মধু পিঁপড়া পর্ব-৮+৯

0
246

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৮
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
ঘুম থেকে উঠে নামিরা প্রথমে সেলিনা খাতুনের সাথে টুকটাক আলাপ আলোচনা করলো।চা বানিয়ে খাওয়ানোর আবদার করল।সেলিনা খাতুন নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে,সেই সুযোগে সে ছুটে গেল বোনের ঘরের দিকে।এখন জিনিসটা দিতে না পারলে যে বড্ড দেরি হয়ে যাবে!সামিরার ফিউচার এর সাথে জড়িত।সে তড়িঘড়ি করে আবির আর সামিরার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।সামিরা মাত্রই ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে।দরজার ফাঁকে বোনকে উঁকি দিতে দেখে কিছুটা অবাক হলো।তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

—“আপা নাটক না করে ভিতরে এসে পড়।তুই যাকে খুঁজছিস সে এখন ঘরে নেই।জরুরি কাজে বাহিরে গেছে।”

আবির ঘরে নেই শুনে নামিরা প্রশান্তির শ্বাস ছাড়লো।যতোই ফ্রি মাইন্ডেড পারসোন হোক না কেন,আবির তার ছোট বোনের হাজবেন্ড।চাইলে কি আর সবকথা তার সামনে বলা যায়?নামিরা দ্বিধা ঝেড়ে ভেতরে ঢুকলো।অতপর গাল ফুলিয়ে বা’হাত নিজের কোমরে রেখে বলল,

–“আমি নাটক করি?কোন এঙ্গেলে আমাকে অভিনেত্রী মনে হয়?”

সামিরা আপাদমস্তক তার বোনকে চেকআউট করলো।তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

-“সত্যি তো!তুই দিন দিন যে হারে ফুলছিস।কোথায় নায়িকারা আর কোথায় তুই!! আমিও যে মাঝে মাঝে কাকে কি বলি!”

নামিরা তার বোনের কথায় তেমন তোয়াক্কা করলো না!সে এই মূহুর্তে ঝগড়া করার মুডে নেই।আসল কাজ ঠিকমতো করতে পারলেই হয়। নামিরা চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো।সামিরার কাছে গিয়ে ছোট্ট একটি প্যাকেট এগিয়ে দিল। অতপর নিচু গলায় বলল,

-“কেউ দেখার আগে জলদি জলদি খেয়ে নে।”

সামিরা ভ্রু কুঁচকালো।প্যাকেট হাতে নিয়ে খুলে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দেখে ভীষণ লজ্জা পেল।দু’গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো।সাথে সাথে বিছানায় ছিটকে ফেলে দিলো।মনে মনে বলল,”আপার মাথা কি পুরোপুরো খারাপ হয়ে গেছে!কি মনে করে মর্নিং আফটার পিল এনেছে সে?”

-“উফফ সামি!ফেলে দিলি কেন?আর,এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?পানিটা ধর।তড়িঘড়ি করে গিলে ফেল।”

নামিরা পুনরায় তাড়া দিলো।তার হাতে পানির গ্লাস।সামিরা আমতাআমতা করে বলল,

-“আপা!তুই যা ভাবছি,তেমন কিছুই হয় নি?”

সামিরার কথায় নামিরা সারাঘরে চোখ বুলালো।ফুলদানিতে থাকা রজনীগন্ধা ফুলগুলো কেমন নেতিয়ে গেছে।বিছানার চাদর আগের টাই বিছানো রয়েছে।সব কিছুই ঠিকঠাক।সন্দেহজনক কিছু পেল না।এর মানে সামিরা ঠিক বলছে,তাদের মাঝে কিছুই হয় নি।সে চাপা শ্বাস ছাড়লো।এগিয়ে এসে সামিরার বা’হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।

-“বিয়ে পবিত্র সম্পর্ক।স্বয়ং,ওপরওয়ালা দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মাঝে বিয়ের মাধ্যমে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে দিয়েছেন।তুই কি সেই বন্ধনটাকে ডিনাই করতে চাচ্ছিস না?”

