মনোভূমির ছায়া পর্ব-১০+১১+১২

0
65

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১০
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

আকাশের মুখ ভার করে কালো মেঘগুলো জমে আছে।
প্রবল বাতাস চিরুনির মতো গাছের ডালপালা গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। স্কুল ছুটি দেওয়া মাত্র স্রোতের ন্যায় সকলে স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পথ ধরছে৷
‘অমিত তোর সব সাবজেক্টের প্র্যাকটিক্যাল খাতা আজই আমাকে দিবি।’ স্কুল বিল্ডিং থেকে বের হতে হতে বলল নিনা।

‘আমার প্র্যাক্টিক্যাল খাতা দিয়ে কী করবি?’

‘স্মুদি বানিয়ে খাব।’

‘কী!?’

‘আজব তো। অফ কোর্স প্র্যাক্টিক্যাল করব বলেই তো চাচ্ছি।’

‘ওহ তো এত মানুষ থাকতে আমার খাতা?’

‘এত মানুষের মধ্যে আর কে কে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড?’

‘কিন্তু নিনা আমার লেখা মাঝেমাঝে আমি নিজেই বুঝি না আর…

‘আর কী অমিত আমি জানি তোর লেখা কেমন। কত বার বলেছি লেখার প্র্যাক্টিস কর তাহলে তো ভালো হবে!’ অমিতকে থামিয়ে দিয়ে বলল নিনা।
‘কী হয়েছে? তোমরা ঝগড়া করছ নাকি?’ ওদের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল এমিলি।

‘আরে না না আমরা ঝগড়া করছি না।’ বলল অমিত।

‘তো কিছু সমস্যা?’

‘তেমন কিছু না৷ ওর প্র্যাক্টিক্যাল খাতাগুলো চাচ্ছিলাম দিচ্ছে না।’ এবার নিনা উত্তর দিল।
ওরা বড় এক ম্যাপল গাছের ঝাঁকড়া ডালপালার নিচে দাঁড়িয়ে। ভারি বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। চুল উড়ে এসে মুখের ওপর পরছে বারবার।

‘ওহ তাই নাকি! তাহলে আমাকে বললেই তো হতো। আমিই তো দিতে পারবো।’

‘তুমি তো আমাদের বর্ষে না।’ বলল অমিত।

‘অমিত তুমি নিশ্চয়ই টনিকে চিনতে? ওর নোট, প্র্যাক্টিকেল খাতা সবই তো পরে আছে। ওগুলো তুমি সব নিয়ে যেত পারো।’ নিনার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘কিন্তু সেগুলো তোমার লাগবে না?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘আমি তো কমার্সে। আমার কাছে ওগুলো অকেজো।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘তাহলে আজই এসে নিয়ে যাও।’

‘আজই? কখন?’

‘তোমার যখন ইচ্ছা।’

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার নাম্বারটা দাও। ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।’
নিনা বলতেই যাচ্ছিল ঠিকানার দরকার হবে না তবে সময় মতো চুপ করে গিয়ে শুধু মাথা নাড়ল। ওদের কাজ শেষে
এমিলি এগিয়ে গেল। অমিত ও নিনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সকলে। অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে ক্যাম্পাস। অমিতকে বিদায় দিয়ে নিনা বেরিয়ে গেল। আজ ও গাড়ি আনেনি। সাইকেলও আনেনি। কি ভেবে যেন হাঁটতে হাঁটতেই চলে এসেছে। তারওপর আকাশও মুখ ভার করে আছে। বৃষ্টি টারও আজই আসা লাগতো! সাইডওয়াক ধরে হাঁটছিল তখনই তীব্র হর্নের শব্দে চমকে উঠল। ওর পাশ থেকেই বাজল হর্নটা। থেমে গেল ও। একটা কালো রঙের শিভ্রেলেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নিনা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কালো উইন্ডো গ্লাস খুলতেই দেখা গেল ড্রাইভিং সিটে ইভান বসে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল,
‘বাসায় যাচ্ছ?’

‘না তোমার বাসায় যাচ্ছি।’ বিরক্ত কন্ঠে বলল। সাথে সাথে মাথায় ভাবনারা নড়েচড়ে উঠল,
‘নাহ ও আমাকে এখনো মাফ করেনি। আমার এমন কাটকাট কথাবার্তা ওর সামনে মানায় না। তাছাড়া আমার তো আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে।’ ভেবে একটু নরম কন্ঠে বলল,
‘কিছু বলতে চাও?’

‘অনেক কিছু। আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।’

‘না থাক। আমি একাই যেতে পারি।’ বলে নিনা হাঁটতে আরম্ভ করলো।

‘সেটা তো আমিও জানি।’ বলে ধীরে ধীরে ইভানও গাড়ি এগিয়ে নিতে শুরু করল। জানালা দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
‘তুমি না গতকাল মাফ চেয়ে গেলা? আমি কী ওটা একসেপ্ট করেছিলাম? করিনি তো। তুমি যদি চাও আমি তোমার এ্যাপোলজি একসেপ্ট করি তাহলে গাড়িতে এসে বস।’ নিনা থেমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বলল, ‘আজব তো তুমি। এটা কী ধরনের কথা?’

‘আমি কী জানি। আমার যা বলার বলে ফেলেছি।’ নির্বিকার চিত্তে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নিনা সোজা হয়ে দাঁড়াল। বিকট শব্দে মেঘ গর্জে উঠল।
নিনা বিভ্রান্তি ভরা দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান ভেতর থেকে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। নিনা ইতস্তত করল এক মুহূর্ত। অবশেষে ফ্রন্ট সিটে উঠে বসে দরজা বন্ধ করল। ইভান গাড়ি সামনে এগিয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি বড় অদ্ভুত। গতকাল এতটা সময় আমার সামনে বসেই থাকলে অথচ আমার উত্তর না নিয়েই গায়েব হয়ে গেলে?’

‘কী? তোমার তো উত্তর দেয়ারও কোন লক্ষণ দেখছিলাম না। আর চলে যাওয়ার পূর্বে তো তোমাকে বলেছিলাম। তারও কোন উত্তর দাওনি।’ অন্য দিকে তাকিয়ে বলল নিনা।

‘কখন বললা? আমি তো শুনিনি।’

‘এখন তুমি যদি অন্য কোন ধ্যানে থাক তাহলে আমার কী করার।’

‘তো তোমার প্র্যাক্টিক্যাল খাতা আর নেওয়া হলো না।’

‘না, নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’

‘কার কাছ থেকে? অমিত?’

‘না টনি…বলতেই ইভান মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিয়ে হতবাক কন্ঠে বলল, ‘কী?!’

‘বলতে চাইছি এমিলির কাছ থেকে টনির প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো সব নিয়ে আসবো।’

‘বাহ না থেকেও এখনো সবকিছুর মধ্যেই থাকে।’ কথাটা বলার সময় কন্ঠে সুক্ষ্ণ তিক্ততা মিশে ছিল।

‘কেন কী সমস্যা ওকে নিয়ে?’ ততক্ষণাৎ শুধালো নিনা।

‘কী আবার? স্বাভাবিকভাবেই বললাম এখনো সবকিছুতে ওকে নিয়েই চর্চা চলছে।’

‘একটা ছাত্র মাত্র গুটিকয়েক দিন পূর্বে খু*ন হয়েছে। তাকে নিয়ে চর্চা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।’

‘খু*ন? তুমি এত শিওর কিভাবে ওটা খু*ন ছিলো?’

‘আমার মনে হয় কাহিনী টা শুনলে যে কেউ এটাকে খু*ন বলেই বিবেচনা করবে।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল, ‘তোমার কেন মনে হয় এটা খু*ন ছিলো না? তাহলে কী ছিল?’
ইভানের কপালে গভীর ভাজ। এক হাত স্টিয়ারিংয়ে। অপর হাতের আঙ্গুল অনবরত টোকা দিচ্ছে পায়ে। নিনা সেদিকে লক্ষ্য করে শান্ত কন্ঠে বলল, কী হলো এটা কী এত ভাবার বিষয়?’

‘না ওটা নিয়ে ভাবছি না। যে চলে গিয়েছে সে চলে গিয়েছে। এখন কেউ খু*ন করে থাকলেও বা কী আর না করলেও বা কী? যদি করেও থাকে তাদের বের করা গেলেও তো টনি ফিরে আসবে না।’
নিনা তাচ্ছিল্যের সমেত হাসল। বলল, ‘বাহ রে আমাদের মাঝে একজন খু*নি অবাধে ঘুরে বেড়াবে সেটা যেন মেনে নেওয়া যায়?’

‘খু*নিকে খুঁজে বের করা তোমারও দায়িত্ব নয় আমারও দায়িত্ব নয়। এটা পুলিশের কাজ। তোমার তো মনে হয় এসব বিষয়ে কিউরিওসিটি একটু বেশিই। একটা কথা আছে না কিউরিওসিটি কি*লস দ্যা ক্যাট।’

‘তাহলে মানছ যে ও আসলে খু*ন হয়েছে।’ বলে থামল। ইভান কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ নিরবে কেটে গেল। নিনাই পুনরায় কথা শুরু করল,
‘তুমি টনিকে দেখতে পারো না?’

‘আমি কখন বললাম দেখতে পারি না?’ অবাক হয়ে বলল ইভান।

‘তোমার কথাবার্তায় তো তাই মনে হয়। নাহলে ওর কথা উঠতেই ক্ষে*পে যেতে না।’

‘আমি ক্ষে*পে যাইনি। শুধু সব জায়গায় একই কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি।’ কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলল।
কিছুক্ষণ দুজনেই আবার মৌনতা পালন করল। গাড়ি স্বাভাবিক বেগে এগিয়ে চলেছে। তবে প্রায়ই থেমে দাঁড়িয়ে থাকছে জামের মাঝে। এখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। গাড়ির জানালা বৃষ্টির ঝাঁপটায় ঝাঁপসা হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর নিনা নিরবতা ভাঙ্গল,
‘থাম থাম। আমি এখানেই নেমে যাবো।’
এখানেই কেন? একই নেইবারহুড তো। বাসার সামনেই নামিয়ে দিচ্ছি।’

‘না না আর কয়েক মিনিটের রাস্তা। আমার একটু কাজ আছে। তারপর আমি চলে যেতে পারবো।’

‘মানে কী? এতদূর যখন চলেই এসেছি শুধু বাসার সামনে যাওয়া নিয়ে ঢং করছ কেনো?’

‘আমি ঢং করছি না। আজব! আমি ড্রাগ স্টোরে যাব। আমার কাজ আছে।’

‘তো? আমি অপেক্ষা করছি। তুমি তোমার কাজ শেষ করো তারপর বাসার সামনে নামিয়ে দিব।’
নিনা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইভানের দিকে সোজা ভাবে তাকাল। বলল,
‘ডু ইউ রিয়েলাইজ ‘তুমি’ এখন আমার সাথে সুপার গ্লুয়ের মতো চিপকে আছ?’

