ভালোবাসি তারে পর্ব-০৮

0
5596

ভালোবাসি তারে

৮.
ডান পায়ের নিচে দু’টো বালিশ রেখে বিছানায় আধ শোয়া অবস্থায় বসে আছে ঝুম। কিছু ভালো লাগছে না তার। ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হচ্ছে। পাঁচ দিনের মাঝে তিন দিন আজকে। এই তিন দিনে নিঝুমকে না দেখতে পেরে ঝুমের অবস্থা প্রবল খারাপ। আরো দু’দিন কিভাবে কাটাবে সে? সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আফসোসের নিশ্বাস ফেলে ঝুম। মোবাইলে নিঝুমের কিছু ছবি তুলে রাখা উচিত ছিল তার। এতে ছবিতে হলেও দেখতে পারতো নিঝুমকে! পরক্ষণেই ঝুমের মনে হলো, নিঝুমের নম্বর তো তার কাছে আছে। নিধা একবার নিঝুমের নম্বর দিয়ে কল করেছিল তাকে। ঝুম নম্বরটা সেভও করে রেখেছে। ‘ঝুমময় নিঝুম’ নামে।

তড়িৎ গতিতে বালিশের নিচে থাকা ফোন বের করে হাতে নিলো ঝুম। নিঝুমের নম্বর খুঁজতেই পেয়ে গেল সাথে সাথে। কিন্তু কল করবে কি করবে না তা বুঝতে পারছে না। যদি ধরা পরে যায়? নিঝুমের কাছে যদি ঝুমের নম্বর সেভ থাকে? চোখ বন্ধ করে মস্তিষ্কের সব অদ্ভুদ ভাবনা ঝেড়ে ফেলল ঝুম। বুকে আকাশ সম সাহস নিয়ে নিঝুমকে কল করল। দু’বার রিং হওয়ার পরপরই নিঝুমের ঘুমুঘুমু কণ্ঠ শোনা গেল,
— “হ্যালো, কে বলছেন?”

অর্থাৎ, নিঝুমের কাছে ঝুমের নম্বর সেভ নেই। নাহলে নিঝুম কখনোই ঝুমকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতো না। একটা প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল ঝুম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার সময় দেখে নিলো। বিকাল ৫টা বাজছে। নিঝুম কি এখনো ঘুমাচ্ছে? কণ্ঠ শুনে তো তাই মনে হয়।
ওদিকে নিঝুম হ্যালো, হ্যালো করেই যাচ্ছে। ঝুমের নার্ভাস লাগছে এখন। হাত পা কাঁপছে। লম্বা নিশ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নিলো ঝুম। দু’আঙ্গুলে নাক চেপে, কণ্ঠসর পরিবর্তন করে বলল,
— “হ্যালো, ডাক্তার নিঝুম বলছেন?
— “জ্বী, আপনি কে?”
— “আমাকে আপনি চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।”

ওপাশ থেকে নিঝুমের বিরক্ত সহিত কণ্ঠ,
— “না বললে চিনবো কি করে? যাই হোক! আমাকে কেন ফোন করেছেন?”
ঝুম কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভেবে নিলো সে কি বলবে। তারপর বলল,
— “আসলে আমার ছোট্ট ভাইয়ের জ্বর হয়েছে তো। তাই আরকি আপনাকে কল করা।”

নিঝুম শোয়া থেকে উঠে বসল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “সরি! বুঝলাম না। এতে আমি কি করতে পারি?”
— “আপনি কি করতে পারেন মানে? ডাক্তার যেহেতু চিকিৎসা করবেন।”
নিঝুম সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
— “আপনি কিভাবে জানেন আমি একজন ডাক্তার?”

ঝুম থতমত খেয়ে গেল। তোতলিয়ে বলল,
— “মা-মানে? ক-কেন জানবো না? বলেছি না আমি আপনাকে চিনি। তাছাড়া আপনি আ-মাদের জমিদারের ছেলে। জানাটা কি স্বাভাবিক নয়?”

নিঝুম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “কিন্তু আমি তো এখনো এখানে ডাক্তার প্রফেশনে জয়েন করি নি। তাছাড়া আমাকে না বলে আপনি তো আপনার ভাইকে নিয়ে ফার্মেসি অথবা হাসপাতালেও যেতে পারেন, তাই না আন্টি?”

‘আন্টি’ শব্দটা কানে যেতেই জ্বলে উঠল ঝুম। নিঝুম তাকে আন্টি বলল? আন্টি? আপুও তো বলতে পারতো। আন্টি-ই কেন? প্রচন্ড রাগে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল ঝুম,
— “হাসপাতালে যাবো কেন আমি? আপনি কেন আছেন তাহলে? ডাক্তারি পাস কি ঘাস কাটার জন্য করেছেন? নাকি সিগ্রেট খাওয়ার জন্যই আপনার জন্ম? সিগ্রেট আর সিগ্রেট! সিগ্রেট ছাড়া আর কিছু বুঝেন না? ডাক্তার হয়ে ডাক্তারি পারেন না, কেউ সাহায্য চাইলেও তাড়িয়ে দেন। ছিঃ! ডাক্তার নামে কলঙ্ক আপনি।”

বলেই কলটা কেটে দিলো ঝুম। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। ঝুমের কণ্ঠ কি আন্টিদের মতো শোনায় নাকি? মাথামোটা নিঝুম!
নিঝুম ফোন হাতে নিয়ে বসে রইল বিছানায়। এমন ধমকি শুনে তার ঘুম উবে গেছে। ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নিঝুম। পরপরই কফি বানাতে নিচে চলে গেল। এখন আর ঘুম আসবে না তার। সুতরাং, একটু কড়া কফি খেলে মন্দ হয় না।

_______________

এভাবে সেভাবে করে আরো দু’টো দিন কেটে গেল। এই দু’দিনে একবার করে হলেও নিঝুমকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেছে ঝুম। কেন যেন নিঝুমের বিরক্ত হওয়া বেশ লাগে তার। তবে মাঝে মাঝে নিঝুমকে দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র অনুভূতি নিয়ে জাগতো। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ নিধাকে পড়াতে যাচ্ছে ঝুম। ডান পা-টাও এখন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে।

কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই জমিদার বাড়ি পৌঁছালো ঝুম। তবে ঝুমের ভাগ্যটা ছিল খারাপ। সেখানে গিয়েই জানতে পারলো নিঝুম আর নিধা বাহিরে ঘুরতে গিয়েছে। ঝুমের মনটা খারাপ হয়ে গেল নিমিষেই। কোথায় ঝুম ভেবেছিলো নিঝুমের সাথে দেখা করবে! কিন্তু তা আর হলো কই? ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মিসেস সানজিদা ঝুমকে বললেন,
— “এভাবে বসে আছিস কেন? পা ব্যথা আগে থেকে কমেছে?”

ঝুম মলিন হেসে বলল,
— “জ্বী আন্টি। আচ্ছা, নিধারা কখন আসবে? ওদের দেড়ি হলে আমি চলে যাই?”
— “একটু পরেই আসবে। ফোন করেছিলাম আমি। এখন চল! তুই বরং আমাকে রান্নায় সাহায্য করবি।”

ঝুম হাসি-মুখে মিসেস সানজিদার কথায় সায় দিলো। তারপর দু’জনে মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলো। কথায় কথায় ঝুম জানতো পারলো, খিচুড়ি নিঝুমের প্রিয় খাবার। এটা জানার প্রায় সাথে সাথেই ঝুম ভেবে নিয়েছে, কাল নিজ হাতে খিচুড়ি বানিয়ে খাওয়াবে নিঝুমকে।

মিনিট দশেক পর নিধার দেখা মিললো। কিন্তু নিঝুম কোথায়? ঝুমের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরল। নিধাকে পড়ানোর সময় সুযোগ বুঝে ঝুম মৃদু স্বরে বলল,

— “আচ্ছা, নিধা? তোমার ভাইয়ু কোথায়? দেখলাম না যে।”
— “ভাইয়ু ব্যাটমিন্টন খেলছে ম্যাম।”
— “কোথায়?”
— “বাড়ির উঠানে। করিম চাচার সাথে।”
ঝুমের হাসি পেলো। করিম চাচা ব্যাটমিন্টন খেলতেও পারেন? বাহ্!

আজকে নিধাকে দ্রুত ছুটি দিয়ে দিয়েছে ঝুম। নিধার নাকি ভালো লাগছে না! ঝুমও বিশ্বাস করে নিয়েছে। নিধাকে পড়া বুঝিয়ে পড়ার রুম থেকে বেড়িয়ে যায় ঝুম। নিঝুমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে পুরো রুম ফাঁকা। বারান্দায়ও কেউ নেই। নিঝুমের খেলা কি এখনো শেষ হয় নি? দেখতে দেখতে রুমে ঢুকে যায় ঝুম। নিঝুমের রুম অনেক গোছালো আর বড়। বিছানার একপাশে অনেক বড় ফ্রেমে নিঝুমের হাসোজ্জল একটা ছবি টানানো আছে। সময় নষ্ট না করে সেটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ঝুম। পরপরই নিজেকে গালাগাল করতে করতে মনে মনে বলল,
— “ছিঃ ঝুম ছিঃ! এতটা ছ্যাঁচড়া হয়ে গিয়েছিস তুই? শেষে কিনা চুরি করে ছবি তুললি? ছিঃ!”

নিজেকে অত শত বকতে বকতে কাঠের টেবিলে থাকা একটা খাতা হাতে নিলো ঝুম। খাতার প্রথম পাতা উল্টাতেই চমকে গেল। পাহাড়ের সেই ঝর্ণার কি সুন্দর চিত্র আঁকা হয়েছে খাতাটায়। ঝুম মুগ্ধ হয়ে গেল যেন। পরের পৃষ্টা পাল্টাতেই একটা গ্রামীণ চিত্র ভেসে উঠল সামনে। আচ্ছা, চিত্রগুলো কি নিঝুম এঁকেছে? নিঝুম ছবি আঁকতেও পারে? তাও এত সুন্দর?

ভাবনার মাঝেই খট করে খুলে গেল দরজা। পরপরই নিঝুমের ভারি গলা শোনা গেল,
— “ঝুম? তুমি এখানে? আমার রুমে কি করছো?”

মনে মনে ভয়ে সিটিয়ে যায় ঝুম। কিন্তু উপর থেকে নিজেকে শক্ত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “কি করছি সেটা আপনাকে বলতে হবে? কতদিন পরে এসেছি আমি। আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে জেরা করছেন কেন?”

নিঝুম অবাক হয়ে বলল,
— “আমি জেরা করছি?”
— “অবশ্যই। আপনার উচিত ছিল আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা।”
নিঝুম হেসে বলল,
— “কেমন আছো? পা ভালো হয়েছে?”
— “হুম, সব ভালো হয়েছে।”

নিঝুম মুখের হাসি বজায় রাখলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলো নিজের। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ঝুম। পানিতে নিঝুমের চোখ কি সুন্দর দেখাচ্ছে! পাঁপড়ি গুলো ভিঁজে একজোট হয়ে যাওয়ায় আরো আকর্ষিত করছে ঝুমকে। নিঝুম ঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমার রুমে কেন এসেছিলে? জানতে পারি মিস শিক্ষিকা?”
ঝুম কিছুক্ষণ চুপ রইলো। আমতা আমতা করে বলল,
— “আপনার রুম দেখছিলাম।”
নিঝুম ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
— “দেখে কি বুঝলে?”
— “আপনি অনেক গোছালো মানুষ।”
নিঝুম মুচকি হেসে বলল,
— “ঠিক বুঝেছো।”

প্রতিউত্তরে ঝুমও হাসলো। তারপর হাতের খাতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ-ই বলে উঠল,
— “আপনি কি ড্রইং পারেন? এগুলো আপনার আঁকা?”
নিঝুমের নির্লিপ্ত কণ্ঠ,
— “হ্যাঁ! ছোট বেলা থেকে একটু আকটু সখ আছে।”

ঝুম মুগ্ধ হয়ে তাকালো নিঝুমের দিকে। আনমনেই বলে উঠল,
— “আপনার সব সুন্দর।”
নিঝুম ঠোঁটের হাসি দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলল,
— “তুমি তার চেয়েও বেশি সুন্দর।”
ঝুম ভড়কে গেল। আর্তনাদ করে উঠল,
— “কি?”
নিঝুম শব্দ করে হেসে উঠল এবার। একহাতে চুল বুলিয়ে বলল,
— “মজা করছিলাম।”
— “ওহ্!”

ছোট্ট করে বলে ঝুম। প্রতিবারের মতো এবারো ঝুমের বুক দুরদুর করছে। ইশ! নিঝুমের বলা কথাটা যদি সত্য হতো! হতাশ হয়ে হাতের খাতাটা টেবিলে রেখে দেয় ঝুম। কিছু একটা মনে করে উৎফুল্ল কণ্ঠে নিঝুমকে বলে,
— “ডাক্তার? আপনি কি মানুষের ছবি আঁকতে পারেন?”
— “টুকটাক। কেন?”
— “আমার ছবি এঁকে দিতে পারবেন?”

ঝুমের আহ্লাদী আবদার শুনে নিঝুমের ইচ্ছে হলো ঝুমের নাক টেনে দিতে। কিন্তু পরে ঝুম কিনা কি মনে করে! সেই ভেবে আর নাক টানলো না নিঝুম। শুধু বলল,
— “ঠিকাছে। চেষ্টা করবো।”

ঝুম খুশিতে লাফিয়ে উঠলো যেন। ঠোঁটে হাসি সিল হয়ে লেগে গেছে তার। এমন সময় নিঝুম আবার বলে উঠল,
— “জানো ঝুম? আমার ফোনে না একটা আননোন নম্বর থেকে কল আসে কয়েকদিন যাবত। কণ্ঠটা অনেকটা তোমার মতো।”

ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকায়। ফাঁকা ঢোক গিলে কয়েকটা। তোতলিয়ে বলে,
— “ম-মানে? আ-আমার মতো কণ্ঠ মানে? আপনার কি মন-নে হয়, আমি আপনাকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করি?”
নিঝুম মাথা ঝাকিয়ে বলল,
— “না, এমনি বলছিলাম আরকি। আমি জানি তুমি সে না।”

কথাটা শুনে প্রাণে প্রাণ ফিরলো ঝুমের। লম্বা নিশ্বাস টেনে আবার ফেলল সে। বলল,
— “আ-আমি এখন আসি ডাক্তার? দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
নিঝুম হাসি-মুখে বলে,
— “ঠিকাছে।”

ঝুম দ্রুত বের হয়ে যায় রুম থেকে। হাত পা এখনো কাঁপছে তার। আজকে যদি ধরা পরে যেতো, তাহলে কি হতো? নিঝুমকে কি উত্তর দিতো সে?

_____________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা