ভুলবশত প্রেম পর্ব-১৩+১৪

0
449

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৩

চারপাশে মৃদুমন্দ হীম হাওয়া বইছে। আকাশে সূর্যের দেখা মেলা ভার। পরিবেশটা কেমন যেনো গুমোট ভাব ধরে বসে আছে। এ যেনো বৃষ্টির দিনের মতো কোনো অবুঝ কিশোরীর মন খারাপের ফল। নিরুত্তাপ সূর্যের লুকোচুরির ফলে আশপাশ হতে যেনো হীম হাওয়া নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে জাপটে ধরছে আমাকে। ভীষণ শীতচোরা প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় শীতে দাঁতে দাঁত লেগে আসার উপক্রম হলো আমার।
আপুর শ্বশুরবাড়িতে আসার পূ্র্বেই আমি অনুষ্ঠান বাড়ির শীত সম্পর্কে ঠিক অনুমান নিয়েই একটা পাতলা শাল নিয়ে বের হয়েছিলাম। এখানে এসে আমার সে অনুমান সঠিক হয়েছিলো। অর্থাৎ আপুর শ্বশুরবাড়িতে আসবার পর শীত নামক কোনো অনুভূতিই পেলাম না আমি। অথচ প্রায় জনমানবহীন এ রাস্তায় চলতে গিয়ে আপাদমস্তক শীতে কাবু হয়ে পড়লাম আমি। এর একটাই কারণ৷ আপুর শ্বশুরবাড়ি মানুষে গিজগিজ করছিলো, কিন্তু এখানে মানুষের দেখা মেলা ভার। ফলে হীম হাওয়াও সুযোগ বুঝে আমার উপর জুড়ে বসেছে।

আমি এবং আদ্রিশ নিশ্চুপ হেঁটে চলছি। কারোর জবান দিয়ে কোনোরূপ কথা বের হচ্ছে না। আমি বরং তখন আদ্রিশের সেই কলের পর উনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এসব বিষয় সম্পূর্ণ উনার ব্যক্তিগত বলে কৌতুহল থাকা সত্ত্বেও আমি এ বিষয়ে নাক গলায়নি। আপাতত সেই ফোনকলের পর হতে আদ্রিশ নিঃশব্দে কিছু সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন। আমিও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলিনি উনার সাথে।

আচমকা শরীরে কাঁটা দেবার ন্যায় এক হীম হাওয়া আমায় স্পর্শ করে গেলো। ফলে গায়ে লেগে থাকা পাতলা শালটা আরো শক্তভাবে শরীরের সাথে চেপে ধরলাম। হাঁটার গতিও ধীর হয়ে এলো আমার৷ আদ্রিশ আমার পাশাপাশি হাঁটছিলেন। হঠাৎ আমার হাঁটার গতি ধীর হতে দেখে তিনিও নিজের হাঁটার গতি ধীর করে নিলেন। আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
” শীত লাগছে না কি?”

পাতলা শালটি গায়ে শক্তভাবে লেপ্টে নিয়ে কোনোমতে বললাম,
” হ্যাঁ। খুব শীত করছে। বাহিরে যে এতো বাতাস জানতাম না। জানলে কখনোও বের হতাম না।”

আমার কথায় আদ্রিশ থমকে দাঁড়ালেন। উনাকে দেখে আমিও হাঁটা বন্ধ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” হঠাৎ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? ফিরে যাবেন?”

আদ্রিশ মুচকি হাসলেন। আমার দিকে চেয়ে নিজের পরনের কোট খুলতে খুলতে বললেন,
” ফিরে যাওয়ার মতলব থাকলে এতোদূর আসতাম না। তোমাকে এই ঠাণ্ডা হতে বাঁচানোর একটা উপায় খুঁজে বের করলাম। যেনো আরো কিছুদূর আমরা একসাথে চলতে পারি।”

এই বলে আদ্রিশ পরনের কোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” নাও, এটা গায়ে জড়িয়ো নাও। আর শীত লাগবে না।”

উনার কথা শুনে আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
” ফিল্মের হিরো সাজার পায়তারা করছেন না কি? বাট ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এখানে কোনো ফিল্ম চলছে না। সো আপনার কোট আপনার কাছেই রাখুন। আমি আমার মতোই ঠিক আছি। ”

এই বলে আমি পুনরায় হাঁটতে শুরু করলাম। পিছে আদ্রিশ হয়তো দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ উনাকে আমার পাশে দেখতে পেলাম না।
কয়েক কদম এগিয়ে আসার আমি কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই আচমকা পিছন হতে কেউ আমার শরীরে কিছু জড়িয়ে দিলো। আমি চমকে উঠে নিজের দিকে তাকাতেই সেই কোটটি দেখতে পেলাম৷ এর দ্বারা এক সেকেন্ডও বুঝতে সময় লাগলো না যে কাজটি কে করেছে। অতঃপর আমি পিছনে ফিরে তাকাতেই আদ্রিশের মুখে জয়ী জয়ী একটা ভাব দেখতে পেলাম। আদ্রিশ ততক্ষণে আমার পাশাপাশি এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
” সব জায়গায় মুড দেখাতে নেই মিশমিশ।”

আমি কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” আশ্চর্য তো! আমি কখন মুড দেখালাম? যা সত্য তাই বলেছি আমি।”

এই বলে আমি উনার কোটটি খুলে নিতে গেলাম। কিন্তু উনি আমার কাঁধের উপর হাত রেখে আমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে বললেন,
” তোমাকে কোটটা শীত কাটাবার জন্য দিয়েছি। হিরো সাজতে নয়।”

উনার পরোক্ষ স্পর্শে আমি তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঝাঁকিয়ে উনার হাত সরিয়ে নিলাম। উনার দিকে চেয়ে ক্রোধিত কণ্ঠে বললাম,
” ফিল্মের হিরোদের মতোই তো কাজ করছেন আপনি৷ ফিল্মের হিরোরা যেমন নায়িকাকে শীত থেকে বাঁচাতে নিজের কোট বা জ্যাকেট খুলে নায়িকাকে দিয়ে দেয় আর নিজে পাতলা শার্টে থাকে। তবুও শীত করে না। আপনার ক্ষেত্রেও তো তাই হয়েছে।”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ সরু চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। অতঃপর ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন,
” ওহহো মিশমিশ…..নিজেকে ফিল্মের হিরোইন মনে করছো তুমি! নট ব্যাড…….”

আদ্রিশের কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র আমি থ বনে গেলাম। উনি যে কথাটা এভাবে আমার দিকে ঘুরিয়ে দিবেন তা কল্পনাও করতে পারিনি আমি। অতঃপর হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতি হতে বেরিয়ে এসে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
” আমার কথাটাকে আপনি একশো আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিলেন! এটা মোটেও আশা করিনি আমি।”

আদ্রিশ জয়ী হাসি হাসলেন। উনার এ হাসি দেখে কি মনে করে মুহূর্তেই আমি জোশের মাথায় বলে ফেললাম,
” আমাকে কোটটা দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তো তাই না? ব্যস, এবার কোটটি আপনি ফেরত পাবেন না। ”

আদ্রিশ যেনো এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিলেন। আমার কথা শুনে উনি আয়েশি ভঙ্গিতে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” আমিও তো এটাই চাই। তোমাকে তো আমি ফেরত দেবার কথা বলিনি। রাখো কোটটা তোমার কাছে। বরং এটা পরেই আজকের দিনটা কাটিয়ে দাও। আমি খুশি হবো।”

” আপনার খুশি দেখে তো আমার কাজ নেই। ওটা আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম। আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আপনার কোট নিবো। যার সম্পত্তি তার কাছেই মানায়৷ ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ির গেটে ঢুকবার আগেই আপনি কোটটা নিয়ে নিবেন। ”

আমার কথা শুনে আদ্রিশ কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” এজ ইউর উইশ। ”

উনার কথা শুনে বেশ স্বস্তি পেলাম আমি।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে আদ্রিশ রাস্তা বদলিয়ে বললেন,
” চলো, আমাদের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসি তোমাকে। ”

আমি নিশ্চুপে পথ চলতে চলতে মাথা নাড়িয়ে উনার কথায় সায় দিলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই উনি ডুপ্লেক্স একটি বাড়ির সামনে এনে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন,
” এটাই আমাদের বাড়ি। ইমাদদের বাড়ি থেকে সোজা রাস্তায় মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে এখানে আসতে। আজ তোমাকে একটু ঘুরিয়ে এনেছি বলে সময় লাগলো। ”

আমি একনজর উনাদের বাড়ির উপরিভাগ দেখে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
“ওহ।”
অতঃপর বাম হাতের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলাম। ঘড়িতে সময় বিকেল চারটা ছুঁইছুঁই। ঘড়ি হতে চোখ তুলে আমি আদ্রিশের দিকে চেয়ে বললাম,
” অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চলুন। সবাই হয়তো যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ ”

” আচ্ছা চলো। আজ আর আমাদের বাড়িতে যেতে বললাম না৷ এর কারণও আছে অবশ্য। যাই হোক, এখন যাওয়া যাক।”
এই বলে উনি হাঁটা শুরু করলেন। উনার পাশাপাশি আমিও হেঁটে চললাম। অতঃপর পাঁচ মিনিটের মাঝে সোজা রাস্তা ধরে আমরা ইমাদ ভাইয়াদের বাড়িতে চলে এলাম৷ ভেতরে ঢুকবার পূর্বে আমি কোটটি খুলে নিয়ে উনার হাতে দিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললাম,
” থ্যাংকইউ।”

আদ্রিশ মৃদু হেসে বললেন,
” ইটস মাই প্লেজার।”

আমি পুনরায় উনাকে বললাম,
” সেদিনের জন্যও থ্যাংকস। ”

আদ্রিশ এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। বরং নিজ হতেই বললেন,
” সবকিছুর জবাব ‘ওয়েলকাম’ দিতে ভালো লাগে না৷ এজন্য কিছু বললাম না। তুমি আবার মাইন্ড করো না যেনো। ”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি এক চিলতে হেসে দিলাম। অতঃপর বিনা বাক্য ব্যয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।

.

বাসায় আসবার পর হতেই ইমাদ ভাইয়ার যত্নআত্তিতে কোনে কমতি রইলো। নানা ধরণের নাস্তা পানি এবং রাতের খাবারের হিড়িক দেখে আমার মাথায় হাত পড়লো। বিরাট এ আয়োজন দেখে আম্মুকে বললাম,
” আম্মু আমি জামাই হবো। আমি কারোর বউ হবো না। জামাই হবো জামাই। আমার এতো এতো যত্নআত্তি আর খাবারদাবার লাগবে। বউ হলে তো আর এসব কপালে জুটবে না।”

আমার কথা শুনে উপস্থিত সকলে একত্রে হেসে উঠে। ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” যাও শালিকা, তোমার জন্য দোয়া করে দিলাম। এমন একটা জামাই পাবে তুমি যে তোমাকে এমন যত্নআত্তিতে রাখবে।”

ইমাদ ভাইয়ার আকাশকুসুম কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললাম,
” কি যে বলেন ইমাদ ভাইয়া। মেয়ে হয়ে জন্মালে ওসব কপালে জোটে না। ওসব তো আপনাদের ছেলেদের জন্য। ”

এই বলে আমি রান্নাঘরে গিয়ে আম্মু এবং চাচিদের সাথে টুকটাক একটু কাজ করে আপুর রুমে চলে আসি। ইমাদ ভাইয়াকে বাহিরে সবার সাথে আড্ডা দিতে দেখে এবং আপুকে একা রুমে পেয়েই আসি আমি। কারণ আপুর সাথে সেই আননোন নাম্বারের ছেলেটির ব্যাপারে কথা বলা প্রয়োজন।

রুমে ঢুকেই দেখলাম আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। আয়না হতে আমাকে দেখে আপু বিস্তৃত হেসে বললো,
” এতোক্ষণে তোকে পাওয়া গেলো। কোথায় ছিলি তুই?”

আমি প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে চুপচাপ আপুর পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু, তোকে একটা প্রশ্ন করবো। একদম ঠিকঠাক জবাব দিবি তো? মিথ্যা বলবি না তো?”

আপু কাজ থামিয়ে আমার দিকে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো,
” কি এমন জিজ্ঞেস করবি তুই?”

আমি সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” তোর কি আগে কারোর সাথে রিলেশন ছিলো?”

মুহূর্তেই আপুর চেহারা পাংশুটে বর্ন ধারণ করলো। নির্বাক চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো আপু। আমি পুনরায় একই প্রশ্ন করবার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। অতঃপর আমি আপুর সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। আপুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আকুতি পূর্ণ সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু, আমাকে বলতে পারিস সব৷ তোর সমস্যা আমার সাথে শেয়ার কর আপু। ঐ ছেলেটি কে? এখনও কি তোদের রিলেশন আছে? তুই কি ঐ ছেলেকে পছন্দ করিস? সব জানতে চাই আপু। সব। প্লিজ আমাকে সবটা বলবি। ”

আপু আমার দিকে কাঁদোকাঁদো চাহনিতে চাইলো। অতঃপর লম্বা একটি শ্বাস টেনে ছেড়ে দিয়ে বললো,
” ঐ ছেলেটাকে তুই চিনিস৷ তোর বান্ধবী রুনুর ভাই রোহান। ”

আপুর কথা কর্ণগোচর হতে আমি ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। অতঃপর অবিশ্বাস্যমূলক এ কথা শুনে তাতে বিশ্বাস আনতে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড রুনু? ওর ভাইয়ের সাথে তোমার রিলেশন ছিলো?”

আপুর দু চোখ তখন জলে ভরে উঠেছে। আপু আমার হাতের মুঠো হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। দু হাত দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিয়ে বললো,
” হ্যাঁ। ঐ রুনুর ভাই রোহান। কিন্তু আমাদের কখনও রিলেশন ছিলো না। ”

” তাহলে রোহান ভাইয়া তোমাকে কল জরে ভালোবাসার কথা কেনো বলে? আপু একটু ডিটেইলস এ বলো। ”

