#মনের_আড়ালে
Part_24
লেখনীতে – #Nusrat_Hossain
মুহূর্তেই ইশমিদের বাড়িভর্তি মানুষজন দিয়ে ভরে গেছে ।হাফসা বেগমের মায়ের বাড়ি থেকেও আত্বীয়স্বজন এসে গেছে ইতিমধ্যে ।ফ্যানে জুলন্ত আহিবার লাশটি নামানো হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই ।আহিবার চেহারাটা বীভৎস দেখাচ্ছে ।চোখ উল্টে আছে , জিহ্বা বের হয়ে গেছে পুরোটা , শক্ত দঁড়ির ঘষায় ডেবে রক্তাক্ত হয়ে আছে গলাটা ।শেষ মুহূর্তে হয়ত আহিবা বাঁচার প্রানপন চেষ্টা করে গলা থেকে দঁড়ি খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি গলায় আহিবার নখের দাগ স্পষ্ট দেখা গেছে ।আহিবার এই বীভৎস চেহারা দেখার পর কেউ আর দ্বিতীয়বার লাশ দেখতে সাহস পেলনা ।তাই আহিবার লাশটা মুখসহ সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রেখেছে । কাউকে আহিবার চেহারা দেখতে দেওয়া হচ্ছেনা কারন যে কেউ দেখলেই ভয় পাবে । সবার ধারনা আহিবা রাতেই ফাঁসি দিয়েছে সারাটা রাত ঝুলে ছিল ফ্যানে ।কিছু কিছু মহিলারা হাফসা বেগমকে সামলাতে ব্যস্ত ।হাফসা বেগম মেয়ের লাশের সামনে বসে উপরে তাকিয়ে দুই হাত তুলে চিৎকার করে কেঁদে বলছেন আল্লাহ আমার আর কেউ রইল না ।সব নিয়া গেলা তুমি আমার ।তুমি আমার শেষ অস্তিত্বটারেও নিয়া গেলা আল্লাহ আমার আর কেউ নাই । আমি কি নিয়া থাকব আল্লাহ ? আল্লাহ তুমি আমারে নিয়া যাও আমার কলিজার টুকরাটারে ফেরত দাও আল্লাহ দয়া কর বলেই হাফসা বেগম মেয়ের লাশটা ঝাপটে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বললেন এই মা চোখ খোল , মায়ের দিকে তাকা , একটু কথা বল মা ওমা বলতে বলতেই হাফসা বেগমের দাঁতে দাঁত লেগে গেল ।মহিলারা হাফসা বেগমের মাথায় পানি ডালতে ব্যস্ত হয়ে পরল।হলরুমের এককোণায় তিথি ইশমিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ।ইশমি এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ।ফ্যানে জুলন্ত আহিবার লাশ দেখে হয়ত সে সহ্য করতে পারেনি ।যখন জ্ঞান ফিরল একদম পাথরের ন্যয় হয়ে গেছে সে ।
আহিবাকে খুব তাড়তাড়ি করে কবর দেওয়া হল কোনোরকমে জানাজা টা পড়িয়ে ।এমনিতেই আত্মহত্যাকারীদের জানাজা মুসল্লি আর হুজুর রা পড়াতে চায়না ।তাই আশেপাশের লোকজন আর দেরি না করে আহিবার লাশটি কবর দিয়ে দিল ।আহিবার লাশটা বাড়ি থেকে বের করার সময়-ও হাফসা বেগমের আহাজারি কম ছিলনা ।চিৎকার করে কেঁদেছে , নিজকে নিজে আঘাত করেছে তার আদরের মেয়েকে যেনো তারা নিয়ে না যায় তার চোখের আড়াল থেকে ।বাড়ির প্রত্যেকেই কাঁদছে ।হাফসা বেগম জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় সয্যারত অবস্থায় পরে আছে ।তার পাশে তার আপন বড় বোন মালিহা , রানী আর কিছু মহিলা বসে আছে ।অপেক্ষায় আছে হাফসা বেগমের জ্ঞান ফেরার ।
সারাটা দিন কেঁটে গেল ।সন্ধ্যা শেষে রাত নেমে এল ।ইশমিসহ বাড়ির কেউ একটা দানাও মুখে তুলতে পারেনি ।হাফসা বেগমের দুপুরের দিকে জ্ঞান ফিরলেও তিনি মেয়ের রুমে বসে এখোনো বিলাপ করে কান্নাকাটি করছে ।বাড়ির আশেপাশের মহিলারা দুপুর পর্যন্ত-ই থেকে চলে গেছে আর আসেনি তারা ।বাড়িতে আপাতত বাইরের লোক বলতে শুধু হাফসা বেগমের বড় বোন মালিহা আর তার ত্রিশ বছরের ছেলে আদনান আছে ।
রাত বাজে বারোটা ইশমি নিজের রুমে ফ্লোরে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে থম মেরে বসে আছে ।তার পাশে তিথিও বসে আছে মনমরা হয়ে ।আয়নাল হোসেন মারা গেছে বেশিদিন হয়নি তারমধ্য আবার আহিবা আত্মহত্যা করে মারা গেল ।বাড়িটা কেমন মৃত্যুপুরি হয়ে গেছে ।ইশমির মাথায় শুধু একটা জিনিস-ই ঘুরপাক খাচ্ছে কালকে রাতে যদি সে আহিবার মাথায় কি চলছে তা বুজতে পারত তাহলে ধরে বেধে হলেও বোনকে নিজের সাথে রেখে দিত আজকে বোনের লাশটা দেখতে হত না তাকে ।
হাফসা বেগম এলোমেলো পায়ে ইশমির রুমে ঢুকল আর ভাঙা গলায় বলে উঠল
ইশমি আমার সাথে একটু ঘুমাবি মা আমার খুব ভয় করছে , আমার অস্থির লাগছে।তোরা আমার সাথে একটু ঘুমা ।
ইশমি হাফসা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন ।তারপর সে আর তিথি হাফসা বেগমকে ধরে রুমে নিয়ে গেল ।
হাফসা বেগম ইশমিকে বুকে ঝাপটে ধরে শুয়ে আছে ।ইশমির খুব কান্না পেল হঠাৎ।হাফসা বেগম ক্লান্ত বিধায় চোখ লেগে গেল উনার ।হাফসা বেগমের চোখ লেগে গেলে ইশমি আলগোছে হাফসা বেগমের বুক থেকে সরে এসে শব্দহীন পায়ে বারান্দায় গেল ।একমনে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে ।তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে ।বাকি রাতটা সে দুচোখের পাতা এক করতে পারলনা ।রুমে এসে অযু করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করল আবার কিছুক্ষণ যিকির করল ।এভাবেই রাতটা পার হয়ে গেল ।ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে সে ফজরের নামাজটা আদায় করতে বসল ।ফজরের ওয়াক্তে হাফসা বেগম জেগে উঠল তিনি বিছানা থেকে নেমে অযু করে ইশমির পাশে বসে পরলেন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য ।
ইশমি নামাজ শেষে একটু চমকে গেল হাফসা বেগমকে নামাজ পড়তে দেখে ।সে কোনো দিন হাফসা বেগম কে নামাজ পড়তে দেখেনি এই প্রথম সে হাফসা বেগমকে নামাজ পড়তে দেখল ।কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে মানুষটা কতটা পাল্টে গেল ।সব-ই আল্লাহর লীলাখেলা ইশমি ভাবে ।
দেখতে দেখতে পঁচিশটাদিন পার হয়ে গেল ।এখন হাফসা বেগমের প্রতিটাদিন কাঁটে নামাজ , রোজা আর জিকির করে ।আহিবা মারা যাবার সাতদিন পর থেকে ইশমি আবার অফিসে যাওয়া শুরু করেছে ।এদিকে আফিয়া রহমানের রেফারেন্সেই রিশা চাকরি করছে নিজের মনমত । যেন সব স্টাফের কাছে সে-ই এই অফিসের বস কিন্তু অভিকের সামনে একেবারে ভেজা বিড়াল ।রিশার চাকরি করা নিয়ে অভিক চাইলেও কিছু করতে পারেনি ।এই নিয়ে বাড়িতে রোজ রোজ মায়ের সাথ কথা কাটাকাটি করতেও সে ইচ্ছুক না ।তাই রিশা মেয়েটাকে অফিসে দাঁতে দাঁত চেঁপে সহ্য করছে ।আর কয়েকটাদিন যাক তারপর রিশার ডানা সে টেনে ছিড়বে ।এখন সে খুব ব্যস্ত থাকে মিটিং নিয়ে , অফিসের কাজ নিয়ে একটুও দম ফেলবার সুযোগ নেই তার ।একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে তাকে ।ব্যস্ত থাকার কারনে ইশমির সাথেও সে ঠিকমতো কথা বলতে পারেনা ।ঠিকমত মেয়েটার খোঁজও নিতে পারেনা ।মেয়েটা খুব ভেঙে পরেছে বোনের মৃত্যুতে ।তবে আর বেশিদিন না অফিসের ব্যস্ততা কমে গেলে সে ইশমিকে একেবারে নিজের করে নিবে ।
এইকয়দিনে ইশমি অভিকের সাথে বেশিএকটা দেখা করতে পারেনি ।শুধুমাত্র অফিসের কাজেই যা একটু দেখা হয় তাদের তাও যখনি সে একটু অভিকের পাশাপাশি থাকে তখনি রিশা তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় ।রিশা অফিসের প্রত্যেক স্টাফের কাছে তার নামে কটুক্তি করে বেড়ায় আর সুযোগ পেলেই তাকে বিভিন্নভাবে হেয় করার চেষ্টা করে ।কয়েকদিন আগেই তো লাঞ্চের সময় সবার সামনে তার মাথার উপর তরকারি ডেলে দিয়েছে আবার খুব সহজেই ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়েছে ।ফলে অভিকের কানে এসব কিছুই পৌঁছায়নি ।অভিক খুব ব্যস্ত থাকে ইশমি জানে ।একটার পর একটা মিটিং , আবার অফিসের এত কাজ সারাটাদিন এমনিতেই ক্লান্ত থাকে সে তাই ইশমিও আর জানায়না কিছু অভিক কে।
ইশমি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরল অফিস থেকে ।সন্ধ্যার আজান পরেছে কিছুক্ষণ আগেই ।সে ব্যগটা রেখে অযু করে নামাজটা আদায় করে নিল ।
নামাজ আদায় করে সে হাফসা বেগমের রুমে গেল ।মূলত হাফসা বেগম-ই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে তাকে কি যেন বলবে নাকি !
ইশমি রুমে গেলে হাফসা বেগম তাকে উনার পাশে বসতে বললেন ইশমি উনার পাশে গিয়ে বসল ।হাফসা বেগম স্থিরচোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ।ইশমি ছাড়া এখন আর উনার কোনো অস্তিত্ব নেই ।মেয়েটাকে উনি এখন চোখে হারায় ।একটা মাত্র অস্তিত্ব-ই উনার এখন বেঁচে আছে ।একে কোনোদিন-ও হারাতে পারবে না হাফসা বেগম ।তিনি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললেন
তোর অফিস কেমন চলছে ?
ইশমি নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল
ভালো-ই চলছে মা।
যা গিয়ে কিছু খেয়ে নে ।হাফসা বেগম মেয়েকে যা বলতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা তিনি আর বললেন না ।
ইশমি মাথা ঝুলিয়ে মাকে হ্যাঁ বুঝিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
————————
— আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি ।দরকার হলে আমি নিজে তোমার বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চাইব । আমার মেয়েটা তোমাকে সত্যি-ই ভালোবাসে বাবা ।ঐদিন আমি ইশমির নামে মিথ্যে বলেছিলাম । ইশমি তোমাকে নিজে থেকে রিজেক্ট করেনি বরং আমি চাইনি ওর বিয়ে হোক।আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও বাবা হাফসা বেগম চোখের পানি ফেলে বলল ।
—- অভিক হাফসা বেগমের মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল সব বুঝলাম এখন কি চান আপনি আমার কাছে ?
—- হাফসা বেগম অকপটে বললেন মেয়ের সুখ চাই ।আমি চাইনা মেয়েটা সারাটাজীবন কষ্ট পেয়ে যাক ।আমি চাই ও বাকিটা জীবন তোমার সাথে কাটাক সুখে শান্তিতে ।
—– তাহলে তো আপনাকে নিজে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার আম্মু আর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে আর তাদের কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে । তাতে যদি আপনার প্রতি তাদের আক্রোশ মিটে ।
হাফসা বেগম তড়িৎগতিতে বলে উঠল আমি সব করতে রাজি আছি মেয়ের জন্য ।আমি মাফও চাইব তাদের কাছে , আর তোমার আর ইশমির বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে যাবো ।কালকেই আমি তোমাদের বাড়িতে আসছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
অভিক ভাবেনি কোনোদিন হাফসা বেগম নিজে তার কাছে আসবে । মনে মনে সে খুব খুশি হল তাকে আর আগবাড়িয়ে কিছু করতে হল না ।এখন দেখা যাক হাফসা বেগম তার আম্মুর রাগ টা পানি করতে পারে কিনা ?
ইশমি অভিকের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে ।সে জানেনা তার মা কেন হঠাৎ অফিসে আসতে গেল ?আর তার মা-ই বা জানল কিভাবে সে অভিকের অফিসে চাকরি করে ?কি এত কথা বলছে অভিকের সাথে তার মা ? উফফ সে না শোনা পর্যন্ত শান্তি পাবে না ।হাফসা বেগম অভিকের সাথে কথা শেষ করে কেবিন থেকে বের হয়ে ইশমির মুখোমুখি হল কিন্তু তিনি এখন ইশমিকে কিছু বলতে চান না ।তিনি ভাবলেন মেয়েকে কালকে একেবারে চমকে দিবেন ।ইশমি ব্যর্থ হল মাকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারল না ।হাফসা বেগম চলে গেলে ইশমি অভিকের কেবিনে চলে গেল কিন্তু এখানেও তাকে ব্যর্থ হতে হল অভিক নেই কেবিনে । মিটিং করতে চলে গেছে সে ।ইশমি থমথমে মুখ নিয়ে কেবিন থেকে বের হতে নিলেই তার চোখ পরল টেবিলের উপর ।একটা চিরকুট রাখা আছে টেবিলের উপর ।ইশমি গড়িমসি করে চিরকুট টা হাতে নিল ।সে বিরবির করে পড়তে লাগল চিরকুটটা ” বি রেডি ফর দা সারপ্রাইজ ডিয়ার ”
চলবে,
@Nusrat Hossain