ভালোবাসি তারে
৩২.
মধ্যাহ্নবেলা। নিঝুম বসে আছে তার কেবিনে। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুপক। দাঁত কেলিয়ে হাসছে সে। নিঝুমের দিকে হাত বাড়িয়ে অতি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল রুপক,
— “হাই, ডক্টর নিঝুম। আ’ম জারিফ রুপক। নাইস টু মিট ইউ।”
নিঝুম ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। হাত মেলালো না। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— “বসুন।”
হাত না মেলানোয় রুপক খানিকটা অপমানিত বোধ করল। কিন্তু বিশেষ একটা পাত্তা দিলো না সেদিকে। হাসি-মুখে বসে পরল চেয়ারে। এবং পরপরই উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল,
— “আপনি তো নামি-দামি ডক্টর। আপনার ড্যাডও জমিদার। শুনেছি, আপনি নাকি নিজের একটা হসপিটালও বানাবেন। আসার সময় হসপিটালের সাইটও দেখে আসলাম। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও আপনি এই সস্তা হসপিটালে চাকরী করছেন… ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।”
নিঝুম সরু দৃষ্টিতে তাকালো রুপকের দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “সবার সব থাকলেই কি সেটা ব্যবহার করতে হয় মিস্টার রুপক? অবশ্যক, আপনি তো নিজেরটার চেয়ে অন্যের সম্পদ বেশি পছন্দ করেন।”
কথাটা ঠিক বুঝলো না রুপক। জিজ্ঞেস করল,
— “কি বললেন? বুঝলাম না।”
নিঝুম উত্তর দিলো না। টেবিলের উপর দু হাত ভর করে ঝুঁকে বসল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— “আমি ভণিতা করতে পছন্দ করি না, মিস্টার রুপক। এখানে ডাকার কারণ সরাসরি বলছি! ঝুমকে আমি ভালোবাসি। তাই ভালো হবে বিয়েটা আপনি ভেঙ্গে দিন।”
রুপক কিছুক্ষণ অবুঝের মতো চেয়ে রইল। পরক্ষণেই কি মনে করে হেসে উঠল সে। হাসতে হাসতে বলল,
— “আপনিই তাহলে ঝুমের সেই প্রেমিক? আমি তো বিলিভই করতে পারছি না ডক্টর। ঝুমের মতো গরিব মেয়েকে আপনার মতো নামি-দামি লোক পছন্দ করে? এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?”
বলেই অট্টহাসিতে মেতে উঠল রুপক। নিঝুমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। আস্তে আস্তে রাগ বাড়ছে তার। ইচ্ছে করছে, শকিং রুমে নিয়ে গিয়ে শক খাওয়াতে খাওয়াতে আধমরা করে ফেলতে রুপককে! রুপকের দিকে কিছুক্ষণ রক্তিম চোখে তাকিয়ে রইল নিঝুম। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ব্যর্থ হচ্ছে! রাগী গলায় বলল,
— “আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনার চাকরী মুহুর্তেই খইয়ে দিতে পারি আমি।”
তৎক্ষণাত রুপকের হাসি থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল সে,
— “আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন ডক্টর?”
— “কেন? ব্ল্যাকমেইল এর মতো লাগছে না? আরো ভয়ংকর কিছু বলা উচিত ছিল কি?”
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল নিঝুম। রুপক ফুঁসে উঠে। বলে,
— “আপনার কথায় আমি ঝুমকে ছাড়বো কেন? ওকে পছন্দ করি আমি। বিয়ে ওকেই করব।”
নিঝুম বিরক্ত হলো। সে ভেবেছিল একটু ভয় দেখালেই রুপক দমে যাবে। কিন্তু না! ত্যাড়া মানুষকে ত্যাড়া পদ্ধতিতেই বোঝাতে হয়। ভেবেই ঠোঁটের হাসিটা আরো গাঢ় করল নিঝুম। রুপকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
— “মিস্টার জারিফ রুপক! আপনার কি মনে হয়? আমি আপনার সম্পর্কে কিছুই জানি না? তিন বছর বিদেশে থেকে আপনি কি করেছেন সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। ড্রাক সেবন করে হাজারটা কেস খেয়েছেন। প্রতিনিয়ত টাকা দিয়ে, দিয়ে জেল থেকে ছুটছেন। আমার কাছে কিন্তু আপনার থেকে বেশি টাকা আছে। একবার জেলে গেলে, এবার আর ছাড়া পাবেন না। এন্ড দ্যাট্’স মাই প্রমিস টু ইউ!”
এসির তীব্র ঠান্ডায়ও তরতর করে ঘামছে রুপক। কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। কেঁশে গলা পরিষ্কার করে নিলো সে। কোনোমতে বলল,
— “আ-আপনি কিভাবে জানেন এস-ব?”
