ভালোবাসি তারে পর্ব-০২

0
8034

ভালোবাসি তারে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

২.
রাতের দিকে নিজ রুমে পড়ছিল ঝুম। বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোটার শব্দ তীব্র আওয়াজ সৃষ্টি করছে। ঠিক যেন কোনো গানের সুরের মতো। শুনতে ভালো লাগলেও পড়ছে বিধায় এখন বিরক্ত লাগছে ঝুমের। চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো ঝুম।

তিন রুমের একটা ছোট্ট বাসায় থাকে ঝুম এবং তার পরিবার। নিজস্ব বাসা তাদের। মোটামোটি পাঁকা হলেও বাসার ছাদটা টিনের তৈরি। ঝুমের বাবা আলম খান একজন প্রাইমারি শিক্ষক। মা গৃহিণী। ছোট একটা ভাইও আছে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার স্বল্প বেতনে ঝুমের পড়ালেখার খচর তেমন হয়ে উঠে না। সেই জন্যেই টুকটাক টিউশনি করতে হয় ঝুমের। আজ বাদে কাল মাস শুরু। কলেজও খুলে যাবে তার। অথচ কিছু বই এখনো কেনা বাকি। চিন্তার ভাঁজ পরলো ঝুমের মুখে। ধীরে ধীরে চোখ খুললো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পড়তে হবে তার। জীবনে বড় কিছু হতে হবে। বাবা-মায়ের মাথা আরো উঁচু করতে হবে। এমন অভাবি জীবন আর ভালো লাগে না তার।

______________

পরেরদিন সকাল সকাল ঝুম বেরোয় বাজারের উদ্দেশ্যে। বাসা থেকেই পরিকল্পনা করে বেড়িয়েছে সে। কিছু মরিচ, পেয়াজ আর ফার্মের মুরগি কিনবে। যেই ভাবা সেই কাজ! বাজারে গিয়ে যা যা লাগবে, সব কিনে নেয় ঝুম। ফেরার পথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় নিঝুমের সাথে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে নিঝুম। দৃষ্টি নদীর ঠিক মাঝখানটায়। কি মনে করে, ঝুম এগিয়ে যায় নিঝুমের দিকে। পেছন থেকে মুখ কুঁচকে বলে,
— “ছিঃ! আপনি সিগ্রেট খান?”

নিঝুম সিগারেটে আরেকটা টান দিচ্ছিল। এহেন কথায় থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে দেখে, ঝুম মুখ বিকৃতি করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন নিঝুম মারাত্তক কিছু করে ফেলেছে। কিন্তু এ মেয়ে এখানে কিভাবে? ভাবতেই নিঝুমের ভ্রু কুঁচকে যায়। ঝুম নাক কুঁচকে বলে,
— “এসব ছাইপাঁশ খেয়ে কি মজা পান আপনারা? ছিঃ কি বিশ্রী গন্ধ!”

নিঝুম চোখ বড় বড় করে তাকায় এবার। তারই সামনে তারই প্রাণ প্রিয় সিগারেটকে অপমান? এত স্পর্ধা? রাগে দাঁত কটমট করে উঠল নিঝুম। বলল,
— “এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন তাহলে? যাও এখান থেকে।”

ঝুম মুখ ফুলিয়ে তাকায়। সুরেলা কণ্ঠে বলে,
— “আপনার প্রাণ বাঁচাতে এসেছিলাম শুধু। নাহলে কি আসতাম?”

নিঝুম অবাক হয়। বলে,
— “মানে? আমার আবার কি হলো?”

ঝুম মুচকি হাসে। নিঝুমের দিকে এক কদম এগিয়ে দাঁড়ায়। নিষ্পাপ স্বরে বলে,
— “সিগ্রেট খেলে মারা যায় মানুষ। ডাক্তার হয়ে এটাও জানেন না? সিগ্রেটের পেকেটেও তো লেখা থাকে।”

নিঝুম অবাক চাহনী নিয়ে তাকিয়েই রয় শুধু। বোকা কয় প্রকার, কি কি তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে এ মেয়ে তাকে। নিঝুমের রাগ হতে লাগলো হঠাৎ। অযথা কথা বলার কোনো মানে আছে কি? শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট! রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে নিঝুম। তবুও রাগী কণ্ঠ বেরিয়ে আসে কণ্ঠনালি থেকে,
— “বাঁচানো লাগবে না আমাকে। আমি বলিও নি। নাও গেট লস্ট।”

অপমান বোধ কাজ করে ঝুমের মাঝে। রাগ হয়। মুখে বাঁকিয়ে নিঝুমকে একবার ভেঙ্গায় ঝুম। তারপর সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে চলে যায় সেখান থেকে। বিস্ময় এখনো কাটাতে পারেনি নিঝুম। যখন কাটাতে পারে, তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় ঝুমের যাওয়ার পথে।

