মনের আড়ালে পর্ব-১৪

0
1313

#মনের_আড়ালে
Part_14
লেখনীতে – #Nusrat_Hossain

অভিক শাওয়ার নিয়ে কমোরে টাওয়াল জড়িয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল ।তার চোখের সামনে বারবার ইশমির মলিন চেহারাটা ভেসে উঠছে ।ইশমির কথাগুলো মনে পরলেই ক্ষনে ক্ষনে সুক্ষ্ম ব্যাথা অনুভূতি হচ্ছে ।পরোক্ষনে অভিক ভাবে হবারই কথা ইশমি তার প্রথম অনুভূতি , প্রথম ভালোবাসা চাইলেও সে মেয়েটাকে ভুলতে পারে না #মনের_আড়ালে এখনো সেই পুরোনো অনুভূতিটা রয়ে গেছে ।এখনো ইশমির জন্য তার মনে একটা সফট কর্নার আছে সে এটা অস্বীকার করবেনা কোনোদিন ।কিন্তু ইশমিকে আগ বাড়িয়ে নিজের অনুভূতিটা আর প্রকাশ করবে না সে ।করবেই বা কেন ? যে তাকে এতোটা ঘৃনা করল , বারবার তাকে ফিরিয়ে দিল তার কাছে বারবার কেন সে নিজের আত্মসম্মান টা বিকিয়ে দিবে ? সে করবেনা আর ।দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই অভিক নিজের ভাবনা থেকে ফিরে এল ।টি-শার্ট আর টাউজার টা গায়ে জড়িয়ে দরজাটা খুলে দিল ।দরজা খুলে দেখতে পেল তার বাবা , ছোট বোন আফরিন , চাচাত ভাই মিনহাজ আর তার স্ত্রী মাইশা দাঁড়িয়ে আছে ।প্রত্যেকে তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাঁসছে ।সে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল

কি ব্যাপার এভাবে হাঁসছো কেনো সবাই ?

সবাই ভেতরে ঢুকে বিছানার পাশের সোফাটায় বসে পরল ।

আফরিন ঠোটে দুষ্টু হাঁসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করল
আজকে তোমার দিনটা কেমন কাঁটল ভাইয়া ?

অভিক স্বভাবমতো নিচের ঠোট কামড়ে মুচকি হেঁসে বলল
প্রতিটাদিন যেমন কাঁটে আজকেও তেমন-ই কেঁটেছে ।

আফরিন বলে উঠল ভাইয়া তোমার গাল দেখি ব্লাশ করছে । ওমা দেখো দেখো সবাই ভাইয়ার গালগুলো কেমন ব্লাশ করছে ।আফরিনের সাথে সাথে মাইশা আর মিনহাজও তাল মিলাল ।

অভিক ত্বরিতগতিতে গালে হাত দিয়ে বলে উঠল কই না তো !

তারা সবাই একসাথে ফিঁক করে হেঁসে বলে উঠল আমরা তো দেখতে পাচ্ছি তোমার গাল ব্লাশ করছে ।
সাদাত চৌধুরি ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে মুখ টিপে হাঁসছে ।

অভিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠল তোমরা যাও তো ।আমার অফিসের কাজ করতে হবে ।

আফরিন বলে আগে ট্রিট দিবে বলো তারপর যাবো ।

অভিক বলল কিসের ট্রিট ?

এই যে ইশমি আর তুমি আবার এক হয়ে গেলে আফরিন হেঁসে বলল ।

অভিকের মুখে অন্ধকার নেমে এল সে গম্ভীর কন্ঠে বলল আমরা কোনোদিন এক ছিলাম না আর ও শুধু আমার অফিসের কর্মচারী ব্যস এইটুকুই ।
সবার মুখ থমথমে হয়ে গেল অভিকের কথা শুনে ।তখনি আফিয়া রহমান অভিকের রুমে ঢুকে বলল

কি নিয়ে কথা হচ্ছে সবার ?

আফিয়া রহমানকে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেল ।আফিয়া রহমান এখনো জানে না ইশমি তাদের অফিসে-ই চাকরি করছে ।বাসার প্রত্যেকটা লোক জানে আফিয়া কতটা ঘৃনা করে ইশমিকে ।অভিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল

আমরা এমনিতেই গল্প করছিলাম আম্মু ।
আফিয়া রহমান মুঁচকি হেঁসে বলল গল্প করলেই হবে ? সবাই ডিনার করতে এসো ।সবাই বসা থেকে উঠে ডিনার করতে চলে গেল ।

ডিনার করা শেষে অভিক বিছানায় ঘা এলিয়ে দিল ।সারাদিন অফিসে এত পরিশ্রম করে সে এখন ক্লান্ত ঘুমোতে চায় সে ।কিন্তু ঘুম আসছে না চোখ বুজলেই ইশমির মলিন চেহারা ভেসে উঠছে আর কথাগুলো কানে বাজছে ।সে বিছানা থেকে উঠে বসে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে নিয়ে আবার বিছানায় ঘা এলিয়ে দিল ।তারপর ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে গেল ।

______________________

হোয়াট !তুই যে অফিসে চাকরি পেয়েছিস সেটা অভিকের অফিস ? তিথি চমকে বলল ।

আস্তে বলো আপু কেউ শুনে ফেলেবে তো ইশমি ফিসফিস করে বলল ।

তিথি একটু গলার আওয়াজ নামিয়ে বলল ওর রিয়েকশন কি ছিল তোকে দেখে ?

প্রথমে আমায় দেখে খুব অবাক-ই হয়েছিল সেটা তার চেহারাতেই প্রকাশ পাচ্ছিল ।আমিও তো খুব চমকে গিয়েছিলাম তাকে সেখানে দেখে ।কোনোদিন ভাবতে পারিনি তার সাথে আর আমার দেখা হবে এই জীবনে ইশমি থমথমে গলায় বলল ।

তিথি মুচকি হেঁসে বলল কিন্তু দেখা তো হয়ে গেল ।

ইশমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে খামের ভেতর থেকে টাকাটা বের করল ।সে টাকাটা গুনে অবাক হয়ে তিথিকে বলল

পঞ্চাশ হাজার টাকা ! আপু এত টাকা কি এডভান্স দেওয়া হয় ?আমার বেতন-ই তো পনেরো হাজার টাকা । আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু একটা ঘাপলা আছে ।কালকেই আমি অভিক কে এই টাকাটা ফেরত দিয়ে দেব ইশমি খামে টাকাটা ভরে হ্যান্ডব্যাগে যত্ন করে রেখে দিল ।

তিথি বলল আমারো বিশ্বাস হয় না এত টাকা এডভান্স কোনো অফিস থেকেই দেয়না আমার জানামতে ।এটা অভিকের-ই কাজ ।কালকে অফিসে গিয়ে দিয়ে দিস টাকাটা ।

ইশমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল হুম দিয়ে দিবো ।

___________________

তোর অফিসে বেতন কত ? হাফসা বেগম জিজ্ঞেস করলেন ।

ইশমি কিছু বলার আগেই তিথি টেবিলের নিচ থেকে ইশমির হাত ধরে থামিয়ে বলে উঠল দশ হাজার টাকা ইশমি কালকে রাতে আমাকে বলেছে ।ইশমি তিথির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল ।তিথি ইশমিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে আশ্বস্ত করল ।

হাফসা বেগম তিথির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠল দশ হাজার টাকা মাত্র ।এত কম টাকা কেন ? তুই তোর বসরে আজকেই কবি জানি বেতন টা আরো বাড়ায়া দেয় ।
ইশমি নাস্তা করছিল হাফসা বেগমের কথা শুনে অমনি খাবার তার নাকে মুখে উঠে গেল ।তিথি দ্রুত ইশমির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে পানি খায়িয়ে দিল ।তিথি মনে মনে তার ফুপিকে বকল , বেকুব মহিলা অফিসটা জানি উনার বাপের ।কাশতে কাশতে ইশমির চোখ দিয়ে পানি পরছে ।
হাফসা বেগম বিরবির করে বলতে লাগল
যেই কইলাম বসরে যেন কয় টাকা বাড়ায়া
দিতে অমনি ওর ডং শুরু হয়ে গেল ।
ইশমির আর নাস্তা করতে ইচ্ছে হলো না সে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই হাফসা বেগম পেছন থেকে চিল্লিয়ে বলে উঠল মনে জানি থাকে তোর বসরে আজকেই কবি যেনো বেতন বাড়ায়া দেয় ।কিন্তু দেখা গেল ইশমি হাফসা বেগমের চিৎকার করে বলা কথা শুনেও থামল না ।হুড়হুড় করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ।
ইশমির কোনো পাত্তা না পেয়ে হাফসা বেগম থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আর দাঁত কটমটিয়ে নাক ফুলাতে ফুলাতে বিরবির করে বলল সাহস টা খুব বাড়ছে আজকাল ।তবে
তিথি মনে মনে খুব খুশি হল এই প্রথম সে ইশমিকে হাফসা বেগমের কথার বিরুদ্ধে যেতে দেখল ।

