ভালোবাসি তারে পর্ব-৩৯

0
6616

ভালোবাসি তারে

৩৯.
চেয়ারে মাথা নত করে বসে ফ্লোরে পায়ের নখ খোঁচাচ্ছে ঝুম। বার বার হাত কঁচলাচ্ছে। টলমলে চোখ জোড়ায় আড়চোখে দেখছে নিঝুমকে। নিঝুম আঁধশোয়া ভাবে বসে আছে বিছানায়। বিরক্তিতে মুখ পানসে তার। সামান্য পা ই-তো কেটেছে। এতে এত অস্থির হওয়ার কি আছে? কান্না করতে হবে কেন? নিঝুম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ঝুমের দিকে। আদুরে গলায় ডাকলো,
— “ঝুম?”

ঝুম নিরুত্তর। নিঝুম আবার বললো,
— “ঝুম? কান্না বন্ধ করো।”
কান্না থামালো না ঝুম। বরং কান্নার বেগ আরো বারিয়ে দিলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পরল পরপর দু’ফোটা জল। নিঝুমের বিরক্তি বেড়ে চলছে। সহ্য হচ্ছে না ঝুমের কান্না। নিঝুম গম্ভীর মুখ করে বললো,
— “আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি ঝুম।”

ঝুম ফুঁফিয়ে উঠে। নাক টেনে ক্ষীণ স্বরে বলে,
— “আপনি খুব বাজে একজন মানুষ।”
— “ব্যাপারটা পুরোনো। নতুন কিছু বলো।”
কান্নার মাঝেই রেগে যায় ঝুম। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে বলে,
— “আপনি খুবই, খুবই খারাপ। নিজের খেয়াল একদমই রাখেন না। কি দরকার ছিল রাতে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার? নিজের কথা না ভাবুন। আমার কথা তো ভাববেন!”

জবাবে মৃদু হাসলো নিঝুম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাসিটাও প্রখর হচ্ছে। ঝুমের চোখে চোখ রেখে বললো,
— “এদিকে আসো।”
ঝুম চোখ পিটপিট করে বলে,
— “আসবো না।”
— “ঝুম, আমার মাথা ব্যথা করছে। কপালে হাত বুলিয়ে দিবে না?”

নিঝুমের আবেগ মাখা অনুরোধ। ঝুম ফেলতে পারলো না। উঠে দাঁড়ালো। এক পা এগোবে তখনই দারজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করলেন সানজিদা শেখ। হাতে কড়া লিকারের কফি। ঝুমের পা থেমে গেল। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। সানজিদা শেখ কফির মগটা নিঝুমের হাতে দিয়ে বিছানার এক পাশে বসলেন। ঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
— “জানিস ঝুম? নিঝুম আজকাল বড্ড বেপরোয়া হয়ে গেছে। একটা কথাও শুনে না। রাত-বিরেতে ছাদে গিয়ে হাঁটাহুঁটি করে। ছাদে হয়তো পিন ছঁড়িয়ে, ছিঁটিয়ে ছিল। ব্যস! ওমনি পায়ে ঢুকে গেছে। তখনো আমাদের কিছুই বলে নি। আর এখন দেখ! পায়ের ব্যথায় হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। শরীরটাও হালকা গরম হয়ে আছে।”

ঝুম কি বলবে ভেবে পায় না। অস্থির চাহনি নিয়ে বার কয়েক বার নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুম বেশ শান্ত ভঙ্গিতে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। শান্ত গলায় সে বললো,
— “আমি ঠিক আছি আম্মু।”
সানজিদা শেখের কঠোর গলা,
— “হাঁদার মতো কথা বন্ধ কর! তোর মা আমি। তোর থেকে বেশি বুঝি তোকে।”
নিঝুম হেসে বললো,
— “তুমি তো আমার বান্ধবী।”

সানজিদা শেখও হাসলেন এবার। নিচ থেকে শাখাওয়াত শেখের ডাক পরতেই বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। ঝুম তখনো নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে। নিঝুম আবারো কফিতে চুমুক দিলো। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,
— “দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো ঝুম। নিঝুম থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে বিছানায় বসল। হাত রাখল নিঝুমের কপালে। তারপর বেশ চিন্তিত গলায় বললো,
— “আপনার শরীর হালকা গরম, গরম লাগছে। একশ জ্বর তো হবেই। রাতে গোসল করেছিলেন তাই না?”

কপাল থেকে ঝুমের হাত সরিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো নিঝুম। হাতে আলতো ভাবে অধর ছুঁইয়ে বললো,
— “সামান্য জ্বরে আমার কিচ্ছু হয় না।”
ঝুম অসন্তুষ্ট হলো। রাগ দেখিয়ে বললো,
— “কেন? আপনি কি জড় বস্তু?”