_________________

বিকেলে জমিদার বাড়ি গিয়েই ঝুম ভেবে নেয় নিধাকে তাড়াতাড়ি পড়িয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু বাঁধ সারলো নিধার মা। ঝুম ছোট বেলা থেকেই এ গ্রামের সবার পরিচিত। গ্রামের মানুষের কাছে মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে নামে এক ডাক তার। সেই দিক দিয়ে, জমিদার বাড়ির সবার সাথেও ঝুমের বেশ ভাব আছে। যা তীব্র হয় নিধাকে পড়ানোর সুবিধার্থে। জমিদার বাড়ির সবাই অনেক আদর করে ঝুমকে। সবচেয়ে বেশি করেন নিধার মা। ফলে তিনি কিছু বললে ঝুম ফেলতে পারে না।

নিধার রুমে যখন ঝুম পড়াতে আসলো, সঙ্গে আসলেন নিধার মা-ও। ঝুমের পাশে বসে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,
— “ঝুম মা? আজকে বরং তুই নিধাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিস। আসলে, নিঝুম আসায় বাড়িতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান হবে তো।”

ঝুম হালকা হেসে বলে,
— “ঠিকাছে আন্টি। আমি তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেবো।”
— “হ্যাঁ, তবে তোকেও কিন্তু অনুষ্ঠানে থাকতে হবে। চিন্তা করিস না। সন্ধ্যার আগে আগেই নিঝুম তোকে তোর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

ঝুম অপ্রস্তুত হয়ে পরল। কি বলবে সে? কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাকচ করতে চাইলে নিধার মায়ের অনুরোধে রাজী হয়ে যায়। ঝুম অনুষ্ঠানে থাকবে শুনে নিধা লাফিয়ে উঠলো আনন্দে। নিধার মা চলে যেতেই অংক করতে করতে নিধা নিজ থেকেই বলে উঠল,
— “জানেন ম্যাম, এটা কিসের অনুষ্ঠান?”

ঝুম কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
— “আন্টি তো বললেন তোমার ভাই এসেছে বলে অনুষ্ঠান করছেন।”

নিধা হেসে বলল,
— “হ্যাঁ, কিন্তু আরেকটা কারণও আছে। ভাইয়া এখানে হস্পিটাল বানাতে চায়। তাই বাবা কিছু মাননীয় ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিং করবেন।”

ঝুম সল্প ভাষায় জবাব দিলো,
— “ওহ্!”

কোনোমতে নিধাকে পড়িয়ে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয় ঝুম। এবং সাথে সাথেই নিধা চলে যায় তার মায়ের কাছে রেডি হতে। ঝুম আস্তে ধীরে বের হয় রুম থেকে। নিধার স্টাডি রুম একদম কোণায় অবস্থিত। এবং পাশেই নিঝুমের রুম। এটা অবশ্যক জানতো না ঝুম। সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ দরজার ফাঁক গলিয়ে নিঝুমকে দেখতে পায় সে। বুক সেল্ফের সামনে দাঁড়িয়ে বই হাতে পড়ছে নিঝুম। ঝুম দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে নিলে নিঝুমের ভারি কণ্ঠ শোনা যায়,
— “কারো রুমে পার্মিশন ছাড়া উঁকিঝুঁকি করা ব্যাড মেনার্স। শিক্ষক হয়ে এটাও জানো না?”

ঝুম চোখ বড় করে তাকালো। তার কথা তাকেই ফেরত দিচ্ছে নিঝুম? কত বড় কপিবাজ! ডাক্তাররা বুঝি এমনো হয়? ঝুম চটে গিয়ে বলে,
— “আপনার থেকে তো ভালোই আছি। অনতত ওই ছাইপাঁশ খাই না।”

নিঝুম রেগে বলল,
— “খবরদার! ওগুলোকে ছাইপাঁশ বলবে না একদম।”
ঝুম ভেঙ্গিয়ে বলল,
— “তো কি বলবো? অমৃত?”

নিঝুম যেন আরো রেগে যায়। ঝুমের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় সে। ঝুম চমকে উঠে। পরপরই রাগে শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে তার। প্রতীজ্ঞা করে, এর জন্য নিঝুমকে একটা শাস্তি দিবেই দিবে সে।

পরবর্তীতে অনুষ্ঠানেও নিঝুমের দিকে অত তাকায় নি ঝুম। কথা বলা তো দূরের কথা। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন বাসায় না ফিরলে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে। তাছাড়া গ্রামের মানুষও খারাপ নজরে দেখবে। তাই নিধার মাকে বলে চলে যেতে চাইছিল ঝুম। কিন্তু নিধার মা আদেশের স্বরে বলে উঠলেন,
— “একা একা কিভাবে যাবি তুই? এখানেই দাঁড়া! আমি নিঝুমকে ডেকে আনছি। ও দিয়ে আসবে।”

ঝুম ভেবেছিলো অনুষ্ঠানের মাঝে ফাঁকফোঁকর দিয়ে বাসায় চলে যাবে। এখন তো দেখছে পরিস্থিতি অন্যরকম। কিভাবে ওই ঝগড়ুটের সঙ্গে যাবে ঝুম? এসব চিন্তা করাটাও তো ঝুমের জন্য দুঃস্বপ্ন সম।

_____________

চলবে…