” গত আট নয় মাস আগে রোহানের কাছে আমি একটু হেল্পের জন্য নক দিয়েছিলাম। শুনেছিলাম উনার এক ফ্রেন্ড আমাদের ভার্সিটি থেকেই সিএসই নিয়ে পড়েছে। মাঝে একটা প্র্যাক্টিকালে আমায় অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। এজন্যই রোহানের সেই বন্ধুর কনট্যাক্ট নাম্বার নিতে চেয়েছিলাম। টুকটাক কথাবার্তায় রোহানের সেই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রবলেম সলভও করে ফেলি। কিন্তু তখনও জানতাম না যে রোহানের কাছে এই সামান্য সাহায্য চাওয়াই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। সে ঘটনার পর থেকে রোহান আমাকে প্রতিদিনই নক দিতো। সামান্য একটু হালচাল জিজ্ঞেস করেই আমাদের কথা শেষ হতো। মাঝেমধ্যে রাস্তায় কখনও দেখা হলে টুকটাক কথা হতো। ব্যস, এভাবেই একদিন রোহান আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমিও ঘুরেফিরে নানা কথা বলে উনাকে রিজেক্ট করে দেই। এরপর উনি চুপচাপ হয়ে যান। তবে কিছুদিন পর থেকে উনি আবারও আমাকে নক করে কথা বলতে শুরু করেন। পরে অতিষ্ঠ হয়ে উনাকে ব্লক করে দিলে উনি রাস্তায় আমার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমি উনাকে বারবার উপেক্ষা করতে থাকি। কারণ আমার তরফ থেকে কখনও উনাকে আমি এমন কোনো সাইন দেইনি যাতে উনি মনে করেন আমি উনাকে পছন্দ করি। আমি সবসময় লিমিটে থেকে ফর্মাল কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু এরপরও উনি ভাবতে থাকেন, আমি উনাকে পছন্দ করি।
এভাবে রোজরোজ রাস্তায় উনার কথা বলার চেষ্টা দেখে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ফলে একদিন সবার সামনে উনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলি৷ ব্যস, তারপর থেকে উনি আমার পিছে এমনভাবে পড়ে যান যে আমাকে রাজি করিয়ে তবেই দম নিবেন। এরপর থেকে উনার কর্মকাণ্ডগুলো পুরো উন্মাদের মতো হতে থাকে। গত এক মাস যাবত উনার এ উৎপাত থেকে বাঁচবার জন্য অনেক রাস্তা অবলম্বন করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি৷ পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আমার উনাকে সুইসাইড করার হুমকি দিলে উনি চুপ হয়ে পড়েন। কিন্তু তারপরও আমাকে মাঝেমধ্যে কল করে ডিস্টার্ব করে। তুই বিশ্বাস করবি না মিম, আমি উনার কতো নাম্বার যে ব্লক লিস্টে রেখেছি তা আমি নিজেই জানি না।প্রতিবার উনি নতুন নতুন নাম্বার জোগাড় করে আমাকে কল করে জ্বালায়। আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি মিম। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রোহান কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই না। আমি কি করবো বল আমায়। কি করবো আমি?”

এই বলে আপু নিচে বসে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমিও নিরবে কাঁদতে কাঁদতে আপুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ দরজার উপর দৃষ্টি পড়ায় আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ছাড়তে ভুলে গেলাম যেনো। কারণ দরজায় দাঁড়িয়ে ইমাদ ভাইয়া অবিশ্বাস্য চাহনিতে আমাদের দিকে চেয়ে আছেন।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৪

ইমাদ ভাইয়ার অবিশ্বাস্য ভরা চাহনিতে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করে বললাম,
” ইমাদ ভাইয়া!”

আমার কথা শোনামাত্র আপু আমাকে ঝট করে ছেড়ে দিয়ে পিছে ফিরলো৷ আমার মতো আপুও ইমাদ ভাইয়াকে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়লো। আমরা দুজনে এ মুহূর্তে ইমাদ ভাইয়াকে এখানে আশা করেছিলাম না।
আপু নিমিষের জন্য ইমাদ ভাইয়ার দিকে বাকহারা হয়ে চেয়ে রইলো। অতঃপর ভীত কণ্ঠে বললো,
” বিশ্বাস করুন ইমাদ। আপনি যা ভাবছেন এমন কিছুই নেই আমাদের মধ্যে। আমি রোহানের সাথে কোনো কোনোরকমের যোগাযোগ রাখিনি। ”

আপুর কথা শোনামাত্র ইমাদ ভাইয়া নিজের ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
” হুঁশশ। ধীরে বলো।”

এই বলে ইমাদ ভাইয়া রুমে প্রবেশ করে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন৷ ধীর পায়ে আপুর কাছে এসে দাঁড়ালেন উনি। আপুর দু চোখ বেয়ে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে। এদিকে আমি নির্বাক চাহনিতে দুজনকে বিশেষ করে ইমাদ ভাইয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি। ইমাদ ভাইয়া এক পলক আমার দিকে চাইলেন। অতঃপর আপুর দিকে রিক্ত চাহনিতে চেয়ে বললো,
” আমার কাছে লুকালে কেনো নাফিসা?”

আপু নতমস্তকে নীরস গলায় বললো,
” আমি লুকাতে চায়নি এটা। কিন্তু আবার আপনাকে বলার সাহসও জোটাতে পারিনি। ”

ইমাদ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণের জন্য আপুর দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন৷ অতঃপর আপুর দু বাহু ধরে আপুকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন এবং নিজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে হতে চেয়ারটা নিয়ে আপুর সম্মুখে বসে পড়লেন। আমিও সেই চেয়ারটা নিয়ে ইমাদ ভাইয়ার পাশে বসে পড়লাম। আপু এখনও নতমস্তকে চোখের জল ফেলে চলছে। ইমাদ ভাইয়া মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” নাফিসা? আমি কি এতোটাই খারাপ যে আমার উপর বিশ্বাস রেখে তুমি রোহানের কথা বলতে পারবে না?”

আপু তড়িৎগতিতে মাথা তুলে বললো,
” না না এমন কিছুই না৷ আপনি মোটেও খারাপ নন। আসলে আমার সাহসের অভাব ছিলো।”

” তুমি তো ভুল কিছু করোনি। তাহলে এতো ভয়ের কি আছে?”

আপু নিশ্চুপ বসে রইলো। ইমাদ ভাইয়া আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে সম্পূর্ণ ঘটনা ডিটেইলস এ বলো। ”

আপু কিয়ৎক্ষণ থেমে দু হাত দিয়ে চোখেরজল মুছে নিলো। অতঃপর আমাকে রোহান ভাইয়া সম্পর্কে যা যা বললো তা ইমাদ ভাইয়ার কাছে পুনরাবৃত্তি করলো। পুরো ঘটনা শোনার পর ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” রোহান এখনও তোমার কোনো ক্ষতি করেনি তাই তো?”

এবার আমি জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। ইমাদ ভাইয়া এবং আপুর উদ্দেশ্যে বললাম,
” কোনো ক্ষতি করেনি ঠিক। তবে আপুকে হলুদের দিন এবং বিয়ের দিন কল করেছিলো। হলুদের দিন রোহান ভাইয়ার কথাগুলো ছিলো অনুরোধের মতো৷ কিন্তু বিয়ের দিন শুরুতে অনুরোধ সুরে কথা বললেও পরমুহূর্তে উনি হুমকি দেওয়ার ঢঙে কথা বলেন। উনার কথা শুনে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম হয়তো উনি সত্যিই আসবেন। কিন্তু সেদিন উনার ছায়াও দেখিনি আমি। ”
এই বলে আমি নিমিষের জন্য বিরত নিলাম। আপু এবং ইমাদ ভাইয়ার দিকে এক পলক চেয়ে পুনরায় বললাম,
” আমার মনে হয় না রোহান ভাইয়া কিছু করবে। হয়তো উনি আপুকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলছেন। ”

ইমাদ ভাইয়ার মুখশ্রীতে এবার উদ্বেগের দেখা মিললো। কণ্ঠে মৃদু উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে তিনি বললেন,
” কিছু করেনি এতোদিন এর মানে এই নয় যে সামনেও সে কিছু করবে না। ”

ইমাদ ভাইয়ার কথায় আমি সহমত প্রকাশ করে বললাম,
” তা আপনি ঠিক বলেছেন। ”

ইমাদ ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” তবে কিছু করার সম্ভাবনাও কম দেখছি। কারণ ও যদি সত্যিই কিছু করতো তবে নাফিসার বিয়ের আগে বা বিয়ের দিনই করে ফেলতো। কিন্তু সে এখনও কিছু করেনি৷ আমার মনে হয়, শুধু শুধু রোহানের কাছ থেকে আমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। ”

আপুর কান্নার গতি বেশ খানিকটা কমে এসেছে। আপু ত্রাসজনক গলায় বলে উঠলো,
” কিন্তু হুট করে যদি কিছু করে বসে?”