নিঝুম কিছু বলল না। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে ঝুমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল সে। কিছুক্ষণ একধ্যানে ঝুমকে দেখতে লাগলো। ঝুম তখন লজ্জায় মিইয়ে গেছে। নিঝুমের দিকে তাকাতে পারছে না। লজ্জায় গাল ভারি হতে শুরু করছে তার।

নিঝুম চোখ বন্ধ করে বললো,
— “মাথা ব্যথা করছে ঝুম। হাত বুলিয়ে দাও।”
ঝুম দ্রুত বলে,
— “দরজা খোলা ডাক্তার। উঠুন!”
— “উহু! ভেড়ানো। আমার রুমে নক ছাড়া কেউ টুকবে না।”

উপায়ন্তর না পেয়ে ঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীরে ধীরে হাত নিয়ে গেল নিঝুমের চুলে। চুলগুলো নড়াচড়া করতে লাগল আলতো ভাবে। নিঝুম চোখ বন্ধ করে আছে। অনুভব করছে ঝুমকে। বুকে কেমন শান্তি শান্তি অনুভূত হচ্ছে তার। ভালো লাগছে ঝুমের ছোঁয়া। এ ছোঁয়া নিঝুম আজীবন চায়। আজীবন!

____________________

নিঝুমকে ঘুম পাড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে ঝুম। আলম খান ড্রইংরুমেই বসে ছিলেন। মিসেস শ্রেয়া রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। ঝুম ঘরে ঢুকেই সালাম দিলো আলম খানকে। সালামের জবাব দিয়ে আলম খান বললেন,
— “ঝুম মা? এদিকে আয়। বস!”

ঝুম আস্তে ধীরে আলম খানের পাশে বসল। তিনি ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললেন,
— “আমি তোর ব্যাপারে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঝুম। যেমন, রুপককেই ধর! ছেলেটাকে দেখে কখনো মনেই হয়নি ছেলেটা এমন হবে!”

আলম খান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটু থেমে আবার বললেন,
— “তাই এবার তোকে তোর ভাবে স্বাধিনতা দিচ্ছি। তুই যা চাস তাই হবে। নিঝুমের সাথে তোর বিয়ে ১৪তারিখে ঠিক করেছি আমরা। চারদিন বাদে গায়ে হলুদ। তোর কি কোনো আপত্তি আছে?”

ঝুমের মনে একরাশ আনন্দ দোলা খেয়ে গেল। উত্তেজনায় পাঁচ-ছয়বার মাথা নাড়ালো সে। আলম খান মুচকি হাসলেন। আবারো ঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তিনি।

_____________________

পরেরদিন ঝুম আবারো জমিদার বাড়ি যায়। নিঝুম এখন অনেকটাই সুস্থ। পায়ের ব্যথা খানিকটা কমেছে। মোটামোটি হাঁটতে পারে সে। ঝুম যখন নিঝুমকে দেখতে যায় নিঝুম তখন ঘুমাচ্ছে তার রুমে। ঝুম ধীর পায়ে রুমে ঢোকে। আশপাশ তাকিয়ে দেখে একবার। তার একটু দূরত্বে একটা ডায়েরী পড়ে আছে টেবিলে। বাতাসের দরুণ এলোমেলো ভাবে উড়ছে ডায়েরীর পৃষ্ঠাগুলো। ঝুম সেদিকে গেল। ডায়েরীটা হাতে নিতেই একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল তার। যেখানে গোটাগোটা অক্ষরে খুব সুন্দর করে লেখা, ‘আমি ভালোবাসি তোমায় ঝুমময় পিচ্চি।’

প্রায় বেশ কয়েক বার একই কথা লেখা। ঝুম বিড়বিড় করে পড়ল লেখাটা। মনে এক আলাদা শিহরণে শিহরিত হলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল চমৎকার হাসি। হঠাৎ পেছন থেকে নিঝুমের ঘুম জড়ানো ভারি কণ্ঠ শোনা গেল,
— “ঝুম? কখন এলে?”

ঝুম চমকে যায়। পেছনে ফিরে তাকায়। নিঝুম আধশোয়া ভাবে বসে আছে বিছানায়। দৃষ্টি ঝুমের পানেই নিবদ্ধ। ঝুম ডায়েরীটা দ্রুত রেখে দিলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
— “এইতো, এখন এসেছি। আপনার ব্যথা কমেছে?”
— “হ্যাঁ।”

নিঝুম আরেকটু ভালো ভাবে বসল। ঝুমের দিকে তাকালো। কি ভেবে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,
— “ঝুম? ড্রয়ারে সিগারেট আছে মনে হয়। দাও তো।”
নিঝুমের চোখে,মুখে দুষ্টুমীর আভা। ঝুম কটমট করে তাকালো। ধমক দিয়ে বললো,
— “আপনি অসুস্থ। খেতে পারবেন না।”
নিঝুম ভারি অবাক হয়ে বলে,
— “তুমি আমাকে খেতে দেবে না?”
— “না।”
— “কিন্তু আমি তো খাবো।”
— “আমার কথা না শুনলে আমি কিন্তু চলে যাবো ডাক্তার।”
— “যাও।” শান্ত স্বরে বলল নিঝুম।

ঝুম তেঁতে উঠলো। রাগ দেখিয়ে সত্যি চলে গেল। নিঝুমের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। ডাকলো না পর্যন্ত! সে শান্ত দৃষ্টিয়ে চেয়ে আছে ঝুমের যাওয়ার পানে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঝুম নিজেই আবার মাথা নত করে হাজির হয়েছে রুমে। মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। একদম বেলুনের মতো। নিঝুম হেসে দেয়। বলে,
— “আমি জানতাম তুমি কোথাও যাবে না।”

কি হলো কে জানে। নিঝুমের হাসি দেখে হেসে উঠলো ঝুমও। খিলখিলানো হাসি।

_____________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
Ishanur Tasmia