ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১৩+১৪

0
444

#ভালোবাসি_প্রিয়
( রিপোস্ট)
#পর্ব_১৩

©জারিন তামান্না

ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে তিয়ান।ম্যাসেজটা সিন হয়েছে কিন্তু রিপ্লাই আসেনি কোনো। বিষয়টা খারাপ লাগছে তার।কিঞ্চিৎ হলেও খারাপ লাগছে।ধরে না রাখলেও সত্যি তো এটাও ছিল যে একটা সময় সেও চেয়েছিল এক হতে। কিন্তু সময়ের স্রোতে নিজের জন্য তীর খুঁজতেই মাঝ সাগরেই তাকে একলা ছেঁড়ে এসেছিল সে। কিন্তু, আজও… এতগুলোদিন পরেও ব্যাপারগুলো ভাবলেই মাথা ভার ভার লাগে তার। সূক্ষ একটা ব্যাথা চিনচিন করে বুকের বা’পাশটায়। কিন্তু তারও কিছুই করার নেই। সে তো নিজেই ছেড়ে দিয়েছিল।তাহলে এখন আর নিজের জন্য জায়গাটা দাবী করার কোন উপায় নেই। একেবারেই নেই। অন্যকেউ তাকে নিজের করে নিয়েছে। এখন সে সুখী হলেই হলো। তবে সে রিপ্লাই কেন করেনি? এতদিন যোগাযোগ ছিল না বলেই কি ভুলে গেছে তাকে? নাকি মনে করতে চাইছেনা বলেই সিন করেও রিপ্লাই দেয়নি! কল করবে কি একবার?ঠিক হবে সেটা? -এত সব কথা ভেবে ভেবে বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেল মনটা তার। ফোনের ডাটা অফ করে বেরিয়ে এলো ম্যাসেঞ্জার থেকে। মনটা রিফ্রেশ করা দরকার। একটা ড্রিংক হলে মন্দ হতো না। এই ভেবেই গাড়ির চাবি নিয়ে রাত ১১ টায়ও বেরিয়ে গেল নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্যে।

_________________________________

বিয়ের শপিং এ এসছে সিফাত, রিহান, রুকু, ইয়ানা আর রেহনুমা আলম। সারাকেও বলেছিল কিন্তু সে কাজের বাহানা দিয়ে আসবে না বলে দিয়েছে।পলকের জন্য শাড়ি কিনবে বলেই সিফাতকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে তারা। সিফাতের কথা, পলকের জন্য শাড়ি কিনবে তো পলককে নিয়ে যাক। নয় তো মা আর বোন মিলেই নিজেদের পছন্দমত কেনাকাটা করুক। তাকে এসব মেয়েদের শপিং এ নেওয়ার কি মানে! কিন্তু, রুকুর কথা, তোর বউয়ের জন্য শপিং করবো তো তুই সেসব পছন্দ করে দিবি। পলকেরও তো জানা দরকার তার হবু স্বামীর পছন্দ অপছন্দ কেমন। রুকুর কথা সে এমনিতেও ফেলতে পারে না। অগ্যতা একপ্রাকার বাধ্য হয়েই সিফাতকে আসতে হয়েছে।কিন্তু সে তো রিহানকে ছাড়া কিছুতেই যাবে না। তাই ভাইয়ের আবদার রাখতে বাধ্য হয়ে অফিস বাদ দিয়ে রিহানকেও আসতে হয়েছে সাথে।

দোকানে বসে একের পর এক শাড়ি দেখছে রুকু আর রেহনুমা। রিহান এক কোণায় বসে ফোনে যতটা সম্ভব অফিসের কাজ করছে। সিফাত আর ইয়ানা পাশাপাশি বসে তাদের কান্ডকারখানা দেখছে। হঠাৎ ইয়ানা তাকে বললো,
_আচ্ছা পাপা,তুমি কেন কোন শাড়ি দেখছো না?
_আমি কি এসবের কিছু বুঝি নাকি আম্মু।শুধু শুধু নিয়ে আসছে আমাকে। -বিরস গলায় বললো সিফাত।
_তাহলে চলো আইসক্রিম খেয়ে আসি আমরা দুজন।
_আচ্ছা,আম্মুর তাহলে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করেছে। -সিফাতের কন্ঠে ইয়ানাকে বুঝে ফেলার উচ্ছ্বাস। আর এটা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ইয়ানা। তারপর সিফাত রুকুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_আপা,তোরা বসে শাড়ি দেখ। আমি আর আম্মু এক্ষুনি আসতেছি। সিফাতের কথা শুনে রুকু বিরক্ত সুরে বললো,
_এখন আবার কই যাবি তোরা। চুপচাপ বস এখানে। শাড়ি দেখ। রুকুর কথায় রেহনুমা আলমও সায় দিলেন। কিন্তু তাদের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে সিফাত বললো,
_আরেএ..তোরা দেখনা শাড়ি আমরা আসতেছি। তারপর রিহানকে বললো,
_রিহান…তুই কি যাবি আমাদের সাথে?সিফাতের কথা শুনে ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সিরিয়ে সিফাতের দিকে চাইলো রিহান।সে খেয়াল করেনি সিফাত ঠিক কি বলেছে।তাই বোকার মত তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড কয়েক। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিফাত বুঝলো ভাই তার কাজে ডুবে ছিল। সে কি বলেছে সেটা ওর কানের ভেতর গেছে ঠিকই কিন্তু মাথায় এন্ট্রি না করে সোজা উপর দিয়ে ফ্লাই করে গেছে। তাই সরাসরি বললো,
_উঠ,,চল বাইরে। -বলেই ইয়ানাকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
রিহান কি বুঝলো কে জানে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো ভাইয়ের কথা মতো। তারপর সিফাত আর ইয়ানার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল সেও।
_________________________________