সামিরা এতো সময় নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।এবার চোখ তুলে তাকাল।বোনের কথা তার অন্তরে যেয়ে আঘাত করেছে।সত্যি কি সে কোনো ভুল করছে?চোখ ছলছল করে উঠলো।

-“কালকে পুরোটা দিন আমি তোর সব কর্মকাণ্ড অবজার্ভ করেছি।মানলাম অচেনা একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে!!তাই বলে তুই তার সাথে যা ইচ্ছে তাই করবি?বর্তমান জেনারেশনে এখনো বহু মানুষ আছে যারা এরেঞ্জ ম্যারেজ করছে।কই তারা তো তাদের সোলমেটকে ইগনোর করে না?তোর উচিত ছিলো না আবিরের সাথে কিছু সময় ক্লোজলি স্পেন্ড করা?”

সামিরার গলা কাপছে।নিশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে।সে কথা বাড়াতে চায় না। তারপরও বলল,

-“ক্লোজলি টাইম মানে কি আপা?ফিজিক্যাল হওয়া?ফিজিক্যাল রিলেশনশিপই কি সবকিছু?”

নামিরা কিছু বলার জন্য মুখ খুলে ছিল কিন্তু সামিরা তাকে সুযোগ দিলো না।নিজের মতো বলতে লাগলো।

-‘তুই নিজেও তো রাজি ছিলি না,আপা।ড্রাইভারের ছেলে বলে বার বার অপমান করছিলি।বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য বাবার আগে পিছনে ঘুরছিলি!!এখন এমন কি হলো যে কয়েকঘন্টায় তোর আবিরকে এতো ভালো লাগতে শুরু করলো?’

নামিরা দু সেকেন্ড চুপ থাকলো।মৃদু হেঁসে বলল,

-“ভালো মানুষ ভালো লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক।আর তুই নিজেও জানিস,এই পরিবারের প্রতিটি মানুষ ঠিক কতোটা মূল্যবান।’

এবার সামিরা চুপ রইলো। নামিরা বলতে লাগলো।

-“আমার জেদের কাছে হার মেনে রাজি হলেও বাবা লাবিবকে কখনোই পছন্দ করে নি।বিয়ের ছয় মাসেও তাকে মেনে নিতে পারে নি। বাবার ধারণা ছিলো লাবিব আমাকে ধোঁকা দিবে।আর অবশেষে তাই হলো।পেয়ে গেলাম জীবনের সবচেয়ে বড় ধোঁকা।বাবা কখনোই আমাদের খারাপ চান না।বিশেষ করে তোর ব্যাপারে তো একদমই না।আমিও চাই না বাবাকে ভুল বুঝে,মানসিক টানাপোড়নে তোর দিন কাটুক।”

এ পর্যায়ে এসে নামিরা সাঈফের বলা কথাগুলোই একটু গুছিয়ে বলতে লাগলো।

–“মাহিদকে বাবা দুটো অপশন দিয়েছিলো।হয়ত তুই নয়ত ওয়েল স্যাটেল্ড লাইফ।মাহিদ তোর উর্ধে লাক্সারিয়াস জীবনটাকেই চুজ করেছে।এবার তোর উচিত আবিরের সাথে আট-দশজনের মতো স্বাভাবিক দাম্পত্যের জীবন শুরু করা।”

–“কেন বুঝছিস না তোরা!আমিও তো একটা মানুষ,আমারও তো একটা মন আছে।মাহিদকে ভালো না বাসলেও,আমি তাকে পছন্দ করতাম। আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে পাশে চেয়েছিলাম।তুই যেটা বলছিস সেটা অন্যায় আপা!মাহিদের সাময়িক মোহ কাটতে,আমি আবিরকে কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারবো না।আই কা’ন্ট অ্যাবইউজ হিম।”

সামিরা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো।তার চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। নামিরা সামিরাকে শান্ত করতে এগিয়ে এলো।আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। চুলে বিলি কাটতে লাগলো।সামিরা বোনের কাঁধে মুখ গুঁজে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

