ভালোবাসি তারে পর্ব-০৬

0
5709

ভালোবাসি তারে

৬.
ক্যামেরার দিকে প্রায় অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলো নিঝুম। বুকের বাঁ পাশে শিরশির অনুভূতি হচ্ছে তার। হৃদপিন্ড কাঁপছে। নিঝুম প্রশ্রয় দিলো না সেটা। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে, আকাশের পানে মুখ করে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ। এমন সময় ঝুম ডেকে উঠল,
— “ডাক্তার? যাবেন না? দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

নিঝুম এ প্রথম খেয়াল করল ঝুম তাকে ডাক্তার বলে সম্বোধন করে। ডাকটা শুনতে ভালো লাগে। নিঝুমের জবাব না পেয়ে ঝুম আবারো বলল,
— “আরো থাকবেন? যাবেন না?”
নিঝুম চোখ মেলে তাকালো। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “চলো।”

ঝুম নিধাকে নিয়ে ঝর্ণার কাছ থেকে সরে এলো। আগের বারের মতোই উঁচু, নিচু, অসমান ভূমি পাড় করতে নিঝুম প্রথমে নিধাকে কোলে নিলো, তারপর ঝুমের হাত ধরে ঝুমকে উপরে উঠালো। পুরো সময়টা কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হলো ঝুমের। নিঝুমের স্পর্শ ঝুমকে কাঁপিয়ে তোলে। ঝুম ঢোক গিললো। আনমনেই হাঁটছিল, হঠাৎ মাটির গর্তে পা ঢুকে যায় তার। পায়ের গোড়ালি বেঁকে যায়। তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠে ঝুম। ঝুমের একটু আগেই হাঁটছিল নিঝুম এবং নিধা। ঝুমের চিৎকার শুনে নিঝুম হকচকিয়ে যায়। পেছনে ফিরে ঝুমকে পা ধরে মাটিতে বসে থাকতে দেখে নিঝুমের বুক দুরদুর করে উঠে। ভয় হয়। নিঝুম দ্রুত পায়ে ঝুমের কাছে যায়। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসে ঝুমের সামনে। তীব্র ব্যথায় ঝুম নাক,মুখ কুঁচকে রেখেছে। গর্তের ভেতরে তখনো ঝুমের পা আটকে! নিঝুম আলতো ভাবে গর্ত থেকে পা বের করতে নিলেই ঝুম গগন বিহারী চিৎকার দিয়ে উঠে,
— “এই না, না, না! পা ছাড়ুন আমার। ব্যথা পাচ্ছি তো।”

বলতে বলতেই ঝুমের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে। নিঝুম তার পা ধরায় ঝুমের ব্যথা আরো বেড়ে গেছে। নিঝুমের মায়া হয়। তারচেয়েও বেশি বিরক্ত অনুভব হয়। বিরক্তি নিয়ে সে বলে,
— “দেখে শুনে চললে তো এমন হতো না ঝুম। পা মচকে গেছে তোমার। ব্যথা সহ্য করো একটু। ঠিক হয়ে যাবে এক্ষুণি।”

কোনোমতে ঝুমের পা-টা বের করতে পেরেছে নিঝুম। কিন্তু পা আবারো ধরতে নিলে আগের চেয়েও বেশি জোড়ে চেঁচিয়ে উঠে ঝুম,
— “প্লীজ ডাক্তার, ধরবেন না। সত্যি ব্যথা পাচ্ছি।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “আমি কি বলেছি তুমি ব্যথা পাচ্ছো না?”
— “আমি সেটা তো বলিনি। বলছি শুধু আমার পা না ধরতে। ব্যথা করে অনেক।”

নিঝুমের বিরক্তি আরো বেড়ে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
— “ঝুম! চুপ থাকো। পা ধরতে দাও আমাকে। নাহলে আরো ব্যথা করবে।”
ঝুম ত্যাড়ামো করে বলল,
— “করুক! তবুও পা ধরবেন না।”

নিঝুম ধমক দিয়ে উঠল এবার। ঝুম মুখ ফুলালো। কাঁদো গলায় বলল,
— “আপনি আমাকে বকতে পারলেন ডাক্তার?”
— “অবশ্যই পারলাম। পায়ের কি অবস্থা দেখেছো? মচকে গেছে। আবার ছিঁলেও গেছে। একদম চুপ করে বসে থাকো। কথা, নড়া বন্ধ!”

শেষের কথাটা আদেশের সুরে বলে নিঝুম। ঝুমের পা ধরতে নিলেই ঝুম চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলে। কিছুক্ষণ পর একটা সূক্ষ্ণ ব্যথার আভাস পেয়ে আবারো চিৎকার করে উঠে ঝুম। চোখ খুলে দেখে নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নিঝুম বলে,
— “দেখোতো পা নাড়াতে পারছো নাকি।”

ঝুম অসহায় ভাবে বলল,
— “না! পায়ে ব্যথা লাগে।”
— “এবার লাগবে না।”

নিঝুমের উপর বিশ্বাস রেখে ডান পা নাড়ানোর চেষ্টা করে ঝুম। অদ্ভুদ ভাবে, পুরোপুরি ভাবে না গেলেও তেমন ব্যথাও করছে না ঝুমের পা। সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাসি ফুটে উঠল ঝুমের। উজ্জ্বল চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “ধন্যবাদ ডাক্তার।”
— “মাই প্লেজার। এবার উঠো! আর কতক্ষণ মাটিতে বসে থাকবে?”

বলেই উঠে দাঁড়ালো নিঝুম। তারপর ঝুমের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল নিঝুমের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে। ঝুমও হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালো। পরপরই হাত ছেড়ে দিলো নিঝুম। ঝুমের একটু মন খারাপ হলো। নিজের মনকে নানা ভাবে সান্তনা দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতে নিলেই পায়ের ব্যথায় পড়ে যেতে নেয় ঝুম। নিঝুম সাথে সাথে ঝুমের হাত ধরে ফেলে। প্রশ্ন করে,
— “কি হয়েছে? পড়ে যাচ্ছো কেন?”

ঝুম ধীর গলায় বলে,
— “পা জ্বলছে। ব্যথা করছে।”
— “হাঁটতে পারবে না?”
ঝুম মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। নিঝুম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ঝুমের দিকে। তারপর হঠাৎ-ই কোলে তুলে নেয় ঝুমকে। ঝুম হকচকিয়ে যায়। পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠে,
— “কি করছেন এটা? আমাকে নামান।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “হাঁটতে পারবে তুমি? যেহেতু না, সেহেতু চুপ থাকো।”
— “কিন্তু ডাক্তার, কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
— “কে দেখবে? আমি শুধু তোমাকে পাহাড়টা পাড় করে দেবো। কেউ দেখবে না।”

ঝুম আর কিছু বলতে পারে না। লজ্জায় মরি,মরি অবস্থা তার। আড়চোখে নিধার দিকে তাকালো ঝুম। নিধা মুখে হাত চেপে মিটিমিটি হাসছে। ঝুম চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে নিধা। ঝুম নিঝুমের দিকে তাকালো এবার। নিঝুম সামনে তাকিয়ে হাঁটছে। ঝুমকে কোলে নিয়ে! ভাবতেই লজ্জা-টা আরো শীর্ষে চলে গেল যেন।

_______________

পুরো পাহাড়টা অতিক্রম করার সময় ঝুম নিঝুমের কোলে ছিল। পাহাড়ে ঝর্ণার কাছের জায়গাটুকুই অসমান। বাকি অধিকাংশ জায়গা সমান। সুতরাং, পাহাড়টা অতিক্রম করতে অত বেশি পরিশ্রম করতে হয় নি নিঝুমের। তবে বিরক্ত হয়েছে নিঝুম। নিজের এত কাছে কোনো মেয়ে আসুক তা কোনো কালেই পছন্দ ছিল না নিঝুমের। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঝুমকে কোলে নিয়েছে সে। এবং পাহাড়ের শেষ মাথায় পৌঁছাতেই নামিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু একটা রিকশা পাওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু, এই রাস্তায় কি আদৌ কোনো রিকশা পাবে নিঝুম? উহু, না! বরং একটা ভ্যানগাড়ি পেয়েছে সে। সেটাতে করেই ঝুমকে তার বাড়িতে পাঠাবে বলে পরিকল্পনা করেছে নিঝুম। তারপর নাহয় সে আর নিধা হেঁটে হেঁটে জমিদার বাড়ি যাবে। ভাবনা মতে, ভ্যানগাড়িটি ভাড়া করে ঝুমকে ভ্যানগাড়ির উপরে বসিয়ে দেয় নিঝুম। তারপর নিজে নিধাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে চলে যায় জমিদার বাড়ি। অথচ, ঝুম যে নিঝুমের কল্পনা করে করে চিন্তিত হয়ে পরছে! সে খেয়াল কি আদৌ হবে না নিঝুমের? কখনো কি হবে না?

