ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব-০৫

0
360

#ভালোবাসি_হয়নি_বলা
#পর্ব_৫
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

নূর রুদ্রের পাশ থেকে দাঁড়িয়ে আনোয়ার চৌধুরীকে বলে উঠলো,’ আমার মনে হয় আপনাদের এখন চলে যাওয়া দরকার। আর ধন্যবাদ আমার রিকোয়েস্ট রাখার জন্য। ‘

আনোয়ার চৌধুরীঃ আমি তোমার রিকোয়েস্ট না আমি আমার মেয়েকে দেখতে এসেছি।
নূর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো,’ আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আপনার মেয়ে আজ থেকে ১৭বছর আগে মা-রা গেছে। এখানে যে আছে তার একটাই পরিচয় সে আমার আম্মু…!

আনোয়ার চৌধুরী কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে পড়লেন।

কিছু জেদ,রাগ,অভিমান এর কারনে কাছের প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যায়।

নূরঃ আমি চাই আপনারা সবাই খুব জলদি এখান থেকে চলে যান। আর ভুলে যান সব কিছু আজ যা যা হয়েছে সব ভুলে গেলেই ভালো হবে। আর দ্বিতীয় বার এখানে আপনাদের না দেখলে খুশি হবো।

ইভাঃ নূর আমি থাকি না প্লিজ আমি থাকি এখানে।
নূরঃ কোনো প্রয়োজন নেই ইভা। এখানে থাকতে হবে না তুমি বাড়িতে চলে যাও। আর ভুলে যেও নূর নামের কারো সাথে তোমাদের কখনো কথা হয়ে ছিলো।

ইভা কান্না শুরু করে দিলো। সে কিছুতেই যাবে না।

এমনি তেই আম্মুকে নিয়ে নূরের টেনশন তার উপর আরেক জ্বালা।

ডাক্তার অভিক এসে ছিলো নূরের সাথে কথা বলতে সে এখন মনে মনে ভাবছে, ‘ এই মেয়ে কি কাঁদতে পছন্দ করে নাকি। আসার পর থেকে কিছু হতে না হতেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিচ্ছে । একটা মেয়ে এতো কাঁদতে পারে কিভাবে। এইগুলো চোখ নাকি সাগর!..?

রুদ্রঃ ইভা চুপ করো আর দাদাভাই তোমারও বাসায় চলে যাওয়া দরকার। মেডিসিন তো সাথে নিয়ে আসোনি।এখন বাড়িতে চলো না হলে নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবে।

আনোয়ার চৌধুরীঃ কিছুই হবে না আমার দাদুভাই। আমি আমার মেয়েকে আরও ভালো ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতে চাই । যত টাকা লাগুক আমার মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে চাই।

নূরঃ আপনার কি মনে হয় আমি আমার আম্মুর চিকিৎসা করাচ্ছি না..? আমার যথেষ্ট সামর্থ্য আছে আমার আম্মুকে ভালো ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু এখন কোনো ডাক্তার আম্মুকে সুস্থ করতে পারবে না।

নূর রাগে ডাক্তার অভিক এর কেবিনে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই দেখে ডাক্তার অভিক দাঁড়িয়ে আছে।

নূরঃ অভিক ভাইয়া…

… ডাক্তার অভিক….
নূর একবার ইভার দিকে আরেক বার ডাক্তার অভিক এর দিকে তাকিয়ে রেগে বলে উঠলো,’ ডাক্তার অভিক আপনি শুনতে পাচ্ছেন…!

ডাক্তার অভিক নূরের কথা শুনে নিজের ভাবনা থেকে বের হলো। নূরের দিকে তাকিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে উনার দিকেই তাকিয়ে আছে নূর।

ডাক্তার অভিক এদিক ওদিকে তাকিয়ে নূরের দিকে তাকালো।

~হুম বলো..?
নূরঃ কিছু কি বলার ছিলো..?
অভিকঃ হুম তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসে ছিলো।
নূরঃ কখন..?
ডাক্তার অভিকঃ গতকাল…
নূরঃ কে ছিলো.? নাম বলেছে..?
ডাক্তার অভিকঃ না, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু একটা নাম্বার দিয়ে গেছে। তুমি আসলে যেনো তোমাকে দেই।
নূরঃ আচ্ছা।
ডাক্তার অভিকঃ আসলে নাম্বারটা যে কোথায় রেখেছি খুজে পাচ্ছি না।
নূরঃ ওহ আচ্ছা সমস্যা নেই। প্রয়োজন হলে আবার আসবে।
ডাক্তার অভিকঃ আচ্ছা তুমি আমার সাথে এসো।

নূর রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমি এসে আপনাদের আর এখানে না দেখলে খুশি হবো।

ডাক্তার অভিক একবার ইভার দিকে তাকিয়ে নূরকে নিয়ে চলে গেলো।

নূর ডাক্তার অভিক এর সাথে চলে যেতেই রুদ্র আনোয়ার চৌধুরী আর ইভা কে বললো বেরিয়ে পরতে।

আনোয়ার চৌধুরীঃ রুদ্র আমি আমার মেয়েকে এমন অবস্থায় রেখে কিছুতেই যাবো না।
রুদ্রঃ আগামীকাল আবার আমি তোমাকে নিয়ে আসবো।
ইভাঃ প্লিজ ভাইয়া নূর একা থাকবে আমি থাকি।
রুদ্রঃ প্রয়োজন নেই ইভা নূর এর চিন্তা তুমি করতে হবে না। আম্মু হয়তো তোমার জন্য টেনশন করছে।

রুদ্র বুঝিয়ে শুনিয়ে আনোয়ার চৌধুরী কে রাজি করালো।

আনোয়ার চৌধুরী মেয়েকে কাঁচের ফাঁক দিয়ে এক নজর দেখে নিলেন তারপর রুদ্রের সাথে বেরিয়ে পরলো। হয়তো এটাই তার শেষ দেখা।

নূর সবাই কে চলে যেতে দেখে শান্তিুর নিশ্বাস ফেললো। প্রয়োজন নেই আজ কারোর। শুধু মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য উনাদের এনেছে।

নূর গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। কতো কথা বলা বাকি। না শুনেই চলে যাবে আম্মু। আমি বড় একা প্লিজ আর একা করে যেও না।

নূর ওর আম্মুর কেবিনের বাহিরে বসে আছে। পাশে কাউকে বসতে দেখে তাকালো।
নূরঃ আপনি…!!?
রুদ্রঃ হুম দেখতেই তো পাচ্ছো.. এখন চুপচাপ এটা খেয়ে নাও।
নূরঃ আপনি যাননি…!
রুদ্রঃ হুম গিয়ে ছিলাম দাদাভাই, ইভা ওদের দিয়ে আসলাম।
নূরঃ আবার কেনো এসেছেন..?
রুদ্রঃ এতো বেশি কথা কেনো বলো। চুপচাপ খেয়ে নাও সারাদিন তো মনে হয় কিছুই খাওনি।
নূরঃ এইগুলো এনে দয়া দেখাচ্ছেন..? আর আমি খেয়ে নিয়েছি।
রুদ্রঃ এটা কে দয়া বলে না ওকে। তুমি নিজে খাবে নাকি আমি অন্য ব্যাবস্থা করবো..?
নূরঃ ওফ্ফ বললাম তো খাবো না। আর অন্য ব্যাবস্থা মানে..?
রুদ্র বাঁকা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,’ তুমি কি আমার হাতে খেতে চাচ্ছো..?
নূরঃ একদম না!!.
রুদ্রঃ তাহলে নিজে খেয়ে নাও। নাহলে জোর করে আমি খাইয়ে দিবো।
নূরঃ আপনি কি আমাকে জ্বালাতে এসেছেন..? প্লিজ রুদ্র আমাকে এখন একা থাকতে দেন। আপনি চলে যান।
রুদ্রঃ ঠিক আছে আগে খেয়ে নাও।
বিরক্ত হয়ে নূর খাবারটা খেয়ে নিলো। এমনিতেও খুব খিদে লেগে ছিলো।
নূরঃ এবার চলে যান।
রুদ্রঃ এতো তারা দিচ্ছো কেনো..? এখানে আমার ফুপিমণি থাকে। আর আমি আমার ফুপিমণিকে একা রাখে কিছুতেই যাবো না।

নূর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে নিলো। খুব ক্লান্ত লাগছে।

_________

আনোয়ার চৌধুরী তিন ছেলের সামনে বসে আছেন। তিন বউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে।

আজাদ চৌধুরীঃ কিছু বলবেন আব্বা..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ হুম বলার জন্যই তোমাদের ডেকে এনেছি।
হানিফ চৌধুরীঃ কি হয়েছে আব্বা আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো..? কিছু কি হয়েছে..?

আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমরা আমার তিন ছেলে এক মেয়ে।

সবার মন কেমন করে উঠলো.. অনেকগুলো বছর পর আনোয়ার চৌধুরীর মুখে মেয়ের কথা শুনে। সবাই তো ভুলেই গিয়ে ছিলো এই বাড়িতে একটা মেয়ে ছিলো সেই কথা।

আজাদ চৌধুরীঃ জ্বি আব্বা।
আনোয়ার চৌধুরীঃ তোমাদের মা মা-রা যায় রাবেয়াকে জন্ম দিতে গিয়ে। আমি তখন কষ্ট পেলেও ভেঙে পরিনি কারন আমার সামনে ফুটফুটে আমার রাজকন্যা শুয়ে ছিলো৷ আমি ওকে কোলে নিয়ে সব ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাদের যেনো অবহেলিত না হওয়া লাগে তাই দ্বিতীয় বিয়ের কথা আমি কখনো ভাবিনি। আমি নিজে থেকেই তোমাদের নিজ হাতে মানুষ করেছি। শুধু একটা ভুলের জন্য আমার রাজকন্যা কে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। রাগ, জেদ আমাকে অন্ধ করে দিয়ে ছিলো।

হানিফ চৌধুরীঃ এতো বছর পর আব্বা এইসব কথা কেনো উঠছে। আমি আপনাকে অনেক বার বুঝিয়ে ছিলাম রাবেয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সে হয়তো ভুল করেছে আমরা বড় আমাদের উচিত ছিলো ওকে ক্ষমা করে দেওয়া আপনি কখনো আমার কথা শুনেন নি৷ আমি অনেক বার লুকিয়ে ওর ওর সব খুজ খবর রেখেছি কিন্তু আজ পাঁচ বছর ধরে আমি ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।

আনোয়ার চৌধুরীঃ রাবেয়া আজকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।

সালমা বেগম কাঁদে বলে উঠলো,’ কি বলছেন আব্বা রাবেয়ার কি হয়েছে..?
আনোয়ার চৌধুরী ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন। এই মানুষটি ছিলো রাবেয়ার সব থেকে প্রিয় একজন মানুষ।
সালমা বেগমঃ কি হয়েছে বলেন আব্বা..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ ব্রেইন টিউমার।
সালমা বেগমঃ আপনি জানলেন কিভাবে..?
আনোয়ার চৌধুরীঃ এতোদিন যেই মেয়েটি আমাদের বাড়িতে ছিলো সে রাবেয়ার মেয়ে।
সবাই আরও অবাক হয়ে গেলো।
সালমা বেগমঃ তাই তো আমি এই মেয়ের মাঝে আমার ননদীকে খুঁজে পেয়েছি।

আজাদ চৌধুরীঃ এখন কোথায় আছে..? কেমন আছে..?

আনোয়ার চৌধুরী সবাইকে সবটা খুলে বললো।

হানিফ চৌধুরীঃ এতো কিছু ঘটে গেলো আর আমরা কিছুই জানিনা বলেই মাথা নিচু করে বসে আছেন।

__________

নূর কাঁচের বাহির থেকে তাকিয়ে আছে রাবেয়া বেগম এর দিকে।
রাবেয়া বেগম এর হাত নড়তে দেখে নূর নিজের মায়ের কাছে গেলো।

নূর রাবেয়া বেগম এর হাতটি শক্ত করে ধরে বলে উঠলো, ‘ আম্মু, আম্মু তাকাও না আম্মু, কথা বলো আম্মু, আমার খুব কষ্ট হয় আম্মু, আমার তোমার সাথে আগের মতো গল্প করতে ইচ্ছে হয়, তুমি সুস্থ হয়ে উঠো আম্মু আমার জন্য, শুধু মাত্র আমার কথা ভেবে সুস্থ হয়ে যাও। এই এতো বড় পৃথিবীতে আমার কেউ নেই তুমি ছাড়া। আমি অন্ধকার ভয় পাই আম্মু একা থাকতে পারি না।
রাবেয়া বেগমের চোখ দিয়ে টপটপ পানি পরছে। চোখ খুলে মেয়ের দিকে তাকালো। হাত দিয়ে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরতে চাইলো।

রুদ্র এসে নূরের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

রাবেয়া বেগম নূরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে।

রুদ্র রাবেয়া বেগম এর কাছে গিয়ে বলে উঠলো, ‘ আপনাকে সুস্থ হতে হবে ফুপিমণি। আমাকে চিনেন আমি আপনার ছেলে, আপনার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে৷

রাবেয়া বেগম নূরের হাত ছেড়ে রুদ্রের হাত ধরলো। কিছু বলতে চাইলো৷ কিন্তু কিছু বলার আগেই সব কিছু থেমে গেলো।

রাবেয়া বেগম রুদ্রের দিকে তাকিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো৷

নূর রাবেয়া বেগম এর গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো,’ আম্মু! আম্মু তোমার কি হয়েছে..? কথা বলছো না কেনো..? চুপ হয়ে গেলে কেনো..? কথা বলো আম্মু। আমার দিকে তাকাও। কি হয়েছে তোমার।

রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,’ আমার আম্মু কথা বলছে না কেনো..!!?’

চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়