ভালোবাসি তারে পর্ব-০৫

0
6821

ভালোবাসি তারে

৫.
সন্ধ্যা হওয়ার আরো এক ঘন্টা বাকি। সকালের তীব্র বৃষ্টিটা এখন আবার আকাশ ধেয়ে নেমে এসেছে। চারিদিক কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। জানালা গলিয়ে সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝুম। চিন্তার ছাপ তার মুখে স্পষ্ট। এ ঝুম বৃষ্টিতে সে বাড়ি ফিরবে কিভাবে? ভাবনার মাঝেই নিধার উঁচু কণ্ঠ,
— “ম্যাম? কবিতাটা মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। বলব?”

জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিধার দিকে তাকালো ঝুম। মুচকি হেসে বলল,
— “বলো।”
নিধা বলে উঠল এবার,
— “ভোর হলো দোর খুলো,
খুকি মণি উঠো রে..”

নিধা একাধারে সম্পূর্ণ কবিতাটি বলে ফেলল। বলা শেষে তাকে ছুটি দিয়ে দিলো ঝুম। তারপর নিজের ব্যাগ গুঁছিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে নিঝুমের রুমে একবার উঁকি দেয় ঝুম। বিকালের মতোই বিছানায় আধ-শোয়া অবস্থায় বসে আছে নিঝুম। তবে এবার সে বই পড়ছে। হঠাৎ দরজার দিকে তাকালো নিঝুম। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল দু’জনে। তৎক্ষণাত ঝুম চোখ নামিয়ে ফেলল। নিঝুম হেসে বলল,
— “নিধাকে পড়ানো শেষ? চলে যাচ্ছো?”
— “জ্বী।”

নিঝুম আবারো হাসল। বলল,
— “সোফায় একটা বই আছে। দিতে পারবে ঝুম?”
ঝুম কিছু বলে না। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পরপরই রুমের ভেতরে ঢুকে পরে বিনা দ্বিধায়। সোফা থেকে বই নিয়ে নিঝুমের দিকে এগিয়ে দেয়। নিঝুম বই হাতে নেয়। প্রশ্ন করে,
— “ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। বাসায় যাবে কিভাবে?”

ঝুম মন খারাপ করে বলে,
— “কি জানি! কোনো এক ভাবে তো যেতে হবে। এখানে তো আর থাকতে পারবো না।”
— “ভাবনাটা মন্দ না। থাকতে পারো।”

বই উল্টাতে উল্টাতে বলল নিঝুম। ঝুম হকচকিয়ে যায়। বলে,
— “আমি কিভাবে.. এখানে…!”
নিঝুম হাসে। ঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কালকে কি ঘুরতে নিয়ে যাবে আমাকে? ফ্রি থাকবে?”

ঝুম ইতস্ততভাবে বলে,
— “হুম। কয়টায় বেড়বেন?”
— “দশটায়, নদীর পারে দেখা করব।”
— “আচ্ছা।”

ঝুম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে নিঝুম আবার বলে উঠে,
— “ড্রাইভারকে বলে দিও। সে দিয়ে আসবে।”
— “ঠিকাছে।”

বলেই বিভ্রমভাবে আবারো বলল ঝুম,
— “আপনার সর্দি কি ঠিক হয়ে গেছে?”
নিঝুম কিছু একটা ভাবার মতো করে বলে,
— “মনে হয়। অনেক্ষণ ধরে হাঁচি দিচ্ছি না তো।”
— “এত তাড়াতাড়ি?”
নিঝুম আরেক দফা হাসলো। কেন হাসল নিজেও জানে না। নির্লিপ্তভাব নিয়ে বলল,
— “আমার সর্দি-কাশি বেশিক্ষণ থাকে না।”
— “ওহ্!”

রুম থেকে বেড়িয়ে যায় ঝুম। রুমের বাইরে এসেই একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে। নিঝুমের সাথে কথা বললে কেমন দম বন্ধ, দম বন্ধ অনুভূতি হয় তার। অস্বস্তি অনুভব হয়।

______________

বাজার থেকে প্রায় ৫-১০ মিনিটের রাস্তা পার করে একটা পাহাড় আছে। পাহাড়টি আকারে অনেকটাই ছোট। এটি অতিক্রম করতে সর্বোচ্চ আধা ঘন্টা সময় লাগে। এবং পাহাড়টির অপর প্রান্তেই রয়েছে বিশাল ঝর্ণা। আপাতত পাহাড় অতিক্রম করার প্রচেষ্টায় আছে নিঝুম, ঝুম আর নিধা। নিঝুম নিধাকেও নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছিল ঝুমের অস্বস্তির কারণ।

ঝুম ব্যস্ত নিঝুমকে দেখতে। বারবার নিঝুমকে আড়চোখে দেখছে সে। রোদের আলোয় নিঝুমের চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠছে। ঝুমের ভালো লাগছে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। নিঝুমের গলায় একটা ক্যামেরা ঝুলানো আছে। পাহাড়ের চূড়ায় তারা পৌঁছাতেই নিঝুম হঠাৎ তার ক্যামেরা অন করে তাক করলো ঝুমের ওপর। মুচকি হেসে বলল,
— “হাসো তো ঝুম। এখানের ভিউ সুন্দর। তোমার ছবি সুন্দর আসবে।”

ঝুমের লজ্জা লাগছে। হাসতে পারছে না। বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে। এরমাঝেই নিঝুম ছবি তুলে নিলো কয়েকটা। ঝুম মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
— “সমস্যা কি আপনার? আমি পারমিশন দিয়েছি আপনাকে আমার ছবি তোলার?”

