মধু পিঁপড়া পর্ব-১৬+১৭

0
79

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৬
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
জ্ঞান ফিরতে সাঈফ দেখলো সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।ফিনাইলের গন্ধ নাকে প্রবেশ করতেই তার গা গুলিয়ে উঠলো।সারারাত না খাওয়া,এর ওপরে জ্বর!সব মিলিয়ে শরীরের অবস্থা করুণ।এখন জ্বর কিছুটা কমলেও,শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা রয়ে গেছে।এক হাতে মাথা চেপে ধরে সে উঠে বসলো।
–“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলে?”
সাঈফ খানিকটা বিরক্তির সহিত বলল।কথাটা যার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে,সে এক মনে পত্রিকা পড়ছিলো।আদিবা পেপার নামিয়ে সাঈফের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।সাঈফ পুনরায় জিজ্ঞেস,
—“জবাব দিচ্ছো না কেন?”
আদিবা চট করেই দাঁড়িয়ে পড়লো কুর্নিশ করার ভঙ্গিমায় বলে উঠলো,
—“মাফ করবেন,জাঁহাপনা!আপনাকে এখানে এনে অনেক বড় ভুল করেছি আমি।দয়া করে আমাকে শাস্তি দিবেন না।”
সাঈফ ভড়কে গেল।আদিবার এমন আচরণের মানে খুঁজে পেল না।কি বলবে তাৎক্ষণিক বুঝতেও পারলো না।পর মূহুর্তে আদিবা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ভেঙিয়ে বলল,
—“আপনি বাদশাহ,রাজাধিরাজ!আপনাকে এমন সস্তা হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।ঢের অন্যায় হয়ে গেছে আমার!আপনার জানাশোনা ফাইভ স্টার হসপিটালের নাম বলুন,সেখানেই না হয় নিয়ে যাচ্ছি।”
এতোক্ষণে সাঈফ আদিবার এ ধরনের কথাবার্তার কারণ ধরতে পারলো।মেয়েটা কি তাকে কখনোই বুঝবে না?সবকিছু উল্টোই কেন বুঝতে হবে তাকে?সে তো শুধু বলতে চেয়েছিলো,এমন গুরুতর কিছুই হয় নি যে হসপিটালে আনতে হবে।সাঈফ চাপা শ্বাস ছাড়লো।আদিবার দিকে আড়চোখে তাকাল।ললনার মুখে বিরক্তির ছাপ।চোখ জুড়ে ক্লান্তি,অবসাদ।ঝুঁটি করা চুলগুলো পিঠের ওপর পড়ে আছে।বেবি হেয়ারগুলো কপালের দুপাশ বেয়ে গালের পাশে ঝুলছে।পরনের কলেজ ড্রেস নিচের দিকে ভেজা।হয়ত পরিষ্কার করেছে।এই অগোছালো আদিবাকে সাঈফ মনে মনে একটা নাম দিলো।মলিন মুখের মায়াবতী!
–“কি হলো জাঁহাপনা?বলুন দয়া করে!কলেজ,ক্লাস টেস্ট সবকিছু রেখে আপনার সেবা করি।”
আদিবার শ্লেষাত্মক কন্ঠ কানে আসতে সাঈফের ঘোর কাটলো।সে মিনমিন করে বলল,
–“ফাইভ স্টার রেস্ট্ররেন্টের নাম জানা আছে কিন্তু হসপিটালের নাম আমার জানা নেই।”
সাঈফের কথা পুরোটাই আদিবার কানে এসেছে। সে কটমট করে তাকাল।আজকে তার ক্লাস টেস্ট ছিলো।পরীক্ষার জন্য বেশ ভালোই প্রিপারেশন নিয়েছিলো সে।অথচ সাঈফের জন্য সব ভেস্তে গেল।এর ওপরে সকাল সকাল রাস্তায় তাকে জড়িয়ে ধরে লোকটা কতো বড় সিনক্রিয়েটই না করলো!কলেজের সামনে হওয়ায় তার ক্লাসমেটদের মধ্যে দু’জন সেটা লক্ষ্যও করেছে।ইতিমধ্যে ক্লাসের সবাই জেনেও গেছে হয়ত।সব মিলিয়ে আদিবা এখন চরম রাগান্বিত!
আচমকা কেবিনের দরজা ধরাম শব্দ করে খুলে গেল।হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো নামিরা।তার পরনে গর্জিয়াছ শাড়ি,মুখ ভর্তি হেভি মেকআপ।দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হয়েছিলো,কোনো রকম ছুুটে এসেছে।নামিরা সাঈফের গালে তাৎক্ষণাৎ চড় বসিয়ে দিলো।পর মূহুর্তে বেডের কোনায় বসে ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে দিলো।সাথে গুনগুনিয়ে বলতে লাগলো,

