ভালোবাসি তারে পর্ব-০৯

0
6250

ভালোবাসি তারে

৯.
পড়ন্ত বিকেল। নিজের হাতে খিচুড়ি বানিয়ে জমিদার বাড়ি হাজির হয়েছে ঝুম। প্রতিদিন কার মতো মিসেস সানজিদার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিধাকে পড়ানোর জন্য পড়ার রুমে যাচ্ছিল ঝুম। নিঝুমের রুম পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ নিঝুম ডাকলো,
— “ঝুম?”

ঝুম চমকে উঠল। নিঝুমের রুমে উঁকি দিতেই নিঝুম গম্ভীর গলায় বলল,
— “উঁকাউঁকির অভ্যেস পাল্টাও। এদিকে আসো!”
ঝুম হালকা ঢোক গিলে। মাথা নত করে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় নিঝুমের দিকে। নিঝুম তখন পেইন্টিং করছি। তার পাশেই টেবিলে বিভিন্ন বই, খাতা রাখা। ঝুম টেবিলটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিঝুন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “কোথায় যাচ্ছো?”
— “নিধাকে পড়াতে।”
— “কিন্তু নিধা তো এ রুমে।”
ঝুম অবাক হয়ে বলে,
— “মানে?”
— “বিছানার দিকে তাকাও।”
সাথে সাথে বিছানার দিকে তাকালো ঝুম। নিধা বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঝুম সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিঝুমের দিকে তাকায় আবার। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলে। নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “এখন কি করবে? ও তো ঘুমাচ্ছে।”
— “নিধাকে উঠিয়ে দিন একটু, প্লীজ!”

নিঝুম বিনাবাক্যে চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে ঝুম বাঁধা দেয়। মিনমিনিয়ে বলে,
— “আপনার জন্য আমি কিছু এনেছি।”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কি?”
ঝুম কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মনে সাহস নিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠল,
— “আপনার জন্য খিচুড়ি বানিয়ে এনেছি।”

ঝুমের দিকে তাকিয়ে নিঝুম শব্দ করে হেসে উঠে। দীর্ঘ সেই হাসি। তারপর বলে,
— “সিরিয়াসলি? আমার জন্য খিচুড়ি বানিয়েছো তুমি?”
ঝুম মাথা ঝাঁকায়। ব্যাগে থাকা খিচুড়ির বক্সটা ধরিয়ে দেয় নিঝুমকে। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সে ভেবেছিল ঝুম মজা করছে! পরপরই বক্সটা খুলতেই খিচুড়ির মন মাতানো ঘ্রাণে চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায় তার। বলে উঠে,
— “ঘ্রাণটা ভীষণ সুন্দর ঝুম। না জানি খেতে কেমন হবে!”

ঝুম লজ্জা পায়। হালকা হাসে। নিঝুম মুচকি হেসে চোখ মেলে তাকায়। বক্সটা লাগিয়ে পাশের টেবিলে রাখে। ঝুম মন খারাপ করে বলে,
— “রেখে দিলেন যে?”
— “মুভি দেখতে দেখতে খাবো।”

ঝুম প্রশ্ন করে না আর। নিঝুম আবার বলে,
— “আচ্ছা, হঠাৎ আমার জন্য খিচুড়ি আনতে গেলে কেন?”
ঝুম থমকে যায়। কি বলবে গুলিয়ে ফেলে। উত্তেজনার দরুণ সত্যিটাই বলে ফেলে।
— “আ-আসলে, আন্টি বলেছিলেন আপনার নাকি খিচুড়ি পছন্দ।”
নিঝুম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ঝুমের দিকে। হঠাৎ হেসে উঠে বলে,
— “ভালো, ভালো।”

ঝুম প্রশ্ন করে,
— “কি আঁকছেন?”
— “তেমন কিছু না।”
— “ওহ্!

ঝুম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে নিঝুমের পাশে। নিঝুমের আঁকা দেখে। পরপরই মুখ কিঞ্চিত বাঁকিয়ে বলে,
— “আপনি কাক আঁকছেন? আর কিছু পেলেন না?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “কেন? সমস্যা কোথায়? তাছাড়া কাক আমার প্রিয় পাখি।”
ঝুম খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে,
— “কি? কাক আবার মানুষের প্রিয়ও হয়?”
ঝুমের চেঁচানোতে নিঝুম বিরক্ত হয় যেন। যথাসম্ভব নিজের বিরক্তি দমিয়ে বলে,
— “আমার হয়।”

ঝুম কিছু না বলে টেবিলে থাকা একটা খাতা উঠিয়ে নেয়। প্রথম পাতা উল্টাতেই কিছু লেখা দেখতে পায়। শব্দ করে লেখাগুলো পড়ে,