শপিং মলের চার ত’লায় একটা আইক্রিম পার্লারে গিয়ে ঢুকলো তারা। ইয়ানাকে তার ফেভারিট চকো চিপস আইসক্রিম দিয়ে রিহানের আনা কফি নিয়ে বসলো দুভাই। কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিহান বললো,
_তোহ..ক’টা শাড়ি চুজ করলি রে ব্রো?
_আমি কোন শাড়ি চুজ করিনি। করতে পারবো না বলেই চুপচাপ কেটে পড়েছি ওখান থেকে।এসব আমার কাজ নয়। বলেই সকৌতুক হাসলো সিফাত।
_কাজ নয়.. পারবি না এসব বললে কি হয়? বিয়ে করতেছিস কত কি করতে হবে..পারতে হবে এখন!-বলেই চোখ মারলো রিহান। আর রিহানের কথায় সিফাত কি বুঝলো সেই জানে..কফিতে সবেই চুমুক দিয়েছিল বেচারা,কথাখানা শুনেই বিষম খেয়ে গেল একদফা। কাশতে কাশতেই বললো,
_স্টপ ইট ইয়ার।
সিফাতের এমন রিয়্যাকশন দেখেই সজোরে হেসে দিলো রিহান। ঠিক সে সময়ই সিফাতের ফোন বেজে উঠলো।রুকু কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই রুকুর ঝাড়ি শোনা গেল।
_এই,কই রে তোরা সব? এক সাথে কই গায়েব হইছিস সবগুলা?
_আরেএএ…কুল ডাউন ডিয়ার সিস্টার। আমরা মলেই আছি। চার ত’লায়। ইনু আইসক্রিম খাবে বলছিল তাই এখানে এসেছি।
_হ্যাঁ,,,ইনুর জন্য গিয়েছো নাকি নিজের জন্য সেটা তো আমি বেশ ভালোই জানি।-রুকুর এহেন কথায় সিফাত হেসে দিল। বোনটা তাকে এত কেন বোঝে,কিভাবে বোঝে সেটা সে ভেবে পায় না। আবার সারা কখনো তার এতটা ক্লোজ হয়নি। শুধুমাত্র কিছু আবদার করার হলেই ভাইকে মনে পড়ে তার। ছোট বোন বলে রুকু আর সিফাত দুজনেই বেশ আদর আহ্লাদ করে তাকে। কিন্তু, সে তুলনায় ভাই বোনদের সে খুব একটা কেয়ার করে না। এই যে আজও এলো না বিয়ের শপিং এ। অথচ তার একটামাত্র ভাইয়ের বিয়ের শপিং এটা। ব্যাপারটা মনে হতেই ম্লান হাসলো সিফাত। শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
_হু। বস তোরা। আসছি আমরা। বলেই কল কেটে দিয়ে ইয়ানাকে বললো,
_আম্মু চলো এখন। তোমার আম্মু যেতে বলেছে।
ইয়ানাও মাথা কাত করে সায় দিল।তারপর তারা ফিরে গেল শাড়ির দোকানটায়।

শাড়ির দোকানে যাওয়া মাত্রই রুকু কয়েকটা শাড়ির সামনে বসিয়ে দিল সিফাতকে। বললো,
_এখান থেকে চুজ কর। হলুদে কোনটা পড়বে। আর বিয়েতে শাড়ি নাকি ল্যাহেঙ্গা কি পড়বে বল। সেটা দেখি এবার।

_আরে..বিয়েতে কি পড়বে সেটা আমি কি করে বলবো?ওকেই জিজ্ঞেস করেনে না!
_আচ্ছা। তাও হয়। তুই ওকে কল করে জিজ্ঞেস কর তো। -পাশ থেকে রেহনুমা আলম বললেন।
_তোমার বউমা,তুমিই কল করে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো। আমি এসব কি করে জিজ্ঞেস করি!
_এই বেশি কথা বলিস না। আমার কাছে ফোন নাম্বার থাকলে তো আমিই কল দিতাম। নেয়া হয়নি নাম্বারটা। তোর কাছে তো আছে। তুই কল দে। -শেষ কথাটা খানিক খোঁচা মেরেই বললেন রেহনুমা।বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।আর তা দেখে রুকু আর রিহানও মিটিমিটি হাসছে।তাদের এভাবে হাসতে দেখে বেশ লজ্জাই পেল সিফাত। গলা খাকড়ানি দিয়ে নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো,
_আমার কাছেই যে নাম্বারটা আছে এমনটাই বা কে বললো তোমাকে?
_সেটা তুই তোর ভাইকেই জিজ্ঞেস কর। বলেই আবার দুষ্টু হাসলেন উনি। মা যে রিহানের কথা বলছে এটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না সিফাতের। চোখ গরম করে রিহানের দিকে তাকালো। যার মানে,একলা পাই, হচ্ছে তোমার আজ। সিফাতের এমন চাহনী দেখে রিহানের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নিমিষেই। ভয় পাওয়া গলায় আমতা আমতা করে বললো,
_ভাই তু.. তুই আমাকে কি দেখছিস? এই তো কত্ত শাড়ি,,এগুলা দেখ।বলেই একটা শাড়ি টেনে নিজের মুখের সামনে ধরে নিজেকে আঁড়াল করে নিল সে। এটা দেখে ইয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আর ইয়ানার হাসি আর যাবতীয় কান্ডকারখানা দেখে রুকু রেহনুমা এমনকি দোকানদারও না হেসে পারলো না। আর যাই হোক,হাসি বড্ড ছোঁয়াচে ব্যাপার!

সিফাত ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল এবার। রিহানের উপর রাগও লাগছে খানিকটা। কেন সব কথা খালা আর বোনকে বলতে হবে তার! নিজেকে শান্ত করতে রিহানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দিলো সে। আর ঠিক তখনই একটা শাড়ির উপর তার চোখ আটকে গেল। কুসুম হলুদ আর অফ হোয়াইটের কম্বিনেশনের জামদানি শাড়ি। চকিতেই তার কল্পনায় পলকের অবয়ব ভেসে উঠলো। এই শাড়িতে তার মৃন্ময়ীকে ভেজা মাটির গায়ে মিঠে রোদ্দুরের মতই শুদ্ধ আর স্নিগ্ধ লাগবে দেখতে।এটা ভাবতেই একটা মৃদু হাসি ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।বেশ কয়েকটা শাড়ির মাঝ থেকে টেনে বের করে হাতে নিল শাড়িটা। তারপর রুকুকে দেখিয়ে বললো,
_হলুদের জন্য এটা দিবি।মানাবে ওকে।
শাড়িটা দেখে দোকানে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হলো। দোকানদার তো রীতিমত সিফাতের প্রশংসা শুরু করে দিল,তার এত সুন্দর চয়েজ দেখে। রুকু, রেহনুমাও খুব পছন্দ করলেন শাড়িটা। এরপর রেহনুমা বললেন, যাক একটা তো হলো। এবার বাকি রইলো মেহেদী, বিয়ের আর বৌভাতের শাড়িগুলো। এগুলাও দেখ তাড়াতাড়ি। বাকি যা লাগে আমরা কিনে নেবো।বিয়ের শাড়ির কথা শুনেই রুকু বললো,
_হ্যাঁ রে ভাই,এরমাঝে তুই ইন্ডিয়া যাবি না রে?
_হ্যাঁ,যেতে পারি হয় তো। কেন?
_না বলছিলাম,বিয়ের শাড়িটা তুই ওখান থেকেই কিনে নিস তাহলে। আর বৌভাতের শাড়িটা আমি আর দিহান দিবো বলে ঠিক করেছি। ওটা তোর না কিনলেও চলবে।
_বেশ তো। তোরা যা ভালো মনে করিস।
ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে রুকু খুশি হয়ে গেল। তারপর তারা সবাই মিলে মেহেদীর ফাংশনের জন্য একটা হালকা ডিজাইনের মধ্যে গাঢ় জলপাই রঙ এর লেহেঙ্গা কিনলো। আর বিয়ের পরে পড়ার জন্য হালকা কয়েকটা শাড়িও নিল। তখনই রুকু বললো,
_ভাই, আমাদের হয়ে গেছে।এবার তুই একটা কাজ কর। পলককে একবার কল দে তো।
_কেন?ওর আবার এখন এখানে কি কাজ?শাড়ি তো সব কেনা হয়েই গেছে। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো সিফাত।
_আহ! শুধু শাড়ি কিনলেই হবে? ব্লাউজ বানাতে দিতে হবে। মাপ লাগবে তো।আর টুকিটাকি জিনিসও আছে কেনার।ওকে দরকার পড়বে তখন। তুই আসতে বল ওকে।

বোনের কথা শুনে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল সিফাত।দুপুর ১:২০ বাজে। এ সময় তো পলক স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়। কই আছে কে জানে! তাও বোনের কথায় ফোন বের করে ডায়াল করলো পলকের নাম্বারে।

কিছুক্ষণ হলো স্কুল থেকে বেরিয়েছে পলক। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। এই অসময় সিফাতের কল দেখে খানিকটা অবাক হলো পলক।তবুও ফোন রিসিভ করে স্বভাবসুলভ শান্তকন্ঠে সালাম জানালো,
_আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। পলকের কন্ঠ শুনেই প্রশান্তির হাসি হেসে জবাব দিল সিফাত।তারপরেই বললো,
_আপনি কি ফ্রি আছেন এখন?
_জ্বী। বাসের জন্য ওয়েট করছি। বাসায় যাবো।
_অহ, আচ্ছা। তাহলে বাসটা ছেড়ে দিন। আর ওখানেই ওয়েট করুন। আমি আসছি।
_আপনি আসছেন মানে? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
_না। কোন সমস্যা হয়নি। আসলে মা, আপা আপনার জন্য বিয়ের শপিং এ এসেছে। আপা বললো আপনাকে দরকার একটু। তাই আর কি…
_অহ। ছোট্ট করে বললো পলক।
_হ্যাঁ। তো আপনি ওখানেই থাকুন আমি আসছি আপনাকে পিক করতে।
_না..না..আপনাকে আসতে হবে না। কোথায় আসতে হবে বলুন আমি চলে আসবো।
_না। আপনাকে যেটা বলেছি সেটাই করুন।জাস্ট ২০ মিনিট কষ্ট করে ওয়েট করুন, আমি আসছি।
_আচ্ছা। ঠিক আছে।-সারাদিনের ক্লান্তির পরে এখন আর সিফাতের সাথে তর্কে জড়াতে চাচ্ছে না পলক। তাই বিনা বিরোধিতায় মেনে নিল তার কথা।
_গুড। জাস্ট ওয়েট দেয়ার। আ’ম কামিং সুন। বলেই মুচকি হাসলো সিফাত।
_হুম। বলেই ফোন রেখে দিল পলক।

পলকের সাথে কথা শেষ করেই রুকুকে উদ্দেশ্যে করে বললো সিফাত,
_আপা,তোরা রিহানের সাথে রেস্টুরেন্টে যা। লাঞ্চ করে নে।আমি মৃন্ময়ীকে নিয়ে আসছি।
_কাকে নিয়ে আসছিস? -চট করেই প্রশ্ন করলো রুকু।রুকুর এহেন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিফাত।মনে মনে জিভ কেটে বললো,
_ধুর…কি একটা অভ্যাস হয়েছে।সবার সামনেই মৃন্ময়ী বলছি এখন!
_কি রে..মৃন্ময়ী কে?-তাড়া দিয়ে বললো রুকু।

সিফাত কিছুটা ইতস্তত করছে,কিভাবে বলবে এদের সামনে..রুকু একা হলেও হতো,সাথে মা আছে। তার সামনে কি করে বলবে যে আস্ত একটা নাম থাকতেও সে পলককে আলাদা করে মৃন্ময়ী বলে ডাকে! মা-ই বা কি ভাববে! তারপর বললো,
_ইয়ে..মানে..
_আরেএ দি..ভাবীকে আনতে যাচ্ছে। চলো আমরা লাঞ্চে যাই। ভাই তুই বেরিয়ে পড়। ভাবী ওয়েট করছে হয় তো।-পাশ থেকে বললো রিহান।

সিফাত যেন মহাবাঁচা বেঁচে গেল। রিহানটা সময়মত উদ্ধার করে দিয়েছে। মনে মনে ভাইকে ধন্যবাদ জানালো। আর মুখে বললো,
_আ..ব..হ্যাঁ। তোরা যা,আমি আসছি। বলেই বেরিয়ে এলো শোরুম থেকে। আর সে বেরিয়ে যেতেই ব্যাপারটা আদতে কি ছিল সেটা বুঝতে পেরেই একচোট হেসে নিল রুকু, রিহান আর মিসেস. রেহনুমা
।ছেলেটা বুঝি তাদের শেষমেশ প্রেমে পড়েই গেল এবার।ব্যাপারটা তাদের জন্য আনন্দের। একলা থাকা ছেলেটার একটা গতি হবে এবার। কিন্তু ছোট্ট ইয়ানা এসবের কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।
_________________________________

শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পলক। সিফাত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি পার্ক করতে গেছে। ঠিক তখনই নিজের পি.এ আসিফের সাথে কথা বলতে বলতে মল থেকে বেরিয়ে এলো তিয়ান। একটা বিজনেস মিটিং এর জন্য এসেছিল এখানে। সিড়ির শেষ মাথায় নেমে আফিসকে বললো ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলার জন্য। পলক তার পাশেই দাঁড়ানো। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ পাশ ফিরে চাইতেই তিয়ান ছোটখাটো একটা ঝটকা খেলো। কত বছর পরে দেখলো এই মুখ?উউউউমমম…৪ বছর?! হ্যাঁ,চার বছর আগেই শেষবারের মত মুখোমুখি দেখা হয়েছিল এই মুখখানা। কিন্তু চিনতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না আজও।পরিবর্তন বলতে বাচ্চা বাচ্চা মুখখানি এখন প্রাপ্তবয়স্ক রমণীর মুখশ্রীতে পরিণত হয়েছে। এটা ভাবতেই একটা মুচকি হাসি ফুঁটে উঠলো তার চোখে মুখে।এক ধ্যানে সে দেখছে পলককে।

এদিকে পলক বেশ কিছু সময় ধরে অনুভব করছে, যেন কেউ তাকে একনজরে দেখছে। কিন্তু পাশ ফিরে তাকাতে সহস পাচ্ছে না। সাহসের চাইতেও বেশি অস্বস্তি লাগছে তার। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়,কেউ তাকে দেখছে,তাহলে সে তাকালেই তো চোখাচোখি হয়ে যাবে। লোকটার নজরে কি থাকবে কে জানে। খারাপ কিছু হলে? ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি রকমের ভয় কাঁটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু এভাবে সহ্যও তো করা যাচ্ছে না। কি করবে না করবে এসব ভাবতে ভাবতেই একটা কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়ালো তার সামনে। তিয়ানের সেদিকে খেয়াল নেই।তাই পাশ থেকে আসিফ ডাক দিল,
_স্যার,চলুন। গাড়ি এসে গেছে।
আসিফের কথায় ধ্যান ভাংলো যেন। পলকের থেকে নজর সরিয়ে পাশে তাকিয়ে আসিফকে জবাব দিল।
_হ্যাঁ..তুমি বসো,আসছি আমি।
_জ্বী স্যার। বলেই আসিফ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

হঠাৎই এক চির পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে পাশে তাকালো পলক। তিয়ানও শেষবারের মত একনজর দেখার জন্য পলকের দিকেই তাকাচ্ছিল। তাই পলকের তাকানোর সাথে সাথেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। পলক হতভম্ব। কতগুলো বছর পরে এতটা কাছ থেকে দেখলো সে এই মানুষটাকে! আগের থেকে কতটা পরিণত দেখাচ্ছে তাকে।একজন সুদর্শন পুরুষে পরিণত হয়েছে মানুষটা। কত বছর পরই আবার শুনলো এই কণ্ঠস্বর সে? ২’৫ বছর হবে হয় তো। বা এর থেকেও কিছুটা বেশি। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর যেন তার ভেতরে গাঁথা। ভোলা অসম্ভব। কিন্তু সে তো চলে গিয়েছিল। তাহলে কবেই বা এলো?এসেছে বলেই কি সেদিন ম্যাসেজ করেছিল? কিন্তু পলকের যে সাহসে কুলায়নি রিপ্লাই দেওয়ার।অসম্ভব রকমের একটা কষ্ট এসে চেপে ধরেছিল তাকে। সেটা উপেক্ষা করে সে কিছুই বলতে পারেনি। তাই রিপ্লাইও করা হয়নি।

পলকের চোখে বিস্ময়,প্রশ্নের ভীড় স্পষ্ট। যেটা না চাইতেও অস্বস্তিতে ফেলছে তিয়ানকে। অনুশোচনায় পোড়াচ্ছে। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে নিরবতা ভেঙে মুচকি হেসে নিজেই জিজ্ঞেস করলো।
_কেমন আছো পলক?
পলকের মুখে কোন কথা নেই। সে পাথরের মূর্তির মত চুপচাপ তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো তিয়ানের দৃষ্টি তার দিক থেকে সরে তার পাশে গিয়ে ঠেকেছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দেখলো সিফাত তার পাশে দাঁড়ানো। সিফাতের মুখের দিকে তাকাতেই তার বিচলিত মুখখানা হুশ ফেরালো পলকের।নড়েচড়ে উঠলো সে। তাকে এমন বিধ্বস্তরূপে দেখে চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলো সিফাত,
_Are u ok, Mrinmoyi?
_মৃন্ময়ী?! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তিয়ান। মেয়েটা তো পলক। তাহলে এই লোকটা ওকে মৃন্ময়ী বলে ডাকছে কেন? তবে কি সে অন্য কাউকে পলক ভেবে ভুল করলো?

এদিকে তিয়ানের এমন অবাক করা কন্ঠে মৃন্ময়ী বলা শুনে চকিতেই তার দিকে তাকালো সিফাত আর পলক। পলকের মস্তিষ্কে উত্তেজনা বাড়ছে। ভেতর ভেতর ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। তার অনাগত ভবিষৎকে পাশে নিয়ে তারই দাফন হওয়া অতীতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলেছে। পাশ ফিরে সিফাতকে দেখলো একবার। তার চোখ মুখে অবাকতা আর একটা প্রশ্ন স্পষ্ট। পলক সেটা ঠিক বুঝতে পারলো। তারপর পরিস্থিতি সামলে নিতেই সম্মুখে ফিরে তিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_হ্যাঁ,,উনি আমাকে মৃন্ময়ী বলেই ডাকেন।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৪
©জারিন তামান্না

_হ্যাঁ,উনি আমাকে মৃন্ময়ী বলেই ডাকেন।
সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির সাথে পলকের এমন সাবলিল কথাবার্তায় সিফাত আন্দাজ করে নিল যে ব্যক্তিটি পলকের পরিচিত। তারপরেও শিওর হওয়ার জন্য পাশ ফিরে পলককে জিজ্ঞেস করলো,
_মৃন্ময়ী উনি…? সিফাতকে পুরো কথাটা আর বলতে হলো না। পলক বুঝে নিল সিফাত আদতে কি জানতে চাইছে। তাই নিজে থেকেই বললো,
_ও তিয়ান। কলেজে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম।আবার ফ্রেন্ডও বলতে পারেন। এইচ. এস. সির পরে স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা চলে গিয়েছিল ও।আর আজ অনেকগুলো বছর পর এখানে দেখা হলো। বলেই ম্লান হাসলো পলক।
পলকের কথা শেষ হতেই সিফাত বললো,
_অহ,,তবে বেশ পুরোনো বন্ধু আপনারা।- কথাটা বলেই সে তার ভুবন ভুলানো হাসি হেসে তিয়ানের দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
_Hi. I’m…
_Shafwan Shifat. Polok’s fiance.I saw in fb -বলেই হাসিমুখে হ্যান্ডশেক করার জন্য বাড়ানো সিফাতের হাতটা টেনে তাকে হাগ করলো।হালকা পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো,_Congratulations, man.
প্রথম পরিচয়েই তিয়ানের এমন সাবলিল আর বন্ধুসুলভ আচরণ বেশ অবাক করলো সিফাতকে। তবে একইসাথে সেটা ভালোও লাগলো খুব। মুখের হাসিটা চওড়া করে সেও বললো,
_Thanks man.
_You most welcome. তিয়ান বললো।বলেই সিফাতকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো দুজন।
পলক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সিফাতের পাশে। বাইরে থেকে সে একদম নির্বিকার। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই অস্থিরতা কাজ করছে তার। আর ঠিক সেই মূহুর্তে সিফাতের একটা কথা ক্ষণিকের জন্য তার অস্থিরতার গতিকে ঠান্ডা বরফের মতো স্থির করে দিল।