‘ধরে নাও ঋণ শোধ করছি।’

নিনা চোখ সরু করল,
‘সিরিয়াসলি ইভান আমি জীবনেও তোমার সাথে সুপার গ্লুয়ের মতো আঁটকে ছিলাম না।’

‘শিওর। বাট তোমার বাড়ি কোনটা সেটা বলো তো?’
নাটকীয়ভাবে বলল ইভান।
নিনা হাসল, ‘কী কথা বাবা! আমার বাসা কোনটা জেনেই বা কি করবা? প্রতিদিন আমাকে দেওয়া নেওয়া করবা?’
এবার ইভান হাসলো। বলল, ‘ইন্টারেস্টিং কোয়শ্চন!’
অবশেষে নিনার কথা মতো একটা ড্রাগ স্টোরের সামনে গাড়ি থামাল। বলল,
‘বৃষ্টি হচ্ছে তো। গাড়িতে ছাতা আছে। ওটা নিয়ে যাও।’

‘আচ্ছা।’ ইভান ড্রপবক্স থেকে ছাতাটা বের করে দিল। ওটা নিয়ে নেমে গেল নিনা। ইভান জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মুখে মিটিমিটি হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘এখনো আশা করবা আর যেন দেখা না হয়?’
নিনা অন্তর্ভেদী নয়নে তাকাল। উত্তরে শুধু মুচকি হাসল। আর কিছুই বলল না। সোজা হয়ে দাঁড়াল। ইভান গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। নিনা ড্রাগ স্টোরে ঢুকে একজোড়া গ্লাভস কিনে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে বাড়ির। হঠাৎ চোখে পরল একটা বাড়ির গেট থেকে এ্যাভরিল বেরোচ্ছে। হাতে ছাতা ধরা। নিনা ওকে দেখে থেমে গেল। ওর স্ট্রেইট চুলগুলো কাঁধে ওপর পরে আছে। গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের শার্ট আর জিনস। নিনাকে দেখে এ্যাভরিল নিজেই এগিয়ে এলো। তবে নিনাই আগে আগে বলল, ‘হেই! তুমি এখানে থাক?’

‘না। বাট সামনে থাকতেও পারি।

‘মানে? সিফট করছো?’

‘অনেকটা তাই। তুমি মনে হয় এদিকেই থাকো?’

‘হ্যা এইতো সামনেই আমার বাড়ি। হঠাৎ এদিকে মুভ করছো কেন?’
এ্যাভরিল উত্তর দিতে ইতস্তত করল। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
‘শুধু আমি মুভ করছি। এদিকে রেন্টটা একটু কম পরে দেখছি। তাই।’

‘শুধু তুমি? কোন সমস্যা হয়েছে?’ ভ্রু কুঁচকালো নিনা।

‘না না তেমন কোন সমস্যা নয়। আমি বেশির ভাগ একাই থাকি। আর এখন রেন্ট তো কম হলেই হয় না একটা ভালো ফ্যামিলিও প্রয়োজন।’

‘অবশ্যই যে বাড়িতে থাকবা তার সদস্যদের ওপর নির্ভর করছে তোমার নিরাপত্তা।’
এ্যাভরিল সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল। ওকে চিন্তিত দেখাল। কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে নিনা ভেবেচিন্তে বলল, ‘এ্যাভরিল তোমার কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাতে পার। আমি আর বাবা মাত্র দুজন মানুষ বাড়িতে একা থাকি। কাজেই বুঝতেই পারছ আরেকটা মানুষের জন্য অনেক জায়গা আছে। ভেবে দেখতে পার।’
এ্যাভরিলের ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠল। নিনার বাহুতে আলতো করে হাত রেখে বলল, ‘ধন্যবাদ নিনা। কিন্তু আমার মনে হয় না তার দরকার হবে।’
নিনা আলতো ভাবে মাথা নাড়ল।

————————

নিনা কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা চারটা ছুঁই ছুঁই করছে। ঘন্টাখানেক আগে সে কী বর্জ্রপাতটাই না হলো। তবে সে তুলনায় তেমন বৃষ্টি হয়নি। হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়েছে কিছুক্ষণ। এখন পরিবেশ ঠান্ডা। চারিদিকের শান্ত প্রকৃতিকে আরোও বেশি সৌন্দর্য মণ্ডিত করতে কোথায় যেন কার্ডিনাল সুর তুলে গান ধরেছে। হালকা সোনালি রোদ এসে পরছে কাঠের পোর্চের ওপর। কিছুক্ষণের মাঝে দরজা খুলে গেল। এমিলি হাসি মুখে ওকে ভেতরে আসতে দিল। ঘরের সাধারণ পোশাকে আছে ও তবুও ওকে অত্যন্ত মার্জিত লাগছে। সোনালি চুলগুলো যেনতেন ভাবে খোঁপা করা। এমিলি দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি নোটগুলো সব গুছিয়ে রেখেছি। ভাইয়ার কামরায় আছে। আসো।’ বলে সামনের করিডর পার হয়ে ড্রইংরুম পার হয়ে আরেকটা করিডোরের শেষ মাথায় থাকা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করল। সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে বর্ণিল ফ্রিজ ম্যাগনেটে ভরা স্টিলের একটা ফ্রেম ঝোলানো। কম করে হলেও শ’খানেক ম্যাগনেট লাগানো তাতে। নিনা ওর পেছন পেছন আসছে। এমিলি আমুদে কন্ঠে বলল, ‘আর হ্যা দেখ খাতাগুলো নিয়েই কেটে পরলে কিন্তু চলবে না। আমার অনেক একা একা লাগে। তুমি কিছুক্ষণ থাকলে ভালো লাগবে।’

নিনা মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আঙ্কেল আন্টি আবারও দেশের বাইরে?’

‘হ্যা কিন্তু তুমি এটা কিভাবে জানো?’

‘ওই যে শুনেছিলাম যে ওনারা দেশে নেই।’

‘না আমি সেটা বলিনি। বললে না যে ‘আবারও গিয়েছেন’? তার মানে সবসময়ই যান সেটা জানো নিশ্চয়ই।’
এমিলি পেছনে না তাকিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। একটা কামরার সামনে এসে থামল। নিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে ওকে। বলল, ‘হ্যা জানি। অমিত সেদিন কথায় কথায় বলেছিল।’
‘ওহ’ ছোট করে বলল এমিলি। নিনাও কামরার ভেতরে ঢুকে দাঁড়াল। জানালা দুটো চাপানো। পর্দা সরানো। সোনালী রোদ তীর্যক ভাবে ভেতরে এসে পরছে। নরম সব রঙের মিশ্রণে সাজানো সবকিছু। চওড়া অর্ধ দেয়াল জুড়ে থাকা বুক পর্যন্ত লম্বা সেলফের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটলো নিনার। এমিলি সেটা লক্ষ্য করে বলল, ‘বই পছন্দ তোমার তাই না?’
‘খুব!’
একটা টেবিলের ওপর গল্পের বই নয় বরং অনেক গুলো খাতা এবং পাঠ্যবই কারি করে রাখা। সেটা পড়ার টেবিল ছিল বোধহয়। এমিলি বেশ কয়েকটা হার্ড কভারের প্র্যাক্টিকেল খাতা হাতে তুলে নিলো। সেগুলো নিয়ে এসে বিছানার ওপর রেখে বলল, ‘এগুলোই। দেখে নিও কিন্তু।’ এমিলির কথাগুলো নিনার কর্ণগোচর হলো কিনা বোঝা গেল না। বুক সেলফের একটা থাকে মাঝারি আকারের একটা নুড়ি পাথর রাখা। পাথরটায় অতি যত্নের সঙ্গে এক গুচ্ছ ল্যাভেন্ডার ফুল আকাঁ। নিনা সেটার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল,

‘নিনা কী হলো? তুমি সত্যি সত্যিই বোটিং করবা না?’ ক্লান্ত স্বরে বলল টনি। বেশ হাপিয়ে গিয়েছে। মাত্র বোটিং করে এসেছে। নিনা নদীর ধারে নরম ঘাসের ওপর বসে ছিল। ছোট একটা রঙের বাক্স খুলে ফেলে রেখেছে। আশেপাশে পরে থাকা নুড়ি পাথরগুলোর একটি হাতে নিয়ে কিছু একটা আঁকছিল। বলল, ‘না আমার ইচ্ছে নেই।’
‘ইশ তাহলে আমরা এখানে আসলাম কেন? দেখো না এত সুন্দর আবহাওয়া এবং দুপাশের বনের মাঝখান দিয়ে নৌকা বাইতে যা মজা লাগে না! তুমি মিস করছো কিন্তু।’

‘প্লিজ টনি জোর করো না। আমার সত্যিই একটুও ইচ্ছে নেই নৌকায় উঠার। ইচ্ছা থাকলে কী এখানে এসেও এমনি বসে থাকতাম?’
টনি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সেও ঘাসের ওপর বসে পরেছে। বলল, ‘তুমি রংগুলো কী গেটের কাছ থেকে কিনে এনেছো?’
‘হ্যা।’

‘কী আঁকছ?’ জিজ্ঞেস করতেই নিনা ওর হাত চালানো থামিয়ে পাথরটা টনির দিকে বাড়িয়ে দিলো। টনি সেটা সাবধানে হাতে নিলো। সবুজ এবং ল্যাভেন্ডার রঙের মিশ্রণে সদ্য আঁকা ফুলগুলো জীবন্ত ঠেকলো। টনি মুচকি হেসে বলল, ‘আমাকে দিয়ে দিলে?’

‘হ্যা।’ বলে মুচকি হাসল।

নিনা যেন মুর্তির ন্যায় জমে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ভাবনায় বুদ হয়ে। ‘নিনা হঠাৎ কী হলো?’ এমিলির কথায় চমকে উঠল। সুন্দর ভাবনার দৃশ্যগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। নিনা পানসে কন্ঠে বলল, ‘কিছু না।’
এমিলিবলল, ‘আহা ওটা টনির অনেক প্রিয় ছিলো। ওর জিনিস কেউ ধরুক সেটা পছন্দ করতো না ও।’
এবার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘যাই হোক দেখ তো এতক্ষণ ধরে তুমি আছো অথচ কিছুই অফারও করলাম না। থামো আমাদের জন্য কফি আনছি। চলবে তো? আর কিছু অবশ্য করতেও পারি না।’

‘ঠিক আছে চলবে। এমনিতেও কে করে এইসব? দরকার ছিলো না।’

‘জানি আসলে কেউ এমন করে না। লিজাও আমার এমন স্বভাব পছন্দ করে না। তবে আমার ভালো লাগলে আমি কী করব?’ পানসে কন্ঠে বলল এমিলি। বলে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। নিনা ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বুঝতে পারলো না ও কী করবে? তবে সারা কামরায় একবার চোখ বুলিয়ে ওর কাজ বুঝে নিলো। দরজার বাইরে একবার উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো এমিলি আশেপাশে নেই। হঠাৎ করেই বিছানার ওপরের দেয়ালে টানানো ফ্রেমটার দিকে চোখ পরল।
ড্যান্ডালাইন গানের দুটো লাইন লেখা। নিনা ভ্রুকুটি করল। ভাবল, ‘কী আজব তো এসব কী কোন তাৎকালিয় বিষয় হতে পারে? তাই বলে এতগুলো? এই গানের কথা টনি বলেছিল সেদিন,

‘শুনেছো?’
‘কী?’ বলল নিনা।
কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কাস্টোমারের দিকে ইশারা করল টনি৷ তার নিকট হতেই মৃদু শব্দে গান ভেসে আসছে। নিনা বলল,
‘হ্যা। ড্যান্ডালিওন।’
টনি লাজুক হাসলো। নিনা ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,
‘কী ব্যাপার? এই গানের সাথে কোন ঘটনা আছে?’
বলে একটা ঝুড়ি আম বের করল। টনি মুখে লাজুক হাসি ঝুলিয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম বোধহয় একটা জায়গার কথা। ন্যাশভিল ডাউনটাউন থেকে কিছুটা দূরে যে একটা ড্যান্ডালাইনের মাঠ আছে। ওখানকার ঘটনা।’
নিনা মুচকি হাসল। বলল,
‘ওহ তাই নাকি?! তো কে সেই ভাগ্যবতী?’

‘ড্যান্ডালাইন।’

‘কী টনি? মেয়েটার নাম তো বলো?’

‘উম পরে একদিন জানাবো।’

‘না, তুমি কথা অসমাপ্ত রাখতে পারো না।’

‘জানাবো তো পরে একদিন সবকিছু খুলে বলবো। এমনিতেও এই কাহিনী বলার সময় অনেক এক্সপ্লেইন করতে হবে। বাট দেখ এখন কাস্টোমার আসছে অনবরত। এখন কী এসব বলা সম্ভব?’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।পুনরায় বাস্তবতায় ফিরে এলো। এরপর মাস পেরিয়ে গিয়েছিল কিন্তু কখনোই পুরো ঘটনাটা শোনার সুযোগ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বিগত তিন মাসে ওদের দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হতো না বললেই চলে। হঠাৎ করেই টনির প্রফুল্লতা, হাসিখুশি ভাবটা কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল কে জানে? মাস চারেক যাবৎ কিছুটা চুপচাপ থাকতো। অন্তত নিনার তাই মনে হয়েছে। নিনা হেঁটে গিয়ে টনির পড়ার টেবিলের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। কিছু কিছু জিনিস হাতে নিয়ে ঘেটেও দেখছে। তবে তেমন সন্দেহজনক কিছুই পেল না। মাত্র কয়েক মিনিট পার হলো বোধহয়। জানালার নিচে দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া গদি বসানো আপহোলস্টেরড বেঞ্চের ওপর একটা সাদা ঝুড়ি রাখা। ঝুড়ির মধ্যে বেশ কয়েকটা পুরনো দেখতে চিঠির খাম এবং দুটো ডায়েরি রাখা। খুব সম্ভবত সাজানোর উদ্দেশ্যেই জিনিসগুলো এভাবে রাখা। কালো ডায়েরির ওপর রাখা একটি মেরুন ডায়েরি। নিনা মেরুন ডায়েরিটা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলো। তেমন কিছুই নেই। বেশির ভাগ পাতাই ফাঁকা। তবে এখানে কিছু কিছু দিনের সুন্দর স্মৃতি গুলো একেকটা নাম দিয়ে সংক্ষেপে লেখা আছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকজনের নাম লিখে তাদের সম্পর্কে নিজের ভাবনাটা লিখে রাখা। নিজের নামটাও দেখেল নিনা। সেটা পড়তে ইচ্ছে হলেও এখন সময় নেই। কাজেই সেটা পার করে ইভানের নাম খুঁজতে লাগলো। অবশেষে ওর নামটা পেতেই সেই পাতাটির ছবি তুলে নিল। এবার ডায়েরিটা আবারও আগের জায়গায় রেখে দিয়ে কালো ডায়েরিটা তুলে নিলো। এটার প্রতিটা পাতা ভরে তারিখ সহ অতি যত্নের সঙ্গে সব লিখে রাখা। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তারিখের স্থান যখন সেপ্টেম্বর আসলো তখন নিনা থমকে গেল। দশ সেপ্টেম্বরের পর আর কোন লেখা নেই। লেখা নেই বলতে লেখা ঠিকই হয়েছিল তবে সেই চার পাঁচটে পাতা নেই। কেউ ছিঁ*ড়ে নিয়ে গিয়েছে। এরপরের বাকি পাতাগুলো খালি।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১১
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

কাঠের সিঁড়িতে পদশব্দের আওয়াজ পাওয়া যেতেই নিনা তাড়াতাড়ি ডায়েরিটা পুনরায় ঝুড়িতে রেখে দিল। এসে বিছানায় বসে একটা খাতা হাতে নিতে না নিতেই দরজা ঠেলে এমিলি ভেতরে ঢুকল। দু’হাতে দুই কাপ কফি। সামনে এগিয়ে নিনার দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘বোরড ফিল করছো না তো? চাইলে বাগানে যেতে পারি আমরা। টনির কামরাটা একটু বোরিংই বটে।’

নিনা মুখে বলল, ‘না না বোরড হওয়ার কী আছে? আমার তো ভালোই লাগছে।’ তবে মনে ভাবল, ‘কী আজব তো! লিজা এমিলি এই দুজনই নিজেদের ভাইকে বোরিং ভাবে কেন? হয়তো এটাও একটা স্বাভাবিক ব্যাপারই তবে আমিই বোধহয় আজকাল সবকিছুই প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছি।’

‘তুমি দেখছি খুব ভাবুক প্রকৃতির।’ এমিলির কথায় দ্বিতীয় বারের মতো ভাবনার সুতোয় টান পরল। এমিলি আবারও বলল, ‘যাই হোক। হঠাৎ তুমি স্কুল পাল্টালে কেন?’

এই প্রশ্নের কোন উত্তর কখনো ভেবে রাখা হয়নি। কাজেই
নিনা অপ্রস্তুত কন্ঠে উত্তর দিল, ‘পূর্বের স্কুলে যেতে আমার একটু সমস্যা হতো। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম স্কুল পাল্টানোর কথা।’

‘ওহ আচ্ছা।’ বলে কফি সিপ করল।

‘আর তুমি আজকাল বাসায় একা কিভাবে সময় কাটাও?’

‘আমি বাসায় থাকিই বা কোথায়? আমি তো বাই…বলে একটু থামতেই নিনা বলল,
‘তো তুমি সারাদিন বাড়ির বাহিরে থাকো?’

‘না না সেরকম নয়। বাসায় থাকি না বলতে আমি বাড়ির ভেতর থাকি না। আমি থাকি বাগানে। হ্যামোকে বসে জার্নাল লিখি, বা মাঙ্গা পড়ি অথবা ছবি আঁকি। সত্যি বলছি বাগানে বসে সব রং তুলি টুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে মনের সুখে ছবি আঁকার মজাই আলাদা।’

‘তুমি মাঙ্গা পড়ো? এমনি বই পড়ো না?’

‘নাহ। এই বাড়িতে যত বই দেখছ এইসব টনির। আমার না।’

‘বাই দ্যা ওয়ে বাগানে বসে থাকার ব্যাপারটা তো এখনকার কথা। আগেই ওখানেই বসে থাকতা?’

‘মাঝে মাঝে। ওহ হ্যা আগে আমরা বেশির ভাগ ট্রাভেল করতাম। সাথে টনিও থাকতো। দল বেঁধে বন্ধুরা মিলে সব ঘুরতে যেতাম।’ বলে থামল। এমিলি চোখের কোণ থেকে পুলকিত ভাবটা মুছে গেল নিমিষেই। মলিন কন্ঠে বলল, ‘জানো কয়েকদিন আগেই টনি প্ল্যানিং করছিল এবার আমার জন্মদিন কিভাবে পালন করবে। কত কী উদ্ভট আইডিয়া বাপরে বাপ। ব্রেন্টউডে আমাদের বাবার একজন বন্ধুর ভ্যাকেশন হোম আছে। ওটা সাধারণত খালিই পরে থাকে। তাই টনি পরিকল্পনা করেছিল দল বেঁধে সকলকে নিয়ে গিয়ে ওখানেই অনুষ্ঠান করবে ।’ বলতে বলতে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল। যেন টনির ছেলেমানুষী কথাবার্তা মনে করে হাসছে। আরোও বলে গেল,
‘তবে সেটা হলো কোথায়? কত প্ল্যানিং কত কী? কিছুই তো করা হলো না। আমার জন্মদিনে ও থাকলোই না।’ বলতে বলতে গলা কেঁপে উঠল। নিনা নিশ্চুপ বিছানায় বসে রইল। সূর্যের কিরণের ছটায় এমিলির চোখে টলমল করে ওঠা নোনা জল চিকচিক করে উঠল। এমিলি এবার মৌন হয়ে চোখের জল লুকাতে মাথা নত করল। নিনার মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তবে এমিলির সামনে তা মোটেও প্রকাশ করার অবকাশ নেই। ও নরম কন্ঠে বলল, ‘এমিলি টনি কোথাও যায়নি। আজীবন ওর আপনজদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে। এটা তোমার ওপর নির্ভর করছে তুমি ওকে তোমার জীবনে বাঁচতে দিবা কিনা।’ কথাটা বলতেই এমিলির চোখের কার্ণিশ পেরিয়ে নোনা জল টপ করে ওর গায়ে পরল। নিনা বলে গেল, ‘তুমি তোমার জন্মদিন ঠিক ওভাবেই পালন করো যেভাবে টনি চেয়েছিল। তাহলে ওর করা কোন প্ল্যানিং আর বৃথা যাবে না।’

এমিলি গাল মুছল। হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘ভালো বুদ্ধি দিয়েছো। আমি তো আমার জন্মদিনের ব্যাপারটা বাতিলই করে দিয়েছিলাম।’

‘তো কবে তোমার জন্মদিন?’

‘এই তো সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহেই।’

‘ওহ আর বেশি দিন নেই।’

‘তোমাকে তাহলে আসতে হবে কিন্তু।’

‘কোথায়?’

‘ওই বাংলোতে।’

‘আচ্ছা দেখি।’ স্তিমিত হেসে বলল নিনা।
কফি শেষ হতেই নিনা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দরজা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়ে এলো এমিলি। নিনা বেরিয়ে যেতেই ঘরে নিরবতা নেমে এলো। নিনা দরজার বাইরে বেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। বেশিক্ষণ মানুষের বাসায় থাকা বা এত গল্প করা ওর ভালো লাগে না। তাও আবার যদি সেটা হয় গ্রেউড বাড়ি। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল।

এমিলি ধীর পদক্ষেপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে টনির কামরায় ঢুকলো। প্রথমে বুক সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে পাথরটা আগে যেভাবে ছিল সেভাবে রাখল। টেবিলের বইগুলো ঠিক করল। বিছানার চাদর টানটান করল। সবশেষে এগিয়ে গিয়ে ঝুড়িটার সামনে দাঁড়াল। ঝুরিতে মেরুন ডায়েরির ওপর কালো ডায়েরিটা রাখা। এমিলি কালো ডায়েরিটা হাতে তুলে নিয়ে ভাবল,
‘কালো ডায়েরিটা সবসময় নিচে থাকে এবং ওপরে থাকে মেরুনটা।’ ভেবে দুটো একটার ওপর আরেকটা ঠিক করে রাখল।

নিনা বাড়ির বাউন্ডারি দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। হেঁটে কিছুটা সামনে এগিয়েই খুব ক্লান্ত অনুভব হলো। কেন জানে না মনটায় বিষন্নতার মেঘ ভার করেছে। হৃদয়ে নিদারুণ অস্থিরতা। নিনা থেমে গিয়ে বাউন্ডারি দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারটা ভাবনা,
‘লিজার সাথে টনির সম্পর্কটা কী? এতকিছু একসাথে কখনই কোইনসিডেন্স হতেই পারে না। টনির জীবনের সেই মেয়েটা কী লিজা ছিলো? লিজার বয়ফ্রেন্ড ছিলো টনি? যে ওর ভাইয়ের শত্রু? তাহলে এই কথাটা কেউ ভুলেও মুখে তোলে না কেন? ইভেন অমিতও জানে না। নাকি আমারই কোথাও দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে গড়মিল হচ্ছে? তাছাড়া সেই ডায়েরিটা? পাতাগুলো ছিঁ*ড়তে পারে এমন কেউ সবার প্রথমে হতে পারে এমিলি। কারণ সেই সর্বক্ষণ ওই বাড়িতে উপস্থিত থাকে। তবে সেটা ভাবা যেত যদি না এর মাঝে হারিন এবং অরল্যান্ডো চুরি করে গ্রেউড বাড়িতে ঢুকতো। ওরা টনির কামরা থেকে ঘুরে গিয়েছে। এবং ওদের একটা উদ্দেশ্য ছিলো। যেটা জানি না আমি। জানি না ওরা কী খুঁজছিল বা জানি না সেটা ওরা পেয়েছিল কিনা। তবে সবচেয়ে সম্ভাব্য বিষয় হতে পারে ওই ডায়েরিতে যা কিছু লেখা ছিলো তা কোন না কোন ভাবে ওদের বিরুদ্ধে ছিলো। কাজেই পাতাগুলো ছিঁ*ড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স*ন্দেহ ওদেরই হয়। তবে এই ক্ষেত্রে এমিলিকে আসলে স*ন্দেহ করাটা পুরোপুরি লজিক্যাল না। কারণ যদি ওই ডায়েরি নিয়ে ওর সমস্যাই থাকতো ও শুধু পাতাগুলো ছিঁ*ড়ে নিয়ে আবার সাজিয়ে রাখতো না। বরং ডায়েরিটাই গায়েব করে দিত। শুধু পাতা ছিঁ*ড়ে সেটা আবারও সাজিয়ে রেখে দেওয়াটা বোকামি। এমিলি এরকম বোকামি করতো না। তবে হারিন এবং অরল্যান্ডোর হাতে ছিলো না সময়। তাছাড়া এমিলিরাও চলে এসেছিল। ওরা হয়তো এতকিছু করার সময়েই পায়নি।’
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পরল ওর তোলা ছবিটার কথা৷ সাথে সাথে মোবাইলটা বের করে ছবিটা খুললো। স্পষ্ট ভাবে পড়ার জন্য একটু জুম করতে লাগলো।

“ইভান দানির :-

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ইং সাল।
আমার দুঃস্বপ্নের নাম। একসময় যে আমার সুইট ড্রিমসের অংশ ছিল সে কখন, কিভাবে আমার দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে তা যেন আমি বুঝতেই পারলাম না। কিন্তু কোন মানুষকে যদি মন থেকে ঘৃণা করে থাকি আমি, সেই একটা মানুষ হচ্ছে ইভান। ও আমার যেই ক্ষতিটা করেছিল সেটা অপূরনীয়। ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্য ওতো কখনো তার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজনবোধই করেনি।

২রা এপ্রিল, ২০২৩ ইং সাল,

বারবার ইভানের কারণে আমি আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান জিনিসটা হারাতে বসেছি। ও কখনোই আমাকে সুখে দেখতে পারে না। এবার সত্যি সত্যি আবারও আমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে প্রিয়জনকে ও ছিনিয় নিল। আমি জানি এটা ওই করেছে। ও যতই অস্বীকার করুক। ও ছাড়া আর কেউই আমার সুখ দেখে এতটা অসন্তুষ্ট ছিলো না। এত সবকিছু করার পরও আমরা দুজনই এখন হসপিটালে এডমিট। নিজেই আমার জীবনটা আমার চোখের সামনে গুঁড়িয়ে দিয়ে সে আবার বড় মুখ করে আমাকেই দোষারোপ করছে। হাস্যকর!’

২৪ শে জুলাই, ২০২৩ ইং সাল

আবার! আবার আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন নষ্ট করে দিল ইভান। কেন? সমস্যা টা কী ওর? আমি আর আমার টিম এত দিন ধরে পার্ফেক্টলি হোমকামিং এর আয়োজন করলাম। অথচ সেটা ওর বাঞ্চাল করাই লাগতো? শুধু মাত্র ওটা আমার প্রোজেক্ট ছিলো বলে

২৭ আগস্ট, ২০২৩ ইং সাল

বাহ এখন এটা কী করলো ইভান? এতটা? শুধু মাত্র আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এত কিছু করলো? এত বড় নাটকটা সাজালো? এত দিন ধরে আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললো? শুধু মাত্র আমার পিঠে ছু*রি মারার জন্য? কয়েক বছর আগে যে বিশ্বাসঘা*তকতা করেছিল সেটা মনে হয় কম পরে গিয়েছিল। কেন আমিই কী আমাদের বন্ধুত্বটা ভে*ঙেছিলাম? হ্যা ভে*ঙেছি হয়তো আমি কিন্তু কারণটা সবসময় ওই ছিল। আর কতদিন? কত দিন আমাকে এভাবেই জ্বা*লিয়ে যাবে?’

এতটুকুই লেখা ছিল। নিনা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ সময় নিল গুছিয়ে সবকিছু পুনরায় ভাবতে,
‘ইভান আসলে কী করেছিল টা কী টনির সাথে? আর শেষেই বা কী হয়েছিল? তার মানে কেউ আছে যে টনিকে বি*ট্রেই করেছে। কিন্তু সেটা ইভান নয়। কারণ বিশ্বাসঘাতক তারা করে যাদেরকে বিশ্বাস করা হয়। শত্রুরা কখনো বিশ্বাস*ঘাতকতা করে না। তারা সামনে থেকে আঘাত। ইভান নয় তাহলে কে? সেটা কে আমাকে জানতে হবে। কারণ সত্যিই তো, টনিকে খু*ন করে কারোও লাভটা কী? কেউ এমনটা কেন করবে? খু*নির স্বার্থটা কী আসলে সেটাই আমাকে আগে বুঝতে হবে। যে ওকে বি*ট্রেই করেছে সে প্রয়োজনে ওকে খু*ন করতেও পারে। কিন্তু সেটা কে? তাকে পেতে হলে ইভানের ওপর কী দোষ এসেছিল সেটা জানতে হবে। যেটা শুধু ইভানই বলতে পারে।’ ভেবে কিছুক্ষণ মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখ বন্ধ করে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎই আরেকটা কথা মাথায় খেলে গেল, ‘ওয়েট, একই গানের পরপর চারটে লাইন লিজা এবং টনি দুজনের কামরায়ই বাঁধাই করা। লিজা সেই একই গান ওর ফিউনেরালে পর্যন্ত গাইল। লিজাই আসলে টনির ড্যান্ডালাইন। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আর কারো কিছু হয়নি অথচ লিজারই হাতে ইনফেকশন। এবং ওর ভাইয়ের সঙ্গেই টনির শত্রুতা। বাহ! বাহ! বাহ! কী সুন্দর৷ তাহলে আমি এইসবের কী বুঝবো? ওর যদি টনির সঙ্গে সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে ও টনিকে মা*রবে কেন? এক্ষেত্রে আবার লিজা সম্পূর্ণ স*ন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পরে যায়। আবার এমনও তো হতে পারে যে লিজাই সেই মানুষটা যে টনিকে বি*ট্রেই করেছে। কিন্তু লিজার টনিকে বি*ট্রেই করা নিয়ে, ইভান কিভাবে দোষী হতে পারে? না না, এখানে মূল বিষয় লিজার চি*ট করা নয় বরং অন্য ঘটনা যেটার পুরো দায়টা প্রথমে ইভানের ওপর পরেছিল কিন্তু তাহলে এটারও সম্ভাবনা থাকে যে আসল দোষী আসলে লিজাই। এমনও হতে পারে আসলেই লিজা ওকে বি*ট্রেই করেছে। আর এই সম্পূর্ণ রিলেশনশিপ ক্যাচালটা ওদের সাজানো ছিল। শুধু টনিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। তাই তো টনি বলেছে, যাকে বিশ্বাস করেছে সেই পিঠে ছু*রি মেরেছে।’

———————-

২০ সেপ্টেম্বর। স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। আজ সূর্য কিরণের তেমন তেজ নেই৷ ভোরের দিকে আকাশে মেঘ করেছিল। তবে বৃষ্টি হয়নি। নিনা ধীরে ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই ইভানও হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পাশাপাশি এলো। তবে কিছু না বলে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। নিনা কয়েকবার ওর দিকে চোখ ফেরাল তবে ইভান ভ্রুক্ষেপহীন। অবশেষে নিনাই
বিরক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

‘কি হয়েছে?’

‘আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে?’

‘আমার তো কিছু হয়নি৷ তোমার কিছু হয়েছে?’

‘কি আজব? কি বলছো টা কী তুমি?’

‘কী বলছি? আমি তো স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছিলাম৷ তুমিই তো কথা শুরু করলে।’

‘হ্যা জানি তুমি হেঁটে যেতেই পারো। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। কিন্তু তুমি আমার সাথে কোথায় যাচ্ছো?’

‘তোমার সাথে যাব কেন? এই রাস্তাটা কী তুমি কিনে নিয়েছ সানশাইন?’

‘ঠিক আছে তোমার যেখান থেকে ইচ্ছা ওখান থেকে যাও। না না শুধু হেঁটে নয় তুমি নাচতে নাচতেও যেতে পারো কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।’ বলে নিনা হাঁটা থামিয়ে দিল।
ইভান প্রথমে হাসল। এরপর নিজেও থেমে গিয়ে বলল,
‘তুমি থেমে গেলে কেন?’

‘তাতে তোমার কী?’

‘তাহলে আমি কী করছি এতে তোমার কোন ভ্রূক্ষেপ করা উচিৎ নয় সানশাই…নিনা ওর কথার মাঝখান দিয়ে বলল
‘এটা কী হ্যা? তুমি আমাকে সানশাইন কেনো বলো?’
ইভান মুচকি হেসে বলল, ‘তুমি একটা টুকরো সূর্যের আলের মতো। তাই।’
‘কীহ!?’ অবাক হলো নিনা।
‘এত অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘কিছু না।’ স্তিমিত স্বরে উত্তর দিল নিনা।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে গেট দিয়ে না বের হয়ে বামের পথ ধরে হাঁটতে থাকল। ক্যাম্পাসের এদিকটা নিরব, নির্জন। সারি সারি ম্যাপল গাছ লাগানো। বেশ কিছু নাম না জানা ফুলের ঝারও রয়েছে। নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইভান বলল,
‘আচ্ছা তোমার কী মুড সুইং এর সমস্যা আছে?’

‘হ্যা? এটা কেন মনে হলো তোমার?’

‘এইতো তোমার মন মেজাজ অথবা বলা যায় ব্যবহার অনেক ক্ষিপ্র গতিতে উঠা নামা করে। বোঝা মুশকিল কখন তুমি ভালো ব্যবহার করবা, কখন বিরক্ত, কখন তিক্ত।’

‘একই কথা তোমার ক্ষেত্রেও বলা যায়।’
ইভান নির্বিকার চিত্তে শ্রাগ করল। নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইভানের কথাটা ভাবল, ইদানীং নিজের মন মেজাজ মোটেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। যখন যা ইচ্ছা ব্যবহার করে বসছে। যা ইচ্ছা বলে বসছে। অথচ এই সময়টায় বোধহয় ওর আরোও বেশি সচেতন হওয়ার কথা৷ নিনা শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমার কী মনে হয় জানো? আমি ভালো আচরণ করি বা খারাপ, তুমি সবকিছুই উপভোগ করো।’

‘তা করি বটে।’

নিনা না হেসে পারল না। সামনে কিছুটা জায়গাজুড়ে কনক্রিটের মেঝে। কয়েকটা কনক্রিটের বসার স্থান সহ কয়েকটা সরু রেলিঙ খাপছাড়া ভাবে দেওয়া৷ এগুলো আসলে বাচ্চাদের খেলার তাগিদে তৈরি। ইভান সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। নিনাও ওর পাশে দাঁড়াল।
ইভানের দৃষ্টি অনুসরণ করে একটা গাছের দিকে তাকাল।

নিনা ভাবছে, ‘এটাই পার্ফেক্ট সময়। ওর মন মেজাজ ভালো আছে। আমাকে এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।’
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল। যতটা সম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল, ‘এবার তোমার ব্যাপারটা বলো হঠাৎ হঠাৎ তুমিই বা এমন রুড আচরণ করো কেন? একদিন আমাকে জ্বালাও, একদিন ফ্লার্ট করো আবার পরের দিন থ্রেট দাও। ব্যাপারটা কী বলো তো?

‘আমি ওটা তো জাস্ট প্রথম দিকে করেছিলাম দুই একবার।’

‘ওই প্রথম দিকেই বা কেন করেছিলা?’

‘কারণ তুমি আমার সবকাজের মাঝে বাগড়া দিচ্ছিলা। তোমার কারণে আমাকে ঝামেলায় পরতে হয়েছিল বলে একটু বিরক্ত ছিলাম তোমার ওপর।’

‘আর এখন?’ ঠোঁটের কোণে অত্যন্ত সুক্ষ্ণ আমদের আভাস ধরে রেখে প্রশ্নটা করল।

‘এখন।’ বলে ইভান নিনার দিকে তাকাল। রোদে ইভানের ধূসর চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। সারা মুখ হিরের মতো চিকচিক করছে। নিনার কাজল কালো চোখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
‘তুমি আমাকে আরোও বড় ঝামেলায় ফেলে দিয়েছ।’
ওর ধীর, গাঢ় কন্ঠে নিনার হৃদযন্ত্রের গতিবেগ হঠাৎ বেড়ে গেল। কানে বাজতে লাগলো নিজেরই হৃদয়ের অনবরত ঢিবঢিব শব্দ। অপ্রতিভভাবে চোখের যোগাযোগ ভেঙে দিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘লিজার কামরায় ড্যান্ডালাইন গানের কয়েকটা বাক্য ফ্রেম করে রাখা। আবার ঠিক সেই দুটো বাক্যের আগের দুটো লাইন টনির কামরায় ফ্রেম করে রাখা। অদ্ভুত না?’ অতি সাবধানে ঢিলটা ছুঁড়ে ইভানের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। ইভানের মুখভঙ্গি নির্বিকার৷ শুনতে পেয়েছে বলেও মনে হলো না। তবে কিছুক্ষণ মৌণ থেকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘হ্যা এই গানটা ওদের খুব প্রিয় ছিল। এর মাধ্যমেই ওরা একে-অপরের প্রতি অনুভূতি গুলো সুস্পষ্ট ভাবে টের পেয়েছিল।’ বলে থামল।

‘তো ওরা রিলেশনে ছিলো?’ নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘হ্যা ছিলো।’ বলে থামল ইভান। এবার কিছুটা বিচলিত ভাব নেচে উঠল ওর চোখে। পানসে কন্ঠে বলল, ‘তবে সেটা টেকেনি। ওদের এই সম্পর্ক নিয়ে উৎফুল্লতা দেখে আমিও কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলাম।’

‘কী নিয়ে?’

‘হয়তোবা টনির সঙ্গে আমার সম্পর্কের তিক্ততাটা মিটতে পারে। তবে সেটা হলো কোথায়! আমি ওকে যতটা নিচু ভেবেছিলাম ও তার চাইতেও বেশি নিচু বের হলো।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল কথা গুলো।

‘মানে?’ হতবাক হলো নিনা।

‘ওদের ব্রেকআপ কেন হয়েছে জানো?’ বলে হঠাৎ করেই নিনার চোখে চোখ রাখল ইভান। নিনা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরল। ইভান বলল, ‘কারণ টনি লিজাকে চি*ট করেছিল!’ নিনা যেন বজ্রা*হত হলো। একমুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘কী আশ্চর্য ও চি*ট করেছিল মানে? কিভাবে?’

‘করতেই পারে। এত অবাক হওয়ার কী আছে? আফটার অল আমাকে কষ্ট দেওয়াটাই ওর জন্য বড় ব্যাপার। আনার বোনকে কষ্ট দিয়ে আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিল।’

‘কার সাথে চিট করেছিল?’

‘জানি না। লিজা কী কী সব ম্যাসেজের স্ক্রিনশট পয়েছিল। যদিও আমি পরিষ্কার ভাবে সেসব দেখিনি।

‘তো শুধুমাত্র এইজন্যেই তোমার সাথে টনির শত্রুতা?’

‘না ঠিক সেরকম নয়। ছোটবেলায় আমরা বন্ধুই ছিলাম।
কিন্তু প্রাইমারিতে থাকতে আমাদের মাঝে কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটে। সেখান থেকেই আমরা একে অপরকে দেখতে পারি না। তবুও বোকার মতো আমি আশা করেছিলাম যে হয়তো আমার ওপর থাকা ওর রাগটা লিজার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ও শুধু আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য, আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লিজাকে এভাবে চি*ট করলো। লিজাকে একদম ভে*ঙে চু*রমার করে রেখে দিল।’
নিনা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে ছিল। আজকাল কী হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। এতদিন জেনে আসা মানুষটা, তার নীতি নৈতিকতা সবকিছু এখন প্রশ্নের মুখে পরে যাচ্ছে। কিন্তু ইভান যা বলছে তাও বা কতটুকু সত্য? কাকে বিশ্বাস করবে ও? দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল নিনা। চোখ বুজল এক মুহূর্তের জন্য। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আবারও ভাবল, ‘যুক্তিসঙ্গত কারণ কিন্তু তবুও টনি কিভাবে? কিন্তু টনি তো নিজের ডায়েরিতে বলেছে, অন্য কেউ বা খুব সম্ভবত লিজাই ওকে বি*ট্রেই করেছে। এদিকে ইভান বলছে টনি লিজাকে বি*ট্রেই করেছে। কে কাকে কষ্ট দিতে চায়? আর কে কাকে বি*ট্রেই করেছে? কেই বা প্রতি*শোধ নিচ্ছে এখানে?….আর ভাবতে পারলো না ও। হৃদয় তীরে উথাল-পাথাল ঢেউ আঁচ*ড়ে পরছে। অদ্ভুত অস্থিরতা আষ্টেপৃষ্ঠে আঁ*কড়ে ধরেছে ওকে। ইভান হঠাৎ ওর বাহু আঁকড়ে ধরতে চমকে উঠল। ইভান অবাক হয়ে বলল, ‘কী হলো এমন থম মেরে গেলে কেন? তুমি ঠিক আছো? তেমার চেহারা এমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে কেন?’ নিনা নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। চেষ্টা করল আপাতত টনি সম্পর্কে শোনা কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে। তবে সেগুলো যেন জোকের মতো আটকে গেছে মনে।
নিনা সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্তিমিত স্বরে বলল, ‘আমার একটু অসুস্থ বোধ হচ্ছে। আমার যাওয়া উচিৎ।’
‘ইভানও সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘ঠিক আছে চলো।’

‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

‘ওফ নিনা প্লিজ এখন আবার তর্কাতর্কি শুরু করো না। তোমার যেহেতু অসুস্থ লাগছে তোমাকে একা যেতে হবে না। আমি….নিনা ওকে থামিয়ে জোর দিয়ে বলল,

‘কী ইভান? তুমি কী প্রতিদিন আমাকে ড্রপ করে দেওয়া শুরু করেছো?’

‘না। কিন্তু তোমার কী মনে হয় এভাবে তোমাকে আমি একা যেতে দেব? যদি তুমি রাস্তার মাঝে মাথা ঘুরে পরে যাও।’ ওর
ধূসর চোখ ভরা দুশ্চিন্তা। নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিনার দিকে। নিনার হঠাৎ কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কোথায় ও ইভানের চোখের সামনে থেকে দূর হতে চাইছে। একটু একা থাকতে চাইছে। নিজের অন্তরকে শান্ত করে ভাবতে চাইছে, তা না ইভান যেন পিছুই ছাড়ছে না। নিনা আর কথা না বারিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ঠিক আছে। যাচ্ছি তোমার সাথে।’ ওরা হাঁটতে আরম্ভ করল। এখন ঝলমলে রোদ উঠেছে । রোদের বিপরীতে ইভানের নাতিদীর্ঘ ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থাকল নিনা। ভাবল, ‘জানি না কার মধ্যে কী চলছে। রোদের আলোয় কতটা উজ্জ্বল তুমি। কতটা উজ্জ্বল সকলেই। তবে যতটা উজ্জ্বলতা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার বিপরীতে ততটাই গাঢ় ছায়া পরে। মানুষের যেমন ইতিবাচক দিক থাকে। অবশ্যই পৃথিবীতে এমন কোন সত্তা নেই যার ছায়া পরে না ঠিক সেভাবেই এমন কোন মানুষও নেই যার নেতিবাচক দিক থাকে না। কেউ বলতে পারে না মানুষের মনোভূমির এই ছায়ার গভীরতা কতটা। ইভান শুধু যদি মাঝে এই গন্ডোগোলগুলো না থাকত তাহলে আমাদের সম্পর্কটা কত সহজ হতে পারতো। তবে এখন আমাদের মাঝে তোমার ছায়া বাঁধা হয়েই থাকবে।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১২
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

সন্ধ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বৃষ্টি। সেই বিকেল থেকে বর্ষণের নিরবচ্ছিন্ন ঝমঝম শব্দ বেজেই চলেছে। তাপমাত্রা কমে গিয়েছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তিরতির করে খোলা জানালা দিয়ে ঢুকছে। পাতলা সাদা পর্দা বাতাসের তালে তালে নাচছে।

‘আপা! আপনি চি*টিং করলেন? এই বয়সে এসে কী আপনার চি*টিং করা মানায়?’ অনেকটা মজার ছলে বলল নিনা।

‘আমি কী করলাম?’ জিজ্ঞেস করলেন উনি।

‘এই যে আপনার ঘোড়া সাদা ঘরে ছিলো। সেটা কালো ঘর থেকে মুভ হলো কী করে? সাদা থেকে কালোতে কখন এলো?’

সারা বাড়ি ফাঁকা। আঁধারে ঢাকা৷ শুধু ড্রইং রুমে হলদে বাতি জ্বেলে নিনা ও ফাতিমা আপা দাবা খেলতে ব্যস্ত। ঘরময় এক ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বিরাজ করছে।

‘ধুর তুই খেয়াল করিস নি। ওটা তো ওখানেই ছিলো। এখন তোর গুটি খাওয়া গেছে বলে তুই চি*টিং করছিস।’

‘আহ্ আপনি আমাকেই চি*টার বানিয়ে দিলেন?’

‘না না চি*টিং তো তোর বন্ধু এসে করে দিয়ে গিয়েছে।’ হঠাৎ এ কথায় নিনা মূর্ছা গেল। টনির চি*ট করার ব্যাপারটা মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। ও গুম মেরে যেতেই ফাতিমা আপা বললেন, ‘কী হলো মা? কিছু হয়েছে? আমার এটুকু কথাতেই রাগ করলি? আচ্ছা যা আমিই চি*ট করেছি।’

নিনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ভান করছিলাম! এইতো চো*র ধরা পরেছে!’

তখনই কলিং বেলের তীক্ষ্ণ টিং টিং শব্দ ভেসে এলো। ফাতিমা আপা উঠতেই যাচ্ছিলেন নিনা ওনাকে থামতে ইশারা করে নিজে লাফ দিয়ে উঠে গেল। দ্রুত পায় দরজার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিতেই অপ্র্যাত্যাশিত একজনকে আবিষ্কার করল। এ্যাভরিল দাঁড়িয়ে। গায়ে রেইনকোট। চুল কিছুটা ভিজে মুখের সাথে লেপ্টে আছে। চোখ মুখ কিছুটা ফোলা ফোলা। গাল দুটো লালচে দেখাল।
হয়তোবা বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় এমনটা হয়েছে। তবুও ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে ম্লান কন্ঠে বলল,
‘তুমি বলেছিলা এই বাড়ির দরজা নাকি আমার জন্য সর্বদা খোলা? নাকি এসে বিরক্ত করলাম?’

ওকে দেখে নিনা প্রথমে হতবাক হয়ে রইল। মনে বিচলতার বন্যা বইতে শুরু জরল। ইতস্তত করলেও চেহারায় তা প্রকাশ করলো না,
‘অবশ্যই খোলা। ভেতরে এসো।’

এ্যাভরিল এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ভেতরে ঢুকল। ও একা নয়। ওর সঙ্গে রয়েছে বড় একটা স্যুটকেস। নিনা সত্যিই অবাক না হয়ে পারল না। দরজা লাগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এ্যাভরিল সবকিছু ঠিক আছে তো তোমার বাসায়? নাহলে এভাবে হঠাৎ…কথাটা অসম্পূর্ণই রেখে দিলো।

‘হ্যা..মানে কিছু ঘটনা আছে। যেহেতু আমার বাড়ির কাঁদার ছিটা আমার সাথে সাথে তোমার বাড়িতেও এসে পরছে তোমাকে তো জানাতে হবেই। পরে ধীরেসুস্থে বলছি।’

‘না না এটা কেমন কথা? তুমি যখন চাও এবং কম্ফোর্টেবল মনে কর নিজেকে তখনই খুলে বলো।’ বলে নিনা সামনে এগোল। ড্রইংরুমে সোফার ওপর বসে ছিলেন ফাতিমা আপা। এ্যাভরিলকে দেখা মাত্রই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ওহ নিনা তুই বলবি না তোর বন্ধু আসছে। আমি কিছু আয়োজন করতাম।’

‘আমি জানতাম না তো ও আসবে। আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

এ্যাভরিলের স্যুটকেস দেখে আপা বললেন, ‘তুমি বোধহয় বেশ কিছু দিন থাকবা। তাই না?’
এ্যাভরিল আলতো করে মাথা নাড়ল। নিনা বলল,
‘না আসলে আপনাকে বলা হয়নি৷ তবে ও এখন থেকে এখানেই থাকবে। আপনি চিন্তা করবেন না কোন সমস্যা হবে না।’

এ্যাভরিল রেইনকোট টা খুলে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিনা খেয়াল করে সেটা ওর হাত থেকে নিয়ে দরজার পাশের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দিল। ওকে লিভিং রুমে বসতে বলল। এ্যাভরিল জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসল। অস্বস্তিতে জর্জরিত হয়ে আছে ও। ফাতিমা আপা শশব্যস্তে রান্নাঘরে গেলেন খাবারের ব্যবস্থা করতে। নিনা এ্যাভরিলের পাশে বসল, ‘তুমি ফ্রেস হয়ে খেয়ে নাও। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।’

‘না না অত ব্যতিব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই আমি…. নিনা ওকে থামিয়ে দিল, ‘মেহমানের মতো আচরণ করা যাবে না। নিজের বাসা মনে করে থাক।’

‘কী এমন ভালো কাজ করেছিলাম যার বিনিময় তোমাকে পেলাম!’ অপ্রতিভ ভাবে হেসে বলল।

নিনা হাসল। এ্যাভরিল উঠে গেল ফ্রেস হতে। নিনা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সোফার পাশে। কপালে সূচালো রেখা। ভাবছে,
‘ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে মন খচখচ করত। আবার সত্যি সত্যিই যখন বাসায় এসে পরেছে তখনও কেমন জানি একটা লাগছে। একা থাকতে অভ্যস্থ আমি। বাসায় হইহট্টগোল পছন্দ করি না। ওর প্রতি যদি বিরক্ত হয়ে যাই তাহলে সেটা অন্যায় হবে। নিজেই ওকে বাসায় এনে, ওর ওপর বিরক্ত হওয়াটাও মানায় না। ওফ! এত হিসেব মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি তারপরেও আমার দ্বারা এত গন্ডগোল হয় কিভাবে?’

বেশ কিছুক্ষণ পর মি.মালিক ফিরলেন। ফাতিমা আপা ততক্ষণে খাবারের আয়োজন সেরে ফেলেছেন। নিনা পরিবেশন করছিল। মি. মালিক টেবিল দেখে মুচকি হেসে বললেন,
‘কী ব্যাপার আজকে চারটা প্লেট? নিনা তোর প্লেটটা ছোট হয়ে গিয়েছে?’

নিনা হাসল। ফাতিমা আপা বললেন, ‘না ভাইজান ওর বান্ধবী এসেছে। তার জন্যেই এই আয়োজন।’

‘আচ্ছা আপা আপনি আজ আমাদের সাথেই খেয়ে যান।’ বললেন মি.মালিক।

‘হ্যা বাবা আমি আগেই ওনাকে বলেছি। এইজন্যেই তো চারটা প্লেট।’ গ্লাস গুলোয় পানি ঢালতে ঢালতে বলল নিনা।

আপা চামচ, কা*টা চামচ সাজিয়ে রাখছিলেন। সেগুলোর টুংটাং শব্দ হচ্ছিল। মি.মালিক নিনার দিকে তাকালেন,
‘কে এসেছে? কোন ফ্রেন্ড?’

‘উম তোমাকে বলা হয়নি। এ্যাভরিল এসেছে। আসলে ও ঠিক শুধু আজকের জন্য আসেনি।’ ইতস্ততভাবে বলল নিনা।

‘আজকের জন্য আসেনি মানে? কয়েকদিন থাকবে?’ বলে প্লেট থেকে একটা চেরি টমেটো তুলে মুখে দিলেন।

‘না অনির্দিষ্টকালের জন্য আই মিন ও এখন থেকে এখানেই থাকবে।’

মি.মালিক ভ্রু কুঁচকালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন, ‘কেন ওর বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে? আমি ব্যাপারটা দেখব? ওকে কী বাসা থেকে বের করে দিয়েছে?’

‘না না সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমি নিজেও এখনো শুনিনি।’
এতটুকু বলে থামল। কথাটা আসলে নিজের কানেও হাস্যকর শোনাল। অবশ্যই কোন গুরত্বপূর্ণ একটা কারণে আজ এই বাড়িতে এসে উঠেছে ও। অথচ যার বাড়ি সে নিজেই জানে না গুরত্বপূর্ণ কারণটা কী?
বাকি কথাটা শেষ করল,
‘ও পরে ধীরেসুস্থে আমাকে জানাবে বলেছে।’ বেশ দ্বিধা মিশ্রিত কন্ঠে বলল।

‘ওহ। তো তুই নিশ্চিত কোন সমস্যা হবে না? হলে আমাকে বল।’

‘কী নিয়ে?’

‘মানে তোর এই বান্ধবীর কথা তো আগে কখনো শুনিনি৷ তাও আবার এমন সময় এলো যখন তুই একটা র*হস্য নিয়ে ব্যস্ত আছিস। দেখিস কোন ঝা*মেলায় জড়িয়ে যাইস না। মানুষের পক্ষে আরেকজন মানুষকে বোঝা সবচেয়ে সোজা মনে হতেই পারে। কিন্তু দুনিয়ায় সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে জটিল জীবও মানুষই। ও এখানে যতদিনই থাকুক আমার সমস্যা নেই। এখন তোর যদি মনে হয় ওর মধ্যে কোন সমস্যা নেই তাহলে তাই হোক।’

ফাতিমা আপা নরম কন্ঠে বললেন, ‘উনি ঠিক বলেছেন। আমি বলছি না মেয়েটা খারাপ হতে পারে। তবে একেবারে বাসায় যেহেতু জায়গা দিয়েছিস আমি বিশ্বাস করি তুই ওকে সেভাবে চিনিস বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।’

নিনা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। আরপকটু বেশি বিচলিত হলো। প্রথম মনে হলো নিজের মন মস্তিস্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রক্ষর। কোন মানুষের সঙ্গে একটু কথা বললেই তার সম্পর্কে অন্তর থেকে একটা অনুভূতির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কোথায় এ্যাভরিলের সঙ্গে এতবার কথা বলেও তো কখনো নেতিবাচক কোন অনুভূতির উপস্থিতি টের পায়নি নিনা। যেই মানুষটাকে আপন করে নিয়ে বাড়িতে স্থান দিল তাকে আসলেও বা কত দিন ধরে চেনে ও? কখনো তো অমিতকেও জিজ্ঞেস করেনি এ্যাভরিলের কথা। অথচ সাহাস্য করতে গিয়ে নিজেই না কোন বড় ভুল করে ফেলেছে এই আশঙ্কার গভীর সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। কিছুতেই সেখান থেকে উঠে আসতে চেয়েও পারছে না। মি.মালিক ফ্রেশ হতে নিজের কামরায় চলে গিয়েছেন। নিনা ডাইনিং টেবিলে নিজের চেয়ারে গুম মেরে বসে রইল। ফাতিমা আপা ধীরে ধীরে নিনার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। নিনার হাতের ওপর তার শক্ত হাতটা রাখলেন। চামড়া ঝুলে গিয়ে কিছুটা ভাজ পরেছে যদিও।

তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘মা আমি তোকে ছোটবেলা থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা দিয়েছি যে যাই হয়ে যাক, ‘নিজের ওপর থেকে আস্থা হারাতে নেই।’ আমি জানি তোর সিক্সথ সেন্স কতটা সুক্ষ্ণ। আমি জানি কখনো তুই মানুষ চিনতে ভুল করিসনি। হয়তো তুই ওকে সাহাস্য করার উদ্দেশ্যেই নিজের বাড়িতে জায়গা দিয়েছিস তাহলে সেটাই ধরে রাখ। একটা সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছিস তাতেই অটল থাক। এটা নিয়ে তুই যত চিন্তা করবি তত বেশি সন্দেহ বাড়বে। তত বেশি উৎকন্ঠা বাড়বে। এবং ওই মেয়েটাও তোর সাথে থাকতে অস্বস্তি বোধ করবে কারণ তোর মাথায় জিনিসটা আটকে থাকলে তুই সহজ হতে পারবি না।’

নিনা চোখ বুঁজে বুক ভরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তখনই এ্যাভরিল হাজির হলো। এসে একটা চেয়ারের পেছনে দাঁড়াল। এখনো ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট আড়ষ্টতা। আপা বললেন,
‘বসো মা। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে নাও।’

এ্যাভরিল নিনার পাশের চেয়ারে বসল। নিনা উঠে গিয়ে নিজের কামরায় প্রবেশ করল। বাথরুম থেকে একবার মুখে পানি ঝাঁপটা দিয়ে আসলো। সকল সন্দেহ, বিভ্রান্তি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কতটা হলো ও জানে না তবে কিছুটা ভালো লাগলো। গিয়ে আবারও নিজের স্থানে বসল। মি.মালিক এসে ডাইনিংয়ে ঢুকতেই এ্যাভরিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গুড ইভিনিং আঙ্কেল।’

‘গুড ইভিনিং এ্যাভরিল। আরে বসো বসো দাঁড়িয়ে গেলে কেন?’ কিছুটা অবাক স্বরেই বললেন। সাধারণত এই মুল্লুকের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছুটা ম্যানারসের ঘাটতি থেকেই যায়। যা এশিয়ানদের মধ্যে পরিপূর্ণ রুপে ফুটে ওঠে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এ্যাভরিলের মধ্যে ম্যানারসের কোন অংশে কমতি নেই। যতক্ষণ না মি.মালিক বসলেন ততক্ষণ এ্যাভরিল দাঁড়িয়ে থাকলো। সকলে খাওয়া শুরু করার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত কামরায় নিরবতা বিরাজ করল। শোনা গেল শুধু চামচ নাড়ার টুংটাং শব্দ। মি.মালিক ও ফাতিমা আপা হাত দিয়েই খান। নিনা পুরোপুরি অভ্যস্ত নয় এ রীতিতে। এ্যাভিরল অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বিষয়টা পরখ করে বলল, ‘আপনারা হাত দিয়েই খান?’

‘হ্যা এটা আমাদের সাংস্কৃতিক আচার।’ বললেন মি.মালিক।
এ্যাভরিল নিনার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। নিনা কিছু বলার পূর্বেই মি.মালিক বললেন, ‘ওর মধ্যে এইসব আচার-আচরণ তেমন একটা দেখতে পাবে না তুমি। ও এখানে বেড়ে উঠার ফলে এখানকারই সব নিয়মনীতি আয়ত্ত করেছে। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।’

‘বাবা আমার কী দোষ? যখন আমাকে হাত দিয়ে খাওয়া শেখাতে চেয়েছ ততদিনে আমি চামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। হাত দিয়ে খেতে কেমন অস্বস্তি হয়।’
ফাতিমা আপা মুচকি হাসলেন। এ বাড়িতে ফাতিমা আপার উপস্থিতির আরেকটি বড় কারণ বাঙালি খাবার রান্না। নিনা যেন সম্পূর্ণ রুপে বাঙালি খাবার-দাবার হতে বঞ্চিত হয়ে আমেরিকান খাবার খেয়েই বেড়ে না ওঠে সেটা নিশ্চিত করতেই ওনাকেই রান্নার দায়িত্বটাও দেওয়া হয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় মি.মালিক বাসায় থাকেন না বলে তখন এটাসেটা রান্না হলেও রাতে অবশ্যই বাঙ্গালী খাবার থাকবেই। এ্যাভরিল বেগুন ভাজার দিকে ইশারা করে বলল,
‘এটা অসাধারণ! খুবই সুস্বাদু।’

‘এটা বেগুন ভাজা।’ বললেন আপা।

‘আসলে বেশির ভাগ খাবারই আমার অচেনা তবে স্বাদে চমৎকার। আবারও মনে হচ্ছে এখানে এসে কোন ভুল করিনি।’

‘শুধু বাঙালি খাবার বলে কথা না আসল জাদু রাধুনির হাতেও রয়েছে। ফাতিমা আপার সব রান্নাই চমৎকার হয়।’ বলল নিনা।

‘এ্যাভরিল শোন এখানে থাকা নিয়ে তুমি কোন রকম চিন্তা করবে না। বিশেষ করে এটাকে নিজের বাড়িই মনে করো এবং তুমি এখানে একদম নিরাপদ।’ মি.মালিক বললেন।

‘ওহ হ্যা আঙ্কেল আমি হাউজ রেন্ট নিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম যে…মি.মালিক ওকে মাঝখান দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘না না মোটেও এই চিন্তা করো না। তুমি বিনা রেন্টেই এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারো।’

‘তা কী করে হয়। আমার হাউজ রেন্ট দিতে কোন সমস্যা নেই।’

‘সেটা জানি তোমাকে বললে তুমি অবশ্যই দেবে কিন্তু আমি নিতে চাই না। তোমার এখানে থাকা খাওয়ার বহন নিতে আমার কোন সমস্যা নেই।’

‘কিন্তু আঙ্কেল এভাবে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো না। আমার বিবেকে বাঁধবে। আমার রেন্ট আপনাকে নিতেই হবে।’

মি.মালিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘একটা কথা বলি শোন। নিনাই শুধু আমার এক মেয়ে নয় আমার দুটো মেয়ে। নিনা-নিমা। এখন নিনা তো আমার কাছেই আছে কিন্তু নিমাকে আমি আমার কাছে রাখতে পারিনি। ওর বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। ও যদি এখানেই থাকতো, তখন ও যেমন নিজের বাড়িতে সবকিছু নিজের মতো আপন করে নিয়ে থাকত আমি চাই তুমিও সেভাবেই থাকো। ওর নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ও এখানে আসতে চায় না সেখানে তোমাকে কেন বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে, আমি জানি না। তবে আশা করছি বুঝতে পারছ। তুমি যদি বিনা রেন্টেই থাক তাহলে হয়তো আমার ব্যর্থ বাবা হওয়ার আফশোস কিছুটা কম মনে হবে।’
এতক্ষণ যাবৎ সকলেই খাওয়া থামিয়ে নিশ্চুপ বসেছিল। এ কথা বলার পর আর কিছুতেই এ্যাভরিল ওর রেন্ট দেওয়ার জেদটা ধরে রাখতে পারল না। অবশেষে হালকা হেসে বলল,
‘ঠিক আছে আঙ্কেল। আপনি যেভাবে চান সেভাবেই হোক।’
মি.মালিক মুচকি হাসলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষেই ফাতিমা আপা প্রস্থান করলেন। মি.মালিক যেহেতু সকাল সকাল বেরিয়ে যান কাজেই উনি আগে আগে শুতে চলে যান৷ অথবা কোন কাজ বাকি থাকলে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন। প্রথমে নিনা এ্যাভরিলকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিল। অতএব এ্যাভরিল সেখানেই গিয়ে ঢুকেছে। নিনা ওকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরতে তাড়া দিচ্ছে। পাশাপাশি কামরায় কোথায় কী আছে তাও দেখিয়ে দিল। গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে ভাবল, ‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা উচিৎ। পাশাপাশি চোখকানও খোলা রাখা উচিৎ।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১২
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

সন্ধ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বৃষ্টি। সেই বিকেল থেকে বর্ষণের নিরবচ্ছিন্ন ঝমঝম শব্দ বেজেই চলেছে। তাপমাত্রা কমে গিয়েছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তিরতির করে খোলা জানালা দিয়ে ঢুকছে। পাতলা সাদা পর্দা বাতাসের তালে তালে নাচছে।

‘আপা! আপনি চি*টিং করলেন? এই বয়সে এসে কী আপনার চি*টিং করা মানায়?’ অনেকটা মজার ছলে বলল নিনা।

‘আমি কী করলাম?’ জিজ্ঞেস করলেন উনি।

‘এই যে আপনার ঘোড়া সাদা ঘরে ছিলো। সেটা কালো ঘর থেকে মুভ হলো কী করে? সাদা থেকে কালোতে কখন এলো?’

সারা বাড়ি ফাঁকা। আঁধারে ঢাকা৷ শুধু ড্রইং রুমে হলদে বাতি জ্বেলে নিনা ও ফাতিমা আপা দাবা খেলতে ব্যস্ত। ঘরময় এক ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বিরাজ করছে।

‘ধুর তুই খেয়াল করিস নি। ওটা তো ওখানেই ছিলো। এখন তোর গুটি খাওয়া গেছে বলে তুই চি*টিং করছিস।’

‘আহ্ আপনি আমাকেই চি*টার বানিয়ে দিলেন?’

‘না না চি*টিং তো তোর বন্ধু এসে করে দিয়ে গিয়েছে।’ হঠাৎ এ কথায় নিনা মূর্ছা গেল। টনির চি*ট করার ব্যাপারটা মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। ও গুম মেরে যেতেই ফাতিমা আপা বললেন, ‘কী হলো মা? কিছু হয়েছে? আমার এটুকু কথাতেই রাগ করলি? আচ্ছা যা আমিই চি*ট করেছি।’

নিনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ভান করছিলাম! এইতো চো*র ধরা পরেছে!’

তখনই কলিং বেলের তীক্ষ্ণ টিং টিং শব্দ ভেসে এলো। ফাতিমা আপা উঠতেই যাচ্ছিলেন নিনা ওনাকে থামতে ইশারা করে নিজে লাফ দিয়ে উঠে গেল। দ্রুত পায় দরজার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিতেই অপ্র্যাত্যাশিত একজনকে আবিষ্কার করল। এ্যাভরিল দাঁড়িয়ে। গায়ে রেইনকোট। চুল কিছুটা ভিজে মুখের সাথে লেপ্টে আছে। চোখ মুখ কিছুটা ফোলা ফোলা। গাল দুটো লালচে দেখাল।
হয়তোবা বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডায় এমনটা হয়েছে। তবুও ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে ম্লান কন্ঠে বলল,
‘তুমি বলেছিলা এই বাড়ির দরজা নাকি আমার জন্য সর্বদা খোলা? নাকি এসে বিরক্ত করলাম?’

ওকে দেখে নিনা প্রথমে হতবাক হয়ে রইল। মনে বিচলতার বন্যা বইতে শুরু জরল। ইতস্তত করলেও চেহারায় তা প্রকাশ করলো না,
‘অবশ্যই খোলা। ভেতরে এসো।’

এ্যাভরিল এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ভেতরে ঢুকল। ও একা নয়। ওর সঙ্গে রয়েছে বড় একটা স্যুটকেস। নিনা সত্যিই অবাক না হয়ে পারল না। দরজা লাগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এ্যাভরিল সবকিছু ঠিক আছে তো তোমার বাসায়? নাহলে এভাবে হঠাৎ…কথাটা অসম্পূর্ণই রেখে দিলো।

‘হ্যা..মানে কিছু ঘটনা আছে। যেহেতু আমার বাড়ির কাঁদার ছিটা আমার সাথে সাথে তোমার বাড়িতেও এসে পরছে তোমাকে তো জানাতে হবেই। পরে ধীরেসুস্থে বলছি।’

‘না না এটা কেমন কথা? তুমি যখন চাও এবং কম্ফোর্টেবল মনে কর নিজেকে তখনই খুলে বলো।’ বলে নিনা সামনে এগোল। ড্রইংরুমে সোফার ওপর বসে ছিলেন ফাতিমা আপা। এ্যাভরিলকে দেখা মাত্রই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘ওহ নিনা তুই বলবি না তোর বন্ধু আসছে। আমি কিছু আয়োজন করতাম।’

‘আমি জানতাম না তো ও আসবে। আপনি ব্যস্ত হবেন না।’

এ্যাভরিলের স্যুটকেস দেখে আপা বললেন, ‘তুমি বোধহয় বেশ কিছু দিন থাকবা। তাই না?’
এ্যাভরিল আলতো করে মাথা নাড়ল। নিনা বলল,
‘না আসলে আপনাকে বলা হয়নি৷ তবে ও এখন থেকে এখানেই থাকবে। আপনি চিন্তা করবেন না কোন সমস্যা হবে না।’

এ্যাভরিল রেইনকোট টা খুলে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নিনা খেয়াল করে সেটা ওর হাত থেকে নিয়ে দরজার পাশের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দিল। ওকে লিভিং রুমে বসতে বলল। এ্যাভরিল জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসল। অস্বস্তিতে জর্জরিত হয়ে আছে ও। ফাতিমা আপা শশব্যস্তে রান্নাঘরে গেলেন খাবারের ব্যবস্থা করতে। নিনা এ্যাভরিলের পাশে বসল, ‘তুমি ফ্রেস হয়ে খেয়ে নাও। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।’

‘না না অত ব্যতিব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই আমি…. নিনা ওকে থামিয়ে দিল, ‘মেহমানের মতো আচরণ করা যাবে না। নিজের বাসা মনে করে থাক।’

‘কী এমন ভালো কাজ করেছিলাম যার বিনিময় তোমাকে পেলাম!’ অপ্রতিভ ভাবে হেসে বলল।

নিনা হাসল। এ্যাভরিল উঠে গেল ফ্রেস হতে। নিনা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সোফার পাশে। কপালে সূচালো রেখা। ভাবছে,
‘ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে মন খচখচ করত। আবার সত্যি সত্যিই যখন বাসায় এসে পরেছে তখনও কেমন জানি একটা লাগছে। একা থাকতে অভ্যস্থ আমি। বাসায় হইহট্টগোল পছন্দ করি না। ওর প্রতি যদি বিরক্ত হয়ে যাই তাহলে সেটা অন্যায় হবে। নিজেই ওকে বাসায় এনে, ওর ওপর বিরক্ত হওয়াটাও মানায় না। ওফ! এত হিসেব মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি তারপরেও আমার দ্বারা এত গন্ডগোল হয় কিভাবে?’

বেশ কিছুক্ষণ পর মি.মালিক ফিরলেন। ফাতিমা আপা ততক্ষণে খাবারের আয়োজন সেরে ফেলেছেন। নিনা পরিবেশন করছিল। মি. মালিক টেবিল দেখে মুচকি হেসে বললেন,
‘কী ব্যাপার আজকে চারটা প্লেট? নিনা তোর প্লেটটা ছোট হয়ে গিয়েছে?’

নিনা হাসল। ফাতিমা আপা বললেন, ‘না ভাইজান ওর বান্ধবী এসেছে। তার জন্যেই এই আয়োজন।’

‘আচ্ছা আপা আপনি আজ আমাদের সাথেই খেয়ে যান।’ বললেন মি.মালিক।

‘হ্যা বাবা আমি আগেই ওনাকে বলেছি। এইজন্যেই তো চারটা প্লেট।’ গ্লাস গুলোয় পানি ঢালতে ঢালতে বলল নিনা।

আপা চামচ, কা*টা চামচ সাজিয়ে রাখছিলেন। সেগুলোর টুংটাং শব্দ হচ্ছিল। মি.মালিক নিনার দিকে তাকালেন,
‘কে এসেছে? কোন ফ্রেন্ড?’