ইশমি অফিসে এসে আবার কালকের মত কাগজ প্রিন্ট করতে লেগে গেল ।কাল অনুযায়ী আজকে কাগজ কমই আসছে ।অভিক এখনো অফিসে আসেনি ।সে আসলেই তার কেবিনে গিয়ে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিবে ।ইশমি তার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে আর নিজের কাজ করছে ।

অভিক গাড়ি থেকে নেমে বইগুলো হাতে নিয়ে অফিসে ঢুকে লিফটে ঢুকে গেল ।আজকে তার লেট হয়ে গেছে সে এটা মানতে পারছে না । অফিসের বস হয়ে তারই যদি অফিসে আসতে লেট হয়ে যায় তাহলে অন্যান্য এমপ্লয়ি তাহলে আর রুলস ফলো করবে না । ফোর্থ ফ্লোরে এসে সর্ব প্রথমেই তার চোখ ইশমির দিকেই আটকে গেল ।না চাইতেও ইশমিকে দেখে তার পা থমকে দাঁড়াল ।ইশমি মন দিয়ে কাগজ প্রিন্ট করে যাচ্ছে ।অন্যান্যা এমপ্লয়িরা অভিক কে গুড মর্নিং জানাল কিন্তু তার চোখ এখনো ইশমিতেই স্থির ।সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কেবিনে চলে গেল ।কেবিনে ডুকেই সে ইশমিকে ডেকে পাঠাল ।ইশমি এতক্ষণ ধরে অভিকের অফিসে আসার অপেক্ষা করছিল টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য কিন্তু তার আগেই অভিক-ই অফিসে এসে তাকে কেবিনে ডেকে পাঠাল ।

ইশমি অভিকের কেবিনের সামনে এসে একটা ঢোক গিলল ।সে জানে না কেন যেন অভিকের সামনে বেশিক্ষণ থাকলেই তার খুব কষ্ট হয় কান্না পায় ।তার ভয় হয় #মনের_আড়ালে থাকা পুরোনো অনুভূতিটা যদি আবার জেগে উঠে ।চাইলেও তো সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও সে একদিন অভিক কে নিজের ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবেই কল্পনা করেছিল ।তাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখেছিল ।কিন্তু ভাগ্য !ইশমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানিটা মুছে নিল আর কেবিনের ডোরে নক করল ।অভিক তাকে ভেতরে ঢুকতে পারমিশন দিলে সে এক পা এক পা করে হেঁটে অভিকের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল ।অভিক তাকে বসতে বললে সে নিঁচু হয়ে বসল ।অভিক টেবিলের নিচ থেকে বইগুলো উঠিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলল

অফিস আওয়ার শেষে বইগুলো নিয়ে যাবেন আর আজকে থেকেই পড়াশোনা শুরু করবেন এক্সামের আর বেশি দেরি নেই ।জানি সবটা এক’দিনে কভার করা সম্ভব না কিন্তু নিজ উদ্যেগে যতটুকু সম্ভব কভার করে নিবেন ।আর আপনার মায়ের চোখ থেকে বইগুলো বাঁচিয়ে রাখবেন যদি আপনার পড়াশোনা করার আগ্রহ থাকে তো ! আমি ভার্সিটির ভিসির সাথে কথা বলেছি আপনার ক্লাস করতে হবে না শুধু এক্সাম টা দিবেন ।আপনার ফ্রেন্ডের নামটা যেনো কি ?অভিক মনে করার চেষ্টা করে বলল হ্যাঁ অনিতা ওর কাছ থেকে সব নোটগুলো সংগ্রহ করবেন ।আপনার পড়াশোনার ক্ষেত্রে যতটুকু সম্ভব আমি হেল্প করবো আপনাকে ।কিন্তু শুধু শুধু আমি হেল্প করলেই তো চলবে না আপনার আগ্রহ থাকাটা প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে হুমম । কি বললাম বুঝতে পেরেছেন তো ?
অভিক খেয়াল করল ইশমি এখনো আগের মতই মাথা নিঁচু করে বসে আছে ।তার কথার কোনো হ্যাঁ বা না জবাব দিল না ।

ইশমি নিঁচু হয়ে নিচের ঠোট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে ।তার খুব কান্না পাচ্ছে ।গলা ভার হয়ে আসছে ।সে তো পড়াশোনা করার আশা ছেড়েই দিয়েছিল কিন্তু অভিকের কারনে আবার সে নতুন করে পড়তে পারবে ।আর এক মুহূর্ত এখানে বসে থাকলে হয়ত সে শব্দ করে কেঁদেই দিবে ।তাই সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে মাথা নাড়িয়ে অভিককে হ্যাঁ বুঝিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল ।

অভিক ইশমির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ।সে ভাবল মেয়েটা কি কাঁদছিল ?

চলবে,
@Nusrat Hossain