‘তুমি বুঝবে না প্রিয়তমা,
তুমি আমার কে?
তুমি হলে আমার একাকীত্বের সঙ্গী।
আমার জীবনের মূল্যবান লক্ষ্য।
তোমার সেই কাজলে লেপ্টে থাকা চোখ জোড়া ভীষণ প্রিয় আমায়।
প্রিয় তোমার… ‘

ঝুম চুপ হয়ে গেল। আর কিছু লিখা নেই খাতায়। নিঝুম সঙ্গে সঙ্গে বলল,
— “ঝুম? তোমার আবৃতি তো অনেক সুন্দর। কোথায় শিখেছো?”
ঝুম উত্তর দেয় না। পাল্টা প্রশ্ন করে,
— “বাকি লেখা লিখেন নি কেন?”
নিঝুম হালকা হেসে বলে,
— “প্রিয়তমা এখনো পাই নি। পেলে লিখে ফেলবো।”

ঝুম হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
— “আপনার গার্লফ্রেন্ড নেই?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “তোমার বড় আমি। কি জিজ্ঞেস করছো?”
ঝুম আকুতি ভরা কণ্ঠে বলল,
— “বলুন না প্লীজ!”
নিঝুম গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— “না নেই।”
ঝুম খুশি হয়ে বলে,
— “সত্যিইই?”
নিঝুম সন্দিহান চোখে তাকায়। ঝুম লজ্জা পায়। কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অত:পর বলে,
— “নিধাকে ডেকে দিন। আমি চলে যাই।”

কথা মতে নিধাকে ডেকে দেয় নিঝুম। ঝুমও নিধাকে পড়াতে পড়ার রুমে চলে যায়।

________________

পরের দিন ছিল বুধবার। রৌদ্রের কড়া উত্তাপের মাঝে নদীর কাছ ঘেঁষে গেঁটে চলছিল ঝুম। ভ্যাঁপসা গরমে ঝুমের বেহাল অবস্থা। পরনের পাতলা ফতুয়া আর স্কার্টও সোয়েটার সম লাগছে তার। এত গরম কেন? ঝুমের মাথা ঘুরাচ্ছে। ঝুমের বাবা আলম খানের বিদ্যালয়ে কি যেন কাজ আছে। তিনি বিকেলের আগে বাসায় আসতে পারবেন না। তাই তো আলম খানকে খাবার দিতে ঝুম বিদ্যালয়ে গিয়েছে। নাহলে কি এত গরমের মাঝে ঝুম বাসা থেকে বের হয়? কক্ষনো না!

তীব্র গরমে ঝুমের সব শক্তি যেন হ্রাস পাচ্ছে। হাঁটতে পারছে না আর। চোখ ছাপসা হয়ে আসছে। কোনোমতে বাসায় পৌঁছায় সে। রান্নার ঘরে যেতেই মাথা ঘুড়ে যায় ঝুমের। ঝুমের মা মিসেস শ্রেয়া ফ্লোরে পড়ে আছেন। ফ্লোরের একপাশে সাবানের টুকরো দেখা যাচ্ছে। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে তার। ঝুম স্তব্ধ হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাত,পা,বুক কেঁপে উঠে। চিৎকার করার শক্তিটুকুও নেই। পরক্ষণেই মনে হলো, ডাক্তার ডাকতে হবে। দিক-বেদিক আর দেখলো না ঝুম। ছুটতে লাগলো বাজারের দিকে। পথিমধ্যে ধাক্কা খেলো একজনের সঙ্গে। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো, সেটা নিঝুম! নিঝুম কালকের বক্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিক দিয়েই যাবে বিধায় বক্সটা ঝুমকে দেওয়ার কথা ভেবেছিল সে। কিন্তু ঝুমের এমন অবস্থা কেন? নিঝুম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় অস্পষ্ট ভাবে বলে উঠল ঝুম,
— “আ-মা-র ম-মাকে ব্বাঁচ-চান ডাক-তার!”

পরপরই ঢোলে পরে নিঝুমের বুকে। নিঝুম দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ঝুমকে। সতর্ক চোখে ঝুমের দিকে তাকায়। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে ঝুম কি বলেছিল। কিন্তু আফসোস, সে বুঝতে পারেনি কথাগুলো। সুতরাং মনে আসার কোনো প্রশ্নই আসছে না। নিঝুম ঝুমের ক্লান্তিমাখা মুখের পানে একপলক তাকালো। কি মনে করে, কোলে তুলে নিলো ঝুমকে।

_____________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা