মনোভূমির ছায়া পর্ব-৭+৮+৯

0
58

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৭
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

বাসায় এসে জুসের বোতলটা আর ব্যাগ থেকে বের করল না নিনা। সন্ধ্যার পর যখন মি.মালিক বাসায় ফিরলেন একেবারে তখনই বের করল। বের করে মোড়ানো কাগজ গুলো খুলে বোতলটা টেবিলে রাখল। মি.মালিক ওনার ল্যাপটপ খুলে বসেছিলেন ওনার স্টাডি টেবিলে। নিনা কোন আগুপিছু না ধরে সোজা বোতলের কথা তুললো,
‘এটা সেই জুসের বোতল যেটা অরল্যান্ডো এনেছিল এবং যেই জিনিস টনি শেষবারের মতো খেয়েছিল।’

মি.মালিক অবাক হলেন, ‘তুই এটা কিভাবে উদ্ধার করেছিস?’

‘গার্বেজ বিন থেকে।’ নিনা নির্বিকার।

‘তুই টনির বাড়ির গার্বেজ বিনও সার্চ করেছিস?’

উত্তরে চোখের মণি ঘোরালো নিনা৷ চিন্তার ছোঁয়া পরল মি.মালিকের কপালে,’কেউ স*ন্দেহ করতে পারতো নিনা। ওই বাড়ির মানুষগুলোকে আমার মোটেও সুবিধের লাগেনি।’

নিনা আলতো করে মাথা নাড়ল। ‘বোতলটা যখন নিচ্ছিলাম তখন একটা কোরিয়ান মেয়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তবে ওকে আমি সামলে নেব৷ অত চিন্তা করো না।’

মি.মালিক গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লেন। জুসের বোতলটার দিকে তাকালেন, ‘আমি এটা টেস্টের জন্য পাঠাচ্ছি।’

কিছুক্ষণ মৌন থেকে আবার বললেন,
‘তোকে আবারও সাবধান করছি উল্টা পাল্টা কিছু করিস না। তুই তোর পাগলামোর কারণে আগেই কম মাথা খারাপ করিসনি আমার। প্লিজ এইসব ত*দন্ত টদন্ত করতে গিয়ে আবারও বিপদে পরিস না। তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’

‘বাবা ওকে তো তুমি হারিয়ে ফেলোনি। তুমি নিজেই ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছো।’ নিনার কন্ঠে সুক্ষ্ম অভিমানের ছোঁয়া।

‘আমি নিমাকে দূরে ঠেলে দেইনি৷ ও নিজেই আর ফিরে আসতে চায় না।’
নিনা ঝট করে উঠে দাঁড়াল, ‘গুড নাইট।’ বলেই বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।

————————-

‘আমি কোনটা নিব?’ ম্যাশ পটেটো এবং গাজরের হালুয়ার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল অমিত। নিনা ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে হাসাহাসি ও হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। চামচ, কাঁটাচামচ নাড়াচাড়ার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। বড় হলের মতো ক্যাফেটেরিয়া। একপাশে বুফের মতো সারি সারি নির্দিষ্ট আইটেম গুলো রাখা৷ অবশ্য প্রতি সপ্তাহে কিছু কিছু পদের বদল ঘটে। তবে ক্যাফেটেরিয়ার খাবার খেয়ে ক্যান্সার ধরে যাওয়ার গুজব আছে বটে। কিন্তু অত পাত্তাই বা কে দেয়? ক্যান্সার একবার ধরে গেলে তখন দেখা যাবে।
অমিত সেই তখন থেকে ম্যাস পটেটো এবং গাজরের হালুয়ার মাঝে ঝুলে রয়েছে। নিনা বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘অমিত কী আশ্চর্য যেকোনো একটা নে না। এটায় এত ভাবার কী আছে বুঝলাম না।’

‘আরেহ ভাই আমি প্রতিদিন ম্যাস পটেটো নেই। আজ অনেকদিন পর ওরা গাজরের হালুয়া বানিয়েছে। এটা নিতে চাই আমি কিন্তু ম্যাস পটেটোও আমার নিতে ইচ্ছে করছে।’

‘তাহলে দুইটাই নে।’

‘না দুইটা নিলে বেশি হয়ে যাবে।’

‘আরেহ আমরা কী নিবো না? আর কতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবা তোমরা?’ নিনার পেছনে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। তাদের কেউ একজন বলল কথাটা। নিনা অতিষ্ঠ হয়ে ম্যাস পটেটো চামচ ভরে তুলে দিল অমিতের প্লেটে। তারপর গাজরের হালুয়াও চামচ ভরে তুলে দিল। অমিত চোখ ছানাবড়া করে বলল, ‘হায় হায় এগুলো কী করলি?’

‘চল এখন।’

‘না, আমি তো এতো খেতে পারবো না।’

‘তাহলে কোনটা তুলে রাখ!’ ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল নিনা।

‘কেনটা তুলবো?’

নিনা এবার চামচ দিয়ে ম্যাস পটেটো এবং হালুয়া দুটোই ঘেঁটে মিশিয়ে দিল। অমিতের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাল, ‘অমিত এমন চলতে থাকলে কোনদিন এমন অবস্থা দাঁড়াবে যে নিঃশ্বাস নিতে হবে কী হবে না এটা নিয়েও তুই দ্বিধায় পরে যাবি!’ বলে নিজের প্লেট নিয়ে গটগট করে চলে আসল। কিন্তু কোথায় বসবে ঠিক করতে পারলো না। অমিত যেই টেবিলে সবসময় বসে বলেছে সেখানেই আবার ইভানও বসে কাজেই ওখানে বসা যাবে না। ইতোমধ্যেই ইভানের সঙ্গে কম দিক থেকে জড়িয়ে যায়নি ও। আর অহেতুক একই টেবিলে গিয়ে বসতে চায় না। কিছুক্ষণ এদিকওদিক চোখ বুলানোর পর একটা টেবিলে এসে চোখ আটকালো। লিজা বসে রয়েছে। সাথে আরো দুজন বসে আছে, এদের একজনকে চিনতে পারলো নিনা। এমিলি গ্রেউড। এবং একটা চেয়ার খালি রয়েছে। নিনা সেদিকেই এগোল। হেঁটে যাওয়ার সময় পাশের একটা টেবিল থেকে হঠাৎ ইভানের কন্ঠ শোনা গেল,
‘হেই ডার্লিং! আমি তো ভেবেছিলাম লাঞ্চ টাইমেও আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকবা। অন্য দিকে যাচ্ছো যে। তোমার জন্য জায়গাও খালি রেখেছি, দেখো।’
নিনা থেমে। ইভানপর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। বলল, ‘আমি তোমার সাথে লেগে নেই। ঘটনাপ্রবাহে আশ্চর্যজনক ভাবে বারবার তুমি আমার সামনে এসে পরছো। সেক্ষেত্রে আমিও বলতে পারি তুমি আমার গলায় ঝুলে গিয়েছো হানি।’

ইভান গায় জ্বালা ধরানো দাম্ভিক হাসি টা দিয়ে বলল,
‘তাই নাকি। আই থট তুমি আমাকে জ্বালানোর পণ করেছো। কাজে এক, মুখে আরেক।’

‘মোটেও না। তাছাড়া তুমি যেখানে আছো সেখানে আমি অন্তত থাকতে চাই না।’ বেশ গম্ভীরমুখে ঠান্ডা গলায় বলল নিনা। বলেই হেঁটে চলে আসল। টনির কাছ থেকে আজ পর্যন্ত ইভান সম্পর্কে যাই কিছু শুনেছে তার কোন কিছুই ইতিবাচকতাকে সামান্যতমও ইঙ্গিত করতো না। অমিতের কথায়ও একই সুর। আর এখন তো নিজের চোখেই তার প্রমাণ পাচ্ছে। যদিও হঠাৎ করে ইভানের আচরণের পরিবর্তন নিনাকে একটু নাড়া দিয়ে গিয়েছে। মনে মনে ভাবল, ‘ওর ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না। একেক সময় কেন একেক রকম ব্যবহার করে?’
সোজা হেঁটে গিয়ে লিজাদের টেবিলের পাশে দাঁড়াল। লিজার পূর্বে এমিলি লাফ দিয়ে উঠল। পান পাতার মতো দেখতে মুখখানা। কালো চোখের মণি। তবে গোল্ডেন ব্রাউন চুল। হাসিমুখে বলল, ‘হেই আমি এমিলি। বসো আমাদের সাথে।’
নিনা ট্রেটা টেবিলে রাখল। তারপর চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

ইভান সেদিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘কী চলছে ওর মনে? আমার বোনের সাথে এত কিসের কথা ওর? কেন সবাই আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমার বোনের পেছনেই লাগে? এই মেয়েটার ব্যাপারটা আরোও খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।’

লিজা নিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কেমন আছো?’
‘এইতো ভালোই।’
‘তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে।’ এমিলি ভ্রু কুঁচকে বলল।
গতকাল ওরই বাড়িতে উপস্থিত ছিলো সেটা বলবে কিনা সে ব্যাপারে দ্বিধায় পরে গেল। বলল, ‘একই স্কুলে যখন পরি আমরা, দেখেছ হয়তো আগেও।’

‘হুম হতে পারে।’ বলে কিছু একটা ভাবলো। তারপর আবারও উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা তোমার পরিচয় যে দিলে না?’

নিনা কিছু বলার পূর্বেই লিজা বলল, ‘ও নিনা। আমাদের বাড়িতে এসেছিল জানিস। আমার সাথে অনেক গল্প করে গিয়েছে।’
এমিলি কিছুটা অবাক হলো, ‘ওদের বাড়ি গিয়েছিলা? কবে?’

‘এইতো পরশু। ভাইয়াকে একটা চিঠি পৌঁছে দিতে।’ এবারও লিজা উত্তর দিলো।
নিনা বিরক্ত হয়ে ভাবল, ‘লিজা অতিরিক্ত দ্রুত কথা বলে।’

‘ওহ তুমি এখন এসব দায়িত্ব পালন করছো?’ জিজ্ঞেস করল এমিলি।

নিনা বলল, ‘না। আমি জাস্ট ওই টাইমে কাউন্টারে ছিলাম। ওদের একটু ঝামেলা হয়েছিল তাই এমনিই জিজ্ঞেস করেছিল আমি করতে পারবো কিনা।’

‘ওহ আচ্ছা। তাই বলো। জানো লিজা আমাকে ওর বাসায় ডাকেই না। আসতে চাইলেও মানা করে দেয়।’

‘হ্যা ও আমাকে বলেছিল বন্ধুদের আনাগোনা মিসেস দানির তেমন পছন্দ করেন না।’

লিজা মুখ গোমড়া করে বলল, ‘আমি আর কী বলবো!’
তখনই নিনার চোখ পরল খাবারের বারগুলোর দিকে৷ হাতে ট্রে নিয়ে বারের সামনেই সেই কোরিয়ান মেয়েটা দাঁড়িয়ে। নিনাকে আরেকবার চমকে দিয়ে ঠিক ওর দিকেই অনিমেষ তাকিয়ে আছে। মেয়েটা ধীরে ধীরে হেঁটে ওদের টেবিলের দিকেই আসছে। নিনার অস্বস্তি বোধ হলো। শুধু ওর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকাই নয় তার সঙ্গে গতকাল ওকে গার্বেজ বিনের সামনে দেখে ফেলার বিষয়টিও নিনাকে চিন্তিত করে তুলেছে। মেয়েটা টেবিলের দিকে এগিয়ে আসলেও ও আসলে টেবিলের পাশ দিয়ে পার হতে যাচ্ছিল। তবে লিজা টিটকারির সুরে বলল, ‘হারিন তোমার যদি নোট আজকাল বেশি হয়ে যেয়ে থাকে তাহলে আমাকে কয়েকটা দিতে পারো৷ আগামী বছরের জন্য না হয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে যাবে।’ ওর কথা বলার বিদ্রুপাত্মক সুরটাই নিনাকে অবাক করে দিতে যথেষ্ট ছিল। হারিন থেমে গেল। লিজার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘নিজের সম্পর্ক গুলোই তো সামলাতে পারো না লিজা। বড় হও তখন যদি অন্তত নোট সামলাতে পারো।’

নিনার নিকট লিজা থেকেও হারিন মেয়েটার বলা প্রতিটা শব্দ শতগুণ বেশি ধারাল ঠেকলো। এগুলো টিটকারি নয় বরং গভীর অপমান ছিলো। যেই কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে পারলো না নিনা। টেবিলে রাখা লিজার হাত কেঁপে উঠল। চোখে অনলের ঝিলিক। হারিন গটগট করে হেঁটে চলে গেল। এমিলি শান্ত কন্ঠে লিজার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, ‘এগুলো কী ধরনের কথা লিজা? ওকে এসব বলতে গেলে কেন?’

নিনা ভাবল, ‘নোট! হারিন কাকে নোট দিত? হারিনই কী টনির বলা সেই মেয়েটা যে ওকে নোট দিত? টনি এখন আর না থাকায় হারিন আর ওকে নোট দিতে পারবে না। কিন্তু লিজা এই ব্যাপারটা নিয়ে ওকে টিটকারি মারতে যাবে
কেন?’ ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করল, ‘হারিন কাকে নোট দিত?’

‘টনিকে।’ বলল এমিলি। একটু থেমে আবার বলল,
‘এবং মেয়েটা আসলে খারাপ না। কিছুদিন আগে আমার কয়েকটা নোটের প্রয়োজন ছিলো। তখন টনি হারিনকে এ কথা জানাতে হারিন নিজের আগের বছরের নোটগুলো সব আমাকে দিয়ে দিয়েছিল।’

‘আহা তার উদারতায় বাঁচি না!’ মুখ বাঁকা করে বলল লিজা।

————————-

স্কুল ছুটির আধঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ স্কুলে নিরবতা নেমে এলো। দুপুর বেড়েছে সাথে বেড়েছে রোদের তেজ৷ রোদের তীব্র তেজে চোখের পাতা বুজে আসে। বড্ড ব্যস্ততার সমেত গাড়িঘোড়া ছুটে চলেছে রাস্তা ধরে। এইসব চলমান যানবাহনের সাপেক্ষে নিনা স্থির দাঁড়িয়ে সাইডওয়াকে। রাস্তা পার হয়ে ড্রাগ স্টোরে ঢুকবে একটু। এরপর আবার ফিরে আসবে স্কুলে। আজ অন্যদের মতো ছুটির পরও ওর ছুটি নেই। শাস্তি ভোগ করতে হবে যে। ঠিক তখনই চোখ পরল একটা মেয়ের দিকে। নিনার সঙ্গে একই দিকের সাইডওয়াকে অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ গাড়িগুলো পরপর যাওয়ার পর রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হলো তবে একটা মিনি ট্রাক আসছিল। সেটা দেখে মেয়েটা থেমে গেল। ট্রাকটা পার হতেই দ্রুত গতিতে পা চালালো তবে ট্রাকের আড়ালে যে একটা ট্যাক্সিও ছিল তা বোধহয় ওর চোখে পরেনি। ট্যাক্সিটা চোখে পরতেই মেয়েটা থমকে গেল। ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গিয়েছে। রাস্তার মাঝে মেয়েটা সজোড়ে ট্যাক্সিটার সঙ্গে ঢা*ক্কা খেয়ে ছি*টকে পরল। তবে খুব বেশি জোরে নয়। নিনা প্রথমে বিস্মিত এবং হতভম্ব হয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল সেদিকে। ট্যাক্সিটা না থেমে দ্রুত গতিতে কেটে পরল। নিনা গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পরেছে ওর পাশে। ফুটপাথ দিয়ে চলাচলরত পথচারীরা কেউ কেউ থেমে গেল। পেছন থেকে যেসব গাড়ি আসছে সেগুলোও ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। নিনা নিজের ব্যাগ থেকে পানি বের করল। মেয়েটার হাঁটু ছিঁ*লে গিয়েছে গভীর ভাবে৷ তিরতির করে র*ক্ত গড়িয়ে পরছে। একজন মহিলাও এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটার পাশে। নিনা ওর বড় ব্যাগ হাতড়ে যত গুলো টিস্যু পেল সব বের করে ক্ষ*ত স্থানে ধরলো। মহিলাটা সাহায্যের জন্য টিস্যুগুলো চেপে ধরে রাখলেন। নিনা ব্যাগ ঘেটে ব্যান্ডেড রোল বের করল। এরপর টিস্যু সহ ওর পায়ে প্যাঁচাতে থাকল। মেয়েটার লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। ভাগ্যিস জ্ঞান হারায়নি। মহিলা বললেন, ‘ওকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া দরকার৷’
মেয়েটা কেমন আঁতকে উঠল। এতক্ষণে উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘না! আমি হাস*পাতাল যাব না। আমি ঠিক আছি।’

নিনা মেয়েটার হাত নিজের ঘাড়ে রাখল। মহিলাটিও এভাবেই আরেক পাশ থেকে মেয়েটাকে ধরে তুলার চেষ্টা করলেন। মেয়েটা হালকা ভর দিতে পারলো। তবে নিজে হাঁটার মতো অবস্থা নেই৷ কোনরকমে ওকে ফুটপাথের একটা বেঞ্চিতে এনে বসাল। নিনা বলল, ‘দেখো এভাবে থাকলে তো হবে না। হাস*পাতালে যেতেই হবে।’
মেয়েটা অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘দেখো একটু বুঝার চেষ্টা করো। আমার পক্ষে হাস*পাতালে যেতে চাই না।’ তারপর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।’ মহিলাটি মাথা নাড়ল তারপর চলে গেল। নিনা মেয়েটার পাশে বসে বলল, ‘তোমার নাম কী?’

‘ইম…আই মিন এ্যাভরিল।’

‘কিন্তু এখন কী করা যায় বলো তো? পায়ের এই অবস্থা নিয়ে তো আর চলাফেরা করতে পারবে না।’

‘আমি পারবো। আমাকে পারতেই হবে। প্রতিদিন তো আর তোমার মতো কাউকে পেয়ে যাব না যে আমাকে সাহায্য করবে।’
নিনা ভালোভাবে তাকাল মেয়েটার দিকে। ওর চেহারাটা কী মিষ্টি। ডিম্বাকৃতির মুখ। মায়াভরা ছোট ছোট টানা চোখ। লালচে বাদামি স্ট্রেইট চুল। লালচে ফ্রেকল ভরা নাকের আশপাশটা। নিনা বলল,
‘তাহলে এখন কী করবা?’

‘বসে থাকবো এখানেই যতক্ষণ না একটু ভালো লাগে।’
নিনা উঠলো না। আবারও ব্যাগ খুললো। ব্যাগ থেকে ছোট একটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করল। মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চকলেট খেলে ভালো লাগবে যদি তোমার আমার পছন্দ মেলে।’
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল। চকলেটটা হাতে নিয়ে বলল,
‘অবশ্যই আমাদের পছন্দে মিল আছে।’

‘কোথায় পড়ো তুমি?’

‘যেই স্কুলের সামনে বসে আছি সেখানেই।’

‘ওহ তাহলে আমরা একই স্কুলে।’

‘বাহ তাই নাকি! কোন গ্রেড?’ জিজ্ঞেস করল এ্যাভরিল।

‘সিনিয়র।’

‘আমরা তাহলে একই গ্রেডে!।’ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল ও।

‘তোমাকে তো দেখিনি এর আগে।’

‘দেখবা কিভাবে, আমি স্কুলে আসি না তো সেরকম।’

‘কেন?’

‘কাজে ব্যাস্ত থাকি তাই।’ চকলেটে কা*মড় বসিয়ে বলল মেয়েটা। কিছুক্ষণ দুজনেই মৌন থাকলো। হালকা বাতাস হচ্ছে। বেঞ্চির ওপরে ভাগ্য করে একটা গাছ আছে। কাজেই আর রোদে পুরতে হচ্ছে না। এ্যাভরিল বলল,
‘স্কুল তো বেশ কিছুক্ষণ আগে ছুটি হয়ে গিয়েছে। তুমি এখনো এখানে কী করছো?’

‘আমি ডিটেনশন পেয়েছি তাই কাজ আছে এখনো।’

‘ইশ গন্ডোগলের শেষ নেই। মারা*মারি, খুনা*খুনি সব অবাধে চলছে।’

‘কিসের খু*নাখু*নি?’ ভ্রু কুঁচকালো নিনা।

‘কথার কথা। যাই হোক এটা বলো আমি না হয় কদাচিৎ আসি কিন্তু তোমাকে কখনো দেখিনি কেন?’

‘কারণ আমি দুইদিন আগেই এই স্কুলে এসেছি।’

‘হাই স্কুল শেষ হওয়ার দুমাস আগে?’ বলে হাসল। তারপর বেশ সিরিয়াস ভাবে বলল, ‘তাহলে শোন একটা এডভাইস দেই।’

‘কী?’

‘বুলিদের থেকে সাবধান থেকো। কোন গন্ডো*গোলে নাক গলাতে গেলে অন্যদের কিছুই হবে না উল্টো তুমিই বি*পদে পরবা।’

‘ওহ ইয়াহ জাস্ট লাইক ইভান।’ চোখের মণি ঘুরিয়ে বলল নিনা।

‘কী? ইভান?’

‘উম হ্যা। ওইটা তেমন কিছু না।’

এ্যাভরিল হালকা হেসে বলল, ‘ওহ তুমি ভুল বুঝাদের দলে পরেছো। ইভান খুব ভালো একটা ছেলে।’

‘ ইউ মিন “ইভান” ভালো একটা ছেলে?’ চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘হ্যা। অবশ্যই। তুমি ওর সাথে ভালো ব্যবহার করো, তাহলেই ও-উ তোমার সাথে সেরা ব্যবহারটাই করবে।’

‘আচ্ছা দেখব।’ কী ভেবে যেন বলল নিনা।
এ্যাভরিল হাসল। বলল, ‘আচ্ছা তোমার দেরি হচ্ছে না?’
নিনা উঠে দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সিকে হিচহাইক করল। ট্যাক্সিটা ওদের সামনে এসে দাঁড়াতেই এ্যাভরিল চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘দেখো আমি ট্যাক্সিতে যাবো না। আমি একাই চলে যেতে পারবো।’

‘না এ্যাভরিল তুমি হাঁটতেও পারছো না ঠিক মতো। এভাবে তো আর তোমাকে ফেলে রেখে যেতে পারবো না।’
এ্যাভরিল কোন রকমে নিজেই উঠে দাঁড়াল। যদিও ওর পা টলছে। অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘প্লিজ আমি ট্যাক্সিতে যেতে চাই না। আমার কথাটা শুনো।’

‘কিন্তু কেন?’

‘এমনি। আমি জাস্ট যেতে চাই না।’ নিনা কোন কথা শুনলো না। ওকে জোর করে ট্যাক্সিতে বসিয়ে দিলো। মেয়েটার কপালে গভীর রেখা। চোখে অস্থিরতা। নিনা ড্রাইভারকে কিছু একটা নিচু স্বরে বলল। জানালা দিয়ে মুখ বারিয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না ঠিকঠাকই বাসায় পৌঁছে যাবা। আবার দেখা হবে।’ তবে এ্যাভরিল বিচলিত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল। অতি কষ্টে হালকা একটু হাসার চেষ্টা করল। গাড়ি চলতে শুরু করল। ড্রাইভার ওকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে, ও ঠিকানা বলল। তবে ধীরে ধীরে চিন্তায় এ্যাভরিলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অস্থিরতায় দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। অবশেষে যখন গাড়িটা ওর বাসার সামনে এসে পৌঁছল ততক্ষণে গলা শুঁকিয়ে কাঠ। স্নায়ুতে অস্বাভাবিক চাপ। কোন ক্রমে ধরে ধরে গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ড্রাইভার কে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার বলল, ‘ওই মেয়েটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে৷ ধন্যবাদ।’ বলে চলে গেল। এ্যাভরিলের যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। ঘাম দিয়ে জ্বর সারল। কিছুটা শান্তিতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল।

———————

নিনা যখন পরিষ্কার করার সরঞ্জাম নিয়ে বাস্কেটবল কোর্টে পৌঁছলো তখন কিছুটা দেরিই হয়ে গিয়েছে। গিয়ে দেখা গেল ইভান নিজের কাজ কিছুক্ষণ পূর্বেই শুরু করে দিয়েছে। ইভান একদিকের গ্যালারি পরিষ্কার করছে। নিনা অপর দিকের গ্যালারিতে ঢুকলো। ইভান লম্বা ঝাড়ু দিয়ে ময়লা গুলো টেনে একদিকে আনছে। বলল, ‘তুমি আরেকটু দেরি করলে তো ধরেই নিতাম তোমার যত নিয়মনীতি অন্যের বেলায়। নিজের বেলায় মাফ।’
এতবড় কোর্টটা একেবারে খালি বলে ইভানের কথা কিছুটা প্রতিধ্বনিত হলো। নিনা বলল, ‘আমি না আসলেই বোধহয় তুমি বেশি খুশি হতে। তাই না?’

‘তুমি কেনো ভাবো যে সকলে কোন না কোন কারণে তোমাকে দেখতে পারে না?’

‘সেটা একেকজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাট তুমি তো আমাকে এমনিতেও পছন্দ করো না। এটার মানেটা কী?’

‘আমি তোমাকে কখন বলেছি যে আমি তোমাকে পছন্দ করি না?’

‘তার মানে করো?’ নিনা ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন করল।

‘না।’ ইভানের উত্তর নিনার ঠোঁটের কোণে সামান্য সময়ের জন্য হালকা একটা হাসির রেখা টেনে দিল।

ইভান স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো। তুমি গায়ে পরে এই শাস্তিটা নিলে কেনো?’

‘আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরটা আমি স্টাফ রুমেই দিয়ে দিয়েছিলাম।’

ইভান হাসলো। বলল, ‘তোমার মনে হয় সেটা বিশ্বাসযোগ্য?”

‘বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার।’ বলে ময়লাগুলো ঝাড়ু দিতে দিতে ইভান যেখানে ময়লা জমা করেছে সেখানে টেনে আনলো। এবার নিনা জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এর আগে কখনো ডিটেনশন পেয়েছ?’

‘বেশ কয়েকবার’

‘তাহলে এই ডিটেনশনটা এত গায়ে লাগলো কেন?’

‘কারণ এর আগের গুলোতে আমি যা গন্ডো*গোলে জড়িয়েছি তা সবার সামনেই জড়িয়েছি। বাট এবারের টা ডিফারেন্ট।

‘ওহ।’

‘জানো তো, তোমাকে দেখলেই মনে হয় রুলস এন্ড রেগুলেশনের গডেস। কী আর জিজ্ঞেস করবো।’

‘কোন কথা কী স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারো না?’ তিক্ত কন্ঠে বলল নিনা। ইভান দাম্ভিক হাসলো,
‘স্বাভাবিকভাবেই তো বলছি। তুমি মনে হয় প্রতিটা কথা একটু বাঁকা ভাবেই শুনতে পাও?’

নিনা দাঁতে দাঁত চাপলো। রাগ মাথায় চড়ে বসছে তবুও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। ভাবল, ‘কোন মানুষ এতটা অসহ্যকর ভাবে কিভাবে কথা বলতে পারে। আশ্চর্য!’

ইভান আমুদে স্বরে বলল, ‘ভাবছো কোন কুক্ষণে শাস্তিটা গ্রহণ করতে গিয়েছিলাম তাই না?’

‘আসলে শাস্তিটা কোর্ট পরিষ্কার করা নয়। শাস্তিটা হলো তোমার সাথে কাজ করা।’ শীতল কন্ঠে বলল নিনা।

‘বাপরে বাপ আমি কারোও ওপর এত সহজে প্রভাব ফেলতে পারি জানতাম না তো।’ নাটকীয় ভাবে বলল। এবার নিনার মনে হলো রাগে রি রি করে গা জ্বলছে। এতক্ষণ ওরা একই সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করছিল। নিনা সেখান থেকে সরে পাশের সারিতে গিয়ে ঢুকলো। এবং যতটা দ্রুত গতিতে কাজ করা যায় তত দ্রুত কাজ করতে লাগলো। ইভান সেটা খেয়াল করে মুচকি হাসল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ওদের দুজনের কেউ কোন কথা বললো না। শুধু শোনা গেল ঝাড়ু দেওয়ার শাট শাট শব্দ। নিনা ভাবছে, ‘এই ছেলেটা খুবই অস*ভ্য, অসহ্যকর! ওর সাথে আধাঘন্টা থেকেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কিভাবে আমি কিছু করবো? এত প্যাঁচ কেন ওর মধ্যে? গতকালই আমাকে এমন ভাবে হুম*কি দিয়ে গেল যেন আমাকে খু*নই করে ফেলবে। আর চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এত পরিবর্তন যে এখন লিটারালি ফ্লার্ট করছে আমার সাথে? তার সাথে সাথে আবার সুযোগ বুঝে খোটাও দিচ্ছে। বাহ! টনি ঠিকই বলেছিল,
“ইভানের সঙ্গে আমি সাধারণত গন্ডো*গোলে জড়াতে চাই না৷ তবে ওর সমস্যাটা কী বুঝি না৷ এমন ভাবে কথা বলে সে যে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।”
কিছুদিন পূর্বে ফোনে বলেছিল টনি এই কথা। নিনা ভাবনায় ডুবে থেকে কিছুটা শান্ত হয়েছে।

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’ স্বাভাবিকভাবেই বলল নিনা।

‘জিজ্ঞেসই তো করছো আমার অনুমতি ছাড়া।’

নিনা বিরক্ত হয়ে চোখের মণি ঘোরাল। বলল,
‘তোমার কখনো মনে হয় না যে কতগুলো মানুষ তোমার জন্য বিরক্ত হতে পারে? তোমার ওপর তাদের ক্ষোব থাকতে পারে। কতগুলো মানুষ তোমাকে অপছন্দ করে।’

ইভান হেসে বলল, ‘বিরক্ত?, ক্ষোব? প্রশ্নই ওঠে না।’

‘কিসের প্রশ্ন ওঠে না?’

‘দেখো যেইসব মানুষকে আমি আমার কাছে রাখতে চাই।তারা তো আমাকে ভালোবাসে। এখন অন্য কেউ বিরক্ত হলেও কী আর না হলেও কী? আমার কিছু যায় আসে না। তাছাড়া কে আমাকে পছন্দ করল না করল তাতেও আমার কিছু যায় আসে না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার তাদের প্রতি কোন ফিলিংস আছে।’

‘হুম এই জন্যেই মনে হয় এত মানুষ থাকতে তোমার সাথেই অনেকের শত্রুতা।’ এই কথায় ইভান হাসল না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। তারপর বলল,
‘এক হাতে তালি বাজে না জানো তো? যদি কারো সাথে শত্রুতা থেকে থাকে দুদিক দিয়েই সমান ভাবে ছিলো।’
নিনা কিছুই বললো না। শুধু কাজ থামিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ইভানই আবার বলল, ‘আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করে অমিত কী ভেবে বোকা ব্যাঙের মতো গরম পানির হাঁড়িতে বসে আছে। ও সহজ সরল জানতাম কিন্তু এতটা বলদ ওটা জানতাম না।’

‘মানে টা কী?’

‘কী আবার তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা আর ব্যাঙের মতো গরম পানির হাঁড়িতে বসে থাকাটা একই কথা না?’

এবার মনে হলো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো ক্রোধ ফেট পরছে মাথায়। মত তবু দাঁতে দাঁত চেপে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল। বলল, ‘এমন ভাবে বলছো যেন আমি কোন মানুষ নই ডাইনি। অবশ্য তুমি মনে হয় আমাকে তাই ভাবো। তাই না?’

‘আমি কী বলেছি এ কথা একবারও? কথাটা তো তুমি নিজেই তুললে।’

‘বলা লাগবে কেন? তোমার কথার ধরনে এটা বোঝাই যায়।’

‘আহা দেখেছো এই যে বলেছিলাম তুমি সব কথা শুনতেই পাও বাঁকা ভাবে। এখন আমার কী দোষ?’ জুলজুল চোখে তাকিয়ে বলল।
নিনা এবার কাজ থামিয়ে দিয়ে ইভান যেদিকে দাঁড়িয়ে সেদিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমার আমার সাথে সমস্যা টা কী ইভান?’
ইভানও থেমে গেল। নিনার দিকে সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নিনা সমস্যা একটাই, সেটা হলো তুমি কোন কিছুকে জাস্ট ছেড়ে দিতে পারো না। স্বাভাবিকভাবে চলতে দিতে চাও না। কেন সবকিছুর একটা কারণ বা মোটিভ থাকাই লাগবে?’