তিয়ান আর সিফাতের পরিচয়ের পর নিজেদের নিয়েই টুকটাক কথা বলছিল তারা। এরমাঝেই কথায় কথায় সিফাত বললো,
_মৃন্ময়ীর ফ্রেন্ড যেহেতু আপনি তাহলে এখনই বিয়ের অগ্রীম দাওয়াত রইলো।প্রতিটা ফাংশনেই কিন্তু থাকা চাই আপনার। কার্ড হাতে পেলে কার্ড পাঠিয়েও ইনভাইট করবো, তবে বন্ধু হিসেবে আগেই বলে দিচ্ছি।আপনি অবশ্যই আসবেন আমার আর মৃন্ময়ীর বিয়েতে। বলেই, পলকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো সে।সেই মূহুর্তে সিফাতের সাথে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় ফ্যাকাশে মুখে ম্লান হাসলো পলক। পলকের ফ্যাকাশে মুখটা সিফাতের নজর এড়ালো না। কিন্তু, এটাকে সে খুব গভীরভাবেও নিল না। ক্লান্তিভাব বলে ধরে নিল। কিন্তু তিয়ান ঠিকই বুঝতে পারলো পলকের এই ফ্যাকাশে মুখের কারণটা ঠিক কি! ফলে, যত দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবলো সে। তাই, সিফাতের সাথে আলাপচারিতা সংক্ষিপ্ত করার জন্য বললো,
_জ্বী,অবশ্যই। যার বিয়ে সে দাওয়াত দিলে নিশ্চয়ই আসবো।
_ধরে নিন যার বিয়ে সেই দাওয়াত দিচ্ছে আপনাকে। মৃন্ময়ী আর আমাকে এখন আলাদা ভাবার কিছু নেই।কি তাই তো মৃন্ময়ী?
সিফাতের এহেন প্রশ্নে চমকে উঠলো পলক। সহসা কি বলবে ভেবে পেল না। শুধু সিফাতের মুখ পানে চেয়ে মৃদু হাসলো খানিক। মুখে কিছুই বললো না। পলকের এই হাসিকেই সিফাত তার প্রশ্নের হ্যাঁ বোধক জবাব ধরে নিল।সেও হাসলো খানিক। তারপরেই আবার তিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
_নিন, হয়েই তো গেল তাহলে এবার। আপনি অবশ্যই অবশ্যই আসছেন আমাদের বিয়েতে। বিয়েটা আমার ফার্ম হাউজে হবে। আর আমি চাইবো বিয়ের ওই ক’টা দিন আপনি আমাদের সাথেই আমাদের ফার্ম হাউজে থাকবেন।
সিফাতের কথা পলকের অস্থিরতা, অস্বস্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে শুধু। একটা অনিচ্ছাকৃত চাপা রাগও হচ্ছে তার সিফাতের এহেন কাজের প্রতি। মনে মনে বলছে,,
_ কেন উনি বারেবারে বিয়েতে আসতে বলছেন তিয়ানকে! তাও আবার প্রতিটা ফাংশনে থাকার জন্য তারই ফার্ম হাউজে ইনভাইট করছেন।বড়লোক মানুষের কি আর খেয়ে দেয়া কাজ নেই যে যাকে ইচ্ছা তাকেই এভাবে দাওয়াত করে নিতে হবে? আবার, পরমূহুর্তেই ভাবলো..আচ্ছা!সিফাত যদি জানতো যে তিয়ান তার কেমন অতীত তবে কি সত্যিই এভাবে হেসে হেসে কথা বলতো তার সাথে? এভাবেই যেচে পড়ে দাওয়াত করতো তাদের বিয়েতে? -এটা ভাবতেই একরাশ চাপা কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠলো পলকের ভেতরটায়। ভাবনার ঘোর কাটলো তিয়ানের কথায়।
_ইনভাইট যখন করছেন তখন অবশ্যই চেষ্টা করবো সেটা রাখার। আফটারঅল, পুরোনো বন্ধুর বিয়ে! বলেই আড়চোখে একবার দেখলো পলককে। তিয়ানের এমন কথা আর চাহনী অস্বস্তিতে ফেলে দিল পলককে।চকিতেই চোখ নামিয়ে নিল সে।
_আচ্ছা,বেশ। তবে তাই কথা রইলো। আপনি আসছেন আমাদের বিয়েতে।
_yeah..sure.বলেই ম্লান হাসলো তিয়ান। তারপরেই আবার বললো,
_Anyway, I ‘ve to leave now. অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে। See u again.
_ok, fine. সিফাত বললো।
_ok..then. stay well. bye.
_bye.বলেই আরও একবার হালকা করে হাগ করলো সিফাত তিয়ানকে। ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে তার। সিফাতের থেকে বিদায় নিয়ে যেই না গাড়ির দিকে এগোতে যাবে ওমনি সিফাতের ডাকে থেমে গেল তিয়ান। পেছন ফিরে চাইতেই সিফাত বললো,
_তোমার এড্রেসটা?
মুচকি হেসে ওয়ালেট থেকে একটা পার্সোনাল কার্ড বের করে এগিয়ে দিল সিফাতের দিকে। সিফাতও ততোক্ষণে নিজের একটা কার্ড বের করে তিয়ান কে দিল।
_& here is mine.
তিয়ান কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলো একবার। সিফাতের বিজনেস কার্ড। অফিসের এড্রেস দেওয়া। তখনই তিয়ানের খেয়াল হলো,প্রোফাইলে দেখেছিল সিফাত পাইলট। তাহলে এটা?ভাবনাটা কড়া নাড়তে চকিতেই প্রশ্ন করলো সে,
_You are a pilot, right?
_yeah.
_then এটা?
_এটাও আমার। ফ্যামিলি বিজনেস আছে আমাদের কিছু। নিজের ইচ্ছের কারণে পাইলট হয়েছি। বাট পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় বিজনেসটাও দেখতে হচ্ছে।
_অহ..আচ্ছা। বেশ ভালো। আচ্ছা,আসছি তবে আজ। ভালো থাকবেন।
_yeah…u too.
তারপরেই আবার পলকের দিকে তাকিয়ে তিয়ান বললো,
_Congregations again, Polok. bye.
তিয়ানের কথায় পলক কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং আগের মতই নির্বিকারভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পলকের এমন ভাব দেখে তিয়ান আর কথা বাড়ালো না। পেছন ফিরে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

তিয়ানের গাড়িটা ওখান থেকে যেতেই সিফাত পলকের দিকে ঘুরে তাকালো।মুখখানা কেমন শুকিয়ে আছে পলকের। তাই প্রশ্ন করলো,
_খুব বেশি টায়ার্ড লাগছে কি, মৃন্ময়ী?
তিয়ায়েন যাওয়ার পথেই তাকিয়ে ছিল পলক। সিফাতের কথায় ধ্যান ভাংলো তার। তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,
_না..না। ঠিক আছি আমি।
_আচ্ছা। তাহলে চলুন ভেতরে যাওয়া যাক। ওরা সবাই অপেক্ষা করছে। লাঞ্চ সেরে শপিং শেষ করতে হবে তো।
_জ্বী,চলুন।
পলকের সম্মতি পেয়ে তারা দুজনেই একসাথে শপিং মলের ভিতরে প্রবেশ করলো।