নিঝুম জবাব দিলো না। টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে একটা টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগল রুপক। কিছু বলতে নিলেই নিঝুম বলে উঠল,
— “বিয়ের ব্যাপারটা আপনার ভাবার প্রয়োজন রুপক। ভাবুন! এবং সঠিক-টাই ভাবার চেষ্টা করুন। পরে যেন পস্তাতে না হয়। আর হ্যাঁ, দরজাটা ওই দিকটায়।”
রুপক অপমানে কিছু বলতে পারল না। ক্রুদ্ধ চোখে একবার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।
৭
আলম খান সোফায় বসে বসে পত্রিকা পড়ছে। কিন্তু তাঁর মন পত্রিকার কাগজে নেই। তিনি পত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু গভীর ভাবে চিন্তা করছেন অন্য কিছু। জমিদার বাড়ির কাজের লোক মেঘলার বিয়ে কাল। আরো আগে হতো, কিন্তু ঝুমের কারণে নাকি বিয়ের তারিখ পেছানো হয়েছে। শুধু মাত্র ঝুমের উপস্থিতির জন্য। মিসেস সানজিদা বড্ড পছন্দ করেন ঝুমকে। তিনি চান ঝুম যেন বিয়ে উপলক্ষ্যে কয়েকদিন তাদের বাড়িতেই থাকে। নিঝুমও কালকে এটাই বলতে এসেছিল। সকালে আবার শাখাওয়াত শেখ নিজ থেকে ফোন করে ঝুমকে পাঠানোর কথা বলেছেন আলম খানকে।
আলম খান যথেষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি এ গ্রামে। এমনকি জমিদার বাড়ির অনেকের সাথেই উনার উঠা-বসা আছে। যেহেতু ঝুমকে নিজ থেকেই তারা পাঠাতে বলছেন, সেহেতু হুট করে মানা করতে পারছেন না তিনি। ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাছাড়া আলম খানের অনেক বিপদেও শাখাওয়াত শেখ বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছেন। দোটানায় ভুগছেন আলম খান। কি করবেন বুঝতে পারছেন না।
আলম খানের একটু দূরত্বেই ঝুম বসে আছে। টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে সে। হঠাৎ আলম খান ডেকে উঠলেন তাকে,
— “ঝুম মা?”
ঝুম চমকে তাকায়। ধীর গলায় জবাব দেয়,
— “জ্বী আব্বা।”
আলম খান ধীরে-সুস্থে বললেন,
— “জমিদার বাড়ির কারো বিয়ে হবে কাল। তোকে কয়েকদিনের জন্য সেখানে পাঠাতে বলছে তারা। এখন, সামনের মাসে তো তোর বিয়ে। এসময় কোথাও পাঠানো ঠিক হবে না। আবার মানাও করা যাচ্ছে না। ওরা যথেষ্ট সম্মান করে আমাকে।”
রান্নাঘর থেকে মিসেস শ্রেয়ার আওয়াজ শোনা গেল। ডালের বাটি নিয়ে আসতে আসতে তিনি বললেন,
— “যেতে বলেছে যেহেতু যেতে দাও। এমনিতেও তোমার মেয়ে বন্ধ ঘরে বসে থাকে সারাদিন। ওখানে গেলে যদি একটু মন ভালো হয়।”
ঝুম অবাক হয়ে চাইলো তার মায়ের দিকে। মানুষটা কি সত্যিই ওর মা? ঝুম মাঝে মাঝে বিস্ময় কাটাতে পারে না। এই কঠিন মহিলাটি মাঝে মাঝে এমন কিছু করে ফেলে যে ঝুম নিজেই ভড়কে যায়। বুঝে উঠতে পারে না কিছু। তার মনের কথাটা কি সুন্দর বুঝে নিলেন মিসেস শ্রেয়া। ঝুম তো ভেবেছিল সে যেতেই পারবে না! এবার খানিকটা শান্তি শান্তি লাগছে তার।
মিসেস শ্রেয়া ডালের বাটি-টি টেবিলে রেখে আবার বললেন,
— “ঝুমকে কখন যেতে বলল? আজকেই?”
আলম খান জবাব দিলেন,
— “হ্যাঁ! বিকালে নিঝুম আসবে ঝুমকে নিতে।”
একটু থেমে ঝুমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “ঝুম মা? কি কি নিবি তৈরি করে নেয়। বেশি সময় নেই।”
ঝুম শুধু মাথা নাড়ালো। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করতে লাগলো সে। নিঝুম আসবে ভাবতেই প্রফুল্ল হয়ে যাচ্ছে তার মন। শীতলতা ঘিরে ধরছে!