নিঝুম ভারী অবাক হয়। জিজ্ঞাসা করে,
— “তুমি পারমিশন দাও নি?”
— “না।”
ঝুমের স্পষ্ট উত্তর। নিঝুম হতাশা নিয়ে বলে,
— “তাহলে আর কি? ছবি গুলো ডিলিট করে দিচ্ছি।”

এবার অবাক হলো ঝুম। ডিলিট করে দিচ্ছি মানে? এখন সত্যি সত্যি রাগ হচ্ছে ঝুমের। সেটা প্রকাশ না করে ধীর গলায় বলে,
— “দেখি কি ছবি তুলেছেন।”

নিঝুম মুচকি হাসে। ক্যামেরা এগিয়ে দেয়। ক্যামেরায় ভেসে উঠা ছবি দেখে বিষম খায় ঝুম। এত সুন্দর ছবি! পেছনের সবুজে ঘেরা গাছপালাগুলো ঘোলা ঘোলা, আর মাঝখানে তাকে ফোকাস করা হয়েছে। ঝুমের মুখের অস্বস্তি ভাবটাই যেন ছবিটির মূল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। আশেপাশে ফড়িংয়ের অস্ত্বিত্বও খানিকটা দেখা যাচ্ছে। ঝুমের ভারী আফসোস হয় এবার। ইশ! যদি শাড়ি পড়ে আসতো সে! ছবিটা আরো সুন্দর হতো হয়তো। কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে ক্যামেরাটা ফেরত দিয়ে দেয় ঝুম। মৃদু স্বরে বলে,
— “ধন্যবাদ।”

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “কেন?”
— “ছবিটা অনেক সুন্দর হয়েছে তাই।”
— “ওহ্! তাহলে তুমি বলছো ছবিটা ডিলিট না করতে?”
কথাটা বলে নিঝুম হাসে। মনে মনে খোঁচা দেওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছিল নিঝুম। দিতে পেরেছে। এখন সার্থক! এদিকে ঝুম লজ্জা পায়। কিছু বলে না। নিঝুম চারপাশে তাকায়। তাদের একটু পাশে নিধা ফড়িং ধরছিল। নিঝুম সেটার ছবি তোলে একটা। পরক্ষণেই নিধাকে ডাক দিয়ে নিজের কাছে আনে। ওর হাত ধরে এগোতে থাকে সামনের দিকে। ঝুম তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। নিঝুম পেছনে ফিড়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “আসছো না কেন?”
— “আ-আসছি।”
দ্রুত পা চালিয়ে নিঝুমের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে ঝুম।

ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছে যায় তারা। কিন্তু সমস্যা হলো, ঝর্ণার কাছে যেতে হলে একটা উঁচু নিচু ভূমি পাড় করতে হবে তাদের। নিঝুম সেটা সহজেই পাড় করতে পারলেও ঝুম আর নিধা পারছে না। যখন ঝুম আর নিধা চেষ্টা করেও নামতে পারলো না, তখন নিধাকে কোলে তুলে নামিয়ে দিলো নিঝুম। পরক্ষণেই ঝুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
— “আমার হাত শক্ত করে ধরো ঝুম।”

কথাটায় কেমন আদেশ আদেশ গন্ধ পেলো ঝুম। নিঝুমের দিকে তাকালো একবার। নিঝুম ইশারায় হাতটা ধরতে বলল। উপায়ান্তর না পেয়ে নিঝুমের হাত শক্ত করে ধরে ফেলল ঝুম। সাথে সাথে মৃদু কেঁপে উঠল সে। নিঝুমের দ্বিতীয় স্পর্শ এটা। আচ্ছা, নিঝুমেরও কি ঝুমের মতো অনুভূতি হচ্ছে? নিঝুমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ঝুম। উহু, না! ঝুমকে নামিয়ে দিয়ে নিঝুম প্রায় সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়েছিলো হাত। এবং পরে নিধাকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এটা দেখে ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র।

ঝুমের মন খারাপ থাকলেও নিধার সাথে ঝর্ণার পানি দিয়ে খেলতে খেলতে একসময় ভালো লাগতে শুরু করে তার। নিধার সাথে সাথে ঝুমও যেন বাচ্চা হয়ে গেছে। মন খুলে হেসে,দুলে খেলছে ঝুম। নিঝুম একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিল ঝুম আর নিধার। তোলা শেষে এক এক করে ছবিগুলো দেখছিল নিঝুম। হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় নিঝুমের। ছবিটির মধ্যে নিধা আর ঝুম একে অপরকে পানি মারছে। সেখানে খিলখিল করে হাসছে ঝুম। নিঝুম হঠাৎ-ই আবিষ্কার করে, ঝুম দেখতে সুন্দর। তার থেকেও অধিক সুন্দর ঝুমের হাসি।

__________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা