ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব-০১

0
717

#ভালোবাসি_হয়নি_বলা
#সূচনা_পর্ব
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে দেখার মতো যন্ত্রণা যে কতটা কষ্টের তা আজ বুঝেছে নূর।
নিজের চোখের সামনে তার প্রিয় মানুষটি আজ অন্য কারো হয়ে গেলো।
অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো সামনে স্টেজে বসে থাকা ফারাজ আর তার বউয়ের দিকে নূর। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কান্না গুলো চিৎকার রূপে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে দুই-হাত দিয়ে নিজের মুখ শক্ত করে চেপে ধরলো নূর। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে।

পাঁচটা বছর এই মানুষকে নিয়ে সে স্বপ্ন বুনেছে। কত-শত স্বপ্ন দেখেছে সে। একটু একটু করে জমানো স্বপ্ন যেনো এক মিনিটেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। নিজের চোখকে আজ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ভালোবাসা কেনো এতো যন্ত্রণা দেয়..? ফারাজ শুধু বিয়ে করেনি ওর সুখ টুকু কেঁড়ে নিলো। একবার ফারাজের সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে ফারাজ আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচবো না, আপনাকে ছাড়া আমি বেঁচে থেকেও মৃত। নূর দৌড়ে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

রাস্তার মাঝে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো।রাস্তার মধ্যে কেউ নেই। নূর একবার সারা রাস্তায় চোখ বুলালো তারপর সুনশান নিরবতা ভেঙে চিৎকার করে বলে উঠলো,’ আমি আপনাকে এতোটা ভালোবেসেও কখনো বলতে পারলাম না স্যার। সবাই বলে এটা নাকি আমার আপনার প্রতি আবেগ কিন্তু আমি তো জানি এটা কোনো আবেগ নয়। সেই পাঁচ বছর আগে থেকে আমি আপনাকে ভালোবেসে এসেছি। কখনো সামনা-সামনি বলার সাহস হয়নি। যেই আপনার পাশে কাউকে সহ্য হতো না সেই আপনি আজ সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হয়ে গেলেন!! আপনার সাথে দেখা হওয়াটা আমার ভুল ছিলো, কেনো আমাদের দেখা হলো..? কেনো আমি আপনাকে ভালোবাসলাম..? কেনো আজ আপনি অন্য কারো..? নূরের নিজেকে এখন নিজের পাগল পাগল মনে হচ্ছে । এটা যদি স্বপ্ন হতো, সব কিছু যদি স্বপ্ন হতো। আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো নূর৷
উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো নিজের বাড়ির দিকে।

ফারাজ আর নূরের বাড়ি পাশাপাশি।

[ ফারাজ যখন প্রথম এখানে আসে তখন নূর ১৫বছরের কিশোরী মেয়ে। অন্য মেয়েদের মতো নূরও প্রথম দেখায় ফারাজের প্রেমে পড়ে যায় ।

প্রতি দিন নূর ফারাজের বাড়ির সামনে মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতো ফারাজ কে একবার দেখার জন্য।
প্রতিদিন বাচ্চাদের চকলেট দিয়ে ফুল পাঠাতো ফারাজ এর কাছে। কখনো নিজে ওর সামনে যাওয়ার মতো সাহস হয়ে উঠেনি।
আসতে আসতে ওর পাগলামো বেড়ে চললো ফারাজের জন্য। পুরো ক্লাসের সবাই ওকে নিয়ে মজা শুরু করলো কিন্তু কেউ জানতো ফারাজ টা কে..? এক সময় সবাই ওর নাম দিলো ফারাজের বউ। যখন কেউ ফারাজের বউ বলে ডাক দিতো লজ্জায় নূর মাথা নিচু করে মুচকি হাসতো।
নূর প্রতি রাতে ফারাজ কে কল দিয়ে জ্বালানো শুরু করলো।

এভাবে কেটে গেলো চারটি বছর। নূর ফারাজের ভার্সিটিতে ভর্তি হলো বিজ্ঞান বিভাগে।

ফারাজ বিজ্ঞান বিভাগের সব থেকে ভালো টিচার।
দিনের পর দিন নূরের ভালোবাসা আরও বেড়েই চললো সে এবার ঠিক করে নিলো অনেক হয়েছে লুকোচুরি এবার সে ধরা দিবে।
কিন্তু দেখা দেওয়ার আগেই ফারাজ অন্য কারো হয়ে গেলো। ]

কিছু সময়ের মধ্যে নূর নিজের বাসায় চলে আসলো।

বাসার ভেতর প্রবেশ করেই দেখলো রাবেয়া বেগম এর রুম থেকে কিছু শব্দ আসছে।
দৌড়ে মায়ের রুমে গেলো নূর।

রাবেয়া বেগমের বুকের ব্যাথা বেড়ে গেছে।
নূর মায়ের মুখে হাত রেখে বলে উঠলো,’ আম্মা ডাক্তার ডাকবো..? কষ্ট হইতাছে বেশি..?

রাবেয়া বেগম চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন। নূরের হাতে হাত রেখে বললো,’ নূর তোর আব্বু হয়তো আমাকে ডাকছে আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুই তোর নিজের খেয়াল রাখবি মা। আমি তোর সুখ দেখে যেতে পারলাম। বলেই আর কথা বলতে পারছেন না হাত দিয়ে কি যেনো ইশারা করছেন।
নূর কান্নায় ভেঙে পরলো। একের পর এক ধাক্কা যেনো ওকে ভেতর থেকে একদম ভেঙে দিচ্ছে। একমাত্র মা ছিলো তার সঙ্গি আজ মা চলে গেলে সে একদম এতিম হয়ে যাবে। তাকে আগলে রাখার মতো কেউ নেই। মাথায় হাত রেখে বলার মতো কেউ নেই আমি তোমার পাশে আছি।

বাবা অনেক আগে মা-রা গেছে… নিজের মায়ের সম্পর্কে কিছুই জানে না নূর। ওর আব্বু আম্মু পালিয়ে বিয়ে করে যার কারনে ওর আম্মুকে ওর নানা ভাই নিজের মেয়ে হিসেবে আর কোনে দিন ও মেনে নেয়নি। কেউ ওর আম্মুর খুঁজ ও কখনো নেয়নি।

নূর ওর আম্মুকে ছেড়ে ডাক্তার কে কল দেয়।

হসপিটালের করিডোরে চিন্তিত হয়ে বসে আছে নূর।

ডাক্তার ICU রুম থেকে বের হতেই নূর গিয়ে সামনে দাঁড়ালো।

নূরঃ ডাক্তার ভাইয়া আম্মু ঠিক আছে তো..?
ডাক্তারঃ নূর আন্টির শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। আমি তোমাকে মিথ্যা বলতে পারবো না।

নূর মুখে হাত দিয়ে কান্না করতে শুরু করলো।

ডাক্তারঃ নূর আন্টির যদি শেষ কোনো ইচ্ছে থাকে তাহলে তুমি পূরণ করে দাও। বলেই ডাক্তার সেখান থেকে চলে গেলো।

নূর মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো সেখানে।

মায়ের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নূর।
মায়ের হাতে হাত রেখে বলে উঠলো,’ আম্মু….!
কোনো সারা শব্দ নেই।
নূরঃ আম্মু।
পিটপিট করে চোখ খোলে তাকালো রাবেয়া বেগম।
নূর নিজের বাবার ছবি ওর মায়ের সামনে ধরলো।

মলিন একটা হাসি দিলো রাবেয়া বেগম স্বামীর ছবি দেখে।

নূর আবার বলে উঠলো,’ আম্মু নানুকে দেখতে ইচ্ছে হয়..? ‘
রাবেয়া বেগম এর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে জল।