–“জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে একবার অন্তত ফোনে কল দিয়ে জানাতে পারতি!কোনো গর্তে বা ড্রেনে পড়ে গেলে,তখন কি হতো?বিয়ে না করতে আমাকে পর করে দিয়েছিস!জ্বর এসেছে একবার জানানোরও প্রয়োজন মনে করিস নি?বাচ্চা মেয়েটা ফোন না দিলে তোকে কি করে খুঁজে পেতাম?”

নামিরার এমন অদ্ভুত আচরণের আদিবা হতভম্ব।এমন কান্ড হবে জানলে সে কখনোই নামিরাকে কল করতো না।সাঈফের জন্য তার হঠাৎই খুব মায়া হতে লাগলো।পরবর্তীতে কি হয় তা দেখার জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।এর মধ্যে রাতুল আর হাসিবও এসে পড়েছে।তাদের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা!সাঈফে ঠোঁটে মৃদু হাসি।সে জানতো যতো কিছুই হোক না কেন,দিনশেষে এই দুই মাথামোটার শেষ ঠিকানা তার কাছেই!হাসিব এক পলক আদিবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে সাঈফকে দেখলো।অন্যদিকে রাতুল কিছু না বলে সাঈফের কপালে হাত রাখলো।স্বাভাবিকভাবেই হাত সরিয়ে নিলো।আদিবাকে দেখেও যেন দেখলো না।

–“আপু!!আমি বরং ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি।”

রাতুল ধীর গলায় বলে উঠলো। নামিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।রাতুলের পেছন পেছন হাসিবও বেরিয়ে গেল।আদিবা এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।ভাই-বোনের মাঝে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা তার কাছে ভীষণ অযাচিত মনে হলো!!সে কেবিন ত্যাগ করার জন্য যেইমাত্র ঘুরে দাঁড়ালো ওমনি নামিরা পেছন উঠে এসে খপ তার হাত চেপে ধরলো।তারপর করুণ গলায় বলল,

—“ইশশ! মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। অনেক সময় হয়েছে এখানে রয়েছো,তাই না?খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?”

—“না না আপু তেমন কিছুই না।আমি ঠিক আছি।”

আদিবা হাল্কা হাঁসলো।নামিরা নিজের মতো বলতে লাগলো,

—-“গাধাটাকে নিয়ে হয়েছে যতো জ্বালা।স্থির থাকতে তার কষ্ট হয়।কি দরকার ছিলো এতো জ্বর নিয়ে বাহিরে বের হওয়ার?কই ভেবেছিলাম ফ্রেন্ডের সাথে ভালো একটা সময় কাটাবো,সব ক্যান্সেল করতে হলো ।সেই সাথে তোমার পুরো দিনটা ও বরবাদ।”

—“সমস্যা নেই আপু।”

আদিবা মৃদুস্বরে জবাব দিলো।

—“আচ্ছা তুই গার্লস কলেজের সামনে কি করছিলি?”

নামিরা আচমকাই সাঈফের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।সাঈফ এতো সময় আড়চোখে আদিবাকে দেখছিলো।নামিরার কথায় সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল।আদিবাও কিছুটা নার্ভাস।সাঈফ যে সেখানে তার জন্যই গিয়েছে সে তা জানে।
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল।নামিরার চোখেও বিষয়টি ধরা পড়লো।সে প্রসঙ্গ বদলাতে বলে উঠলো,

–“যাক গে!সামুকে জানিও না,ও আবার অহেতুক চিন্তা করবে।”

আদিবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।মুখে বলল,

—“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন!ভাবীকে আমি কিছুই বলবো না।”

খানিকটা থেমে বলল,

–“তাহলে এবার আমি আসি,না হয়?”

–“তা হবে না,সোনা! একা একা তোমাকে যেতে দিচ্ছিনা।তোমাকে পৌঁছে দিয়ে,আমরা বাড়ি ফিরবো।”

–“কিন্তু আপু আমি…।

নামিরা চোখ পাকালো।গম্ভীর গলায় বলল,

–“ব্যস!আমি যা বলেছি তাই হবে।”

নামিরার শাসনের সামনে আদিবা দমে গেল।এছাড়া সে নিজেও কিছুটা সময় সাঈফের পাশে থাকতে চাচ্ছিলো।

—————-
স্বচ্ছ কাচের অপরপাশে নীলচে পানির সম্ভার। নৈসর্গিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে মহাসাগরীয় অতল জুড়ে।রঙিন জলজ প্রাণীর পাশাপাশি তলদেশের হরেক জীব। সমস্তটাই যেন এক রূপকথার সাম্রাজ্য !
সামিরা খানিকের জন্য মোহে আঁটকে পড়ে গেছে।অপরদিকে আবিরও একমনে আশপাশটা দেখলেও,তার নজর বার বার স্নিগ্ধ প্রেয়সীর পানে আঁটকে যাচ্ছে।

ইথা আন্ডারসি রেস্টুরেন্ট।তারা এখানে এসে লাঞ্চ করতে!মাছকে সাঁতার কাটতে দেখে পানির নিচে খাবার খাওয়া জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
সেই সাথে মৎস্য জগৎটাকে কাছে থেকে পুরোপুরি উপভোগ করা।
ইথা,যার দিভেহির অর্থ মাদার-অফ-পার্ল! মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্রের আলিফ ধাল অ্যাটলের কনরাড মালদ্বীপ রাঙ্গালি দ্বীপ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার নীচে অবস্থিত একটি সমুদ্রের নিচের রেস্তোরাঁ।এর বিশেষত্ব হলো প্রবেশদ্বারে জেটির শেষ প্রান্তে একটি খড়ের প্যাভিলিয়নের একটি সর্পিল সিঁড়ি রয়েছে। ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্পের পর যে সুনামি হয়েছিল তা সিঁড়ির প্রবেশপথের নীচে ০.৩১ মিটার উপরে উঠেছিল এবং রেস্তোঁরাটির কোনও ক্ষতি হয়নি।নিজস্বতা আঁকড়ে ধরে এটি টিকে রয়েছে।

—“মিরা!অনেক তো মাছ দেখলে,এবার দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে একটু তাকাও।”

—“আপনার দিকে তাকালে কি হবে?”

সামিরার হেঁয়ালি উত্তর।আবির তাৎক্ষণাত জবাব দিলো।

–“কি আর হবে?প্রেমে পড়েবে।”

–“ওমা তাই?ঠিক আছে তাহলে।”

সামিরা সঙ্গে সঙ্গে আবিরের দিকে চোখ টেরা করে তাকালো।আবির যেন প্রস্তুত ছিলো।সে সামিরার বাহু আঁকড়ে ধরে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো।

—“বহুত হয়েছে বাচ্চামো! এবার চল।খেয়ে নেই।”

—“আপনি কিন্তু এখন আমাকে জোর করছেন।”

—“নো মোর ওয়ার্ড।তোমার ভালোর সাথে রিলেটেড সবকিছুতেই জোর করবো।কোনো বাঁধাই মানবো না।”

সামিরাকে তাড়া দিয়ে এক প্রকার জোর করেই কাঙ্খিত চেয়ারে বসিয়ে দিলো।সামিরাও চুপচাপ বসে পড়লো।কেন যেন আবিরের এই এক্সট্রা কেয়ার তার খুব ভালো লাগছে।মুখ ফুটে না বললেও মনে মনে বেশ শান্তি অনুভব করলো।আবির বিপরীত পাশের চেয়ারে নিজেও বসে পড়লো।মিনিট দশের মধ্যে রিফ লবস্টার স্টাফড ক্যালামরায় পাস্তা,ওয়াইল্ড মাশরুম এন্ড ট্রাফল ডাম্পলিং,গ্রীন আ্যাপল ও জিনজান সরবেট নিয়ে ওয়েটার হাজির হলো। আবির লক্ষ্য করলো সামিরা খুব সুনিপুণ ভাবে ডাম্পলিং গুলো চপস্টিকের সাহায্যে মুখে তুলে নিছে।সে নিজস্ব কৌতূহল মেটাতে কাটা চামচ রেখে চপস্টিক হাতে তুলে নিলো।দেখতে সহজ মনে হলেও অভ্যাস ও সংস্কৃতিগত কারণে সে কয়েকবার চেষ্টা করেও অপারগ হলো।হাল ছেড়ে দিয়ে যখন কাঁটাচামচে হাত দিলো,ঠিক সেই মূহুর্তে সামিরা তার মুখের সামনে চপস্টিকে করে খাবার তুলে ধরলো।সিরিয়াস কন্ঠে বলল,

–“আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনি মানুষটা বেশ ধৈর্যশীল।কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে ঠিক ততোটাই অধৈর্য।”

আবির কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে নিলো।সে ভেবেছিলো সামিরা হয়ত একইভাবে বাকি খাবার গুলো খাইয়ে দিবে।কিন্তু সে তার হাতে চপস্টিক তুলে দিলো।তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল,

—“এখানে জোরজবরদস্তির কিছুই নেই!খুবই লাইটলি চপস্টিক দিয়ে ডাম্পলিং গুলো তুলে নিন।”

আবির সামিরার কথামতো চেষ্টা করলো।দেখা গেল এবার খুব সহজেই তুলে নিতে পেরেছে।ফটাফট দুটো নিজের মুখে পুরে নিলো।

—“আপনি তো ভীষণ স্বার্থপর দেখছি!!আমাকে না দিয়ে একা একাই খেয়ে নিচ্ছেন।”

আবির সামিরার কথামতো মুখের সামনে তুলে ধরলো।কিন্তু সামিরা মুখ ফিরিয়ে নিলো।কপট রাগান্বিত স্বরে বলল,

—“খালি আমার কাছে আসার ধান্দা!!সবই বুঝি আমি।”

—“সবই যখন বুঝতে পারো।তাহলে মেনে নিচ্ছো না কেনো?”

কিছু সময় আগে সামিরা মজা করলেও এবার আবিরের কথায় সে থমকে গেল।আপন মনে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্ব ১৭
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
ক্ষণে ক্ষণে বুকটা মুচড়ে উঠছে।এ কেমন নিদারুণ কষ্ট?হৃদয়ের অন্তঃস্থিতে তান্ডব শুরু হয়েছে।সমস্তটাই কেমন দিগ্‌ভ্রান্ত!পকেটে রুমাল থাকা স্বত্তেও, অদৃষ্টে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘর্ম কণা হাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে মুছে নিলো আবির।স্বেদ জ্বলে ভিজে পরনের হাওয়াইয়ান শার্ট সিনার সাথে লেপ্টে আছে।গৌরবরণ বলিষ্ঠ কায়ার প্রতিটি ধমনীতে ধপ ধপ করছে।গলা শুকিয়ে কাঠ!অথচ কয়েক মিনিট আগেই সে এক গ্লাস পানি পান করেছে।এরপরই তো অঘটন ঘটলো।কি হতো সে যদি ওই সময় কল রিসিভ করতো না উঠতো!নিরতিশয় দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল সে।না,তার মিরা নেই!তাকে এভাবে একা রেখে কোথায় গেল মেয়েটা?চিরকালের জন্য কি ছেড়ে গিয়েছে?আচমকা এমন ভাবনা মাথায় আসতেই আবিরের অন্তর কেঁপে উঠলো।সে নিজেকে শুধালো।
“না!না এমন নেতিবাচক চিন্তার কোনো মানেই হয় না।”
হঠাৎ সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।দু’হাতে চুল খামচে ধরলো।চোখ দুটোয় লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে।দেহের ভেতরের মনটা কেমন অশান্ত!কিছু সময় আগের দৃশ্য নয়নপটে ভেসে উঠলো।

———-

—“তুমি সিউর আর কিছু নিবে না?এপেটাইজারেও তো তেমন কিছুই নিলে না।সবটা আমাকেই দিয়ে দিলে।”

—“আপনার কি আমাকে রাক্ষস মনে হয়?আমার পক্ষে আর কিছু খাওয়া সম্ভব না।”

—“ওকে ফাইন!বাট…”

কথোপকথনের মাঝে আবিরের ফোন বেজে উঠলো।ফোন কলটি দেখে তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।তাৎক্ষণাৎ কলটি রিসিভ করে নিলো।কানে ধরতেই বিপরীত পাশের লোকটি মিনিট দুই অনর্গল কথা বলল।আবির সমস্তটাই কেবল শুনলো।মাঝে খানিকটা মৃদু গলায় বলল,

—“রাইট নাও??”

কয়েক সেকেন্ড নিরবতা।অপরদিকের মানুষটি কিছু বলছে হয়ত!সামিরা শুনতে পেল না।

—ওকে স্যার।”

আবির পানির গ্লাস হাত থেকে নামিয়ে দূরের টেবিলে আড়চোখে কিছু একটা দেখে নিলো।সেখানে একজোড়া কাপল বসে আছে।এদের মধ্যে একজন মধ্য বয়সী লোক!টাক মাথার,আধাপাকা গোঁফ ও অতিশয় ভুরি বিশিষ্ট গোলগাল চেহারার মানুষটিকে দেখে বাংলাদেশী মনে হচ্ছে।সাথে থাকা মেয়েটি অল্পবয়সী।সেই সাথে বেশ সুন্দরীও। আনুমানিক ১৮-২০ বছর।তারা একে অপরের হাত আঁকড়ে ধরে কিছু একটা বলছে, আর মিটমিট করে হাসছে।
প্রথম দেখায় যেকারোই মনে হবে তারা হয়ত বাবা-মেয়ে!!তাদের থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে সে এক পলক তার মিরার দিকে তাকাল।সামিরা তখন চারপাশের মানুষের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে।তার নজর আবিরের চিন্তিত মুখ এড়িয়ে গেল।অপরদিকে সেই মধ্যবয়স্ক লোক ও মেয়েটি ইতিমধ্যে এক্সিট পয়েন্টের দিকে পা বাড়িয়েছে।আবির তাৎক্ষণাৎ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে সামিরার হাত আলতোভাবে ছুঁয়ে দিলো।নিগূঢ় স্বরে বলল,

–“অফিসের কল।বেশ ইম্পর্ট্যান্ট।একটু পারসোনালি এ্যাটেন্ড করতে হবে!”

–“ওকে,সমস্যা নেই।আপনি নিশ্চিন্তে কথা বলুন।”

সামিরার সম্মতি পেয়ে আবির চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল।কয়েক কদম হেঁটে পুনরায় ফিরে এলো।কিছুটা গম্ভীর ও শাসনের স্বরে বলল,

“—-বিল পে করা হয়ে গেছে।স্টে দেয়ার!ডোন্ট গো এনিহোয়ার।আইল ইউল কাম ব্যাক সুন।”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কানে নিয়ে আবির এক্সিটের দিকে চলে গেল।কাজ শেষ হতেই মিনিট বিশেকের মধ্যেই ফিরে এলো।এসে দেখলো কাঙ্খিত চেয়ার সম্পূর্ণ ফাঁকা!সামিরা নেই।অথচ তার মোবাইল টেবিলে পড়ে আছে।আবিরের সমস্ত দুনিয়া কেমন দুলে উঠলো!অশান্ত মনকে বুঝিয়ে এদিক ওদিক তাকাল।সে সাথে পাও চলতে লাগলো।কয়েকজনকে সামিরার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেসও করলো।না কেউ তাকে দেখে নি!!সময় যতো বাড়তে লাগলো আবিরের চলনের গতিবেগ ও হৃদস্পন্দন দু’ই বেড়ে গেল।গুরমেট ডাইনিং এর প্রতিটি কোণা কোণা চেক করলো।চিবুক বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো।ক্লান্তিতে শরীর কেঁপে উঠল। এক পর্যায়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

——-

–“কি হয়েছে আপনার?শরীর খারাপ করছে?এভাবে এখানে বসে আছেন কেন?”

আবির দু’হাতে মুখ চেপে সামিরার সাথে কাটানো বিগত সময়গুলো ভাবছিলো।আচমকা কানের মধ্যে সুপরিচিত রিনরিনে কন্ঠ বেজে উঠতেই সে ধড়ফড় করে উঠে দাড়াল।চারপাশের তোয়াক্কা না করেই পাখি নরম তুলতুলে শরীরটাকে নিজের বুকপটে চেপে ধরলো।মুখ জুড়ে এলোপাতাড়ি চুমু খেলো।অতপর ঘাড়ের মাঝে মুখ গুঁজে দিলো।জল বিহীন মাছের ছটফটানি জলের সংস্পর্শে আসলে যেমন থেমে যায়,ঠিক তেমনি সামিরার পরশে আবিরের মনের দহন নিমিষেই নিভে গেছে!এদিকে সামিরা হতবিহ্বল,জ্ঞানশূন্য।কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারলো না।আবিরের তপ্ত নিশ্বাসে তার শরীর শিউরে উঠছে।হাত,পা অসার হয়ে আসছে।
মনে হচ্ছে মসৃণ বদনের প্রতিটি ভাঁজে পুরু ওষ্ঠের ওম মিশে গেছে।সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে,নিজের পরনের জামার একাংশ শক্ত করে মুঠো পুড়ে নিলো। চোখ বুঝে দাঁড়িয়ে,জুড়ে জুড়ে শ্বাস ফেলছে।খানিকটা আগে তার জীবনের সবচেয়ে অস্বস্তিজনক ও বিব্রতকর ঘটনাটি ঘটে গেছে।সে লজ্জায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।হঠাৎ আবির বাঁধন থেকে সামিরা মুক্ত করলো।বলশালী দু’হস্তে কোমল বাহু সমস্ত শক্তিতে চেপে ধরলো।সামিরা ভীষণ ব্যথা পেলেও তেমন রিয়েক্ট করো না।সে আবিরের রক্তচক্ষু পানে তাকিয়ে আছে।এ কেমন রূপ?মানুষটাকে এ মূহুর্তে ভীষণ হিংস্র লাগছে।আবিরের রাগান্বিত গলায় সামিরার ঘোর কাটলো।

—“ডোন্ট ইউ হ্যাভ এ্যানি সেন্স?মানুষকে পেরেশানিতে রাখতে বেশ মজা পাও তাই না!!একবার যখন বলেছি,কোথাও যাবে না।তারপরও তুমি কেন গেলে?হা?টেল মি!কেন গেলে?আর কোথায় গিয়েছিলে?”

আবিরের এমন চাপা হুংকারে সামিরা কিছুটা দমে গেলেও।আচমকা তার মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।সে আবিরের হাত জোড়া তার বাহু থেকে সরিয়ে দিলো।তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

—“এক সপ্তাহ হয় নি,আমাদের বিয়ে হয়েছে।এর মধ্যে কৈফিয়ত নেওয়া শুরু করেছেন??এই আমাকে এডজাস্টমেন্টের সময় দেওয়া?অথচ কিছুটা সময় পূর্বে আপনি আমার পারমিশন ছাড়া কাছাকাছি এসেছে।”

সামিরার এমন ধরনের কথা আবিরকে আহত করলো।বাচনভঙ্গি যে ভীষণ অপমানজনক।মিরা তার অস্থিরতা,মনোদহন,বেদনা দেখতে পেল না।সে কেবল তার ছোঁয়াটাকেই দেখলো।হ্যাঁ,ভুলটা তো তারই!অবাধ্য মন যে শুধুই নৈকট্য কামনা করে।কিছুটা সময় দেখতে না পেয়ে হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল।তাই সে সময় আউট অফ কনট্রোল হয়ে পড়েছিলো।কাছ থেকে ছুঁইয়ে দিয়েছিলো।আবির দেখলো আশপাশের মানুষজন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।সে সামিরার চোখের চোখ রেখে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

—“এক্সট্রেমলি সরি ফর এভরিথিং।তোমাকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমার উচিত ছিলো নিজস্ব লিমিটে থাকা।আসলে আমি ছোট ঘরে মানুষ হয়েছি তো,মাঝে মাঝেই নিজস্বতা ভুলে যায়।এরপর কোথাও গেলে তোমার ফোন সাথে নিও,অথবা আমাকে একবার জানিয়ে যেও।”

আবির সামিরার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো।এবার সামিরার মধ্যে অশান্তি শুরু হলো।প্রবল অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।
আবিরের ঠান্ডা কন্ঠের প্রতিটি শব্দ তার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে।এমন কর্কশতা দেখানোর মতো কিছুই হয় নি।এলোমেলো রূপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা তাকে নিয়ে কতোটা টেনসড্ ছিলো!অথচ সে এখন সে কি করলো??তার ভীষণ কান্না পেল।সে মিনমিন করে বলতে লাগলো,

—-“আসলে আমি একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম…..”

—“দেরী হয়ে যাচ্ছে।আরো কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখা এখনো বাকি আছে। লেইট’স গো।”

আবির সামিরাকে পুরো কথা শেষ করার সুযোগ ও দিলো না।স্বাভাবিক স্বরে মুখের ওপর দমিয়ে দিলো।নিজের মতো হাঁটা শুরু করলো।সামিরার দিকে তাকালোও না।সামিরার কষ্ট হলেও সে আর কিছু বলল না।মলিন মুখে আবিরের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো।

চলবে