বাসায় গিয়ে মায়ের ঝারি খেতে খেতে পেট ভরে যাচ্ছে ঝুমের। সে যখন বাসায় পৌঁছেছে, তখন দুপুর হয়ে গেছে। তারওপর পায়ের অবস্থা নাজেহাল। পায়ের ছিঁলে যাওয়া অংশ থেকে একটু একটু রক্ত পরছে। ঝুমের বাবাকে ঝুমকে ধরে ধরে বাসার ভেতর ঢুকাতে হয়েছে। মূলত এসব কারণেই ঝুমের মায়ের এত শত রাগ। কেন ঝুম ওখানে গেল? কেন সে দেখে শুনে হাঁটতে পারলো না? কেন সে এত দেড়ি করে আসলো? এসব ছোটখাটো বকাগুলোকে পরোয়া না করে ঝুম তার মতো ফ্রেস হয়ে, খেয়ে-দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। তখন বিকাল প্রায়। ঘুমু ঘুমু ভাবটা চোখে চড়ে বসেছে তখনই ফোনটা বেজে উঠল তার। রাগ হলেও সেটা দমিয়ে ফোনটা হাতে নিলো ঝুম। আননোন নম্বর। কল রিসিভ করে ঝুম বিরক্তির সুরে বলল,
— “আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে নিধার মিষ্টি সুর ভেসে উঠল,
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম, ম্যাম। আমি নিধা বলছিলাম।”
— “ও নিধা! হঠাৎ ফোন দিলে যে? এটা কার নাম্বার?”

অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ঝুম। নিধা বলল,
— “ভাইয়ুর। আম্মুর ফোনে ব্যালেন্স ছিল না তো! আচ্ছা, আপনার পায়ের ব্যথা কমেছে ম্যাম? মা জিজ্ঞেস করছিল।”
— “আগের থেকে একটু ভালো।”
একটু থেমে ঝুম আবারো বলল,
— “তুমি কি আন্টিকে বলে দিয়েছো আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি?”
— “আমি বলি নি। ভাইয়ু বলেছে।”

ঝুম বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। যেহেতু নিঝুম মিসেস সানজিদাকে ব্যথা পাওয়ার কথা বলেছে, নিশ্চয়ই কোলে নেওয়ার বিষয়টা চাপিয়ে গেছে। এই ভেবে ঝুমের চিন্তা ভাবটা একটু কমে গেল। নিধা আবারো বলল,
— “ম্যাম? আম্মু আর ভাইয়ু আপনাকে বলেছে কয়েকদিন পড়াতে না আসতে। রেস্ট নিতে বলেছে।”

ঝুম মনে মনে বলল, ‘তেনারা না বললেও আমি কি আসতাম নাকি? তবে কয়েকদিন গ্যাপ নিতে তো পারবো না। নিঝুমকে দেখবো কিভাবে তখন?’
ঝুম প্রতীজ্ঞা করে, সে আজকে না গেলেও কালকে ঠিকই যাবে। তাই বলল,
— “আমি ঠিক আছি নিধা। কালকে আসতে পারবো। আন্টিকে বলে দিও।”

নিধা ‘আচ্ছা’ বলে ফোনটা কেটে দিলো। ঝুম ডান পা-টা একটু নাড়াতে নিলেই পায়ে ব্যথা পেলো। ছিঁলে যাওয়ার দরুণ মনে হচ্ছে, কেউ যেন আঘাতের স্থানে হাতুড়ি পেটা করছে। তবুও কয়েকবার পা নাড়ানোর চেষ্টা করে ঝুম। শেষে মনে হলো পায়ের ব্যথা একটু কম লাগছে। ভেবে শান্তি পেল ঝুম। কালকে যে করেই হোক জমিদার বাড়ি যাবে সে। নাহলে যে ওই হালকা সবুজ চোখ জোড়ার দেখা মিলবে না!

______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
(অনুগ্রহ করে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। ধন্যবাদ।)