_________________________________

রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকতেই ইয়ানা ছুটে এসে সেদিনের মতই জাপটে ধরো পলককে। তারপর,তার মিষ্টি মুখখানি উঁচু করে পলকের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আসসালামু আলাইকুম,মামণি। কেমন আছো তুমি? জানো আমি তোমাকে অনেকগুলা মিস করেছি। বলেই পলকের পেটে মাথা ঠেকিয়ে কোমড় জাপটে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
এদিকে এই ছোট্ট বাচ্চাটার মুখে সালাম আর এমন মায়াভরা শুনে পলক অভিভূত। এই তো মাত্র কয়েকদিনের পরিচিত সে মেয়েটির। তারপরেও মেয়েটা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তার মায়ায়। কি মিষ্টি করে বললছে,”আমি তোমাকে এত্তগুলা মিস করেছি”! এখন আবার মুখ গোমরা করে আহ্লাদী হচ্ছে। ইয়ানার কান্ড দেখে হেসে দিল পলক। তারপর ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে দু হাতের আঁজলায় ইয়ানার আদুরে ছোট্ট মুখখানি নিয়ে কপালে চুমু খেলো একটা। তারপর বললো,
_ওয়ালাইকুম আসসালাম, সোনা আম্মু। আমি আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
_আমিও ভালো আছি। গোমড়া মুখে বললো পলক।
_আচ্ছাহ! তাহলে আমার সোনা আম্মুর মুখটা এমন গোমড়া কেন? করুন মুখে বললো পলক।
_তুমি তো আমাকে একটুও মিস করো না। ভালোই বাসো না আমাকে।
_অহ…তাহলে আর কি! আমি যে ইনু সোনার প্রিয় চকলেট গুলো আনলাম, শুধুমাত্র আমার সোনা আম্মুটা এটা পছন্দ করে বলে।তাহলে এগুলো এখন আমি কাকে দেই?! ইনু আম্মু কে তো আমি ভালোই বাসি না। তাহলে এই ভালোবাসাগুলো এখন কাকে দিবো আমি?-ইয়ানার প্রিয় চকলেটগুলো হাতে নিয়ে বললো পলক। পলকের এহেন কথায় ইয়ানা একবার আড়চোখে দেখলো তাকে।তারপর চকলেটগুলো দেখেই খুশিতে ঝাপিয়ে পড়ে জাপটে ধরলো পলকে। বললো,
_Thank u maamoni. I love u so much.-বলেই পলকের গালে চুমু খেলো সে। পলকও টুক করে ইয়ানার গালে একটু চুমু খেয়ে নিল। আর এদের এই আদর আহ্লাদ দেখে রেস্টুরেন্টের সবাই বেশ মুগ্ধ। সব থেকে বেশি খুশি রুকু। তার বড্ড চিন্তা ছিল ভাইয়ের বউকে নিয়ে।সিফাতের সাথে ইয়ানার সম্পর্ক কতটা গভীর সেটা তাদের পরিবার, আত্মীয়দের সব্বাই বেশ ভালো করেই জানে। সেখানে সিফাতের বউ যদি ইয়ানাকে সিফাতের মত ভালোবাসতে না পারে! মেনে না নেয় নিজের মেয়ের মত! কিন্তু পলককে দেখে ওর সত্যিই বড্ড স্বস্তি লাগে। সিফাত নিজের জন্য সঠিক মানুষকেই বেছে নিয়েছে। মেয়েটার মনটা সত্যিই মাটির মত। এসব ভাবতে ভাবতেই সে এগিয়ে গেল পলকের দিকে। কাছে যেতেই ইয়ানাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_আম্মা, তোমার মামণিকে ছাড়ো এখন। সে তো মাত্রই এসেছে স্কুল থেকে। টায়ার্ড এখন। আগে লাঞ্চ করে নিক তারপর তুমি তোমার মামণির কাছে যেও, কেমন?
_আচ্ছা আম্মু।ইয়ানা বললো। তারপরই পলকে উদ্দেশ্য করে রুকু বললো,
_আসসালামু আলাইকুম পলক। কেমন আছো তুমি?
রুকুর সালাম দেওয়া দেখে বেশ লজ্জা পেল পলক। সালামটা তারই আগে দেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু, ইয়ানার সাথে কথা বলতে বলতে সেই সুযোগটাই হলো না তার। তবুও,মুচকি হেসে জবাব দিল।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম আপু। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
_আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আমিও। এসো।
বলেই হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল তাদের বুক করা টেবিলে। সেখানে রিহান আর মিসেস. রেহনুমাও ছিল। তাদের দেখেও পলক সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। তারপর রেহনুমা বললো,
_সিফাত!বাবা, তুই আর পলক লাঞ্চ করে নে। আমারা খেয়ে নিয়েছি। তোরা খেয়ে দেয়ে আয়, ততোক্ষণ আমরা নিজেদের কিছু টুকিটাকি শপিং আছে..সেগুলো করে নেই। তোদের হলে কল দিস।
_আচ্ছা,ঠিক আছে। – সিফাত বললো।
তারপরেই, সিফাত আর পলককে রেখে বাকিরা বেরিয়ে গেল শপিং এর জন্য। তারা যেতেই সিফাত বললো,
_আপনি ঠিক আছেন তো মৃন্ময়ী?
_জ্বী..?হ্যাঁ..ঠিক আছি আমি।ক্যা..ক্যা.. কেন?
_না..মানে,বেশ টায়ার্ড লাগছে আপনাকে। মুখটা শুকিয়ে আছে।
_অহ..! না,I’m fine.
_ ok..But I think আপনি চোখে মুখে পানি দিলে,I mean খানিকটা ফ্রেস হয়ে নিলে ভালো লাগতো আপনার।
_হু। বলেই চুপ হয়ে গেল পলক।
সিফাতের ঠিক ভালো লাগছেনা পলকের হাবভাব।মনে হচ্ছে সে কিছু নিয়ে চিন্তিত। তারপরেও,নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পলকে ওয়াসরুমের দিকটা দেখিয়ে দিল।আর পলকও আর বেশি কিছু না বলে চলে গেল ফ্রেশ হতে।
________________________________

ওয়াসরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পলক। কান্না করার ফলে চোখ খানিকটা লাল হয়ে আছে। নিজেকে যখনই আয়নায় দেখছে শপিংমলের বাইরে ঘটা ঘটনাটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। দমবন্ধ লাগছে তার। বারেবার শুধু এটাই মনে হচ্ছে যে,কেন এতগুলো বছর পর তার অতীত তার সামনে এলো? ভুলেই তো গেছিল প্রায়। কিন্তু, আবার! আবার সেই মুখ, সেই মানুষটার মুখোমুখি হতে হলো তাকে।অথচ সামনেই তার বিয়ে! বিয়ের কথাটা মনে হতেই একবার সিফাতের কথা মনে হলো তার। সিফাতকে কি বলে দেবে সবটা? বলা তো উচিৎ তার। যার সাথে সারাজীবন থাকবে তাকে তো সব বলে কয়ে নেওয়া উচিৎ। আর যাই হোক,এই বিষয়টাকে তো জানানো উচিৎ। নয় তো ঠকানো হবে সিফাতকে। আর এটা সে কি করে করবে! মনে মনে এসব ভাবছে পলক..ঠিক তখনই মস্তিকের ভেতর থেকে কে যেন বললো,