নিনা লম্বা একটা শ্বাস ফেললো। আর কিছুই বললো না। দ্রুত হাত চালাতে চালাতে দুদিকের গ্যালারি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। এরপর বাস্কেট বলের ময়দানটায় মপ করতে আরম্ভ করল। সেটাও বেশ কয়েক মিনিট খানেকের মধ্যে অর্ধেক করে ফেললো। নিনা ফ্লোর মুছতে মুছতে ইভানের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ছিল তখন ইভান বলল, ‘যেভাবে কাজ করছো তুমি আসলেই কাজের প্রতি এতটা ডেডিকেটেড নাকি আমার সামনে থেকে দূর হওয়ার জন্য?’

‘দুটোই।’

‘হুম আমিও দেখছি কিছু না করেই তোমার অপছন্দের তালিকায় এসে পরেছি।’

‘আমি সিওর শুধু আমার না তুমি অনেকেরই অপছন্দের তালিকায় আছ।’

‘ওমা কত্ত খারাপ আমি। তাই না?’

‘আসলেই। যেন তুমি কিছুই করোনি।’ কথাটা এতটা তিক্ততা ভরে বলল নিনা যে ইভান থমকে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কী করেছি?’ নিনা থেমে গেল। হঠাৎ মনের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভগুলো উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। নিনা আত্মসংযম করে বলল, ‘বিরক্ত। আমার কাজ শেষ।’ বলেই হাঁটা ধরছিল কিন্তু ইভান শক্ত করে বাহু আঁকড়ে ধরল ওর। নিনা থমকে গিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল কিন্তু কিছুই বলল না। ইভানের কাঠ পোড়া ছাইয়ের মতো ধূসর চোখের মণি রহস্যে ঘেরা। ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখের পাতা। ধারাল হিরের মতো চাপা দৃঢ় চোয়াল। এতক্ষণের আমুদে, ঠাট্টা – তামাশা করছিল সেই ছেলেটা যেন অন্য কেউই ছিলো। এখন সামনে যে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে যেন ফিরে এসেছে গত দিনের রু*ক্ষ, শীতল সত্তা। তবে কথা বলল বেশ নরম কন্ঠে,
‘নিনা আমি তোমার সাথে রুড হতে চাই না। আমি চাই তোমার সাথে যেমনই সম্পর্ক হোক সেটা যেন কোন প্রকার ঝামেলার সাথে না জড়িয়ে থাকে। তাই বলছি আমার পেছনে লাগা বন্ধ করে দাও।’
‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’ নিনা কথাটা বলেই ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল। হাতে থাকা জিনিসপত্র নিয়ে গটগট করে হেঁটে কোর্ট রুম ত্যাগ করল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৮
লেখনী: #মাহীরা_ফারহীন

আঁধারের আড়ালে ঝিঁঝি পোকারা গান ধরেছে। খোলা জানালা দিয়ে পর্দায় ঢেউ তুলে ঠান্ডা বাতাস আসছে। বাতাসের ঝাঁপটায় কাটা কাগজের টুকরো গুলো বারংবার উড়ে যাচ্ছে। আঠা, কাঁ*চি, কাগজ, মার্কার পেন এলোমেলো পরে আছে। নিনা বসে ওর ত*দন্তের চার্ট তৈরি করছে। স*ন্দেহের তালিকায় থাকা প্রত্যেকেরই ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইল রয়েছে। সেখান থেকে ও তাদের ছবি সংগ্রহ করেছে। ইভানের টা লক করা ছিল। ওর ছবি লিজার প্রোফাইল ঘেঁটে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তবে শুধু সম্ভব হয়নি হারিনের কোন প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া। কাজেই ওর কোন ছবি নেই। সন্দেহভাজনদের ছবি এবং নিচে তাদের স*ন্দেহের কারণ লিখছে। এই তালিকায় প্রথমেই ইভানের নাম। এরপর, অরল্যান্ডো এবং লিজা। এছাড়া হারিন তো আছেই। সরাসরি ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও হারিনের মধ্যে কোন না কোন গন্ডগোল যে আছে সে বিষয়ে নিনার কোন সন্দেহ নেই৷ লিজার নামটা রাখতেই হলো তালিকায়। লিজা, ইভান এই দুভাইবোনের কাউকেই নিনার কাছে সুবিধার ঠেকছে না। ঘটনাচক্রে লিজা পারতপক্ষে জড়িত না থাকলেও ওকে যথেষ্ট স*ন্দেহ হচ্ছে। তার কথাবার্তা, চলনবলনই সুবিধার ঠেকেনি। তাছাড়া ওর হাতে কোন বিষাক্ত গাছের ইনফেকশন? এরপর এমিলি এবং মিস ম্যারিও রয়েছেন তালিকায়।
তখনই দরজায় খট করে শব্দ হলো। নিনা বলল,
‘আসো।’
দরজাটা সামান্য ফাঁক করে মি.মালিক ভেতরে উঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। মি.মালিক বললেন,
‘তুই চেয়ার টেবিল থাকতে মেঝেতে কেন বসে আছিস?’

‘এমনি ইচ্ছে করছিল।’
মি.মালিকও এসে মেঝেতে বসে ছড়িয়ে পরে থাকা ছবিগুলোর ওপর থেকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। বললেন, ‘কেসটা খুব বেশিই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছিস তুই। একটা কথা শোন।’ বলে থামলেন। নিনা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল।

উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘আমার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি এটা কোন দুর্ঘটনা নয়। যে বা যারা এটা করেছে খুব ঠান্ডা মাথায় জেনেশুনে করেছে। ঠিক তখন যখন সবকিছু তাদের ফেভারে ছিল।’ নিনার শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। কেউ ঠান্ডা মাথা জেনেশুনে টনির মতো একটা মানুষকে মে*রে ফেলেছে সেটা ভাবা যায় না।

মি.মালিক বললেন, ‘খুব বেশি ইনভলভ হইস না। এতে তোরও বিপদ হতে পারে। বিশেষ করে ওই গ্রেউড বাড়িতে যাওয়া এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কর।’

‘কেনো?’ কপাল কুঁচকালো নিনা।

‘টনি হয়তো ওর পরিবারের সদস্যের থেকে একটু আলাদা ছিলো। কিন্তু পরিবারটা খুব একটা সুবিধার নয়। আমি তোকে আগেই বলেছি।’
নিনা আলতো করে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ওই বোতলটার পরীক্ষার ফলাফল
কী এসেছে?’

