ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-০৯

0
4057

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-০৯
রোকসানা আক্তার

-ওয়েটার,দুটো পিজা এবং দুটো কোকোলা দিন।
-জ্বী,ম্যাম দিচ্ছি।দয়া করে অপেক্ষা করুন।
-ওকে।

নীর ডলির মুখের সামনে তূরী বাজিয়ে বলে,
-কেন ডেকেছিস এবার তার কারণ বল।
-বলবো,আগে তো খাবারটা শেষ করি আমরা।
নীর মুখে বিরক্তি চাপ এনে বলে,
-তাড়াতাড়ি।
-নীর তোর কি খুব তাড়া?
-তা নয়।আমি ভীষণ ক্লান্ত।বাসায় গিয়ে প্রচুর ঘুম দিতে হবে।
-আচ্ছা বুঝলাম।
ওয়েটার খাবার দিয়ে যায়।ডলি নীরকে ইশারা করে খাওয়ার জন্যে।নীর নিজের মাথার চুল মুচড়ে বলে,
-আজ ক্লাইন্টদের সাথে এসব ফাস্টফুড খেতে খেতে পেটটা এখন বদহজম।মনে হয় না খেতে পারবো।তোর সারপ্রাইজও গিলতে পারবো কি না সন্দেহ!

ডলি নীরের কথায় খিলখিলহেসে উঠে।হাসি চেপে বলে,
-কম খাস বিধায় আজও চিকু হয়ে রইলি।তোকে মটু আর এই জনমেও দেখতে পাবো না।
-হইছে রাখ।আমার তর সইছে না তোর সারপ্রাইজ পাওয়ার ব্যাকুলতায়।প্লিজজ কুইকলি টেল মি!
-ওয়েট বলছি নীর—–!

ডলি তার ডানহাতটা নীরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নীরের বামহাতে চেপে ধরে।গলার স্বর ছোট করে বলে,
-নীর তোর কি কেউ পছন্দের আছে?আই মিন কাউকে তুই লাইক/লাভ করিস?
নীর ডলির কথায় আচমকা।হম্বিতম্বি হয়ে বলে,
-সাডেন এসব কথা!বুঝলাম না।

ডলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরের হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে। এই স্পর্শের কাতরতায় ডলির সারা শরীর শিরশির করে উঠে।ইচ্ছে হয় নীরকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে।মুখে অনবরত কিস দিয়ে বলতে –আই লাভ ইউ নীর!আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।তোর কাছে এসে দাড়ালে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলেপুড়ে যায় আমি নিজেকে সামলাতে পারি না।বুঝি না এই বেখেয়ালি মনের ভাষণা।তুই কি আমায় ভালোবাসিস নীর!?
-কি হলো ডলি?এত হাত চাপাচাপি করছিস ক্যান?কথাতো শেষ করবি!

ডলির টনক নেড়ে উঠে।সে স্বাভাবিক হয়ে বসে।মুখে স্মিতভাব এনে বলে,
-নীর আমি যে তোকে কথায় কথায় জড়িয়ে ধরি,চুমু খাই…এসবে তোর কেমন ফিলিংস হয়?
-কেমন ফিলিংস হয় মানে?
ডলি হাঁক ছেড়ে আবার স্বাভাবিক হয়।ক্ষীণ গলায় সড়াৎ সড়াৎ বলে দেয়,
-আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি নীর।আর এই ভালোবাসা সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে।তোকে একথা কখনো বলতে যেয়েও পারিনি।জানিস?বাসা থেকে বারংবার বিয়ের থ্রেট আসছে।বাবা এক পায়ে খাঁড়া যে উনার বন্ধুর ছেলের কাছেই আমায় বিয়ে দিবেন।আকাশ ভাইয়াও ক’দিন ওর লন্ডন থেকে বাংলাদেশ ব্যাক করবেন ।কিন্তু বিলিভ কর আমি তোকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনা। নীর তুই কি আমায় ভালোবাসিস, বল?আর আমার এই প্রপোজালে তোর কোনো আপওি আছে?

নীর আশ্চর্যিত হয়ে যায়।কারণ,সে ডলিকে শুধু বন্ধুই ভেবেছে।আর এইযে কিস,টাচ সবই নীরের কাছে নর্মাল বিহেভ ।তবে,তার স্পর্শতার অনুভূতি ডলির মাঝে যে নার্ভাসনেস এনে দিয়েছে তা নীর এখন বুঝতে পেরেছে।ডলির দিকে সায় তাকিয়ে থেকে নীর মুখফুলে একটা নিঃশ্বাসের ধোঁয়া ছাড়ে।হাতের আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে কিছু একটা বলতে যাবে ওমনি নীরের ফোন বেজে উঠে,
-হ্যালো,মা?
-কোথাই তুই?
-এইতো অফিস থেকে মাএ বের হলাম।
-তাড়াতাড়ি বাসায় আস।নাতাশার শরীরটা ভালো ঠেকছে না।কাঁপুনি দিয়ে দিয়ে খালি জ্বর আসছে।
-মা আমি একটু পর আসছি।
-ওকে,বায়।
নীর ফোনটি কান থেকে সরিয়ে নেন।ডলি বলে উঠে,
-কে কল দিয়েছে নীর?
-মা।
-কেন?
-বাসায় যেতে হবে।তুই এখন থাক। পরে কথা বলবো।
-ওকে।তবে হ্যাঁ তোর কিন্তু উওরের অপেক্ষায় থাকবো।

নীর তড়িঘড়ি ডাইনিং ছেড়ে ফোন হাতে নিয়ে চলে আসে।
কোহিনুর বেগম নাতাশার কপালে পানির ফট্রি দিচ্ছেন।রহিমা খাতুন পাশে দাড়িয়ে আছেন।ফাহাদ নাতাশার গা ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।কোহিনুর বেগম বিড়বিড় করে বলেন,
-এই মেয়েটাকে কত্তবার বললাম কোনে কাজ না করত!আর এখন জ্বর বাঁধিয়ে ১০০ ডিগ্রী করেছে।ক’দিন পর নাকি আবার পরিক্ষা!
নীর রুমে প্রবেশ করে।কোহিনুর বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-মা হাসপাতাল নিয়ে গেলে ভালো হতো!
-হাসপাতালের সেবা ছাই।অন্তত বাড়ির সেবাটাই তো পায়না।তোর সারাদিন কিসের এত্ত কাজ!বিয়ের পর থেকে দেখছি তোর মাথার উপর বেশি কাজ চেপে বসেছে। আগে তো এমনটি ছিলনা।
-মা, প্লিজজ তুমি বুঝবে না।
-হু আমি বুঝি না তুই বুঝিস।তুইতো আমার আগে পৃথিবীতে এসছিস!ক’দিন অফিস থেকে বিরতি নে একটু।আর বউকে একটু সময় দে,তার একটু যত্ন নে! আমি গেলাম।এখন তার কপালে বাকি পানির ফট্রিগুলো দে গেলাম।চল ফাহাদ,রহিমা।
-দাদু আমি যাবো না।কাকিমা যতক্ষণ না চোখ না খুলবেন ততক্ষণ আমি এখানেই বসে থাকবো।
-আচ্ছা থাক আমরা গেলাম।আর নীর নাতাশাকে দেখ।

কথা শেষ করেই রহিমা বেগমকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যান।।নীর আনমনে নাতাশার দিকে তাকায়।লম্বা চোখের পাপড়ির গোছায় চোখবুঁজা পাতাগুলো বেশ লাগছে।ঘুমন্ত কোনো পরী যেন স্বপ্বের রাজ্যে তার ঘুম ছড়িয়ে দিয়েছে।নীর নাতাশার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে চোখগুলো আবার নিচু করে আনে।গলায় খেচকি টেনে ফাহাদকে বলে,
-কি ফাহাদ? ঘুমোতে যাবে না?
-য়ু হু।
-কেন?
-আমি আজ কাকিমার কাছে থাকবো।তুমি দেখতে পাচ্ছো না কাকিমার যে অসুখ।
-হু পাচ্ছি।

নিহান দরজায় টোকা নেরে নীরকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-নীর?ফাহাদকে একটু পাঠিয়ে দে তো আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি।
-ফাহাদ তোমার আব্বু ডাকছেন,যাও সোনা।
-বললাম তো যাবো না।বার বার হাসের মতো প্যাক প্যাক করো কেন!?

নীর টানা চোখে ফাহাদের দিকে তাকায়।ছোটছেলের মুখে এমন বুলি আসলেই ধাঁধা! বায় দ্য ওয়ে আজকালকার পোলাপান বলে কথা।নীর মুঁচকি হেসে ফাহাদকে আবার বলে,
-ছোটবাবা,এভাবে ঘাড় ত্যাড়ামি করলে লোকে মন্দ বলবে।দেখো না তোমার কাকিমার ভীষণ অসুখ করছে, সেও তোমার এরকম অসদাচরণে কষ্ট পাবে।উল্টো তার অসুখ আরো বেড়ে যাবে।বাবার কথা শোনো!যাও বাবার সাথে চলে যাও।

ফাহাদ কিছুটি আর না বলে পিটপিট চোখে চারপাশটা তাকায়।ক্ষণিকে দাঁত খিঁচে বলে,
-যাচ্ছি!থাকবো না তোমাদের রুমে।বিদাই।
-আচ্ছা যাও।
-কাকিমাকে দেখো।

সড়াৎ করে ফাহাদ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।নীর নাতাশার পাশে যায়।ফট্রি প্রায়ই শুকিয়ে আসছে।
নীর বাটি থেকে পানির ফুটো ফট্রির উপর ছিটিয়ে দেয়।নাতাশার সেদিকে হুঁশ নেই।নাতাশা ক্লান্ত শরীরে গলা ছেড়ে নির্বিঘ্নে ঘুমচ্ছে।হয়তো এখন হালকা হুঁশ থাকলেও নীরকে মুখের উপর কয়েক দফা কথা শুনিয়ে দিত।
নীর আর কয়েকট ফোঁটা পানি ছিটিয়ে দিয়েই কোটটা খুলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।হাতমুখ ধুঁয়ে নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাড়ায়।মুখে একটুখানি ময়েশ্চারাইজার মেখে মাকাল ফুলের মুখটা দেখে নেয়।মাকাল আলা এই কারণে যে–যার বাহ্যিক সুন্দর, ভেতরে ছাই!

