#মনের_আড়ালে
Part_11
লেখনীতে – #Nusrat_Hossain
তিথি রুমে খাবার নিয়ে ঢুকে দেখতে পেল ইশমি দুই হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে ।সেদিন পাড়ার লোকগুলো অভিক কে রাস্তায় মারছিল আর হাফসা বেগম তার ফুপি দরজা আটকে ইশমিকে খুব মেরেছিল ।বাসার কেউ-ই হাফসা বেগম কে আটকাতে পারেনি ।হাফসা বেগম রেগে গেলে একদম দানবমূর্তি ধারন করে তখন তাকে আটকানো কষ্টসাধ্য হয়ে যায় ।আর অসভ্য গালাগাল তো আছেই ।কয়টা দিন পর্যন্ত মেয়েটা বিছানায় জ্বরে পরে ছিল ।সে খাবার টা রেখে ইশমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ।ইশমি মাথা তুলে তিথির দিকে তাকাল ।অতিরিক্ত কান্নাকাটি করার ফলে ইশমির চেহারা লাল হয়ে চোখ ফুলে গেছে ।এখনো কাঁদছিল মেয়েটা ।ইশমি তিথির কমোর জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আর বলল
আপু আ্ আমার ভাগ্যটা এত খারাপ হল কেন ? আমি কেন এতিম হয়ে জন্ম নিলাম ? ব্ বাবা মা আমায় কেন এতিম খানা থেকে এডপ্ট করতে গেল ? তাহলে না আমি কষ্ট পেতাম , না অ্ অভিক ইশমি আর বলতে পারল না ফুঁপিয়ে
কেঁদে উঠল !
সে কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারো বলতে শুরু করল ছোটবেলায় মায়ের অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারতাম না যেদিন থেকে বুজতে শিখেছি সেদিন থেকে আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত নিজের মৃত্যু কামনা করে প্রার্থনা করতাম ।কিন্তু এখন ধীরে ধীরে আমার সব সয়ে গেছে ।কোনো আঘাতই আর আমার গায়ে লাগেনা ইশমির গলা কাঁপছে ।
তিথির খুব কান্না পাচ্ছে ।সে জিজ্ঞেস করল ভালোবাসিস অভিক কে ?
ইশমি কান্নারত অবস্থায় ফুঁপিয়ে বলল
আ্ আমি এটা ক্ কোনোদিন অস্বীকার করবো না যে উনিই আমার প্রথম অনুভূতি ।প্রথম যেদিন দেখা হল আমাদের , আমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম উনি আমায় খুব যত্ন করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল আমি ঐ দিনটার কথা কোনোদিনও ভুলব না ।আর যেদিন থেকে আমাদের ভার্সিটিতে জয়েন করলেন সেদিন থেকে ক্লাস শেষে ব্রেক টাইমে আমায় নিজে থেকে পড়া বুঝিয়ে দিতেন আর আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম বলেই ইশমি ফিঁক করে হেঁসে দিয়ে , চোখের জল মুছে বলল আমাকে তার সামনে বসিয়ে কতশত গল্প করত আর আমি ঘোরলাগা দৃষ্টিতে চেয়ে তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনতাম ।আমার তার প্রতি ভালো লাগার অনুভূতি সেখান থেকেই শুরু হয় ।যেদিন উনি আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল আমার খুব আনন্দ হয়েছিল ভাবলাম আমার ভালো থাকার দিন বুঝি এখন থেকে শুরু হল আর বুঝি আমায় কাঁদতে হবে না মুহূর্তেই তাকে নিয়ে চোখে হাজারো স্বপ্ন দেখতে লাগলাম কিন্তু আমার তো আবার কপালটাই খারাপ । মা উনাদেরকে সরাসরি না করে দিল ।উনিও আমায় ভুল বুঝে বসল।এমনিতে আমি ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে চক্ষুশূল ।মা আমায় আদেশ করে বলল, ইশমি এই ছেলেকে তুই বিয়ে করতে পারবিনা , এই ছেলের সাথে তোর বিয়ে হবেনা আমিও সব মেনে নিলাম , দুদিন ইচ্ছামত কাঁদলাম তারপর তার জন্য হওয়া সব অনুভূতি আমি মন থেকে সরিয়ে দিলাম ।কিন্তু উনি সরালেন না আমায় তার মন থেকে উল্টো দিন দিন উনার উন্মাদতা বাড়তে লাগল আমার প্রতি ।
তিথি ইশমির মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল সবার ভালোবাসার ধরন এক হয় না ইশু ।কেউ কেউ নিজেদের স্বভাবমত দুই দিন পর পর গার্লফ্রেন্ড /বয়ফ্রেন্ড পাল্টায় , আবার কেউ কেউ একজনকেই পাগলের মত মনপ্রান উজার করে ভালোবাসে আর অভিক হচ্ছে এই টাইপের ।এই ধরনের সাইকো টাইপ ছেলেগুলো এত সহজে ভালোবাসার মানুষকে নিজেদের মন থেকে সরিয়ে দিতে পারেনা ।এরা ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে খুব পসেসিভ হয় ।
ইশমি ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখমুছে বলল আমি পারলে উনি কেন পারবেনা ? কেন আমায় নিজের মন থেকে সরিয়ে দিচ্ছেনা আমি তো দেখতে আহামরি সুন্দরীও নই ।তাহলে কেন এভাবে আমার পিছনে পরে আছে ? আমার কি ভালো লাগা , খারাপ লাগা কোনো অনুভূতি নেই ? আমার কি রাগ ,অভিমান হয় না ? ঐদিন আমি রাগে কি ব্লক মারলাম , তো উনি একদম আমার বাসার সামনে হাজির হয়ে গেলেন ?তারপর পাড়ার ছেলেদের হাতে মারও খেলেন এত বেহায়া কেন উনি ?কেন আসতে গেল এখানে ? কি প্রয়োজন ছিল তার এখানে আসার ?দূর থেকেও তো ভালোবাসা যায় ।এত অধৈর্য কেন হল উনি ? আজকে বিশটা দিন হতে চলল উনার কি অবস্থা আমি এখনো জানতে-ই পারলাম না ।আমার তো ছোটবেলা থেকে শরীরে আঘাত পেতে পেতে অভ্যাস হয়ে গেছে উনি কিভাবে সহ্য করলেন আপু ?
তিথি ইশমির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল এইখানে পরে থাকলে তুই মরেই যাবি ইশমি আর কত ? ঐ ডাকাত মহিলা তোকে মারতে মারতে একদিন শেষ-ই করে ফেলবে আমরা ঐ ডাকাত মহিলাকে আটকাতেও পারিনা পর্যন্ত।তুই এখান থেকে চলে যা অভিকের কাছে ।অভিক কে সব বলে দে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে ।তুইও ভালো থাকবি অভিকও ভালো থাকবে ।ভালো একটা লাইফ লিড করতে পারবি ।
ইশমি মাথা নাড়িয়ে বলল , না ।আমি যদি এখন সবকিছু ছেড়ে চলে যাই তাহলে বাবা , মা আর কোনোদিনও আমায় কাছে টেনে নিবে না ।আপন সন্তান হলে হয়ত একদিন না একদিন আমায় আদর করে বুকে টেনে নিত ।কিন্তু আমি তো তাদের নিজ সন্তান নই আপু আমি চলে গেলে তারা আমাকে মেনে নেওয়া তো দূর আমাকে মেয়ে বলে পরিচয়ও হয়ত দিবে না কোনোদিন।আমি আবার বাবা , মা হারা হয়ে যাবো আর আমি এটা চাই না ।সম্ভব না আপু ।আমি বাবা মাকে কষ্ট দিতে পারবো না ।যে পর্যন্ত তারা নিজ থেকে না চাইবে ঐ পর্যন্ত আমি পারবো না ।
তিথি দাঁতে দাঁত চেঁপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল তাহলে তুই এখানেই পরে আজীবন কাঁদতে থাক গাধী কোথাকার আর মরে যা ।আসল কথা হল ছোটবেলা থেকে ঐ ডাকাত মহিলার কথা মত চলতে চলতে তুই নিজের আসল সত্তাটাই হারিয়ে ফেলেছিস এখন সব কিছুতেই তোর ভয় হয় ।রাগ হচ্ছে তিথির খুব ।কিভাবে একটা মেয়ে এত আঘাত সহ্য করে ? সে হলে কবে এই নরক থেকে পালিয়ে যেত ।
ইশমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল আ্ আপু আমার তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ।এ্ একটা কিছু করে আমায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করবে প্ প্লিজ ।তাকে চোখের দেখা দেখেই চলে আসবো আমি ।
তিথি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল ওরে বাবা তোর ডাকাত মা জেনে গেলে তোকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে আর এখন তো তোর বাপও যোগ দিয়েছে তোর মায়ের সাথে ।জানিনা মহিলা কি কানপড়া দিয়েছে তোর বাপকে তোর ব্যাপারে সারাক্ষণ পাহাড়া দিয়ে রাখে ঘরের বাইরে ।
ইশমি তড়িৎগতিতে বলে উঠল আপু তুমি ভুলে গেলে আজকে বাবাকে নিয়ে মায়ের হসপিটালে যাওয়ার ডেট আর হসপিটাল থেকে ফিরতে দেরি হবে অনেক । ততক্ষণে আমি চলে আসবো তাকে দেখে ।
তুই জানিস অভিক এখন কোন হসপিটালে আছে ? আন্দাজে কই ঘুরবি ?
আগে উনার বাড়িতে যাবো ।বাড়িতে কেউ না কেউ তো থাকবে সেখান থেকে জেনে নিয়ে হসপিটালে যাবো ।আর অভিক একদিন আমার সাথে গল্প করার সময় কথায় কথায় বলেছিল তার বাড়ির কথা ।আমি চিনতে পারবো ।
তিথি রুম থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দেখল হাফসা বেগম আর আয়নাল হোসেন হসপিটালে চলে গেছে কিনা ?
সে পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে ইশমিকে বলল রেডি হয়ে নিতে ।ইশমি বোরখা আর নিকাব টা পরে নিল , হাতে কিছু টাকা নিয়ে বের হয়ে গেল ।তারপর একটা সিএনজি নিয়ে নিল ।তার বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে-ই অভিকের বাড়ি ।সে এই প্রথম অভিকদের বাড়ি যাচ্ছে তাই বুজতে পারছেনা ঠিক কতক্ষণ লাগবে অভিকদের বাড়ি যেতে ।ঠিকানা অনুযায়ী পঞ্চাশ মিনিটের মত লাগল ইশমির অভিকদের বাড়ি পৌঁছাতে ।সে সিএনজি থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে এক এক পা করে অভিকদের বাড়ির সামনে যেতে লাগল ।আজ পর্যন্ত সে কোনোদিন কলেজ , ভার্সিটি ছাড়া একা কোথাও বের হয়নি এই প্রথম সে একা কোথাও এল আজ তার সাহস দেখে সে নিজেই অবাক ।বাড়িটা ঘিরে বিশাল উঁচু দেয়াল যার ফলে ইশমি এখন পর্যন্ত বাড়িটা দেখতে পায়নি ।আশেপাশে আর কোনো বাড়ি দেখা যাচ্ছে না তাই ইশমি ধরেই নিল এটাই অভিকদের বাড়ি হবে ।ইশমি বাড়ির গেটের সামনে একজন দারোয়ান কে টুলে বসা দেখতে পেল ।দারোয়ানটা কম বয়সের ছেলে তাই ইশমি তাকে জিজ্ঞেস করল
এই যে ভাই এটা কি অভিকদের বাড়ি ?
দারোয়ান তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল হ এটা ছোটসাহেব দের বাড়ি কিন্তু আপনি কে ? আগে তো কোনোদিন দেখি নাই আপনারে ?
ইশমি গড়িমসি করে বলল আমি তার বন্ধু হই ।আপনি কি বলতে পারেন অভিক কোন হসপিটালে এডমিট আছে ?
দারোয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল ছোট সাহেবের বাবা , মা ছোট সাহেবকে নিয়ে কালকেই সিংগাপুরে চলে গেছেন উনার চিকিৎসা করাইতে ।
ইশমির মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল অভিকের বাহিরের দেশে যাওয়ার কথা শুনে ।একটা মানুষকে কতটা আঘাত করলে তাকে বাহিরের দেশে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসা করাতে ।তার খুব কান্না পাচ্ছে ।সে নিজের চোখের পানিটা আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল
কতদিন লাগবে তাদের দেশে ফিরতে ?
দারোয়ান চোখ মুখ কুঁচকাল ।বোঝাই যাচ্ছে উনি খুব বিরক্ত হচ্ছে ইশমির উপর।কিন্তু ইশমি দারোয়ানের তার উপর বিরক্ত হওয়ার বিষয়টা একদমই পাত্তা দিল না ।দারোয়ান বিরক্তিকর মুখে বলল
ছোট সাহেবের পায়ের চিকিৎসা আর মানসিক চিকিৎসা করানোর পর ছোট সাহেব সুস্থ হলে তবেই দেশে ফিরব ।কমপক্ষে তিন থেকে চারমাস তো লাগবই ।
ইশমি চমকে জিজ্ঞেস করল মানসিক চিকিৎসা মানে ?
ছোট সাহেবের জ্ঞান ফিরতেই উনি পাগলের মত করছিল তাই ডাক্তার বড় সাহেব আর ম্যাডাম কে জলদি মানসিক চিকিৎসা করানোর জন্য বলে , তাই উনারা আর দেরি না করে কালকেই সিংগাপুরে নিয়া যান ।সিংগাপুরে বড় সাহেবের একজন বন্ধু থাকে যিনি সাইক্রি না কি যেন বলে তার কাছে চিকিৎসা করাবেন ।
ইশমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল স্ সাইক্রিয়াটিস্ট ।
দারোয়ান বলল হ ঐ টাই ।
ইশমি একবার স্তব্ধ চোখে অদূরে থাকা বাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে
সেখান থেকে চলে এল ।এখন বাজে দুপুর একটা ।মাথার উপর উত্তপ্ত রোদ ,আগুনের গোলার ন্যায় জ্বলছে সূর্যটা আকাশে ।ইশমি রাস্তার এক পাশ দিয়ে নিস্তব্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে অজস্র জল গড়িয়ে পড়ছে । এই জীবনে কি আর অভিক কে দেখতে পাবে না সে ? এইখানেই কি তবে সব কিছু থেমে গেল ?
________________________
___________
চলবে,
@Nusrat Hossain