মনের আড়ালে পর্ব-১৩

0
1316

#মনের_আড়ালে
Part_13
লেখনীতে – #Nusrat_Hossain

ক’দিন আগে মা সব বই বেচে দিয়েছে ।

অভিক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ইশমির কথা শুনে ।সে ভাবল আজকালকার দিনে এমনও হয় নাকি কি আশ্চর্য ! সে আজ পর্যন্ত এমনটা কোনোদিন শুনেনি ।সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল

সামান্য কয়টা টাকার জন্য বই বেচে দিল ? বইগুলো যখন বেচেছিল আপনি কোথায় ছিলেন ?আপনি আটকান নি আপনার মাকে ?

ইশমি চুপ রইল ।অভিকের এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই ।অভিক তার দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে ।কি উত্তর দিবে সে ? সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করল

শুধু যে মাত্র বই-ই যে বেচা হয়েছে তা না !বইসহ , মোবাইল প্রয়োজনীয় সবকিছুই বেচা হয়ে গেছে ।

অভিক ইশমির কথা শুনে একটুও অবাক হল না ।পড়ার বইগুলো যেহেতু বেচতে পেরেছে তাহলে এগুলো বেচা কোনো ব্যাপার না ।তার কিছুই ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে ।সে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে এখন একটু একা থাকতে চায় ।তাই সে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে আপনার কাজটা বুজে নেওয়া উচিত এখন , এই বলে অভিক একজন মেয়ে স্টাফকে ফোন করে আসতে বলল ।তিন মিনিট পর স্টাফটি ডোর নক করে কেবিনে ঢুকলে অভিক তাকে ইশমিকে দেখিয়ে বলল

মিস জাহান উনি হচ্ছে মিস ইশমি । আজকে থেকে উনি প্রিন্টারের কাজ করবে ।উনাকে শিখিয়ে দিন কিভাবে কি করতে হবে আর আগে যে এই কাজটা করত তাকে অন্য কোনো কাজ বুঝিয়ে দিন ।

জাহান মুচকি হেসে বলল ওকে স্যার ।

ইশমি অভিকের দিকে তাকাল ।অভিক তাকে যাওয়ার জন্য ইশারা করল ।

জাহান ইশমিকে শিখিয়ে দিল কিভাবে কাগজ প্রিন্ট করতে হয়।ইশমিও মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা শিখে নিল ।

বুজলে তো কিভাবে কি করতে হবে ।কোনো সমস্যা হলে আমায় ডাকবে আমি সামনের কেবিনেই আছি ।জাহান ইশমিকে মুচকি হেসে বলল ।

ইশমিও ঠোটে হাঁসি রেখে বলল ঠিক আছে আপু ।আপনি এখন আপনার কেবিনে যেতে পারেন ।আমি করতে পারবো এটা খুব সহজ একটা কাজ ।জাহান চলে গেল নিজের কেবিনে ।

ইশমি সেই কখন থেকে একটার পর একটা কাগজ প্রিন্ট করেই যাচ্ছে ।একটু পর পর কেউ না কেউ এসে তার হাতে এক গাধা কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে ।অভিক বলেছিল এই প্রিন্টারের কাজটা খুব সহজ আসলেই খুব সহজ ।কিন্তু সেই কখন থেকে কাগজ প্রিন্ট করতে করতে তার মাথা ঝিম ধরে গেছে আবার ঘুমও পাচ্ছে ।এর মধ্যে আর অভিকের সাথে তার দেখা হয়নি ।

হেই ইশমি চা খাবে জাহান ইশমিকে বলল ।

হ্যাঁ আপু মাথাটা খুব ধরেছে ।একটু ব্রেক নিলে ভালো লাগত ।কিন্তু কাজ রেখে ব্রেক নিলে কোনো প্রবলেম হবে না তো ?

জাহান হেঁসে বলল দূর কোনো প্রবলেম হবে না ।অভিক স্যার নিজেই বলে আগে শরীর আর মন সুস্থ থাকা চাই তারপর কাজ ।
জাহান আর ইশমি দশ মিনিটের মত ব্রেক নিয়ে আবার যে যার কাজে মন দিল ।এখন ইশমির বডি আর মাইন্ড টা ফ্রেশ লাগছে ।জাহান মেয়েটার সাথে তার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ।মেয়েটা তার থেকে তিন – চার বছরের বড় হলেও তার সাথে অনেক ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করে আর অনেক স্মার্টও জাহান মেয়েটি ।সে ভেবেছিল অফিসে কারো সাথে হয়ত সে মিশতেই পারবেনা কিন্তু প্রথম দিনই একজন ভালো বন্ধু পেয়ে গেল ।ভালো-ই লাগছে তার ।মোটামুটি সব কাগজ প্রিন্ট করা শেষ ।আর কয়েকটা কাগজ বাকি আছে ।সে কাগজ প্রিন্ট করতে-ই যাচ্ছিল আর তখনি জাহান আর তার সাথে আরো দুটো মেয়ে সামনে এসে বলল

লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে ইশমি এখন কাজ বাদ দাও আর চল আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে যাই ।কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে ।

ইশমি ত্বরিতগতিতে বলে উঠল আমার খিদে নেই আপু আপনারা যান ।তাছাড়া এখনো সব কাগজ প্রিন্ট করা হয়নি ।

জাহান বলল দুপুরে আবার কারো খিদে না পায় কোনো কথা শুনবো না চল তো তুমি ।জাহান ইশমির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রেস্টুরেন্টে ।তারা চারজন একটা টেবিলে গিয়ে বসল ।

অভিক কেবিন থেকে বেরিয়ে ইশমিকে খুঁজতে লাগল লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে ।সে ইশমিকে লাঞ্চের অফার করত , যদিও ইশমি তাকে না করে দিবে সে জানে তারপরও সে অফার করবে ।আগের মত সে আর ইশমিকে জোড় করতে পারবেনা অনেক কিছুই পাল্টে গেছে ।না চাইতেও তাদের দুজনের মধ্যে অনেকটা গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে ।
সে ইশমিকে অফিসে খুঁজে না পেয়ে জাহানকে কল করল ।জাহানের কাছ থেকে জানতে পারল ইশমি জাহানদের সাথে রেস্টুরেন্টে-ই আছে ।সেও চলে গেল রেস্টুরেন্টে ।অফিসের অপর পাশেই রেস্টুরেন্ট টা ।দুই মিনিট লাগে যেতে ।

ইশমি জাহান ,রিনা আর তিন্নির সাথে কথা বলছিল আর খাবার খাচ্ছিল ।তখনি অভিক কে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখতে পেল সে।অভিক ওদের পাশের টেবিলটাতে বসল আর ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য খাবার অর্ডার করল আর ইশমির দিকেও বারবার লক্ষ্য করছিল ।ইশমি খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে অভিক কে দেখছিল আর অমনি অভিকের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে যায় ।সে দ্রুত অভিকের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মন দিল ।
খাওয়া শেষে তারা ওয়েটারকে বিল দিতে গেলে ওয়েটারটি বলল আপনাদের বিল দেওয়া হয়ে গেছে ।

জাহান , তিন্নি আর রিনা চমকে জিজ্ঞেস করল কে দিয়েছে বিল ? ওরা চমকালেও ইশমি একটুও চমকাল না সে জানে বিল কে দিতে পারে ।সে আড়চোখে আরেকবার অভিকের দিকে তাকাল ।নিচু হয়ে মন দিয়ে খাবার খাচ্ছে ।ইশমি খেয়াল করল অভিকের খাবার খাওয়ার স্টাইলটাও খুব চমৎকার ।মুখ বন্ধ করে খাবার খাচ্ছে ।সে পারে না এভাবে খেতে ।উচ্চবিত্ত মানুষজনগুলো এভাবেই খাবার খায় সে ভাবে ।তাদের হাইলি ট্রেন্ড ।
ওয়েটারটি অভিক কে ইশারা করে দেখিয়ে বলল স্যার দিয়ে দিয়েছে বিল ।

তারা সবাই খুশি হয়ে অভিকের কাছে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল তবে ইশমি চুপচাপ -ই ছিল ।অভিক বিনিময়ে সৌজন্যমূলক মুচকি হাসল ।

লাঞ্চ ব্রেক শেষে সবাই আবার নিজ নিজ কেবিনে কাজ করতে চলে গেল ।ইশমির এখন আর কোনো কাজ নেই ।মাঝেমধ্যে দুই , তিনটা কাগজ আসলে তা প্রিন্ট করে দিচ্ছে আর না আসলে অফিসটা ঘুরে ঘুরে দেখছে ।অফিসে এত এত লোক সবাই একমনে নিজের কাজ করছে ।কেউ ল্যাপটপে কাজ করছে তো আবার কেউ ফাইল ঘাটাঘাটি করছে এই স্টাফগুলোর কাজ ইশমির মাথায় কিছুই ঢুকল না ।কারো দিকে কারো তাকাবার টাইম নেই । সবাই যে যার মত কাজ করছে ।ইশমি কোনোদিনও ভাবতে পারেনি সেও এই রকম অফিসে কোনোদিন চাকরি করতে পারবে যদিও তার কাজটা খুবই ছোট তবুও তার খুব আনন্দ হচ্ছে ।সে প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিল এত লোকের মাঝে সে কিভাবে কাজ করবে ।কিন্তু এখন আর সেই ভয়টা নেই ।সবাই খুব ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করে আর সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে অভিকের তার উপর পজিটিভ দিকগুলো দেখে ।সে নির্দ্বিধায় খুশিমনে এখানে কাজ করতে পারবে ।

অফিস শেষে এই খামটা মিস ইশমির হাতে দিবেন আর যা যা বলতে বললাম তাই বলবেন । একটু পরই অফিস আওয়ার শেষ হবে আপনি মনে করে তার হাতে খামটা দিয়ে দিবেন ।মনে থাকবে তো ? অভিক তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমানের হাতে খামটা দিয়ে বলল ।

অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমান নিজের বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেঁসে বলল স্যার আপনি রিলেক্সে থাকুন আমি এই খামটা মিস ইশমির হাতে দিয়ে দিবো আর আপনি যা যা বললেন তাই বলব ।
অভিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমানকে হাতের ইশারায় যেতে বলল ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমান চলে গেলে অভিক চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল ।

অফিস আওয়ার শেষে ইশমি জাহান , তিন্নি , আর রিনার সাথে অফিস থেকে বের হতে নিলেই
পেছন থেকে কেউ তাকে মিস ইশমি বলে ডাক দিল ।ওরা সবাই পেছনে ফিরে তাকাল ।ইশমি খেয়াল করল একজন পঁচিশ বা ছাব্বিশ বছরের ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে ।ইশমি জাহানেকে জিজ্ঞেস করল উনি কে ?

জাহান মুখে লজ্জা ভাব এনে বলল অভিক স্যারের অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমান ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ওসমান তাদের কাছে এসে মুখে হাঁসি ঝুলিয়ে জাহানকে উদ্দেশ্য করে বলল

জাহান তোমরা চলে যাও ।আমার মিস ইশমির সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা আছে ।

জাহান ওসমানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল কেন আমরা থাকলে প্রব কি ? আমাদের সামনেই বলুন ।

ওসমান ফিঁক করে হেঁসে দিল ।মেয়েটা জেলাস ফিল করছে নিশ্চিত সে ভাবল ।সে বলল

মিস ইশমির সাথে কাজের ব্যাপারে-ই কথা বলব তোমরা চলে যাও ।তোমাদের বাসা কিন্তু অনেক দূরে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে নাহলে ।অগত্যা তাদের তিনজনকে চলে যেতে হল ।

ওসমান ইশমির দিকে খাম এগিয়ে দিল।

ইশমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল এটা কি ?

ওসমান নিজের হাঁসিটা বজায় রেখেই বলল আমাদের অফিসে নতুন স্টাফদের এডভান্স বেতন দেওয়া হয় ।

ইশমি মনে মনে ভাবছে অভিক কি এরকম সবাইকে-ই এডভান্স বেতন দেয় ,নাকি শুধু তাকে-ই দিচ্ছে ।

ওসমান বলল কি হল ধরুন ।

ইশমি থমথমে গলায় বলল এই রুলস টা কি সবার জন্য ?

ওসমান হেঁসে বলল হ্যাঁ এই নিয়ম টা সবার জন্যই ।

ইশমি কিছুক্ষণ উশখুশ করে খামটা হাতে নিল ।তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়াল সিএনজি অথবা রিকশার জন্য ।একটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে ।
অভিক অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ইশমির পাশে দাঁড়িয়ে বলল আমার গাড়িতে উঠে বসুন আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবো ।ইশমি অভিকের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে থাক তার প্রয়োজন নেই ।আমি যেতে পারবো ।
অভিক বলে উঠে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে বাসায় ফিরতে লেট হয়ে যাবে আপনার ।একটু পর সন্ধ্যার আযানও পরে যাবে ।তাই বলছি আমার গাড়িতে উঠে বসুন ।ভয় পাবেন না আপনাকে কিডন্যাপ করে কাজী অফিসে নিয়ে যাবো না বাসাতেই পৌঁছে দিবো ।

অভিকের ঠেসমারা কথায় ইশমি মনে মনে খুব হাঁসল কিন্তু মুখে হাঁসিটা প্রকাশ করল না ।সে হাঁসিটা চেঁপে রেখে মনে মনে বলল আমি চাই না আপনি আর আমাদের পাড়ায় যান ।

অভিক অধৈর্য হয়ে বলল এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন ।দেখুন আপনার জন্য আমারও লেট হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফিরতে ।

ইশমি বলল আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? আপনাকে বলেছি দাঁড়িয়ে থাকতে ?

অভিক বিরবির করে বলল এটা বুঝতে পারলে তো আপনি , বিয়ে হয়ে তিন-চার বাচ্চার বাপও হয়ে যেতাম আমি আজকে ।

ইশমি অভিক কে বিরবির করতে দেখে বলল কি বললেন ?

অভিক নিজেকে সামলে বলল কিছু না ।আমার একটা দায়িত্ব আছে আমার স্টাফদের প্রতি ।সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে উবারে কল করল ।
যে পর্যন্ত উবার না আসল ঐ পর্যন্ত ইশমির পাশেই দাঁড়িয়ে রইল অভিক ।

চলবে,
@Nusrat Hossain