____________________
গাড়ি জমিদার বাড়ি না নিয়ে গ্রামের কাছাকাছি শহরের একটা পার্কে থামিয়েছে নিঝুম। গাড়ি থামতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিঝুমের দিকে তাকালো ঝুম। জিজ্ঞেস করল,
— “গাড়ি থামালেন যে? জমিদার বাড়ি যেতে দেড়ি হয়ে যাবে না আমাদের?”
তখন বিকেলের মধ্যভাগ। সূর্যের রশ্মি সরাসরি এসে পড়ছে নিঝুমের ঘর্মান্ত মুখের ওপর। ঝুম সেদিকেই চেয়ে। নিঝুম জবাব দিচ্ছে না। গাড়ির ছোট্ট ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সে। সঙ্গে সঙ্গে ঝুম মৃদু ধমকে উঠল,
— “একদম আমার সামনে ছাইপাঁশ খাবেন না। রাখুন এটা।”
ঝুমের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিঝুম একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে টান দেওয়ার আগ মুহুর্তেই সিগারেট কেড়ে নিলো ঝুম। নিঝুম শীতল চাহনিতে ঝুমের দিকে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল,
— “ওটা দাও ঝুম।”
ঝুম ত্যাড়ামো করে বলল,
— “কখনো না। আমার সামনে এগুলো খাওয়া বারণ আপনার।”
— “খেতে ইচ্ছে করছে, দাও!”
নিঝুমের উঁচু গলা। ঝুম আবারো মৃদু ধমক দেয়,
— “না বলেছি না? এগুলো খেয়ে কি মজা পান আপনি?”
বলতে বলতেই জানালা গলিয়ে সিগারেট ফেলে দিলো ঝুম। নিঝুম ডান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
— “ফেললে কেন?”
— “আগে উত্তর দিন।”
নিঝুম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। ঝুমের কাঁধে মাথা রেখে লেগে বসে একদম। ঝুম ভড়কে যায়। বড় বড় চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে। নিঝুম নির্লিপ্ত। চোখ বন্ধ করে সে বলে,
— “আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।”
কিছুক্ষণ ঝুম জবাব দিতে পারলো না। তার শরীর কেমন কাঁপছে। কথা গলায় বেজে যাচ্ছে। ঝুম কাঁপা গলায় বলল,
— “বাজে অভ্যেস ছেড়ে দিন।”
— “তুমি আমার অভ্যেস হবে ঝুম? ভালো, সুন্দর অভ্যেস!”
ঝুম ঢোক গিললো। অনুভূতিতে টইটুম্বুর সে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। চোখ মুদে থাকা অবস্থায় নিঝুম আবার বলল,
— “আমার চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো পিচ্চি।”
অনুরোধ নাকি আদেশ ঠিক বুঝলো না ঝুম। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে কাঁপা হাতটা রাখলো নিঝুমের চুলে। ধীরে ধীরে চুল নেড়ে চেড়ে দিতে লাগল।
নিঝুমের চুল অনেক সফ্’ট। ধরতে ভীষণ ভালো লাগছে ঝুমের। নিঝুম চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে। প্রায় অনেক্ষণ কেটে যায় ওভাবেই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে প্রায়। এখনো তারা সেই পার্কেই। জমিদার বাড়ি যেতে দেড়ি হয়ে যাবে না?
ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো নিঝুমের। ফোনটা সামনেই রাখা ছিল। ফোনের স্ক্রীনে ‘আম্মু’ নামটা ভেসে উঠছে। অর্থাৎ, মিসেস সানজিদা কল করছেন। ঝুম একবার ভাবলো কলটা ধরবে। কিন্তু নিঝুম এমন ভাবে কাঁধে মাথা রেখে আছে, ঝুম নড়তেই পারছে না। নিঝুমও ধরছে না ফোন। ঘুমিয়ে গেছে নাকি সে? ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল। তারপর আর ফোন এলো না। ঝুম আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো নিঝুমকে। নিঝুমের জবাব না পেয়ে এবার একটু জোড়েই ডাকলো,
— “ডাক্তার?”
— “হু।”
হালকা স্বরে বলে নিঝুম। ঝুম আবার বলে,
— “আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?”
— “উহু!”
— “তাহলে চলুন। দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। আপনার মাও ফোন দিয়েছে এই মাত্র। সবাই হয়তো চিন্তা করছে।”
এবার চোখ মেলল নিঝুম। অস্থির চোখে ঝুমের দিকে তাকালো। নরম সুরে আদুরে গলায় বলল,
— “আমাকে বিয়ে করবে ঝুম? এখন, এই মুহুর্তে?”
আপনা-আপনি ঝুমের চোখ বড় হয়ে যায়। বুক কেঁপে কেঁপে উঠে। হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। অথচ বাইরের দিক দিয়ে ঝুম স্বাভাবিক। মূর্তির মতো বসে সে। জবাব দেওয়ার শক্তিটুকুও পাচ্ছে না।
___________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia