মধু পিঁপড়া পর্ব-১০+১১

0
87

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ১০
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
মোখলেস মিয়ার মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না।তাইজুল ইসলামের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছেন বহু বছর!মানুষটা সব সময় তাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করে এসেছেন।নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার সাথে সেলিনার বিয়ে দিয়েছেন।অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন!নাহলে তার মতো এতিম অসহায়,ছেলের কপালে সেলিনার মতো অনন্য অসাধারণ মেয়েটি কখনোই জুটতো না।আবির হওয়ার সময়ও অনেক সাহায্য করেছেন।হাসপাতালের সমস্ত খরচ বহন করেছেন।কখনো ছোট করে দেখেন নি।আজ এই মানুষটি তার বেয়াই ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছে।নিজ হাতে সবাইকে বেড়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন তিনি।ছেলের বউকে পারছেন না নিজের হাতে খাইয়ে দিতে।কালকের পর থেকে তিনি যেন একটু ভয়েই আছেন।খানিক সময় পর পর জিজ্ঞেস করছেন।

–“মা তোমার কি কিছু লাগবে?আমি মাছ বেছে দিবো?তুমি এক কাজ কর মুরগির মাংস খাও।একটু ঝোল নেও।ডালটা খুব স্বাদ হয়েছে।এটা কিন্তু অবশ্যই নিবে!”

আবার আশেপাশে নজর দিতে ভুলছেন না।সবার খাওয়ার দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লক্ষ্য রাখছেন।তার সাথে যোগ হয়েছেন সেলিনা খাতুন।তিনি আরো একধাপ এগিয়ে।অন্যদিকে আবির অসহায় চোখে বার বার সামিরার দিকে তাকাচ্ছে।তার মা-বাবার মাঝে সে কথা বলার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না।কোথায় সে তার বউয়ের সাথে বসে খাবে, তা না?তাকে দূরে বসানো হয়েছে।ইশশ!মেয়েটা ইলিশ মাছ নিয়েছে।আবার যদি কোনো অঘটন ঘটে।সামান্য চিন্তায় তার ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।সে নাকি কাস্টমসের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা!অথচ মেয়েটাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে!!আবিরের নিজের খাওয়ায় একদমই খেয়াল নেই,তার চোখ কিছুটা দূরের চেয়ার বসে থাকা রমণীর পাতে নিবদ্ধ!না পারছে কিন্তু বলতে, না পারছে সহ্য করতে।আচমকা সে না খেয়েই উঠে গেল।এদিকে সবাই যার যার মতো খেয়েই যাচ্ছে।নাদিরা বেগম ছাড়া আবিরেকে কেউ তেমন খেয়াল করলো না।আমেনা বেগম আবিরের আচরণে কিছুটা ভয় পেয়েছেন,তাই তিনি গেস্ট রুমে বসে খাচ্ছেন।তার সাথে আঞ্জুমান আরাও আছেন।সবার চেয়ে বেশি খাটছে চমকি।সে দৌড়ে দৌড়ে সব কাজ করছে।
খাওয়া শেষ হতেই সামিরা জরুরি কাজের কথা বলে নামিরাকে নিয়ে আদিবার রুমে চলে গেল।আদিবার খাওয়া এখনো শেষ হয় নি।সে ডাইনিং রুমে।তার রুমটাই এই মূহুর্তে ফাঁকা,সামিরা সেই সুযোগটা কাজে লাগালো।তড়িঘড়ি করে কথা শেষ করতে হবে,সময় নষ্ট করা যাবে না।

—————

–“আবিরকে না নিয়েই চলে যাবো!! মানে কি,সামি?এসব কি বলছিস তুই?মাথা ঠিক আছে?”