-“আমার সময় লাগবে আপা।বেশ দীর্ঘ একটা সময়!আমি আবিরকে খুব করতে ভালোবাসতে চাই!দৃষ্টিহীন অন্ধের মতো তাকে বিশ্বাস করতে চাই।এই মূহুর্তে নিজেকে মোহতে আটকানোর মতো দ্বিতীয় ভুল আমি করতে চাই না।”

নামিরা বোনের হৃদয়ের বেসামাল অবস্থা বুঝতে পারলো।চিরচঞ্চল মেয়েটা একদিনে কেমন চুপসে গেছে।সে বিষয় নিয়ে আর কোনো কথায়ই বলল না।পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে নামিরা খুব অভ্যস্ত।চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে,সিরিয়াস কন্ঠে বলে উঠলো,

-“সামু জানিস তোর শশুর ভীষণ হেল্থ কনসিয়াস!সকাল সকাল একঘন্টা দৌড়ে ঝাঁপ সেরে আসলো।আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল,মামনী!আমি দৈনিক হাঁটাহাটি করি সেই সাথে টাইমলি সব রুলস ফলো করি!খাওয়া দাওয়া একদম মাপ মতো।ডায়বেটিসকের পেসেন্ট তো তাই অনেক সচেতন থাকতে হয়।”

-“এখানে সমস্যাটা কোথায়, আপা?”

-“আহা!আগে পুরো কথা শোন না।”

-“আচ্ছা বল।”

-“এরপর আঙ্কেল ডায়বেটিসকের পয়েন্ট চেক করলো,ইনসুলিনও নিলো।তারপর তোর শ্বাশুড়ির আড়ালে,দু’টো মিষ্টি টপাটপ মুখে পুরে নিলো।মিষ্টি খাওয়া শেষ হতে,আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে নিজের কামরার দিকে চলে গেল।দেখলি কতো ধুরন্ধর!”

সামিরা হেঁসে দিলো।তারপর সেও রসিকতার স্বরে বলল,

–“আপা, তুই কিন্তু আবার আমার শশুর বাড়ির অপমান করেছিস।ব্যাড ম্যানার।”

বোনের মুখে হাসি দেখে নামিরার মন শান্ত হয়ে গেল।

———-

সকাল সকাল যে আবির জরুরি কাজের নামে বের হয়ে গিয়েছিল সেটা আসলে সামিরার জন্য।তাইজুল ইসলাম মেয়ের কাছাকাছি এসে মাথার ওপর হাত রাখলেন।তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।হয়ত সারারাত ঘুমোতে পারেন নি!কম্পমান গলায় বললেন,

–“মারে,রেগে আছিস?”

সামিরা বাবাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।

আবির সকাল সকাল তার মাকে জানিয়েছে যে সে সামিরাকে নিয়ে আজ তার বাড়ি যাবে।কিন্তু সেলিনা খাতুন বেঁকে বসলেন।তিনি কোনোভাবেই রাজি হন নি।তার দূর সম্পর্কের এক খালা আসছেন,নতুন বউকে দেখতে।তিনি ছেলেকে বললেন,আগামীকাল বউ সমেত শশুর বাড়ি যেতে।উপায় না পেয়ে আবির শশুর,শাশুড়ীর সাথে নানী শাশুড়ীকেও তার কোয়াটারে নিয়ে এসেছে।এতে মাও কষ্ট পেল না,বউও খুশি থাকলো।

সেলিনা খাতুন আর নাদিরা বেগম নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছেন।তাইজুল সাহেব মোখলেস মিয়ার সাথে খোশমেজাজে গল্প করছেন।তিনি ভুলেই গেছেন সামনে থাকা লোকটা এক সময় তার ড্রাইভার ছিলো।যদিও মোখলেস মিয়া কথায় কথায় তাকে স্যার বলে সম্বোধন করছেন।তাইজুল ইসলাম অবশ্য এ আচরণের কিছুটা অসন্তোষ হলেন।

সামিরা,নামিরা,আদিবা আর চমকি মিলে সোফায় বসে লুডু খেলছে।আবির তাদের সামনে এসে কয়বার ঘুরঘুর করলো।পানি খেয়ে শব্দ করে গ্লাস রাখলো।কেউ তাকে তোয়াক্কাই করলো না।আসলে সে সামিরার সাথে একান্তে কিছু সময় কথা বলতে চাইছে।সামিরা বুঝতে পেরেও ঠাঁই বসে রইল।নামিরা আড়চোখে তাদের দু’জনকেই পরখ করলো।কি মনে করে সামিরা খেলা রেখে উঠে রুমে চলে গেল।আবির মনে মনে খুশি হলো।সেও পেছন পেছন ছুটলো।চমকি তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা জোরে বলে উঠলো,

—“আবির ভাই কালই রাইতে তো দরজা না লাগায় ঘুমায় পড়ছেন।আমি ভালা মানুষ তাই উঁকি দিয়া দেহি নাই।আমার দাদী কইত,মানুষের ঘরে উঁকি দেওন ভালা না।হে কথাই স্মরণে রাখছি আমি।এখন আমনের হউর হাউরি বাইত আছে,দরজা লাগায় লন।সবাই এই চমকি না।”

আবিরের কানে কোনো কথাই গেল না।এদিকে চমকিকে থামাতে আদিবা তার মাথায় গাট্টা মারলো।

———

-“ডাকছিলেন কেন?”

আবির তড়িঘড়ি করে তার পরনের ডেনিম প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো।একটা ছবি বের করে সামিরার সামনে তুলে ধরল।সামিরা আশ্চর্য হলো।তাদের ট্রিপ এক্স বাড়ির ছবি।আবির কেন তাকে তাদের বাড়ির ছবি দেখাচ্ছে!!

–“আসলে কাল রাতে তুমি বললে না,বাড়ির কথা,বাবার কথা মনে পড়ছে?বাবা-মাকে নিয়ে আসতে পারলেও তোমার বাড়িটা সাথে করে আনতে পারি নি।তাই ছবি তুলে নিয়ে এসেছি।”

আবির কথা শেষ করে হাসলো।সামিরা বিস্মিত!এই লোকটা এমন কেন?সে কখনো ভাবে নি কেউ তার এতো ছোট একটা কথাকে,কেউ এতো গুরুত্ব দিবে।সে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো।সুদর্শন পুরুষটির চোখে ভেসে উঠলো একরাশ আতংক!

চলবে

#মধু_পিঁপড়া
পর্বঃ০৯
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
-“এতো ফুল কেন এনেছিস?ভর্তা করে খাবি নাকি?এতো বড় হয়েছিস অথচ জ্ঞান- বুদ্ধি কিছুই হয় নি।বুদ্ধি কিনতে পাওয়া গেলে সবার আগে তোর জন্য আমি বুদ্ধি কিনতাম।তারপর পানির সাথে গুলিয়ে খাইয়ে দিতাম।”
নাদিরা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে কথা বলছেন।আর আশেআশে তাকাচ্ছেন। ছেলের কাজকারবারে তিনি অতিষ্ঠ।বোনের শ্বশুর বাড়িতে কেউ এতো বড় ফুলের তোড়া নিয়ে আসে!দিন শেষ এই ফুলগুলো স্থান তো ময়লার ঝুড়িতেই হবে।সাঈফ একবার মায়ের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার হাতে থাকা বুকেটার দিকে নজর দিচ্ছে।তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে।চমকির কাছ থেকে শুনেছিলো আদিবার লাল গোলাপ অনেক পছন্দ।সে লাল,সাদা,হলুদ,কমলা রঙের গোলাপের মিশ্রণের তোড়া নিয়ে এসেছে।বুকেটাতে প্রায় দুইশোর ওপরে ফুল আছে।ফুলগুলো রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে নিয়েছে সে।কেনার আগে সে না এতোকিছু ভাবে নি!পরে সারা রাস্তায় ভেবেছে,কি করে আদিবার হাতে পৌঁছে দিবে।আবিরদের ফ্লাটের কলিংবেল বাজাতেই তার মা দরজা খুলেছে।সে মনে মনে প্রার্থনা করছিলো,হয়ত আদিবা নয়ত তার বোনদের কেউ যেন দরজা খুলে।কিন্তু তার প্রার্থনা সফল হয় নি।

-“শোন,এটা যেখান থেকে এনেছিস সেখানে রেখে আয়।আর কিছু আনা লাগবে না,তোর বাবার মনুকে দিয়ে সবার পছন্দের সব রকমের খাবার আনিয়েছে।তুই না হয়…

-“ওমা গো!এত্তো গিলা ফুল!কি সুন্দর!পরাণ ডা মোর জুড়ায় গেল।সাঈফ ভাই এডি কি আমার লইগা?”

নাদিরা বেগমের কথার মাঝে চমকি গলা উঁচিয়ে অস্ফুট শব্দে চিৎকার করে উঠলো।আচমকা শব্দে নামিরা বেগম ভয় পেয়ে বুকে হাত চেপে ধরলেন।সাঈফ পড়েছে বিপাকে!সে হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না।কেবল চোখের সামনে আসা চুলগুলো ঠেলে সরিয়ে দিলো।

-“কি ভাই কিছু কন না কেন?””

চমকি চুপসে মুখে পুনরায় প্রশ্ন করলো। নাদিরা বেগম পড়েছেন বিপাকে,তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন।মাকে চলে যেতে দেখে,সাঈফ চমকির দিকে তাকিয়ে ডান হাতে মাথা চুলকালো।বোকা হাসি দিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

-“আসলে আমি আদিবার জন্য এনেছিলাম। ”

সাঈফের উত্তর শুনে চমকির চুপসানো মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে ফিচলে হাসি দিয়ে বলল,

-“প্রেমী ও প্রেমী,
মনের মাঝে আদিবা রানী।”

চমকির কথায় সাঈদ খানিকটা ইতস্তত বোধ করলো।সে তার পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো।তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।আদিবা মাত্রই কলেজ থেকে এসেছে।এইচএসসি পরীক্ষার্থী হওয়ায় তার পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি।ক্লান্ত বিধস্ত মুখে সে সিঁড়ি গোড়ায় স্ট্যাচু মতো দাঁড়িয়ে আছে।কাঁধে থাকা ব্যাগের ভাড়ে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে সে।সাইফ আর চমকির সব কথাই তার কানে এসেছে।সাঈফের হাতে নিজের পছন্দের ফুল দেখে তার বুক ধকধক করছে।অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে।সে সাঈফের চোখের দিকে তাকাল।আবেশীয় এক অনুভূতির সন্ধান পেলো।এদিকে সাঈফ আর আদিবাকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকি মুচকি হেঁসে সরে গেল।সাঈফ কিছুটা৷ এগিয়ে হাতের বুকেটা আদিবার হাতে ধরিয়ে দিলো। মুখে কিছু বলল না।তারপর স্বাভাবিকভাবে ফ্লাটের ভেতর প্রবেশ করলো।

——

সেলিনা খাতুন মাথায় ক্রমাগত পানি ঢালছেন।এক হাতে তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। গায়ের সেলোয়ার-কামিজ ভিজে গেছে।প্রেসার বেড়েছে কি না বুঝতে পারছেন না!চোখ সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখছেন।ঘাড়েও ব্যাথা।বমি বমিও লাগছে।
ছেলে তার বরাবরই শান্ত।ছোট থেকে যেভাবে চেয়েছেন,ঠিক সেভাবেই চালিয়েছেন।ছেলেও সবকথা শুনে বড় হয়েছে।শুধু মাত্র আঠারো বছর বয়সে এসে বাচ্চাদের মতো একবার বায়না ধরেছিলো।দু’দিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে এক রুমে পড়েছিলো।উপায় না পেয়ে তিনিও কথা দিয়েছিলেন সাধ্যে কুলালে কাঙ্ক্ষিত আবদারের বস্তু এনে দিবে।দিয়েছেন ও!অথচ সেই বায়না পূরন হতে না হতেই ছেলেটা কেমন বদলে গেছে।হুটহাট কাজ তার কখনোই পছন্দ না।নতুন বউয়ের পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসার আগে ছেলেটা তাকে অন্তত জানাতে পারতো!বড়লোক মানুষ!তাদের মতো শাকপাতা খেয়ে তো তারা অভ্যস্ত নয়।প্রথমবার তাদের বাসায় এসেছে!এছাড়া মেহমানদারি করতে গেলে,ভালোমন্দ তো রান্না করাই লাগে।কার জন্য কি আইটেম করবেন,এই ভেবেই তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে!!প্রথমে ভেবেছিলেন পোলাও করবেন,সাথে চিকেন সাসলিক আর কালা ভুনা।পরক্ষণে মনে হলো একদম লাইট খাবার হয়ে যাচ্ছে।সিদ্ধান্ত বদলে বিরিয়ানিতে শিফট করলে।গরুর বিরিয়ানি!তাইজুল সাহেবের হাই প্রেসারের কথা শুনে,সেটাও বদলে ফ্রাইড রাইসের করার জন্য পাকাপোক্ত প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছিলেন।পরে যুতসই কোনো ইনগ্রিডিয়েন্ট খুঁজে পেলেন না।ঘরে না আছে মাশরুম,না আছে চিংড়ি।সয়া সস ও নেই।মানুষ শুনলে বলবে সামান্য রান্নার জন্য কারো প্রেসার বাড়ে?মানুষ তো আর বুঝবে না রান্না সামান্য হলেও মানুষ গুলো তো আর সামান্য না।সেলিনা খাতুন নিজেকে নরমাল রাখা চেষ্টা করলেন।মাথায় একগাদা তেল দিয়ে,জামা কাপড় বদলে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

———

-“তুই এক কাজ সালাদটা বানিয়ে ফেল।”
-“টমেটো আর শসা কয়টা করে নিবো?”
-“যতজন মানুষ, সেই হিসেবেই নে।আমি একটু দেখে আসি।আপার মনে হয় শরীর ভালো না।”

নাদিরা বেগম বড় মেয়েকে ইনসট্রাক্টশন দিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হতেই নিচ্ছিলেন।সেলিনা খাতুনের সাথে দেখা।

-“আপা করছেন কি আপনারা?আমার একটু মাথা ঘুরছিলো তাই ঘরে গিয়েছিলাম।ইশশ!কতো কষ্ট করলেন?সব রান্না তো শেষ দেখি!”

সেলিনা খাতুন তড়িঘড়ি করে সব পাতিলের ঢাকনা খুলছেন।বেশির ভাগ দেশীয় খাবার রান্না করা হয়েছে।মনে মনে খুশি হলেন।লক্ষ্য করলেন ঘাড় ব্যথা সেরে গেছে।আগের মতো বমি বমি ভাবটাও নেই।নাদিরা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,

–“আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই আমার মন মতো সব করে ফেললাম।কিছু মনে করেন নি তো?”

-“আরে না না,কি বলছেন!বরং আমারই লজ্জা লাগছে।আপনি একা একা কষ্ট করলেন।ডাক দিলেও পারতেন।”

-“ভাবলাম আপনার শরীর ভালো না,তাই আর কি!!আর চমকি তো সাথেই ছিলো,অর্ধেক কাজ সেই করেছে।

সেলিনা খাতুনের হঠাৎ করেই কান্না এসে গেল।তিনি ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ালেন।বাকি কাজ নিজে সামলে নিবেন বলে,এক প্রকার জোর করে নাদিরা বেগম আর নামিরাকে গেস্ট রুমে পাঠিয়ে দিলেন রেস্ট নিতে।মনে মনে,সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায় করলেন।তিনি কতোকিছুই না ভেবে বসেছিলেন।কোথায় বসতে দিবেন,কিভাবে রাঁধবেন,কি রাঁধবেন!অথচ কতো সহজেই সবকিছু হয়ে গেল।জীবনটাকে সহজভাবে নিলে জীবন সুন্দর,অবশ্য এর জন্য সঙ্গ ভালো হতে হয়।

——-

–“কি কলি কাল আইলো।নতুন বউ,জামাই নিয়া দিনে-দুপুরে দরজা দেয়।”

-“ঠিকই কইছেন।আমগো সময় বিয়ার পর দিন সক্কাল সক্কাল উঠি ত্রিশ জন মানুষের রান্ধা রান্ধোন লাগছে।জামাই এর কথা মন নি আছিলো।নাতনি ডারে কিচ্ছু শিখাইতে পারলাম না।”

সেলিনা খাতুনের দূর সম্পর্কের খালা আঞ্জুমান আরা।দুনিয়ায় মানুষ চিন্তা ভাবনা,প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেলেও তিনি এখনো নব্বই দশকের বিবেক নিয়ে মাথা বোঝাই করে রেখেছেন।তার সাথে যোগ হয়েছেন আমেনা খাতুন।এমনিতেই সামিরাকে তিনি তেমন একটা পছন্দ করেন না।তার উপরে অপছন্দের নাতনির ত্রুটি,এ যেনো তার জন্য সোনায় সোহাগা।বাড়িতে মেয়ের জামাইয়ের জন্য নাতনিকে বকার কখনো তেমন সুযোগ পান নি।কিন্তু এখানে এসে এমন মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাবেন,এটা তার জন্য ভাবনাতীত ব্যাপার!তাই সুযোগটাকে কাজে লাগালেন।এদিকে সামিরা আঞ্জুমান আরার কথায় প্রথমে ভীষণ লজ্জা পেলেও,পর মূহুর্তে নানীর বঞ্চনায় তার চোখে পানি এসে গেল।সে আশেপাশে তাকাল।না কেউ নেই!সবাই দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে।সে ড্রইং রুমে একা,দু’জন কুটনি বুড়ির সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে।মনে হচ্ছে তাকে শুধু কটু কথা শোনানোর জন্য রুম থেকে ডেকে আনা হয়েছে।যা সে বিগত দশ মিনিট যাবৎ কান পেতে শুনে যাচ্ছে।

–“বুঝি বুঝি!আমার বউকে হিংসা করছো তাই তো?তাহলে চলো!তোমাদের দুইজনকে নিয়ে রুমে দরজা দেই।”

কোথা থেকে আবির এসে দু’জনের হাত চেপে ধরলো।আমেনা বেগম এক প্রকার লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে পড়লেন।শাড়ি ভালো ভাবে শরীরে জড়িয়ে নিলেন।সাথে মুখও ঢাকলেন।অপরদিকে আঞ্জুমান আরা অপ্রস্তুত!তিনি এমন আতর্কিত হামলার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না।

–“কি হলো চলো না?দুইজনের সেবার পাওয়ার জন্য আমার শরীর-মন কেমন যেন করছেন?”

আমেনা বেগম ভেবেছিলেন সামিরাকে দুটো কথা শুনিয়ে দিবেন।কিন্তু আবিরের ফিচলামোতে তিনি পুরোপুরি ভড়কে গেছেন। এক প্রকার ভয় পেয়ে কেটে পড়লেন।আঞ্জুমান আারা মুখ খুললেন,

–“তোর বউয়ের লগে একটুখানি মজাও করতে পারতাম না?”

–“বউয়ের সাথে মজা পরে হবে,আগে চলো জানেরা আমার সাথে মজা মজা খেলা হবে।”

আবির মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে,ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলো।কথা বলতে বলতে সে আঞ্জুমান আরার শাড়ির আঁচলে হাত রাখলেন।আমেনা বেগম এতোক্ষণ সোফায় বসে থাকলেও এবার উঠে পড়লেন।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

–“গোলামের পুত”

আর এক মিনিট ও দাঁড়ালেন না।তাৎক্ষণাত প্রস্থান নিলেন।সামিরা এতো সময় আবির আর দুই কুটনি বুড়ির কাহিনি দেখছিলো।তারা যেতেই সে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। দরজার পেছন থেকে বের হয়ে এলো আদিবা আর চমকি।তারাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।মূলত তারাই আবিরকে ডেকে এনেছে। হাঁসতে হাঁসতে সামিরার চোখে পানি এসে পড়লো।

চলবে