ইমাদ ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
” এখন তুমি একা নও নাফিসা। তোমার সামনে সবসময় ঢাল হয়ে আমি থাকবো। রোহান কিছু করতে চাইলেও পারবে না। কারণ তার আমাকে অতিক্রম করে তোমার ক্ষতি করার সাহস নেই।”

ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে আমি এবং আপু দুজনে আশ্বস্ত হলাম। ইমাদ ভাইয়া এ পর্যায়ে উঠে গিয়ে আপুর পাশে বসলেন। আপুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
” তুমি ভয় পেয়ো না নাফিসা। শুধু শুধু রোহানকে ভয় পেয়ে কেনো নিজের সবকিছু নষ্ট করবে? আর তুমি এখন থেকে নিশ্চিন্তে থাকো। কারণ আগামীকাল বাড়িতে গিয়েই সিকিউরিটির ব্যবস্থা করবো আমি। আর বাড়িতে গিয়ে রোহান সম্পর্কে খোঁজ লাগাবো আমি। সো নো টেনশন। ”

ইমাদ ভাইয়ার বলা প্রতিটা কথায় আমি আশ্বস্ত অনুভব করলাম। আর আপুর ঠোঁটের কোনায় ফুটলো মিষ্টি এক হাসির রেখা। সে মেদুর কণ্ঠে ইমাদ ভাইয়াকে বললেন,
” থ্যাংকইউ সো মাচ আমার লাইফে আসার জন্য। আমার ভরসার স্থল হওয়ার জন্য।”

ইমাদ ভাইয়া মৃদু হেসে আপুর বাহু জাপটে নিজের পাশে টেনে নিলেন। দুজনের এ মিষ্টি মুহূর্ত দেখে আমি আনমনে বলে উঠলাম,
” আপু, তুমি খুব লাকি। ভাগ্যগুণে এমন পার্টনার পেয়েছো। থ্যাংক ইউ ইমাদ ভাইয়া, থ্যাংকইউ।”

.

আজ পুরো এক সপ্তাহ বাদে মেডিকেলে এসে মনমেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেলো। এখন আমি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি। পায়ের ব্যাথাও একদম চলে গিয়েছে। তবে এক সপ্তাহের এন্টিবায়োটিক এখনও চলছে। আর দু তিনদিন পার হলেই এসব ওষুধের প্যারা হতে বাঁচি।

এক সপ্তাহ পর অনেক স্যার ম্যাডামই আমাকে দেখে কয়েকটা টিটকারিমূলক কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অপর কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। কারণ তাদের এসব কথা ধরে বসে থাকলে আমার আগামী কয়েকদিন মন খারাপের দিন হয়ে রবে। যা আমি চাই না৷ এজন্যই এসব বিষয় হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া উত্তম।

লেকচার ক্লাশ শেষে আমি, তিন্নি, নিশাত মিলে ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছি। হসপিটাল বিল্ডিংয়ের লিফটের কাছে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেনো পলি নামের একজন নার্স আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তার চলার গতি দ্রুত এবং চোখেমুখে মৃদু আতঙ্কের ছাপ। আমাকে দেখতে পেয়েই তিনি শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার নামই তো মিম তাই না?”

আমি অদ্ভুত চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে হ্যা সূচক জবাব দিলাম। উনি আমার জবাব শুনে যেনো প্রাণ ফিরে পেলেন। অতঃপর হড়হড় করে বলতে শুরু করলেন,
” তৃতীয় তলার ওয়ার্ডে আদ্রিশ নামের একজন পেশেন্ট আপনাকেই খুঁজছে। আপনাকে চাই মানে আপনাকেই চাই। উনার জখম জায়গাগুলোতে উনি কিছু করতেই দিচ্ছেন না। আপনাকে আর্জেন্টলি যেতে হবে সেখানে।”
®সারা মেহেক

#চলবে