—“আপা!এতো অবাক হওয়ার মতো তো কিছু বলি নি আমি!আমি শুধু আমার মতামত জানিয়েছি।”

—“এসব কথা তোর শশুর বাড়ির কারো কানে গেলে কি হবে একবার ভেবেছিস?সকালেই তো তোকে বোঝালাম তাও বুঝলি না।”

—“দেখ আপা তুই ভালো করেই জানিস আমি ফর্মালিটি করতে পছন্দ করি না।আমি অলয়েজ আমার মনে কথা মুখের বুলিতে প্রকাশ করি।আর সত্যি বলতে আমি তোদের জন্যই আবিরকে সাথে নিতে চাচ্ছি না।”

—-“বাহ!এখন সব দোষ আমাদের?দরকার হলে তোকে রেখে যাবো,তবুও আবিরকে ছাড়া যাবো না।”

কথা শেষ না করেই নামিরা রাগে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিতে নিতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।সামিরা সেদিকে তাকিয়ে থাকল।বুক ফুঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো।সব কথা সব সময় বলে বোঝানো যায় না।সে জানে বাড়িতে পৌঁছাতে দেরি তার ফুপুদের আসতে দেরি হবে না।এরপর শুরু হবে আসল সিন।তামাশার শেষ পর্যায় দেখা যাবে।ধ্যাত!সে আর ভাববে না যা হওয়ার হবে।

————–

সামিরা তার বাবার গাড়িতে করে আসতে চেয়েছিলো।কিন্তু আবিরের ঘাড়ত্যাড়ামির কাছে হার মেনে তার গাড়ি করে আসতে হচ্ছে।আসার সময় সেলিনা খাতুন অনেকক্ষণ সামিরাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন।
গাড়িতে কেবল আবির আর সামিরা।অন্যরা বাকি গাড়িতে।ড্রাইভার ছুটিতে থাকায় আবিরকে ড্রাইভ করতে হচ্ছে।সামিরার পরণে কাতান শাড়িটি স্কাই ব্লু রঙের।তার শাশুড়ির দেওয়া প্রথম উপহার! গলার হারটি শশুরের দেয়া।আদিবা দিয়েছে স্বর্ণের আংটি।সে নিজের সমস্ত জমানো টাকা দিয়ে একমাত্র ভাবীর জন্য এই উপহার এনেছে। সামিরা এতো সময় মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলো।সে হঠাৎই সরাসরি আবিরের মুখের দিকে তাকালো।স্কাই ব্লু কালারের পাঞ্জাবির হাতা কনুই অবদি গোটানো।কাপল সেট হওয়ায় সামিরার শাড়ির সাথে ম্যাচ হয়ে গিয়েছে।হাতের কালো পশম গুলো গৌর বর্ণের চামড়ার সাথে লেপ্টে আগে।চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।মুখে অন্য রকম গাম্ভীর্য!কপালের রগ ফুলে উঠেছে।গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো যেন চেহারা উজ্জ্বলতা অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিয়েছে।ট্রেনিং প্রাপ্ত পাকাপোক্ত কায়ার আপাদমস্তক স্নিগ্ধতা মাখা।নজরকাঁড়া ব্যক্তিত্ব ও গড়ন।চোখ দুটো রাস্তার দিকে স্থির।সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকটায়!সামিরা কখনো একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের সৌন্দর্যের তুলনা করতে পছন্দ করে না।কিন্তু এই মূহুর্তে মনে মনে স্বীকার করল যে,আবির মাহিদ অপেক্ষা সুদর্শন।

—“চাইলে দুটো চুমু খেতে পারো।আমি না করবো না।”

আবিরের ঠোঁটের কোনে তীর্যক হাসি।আচমকা কথা বলায় সামিরা কিছুটা ভড়কে গেল।লজ্জায় তার গাল গরম হয়ে গেল।কান দুটো থেকে অদৃশ্য ধোঁয়া বের হতে লাগলো। দৃষ্টি সরিয়ে সে বাহিরের দিকে তাকাল।এতো সময় এক ধ্যানে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকা ঠিক হয় নি।লোকটা এক নম্বর অসভ্য!সুযোগের অসৎ ব্যবহার করতে ছাড়লো না!সে না হয় একটু তাকিয়েই ছিলো!তাই বলে এভাবে লজ্জা দিতে পারলো তাকে?সামিরা নিজেকে স্বাভাবিক করে।মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলল,

—–“আমি আপনার দিকে তাকাই নি।আপনাকে দেখার মতো কিছুই নেই।আমি ওই সাইডের উইন্ডো দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম।”

—–“আমি কখন বললাম,তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?”

আবির ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো। মুখে শয়তানি হাসি।এবার সামিরার লজ্জা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।আজ অতিরিক্ত কথার দরুন,ফেঁসে গেল সে!চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলো।সে আর কোনো রকম কোনো বোকামি করতে চায় না।মিনিট পাঁচেক পর ম্যানলি রাশভারী কন্ঠস্বর খুব কাছ থেকে ভেসে আসলো।ফট করে চোখ খুলে তাকাল সে!রাস্তায় জ্যাম।আবির সিট বেল্ট খুলে কিছুটা কাছাকাছি এসেছে বসেছে।ডার্ক হ্যাজেল ব্রাউন রঙের চোখের মনি জোড়া অবসাদে ছেয়ে আছে।আকস্মাৎ সে চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল।আবির দু’হাতে সামিরার বাহু চেপে ধরলো।সামিরা স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রইলো।

—–“প্রতিটি মানুষের মাঝে আত্মসম্মান বোধ আছে।কারো প্রখর তো কারো প্রচ্ছন্ন!এ ক্ষেত্রে আমার পারসোনালিটি তীব্রতর প্রখর।আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমার থেকে সব ধরনের স্পেস তুমি পাবে।জীবনের প্রতিটি জটিল পরিস্থিতিতে আমি তোমাকে একজন বন্ধুর মতো সর্বাত্মক সমর্থন করবো।এভাবে অপমান না করলেও পারতে।”

আবিরের হিমশীতল কন্ঠ।শেষের দিকে কথাগুলোতে কেমন অসহায়ত্ব শোনা গেল। সামিরার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল।সে এখনো এক প্রকার অভিঘাতের মাঝে আঁটকে আছে। আবিরের আচরণের এমন পরিবর্তন তার মাথা ঢুকছে না।একটু আগেই তো তার সাথে ভালো করে কথা বলছি!একটু সময়ে এমন কি হলো!কথা শেষ হতে আবির সামিরাকে ছেড়ে দিলো।ততক্ষণে জ্যামও ছেড়ে গেছে।সে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো।সামিরা তাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাইলো।কিন্তু থমথমে রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেল না।চল্লিশ মিনিটের মধ্যে তারা বনানী মডেল টাউন পৌঁছে গেল।আবির গাড়ি থেকে নেমে বিপরীত পাশের দরজা খুলে দিলো।সামিরা নামার আগ পর্যন্ত সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।এতোটুকু কেয়ারিং সামিরার খুব ভালো লাগলো।মাহিদ কখনো এমন করতো না,এমনকি হাঁটার সময় সামিরা তার পাশে আছে কি না সেই খেয়ালও তার ছিলো না।তার কেবল একটাই লক্ষ্য ছিলো,কি করে কম পরিশ্রমে টাকা উপার্জন করবে সেই মাধ্যম খুঁজে বের করা।

——-

——“দুঃখিত মা!আমি এই মূহুর্তে ভেতরে আসতে পারবো না।আমায় এখনই সেগুনবাগিচায় যেতে হবে।একটু আগেই এন বি আর থেকে জরুরি কাজের তলব এসেছে।”

——“সে কি আবির এটা কেমন কথা!বিয়ের পর দিন আবার জরুরি কাজ কিসের?”

——“আসলে মা! হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়েছে তো।তাই অফিসের কাউকে জানানো হয় নি।ছুটিও নেওয়া হয় নি।আপনি প্লিজ মন খারাপ করবেন না।সুযোগ পেলে রাতে অবশ্যই আসবো।”

নাদিরা বেগম আবিরের কথায় বেশ কষ্ট পেলেন।তার মুখ কালো হয়ে গেল।

—–“দেখো আবির গত কাল রাতে তুমি যখন আমাকে আপু বলে ডাক দিয়েছো,সেই থেকে তোমাকে আমি আমার ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছি।এখন এই মূহুর্তে তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।আমাদের সাথে বাড়িতে প্রবেশ করবে।অন্য কারো কথা শুনে আমার ভাই অপমান বোধ করবে,নামিরা বেঁচে থেকে তা চেয়ে চেয়ে দেখবে??ইম্পসিবল।দরকার তোমার জন্য সবার মাথায় ধরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।ঘাড়ে ধরবো না কারণ আমার শক্ত হাতের চাপ লাগলে যদি উল্টো পালটা কিছু হয়ে যায়,তাই।”

—–“আপু,আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না।আমি বললাম তো রাতে সুযোগ থাকলে অবশ্যই আসবো।”

একে একে সবাই মিলে অনুরোধ করল।সাঈফও অনেকবার রিকোয়েস্ট করে যখন আটকাতে পারলো না।তখন তাইজুল ইসলাম মুখ খুললেন।আবির তাকে কোনোরকম বুঝ দিয়ে কেটে পড়লো।যাওয়ার আগে কথা দিয়ে গেছে,যে রাতে অবশ্যই আসবে।সবার কথোপকথনের সময় টুকুতে সামিরা পুরোপুরি নিরব ছিলো।সে তখন মনে মনে হিসেব কষছে।এর মানে আসার আগে তার আর নামিরার সম্পূর্ণ কথাবার্তাই আবিরের কানে গেছে।এজন্যই গাড়িতে জনাব রেগেছিলো!!আবির ভুল বুঝে এভাবে চলে যাওয়ায় সামিরার খুব মন খারাপ করলো।সে কাউকে কিছু না বলে নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ১১
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
আজানের শব্দ কানে পৌঁছাতে সামিরা ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।পয়তাল্লিশ মিনিটের ঘুমে চোখ মুখ একদম ফুলে গেছে।সে সময় রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে যাবতীয় ঘটনা গুলো ভাবছিলো।কখন যে চোখ লেগেছে সে টেরই পায় নি!বাঁকা হয়ে শোয়ার কারণে ঘাড়ে হাল্কা ব্যথা হচ্ছে।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।পুরো কামরা আঁধারে ডুবে আছে।হঠাৎ করেই শরীর কেমন ছমছম করে উঠলো।ল্যাম্প পোস্টের পিঙ্গল আলো বারান্দায় এসে পড়ছে।মনে হল বেলকনিতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।সামিরা হাতড়ে হাতড়ে ঘরে লাইট জ্বালালো।জোরে নিশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে,বেলকনিতে উঁকি মারলো।হ্যালুসিনেশন!কেউ নেই সেখানে।মিনিট পাঁচেক ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।বাড়ির মেইন গেইটের দিকে তাকালো সে।দারোয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে!আবার ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠে আশেপাশে তাকাচ্ছে।সামিরা দ্রুত ঘরে প্রবেশ করলো।শাড়ি বদলে সাদা রঙের কুর্তি সাথে পার্পল কালারের পায়জামা ওড়না পড়ে নিলো।ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো।অতপর সকল দ্বিধা ঝেড়ে আবিরের নম্বরে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিলো।আজ সকালেই নামিরা তার মোবাইলে আবিরের নম্বর সেভ করে দিয়েছে।মেসেজ পাঠাতেই বিক্ষিপ্ত মনটা যেন মূহুর্তেই স্থির হয়ে এলো!যেহেতু মানুষটা তাকে সময় দিয়েছে,তারও উচিত দু’কদম এগিয়ে এসে বৈবাহিক বন্ধনটাকে দৃঢ় করা।আর বিগত কয়েক ঘন্টায় যতোটুকু জেনেছে বা দেখেছে মানুষটাকে খারাপ মনে হয় নি।আবিরের মাঝে কিছু একটা রহস্য আছে,এই বিষয়ে সামিরা সিউর।আবিরের চোখজোড়াতে কেমন যেন এক বেদনাময় আকুলতা!কোনো কিছু পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ যেন মানুষটার ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।আচ্ছা!সে কি সামিরাকে ভালোবাসে?নিজের ভাবনায় সামিরা চমকে উঠলো।না,না!!ভালোবাসলে বিয়ের সময় কাঁদছিলো কেন? তাহলে সে কি অন্য কাউকে ভালোবাসে?অন্য কাউকে ভালোবাসলে তো সামিরার সাথে স্বাভাবিক সংসার করতে চাইতো না?উফফ!!জীবনে এতো জটিলতা কেন?সামিরা দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো।সে প্রথম ভেবেছিলো সেলিনা খাতুন হয়ত তার বাবার টাকার লোভে পড়ে,নিজের ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন।কিন্তু গত কাল সেলিনা খাতুনের সাথে কথা বলার পর,সামিরার ধারণা পুরোপুরি বদলে গেছে।সেলিনা খাতুন আত্মসম্মানী,অমায়িক,বিশুদ্ধ মনের একজন নারী।সামিরা নিজের বিবেক,চিন্তা শক্তিকে মনে মনে ধিক্কার জানালো।দরজায় টোকা পড়ার শব্দে তার ধ্যান ভাঙলো।তড়িঘড়ি করে রুমের দরজা খুললো।চমকিকে দেখে কিছুটা আশাহত।সে ভেবেছিলো তার মেসেজ পেয়ে আবির হয়ত ছুটে এসেছে।মনে মনে দুঃখ পেলেও ওপরে ওপরে সে তার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক রাখলো।

—“কিছু বলবে,চমকি?”

—-আমনের ফুপুরা আইছে,নামিরা আপা নিচে যাইতে কইছে।

—-“তুমি যাও,আমি আসছি।”

চমকি চলে যেতেই সামিরা দরজা লাগিয়ে দিলো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক নিজেকে কয়েকবার পরখ করলো।নিচে যাওয়ার আগে নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরি করে নিলো।

————-

—“সামিরার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছো?একদিনে মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে!!বিয়ে ভেঙেছেই না হয়!তাই বলে কি দরকার ছিলো,এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেওয়ার?এখনো সময় আছে,ডিভোর্সটা করিয়ে দেও।”

স্ত্রীর কথায় তাইজুল ইসলামের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেল না।তিনি যা করেছেন ভেবে চিন্তেই করেছেন।মেয়ের ভালো কিসে তিনি খুব ভালো করেই জানেন!!

—-“কিছু তো বলো!এভাবে চুপ থাকার মানে কি?'”

—-“আবিরের সাথে একটু আগেই কথা হয়েছে।তার ডিপার্টমেন্টের হেড অফিসার নাকি বিয়ের উপহার স্বরূপ পুরো এক সপ্তাহ মালদ্বীপে থাকা ও ঘোরার সকল ব্যবস্থা করে দিয়েছে।সে সামিরাকে নিয়ে কালকে সকালেই মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে চায়।সামিরার ভিসা,পাসপোর্ট তো আগেরই তৈরি।আমার মতে,দুজনে একসাথে ঘুরে আসুক দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”

—-“এড়িয়ে যাচ্ছো?আচ্ছা,তোমার মনে হয় না মেয়ের জীবন নিয়ে,তুমি এবার একটু বেশি হেলাফেলা করছো।মেয়েটা অন্তত জিজ্ঞেস করো,সে যেতে রাজি কি না?

—–“নাদিরা!মেয়েটা কিন্তু আমারো।বিয়েটা যেহেতু আমি দিয়েছি,অতএব আমাকেই বুঝতে দেও।”

স্বামীর এমন শীতল কণ্ঠে নাদিরা বেগম পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলেন।বুঝতে পারলে এখানে তার কথায় কিছুই হবে না।কেবল চুপচাপ দেখেই যেতে হবে।কিছু সময় স্বামীর মুখের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে,কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন।

—————–

–“কিরে!জামাই আসে নি?বিয়ের পরদিন জামাইকে না নিয়েই এসে পড়েছিস?”

সামিরা তার বড় ফুপুর কথার উত্তর দেওয়ার পূর্বে পাশ থেকে তার ছোট ফুফু বলে উঠলো,

—“আরে নাজমা ভুলে গেছিস নাকি!ড্রাইভারের ছেলে তো!নিজেও বোধহয় গাড়ি চালায়।একদিন কাজে না গেলে তো ড্রাইভারদের বিশাল লস।পরে আমাদের সামিরা খাবে কি?কাজের জন্যই আসে নি বোধ হয়।”

—-“কেন কেন?তাইজুর কি টাকা কম পড়ে গেছে!!দরকার হলে ঘর জামাই রেখে দিবে,মেয়ের সাথে সাথে জামাইয়েরও ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করবে।তাও মেয়েকে ফকিরি হাওলাতে রাখবে না।”

নাজমা বেগমের কথায় নাজনীন বেগম উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলেন।সামিরা জানতো এমন কিছুই হবে।ভাগ্যিস!আবির এখানে নেই।মানুষটা কি করে এতো বড় অপমান সহ্য করতো।সামিরা নামিরার দিকে তাকালো।নামিরার চোখে জল।তার সমস্যা এখানেই!কখনোই সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না।বড় মানুষের মুখে মুখে তর্ক করতে নেই,এই শিক্ষাই তারা তাদের মায়ের থেকে পেয়ে এসেছে।নামিরার বুক ফাটে,তবুও মুখ ফুটে না!কিন্তু তার বাবারও একটা শিক্ষা আছে,যেটার সঠিক ব্যবহার সামিরা যথাযথভাবেই জানে।বিনা তর্কে অনেক সময় সঠিক কথা বলে জেতা সম্ভব।তার জন্য প্রয়োজন একটু ট্রিকস খাটিয়ে কথা বলা।দুই ফুপুর ঠাট্টা,তামশা সামিরার দেহে কাঁটার ন্যায় বিঁধতে লাগলো।তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল।পরক্ষণে মুখে অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠলো।

—-“সত্যি বলতে আমার বাবার টাকা দিন দিন কমে যাচ্ছে।আর এর কারণ হলো প্রতিমাসের শুরুতে দু’দুটো ভিখারি আসে,তারাই আড়ালে আবডালে ছোটখাটো জিনিস লুট করে নিয়ে যায়।কিন্তু তোমরা টেনশন নিও না, আমার স্বামী তো কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার।কিছুদিন আগে চোরাকারবারির সাথে জড়িত লোকদের সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাকে গ্রান্ট অফ রিওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে।ভাবছি শীঘ্রই তাকে দিয়ে রেইড নোটিশ জারি করাবো।তারপর সেই দুটো ভিখারির বাড়িতে তল্লাশি চালাবো।”

সামিরার কথা শুনে তার উভয় ফুপু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল। মাসের শুরুতে নিজেদের সংসারের যাবতীয় খরচ এখনো তারা তাদের ভাইয়ের থেকে আদায় করে।সেই সাথে মাঝে মাঝে হাত সাফাইয়ের জন্য কিছু জিনিস এদিক সেদিক করে।কিন্তু তাদের ধারণা ছিলো এসব কারো নজরে পড়ে নি!এদিকে সামিরা সব জেনে বসে আছে। লজ্জায়,রাগে নাজমা ও নাজনীন বেগম কাউকে কিছু না জানিয়ে তাৎক্ষণাৎ প্রস্থান নিলেন।পুরো ঘটনার সাক্ষী থাকলো শুধু নামিরা, সামিরা ও অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা চমকি।

————

সামিরাদের বাড়ির পেছনে বেশ বড়সড় একটা সবজি বাগান।প্রায় বারো রকমের শাকসবজির গাছ রয়েছে।আদিবা ঘুরে ঘুরে সবকিছু অবজার্ভ করছে।তার এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে।আচমকা কেউ তার উষ্ণ গালে হিমশীতল হাত চেপে ধরলো।একে তো শীত!চারদিকে টুপটাপ কুয়াশা ঝরছে।তারপর আকস্মিক এমন বরফ শীতল স্পর্শ!আদিবা চোখমুখ কুচকে অস্ফুট শব্দে চেঁচিয়ে উঠলো।আদিবাকে জ্বালাতে পেরে সাঈফ খিকখিক করে হাসতে লাগলো।আদিবা চোখ খুলে সাঈফের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল।সাঈফকে শায়েস্তা করার জন্য নিচে পড়ে থাকা ছোট সাইজের ওয়াটারিং ক্যান হাতে তুলে নিলো।অল্প কিছু পানি আছে!এতেই তার কাজ হয়ে যাবে।সে সাঈফের কিছুটা কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়ালো।তারপর ক্যানের ফ্রন্ট সাইডের ঝাঁঝরির মতো অংশ টুকু কৌশলে সাঈফের পিঠের দিক দিয়ে শার্টের ভেতর প্রবেশ করালো।শীত অনুভূত হওয়ার পূর্বেই পানির ধারায় মূহুর্তেই পেছন দিক পুরোপুরি ভিজে গেল।কয়েক সেকেন্ডে ঠান্ডার মাত্রা বেড়ে গেলে!ততোক্ষণে সাঈফের হুশ এসে গেছে।সে আদিবার গায়ের চাঁদর টেনে নিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো।প্রথমে কিছুটা হাসি পেলেও পর মূহুর্তে আদিবার মায়া হলো।সে কাচুমাচু মুখে সাঈফে সরি বললো।আদিবার ছলছল গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে সাঈফের কিছু একটা হয়ে গেল।তাদের মধ্যকার দূরত্ব গুছিয়ে সে অনেকটা কাছে এসে,আদিবার কপালে তার পুরু ঠোঁট চেপে ধরলো। দু’সেকেণ্ডের মাথায় সরেও এলো।আদিবা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল।তার হাঁটু কাঁপছে।গলা শুকিয়ে গেছে।জীবনের প্রথম কোনো পুরুষকে এতো কাছ থেকে সে অনুভব করেছে।এইটুকু হাল্কা স্পর্শ যেন তার সারা দেহের শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে্।সাঈফ আদিবার থুতনি ধরে মুখটা কিছুটা ওপরে তুলে ধরলো।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

“তারার মতো তন্দ্রাহারা
তোমার দুটি আঁখিতারা
আমার চোখে চেয়ে চেয়ে
অশ্রুসজল হোক”
(কাজী নজরুল ইসলাম)

আদিবার চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সাঈফের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়কে গভীর ভাবে ছুইয়ে দিয়েছে।সে কয়েক কদম পিছিয়ে,ঘোরগ্রস্তের ন্যায় বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।পেছনে ফেলে গেল এক অমীমাংসিত প্রণয় উপাখ্যান।

——————

আবির এলো রাত একটা বাজে।বাড়ির সকলে তখন নিজ নিজ কামরায় নিদ্রারত!সামিরা হলরুমে বসে সেমিস্টার ফাইনালের পড়া কভার করছিলো।আবিরকে দেখে তেমন অবাক হলো না।সে জানত,আবির তার মেসেজ দেখলে অবশ্যই আসবে।তীব্র শীতের মাঝেও সে হাঁপাচ্ছে।পরনের শার্ট জায়গায় জায়গায় ঘামে ভিজে গেছে।

——“সরি!ব্যস্ততার জন্য তোমার মেসেজ দেখতে পাই নি।একটু আগেই দেখেছি।আর দেখার সাথে সাথে ছুটে এসেছি।”

——-“আমার জানা মতে গরু,ছাগল,বাছুর ছুটোছুটি করে।কিন্তু আপনি তো মানুষ!!তাহলে ছুটে আসলেন কেন?আস্তে ধীরে হেঁটে আসতেও পারতেন।”

সামিরার কথায় আবির কিছুটা লজ্জা পেলো। আমতা আমতা করে বলল,

—“তুমি তো মেসেজে বলেছিলে,আমি না আসলে নাকি রাতে ভাত খাবে না।তাই ভাবলাম এখনো হয়ত খাও নি।তাই আর কি…..”

—-“ভাত খাবো না বলেছি,কারণ রাতের খাবারে আমি চিকপি সালাদ খাই।”

সামিরার এমন কাট কাট কথায় আবিরের মুখ ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।মেয়েটা যে ইচ্ছে করে তাকে জ্বালাতে চাইসে,সে ভালোভাবে বুঝতে পারলো। প্রসঙ্গে বদলে সে বলে উঠলো,

—“মালদ্বীপ যাবে?”

—–“হ্যাঁ!যাবো তো।কিন্তু আপনার সাথে না। ”

আবিরের দুঃখের মাত্রা বেড়ে গেল।সে মর্মাহত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—“তাহলে,কার সাথে যাবে?”

সামিরা কিছুটা ভাব নিয়ে,ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

—“আপা নাকি একটা নতুন ভাই পাতিয়েছে।সারাক্ষণ খালি সেই ভাইয়ের তারিফ করে।ভেবেছি ওই লোকের সাথেই যাবো।গিয়ে দেখি একবার,কেমন ভালো সে!”

কিছু সময় পার হতেই আবির সামিরার কথা ধরতে পারলো।তার ওষ্ঠ খুশিতে প্রসারিত হয়ে গেল। যাক,অবশেষে তার মধু চাঁদ বিহীন হানিমুন সফল হতে চলছে! সামিরা আড়চোখে আবিরের প্রাণবন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

চলবে…