম।

বেশকিছুক্ষন পর,
ডাইনিং এ ঘুরাফিরা করছি আমি। তখনই রান্নাঘর থেকে শিরিন মামি অর্থাৎ পলাশ ভাইয়ার আম্মু আমাকে ডাকলো।তার ডাক শোনার পরপরই আমি রান্নাঘরে ছুটে গেলাম।আমাকে দেখেই মামি আমার হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“যাও তো মা,শরবতটা আদ্রিশকে দিয়ে আসো তো।আসার পরপরই আমাকে বলল এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত দিতে।”

বড় মামির কথা শুনে আমি চমকে গেলাম।এতো রেখে আমাকে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে শরবত নিয়ে পাঠাচ্ছে!ছেলেটা যে খুব একটা ভালো তা মনে হলো না আমার।তখনকার সে রাফ ব্যবহারেই বুঝে গিয়েছি আদ্রিশ ভাইয়া পলাশ ভাইয়ার মতো নরম স্বভাবের নয়।
আদ্রিশ ভাইয়ার রুমে যেতে বেশ ইতস্তত বোধ হতো লাগলো আমার।এ ভাবটা যেন মামি বুঝে গেলেন সহজেই।সে হালকা হেসে বলল,
“একটু কষ্ট করে তুমিই দিয়ে আসো মা।তোমার ছোট মামি আর আমি তো কাজে ব্যস্ত।আদ্রিশের পছন্দের সব খাবার রান্না করছি।রাইসা তো নিজের রুমে।ওকে আর কষ্ট করে ডাকলাম না।তাই তুমিই একটু দিয়ে আসো।”

মামির কথা শুনে আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,
“আরে মামি,এতে কষ্ট কিসের।আমিই দিয়ে আসছি। কোনো সমস্যা নেই।”
এই বলে আমি মামির কাছ থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে চলে এলাম আদ্রিশ ভাইয়ার রুমের সামনে।নদীর পাশের রুমটাই উনার রুম।প্রথমদিনেই নদী দেখিয়েছিল।
আদ্রিশ ভাইয়ার রুমে যেতে বেশ অস্বস্তি লাগছে।কে জানতো যে এই ছেলেটা আজ আসবে।আমি যদি আগে জানতাম তাহলে কখনোই এখানে থাকতাম না।কেঁদেকেটে হলেও আম্মুকে বলতাম তার সাথে নিয়ে যেতে।শুধুমাত্র এই ছেলেটার জন্য আমি এ বাড়ীতে একটুও শান্তিতে থাকতে পারব না।সবসময় অস্বস্তিকর এক অনুভুতি হবে।
আর না কিছু না ভেবে ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকলাম আমি।আদ্রিশ ভাইয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ফোন চালাচ্ছিলেন।আমার উপস্থিতি টের পেয়ে উনি ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন।মূহুর্তেই ভ্রু দুটো কুঁচকে চেহারায় একটু বিরক্তির ছাপ নিয়ে বললেন,
“কি চাই?”

উনার প্রশ্ন শুনে কোনো এক অজানা কারনে আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম।এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো সেই বইটা পড়ার জন্য উনার কাছে পারমিশন নিয়ে নেই।পরমূহুর্তেই মনে হলো,নাহ থাক।দরকার নেই।পরে সময় করে বইটা কিছুক্ষণের জন্য উনার কাছ থেকে চেয়ে নিব।

আমার নিশ্চুপ ভঙ্গি দেখে আদ্রিশ ভাইয়া এবার একটু গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
“এই চাশমিশ,কি চাই?”

আমি শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দেখিয়ে বললাম,
“আপনার জন্য শরবত পাঠিয়েছে আদ্রিশ ভাইয়া।”

আমার কথা শোনামাত্রই আদ্রিশ ভাইয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে এলেন।আমি তখনও দরজার কাছে দাঁড়ীয়ে আছি।উনি যতই এগুচ্ছেন আমার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজটা কোনো এক কারনে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।আমি মাথা নিচু করে শুকনো একটা ঢোক গিলে আদ্রিশ ভাইয়ার দিকে তাকাই।
আদ্রিশ ভাইয়া চোখজোড়া ছোট ছোট করে আর ভ্রুজোড়া হালকা উঁচিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
“এই মেয়ে,তুমি কে?আর আমাকে ‘ভাইয়া ভাইয়া’ বলে ডাকছ কেনো?”

উনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি হালকা একটু হেসে প্রস্তুত হলাম।কিন্তু আমার মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আদ্রিশ ভাইয়া বললেন,
“এই,তুমি কি বাসার নতুন কাজের লোক?আম্মু কি তোমাকে কাজের লোক হিসেবে এনেছে?”

আদ্রিশ ভাইয়ার কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পরলাম।কি বললেন উনি!আমাকে কাজের লোক বানিয়ে দিলেন!কতো বড় অপমান!আর কিছু আন্দাজ করতে পারতেন না উনি।সোজা কাজের লোক!
প্রচন্ড অপমানিত বোধ করলাম আমি।রাগে দুঃখে মন চাইল হাতে থাকা গ্লাসের সবটুকু শরবত সামনের মানুষটার মুখে ছুঁড়ে মারি।এতে যদি অপমানের শোধ নেওয়া হয়।কিন্তু কিছু কিছু ইচ্ছা অপূর্ণই রাখাই ভালো।সে হিসেবে আমার এ ইচ্ছাটাকেও মাটি চাপা দিয়ে দিলাম আমি।তবে ভেতরের রাগটাকে কিছুতেই কমাতে পারছি না।শেষমেশ দাঁতে দাঁত চেপে হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলে জোরে করে রেখেই রুম থেকে চলে আসলাম।বড় বড় পা ফেলে নদীর রুমের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম।বারবার শুধু ঐ লোকটার দুটো বাক্য মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।এমন অপমানিত আমি খুব কম হয়েছি বলেই আমার মনে পরছে।
রাগের বশে দাঁতে দাঁত চেপে ঐ বেয়াদব লোকটার মাথার সবকটি চুল ছিঁড়তে লাগলাম।বাস্তবে নয়,কল্পনায়।

®সারা মেহেক
চলবে??