ভুলবশত প্রেম পর্ব-১৭+১৮

0
419

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৭

আদ্রিশের হেন প্রশ্নের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ফলে উনার প্রশ্ন শুনে আমি বেশ ভড়কে গেলাম। মুখ দিয়ে বের হলো না টু শব্দটুকুও। আদ্রিশ আমার হেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে মৃদু হাসলেন। বললেন,
” এর মানে, আমার প্রশ্নের জবাব ‘হ্যাঁ’, হবে? ”

আমি পুনরায় কোনোরূপ জবাব দিতে পারলাম না৷ কেনো যেনো কোনো এক কারণে আমি এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না৷ মনেও সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না৷ ফলস্বরূপ বিনাবাক্যে নতমস্তকে নিশ্চুপ বসে রইলাম আমি। আদ্রিশও নিশ্চুপ রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” সাদিককে আগে থেকেই চিনতে?”

উনার প্রশ্ন শোনার পরও আমি কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলাম। অতঃপর মনে আত্মবিশ্বাস এবং সাহস জুগিয়ে মাথা তুলে চাইলাম উনার দিকে। কাষ্ঠ হেসে বললাম,
” পছন্দ করার জন্য কি আগে থেকেই পরিচিতি থাকতে হয়? পছন্দ তো প্রথম দেখায়ও হয়ে যেতে পারে। ”
এই বলে আমি প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লাম। অতঃপর দৃঢ়চিত্তে স্মিত হেসে বললাম,
” এবং মজার ব্যাপার কি জানেন? এ ধরণের ‘প্রথম দেখায় পছন্দ হওয়া, প্রেম, মনে ধরা’ ব্যাপারগুলো টিকে কম। এগুলো হয় নশ্বর। যেমনটি আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।”

এই বলে আমি নিরস দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশও গভীর চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। পেলব গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কষ্ট পাচ্ছো না?”

আমি উনার প্রশ্নে এক দফা হেসে দিলাম। অতঃপর দৃঢ়চিত্তে বললাম,
” এ অনুভূতি যেমন নশ্বর, এর দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখ, কষ্টও তেমন নশ্বর। এই যে, আমি এখন যেমন কষ্ট পাচ্ছি। দুদিন বাদে এ কষ্ট আর থাকবে না। সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ আমি সাদিককে খুব গভীরভাবে পছন্দ করিনি। প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো, এই যা। এভাবে হুটহাট একটু পছন্দ করেছিলাম বিধায় হুটহাট করেই একটু কষ্ট পেয়ে বসলাম, ব্যস। এখন এ নিয়ে তো বসে থাকলে চলবে না।”
এই বলে কিয়ৎক্ষণ নিজের ভেতরটা অনুভব করার প্রয়াস করলাম আমি৷ ধীরেধীরে অনুভব করতে পারলাম, পূর্বের ন্যায় সেই কষ্টের অনুভূতিটা এ মুহূর্তে আর নেই। এখন মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছি আমি৷ এদিকে আদ্রিশ যেনো আমার নিকট হতে এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তা উনার কিঞ্চিৎ বিস্মিত অভিব্যক্তি দেখেই টের পেলাম আমি।

আদ্রিশ আমার কথাগুলো বিশ্বাস করে নিতে চোখ কুঁচকে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” যা বলছো তা কি নিজের থেকে বলছো? আই মিন সিরিয়াসলি এসব বলছো তুমি?”

আদ্রিশের কথায় আমি সশব্দে হেসে উঠে বললাম,
” কেনো? অবিশ্বাস্য কেনো মনে হচ্ছে এসব? আমি যা বলছি, সিরিয়াসলি বলছি। আমি উনাকে আহামরি পছন্দ করি না। চোখের দেখায় একটু ভালোলাগা। অতঃপর নিজের এ কাজের জন্য কষ্টমূলক এক ফল পাওয়া। যাই হোক, আপাতত এসব ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করি?”