নূর ওর আম্মুর হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে পরলো মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে। যতোই কষ্ট হোক সে তার মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে। মায়ের ডাইরিটা বুকে চেপে বললো,’ আমি তোমার প্রিয় মানুষগুলোকে তোমার সামনে নিয়ে আসবো আম্মু.. চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো হসপিটাল থেকে।

_____

সকাল থেকেই চৌধুরী বাড়িতে খুশির আমেজে ভরে উঠেছে। বাড়ির মহিলারা বিভিন্ন আইটেমের রান্নার কাজে লেগে গেছে । পাঁচ বছর পর দেশে আসছে এই বাড়ির ছোটো ছেলে রুদ্র চৌধুরী।

বাড়ির বাচ্চাদের ও জেনো আনন্দের শেষ নেই।

বাড়ির বড় কর্তা আনুয়ার চৌধুরী এসে উনার তিন ছেলেকে বললো গাড়ি বের করতে।

বাড়ির বড় ছেলে হানিফ চৌধুরী। মেঝো ছেলে আজাদ চৌধুরী। আর ছোটো ছেলে রায়হায় চৌধুরী। তিন ভাই..

হানিফ চৌধুরীর তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক মেয়ে ক্লাস ৯এ পড়ে।
আজাদ চৌধুরীর এক মেয়ে। এবার ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছে।
রায়হান চৌধুরীর এক ছেলে এক মেয়ে । ছেলে রাশিয়া থেকে ডাক্তারি পড়া শেষ করে দেশে আসছে আর মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে।

এই বংশে শুধু একটাই ছেলে রুদ্র চৌধুরী। তাই তাকে নিয়ে সবার স্বপ্ন অনেক।

গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো সবাই।

_____

নূর ডাইরির পাতা উল্টে আবার দেখলো গ্রামের নামটা ঠিক আছে কিনা…
আনন্দপুর চৌধুরী বাড়ি।

কিন্তু গিয়ে কি বলবে ও..? ওরা কেউ তো ওকে চিনবে না… প্রথমে যদি গিয়ে বলে আমি আপনার মেয়ে রাবেয়ার মেয়ে তাহলে ঠিক হার্ট বরাবর বন্দুক তাক করবে। আগে বাড়িতে গিয়ে বাড়ির পরিস্থিতি বুঝতে হবে। মায়ের প্রতি তাদের ঘৃণাটা কতোটুকু দেখতে হবে না হলে মায়ের শেষ ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারবো না। উল্টো নিজের জান দিতে হবে।

নূর আল্লাহর নাম নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলো। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না।হাতেও বেশি সময় নেই।

নূর গ্রামে ডুকতেই দুইটা গাড়ি ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
কিছু দূর গিয়ে একটা গাড়ি থেমে গেলো।
গাড়ি থেকে নেমে আসলো একজন বৃদ্ধ লোক।
নূর ভ্রু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকালো।
বৃদ্ধ লোকটা নূরের সামনে এসে ভালো করে ওর দিকে তাকালো অনেক দিন পর যেনো তার মেয়েকে দেখতে পেলো চোখের সামনে।
বৃদ্ধঃ তুমি কে..? কোথায় থেকে এসেছো..? আগে তো গ্রামে কখনো দেখিনি…
নূরঃ আমি নূরে হাফসা। আসলে নানাভাই আমি রাস্তা ভুলে ফেলেছি। ভুল করে এই গ্রামে এসে পড়েছি।

বৃদ্ধঃ তাহলে চলো আমরা শহরের দিকে যাচ্ছি তোমাকে তোমার শহরে দিয়ে আসবো।
নূরঃ না, না কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে পারবো।

বৃদ্ধ লোকটি নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,’ তোমার মায়ের নাম কি..???
নূর কিছু বলার আগেই । পেছন থেকে রায়হান চৌধুরী বলে উঠলো আব্বা দেরি হয়ে যাচ্ছে….

চলবে…

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।