‘উম তোমাকে বলা হয়নি। এ্যাভরিল এসেছে। আসলে ও ঠিক শুধু আজকের জন্য আসেনি।’ ইতস্ততভাবে বলল নিনা।

‘আজকের জন্য আসেনি মানে? কয়েকদিন থাকবে?’ বলে প্লেট থেকে একটা চেরি টমেটো তুলে মুখে দিলেন।

‘না অনির্দিষ্টকালের জন্য আই মিন ও এখন থেকে এখানেই থাকবে।’

মি.মালিক ভ্রু কুঁচকালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন, ‘কেন ওর বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে? আমি ব্যাপারটা দেখব? ওকে কী বাসা থেকে বের করে দিয়েছে?’

‘না না সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমি নিজেও এখনো শুনিনি।’
এতটুকু বলে থামল। কথাটা আসলে নিজের কানেও হাস্যকর শোনাল। অবশ্যই কোন গুরত্বপূর্ণ একটা কারণে আজ এই বাড়িতে এসে উঠেছে ও। অথচ যার বাড়ি সে নিজেই জানে না গুরত্বপূর্ণ কারণটা কী?
বাকি কথাটা শেষ করল,
‘ও পরে ধীরেসুস্থে আমাকে জানাবে বলেছে।’ বেশ দ্বিধা মিশ্রিত কন্ঠে বলল।

‘ওহ। তো তুই নিশ্চিত কোন সমস্যা হবে না? হলে আমাকে বল।’

‘কী নিয়ে?’

‘মানে তোর এই বান্ধবীর কথা তো আগে কখনো শুনিনি৷ তাও আবার এমন সময় এলো যখন তুই একটা র*হস্য নিয়ে ব্যস্ত আছিস। দেখিস কোন ঝা*মেলায় জড়িয়ে যাইস না। মানুষের পক্ষে আরেকজন মানুষকে বোঝা সবচেয়ে সোজা মনে হতেই পারে। কিন্তু দুনিয়ায় সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে জটিল জীবও মানুষই। ও এখানে যতদিনই থাকুক আমার সমস্যা নেই। এখন তোর যদি মনে হয় ওর মধ্যে কোন সমস্যা নেই তাহলে তাই হোক।’

ফাতিমা আপা নরম কন্ঠে বললেন, ‘উনি ঠিক বলেছেন। আমি বলছি না মেয়েটা খারাপ হতে পারে। তবে একেবারে বাসায় যেহেতু জায়গা দিয়েছিস আমি বিশ্বাস করি তুই ওকে সেভাবে চিনিস বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।’

নিনা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। আরপকটু বেশি বিচলিত হলো। প্রথম মনে হলো নিজের মন মস্তিস্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রক্ষর। কোন মানুষের সঙ্গে একটু কথা বললেই তার সম্পর্কে অন্তর থেকে একটা অনুভূতির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কোথায় এ্যাভরিলের সঙ্গে এতবার কথা বলেও তো কখনো নেতিবাচক কোন অনুভূতির উপস্থিতি টের পায়নি নিনা। যেই মানুষটাকে আপন করে নিয়ে বাড়িতে স্থান দিল তাকে আসলেও বা কত দিন ধরে চেনে ও? কখনো তো অমিতকেও জিজ্ঞেস করেনি এ্যাভরিলের কথা। অথচ সাহাস্য করতে গিয়ে নিজেই না কোন বড় ভুল করে ফেলেছে এই আশঙ্কার গভীর সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। কিছুতেই সেখান থেকে উঠে আসতে চেয়েও পারছে না। মি.মালিক ফ্রেশ হতে নিজের কামরায় চলে গিয়েছেন। নিনা ডাইনিং টেবিলে নিজের চেয়ারে গুম মেরে বসে রইল। ফাতিমা আপা ধীরে ধীরে নিনার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। নিনার হাতের ওপর তার শক্ত হাতটা রাখলেন। চামড়া ঝুলে গিয়ে কিছুটা ভাজ পরেছে যদিও।

তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘মা আমি তোকে ছোটবেলা থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা দিয়েছি যে যাই হয়ে যাক, ‘নিজের ওপর থেকে আস্থা হারাতে নেই।’ আমি জানি তোর সিক্সথ সেন্স কতটা সুক্ষ্ণ। আমি জানি কখনো তুই মানুষ চিনতে ভুল করিসনি। হয়তো তুই ওকে সাহাস্য করার উদ্দেশ্যেই নিজের বাড়িতে জায়গা দিয়েছিস তাহলে সেটাই ধরে রাখ। একটা সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছিস তাতেই অটল থাক। এটা নিয়ে তুই যত চিন্তা করবি তত বেশি সন্দেহ বাড়বে। তত বেশি উৎকন্ঠা বাড়বে। এবং ওই মেয়েটাও তোর সাথে থাকতে অস্বস্তি বোধ করবে কারণ তোর মাথায় জিনিসটা আটকে থাকলে তুই সহজ হতে পারবি না।’

নিনা চোখ বুঁজে বুক ভরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। তখনই এ্যাভরিল হাজির হলো। এসে একটা চেয়ারের পেছনে দাঁড়াল। এখনো ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট আড়ষ্টতা। আপা বললেন,
‘বসো মা। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে নাও।’

এ্যাভরিল নিনার পাশের চেয়ারে বসল। নিনা উঠে গিয়ে নিজের কামরায় প্রবেশ করল। বাথরুম থেকে একবার মুখে পানি ঝাঁপটা দিয়ে আসলো। সকল সন্দেহ, বিভ্রান্তি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কতটা হলো ও জানে না তবে কিছুটা ভালো লাগলো। গিয়ে আবারও নিজের স্থানে বসল। মি.মালিক এসে ডাইনিংয়ে ঢুকতেই এ্যাভরিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গুড ইভিনিং আঙ্কেল।’

‘গুড ইভিনিং এ্যাভরিল। আরে বসো বসো দাঁড়িয়ে গেলে কেন?’ কিছুটা অবাক স্বরেই বললেন। সাধারণত এই মুল্লুকের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কিছুটা ম্যানারসের ঘাটতি থেকেই যায়। যা এশিয়ানদের মধ্যে পরিপূর্ণ রুপে ফুটে ওঠে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এ্যাভরিলের মধ্যে ম্যানারসের কোন অংশে কমতি নেই। যতক্ষণ না মি.মালিক বসলেন ততক্ষণ এ্যাভরিল দাঁড়িয়ে থাকলো। সকলে খাওয়া শুরু করার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত কামরায় নিরবতা বিরাজ করল। শোনা গেল শুধু চামচ নাড়ার টুংটাং শব্দ। মি.মালিক ও ফাতিমা আপা হাত দিয়েই খান। নিনা পুরোপুরি অভ্যস্ত নয় এ রীতিতে। এ্যাভিরল অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বিষয়টা পরখ করে বলল, ‘আপনারা হাত দিয়েই খান?’

‘হ্যা এটা আমাদের সাংস্কৃতিক আচার।’ বললেন মি.মালিক।
এ্যাভরিল নিনার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। নিনা কিছু বলার পূর্বেই মি.মালিক বললেন, ‘ওর মধ্যে এইসব আচার-আচরণ তেমন একটা দেখতে পাবে না তুমি। ও এখানে বেড়ে উঠার ফলে এখানকারই সব নিয়মনীতি আয়ত্ত করেছে। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক।’

‘বাবা আমার কী দোষ? যখন আমাকে হাত দিয়ে খাওয়া শেখাতে চেয়েছ ততদিনে আমি চামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। হাত দিয়ে খেতে কেমন অস্বস্তি হয়।’
ফাতিমা আপা মুচকি হাসলেন। এ বাড়িতে ফাতিমা আপার উপস্থিতির আরেকটি বড় কারণ বাঙালি খাবার রান্না। নিনা যেন সম্পূর্ণ রুপে বাঙালি খাবার-দাবার হতে বঞ্চিত হয়ে আমেরিকান খাবার খেয়েই বেড়ে না ওঠে সেটা নিশ্চিত করতেই ওনাকেই রান্নার দায়িত্বটাও দেওয়া হয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় মি.মালিক বাসায় থাকেন না বলে তখন এটাসেটা রান্না হলেও রাতে অবশ্যই বাঙ্গালী খাবার থাকবেই। এ্যাভরিল বেগুন ভাজার দিকে ইশারা করে বলল,
‘এটা অসাধারণ! খুবই সুস্বাদু।’

‘এটা বেগুন ভাজা।’ বললেন আপা।

‘আসলে বেশির ভাগ খাবারই আমার অচেনা তবে স্বাদে চমৎকার। আবারও মনে হচ্ছে এখানে এসে কোন ভুল করিনি।’

‘শুধু বাঙালি খাবার বলে কথা না আসল জাদু রাধুনির হাতেও রয়েছে। ফাতিমা আপার সব রান্নাই চমৎকার হয়।’ বলল নিনা।

‘এ্যাভরিল শোন এখানে থাকা নিয়ে তুমি কোন রকম চিন্তা করবে না। বিশেষ করে এটাকে নিজের বাড়িই মনে করো এবং তুমি এখানে একদম নিরাপদ।’ মি.মালিক বললেন।

‘ওহ হ্যা আঙ্কেল আমি হাউজ রেন্ট নিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম যে…মি.মালিক ওকে মাঝখান দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘না না মোটেও এই চিন্তা করো না। তুমি বিনা রেন্টেই এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারো।’

‘তা কী করে হয়। আমার হাউজ রেন্ট দিতে কোন সমস্যা নেই।’

‘সেটা জানি তোমাকে বললে তুমি অবশ্যই দেবে কিন্তু আমি নিতে চাই না। তোমার এখানে থাকা খাওয়ার বহন নিতে আমার কোন সমস্যা নেই।’

‘কিন্তু আঙ্কেল এভাবে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো না। আমার বিবেকে বাঁধবে। আমার রেন্ট আপনাকে নিতেই হবে।’

মি.মালিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘একটা কথা বলি শোন। নিনাই শুধু আমার এক মেয়ে নয় আমার দুটো মেয়ে। নিনা-নিমা। এখন নিনা তো আমার কাছেই আছে কিন্তু নিমাকে আমি আমার কাছে রাখতে পারিনি। ওর বাবা হিসেবে আমি ব্যর্থ। ও যদি এখানেই থাকতো, তখন ও যেমন নিজের বাড়িতে সবকিছু নিজের মতো আপন করে নিয়ে থাকত আমি চাই তুমিও সেভাবেই থাকো। ওর নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ও এখানে আসতে চায় না সেখানে তোমাকে কেন বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে, আমি জানি না। তবে আশা করছি বুঝতে পারছ। তুমি যদি বিনা রেন্টেই থাক তাহলে হয়তো আমার ব্যর্থ বাবা হওয়ার আফশোস কিছুটা কম মনে হবে।’
এতক্ষণ যাবৎ সকলেই খাওয়া থামিয়ে নিশ্চুপ বসেছিল। এ কথা বলার পর আর কিছুতেই এ্যাভরিল ওর রেন্ট দেওয়ার জেদটা ধরে রাখতে পারল না। অবশেষে হালকা হেসে বলল,
‘ঠিক আছে আঙ্কেল। আপনি যেভাবে চান সেভাবেই হোক।’
মি.মালিক মুচকি হাসলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষেই ফাতিমা আপা প্রস্থান করলেন। মি.মালিক যেহেতু সকাল সকাল বেরিয়ে যান কাজেই উনি আগে আগে শুতে চলে যান৷ অথবা কোন কাজ বাকি থাকলে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেন। প্রথমে নিনা এ্যাভরিলকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিল। অতএব এ্যাভরিল সেখানেই গিয়ে ঢুকেছে। নিনা ওকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরতে তাড়া দিচ্ছে। পাশাপাশি কামরায় কোথায় কী আছে তাও দেখিয়ে দিল। গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে ভাবল, ‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আমার নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা উচিৎ। পাশাপাশি চোখকানও খোলা রাখা উচিৎ।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।