আদ্রিশ যেনো আমার কথায় বেশ স্বস্তি পেলেন। কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,
” ওকে। ঠোঁটে একদম জিপ লক লাগিয়ে দিলাম। খাবার আসার আগ পর্যন্ত আর কোনো কথা নেই। আপাতত কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করি।”

আদ্রিশের বাচনভঙ্গিতে আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। কিছুক্ষণের মাঝেই খাবার চলে এলে আমরা স্বাভাবিক কিছু কথাবার্তা বলতে বলতে খেয়ে নিলাম।

.

এক সপ্তাহের জন্য ব্যাগপত্র গুছিয়ে বসে আছি আমি। গন্তব্য আপুর শ্বশুরবাড়ি। আজ বিকেলে হঠাৎ আপুর কল আসে আম্মুর ফোনে। আপু জানায়, ইমাদ ভাইয়া এক সপ্তাহের জন্য ভার্সিটি হতে ট্রেনিং এ শহরের বাহিরে যাবে। আবার কিছুদিন পর আপুর পরীক্ষা। এর মাঝে কিছু পেপার ওয়ার্কও সাবমিট করতে হবে। যার জন্য আমার আপুকে সাহায্য করতে হবে। এজন্যই আমাকে আপু তার শ্বশুরবাড়িতে যেতে বলেছে। এমনকি সেখানে থাকতেও বলেছে। তবে আমাকে ডাকবার প্রধান কারণ এটা না। নতুন জায়গায় আপু একা থাকবে, খুব কাছের কারোর সঙ্গ থাকবে না, এসব কারণেই মূলত আপু আমাকে ডেকেছে।
আপুর এ প্রস্তাব প্রথম দফায় আব্বু আম্মু কিছুতেই রাজি ছিলো না। তবে আপু যখন বললো, আপুর শ্বাশুড়িই আপুকে এ বুদ্ধি দিয়েছে যে আমাকে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে, তখন আব্বু আম্মু এবং আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না যে নাসরিন আন্টী এমন বুদ্ধি দিবে।
নাসরিন আন্টীর কথা শোনার পরও আব্বু আম্মু রাজি ছিলো না। অতঃপর আপু বাধ্য হয়ে নাসরিন আন্টীকে আম্মুর সাথে কথা বলিয়ে দিলো। ফলস্বরূপ কিছুক্ষণের জোরাজুরিতে আম্মু রাজিও হয়ে গেলো।

মাগরিবের আজানের পর পরই ইমাদ ভাইয়া আমায় নিতে চলে এলেন। প্রথম প্রথম আভাকেও আমাদের সাথে নিতে চাইলেন উনি। কিন্তু এ সপ্তাহে আভার ক্লাসটেস্ট থাকায় ওকে নেওয়া হলো না আমাদের সাথে।
বাসায় সাজো সাজো নাস্তা করে ইমাদ ভাইয়ার অবস্থা রীতিমতো কাহিল। উনার চেহারার হাবভাব দেখার মতো হয়েছে। উনার হেন পরিস্থিতি দেখে আমি ও আভা হেসেই কূলকিনারা পেলাম না৷
ইমাদ ভাইয়া ভরপেটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

ইমাদ ভাইয়াদের বাড়ি পৌঁছে আমার প্রতি নাসরিন আন্টীর খাতিরযত্ন দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো ছাড়া উপায় রইলো না আমার কাছে। উনার আন্তরিক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ না হয়ে উপায়ন্তর পেলাম না৷ উনি যেমন মিশুক ঠিক তেমনিও যত্নশীল একজন মানুষ। নাসরিন আন্টীর আচরণ দেখে মুহূর্তেই বলে দেওয়া সম্ভব ইমাদ ভাইয়া কার আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

নাসরিন আন্টী, আপু এবং ইমাদ ভাইয়ার সাথে কিছুক্ষণ গল্পগুজব শেষে দোতালায় আপুসহ আপুর রুমে চলে এলাম আমি। ইমাদ ভাইয়া গেলেন বাহিরে। আপু আমাকে রুমে দিয়ে কিছু কাজের জন্য নিচে চলে গেলো। আমি আপুর রুমে গিয়ে ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে বসে রুমের প্রতিটি জিনিস দেখতে লাগলাম। ইমাদ ভাইয়া যে বেশ শৌখিন ধরণের একজন মানুষ তা রুমের সাজসজ্জা দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পেলাম আমি। রুমের প্রতিটি শোপিস এক এক করে দেখতে দেখতে আমার দৃষ্টি একটি কাঁচের শোপিসের উপর। আমি উঠে গিয়ে সেই কাঁচের শোপিসটি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম।

আচমকা পিছন হতে সশব্দে ‘নাফিসা ভাবী!’ ডাক শুনে ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। ফলস্বরূপ অসাবধানতাবশত হাত হতে শোপিসটি পড়ে গেলো। মুহূর্তেই তা চূর্ণবিচূর্ণ পদার্থে পরিণত হলো। আমি স্তব্ধ হয়ে কিয়ৎক্ষণ ভাঙা শোপিসটির দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর প্রচণ্ড ক্রোধে এ কাজে দায়ী লোকটিকে দেখতে চট করে পিছনে ফিরলাম আমি। পিছনে ফিরে আদ্রিশকে দেখে আমার ক্রোধ এবং বিস্ময়, দুটোর মাত্রাই পূর্বের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো।

#চলবে

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

১৮

ঠোঁটের কোনে দুষ্টুময় চাপা হাসি এঁটে আদ্রিশ আমার পিছে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার এ হাসি আমার সমস্ত শরীরে কাঁটার ন্যায় বিঁধলো। ফলে আমি উনার দিকে ক্রোধান্বিত চাহনিতে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলাম। কিন্তু আদ্রিশের ভাবভঙ্গির কোনোরূপ পরিবর্তন হলো না। বরং উনি আমার এহেন চাহনি উপেক্ষা করে ঠোঁটের কোনে পূর্বের ন্যায় হাসি বজায় রাখলেন। আমি কিছু বলতে নিলেই আদ্রিশ বিস্মিত হবার ভান করে বললেন,
” হায় হায় মিশমিশ! এতো সুন্দর শোপিসটা ভেঙে ফেললে তুমি!”

আদ্রিশের কথা শোনামাত্র রাগে আমার সমস্ত শরীর রি রি করতে লাগলো। আমি এক প্রকার চেঁচিয়ে উনাকে বলে উঠলাম,
” আপনি ইচ্ছা করেই এমন করেছেন ঠিক না?”

আদ্রিশ অবুঝ হবার ভান করে বললেন,
” আমি কি করলাম বলো তো? আমি তো নাফিসা ভাবীকে ডেকেছিলাম। কে জানতো তুমি রুমে আছো আর আমার ডাকেই ভয় পেয়ে যাবে তুমি!”

” আচ্ছা? আপুকে ডাকছেন, ভালো কথা। তাই বলে এতো জোরে এবং আচমকা ডাকবেন না কি! আপনি ইচ্ছা করেই এমন করেছেন। এখন এই শোপিস ভাঙার সব দায় দায়িত্ব আপনার উপর। আপনিই ভেঙেছেন এটা।”

আদ্রিশ কিছু বলতে নিলেই আপু হুড়োহুড়ি করে রুমে ঢুকে পড়লো। আপুর মুখশ্রীতে চিন্তা এবং আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। আপু দ্রুত পায়ে এসে আমার এবং আদ্রিশের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভাঙা শোপিসটির দিকে এক নজর চেয়ে আমার উদ্দেশ্যে চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” মিম? তুই ঠিক আছিস তো? কাঁচ টাচ বিঁধেনি তো?”

আমি তৎক্ষনাৎ আদ্রিশের দিকে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে আপুকে বললাম,
” না আপু৷ আমি একদম ঠিক আছি। ”

আপু পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” এটা ভাঙলো কি করে?”

আমি সাথে সাথে আদ্রিশের দিকে আঙুল তাক করে বললাম,
” উনি ভেঙেছেন।”

আমার কথা শোনামাত্র আদ্রিশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে নির্বাক চাহনিতে চেয়ে প্রতিরক্ষামূলক গলায় আপুকে বললেন,
” বিশ্বাস করুন ভাবী। আমি মোটেও এটা ভাঙিনি। আপনার বোন যে এতো বড় মিথ্যাবাদী এটা জানা ছিলো না আমার। ”

উনার কথার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমি ঝেঁঝে উঠা গলায় বললাম,
” আপনি পিছন থেকে ওভাবে আপুকে ডাক দিয়েছিলেন কেনো? আচমকা কাউকে ওভাবে ডাকলে তো সে ভয় পাবেই। এটাই স্বাভাবিক। আপনি আমাকে…….”

আমার কথা শেষ হবার পূর্বেই আপু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
” ব্যস ব্যস, হয়েছে। আমি এতো সাফাই শুনতে চাইনি। আর না তোমাদের ঝগড়া দেখতে চেয়েছি।”

আপুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই আমি কিয়ৎক্ষণ আদ্রিশের দিকে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এ মুহূর্তে উনার কাজকর্ম দেখে আমার মন চাইছে উনার মাথার প্রতিটা চুল টেনে টেনে ছিঁড়ি৷ এতে যদি মনে শান্তি পাওয়া যায়! এদিকে আদ্রিশ আমার দিকে এমন চাহনিতে চেয়ে আছেন যে মনে হচ্ছে উনি আমার এহেন পরিস্থিতি দেখে বেশ আনন্দ নিচ্ছেন। উনার এহেন চাহনির ফলস্বরূপ আমি উনার উদ্দেশ্যে ফোড়ন কেটে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু? এই লোকটা এখানে পড়ে থাকে না কি সারাদিন? নিজের বাড়িঘর নেই না কি?”

আমার কথা শুনেই আপু বিস্মিত চাহনিতে কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর আমার বাহুতে সবেগে মেরে বিপন্ন গলায় বললো,
” ছিঃ মিম! এসব কি বলছিস তুই? কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা দেখি বেমালুম ভুলে বসেছিস তুই! ইমাদকে বলি, তোকে যেনো এক্ষুনি বাসায় রেখে আসেন। কত্ত বড় বেয়াদব হয়েছিস তুই!”
এই বলে আপু আদ্রিশের দিকে চেয়ে কোমল ক্ষমাপ্রার্থী কণ্ঠে বললো,
” কিছু মনে করো না আদ্রিশ। ও আসলে এমন না। এই……”

আপুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিশ আমার দিকে চেয়ে অত্যুজ্জ্বল হাসি দিয়ে বললেন,
” ও কেমন আমি জানি ভাবী। এতো ফর্মাল হবার দরকার নেই আমার সাথে। ছোট মানুষ, একটু আধটু উল্টাপাল্টা কথা বলতেই পারে। সব কথা কি আর মনে নিতে হয় না কি!”

আদ্রিশের কথা শোনামাত্র বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে এলো। আমায় ছোট বলে যে উনি পরিপূর্ণভাবে আমায় অপমান করে বসলেন তা আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার। আপাতত পরিস্থিতির শিকার হয়ে উনাকে কিছু বলতে পারলাম না আমি। বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়ে কটমট দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। এদিকে আমার এ চাহনিতে আদ্রিশ ঠোঁটের কোনে চাপা হাসি বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেনো উনি এসবে ভীষণ মজা পাচ্ছেন। আর আমি নিরুপায় হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণের মাঝেই আপু একজন সার্ভেন্টকে ডেকে ভাঙা কাঁচগুলো পরিষ্কার করতে বললো। রুমে সার্ভেন্ট আসায় আমি রুমের এক কোনায় গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আদ্রিশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়ে অতঃপর চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই আপু আলমারি হতে একটি শাল বের করে নিজের শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে আমাকে বললো,
” সোয়েটার পরে গায়ে শাল জড়িয়েনে। ছাদে বেশ ঠাণ্ডা লাগবে।”

আমি চোখজোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
” এতো রাতে ছাদে কেনো আপু?”

” এতো রাত কোথায় দেখলি? মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। ছাদে আমরা সবাই একসাথে একটু গল্পগুজব করবো। এই আর কি। আব্বু, আম্মুও থাকবে কিন্তু। ”

” বাহ! তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ী তো বেশ ফ্রি মাইন্ডের রে আপু!”

আপু আমার গাল টেনে মুচকি হেসে বললো,
” এখনও তো কিছু দেখলি না তুই। সাতদিন থেকে দেখ, তারপর বলিস, তারা কেমন ফ্রি মাইন্ডের।”

আপুর কথায় আমি মৃদু হেসে সোয়েটার পরে গায়ে শাল জড়িয়ে নিলাম। আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপু? তোর ননদ কুহু কোথায়?”

” কুহু ওদের নানুবাড়ি গিয়েছে। কাল পরশুর মধ্যেই হয়তো চলে আসবে। ”

” আর জেবা ভাবীরা কোথায়?”

” জেবা ভাবী আর ইমতিয়াজ ভাইয়া তাদের মেয়েকে নিয়ে জেবা ভাবীদের বাড়ি গিয়েছিলো। ভাবীর বাবা একটু অসুস্থ ছিলো বিধায় দেখতে গিয়েছিলো। ”

” আচ্ছা….. ইমতিয়াজ ভাইয়া আর তাদের মেয়ের সাথে তো দেখাই হলো না আমার। শুধু তোর মুখে নামই শুনলাম।”

” আজকে দেখিস। ভাবীরা চলে এসেছে বোধহয়। চল ছাদে যাই। সবাই ওয়েট করছে মেবি।”
এই বলে আপু আমার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে নিয়ে এলো। ছাদে পা রাখতেই হিম শীতল হাওয়া আমার পুরো শরীরে মৃদু আকারের কম্পন ধরিয়ে দিলো। শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা শালটা আরো শক্ত হাতে চেপে ধরলাম আমি। ছাদে উঠেই দেখলাম ছাদের কোনার দিকে ছন নির্মিত একটি ঘর রয়েছে। গ্রাম্য সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গড়ে উঠা ঘরটি অসম্ভব সুন্দর এবং সুসজ্জিতভাবে ছাদে অবস্থান করছে। আপুর সাথে ঘরটিতে প্রবেশ করতেই দেখলাম জেবা ভাবী, ইমাদ ভাইয়া, আপুর শ্বশুর, শাশুড়ি এবং আদ্রিশ গোল হয়ে বসে আছেন। তাদের সাথে আরো একজন লোক এবং ছোট্ট একটি মেয়েও বসে আছে। এ দুজনকে দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তাদের পরিচয় কি।

আপু আমাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই জেবা ভাবী উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছো মিম? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা!”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
” আমি ভালো আছি ভাবী৷ আপনি কেমন আছেন?”

জেবা ভাবী আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” আমিও ভালো আছি। ইমাতিয়াজ আর ইকরার সাথে দেখ করিয়ে দেই চলো। ” এই বলে জেবা ভাবী আমার হাত ধরে ইমতিয়াজ ভাইয়ার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
” বেয়াইনের সাথে দেখা করো। বিয়ের দিন তো দেখা করতে চেয়েছিলে। কিন্তু সেদিন মিমকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ”

জেবা ভাবীর কথায় ইমতিয়াজ ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,
” আমাদের বেয়াইন সাহেব হয়তো ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। যাই হোক, তোমার সাথে দেখা করে ভালো লাগলো। এবার আমাদের পিচ্চি মেয়েটার সাথে দেখা করো। ওর নাম ইকরা। বয়স কিন্তু মাত্র দশ মাস।” এই বলে ইমতিয়াজ ভাইয়া ইকরাকে আমার কোলে দিয়ে বললেন,
” ও সবার কোলেই যায় কিন্তু এবং যাকে একটু পছন্দ করে বসবে তার কোল হতে কিছুতেই নামতে চাইবে না ও। ভীষণ ছটফটে মেয়ে কিন্তু ও।”

ইমাদ ভাইয়ার কথায় আমি মৃদু হেসে ফর্সা টুকটুকে ছোট্ট ইকরার গোলগাল গালটা ধরে টেনে দিলাম। আমার কাণ্ডে ইকরা আমার দিকে ড্যাবড্যাব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। অতঃপর মিনিট খানেকের পর্যবেক্ষণ শেষে ইকরা ফোকলা হেসে আমার চশমায় হাত বসালো। ওর অতর্কিত আক্রমণে আমি তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ হতে চশমাটা খুলে হাতে নিলাম। ইকরা অবুঝের মতো আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চশমা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার এ কাণ্ডে আমিসহ সকলেই হেসে উঠলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, বাচ্চাদের কাছে এ চশমাগোষ্ঠী কেনো এতো প্রিয়?

ইকরাকে নিয়ে সকলের সাথে গদির উপরে বসে আছি আমি৷ সকলেই টুকটাক কথায় মশগুল। আর আমি মশগুল ইকরার সাথে। বারবার ওর নরম গোলগাল গাল টানার লোভ সামলাতে না পেরে ওর গাল টেনে দিচ্ছি আমি। ওর স্বাস্থ্যবান হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু এঁকে দিচ্ছি। মোট কথা, এ মুহূর্তে চারপাশের সব ভুলে আমি ইকরার সাথে খেলায় মশগুল হয়ে পড়েছি।

” ইশ! ভীষণ খারাপ মানুষ তো তুমি মিশমিশ!”

আচমকা কানের নিকটে আদ্রিশের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি৷ পাশ ফিরে আদ্রিশের দিকে চাইতেই দেখলাম সে আমার থেকে নিকটবর্তী দূরত্বে বসে আছেন। কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই হঠাৎ আমার নিকট হতে ইকরাকে কোলে নিয়ে বললেন,
” কথায় কথায় এতো আঁতকে উঠো কেনো মিশমিশ? ”

উনার প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ জবাব না দিয়ে আমি চারপাশে সকলকে একনজর দেখে নিলাম। অতঃপর নিচু স্বরে বললাম,
” আর সবসময় আমার কানের কাছে এসে কথা বলে উঠেন কেনো আপনি?”

আদ্রিশ বিস্তৃত হেসে বললেন,
” সবসময় না মিশমিশ। হঠাৎ হঠাৎ।”

” সবসময় হোক বা হঠাৎ হঠাৎ হোক, আমার কানের কাছে কথা বলেন কেনো আপনি?”

” কানের কাছে না মিশমিশ। কানের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলি। ”

” কথাই বা বলবেন কেনো আপনি? ”

” কথা বলা আমার মৌলিক অধিকার তাই বলি।”

কথায় কথায় আদ্রিশের জবাব শুনে আমি বেশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” ইশ! আপনি তো ভীষণ খারাপ মানুষ!”

আদ্রিশ ইকরার গাল দুটো টেনে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
” ওহহো ‘ইশ’! তুমি তার মুখে কি কিউট শোনাও!”

উনার কথা কর্ণকুহরে প্রবেশ মাত্র আমি বিস্মিত চাহনিতে চেয়ে রইলাম উনার দিকে। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
” কি বললেন আপনি! ”

আদ্রিশ ইকরার সাথে খেলতে খেলতে নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললেন,
” যা শুনেছো তাই বলেছি৷ ”

আমি পূর্বের তুলনায় কণ্ঠে আরো বিস্ময় মিশিয়ে বললাম,
” আপনি আমায় নিয়ে কি বললেন!”

আদ্রিশ এ পর্যায়ে চট করে আমার দিকে চেয়ে কুঞ্চিত ভ্রুজুগল নিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
” তোমায় নিয়ে কি বললাম আমি? আমি তো ‘ইশ’ নামক শব্দটিকে নিয়ে বলেছি। মনে মনে কি চলছে তোমার মিশমিশ? ”

আমি তৎক্ষনাৎ কোনো জবাব দিতে পারলাম না। কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে হাল ছেড়ে বললাম,
” সম্ভব না আমার পক্ষে। কিছুতেই সম্ভব না।”

আমার কথায় আদ্রিশ গর্বের সহিত হেসে বললেন,
” তুমি কখনই আমার সাথে পেরে উঠবে না মিশমিশ। এ তো কেবল শুরু। আগে আগে দেখো, কি কি হয়। তাই না ইকরা মামনি?”
এই বলে আদ্রিশ ইকরাকে শূন্যে তুলে দোলাতে লাগলেন এবং আমি মহা চিন্তায় উনার দিকে চেয়ে রইলাম। আসলে এই লোকটার মতলব কি!

#চলবে