মধু পিঁপড়া পর্ব-৬+৭

0
106

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৬
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
সামিরা মাহিদকে প্রথম দেখেছিল বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে।লেবেল ওয়ানের ব্লক সি তে!ইংলটের স্টোরের ভেতরে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক পায়চারি করছিলো মাহিদ।একটু পর পর দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছিলো।কিছু একটা নিয়ে ভীষণ চিন্তত মনে হচ্ছিল তাকে।কিছুটা বিভ্রান্ত!সামিরা সাথে তার বান্ধবী লিয়াও ছিল।স্টোরে থাকা ছয়জন মেয়ের মাঝে মাহিদই একমাত্র পুরুষ ছিলো।যার কারণে প্রায় সকলের নজর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার উপরে আটকাচ্ছিলো।সবার পাশাপাশি মেক-আপ কিট পারচেজ করার ফাঁকে ফাঁকে লীন বডির শ্যামলাভ বর্ণের ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো সামিরা!মাহিদের সেদিকে কোনোরকম কোনো খেয়াল নেই।সে নিজের মতো ভাবুক!এক পর্যায়ে কৌতুহল দমাতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে নিজ থেকে প্রশ্ন করলো সামিরা!

-“হউ লুক সো ডিসট্রেক্টেড!ইফ ইউ ওয়ান্ট,আই ক্যান এসিস্ট ইউ!”

মাহিদ প্রথমে কিছুটা চমকালেও পর মূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো।অপরিচিত কাউকে সমস্যার কথা বলবে কি না বুঝে উঠতে পারলো না!সামিরা তখনও মাহিদের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে।সেধে কথা বলতে এসে ভুল করলো কি না,তাই ভাবসে সে।মাহিদ এক পর্যায়ে আমতা আমতা করে বলল,

-“আসলে আমার মায়ের জন্য কাজল কিনতে চাচ্ছিলাম।একই ব্রান্ডের এতো রকমের কাজল দেখে বুঝতে উঠতে পারছি না ঠিক কোনটা নিবো?সপ কিপার আপুকে জিজ্ঞেস করলাম!উনি সবগুলোর আলাদা আলাদা কোয়ালিটি বলল।তাও বুঝে উঠতে পারছি না।এছাড়া সত্যি বলতে দামেও মিলছে না।”

সামিরা ভীষণ অবাক হলো।সে ধরেই নিয়েছিলো,আট-দশটা ছেলের মতো এই ছেলেটা হয়ত তার প্রেমিকার জন্য কিছু কিনতে এসেছে!কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে পুরো ভিন্ন কেস।সামিরা মাহিদের আপাদমস্তক ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলো।ছেলেটা হয়ত তার সমবয়সী বা কিছুটা বড় হবে!তার চেয়ে কিছুটা লম্বা!গালের দাড়িগুলো ক্লিন সেভড করায়,হাত পায়ের তুলনায় গোলগাল মুখটা ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।সামিরা কিছুটা বিরক্ত হলো।মনে মনে”ছিলা মুরগি”বলে ভর্ৎসনা করলো।অনেকদিনের চিরুনি না পরা চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে।রোগা শরীরে কালো রঙের ঢিলেঢালা শর্ট স্লিভ আন্ডারবেস্ট শার্টে হাবাগোবা দেখাচ্ছিলো মাহিদকে।নেভি ব্লু রঙের ডেনিম প্যান্টের রং চটে গেছে।পায়ের জুতা জোড়া ভীষণ নোংরা!বছরখানেক হবে হয়ত পরিষ্কার করা হয় নি।সামিরা এবার সরাসরি মাহিদের চোখের দিকে তাকালো।কোটরাগত টলটলে নয়ন জোড়ায় বিষাদের সাগর!চোখের নিচের ত্বকে কালো দাগ পড়ে গেছে।সামনে থাকা পুরুষটির অন্তর্নিহিত কষ্টগুলো মূহুর্তেই সামিরার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো।অনন্যসুলভ এক মায়া অনুভূত হলো!চোখ সরিয়ে নিলো।মাহিদের কিছুটা কাছে যেয়ে ফিসফিস করে বলল,

-“ইংলট ইজ এ হাই-ইন্ড ব্র্যান্ড।দেয়ার প্রাইসেস আর ব্রিলিয়ান্ট!হাফওয়ে বিটউইন ড্রাগ-স্টোর এন্ড ডিপার্টমেন্ট-স্টোর প্রাইসেস।আই থিংক ইউ শুড গো টু এনাদার কসমেটিক শপ??”

সামিরার কথা শুনে মাহিদ কিছু সময় চুপ রইল।সত্যি তো!এতো এক্সপেন্সিভ কসমেটিকস কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই।একমাত্র সেলিব্রিটি ও বড়লোকেরা এসব কসমেটিকস বেয়ার করতে পারে!দোকানিকে দিয়ে এতোগুলা কাজল বের করে অন্য জায়গা থেকে কিনবে,সেটাও তার মন সায় দিচ্ছে না।মৌনতা ভেঙে স্বাভাবিকভাবেই বলল,

-“মা আমার কাছে এই প্রথম কিছু একটা নিজ থেকে আবদার করেছে।আমি তাকে বেস্টটা দিতে চাই।আমার কাছে এই মূহুর্তে এক হাজার টাকা আছে,আপনি এর মধ্যে আমাকে এই দোকানেরই একটা ভালো মানের কাজল সাজেস্ট করুন।”

মাহিদের কথায় সামিরা কিছু সময় ভাবলো।তারপর দোকানির সাথে কথা বলে বেশ ভালো মানের একটা কাজল নিয়ে নিলো।ডিসকাউন্ট থাকায় দাম পড়লো আটশত পঞ্চাশ টাকা!সামিরা নিজ থেকে মাহিদের মায়ের জন্য লিপস্টিক কিনলো।মাহিদ কোনোরকম কোনো ফর্মালিটিস ছাড়া নিয়ে নিলো।এই মূহুর্তে তার মায়ের খুশি থাকাটা বেশি ইম্পরট্যান্ট!ভবিষ্যতে টাকা হলে না হয়,সামিরাকে এমন দশটা লিপস্টিক গিফট করবে!অবশেষে একে অপরকে বিদায় দিয়ে যার যার পথের দিকে রওনা দিলো।কি মনে করে মাহিদ সামিরাকে পিছু ডাকলো!সামিরা ঘুরে দাঁড়ালো।

-“আপনি যদি নিজ থেকে উপহারটা আমার মায়ের হাতে তুলে দিতেন,তাহলে বেশ ভালো হতো।”

সামিরা কোনোকিছু না ভেবেই চট করে রাজি হয়ে গেল।লিয়া প্রথমে কিছুটা অপ্রতিভ হলেও,সামিরাকে একা অচেনা ছেলের সাথে পাঠাতে তার মন সম্মতি দিলো না।তাই সেও সামিরার সাথে মাহিদের বাসায় যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল।

——-

মাহিদের মা ইরা বেগম বেশ শান্ত ও নিরব একজন গোছের রমণী।স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর,দশ বছর একা এক হাতে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন।ছোট ছেলে মৃদুলকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বড় করেছেন।আঠারো বছর বয়সী মৃদুলকে কখনো বাবার অভাব বোধ করতে দেন নি।মাহিদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা ছিলো।সে বুঝদার হওয়ায় তাকে আলাদা টেক কেয়ারের প্রয়োজন পড়ে নি।সম্প্রতি মাহিদ গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে।হন্য হয়ে চাকরি খুঁজছে সে।ইরা বেগমের সাথে কথা বলে সামিরা আরো একটা বিষয় জানতে পারলো তা হলো তিনি বছরখানেক যাবৎ ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছেন।স্টেজ ২!টিউমারগুলো লিম্ফ গ্ল্যান্ড অবদি ছড়িয়ে পড়েছে।শরীরের অবস্থা করুণ।সামিরা মুখে আধার ঘনিয়ে এলো।দু’চোখ কেবল মাহিদকে খুঁজতে লাগলো।বিষন্ন চোখে ভেসে উঠা অব্যক্ত বিষাদের কারণগুলো মূহুর্তেই স্পষ্ট হয়ে এলো।সামিরা সিদ্ধান্ত নিলো এই মহীয়সী নারীর পাশে দাঁড়াবে সে।মাহিদকে সাহায্য করবে।সামিরা নিজ থেকে মাহিদের সাথে ক্যাজুয়াল রিলেশনে জড়িয়ে গেলো।বানের পানিতে ভাসতে থাকা অসহায় মানুষ খড়কুটোকে যেভাবে আঁকড়ে ধরে মাহিদও ঠিক তেমনি সামিরাকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিলো। মূলত সামিরা ও মাহিদ কখনোই একে অপরকে ভালোবাসে নি।সামিরার মনে মাহিদের জন্য করুণা ব্যতিত কিছুই ছিলো না।আর মাহিদ ছিলো সুযোগ সন্ধানী।বাবার উদাসীনতা,মায়ের চিকিৎসা,বড় ছেলের পাশাপাশি বড় ভাই হওয়ায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো।সামিরাকে বিয়ে করে সে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলো।তাইজুল ইসলাম কখনোই মাহিদকে মেনে নিতে চান নি।যখন দেখলেন সামিরাকে অনেক বুঝিয়েও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারছেন না,সেই মূহুর্তে নিজের মতো ফন্দি আঁটেন!যথাযথ ব্যবস্থার সহিত মাহিদ ও তার পরিবারকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেন।ইরা বেগমের সমস্ত চিকিৎসার ব্যয় নিজের ওপরে নিয়ে নেন।ভেবেছিলেন মাহিদের কাছ থেকে ধোঁকা পেয়ে সামিরা তার পছন্দ মতো পাত্রকে বিয়ে করবে!হয়েছেও তাই!কিন্তু হুট করে আবিরের সাথে সামিরার বিয়ে হওয়া ছিলো পুরোপুরি কাকতালীয় ব্যাপার।তাইজুল ইসলাম ভেবেছিলেন মাহিদের ইন্ডিয়া পৌঁছনোর খবর সামিরার কর্ণগোচর হতেই বিয়ে ভেঙে যাবে!!পরর্বতীতে নিজের পছন্দের পাত্র খুঁজে ধীরে সুস্থে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করবেন। হয়ত ওপরওয়ালার ইশারা ছিলো!বিয়ের অনুষ্ঠানে আচমকা সেলিনা খাতুন তাইজুল ইসলামকে ডেকে জানান যে তার একমাত্র পুত্র আবির সামিরাকে পছন্দ করে।প্রথমত আবিরদের ফ্যামিলি ওয়েল ব্যাকগ্রাউন্ডেড,দ্বিতীয়ত সেলিনা খাতুনের এক্সিডেন্টের দায়,তৃতীয়ত মাহিদের পুনরায় ফিরে আসার ভয়।সব মিলিয়ে তাইজুল ইসলাম সুযোগ কাজে লাগান!নিজেকে নির্দোষ রাখতে এক প্রকার সেলিনা খাতুনের কথাকে ধরেই তাৎক্ষণাৎ আবিরের সাথে সামিরার বিয়ে দিয়ে দেন।এদিকে সবকিছুর জন্য মনে মনে নিজেকে দ্বায়ী মনে করে অনুতাপে জর্জরিত হতে থাকেন সেলিনা খাতুন।মাহিদের সাথে বিয়ে না হওয়ায় পেছনের কাহিনি সামিরা অজানা।সে ধরেই নিয়েছে সেলিনা খাতুনের কথাকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে,তার বাবা আবিরের সাথে তার বিয়ে দিয়েছে।মাহিদের সাথে বিয়ে না হওয়ায় সামিরা যে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে,এমনটাও নয়!সে কেবল মাহিদের কষ্টটুকু ভাগাভাগি করতে চেয়েছে।তাদের এক বছরের সম্পর্কে কোনো রকমের কোনো ভালোবাসা ছিলো না।যা ছিলো,তা হলো সামিরার এক পাক্ষিক মায়া!

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৭
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

জীবন নামক রাস্তাটা মাঝে মাঝে ভীষণ সোজা মনে হয়।যাতে নেই কোনো রকমের কোনো বাঁক!মোড় ঘুরলেই হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।আছে শুধু পথ ভর্তি অদৃশ্য কিছু কাঁটা!আর সে অদৃশ্য কাঁটাগুলো চলার পথটাকে দূর্ভেদ্য করে তোলে।সামিরা ও আবিরের মাঝে মাহিদ হলো সেই কাঁটার ন্যায় ঝঞ্ঝাটময় বস্তু।মিরাকে পুরোপুরি ভাবে অর্জন করতে যে বেশ দীর্ঘ একটা সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।আবির আকাশের দিকে তাকালো।পুরো আকাশ কালো রঙে ছেয়ে আছে।জ্বলজ্বলে নক্ষত্রগুলো বেরঙের মেঘে ঢেকে আছে।তার মুখ দিয়ে হতাশার শ্বাস বের হয়ে এলো।নামিরা করুণ চোখে আবিরের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।তার কিছুটা খারাপ লাগলো।এতো সময় যাবৎ সে আর আবির ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।মাহিদ আর সামিরার ভিত্তিহীন সম্পর্কের বিষয়টা খোলাসা করা তার কাছে বেশ জরুরি মনে হয়েছে।আবির চিন্তিত নামিরাকে ছাদে রেখেই নিচে নেমে গেল।

——–

সামিরা ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলো তার গলায় আঁটকে থাকা আর কাঁটা অনুভূত হচ্ছে না।আশ্চর্য!সে তো বিড়ালের পা ধরে মাফ চায় নি।কি করে সম্ভব হলো?মনে মনে কিছু সময় এ নিয়ে গবেষণা করে,যুতসই উত্তর না পেয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। ইতিমধ্যে রাত বেশ গভীর হয়েছে।সে আশেপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো রুমের জায়গায় জায়গায় ফুলদানি সাজিয়ে রাখা হয়েছে।হোয়াট মিডল ফ্লাওয়ার ভাসগুলো তাজা রজনীগন্ধা ফুলের স্টিকে ভরপুর।ফুলের মন মাতানো গন্ধে পুরো ঘর ভরে গেছে।প্রখর এই ঘ্রাণে সামিরার কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে।একে তো রজনীগন্ধা তার পছন্দের ফুল!! তার ওপরে মনকাড়া ফুলের শ্বেত শুভ্র রঙ!!সে দুটো স্টিক হাতে তুলে নিল,স্টিকের সবগুলো ফুল মূহুর্তে হাতের মুঠে নিয়ে নিলো।নাকের কাছে নিয়ে গভীর ভাবে গন্ধ শুকলো।ফুলগুলো নাকের কাছে নিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে রইলো।দরজা খোলার শব্দ হতেই তার টনক নড়লো।ঘাড় বাকিয়ে তাকাল।

–“আপুর কাছ থেকে শুনলাম তোমার ডিম ভাজি খুব প্রিয়!সে সময় তো কিছু খেতে পারলে না।তাই মা তোমার জন্য গরম গরম ভাতের সাথে ডিম ভাজি পাঠিয়েছে।”

কথা শেষ করে আবির বোকা বোকা হাসি দিলো।তার হাতে ভাতের প্লেট!গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে।সে প্লেট হাতে নিয়ে খাটে বসলো।ডিম ভাজির গন্ধ নাকে ঢুকতেই সামিরার পেট মুচড়ে উঠলো। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার দরুন এমনটা হচ্ছে।সে কিছু না বলে আয়নার সামনের টুল নিয়ে আবিরের মুখোমুখি বসে গেল।ভাত খাওয়ার উদ্দেশ্যে হা করলো।সামিরার কর্মকাণ্ডে আবির হতভম্ব হয়ে গেল।বড় বড় চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।সে আসলে বুঝতে পারছে না,মিরা কি তার হাতে ভাত খাবে?কিন্তু কেনো?সে কি তাদের বিবাহিত সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে চাচ্ছে?নাকি শুধুমাত্র দায়সারাগোছে এমন করছে!!আর আবির নিজেও কেন যেন খুশি হতে পারছে না।সে তো চায় মিরা তার সাথে সহজ হয়ে আসুক!!কিন্তু তাই বলে প্রথম দিনে নিজের মনের সাথে জোরজবরদস্তি করে নয়!আবিরের অভিব্যক্তি দেখে সামিরা কিছুটা বিরক্ত হলো।সে উঠে গেল।হাত ধুয়ে এসে আবিরের হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিজেই খাওয়া শুরু করলো।প্লেটে ডিম ভাজির সাথে আলু ভর্তাও আছে।সে মনে মনে খুশি হলো।তাদের বাড়িতে এসব খাবার মাসে একবার বানানো হয়,তাও সামিরার আকুল আবদারে।বেশির ভাগ সময় ক্লাসিক হেলদি ফুডগুলোই খাবারের মেনুতে থাকে।লাইক–বাটার চিকেন,ক্রিমি টমেটো স্যুপ,ফিস স্টেক,বাটার বিন এন্ড মাশরুম আরো কত কি!!সামিরা হয়েছে ঠিক তার বাবার মতন।তাদের দু’জনের মতে, দেশীয় খাবার স্বাদে ভরপুর।এদিকে আবির সামিরার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ চোখ তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর করে ছোট ছোট লোকমা দিয়ে অল্প হা করে খাবার খাচ্ছে তার মিরা!!না একটা ভাত নিচে পড়েছে,না মুখের কোথাও খাবার লেগেছে।ছোট একটা কাজ,,তাও কতো গুছিয়ে একাগ্রতার সহিত করছে।আর অন্যদিকে সে মানুষটা সম্পূর্ণ অস্থির!সাধারণ তরকারি চামচ দিয়ে বেড়ে নিতে পারে না।খাওয়ার সময় ভাত তরকারি প্লেটের বাহিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে!এই তো কয়েকমাস আগের কথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে একটা বৈঠক হয়েছিল।বৈঠক শেষে সকলে যখন একসাথে লাঞ্চ করতে বসল,পানির গ্লাস উল্টে তার শার্টের অবস্থা রফাদফা!সরি,সরি বলে টেবিল ছেড়ে উঠতেই নিয়েছিলো,তখন ঘটলো আরেক অঘটন।তরকারি বোল ছিটকে পড়ে গেল সহকারী কমিশনারের গায়ে।ছেলেটা মাত্রই জয়েন করেছে।পড়াশোনা শেষ করতে করতেই তার বিসিএস হয়ে গেছে।জুনিয়র হওয়ায় তেমন ঝামেলা করলো না।কিন্তু সিনিয়র অফিসার টিটকারি করতে ভুললেন না।তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বলেই ফেললেন,

-“তা আবির সাহেবের এতো তাড়াহুড়ো কিসের?বিয়ে তো এখনো করেন নি,যে দেরি করলে বউয়ের কাছে মার খাওয়ার ভয় আছে!অবশ্য গার্লফ্রেন্ড থাকলে আলাদা হিসেব।”

সিনিয়র অফিসারের কথা শেষ হতেই পুরো কক্ষে হাসির রোল পড়ে গেল।জুনিয়র ছেলেটাও চুপ চেপে হাসলো।লজ্জায় হতবিহ্বল আবির ওই মূহুর্তেই মুখে কুলুপ আটলো।সেদিনের বাকি মিটিং এ সে মাথা নিচু করেই বসে ছিলো।

—-

-“আমি খুব কম ভাত খাই।এখানে ভাতের পরিমাণ একটু বেশি।আপনি কি খাবেন?”

আবির চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে সামনে তাকালো।সামিরার খাওয়া শেষ।প্লেটে কিছু ভাত,ডিম আর ভর্তা অবশিষ্ট আছে।সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে।আবির মাথা নেড়ে,প্লেট হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

-“তোমার জন্য গলার কাঁটা নামানোর সিরাপ এনেছিলাম।ওয়াল সেল্ফে মাটির পটের পাশে আছে,খেয়ে নেও।”

সামিরা প্রতিউত্তর করলো না।কিন্তু ভাত মুখে নিয়ে কথা বলায় আবির বিষম খেল।সামিরা তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।আবির কাচুমাচু মুখে পানি খেয়ে নিলো।ধ্যাত!কেন যে সে একটু স্থির থাকতে পারে না!!

——

খাওয়া শেষ হতেই এবার ঘুমানোর পালা।এখন প্রায় রাত দেড়টা।নামিরা,আদিবা আর চমকি ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।তারা এক রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বহু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।সামিরা জ্ঞান হারানোর আধঘন্টা পরই সাঈফ বাড়ি চলে গেছে।সে জানে তার বোনের খেয়াল রাখার মানুষ আছে,যে তার চেয়ে গভীর যত্নে তার বোনকে রাখবে।

আবির বেশ নার্ভাস।কক্ষ জুড়ে পায়চারি করছে আর মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করছে।কেন যে বেলকনির রুমটিতে তার বাবা-মাকে থাকতে দিলো?মিরার সাথে এখন কি করে এক বিছানায় থাকবে??যদি কোনো ভুল হয়ে যায়!!রুমে বেলকনি থাকলে হয়ত আজ রাতটা সেখানেই রাত কাটিয়ে দিতে পারতো।এই মূহুর্তে রজনীগন্ধা ফুলের নেশাক্ত গন্ধটা কেমন গভীর ভাবে জেঁকে ধরেছে।আবির সামিরার দিকে তাকালো,সে আপাতত নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত।কিছু একটা গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে।আবির শুকনো কাশি দিলো।

–“বলছিলাম কি,আমি কোথায় ঘুমাবো?”

সামিরা ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবিরের দিকে অবাক চোখে তাকাল।এতো বড় বিছানা রেখে এই লোক ঘুমানোর জায়গা খুঁজচ্ছে! সে আশেপাশে তাকালো।না ঠিকই তো আছে!সে তো একপাশে বসেছে।বিছানার অর্ধেক জায়গা অনেকটাই ফাঁকা।মেয়ে মানুষ হয়ে সে একদমই স্বাভাবিক,অথচ বিপরীত মানুষটা কেমন ব্যাকুল।সামিরা কখনো ভাবে নি তার বাসর রাতে তার স্বামীর মুখ থেকে এমন সব ফিল্মি ডায়লগ শুনতে হবে।আবির পুনরায় বলল,

-“আই নো,তুমি তোমার ইচ্ছেতে বিয়েটা করো নি।পারসোনালিও আমাকে তেমন চিনো না।আমাদের যেভাবেই বিয়ে হোক না কেন!!আমি তোমার কাছে একজন স্ট্রেনঞ্জার।সে হিসেবে তুমি আমার থেকে সব ধরনের স্পেস পাবে।”

-“সাচ এন ওভার থিঙ্কার গাই।”

সামিহা বিড়বিড় করে বলল।পর মূহুর্তে মুচকি হেঁসে আবিরকে বললো,

-“এক কাজ করুন আজকে না হয় আপনি মেঝেতে শুয়ে পড়ুন।”

আবির আশাহত হল।মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেল।সে ভেবেছিল সামিরা অধিকার খাটাবে! জোর করে ডেকে নিয়ে তাকে তার পাশে শোয়াবে।কিন্তু মেয়েটা যে বড্ড বেরসিক!আবির ভাঙা মন নিয়ে বিছানার পাশে মেঝের ফাঁকা জায়গায় একটা চাদর বিছিয়ে,বালিশ নিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পরলো।লাইট নেভানোর কথাও ভুলে গেল।
দশ মিনিট কেটে গেছে।কেবলই আবিরের চোখ লেগেছে।ওমনি বুকে হাল্কা ভার অনুভব হলো।ফট করে চোখ জোড়া খুললো।সামিরা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।নাক টানার শব্দ হচ্ছে।মেয়েটা কি কাঁদছে!কিন্তু কেন?মাহিদের জন্য?আবিরের বুক ধক করে উঠলো।সে লক্ষ্য করলো,সামিরা বিড়বিড় করে কিছু বলছে।

-“কেন যেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।কিসের কষ্ট জানি না!কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধির ন্যায়,এই কষ্ট টাও দুরারোগ্য মনে হচ্ছে।বাবার কথা,বাড়ির কথা খুবই মনে পড়ছে।”

আবিরা এতোক্ষণে সামিরার কান্নার কারণ ধরতে পারলো।মেয়েটা সারাদিন নিজেকে কঠোর মুখোশে আবৃত করে রাখলেও,দিনশেষে সেই মুখোশ মিইয়ে গেছে।আবির তার অর্ধাঙ্গিনীর মাথা হাত বুলিয়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর ফিসফিস করে বলল,

-“ইনশাআল্লাহ!কালকেই তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো।এখন ঘুমিয়ে যাও প্লিজ!”

আবিরের কথায় সামিরা হুট করে তাকে ছেড়ে দিলো।ধপধপ শব্দ তুলে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পরলো।মাথা তুলে খানিকা উচ্চ স্বরেই বললো,

-“ঢং শেষ হলে,লাইট ওফ করে চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়ুন।মাঝ রাতে কোনো রকমের কোনো তামশা করতে চাইছি না।”

আবির হাল্কা হেঁসে উঠে পড়লো।চুপচাপ সুবোধ বালকের ন্যায়,কিছুটা ঘেঁষেই সামিরার পাশে শুয়ে পরলো।

চলবে……