_এত ভাবার কি আছে পলক! তোমার এই অতীত তুমি আর তিয়ান ছাড়া কেউ তো জানে না।আর তিয়ান নিজেই তো তোমায় অস্বীকার করেছিল। একলা ছেড়ে দিয়েছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তোমার থেকে যখন তোমার তাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। কই তখন তো একবারও সে তোমাকে ধরে রাখতে চায়নি। নিজের ভালোর কথা ভেবে একলা করে দিয়েছিল।এরপর তো যোগাযোগও রাখেনি কোন।মনে রাখেনি তোমাদের অনুভূতিগুলোও।আজও তো দেখলে কতটা স্বাভাবিক সে।তুমি তার বিশেষ কেউ ছিলেই না কখনো।তাছাড়া, ৩ বছর আগেই এই অতীত তুমি নিজের মাঝেই দাফন করে নিয়েছিলে। এতদিনে সেটা সময়ের আস্তরণে চাপা পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে তোমার ভিতর। কোন অস্তিত্ব নেই এখন আর এটার।তাহলে কেন পুরোনো কবর খুদে নিজের ভবিষৎকে নষ্ট করতে চাইছো?! কোন দরকার নেই এর। চুপ করে থাকো।

কিন্তু পরক্ষণেই মন বললো,

_তুমিই তো বলো পলক,সত্যি লুকিয়ে যাওয়া মিথ্যা বলার থেকেও ভয়ংকর! তাহলে,আজ স্বার্থপর..লোভী হচ্ছো কী কারণে? কেন লুকাবে তোমার এ সত্য ঐ মানুষটার কাছ থেকে? এটা জানা তো তার অধিকার।

মন আর মস্তিষ্কের দোলাচলে যখন পলক ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছিল,ঠিক তখনই জোর আওয়াজে তার ব্যাগে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। বাস্তবে ফিরে এলো সে। তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। দেখলো সিফাত কল করেছে।সিফাতের নামটা দেখতেই একরাশ অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরলো তাকে।তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে রিসিভ করলো কলটা। আর রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উৎকণ্ঠায় ভরা সিফাতের গলা পাওয়া গেল।।
_হ্যালো,,মৃন্ময়ী? কোথায় আপনি? লাস্ট ১৫ যাবৎ ওয়েট করছি আমি আপনার। এবার তো টেনশন হচ্ছে রীতিমত।
_স্যরি।আসলে আমি ফ্রেস হচ্ছিলাম। তাই একটু দেরি হয়ে গেল। আসছি এখনই আমি।
_ওকে,ফাইন।কাম ফাস্ট।
_হুম। বলেই ফোন রেখে দিল পলক। তারপর চোখ মুখে বেশি করে পানির ছিটা দিল সে। এরপর আয়নায় দেখলো নিজেকে।কিছুটা স্বাভাবিক লাগছে এখন।মুখটা মুছে ফিরে গেল টেবিলে।

পলকে দেখেই বেশ বিচলিত হয়ে গেল সিফাত। চোখমুখ কেমন লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে কি মেয়েটা? কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটা মাথায় আসতেই চকিতেই সে পলকেও জিজ্ঞেস করলো,
_আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে মৃন্ময়ী?
_ক..অ….কই না তো! বলেই ম্লান হাসলো সে।
_তবে কেঁদেছেন কেন?
সিফাতের এমন সরাসরি প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল পলক। সিফাত কি করে জানলো সে যে কেঁদেছে?!এখন কি বলবে সে? কিন্তু কিছু তো বলতে হবে। নইলে আরও সন্দেহ হবে তার। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বললো,

_না। .আ..আসলে এমন কিছু না। ওই..একটু মাথা ব্যাথা করছিল। আর মাথা ব্যাথা করলে আমার চোখ লালচে হয়ে আসে একটু।এটা কোন ব্যাপার না! -বলেই ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মৃদু হাসলো পলক। কিন্তু এতে সিফাতের মনের খটকা দূর হলো না। তিয়ানের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই পলকের চোখ মুখে এহেন মেদু ভাব সে খেয়াল করেছে। প্রথমে এটাকে ক্লান্তিভাব মনে করলেও এখন অন্যকিছু মনে হচ্ছে তার। তবে এই মূহুর্তে পলকে আর বেশি ঘাঁটতে চাইলো না সে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বললো,
_আচ্ছা। আর, স্যরি। আমারই আসলে উচিৎ হয়নি স্কুলের পরে হুট করেই এভাবে আপনাকে এখানে নিয়ে আসাটা। আপা জোর করলো, আর হাতে সময়ও কম, তাই জন্য..

_আরেএএ..না,না। কি বলছেন আপনি এসব। এমন কিছুই না। একদম ঠিক আছি আমি। আপনি ওরিড হবেন না প্লিজ।
-ওকে, ফাইন। এখন তাহলে লাঞ্চ করে নিন।তারপর আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসবো। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই দেখবেন ঠিক লাগবে।

_না,,সেটার দরকার নেই। যে কাজের জন্য এসেছি সেটা শেষ করেই বাড়ি ফিরবো। সমস্যা নেই।

আজ পলককে বেশ অন্যরকম লাগছে সিফাতের কাছে। কেমন যেন অস্থির লাগছে তার মেয়েটাকে। কিছু নিয়ে কি টেন্সড মেয়েটা? নাকি সে যা বলছে তাই সত্যি বলে মেনে নেবে সে! মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে কিছু বললো না সে। বরং লাঞ্চের পরে গরম কফি অর্ডার করলো পলকের জন্য। এতে যদি মেয়েটা একটু রিলিফ ফিল করে। তবে পলকেরএমন অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে সত্যিই বেশ উদ্বিগ্ন হলো সে।কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলো না সিফাত। চুপচাপ লাঞ্চ শেষ করে তারা বেরিয়ে গেল শপিং এর জন্য।

চলবে…