মধু পিঁপড়া পর্ব-৪+৫

0
101

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৪
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
পাঁচ কেজি ওজনের তিনটি কোরাল মাছের বারবিকিউ,বিশ পঁচিশটির মতো মিডিয়াম রূপচাঁদা ফ্রাই,এক বোল ছুরি শুটকির ভর্তা সাথে গামলা ভর্তি বাসমতি চালের গরম গরম সাদা ভাত।মাছে-ভাতে বাঙালির উৎকৃষ্ট নির্দশন!আশেপাশের ফ্লাটের মানুষদেরও আমন্ত্রণ করা হয়েছে।প্রায় পনেরো-বিশ জনের আয়োজন!তুমুল ব্যাপার-স্যাপার!একটু পর হয়ত সকলেই এসে পড়বে।তাদের বলা হয়েছে আবিরের ঘরোয়া ভাবে কাবিন হয়েছে,তারা যেন এসে বউ দেখে যায়।যদিও অনেকে অনেক ধরনের প্রশ্ন করেছিল!সেলিনা খাতুন পুরো ঘটনা চতুরতার সাথে এড়িয়ে গেছেন।
ছাদের ওপরে লম্বা শীতলপাটি বিছানো হয়েছে।মোখলেস মিয়া অহেতুক ছুটোছুটি করছেন।কারণ ছাড়া একটু পর পর নিচে নামছেন,আবার দু’মিনিট পরই ফেরত আসছেন।সিঁড়ি ভেঙে ওঠা নামা করতে তার মধ্যে কোনোরকম কোনো ক্লান্তি নেই!একমাত্র ছেলের হুট করেই বিয়ে হয়েছে,এ নিয়ে তিনি যেন বেশ আমোদেই আছেন!নামিরা আর চমকি মিলে পাটির ওপরে ভাত আর মাছের বোল সাজিয়ে রাখছে।সাঈফ গিয়েছে দই আনতে।আদিবা ছাদের কোণার এক চেয়ারে দুই পা তুলে জবুথুবু হয়ে বসে আছে।শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে।ব্রুমস্টিক স্কার্টের ওপরে লাইন টপ!এতো পাতলা কাপড়ে কি আর শীত হার মানে!হিমশীতল বাতাসে শরীরের সমস্ত পশম দাঁড়িয়ে আছে! মাথার চুলগুলো এলোমেলো।চোখ গুলো রক্তিম! রাগে তার শরীর ফেটে যাচ্ছে!সাঈফকে সামনে থাকা মশলা মাখা কোরাল মাছগুলোর মতো কয়লার আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু কেন!কেন আবার?চমকির সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলেছে সেই অপরাধে।কই তার সামনে তো হাসে না!তার সামনে আসলে লম্বা চুলগুলো ঝাউ বনের মতো মুখের ওপর বিছিয়ে রাখে।নয়ন ঝু়ঁকিয়ে রাখে,দৃষ্টি মেঝেতে!কেন এমন করে কে জানে?একটু তাকিয়েও দেখে না!মনটা বেশ ভার হয়ে আছে।চোখ ফেটে কান্না আসছে আদিবার।হঠাৎ পৃষ্ঠদেশে গরম ওম পেল!আগের মতো শরীর কাপছে না!কেউ একজন শাল জড়িয়ে দিয়েছে।আদিবা চোখ তুলে তাকালো।সিম্পলি হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবি সামনের মানুষটির তামাটে বর্ণের চামড়ার সাথে মিশে আছে !হাতা কনুই অবদি গোটানো। লম্বা পেটানো দেহের ভাঁজে ভাঁজে পরিহিত পোশাকটি এঁটে আছে।সিল্কি লেন্থ হেয়ারগুলো ব্যাকব্রাশ করা।গালের দাঁড়িগুলো ছোট ছোট করে কাটা।ফ্রেশ লাগছে।বাড়ি গিয়েছিলো হয়ত!বেশ ফিটফাট হয়েই এসেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে চোখের সামনে পেয়ে আদিবার অভিমান গাঢ় হয়ে এলো।চট করে শালটা সরিয়ে দিতে চাইলো।সাঈফ সাথে সাথে দু’হাত চেপে ধরলো।ভরাট গলায় ধমকে উঠলো।

-“খবরদার!গাধার রানী!একদম হাত দিবে না।হাত কিন্তু ভেঙে দিবো!পিউর কাশ্মীরি শাল!ইমপোর্টেড ফ্রম ইন্ডিয়া!তোমার হাতের স্পর্শে নোংরা হয়ে যাবে।”

আদিবার রাগের পারদের তাপমাত্রা বেড়ে গেল।উত্তেজনায় গাল দুটো লাল হয়ে গেল। সে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো।এক ঝাটকায় সাঈফের হাত সরিয়ে দিতে চাইলো।পুরুষালী শক্তির সাথে না পেরে ছটফট করে উঠলো।দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করলো,

-“নোংরা হওয়ায় এতো ভয়!তাহলে আমার গায়ে জড়িয়েছেন কেন?নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখুন।একজন কাজ করুন উলঙ্গ হয়ে,সারা গায়ে এই বিদেশি শাল জড়িয়ে রাখুন।”

সাঈফ ঠোঁট কামড়ে হাসলো।এবার আদিবা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। সাঈফ আদিবার দু’হাত নিজের ডান হাতের দ্বারা আঁটকে ধরলো।বাম হাতে পাশে থেকে একটা চেয়ার টেনে আদিবার মুখোমুখি বসলো।ফিচলে হেঁসে বলল,

-“তুমি আসলেও গাধার রানী।বেকুব বাচ্চা!তা কোন ক্লাসে যেন এইবার তুমি?”

আদিবা জবাব দিলো না।আশেপাশে তাকালো।সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। এতো বড় অপমান!তাকে বেকুব বলা??আদিবা তাকে উচিত শিক্ষা দিবে।গোবর মেখে দিবে তার বিদেশি শালে।আস্ত বেয়াদব ছেলে!এদিকে সাঈফ বিমোহিত নয়নে গাল ফুলো ফুলো ফ্যাসফ্যাসে কান্নারত অষ্টাদশী কন্যার দিকে তাকিয়ে রইল।প্রথম দেখায় এই মেয়ে তার হৃদয় শুষে নিয়েছে।এখন তো পুরো শরীরটাই নিঃশেষ হয়ে গেল!সাঈফ আদিবার দু’হাত আলতোভাবে ছেড়ে দিলো।হাত ছাড়া পেয়ে আদিবা লাফিয়ে উঠলো।শাল টেনে এনে নাকের ঘষলো। ফ্যাত ফ্যাত শব্দ করে সর্দি বের করে,শালে মুছলো!পর মূহুর্তে সাঈফের মুখের দিকে ছুঁড়ে মারলো।এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল।আদিবা চোখের আড়াল হতে সাঈফ শালটা নাকের সামনে নিলো।চোখ বন্ধ করে আদিবার দেহের গন্ধ শুকলো।অতি যত্নে নিবিড়ভাবে দেহের সাথে জড়িয়ে ধরলো।যেন আদিবা নামক মানবীকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে!আড়াল থেকে সবটাই আদিবার নজরে পড়লো।লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে নিলো।

———

-“কারো চোখের দৃষ্টিতে নিজের জন্য সহানুভূতি বা অসহায়ত্ব দেখলে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে।মনে হয় দেহের প্রতি কোষে কোষে কেউ বুঝি বিষাক্ত এসিড ঢেলে দিয়েছে।”

সেলিনা খাতুন কথার ফাঁকে নিচে ঝুকলেন।কোমড়ে গুঁজে থাকা শাড়ির এক পাশ সামিরার হাতে ধরিয়ে দিলেন। অপর পাশ থেকে এক হাতে অভিজ্ঞদের মতো কুঁচি তুলতে লাগলেন।বিন্দুমাত্র জড়তাও নেই!সামিরা ছাঁদে যাওয়ার পর পর নিজ হাতে তার জন্য কফি বানিয়ে, চমকিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন।অতঃপর সন্ধ্যা নামার পর পর সব কাজ শেষ করে পুনরায় চমকিকে পাঠান নতুন বউকে ডাকতে!সামিরা নিচে আসতেই সদ্য কিনে আনা লাল কাতান শাড়ি তার হাতে তুলে দেন।সামিরার তখন মাঝ সমুদ্রে পরার মতো দশা!তাদের ঘরের কেউ তেমন শাড়ি পরে না।সে নিজেও শাড়ি পড়তে জানে না।শাড়ি পড়ে হাঁটতে নিলে তার ভীষণ অস্বস্তি হয়।এই বুঝি খুলে গেল!জীবনের প্রথম সে তার বিয়েতে শাড়ি পরেছে।তাও পার্লারের মহিলারা পড়িয়ে দিয়েছে।সামনে থাকা গম্ভীরমুখী নারীটির সাথে কথা বলতে এমনিতেই তার বেশ জড়তা কাজ করে!সামিরা কি করবে ভেবে পেল না।মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল।ছেলের বউয়ের নিরুপায় চেহারার দিকে তাকিয়ে সেলিনা খাতুন নিজেই শাড়ি পড়ানোর দায়িত্ব নেন।

-“অনেক মানুষ আছে পৃথিবীতে, যারা জন্মগত পঙ্গু।তাদের অনেকের আবার আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো থাকে না।তাদের জীবন কিন্তু সহজ,সুন্দর!তারা নিজেরাই সেভাবে নিজেদের জগৎ তৈরি করে নিয়েছে।আমিও ঠিক তাদের মতো!আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমি আমার বা’হাত খুইয়েছি!এতে তোমার বাবাকে আমি কোনোরূপ ভাবে দোষারোপ করি না।সবই কুদরতের ইশারা!তোমার বাবা আমার ভার্সিটি সিনিয়র ছিলেন।আমার এতোবড় এক্সিডেন্টের জন্য সে কোনো না কোনোভাবে দ্বায়ী ছিলো।কিন্তু আমাকে সে কোনোদিন অসহায় ভেবে ট্রিট করে নি!কিচেনে যখন তুমি আমার দিকে তাকালে, তোমার চোখে আমি একটা অপরাধবোধের ছাপ দেখতে পেয়েছি।কিসের অপরাধ বলতো?তুমি তো কোনো দোষ করো নি!বরং আমি একটা মেয়ে হয়ে তোমার মনোভাব বুঝতে পারি নি।বিনা তোমার মতামতে তোমাকে আমার ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছি।”

সেলিনা খাতুন শ্বাস ছাড়লেন।একসাথে এতোকথা বলে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন।সামিরা কিছু বললো না।মসৃণ চেহারার শ্যামবরণ মায়াবী নারীটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।কতো সাবলীল নিজেকে উপস্থাপন করলেন।কোনো ধরনের কোনো রাখঢাক নেই। খোলা বইয়ের ন্যায়!যেকেউ পড়তে পারবে।কেবল ভাষা জানতে হবে।

——–

ঘরে ঢুকে আবির হতভম্ব হয়ে গেল।চোখ দু’টো কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়া উপক্রম।সামিরার অবরুদ্ধ তকতকে মসৃণ জঠর দিকে তাকিয়ে তার হাঁটু কাঁপতে লাগলো।বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল।কাঠফাটা রোদে পানির তৃষ্ণায় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকা পথিকের ন্যায় অসহায় সে!তাৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিলো।সেলিনা খাতুন ইতিমধ্যে শাড়ির কুঁচি গুজে ফেলেছেন।ছেলের দিকে চোখ পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

-“এসেছিস,তাহলে?নে তোর বউ এবার তুই সামলা।এসব শাড়ি-টারির বোঝা আমি আর বইতে পারবো না,,বাপু।পঙ্গু মানুষ আমি!আমাকে দিয়ে কাজ করানোর যতো ধান্দা।”

সেলিনা খাতুন কপট রাগ দেখিয়ে মুখ বাঁকালেন।কাউকে কথা বলার কোনোরকম সুযোগ দিলেন না।ছেলেকে টপকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।সামিরা চট করে শাড়ির আঁচল বুকের ওপরে ছড়িয়ে নিলো।শাশুড়ীর এমন ধাপধুপ পরিবর্তনে সে বেশ অবাক।তার নজর আবিরের দিকে!গৌরবর্ণের গালে হাল্কা হাল্কা আঁচড়ের দাগ।লালচে ভাব আগের চেয়ে কমে এসেছে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে মানুষটাকে।আবির ধীরে ধীরে সামিরার কাছে এগিয়ে এলো।তার হাতে একটা ক্লাসিক শপিং ব্যাগ। ওপরে লিখা ‘ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড’।আবির কাছে এসে তার নববিবাহিতার চোখে চোখ রাখলো।সেই চোখে এক রাশ মুগ্ধতা!সামিরা কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গেল।ব্রেইন কজা করা বন্ধ করে দিলো।আবির ততক্ষণে শপিং ব্যাগ থেকে জুয়েলারি বক্স বের করে একে একে গলায় হার,কানের দুল,হাতের চুড়ি সযত্নে পড়িয়ে দিলো।আবিরের খসখসে পৌরুষ হাতের ছোঁয়া পেতে সামিরা কেঁপে উঠলো।গহনা পড়ানো শেষ হতে আবির নিচে ঝুঁকে শাড়ি ঠিক করে দিলো।সামিরা তখন ঠাঁই দাঁড়িয়ে।

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৫
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

শাড়ি ঠিক হতেই সামিরা সটকে পড়লো।আবিরের দিকে ফিরেও তাকাল না।এই ব্যাটা যা ইচ্ছে করুক, তাতে সামিরার কি?আচ্ছা!!সে কি একবার জিজ্ঞেস করবে কবুল বলার আগে লোকটি কাঁদছিল কেন?ধ্যাত!এই লোক হাসুক,কাঁদুক,পাদুক যা ইচ্ছে তাই করুক তাতে তার কিছুই আসে যায় না।সামিরা,মনে মনে ব্যঙ্গ করলো!এক প্রকার এড়িয়ে যেতে অহেতুক কাজ করতে লাগলো।কাজল দেওয়া চোখে পুনরায় কাজল পড়ল।দু গ্লাস পানি খেল!সদ্য পরিহিত হাতের চুড়িগুলো গুনলো।দু’হাত মিলিয়ে ছয় জোড়া!পর্দা ঠিক করার বাহানায় জানালার বাহিরে উঁকি দিলো।আবার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে আবিরের দিকে নজরও দিলো।চোখে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে গেল।লোকটা এমন করে কি দেখছে?মনে হচ্ছে ট্যাবেলেটের ন্যায় পানি দিয়ে সামিরাকে টুক করে গিলে ফেলবে।এতো নার্ভাস লাগছে কেন?কই মাহিদের সামনে তো কখনোই এমন হয় নি!এক বছরের পরিচয় ছিলো তাদের।শুধুই কি পরিচয় ছিলো? নাকি আরো কিছু?সামিরা মন থেকে কোনো জবাব পেল না।আবিরের চাহনিতে বুক ট্রেনের ন্যায় হুইসেল বাজাচ্ছে!যা কেবল সামিরাই শুনতে পাচ্ছে!আর ভাববে না।মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলো।ক্যাটক্যাটে লাল রঙের একটা লিপস্টিক হাতে তুলে নিলো। ঠোঁটে ঘষার পূর্বে,পেছনে থেকে আবির ছোঁ মেরে নিজের হাতে নিয়ে নিলো।সামিরা কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।পেছন ফিরলো না।আবির ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।আয়নার মানুষটির অভিব্যক্ত পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

-“প্রসাধনীর ওপরে প্রসাধনীর প্রলেপ!ভেরি আনফেয়ার!”

তাদের বিয়ে হয়েছে সাত ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে।এই প্রথম আবিরের গলার আওয়াজ শুনতে পেল।ম্যানলি হাস্কি ভয়েস!সামিরার পেট মুচড়ে উঠলো।দেহে অস্পর্শী অনুরণন অনুভব করলো।আবিরের কথা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকাল।

-“তুমি নিজেই আস্ত এক প্রসাধনী…. মিরা।সাধারণতাই তোমার অঙ্গসজ্জা।আলাদা সাজের প্রয়োজন নেই।”

বাব্বাহ!!প্রথমবারেই মিরা ডেকে ফেলেছে। ছেলে বেশ এডভান্স। বোঝাই যাচ্ছে।সাথে বাকপটু!সামিরা কোনো উত্তর দিলো না।মনে মনে হাসলো।আবির সামিরার শুকনো ফ্যাসফ্যাসে গোলাপি ঠোঁটের দিকে তাকাল।উভয়েই আয়না দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।আবিরের বুকের সাথে সামিরার পিঠ ছুঁই ছুঁই।লম্বায় সামিরা আবিরের চেয়ে চার’ইঞ্চি খাটো!তার ঘন কোঁকড়ানো চুল থেকে ভুরভুর করে পার্সিয়ান রোজ হেয়ার মিস্টের গন্ধ বের হচ্ছে।আবির ঘোরগ্রস্তের ন্যায় কিছুটা এগিয়ে এসে সামিরার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল।ঝকঝকে মেয়েটিকে বউ সাজে ভীষণ প্রানবন্ত লাগছে।আবিরের বুকপটে তোলপাড় শুরু হলো।কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে!এই মেয়েটি আজ থেকে তার,ভাবতেই মন আনন্দে নেচে উঠছে।সেই সাথে সামিরার নির্লিপ্ততা দেখে ভীষণ ভয়ও হচ্ছে।আবিরের চাহনি লক্ষ্য করে সামিরা জীভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।নিজেকে প্রস্তুত করলো।তাকে আবিরের মোটিভ জানতে হবে।হুট করে এভাবে অজানা একজনকে কি করে বিয়ে করতে পারলো সে?আর তারা এতো স্বাভাবিক কি করে!!নির্ঘাত মা ছেলের মিলে ভেতরে ভেতরে কিছু একটা প্ল্যান করছে।সামিরাকে নরম হলে চলবে না।এদের নিশ্চিত কিছু উদ্দেশ্য আছে!সে পেছনে ঘুরে আবিরের মুখোমুখি দাঁড়াল।ডান পাশের ভ্রু নাচিয়ে অতিরিক্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,

-“আপনি দেখি পাকাপোক্ত ফ্লিপার!মুখের সাথে সাথে চোখ দিয়েও ফ্লার্ট করছেন?তা আমি কয় নম্বর?”

আবিরের মুখটা মূহুর্তেই চুপসে গেল।মনটা কাচের ন্যায় ঝরঝর করে ভেঙে গেল।সামিরার স্পষ্ট তাচ্ছিল্য টের পেল।তার মনের অবস্থা যদি মিরা বুঝতে পারতো,তাহলে এতো সাধারণ দুটি বাক্য শুনে কখনোই এতো রূড হতো না।তারা মধ্যবিত্ত বলে কি তাদের আত্মসম্মান নেই!সে কি চরিত্রহীন, যে মেয়েদের দেখলেই ফ্লার্ট করবে!! নাকি অন্য ব্যাপার?মিরা কেন তার চোখের দিকে তাকায় না!একবার তাকালে কি এমন ক্ষতি হবে! আবির সামিরাকে কিছু না বলে ধপধপ শব্দ তুলে কাবার্ড থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।আবিরের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে সামিরা চাপা শ্বাস ছাড়ল।

———-

চারপাশে হট্টগোল।যাদের যাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে,তারা প্রায় সকলেই এসেছে।এক একজনের হাতে এক্সপেন্সিভ সব গিফট বক্স।অল্প সময়ে যে যার যার মতো এরেঞ্জ করেছে।তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে তারা হাই স্ট্যান্ডার্ড প্রোফেশন থেকে বিলং করে!কেউ সাংবাদিক, কেউ পাইলট, কেউবা আর্কিটেক্ট!যেহেতু সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন সেহেতু গভমেন্ট জবের আন্ডারে থাকা যেকেউ এখানে থাকার আবেদন করতে পারে।কারো মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিমাণ অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই!সামিরাকে দেখে কেউ কোনোরকমের কোনো বাড়তি মন্তব্য করলো না।বরং খুব আন্তরিকতার সাথে আপন করে নিলো।সামিরাও খুব স্বাভাবিক।সৌজন্যের সহিত সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো।
আবিরদের পাশের ফ্লাটে থাকেন জামশেদ আলী।তিনি সরকারি বাংলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক।স্ত্রী আর পনেরো বছরের মেয়ে নিপাকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার।সামিরাকে দেখার পর থেকে তাদের আফসোস যেন শেষই হচ্ছে না!নিপা তো একবার বলেই বসলো,”তার একটা ভাই থাকলে আবির নাকি কোনো পাত্তাই পেত না।তার ভাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সামিরার পেছনে লেলিয়ে দিতো।দরকার হলে সবাই মিলে অনশন করতো!তাও সামিরাকে হাতছাড়া করতো না।”
এদিকে জামশেদ আলীর স্ত্রী মুনিয়া বেগম বারবার সেলিনা খাতুনকে কনুই দিয়ে গুতা দিচ্ছেন।বিগত এক ঘন্টা যাবৎ আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চাচ্ছেন।নামিরাকে তার বেশ মনে ধরেছে।বেশ হাসিখুশি!সাদাসিধা!তার বোনের ছেলের জন্য এমন মেয়েই খুঁজচ্ছেন তারা।সেলিনা খাতুন সব শুনে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন।আর কেউ না জানুক,তিনি তো জানেন মেয়েটা কতোটা ভুগেছে! এমনকি এখনও ভুগছে।আর যাইহোক, এসব কথা তুলে তিনি মেয়েটাকে কষ্ট দিবেন না।

——-

হোয়াইট এমব্রয়েড কটন পাঞ্জাবিটি যেন আবিরের লম্বা চওড়া দেহের জন্যই তৈরি!হাতে সাধারণ ঘড়ি।পায়ে ঘরের স্লিপার।শাওয়ার নেওয়ায় ভেজা চুলগুলো কপালের ওপরে ছড়িয়ে আছে।রেগুলার কাট দেওয়া কৌশেয় চুলগুলো মৃদু বাতাসে হালকা দুলছে।গোসল করায় বেশ সতেজ লাগছে তাকে!নির্মল হাসিমুখের এই ছেলেটির সামনে আকাশের জাজ্বল্যমান অর্ধ চন্দ্রকেও ম্লান মনে হচ্ছে!পাঞ্জাবিটি মূলত সাঈফ তার নিজস্ব ইনকামের টাকা দিয়ে আড়ং থেকে কিনে এনেছে।আবির যে এটা আজকেই পড়বে সে ভাবে নি।ভীষণ খুশি লাগছে।মাঝে মাঝে চাইলেই ছোটখাটো বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত খুশি হওয়াই যায়!সেজন্য বিশাল এক মনের প্রয়োজন।আবিরকে দেখে নামিরার অভিব্যক্তি প্রথমে বোঝা গেলো না।থমথমে মুখে বসে রইলো সে।যেই আবির তার চিরচেনা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপু!আপনার কি শীত করছে!আমার একটা হুডি এনে দিবো?গত বছর ধুয়ে রেখেছিলাম।এখন অবদি ব্যবহার করা হয় নি।”

ব্যস!নামিরা তাতেই কঠিন বরফ থেকে তরল পানিতে পরিণত হয়ে গেল।যেই ছেলে দূর থেকেই অচেনা একটা মেয়ের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পারে।সেই ছেলে নিশ্চিত তার বোনকে অবহেলায় রাখবে না?তাৎক্ষণাত পরম করুণাময়ের নিকট লাখ লাখ শুকরিয়া জানালো নামিরা।আবিরের দিকে তাকিয়ে খুশিতে সে কেবল মাথা নাড়ালো।আবির সাথে সাথে নিচে নেমে গেল।এই ছেলেকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা আগের নামিরা দ্বিধায় ছিলো।নিষ্পাপ হাসির দাপটে নিমিষেই সব জড়তা কেটে গেল।সব কিছু হয়েছে সাঈফের জন্য!সেই সময় শক্ত করে হাতটা ধরতেই নামিরার নিজের মধ্যে আলাদা এক অনুভূতির অনুভব হয়েছিলো।এটাকেই বুঝি বলে “সিবলিং’স পাওয়ায়”।নামিরা ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে সাঈফে খোঁজার চেষ্টা করলো।একটু উঁকি ঝুঁকি মারতে নজরে এলো।সাঈফ আদিবাকে একটু পর পর চোখ দিয়ে শাসাচ্ছেন।নামিরার মনে হলো তার ভাইটি যেন চোখের পলকেই বড় হয়ে গেছে।এইতো সেদিনে কথা! সে নিজ হাতে সাঈফের ন্যাপি বদলিয়ে দিয়েছে।ঘন্টার পর ঘন্টা কোলে নিয়ে বসে থেকেছে!নামিরা এবার সামিরার দিকে তাকাল।কি সুন্দর করে মেয়েটি সবাইকে বেড়ে বেড়ে খাওয়াচ্ছে!অথচ একসময় এই মেয়েটিকে এক বেলা না খাইয়ে দিলে গাল ফোলাতো!সারাদিন না খেয়েই থাকতো।নামিরার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

——–

খাওয়ার সময় সামিরাকে আবিরের পাশে বসানো হলো।আবির যেন ইচ্ছে করেই গা ঘেঁষে বসলো।বা’হাত রাখলো সামিরার ডান উরুতে।সেখানে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।শাড়ি ভেদ করে তপ্ত স্পর্শ যেন চামড়া পুড়িয়ে দিতে লাগলো।খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল সামিরার!ম্যানলি পারফিউমের গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।অতিথিরা ইতিমধ্যে যে যার মতো বিদায় নিয়েছে।এখন শুধু ঘরের মানুষেরা বাকি!সাঈফ আর নামিরার মাঝে বসে আছেন মোখলেস মিয়া।তিনি খাচ্ছেন কম খাওয়াচ্ছেন বেশি!বেছে বেছে মাছের বড় বড় টুকরো গুলো পাতে তুলে দিচ্ছেন।সাঈফ আর নামিরার কোনরূপ কোনো বাঁধা মানছেন না।এদিকে সেলিনা খাতুন রূপচাঁদা মাছের মচমচে ফ্রাইগুলো সামিরার প্লেটে তুলে দিলেন।সবাই পাটিতে বসলেও চমকি বসলো চেয়ার।দু’পা তুলে সে আয়েশী ভঙ্গিতে খাচ্ছে।আদিবা মাথা ব্যথার অযুহাতে অনেক আগেই নিচে নেমে গেছে।সে আসলে সাঈফের থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে।আচমকা সামিরার গলায় কাঁটা আঁটকে গেল!গলায় ব্যথা হতে লাগলো।চোখ থেকে অটোমেটিক পানি গড়িয়ে পড়ছে।আবির চট করে উঠে দাঁড়াল।সাদা ভাত দলা করে সামিরার মুখের সামনে তুলে ধরলো।না চিবিয়ে গিলে ফেলতে বলল।সাঈফ খাওয়া ছেড়ে নিচে গেল পাকা কলা আনতে।সেলিনা খাতুন আলতোভাবে সামিরার গলায় মালিশ করছেন আর বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন।মোখলেস মিয়া আর নামিরা কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে হা হুতাশ করছেন।এসবের মাঝে চমকিকে কোথাও পাওয়া গেল না।

কোরাল মাছের কাঁটা!যদিও এসব মাছে তেমন কাঁটা থাকে না।যাও থাকে সব বড় বড়!কিন্তু অন্যমনস্কতার দরুন সামিরার বিপদ ঘটেছে।পনেরো মিনিট হয়ে গেছে কোনোভাবে কাঁটা নামছে না।কলা,শুকনো মুড়ি,পানি,ভাত সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করা হয়ে গেছে।সামিরা চোখ বুজে চেয়ারে বসে আছে।একটু ঢোক গিললেই কাঁটার সরু মাথা জিভে গুতা মারছে।সামিরা এমন ঝিমিয়ে পড়ায় আবির অস্থির হয়ে উঠলো।বুকে বা’পাশে হাত ঘষছে সে!কপাল ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে।পাঞ্জাবির উপরের দুই বোতাম সে ইতিমধ্যে খুলে ফেলেছে।

-“মিরা! বেশি খারাপ লাগছে?”

আবিরের ব্যাকুল কন্ঠ।সামিরা মাথা নাড়ালো। হ্যাঁ বলছে,নাকি না বলছে কিছুই বোঝা গেলো না। আবির হঠাৎ ফোন বের করে উবার বুক করলো।সামিরাকে সে হসপিটালে নিয়ে যাবে।সেলিনা খাতুন ছেলের এমন হটকারিতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন।ছেলে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে।নাহলে নিজের গাড়ি রেখে কেউ আবার উবার বুক করে!!তিনি কিছু বললেন না।নতুন বউয়ের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল।একদিনও হয় নি মেয়েটা তার বাড়িতে এসেছে।তার মধ্যে কান্ড ঘটে গেল। সবার মাঝে একমাত্র সাঈফই শান্ত।সে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে।নামিরা দূরে দাঁড়িয়ে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদছে।

আবির সামিরাকে নিয়ে লিফটে চড়বে!এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে চমকি উপরে উঠে এলো।তার হাতে একটা ফুটফুটে সাদা বিড়াল।চারতলার ডাক্তারের পোষা বিড়াল টিমটিম!জাতে পার্সিয়ান!ড্যাবড্যাব করে সামিরার দিকে তাকিয়ে আছে।চমকি বিড়ালটা সামিরার দিকে এগিয়ে দিলো।

-“ভাবি জলদি বিড়ালের পায়ে ধইরা মাফ চান।জলদি,ধরেন!নাইলে এই কাডা ইহজীবনে আমনের গলা ছাড়তো না।আমার দাদি কইতো বিড়ালের পা ধইরা মাফ চাইলে কাডা নিজ ইচ্ছায় যায় গা।”

সামিরার দিকে বিড়াল এগিয়ে দিতে সে এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো।দু’হাতে আবিরের বাহু খামচে ধরলো।ধারালো নখ গেঁথে গেল।গলায় কাটা আঁটকে থাকায় মুখ দিয়ে কেমন অস্ফুট শব্দ বের হলো।ছোট থেকেই সে বিড়ালকে যমের মতো ভয় পায়।ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে হতভম্ব। এর মধ্যে নামিরা ফিক করে হেঁসে দিলো।সে নাকি একটু আগে কাঁদছিলো!এদিকে চমকির কাজ কারবার দেখে আবির হতবাক।ডাক্তারকে রেখে তার বিড়াল নিয়ে এসেছে!কতোবড় বেকুব!অবশ্য সে নিজেও চমকির দলে।আবির চমকিকে এক রাম ধমক দিলো।উচ্চ শব্দে বিড়াল ভয় পেয়ে গেল।চমকির কোল থেকে ছিটকে সামিরার ওপরে যেয়ে পড়লো।সামিরা আবিরের গলা জড়িয়ে ধরে সমস্ত শক্তিতে চিৎকার করে উঠলো।চিৎকারের মাত্রা এতোই বেশি ছিলো যে, আবিরের কান এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো।সামিরা জ্ঞান হারিয়ে আবিরের ওপরে ঢলে পড়ল।

চলবে