‘ওহ হ্যা ওটাই বলতে এসেছিলাম।’
মি.মালিক সকালে জুসের বোতলটা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। নিনা আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উনি বললেন, ‘ওই বোতলে কিছুই ছিলো না। টনি নাকি শেষবার শেইকটা একটা গ্লাসে করে খেয়েছিল। আমার ধারণা যা ছিল সেই গ্লাসে ছিলো।’

নিনা হতাশ ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল, ‘বাবা রহস্যটা খুব জটিল। কেউ কেন টনিকে খু*ন করতে যাবে? কার কী ক্ষতি করেছিল ও?’ ছোট বাচ্চাদের মতো প্রশ্নটা করল।

মি.মালিক বললেন, ‘নিনা কিছু মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় যে কারোও ক্ষতি করার জন্য তাদের কোন কারণ লাগে না।’
আরোও কিছুক্ষণ বসে থেকে উনি উঠে গেলেন। নিনা অরল্যান্ডোর ছবিটার দিকে তাকাল। ভাবল, ‘মাঝেমাঝে ঘরের মানুষদেরও বিশ্বাস করা যায় না সেখানে তো তুমি ছিলে বাইরের মানুষ। সে যতই হও ওর ছোট বেলার বন্ধু কে বলতে পারে কোন অজানা বিষয় তোমার ওর ওপর ক্ষো*ব বা রাগ ছিলো না?’

ইভানের একটা সরু রেলিঙের ওপর লিজার সাথে বসে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘জানিনা কেমন শত্রুতা ছিলো তোমাদের। কিন্তু এতটুকু জানি টনির যদি সবচাইতে অপছন্দের কোন মানুষ থেকে থাকে তাহলে সেটা তুমি। তোমার হাজারটা কারণ থাকতে পারে টনিকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার।’

ওর পাশেই থাকা লিজার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবল,
‘তোমার এমিলির বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া, টনির বাসায় ঘনঘন যাওয়া, তোমার হাতের ইনফেকশন এবং তোমার স্বভাব চরিত্রই বারবার আমার মনে স*ন্দেহ জাগাচ্ছে। যেকোন কারণেই হোক কিছু একটা গোলমাল তোমার মধ্যেও আছে লিজা।’

এবার হারিনের নামটির ওপর তাকিয়ে ভাবল, ‘তোমাকে বোকা বলবো কিনা বুঝতে পারছি না। আমার সাথে কী সমস্যা জানি না তবে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থেকে তুমি নিজেই আমার মনে স*ন্দেহ জাগিয়েছো। যদিও এক্ষেত্রে আমার ধারণা নিছকই ভুল হতে পারে।’

মিস ম্যারির ছবি নেই কোন। কিন্তু তালিকায় লেখা নামটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ‘আপনি সারাদিন থাকতেন টনির সাথে। টনির বাবা মা থেকে ওকে বেশি ভালো ভাবে চিনতেন, জানতেন আপনি। ওর লা*শটাও আপনিই পেয়েছেন। কিভাবে এত সহজে ভেবে নিতে পারি যে টনির মৃ*ত্যু পেছনে আপনার কোন মোটিভ নেই?

আর এমিলি। এমিলির নাম টা লিখবে কী লিখবে না করেও লিখেনি। যদিও এমিলির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওকে ঠিক ভালো লাগেনি নিনার। কাকেই বা বিশ্বাস করা যায়? যখন ওর নিজের পরিবারই সব ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছে।’

———————-

মিস ইনস্তিকার ক্লাস শেষে বাকিরা বেরিয়ে গেলেও নিনাকে থামতে বললেন। উনি ক্যামিস্ট্রি টিচার। গোটা ফাঁকা ক্লাসে রয়ে গেলেন শুধু উনি এবং নিনা।
মিস ইনস্তিকার বললেন,
‘আমরা গত দেড় মাসে যেই প্র্যাক্টিকেল করিয়েছি সেগুলো আজ কিংবা কালকের মধ্যেই কারো কাছ থেকে নিয়ে নাও। তুমি বাদে সকলের করা হয়ে গিয়েছে।’

নিনা বলল, ‘ম্যাডাম আমার পূর্বের স্কুলের বেশির ভাগ প্র্যাক্টিকেল করানো হয়েছিল। সেগুলো…. মাঝখান দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে কড়াভাবে বললেন,

‘এই স্কুল এবং তোমার আগের স্কুল একই নয় এবং টিচারও একই নয়। তুমি যখন এখানে পড়ছ তখন এখানকার নিয়ম অনুযায়ী প্র্যাক্টিকেল করবে।’

একটু থেমে আবার বললেন, ‘এক কাজ করো হারিন অথবা ইভান যেকোনো একজনের কাছ থেকে প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো নাও।’

নিনা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘অন্য কারো কাছ থেকে নেয়া যাবে না?’

‘ওদের কথা বললাম কারণ ওরা সব নোট, প্র্যাক্টিক্যাল সবচেয়ে বেশির গুছিয়ে করে। তুমি কী করবা সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছ থেকে সময় মতো সাইন করিয়ে নিতে হবে।’

‘ঠিক আছে।’

উনি চলে যেতেই নিনাও বেরিয়ে গেল। ভাবছে,
‘এভাবে চলবে না নিনা। ইভানকে যতই অসহ্য লাগুক না কেন ওই আমার প্রথম সন্দেহভাজন। ওর কাছ থেকে জানার অনেক কিছু আছে। ওকে এড়িয়ে যাওয়াটাই সোজা হলেও সে পথ বেছে নেয়ার উপায় নেই৷ আমাকে দূরে সরে থাকলে হবে না।’ ভাবতে ভাবতে লকারের কাছে পৌঁছল। সেখানে দারুণ চিৎকার চেঁচামেচি। বেশ কয়েকজনের মাঝে কথা কাটাকাটি হচ্ছে বোধহয়। তবে৷ এর মাঝে কোথাও ইভান কে দেখা গেল না। নিজের লকার খুলতেই ওমানাকে চোখে পরল। নিনা নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘হেই।’

‘হেই নিনা।’ হাসি মুখে বলল ওমানা।

‘তুমি কাইন্ডলি আমাকে বলতে পার ইভান কোথায়?’

‘ওরা বাস্কেটবল প্র্যাক্টিস করতে গিয়েছে।’

‘ওহ থ্যাঙ্কিউ!’

