ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব-০৬

0
344

#ভালোবাসি_হয়নি_বলা
#পর্ব_৬
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

আজ তিন ধরে নূর কারো সাথে কথা বলছে না। সব সময় দরজা বন্ধ করে রুমে বসে থাকে।

রাবেয়া বেগম মা’রা গেছে আজ তিন দিন।
রাবেয়া বেগম মারা যাওয়ার পর নূর পাগলের মতো চিৎকার করে কান্না করেছে। তারপর আর নূর কে কেউ কান্না করতে দেখেনি।

সালমা বেগম হাতে খাবার নিয়ে নূরের রুমে গেলো৷
সালমা বেগমঃ নূর খেয়ে নে মা।
নূর কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাহিরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশের তাঁরার মাঝে নিজের মা’কে খুজঁতে সে এখন ব্যস্ত।

সালমা বেগম নিজে এক লোকমা নিয়ে নূরের মুখের সামনে ধরলো।

নূরঃ খাবো না মামি।
সালমা বেগমঃ এখন না খেলে রুদ্র এসে জোর করে খাওয়াবে খেয়ে নে হা কর।
নূর সালমা বেগম এর কাছ থেকে প্লেট নিয়ে বলে উঠলো,’ আমি খেয়ে নিবো তুমি যাও।

সালমা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
নূর সহজে কারো সাথে কথা বলতে চায় না। রুদ্র সব সময় জোর করে নিজে খাইয়ে দেয়।

নূর খাবো বলে এই খাবার যেখানে রাখে সেখানেই নষ্ট হয়ে থাকে।

রুদ্র রাতে বাসায় এসেই প্রথমে নূরের রুমে গেলো।

নূর ঘুমিয়ে আছে টেবিলের পাশেই খাবার ভর্তি প্লেট।

রুদ্র নূরের রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই নূর চোখ খোলে উঠে রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো।

রুদ্র ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই হানিফ চৌধুরী রুদ্র কে ডেকে বলে উঠলো, ‘ এখন কি করবো রুদ্র..?
রুদ্র হানিফ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ দাদাভাই এর অবস্থা কেমন..?’
হানিফ চৌধুরীঃ ভালো না। আব্বা কারো সাথে কথা বলে না, খাবার খায় না।
রুদ্রঃ সব ঠিক হয়ে যাবে বড় আব্বু কিন্তু একটু সময় লাগবে।
হানিফ চৌধুরীঃ আর নূর..!
রুদ্র কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো,’ নূর এখানেই থাকবে আর ইভার সাথে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেন আপনি। ‘
হানিফ চৌধুরীঃ ওকি থাকবে…?
রুদ্র কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠলো,’ ওর যাওয়ার মতো এখন কোথাও জায়গা নেই। এখানেই থাকতে হবে না থাকতে চাইলেও এখানেই থাকতে হবে। ‘

আয়েশা বেগম রান্না ঘরে কাজ করছেন আর নূরের কথা ভাবছেন। এতো ভালো একটা মেয়ের জীবন কেনো এমন হলো। একদম এতিম হয়ে গেলো! আয়েশা বেগম কখনো রাবেয়া বেগম কে দেখেননি। তবে অনেক বার নিজের স্বামী আর বড় জা এর কাছে শুনেছেন। খুবি ভালো আর মিশুক মেয়ে ছিলো রাবেয়া বেগম।

রুদ্র গিয়ে ওর আম্মুকে বলে উঠলো, ‘ আম্মু..?
আয়েশা বেগম ছেলের ডাক শুনে নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে ছেলের দিকে তাকালো।

~ কি হয়েছে..?
~আম্মু একটু নূরের কাছে যাবে..
আয়েশা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো, ‘ কেনো ওর কি কিছু হয়েছে..?
রুদ্রঃ না আম্মু কিছু হয়নি। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখো আম্মু এখন নূরের তোমাদের আদর, ভালোবাসা প্রয়োজন। ওর পাশে তোমরা থাকলে খুব তারাতারি ও ঠিক হয়ে যাবে। এখন ওর আপন বলতে তোমরাই।

আয়েশা বেগম ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,’ হুম বুঝতে পেরেছি আর বলতে হবে না। আমাদের আরেক মেয়ে ও, আমরা নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসে ওকে সুস্থ করে নিবো।
রুদ্র ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘ ধন্যবাদ আম্মু…’

কেটে গেছে তিন মাস। নূর এখন আগের মতো হাসে, সবার সাথে আগের মতো দুষ্টমি করে।

এই তিন মাস সবাই ওকে নিজের মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবেসেছে সব সময় ওকে আগলে রেখেছে। বিশেষ করে ইভা, নীলা সব সময় ওর পাশে পাশে থেকেছে ওকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে।
রুদ্র দূর থেকে ওর হাসি দেখে নিজেও হেঁসেছে।

নূর এখন ইভার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।

ইভা গিয়ে নূরের মুখে এক জগ পানি ডেলে দিলো।

নূর ভয়ে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে।
নূরের অবস্থা দেখে ইভা হাসতে হাসতে বিছানার মধ্যে লুটিয়ে পড়লো।
নূরঃ ইভার বাচ্চা এভাবে কেউ পানি দেয়!!
ইভাঃ তো কিভাবে দেয়..?
নূরঃ এদিকে আয় দেখাচ্ছি।
ইভাঃ থাক বইন আমার ওতো দেখার সখ নেই।

নীলা মাথা চুলকাতে চুলকাতে নূরের রুমে ঢোকে বলে উঠলো, ‘ এই নূর আপু আমার মাথাটা একটু দেখে দাও না। মনে হয় উকুন হয়েছে।
ইভা নীলার মাথায় গাট্টা মেরে বলে উঠলো,’ গাঁধি কয়টা বাজে দেখ! আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে তারাতারি রেডি হয়ে নিচে যা।
দশ মিনিটের কথা শুনে সব গুলোর চোখ চড়কগাছ।

তারাতারি সবাই রেডি হয়ে নিচে যেতেই সালমা বেগম তিন জনকে তিন লোকমা জোর করে খাইয়ে দিলো।

ভার্সিটির সামনে গিয়ে নীলা বলে উঠলো, ‘ আপু একটা সিনিয়র ভাইয়া আমাকে অনেক ডিস্টার্ব করছে।’
নূরঃ কেনো..? শুধু শুধু তো ডিস্টার্ব করার কথা নয় কি করছো তুমি..?
নীলাঃ সত্যি আপু আমি কিছু করিনি।
ইভাঃ আচ্ছা চল সামনে পড়লে দেখাইস ছেলেটা কে। কত বড় সাহস আমার বোনের দিকে নজর দেয়। আজ তারে দেখে নিবো।

নীলা চোরা চোখে ইভার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,’ থাক আপু।’
নূর ভ্রু কুঁচকে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু তো একটা করেছে শুধু শুধু তো আর ডিস্টার্ব করে না।

ওরা তিন জন ভার্সিটির মাঠের এক কোনায় বসে পড়লো।

কিছু সময় পর একটা ছেলে এসে বললো,’ এখানে ইভা কে..?
ইভা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,’ কেনো..?
~ ইভা ভাবি কে বড় ভাই ডাকছে।
ইভা অবাক হয়ে বললো,’ ভাবি!!..
নূর ভ্রু কুঁচকে ইভার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তলে তলে টেম্পো চালাও…
ইভাঃ একদম না নূর। আমি বড় ভাই কে কিছুই চিনিনা। আর এই ছেলে আমাকে ভাবি কেনো ডাকছো হা। দেখো গিয়ে ইভা নামের অনেক মেয়েই আছে।
~ না ভাবি ভাই আপনারেই বলছে।
ইভা রেগে বলে উঠলো, ‘ আরেক বার ভাবি বললে মুখ সেলাই করে দিবো ছেলে। ভালো চাইলে এখান থেকে যা।

নীলা ভয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ আপু আমি আমার ক্লাসে যাই। ‘

নূর আবারও নীলার দিকে তাকালো। এই মেয়ে কি কিছু লোকাচ্ছে..?!

ওরা ক্লাসে গিয়ে শুনলো কাল কে নতুন বিজ্ঞান টিচার আসবে।

নূর কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো। অনেক দিন পর ফায়াজ স্যারের কথা মনে পরলো। হয়তো বউ নিয়ে খুব সুখি আছে। উনি হয়তো কোনো দিন জানতেও পারবে না দূর থেকে লুকিয়ে কেউ একজন তাকে অসম্ভব ভালোবেসে গেছে। আজকাল আর কারো কথা ভেবে চোখ থেকে পানি পড়ে না। শুধু ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।

রুদ্র বসে আছে আনোয়ার চৌধুরীর সামনে।
রুদ্রঃ দাদাভাই…
আনোয়ার চৌধুরীঃ দাদুভাই তুমি এই সময়..
রুদ্রঃ কেমন লাগছে এখন..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ ভালো…
রুদ্রঃ এভাবে চলে না দাদাভাই তোমার নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ করো। সময় চলে যাওয়ার পর আর আপসোস করে লাভ নেই।

আনোয়ার চৌধুরীঃ নূর কোথায়..?
রুদ্রঃ নূর ঠিক আছে।
আনোয়ার চৌধুরীঃ বাসায় আসলে আমার সাথে দেখা করতে বলিস।
রুদ্রঃ দাদাভাই হসপিটালের কাজ শেষ।
আনোয়ার চৌধুরীর মুখে আজ হাসি নেই। কতো সখ ছিলো এই গ্রামে নিজের হসপিটাল হবে। নিজের নাতি প্রথম ডাক্তার হয়ে জয়েন করবে।কত যে অপেক্ষা করেছে এই দিন টির। কিন্তু আজ তার চোখে মুখে সেই অপেক্ষার খুশির কোনো ছিটেফোঁটাও নেই।

রুদ্র আনোয়ার চৌধুরী রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই ধাক্কা খেলো নূরের সাথে।
নূর রেগে রুদ্র কে বলে উঠলো, ‘ আপনি কি চোখে দেখে চলতে পারেন না! সব সময় আমার সামনে এসে কেনো পড়েন…!!?
রুদ্রঃ তুমি নিজে দেখে শুনে চললেই হয় নূর। এখানে তোমার দোষ আমার না।
নূরঃ ওহ আচ্ছা.. আমি তো দেখেই চলছিলাম আপনি নিজেই ইচ্ছে করে আমার সাথে ধাক্কা খেলেন৷
রুদ্র বুকে হাত গুঁজে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আচ্ছা তুমি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাচ্ছো..?
নূরঃ আমাকে দেখে কি আপনার ঝগড়াটে মনে হয়!
রুদ্রঃ না এমনটা আমি কখন বললাম।
নূরঃ আপনার কথায় তো বুঝা যায়।

কুলকুল আক্তার নূর আর রুদ্র কে ঝগড়া করতে দেখে ওদের সামনে এসে বলে উঠলো, ‘ কি হয়েছে রুদ্র তোমরা ঝগড়া কেনো করছো..!?
নূর কিছু বলার আগেই রুদ্র বলে উঠলো, ‘ মেঝো আম্মু আমরা ঝগড়া কোথায় করছি আমি তো নূরকে পড়াশোনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছি।
নূর অবাক হয়ে রুদ্রের দিকে তাকালো। কতো মিথ্যাবাদী।
কুলসুম আক্তারঃ কিন্তু তোমাদের দেখে তো ঝগড়া করছো মনে হলো..!
রুদ্রঃ তেমন কিছু না মেঝো আম্মু।
কুলসুম আক্তার একবার নূরের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। এইসব ব্যাপারে নাক গলিয়ে কাজ নেই উনি তো আজ নীলা আর রুদ্রের বিয়ে নিয়ে কথা বলবেন। কতো স্বপ্ন এই চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ হবে নিজের আদরের মেয়ে।

কুলসুম আক্তার চলে যেতেই নূর চোখ ছোটো ছোটো করে বলে উঠলো,’ আপনি মিথ্যা কেনো বললেন..?’
রুদ্রঃ তোমার এই ঝগড়াটে মাথায় এসব ঢোকবে না।
নূরঃ আপনি আমাকে আবার ঝগড়াটে বললেন!

রুদ্র নূরের হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চোখ মেরে চলে গেলো।
নূর হা করে রুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো!! একবার হাতের চকলেট এর দিকে তাকিয়ে আবার রুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকালো….

চলবে…
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।