এরইমাঝে নাতাশা হালকা নড়াচড়া করে উঠে।ঘুম ঘোর ভেঙ্গে যাচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে।হয়তো পোড়া জ্বরের অস্বস্তি ঘুমঘোরেও কাতর করে তোলে।নীর তড়িঘড়ি নাতাশার গাঁয়ের উপর আর একটা কম্বল লেপে দেয়।নাতাশা গরমের আরামে কম্বলকে জড়িয়ে নাক ছেড়ে আবার নিমজ্জে ঘুমিয়ে যায়।নীরের তা দেখে মুঁচকি হাসি আসে।ঠোঁটের কিণারায় হাসিটা চেপে ডাইনিংএ যায়।কোহিনুর বেগম খাবার বেড়ে দেন।নীর কোহিনুর বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-তোমার বউমা খেয়েছে?
-কোন বউমা?
-জ্বর যার।
-নাম নেই তার?!?
কোহিনুর বেগমের ঝংকার আওয়াজে নীরের শুকনো কাশি চলে আসে।কোহিনুর বেগম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেন।আর খচখচ করে বলেন,
-আস্তেধীরে ভাত গিলা যায়না?এত্ত তাড়াহুড়োর কি আছে?
এরইমধ্যে নীর লাল টকটকে হয়ে যায়।কোহিনুর বেগম ছেলের দিকে গোলমুখে তাকান।নীর ছোটবেলা থেকেই কাশতে গেলে লাল হয়ে যেত।তা দেখে কোহিনুর বেগম নীরের কপালের কিণার,কানের পেছনের লতিতে কালি লেপে দিতেন যাতে অন্যকারো নজর না পড়ে।আজও তেমনটি ইচ্ছে হলো কিন্তু সম্ভব না।ছেলের মাথার দিকে হাত বাড়িয়ে আলতো চুলগুলো নাড়তে থাকেন।গলা ছোট করে বলেন,
-খোকা খাবারটা আস্তে খেতেই তো পারিস,এত্ত তাড়াহুড়োর কি আছে বাপ?
নীর মুঁচকি হেসে পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখে।আর চিরল হাসি এনে বলে,
-তোমার কথাইতো আমায় মুচড়ে ফেললো মা।
-আচ্ছা বাদ দে।এবার আসল কথা বলি। নাতাশা তাদের বাড়ি যেতে চাচ্ছে।এখন আমি ভাবলাম তুই ক’দিনের জন্যে ছুটি নিয়ে যদি নাতাশাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসতি তাহলে মেয়েটার ভালো লাগতো।হয়তো মা-বাবার কারণে বেজার মনটা।বৌ-ভাতের সময় না তুই থাকলি,না সে তার বাপের বাড়ি যেতে পারলো।খা খা হওয়া বুকটাকে একটু পরিপূর্ণ করিয়ে দে।কালই মেয়েটাকে নিয়ে গ্রামে যা।।
নীর প্লেটের উপর হাতের আঙ্গুল থামিয়ে বলে উঠে,
-মা তুমি কি বলছো এসব?ওর তো শরীর ভালো না।এসময় বেড়ানোটাও মুশকিল।ভালো হোক তারপর নাহয়..

কোহিনুর বেগম পাশের চেয়ার টেনে আসে পড়েন।টেবিলের উপর একহাত রেখে বলেন,
-অসুখ শারীরিক এবং মানসিল দুটোর উপরই প্রভাব ফেলে।খালি যে শারিরীক সুস্থ্যতা মানসিক সুস্থতা বিহীন হবে এমন না।তাছাড়া নাতাশার এক্সাম ফর্ম-ফিলাপ করতে হবে।
নীর তড়িঘড়ি কয়েক নালা ভাত মুখে তুলে উঠে পড়ে।কোহিনুর বেগমকে হাই তুলতে তুলতে বলে,
-আমি এত্তকিছু জানি না।ও যদি যেতে চায় তাহলল তুমি গিয়ে দিয়ে আসো।
কথা শেষ করেই বেসিনে হাতটা ধুঁয়ে ধপাস ধপাস রুমে চলে আসে।কোহিনুর বেগমের মুখটা বেজার হয়ে যায়।তার ছেলে এখনো কি আগের সে পাগলামী ছেরেছে?নাকি এখনো পাগলামী নিয়ে আছে। বিয়ের পর ছেলেদের কতধরনের পরিবর্তন। কিন্তু এ ছেলেকে তো দেখছি অগাধ ষাঁড় একটা!

নীর নাতাশার পাশে এসে আলতো ফট্রিতে হাত লাগায়।আর একটানে উঠিয়ে ফেলে।নাতাশা এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। ফট্রিটা পানির বাটির মধ্যে রেখে টি-টেবিলের উপর রেখে দেয়।মুখে শিষের শব্দ তুলে সোফার উপর শুয়ে পড়ে।

চলবে…
(নীরের কি লোক দেখানো মায়া নাকি আবেগের মন্ত্রে মায়া!?বুঝতেছি না।দেখি কি হয়!