‘ইউ আর ওয়েলকাম।’ বলে নিজের লকারটা বন্ধ করে চলে গেল ও। নিনা নিজের ব্যাগটা লকারে রেখে সেটা বন্ধ করল। এরপর করিডোরের পর করিডোর পেরিয়ে বাস্কেটবল কোর্টে গিয়ে পৌঁছল। ভেতরে ছাত্রদের কোলাহলের সঙ্গে ধুপধাপ শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বড় হলরুমটায়। সে শব্দ যেন গজঘণ্টাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। বড় প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়াতেই কয়েকজন ওকে দেখে থেমে গেল। মোটে দশ এগারো জন ছাত্র খেলছে এখানে। ওদের স্পোর্টস টিচারও উপস্থিত রয়েছেন। এর মাঝে ইভানও রয়েছে। ওর উপস্থিতি লক্ষণীয়। কী গতি এবং ধার ওর প্রতিটা পদক্ষেপে। ডার্ক চকলেটের মতো ছোট সিল্কি চুল গুলো এলোমেলো। সবসময়ের মতোই ধূসর চোখ ভরা উচ্ছাস এবং অদম্য মনোবল। প্রথমেই নিনার উপস্থিতি খেয়াল করলো না ইভান। তবে ইভানের উপস্থিতি নিনাকে নাড়িয়ে দেয়। ওর স্নায়ুর ওপর এক অচেনা, অপরিচিত চাপ সৃষ্টি করে৷ ওকে দেখেই বিরক্ত লাগে বলেই হয়তো এমনটা হয়। একটা ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী খেলা দেখতে এসেছ?’

‘না আমার ইভানের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।’
ওরা সকলেই একত্রে ইভানের দিকে তাকাল। ইভানকে আর আলাদা করে বলা লাগলো না। নিনার গাঢ় ভাবে বলা প্রতিটা কথাই প্রতিধ্বনিত হয়ে সকলের কানে ঢুকেছে। ইভান এগিয়ে এসে প্রবেশদ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। নিনাও সাথে সাথে বেরিয়ে আসল। ইভান ঘেমে গিয়েছে। লম্বা লম্বা গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ফর্সা মুখ র*ক্তিম হয়ে আছে। সুক্ষ্ম এক মুচকি হাসির রেশ ঠোঁটে। ওই প্রথমে আমুদে কন্ঠে বলল,
‘তুমিই না গতকাল হৃদয় এবং আত্মা উজার করে দিয়ে চেষ্টা করছিলে আমার কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার। আর আজ নিজেই চলে এসেছো আমার সাথে কথা বলতে? এম আই ‘দ্যাট’ এট্রাক্টিভ?’ ওর কথা বলার ধরনে বিচলিত হলো নিনা। পাশাপাশি বিরক্তও হলো। সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না কেউ ওকে শুধু নিজের উপস্থিতির মাধ্যমে বিচলিত করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এই তো সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইভান। নিনা স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘ইভান তোমার সবকিছু নিয়ে কাহিনী না বনালে হয় না?’
ইভান শ্রাগ করল।
নিনা বলল, ‘তোমার ক্যামিস্ট্রি প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো আমাকে দিতে পারবা?’

‘বাহ তুমি এখন আমার জিনিসপত্রেও অধিকার বসিয়ে ফেলেছ!’

‘আল্লাহ আল্লাহ! মিস ইনস্তিকার আমাকে বলেছেন তোমার কাছ থেকে প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো নিয়ে সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে।’
ইভান হাসলো। নিনা ভ্রু কুঞ্চিত করল। ইভান বলল,
‘ভালোই। আমি মিস ইনস্তিকারের এত ফেভারিট ছাত্র জানতাম না। তাও আবার লাস্ট ইন্সিডেন্টের পর।’

‘ওয়েল আমার সেসবের মাঝে আগ্রহ নেই। তুমি তোমার প্র্যাক্টিক্যাল খাতা দিবা নাকি না সেটা বল।’

‘অবশ্যই সুইটহার্ট।’
সহসা নাম পরিবর্তনে বিরক্ত হলো নিনা। ইভানের দিকে চোখ রাঙাল। তবে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘আজ স্কুলের পর?’

‘স্কুলের পর একটু ব্যস্ত থাকবো। বিকেলের পর?’

‘কখন?’

‘সাড়ে পাঁচটার দিকে?’

‘ঠিক আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় জার্মানটাউন।’

‘জার্মানটাউন ক্যাফে?’

‘হ্যা।’

ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ঠিক আছে। সময়মতো এসে পরো।’

————————–

ক্যাডবেরি চকলেটের থিম মিউজিক বাজছে কোথাও। বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর নিনা এসে ধরল সেল ফোনটা। নম্বরটা দেখে স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি হলো। নিজের বিছানায় বসে পরে কলটা রিসিভ করল। প্রথমেই ওপাশ থেকে বলল,
‘হ্যালো নিনা।’

‘হ্যালো কেমন আছো?’ উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘এইতো আছি। আচ্ছা শোন উনিকি বাসায় আছেন?’

‘না কিন্তু…নিনার কথার মাঝখান দিয়ে ওপাশ থেকে বলল,

‘শোন আমার একটা দরকার আছে। আমাদের স্কুল থেকে স্টাডি ট্যুরে লেক কাউন্টি নিয়ে যাচ্ছে। অনুমতি পত্রে অভিভাবকের সাইন লাগবে।’

‘তাহলে তুই বাসায় ফিরবি এর মধ্যে?’

‘নিনা বারবার একই কথা আমার ভালো লাগে না! আমি বাসায় ফিরছি না। তুই শুধু ওনাকে এটা জানিয়ে দিস। ব্যস।’ কঠিন স্বরে বলল নিমা। কোথা থেকে যেন এক বিষাদময় শূন্যতা দমকা হাওয়ার মতো এসে নিনার হৃদয়েকে নাড়া দিয়ে গেল। নিনার বেশ অস্থির অনুভূত হলো। ভারি কন্ঠে বলল, ‘নিমা এটা তুই নিজেও বাবাকে বলতে পারতি। পারতি না? আর কত দিন তুই এভাবে মানসিক ভাবে কষ্ট দিয়ে যাবে আমাদের?’

‘আমাদের? হুম ঠিক বলেছিস, তোদের। আমি তোকে আর ওনাকে তো কষ্টই দিচ্ছি। কিন্তু তুই যে নিজের বাড়িতে বাবাকে নিয়ে শান্তিতে আছিস। বাবার এক মাত্র মেয়ে হয়ে? নিজের খালা এবং চাচার একমাত্র ভাগ্নি এবং ভাতিজি হয়ে? সেটার কী? আমি কী এসব থেকে বঞ্চিত নই?’

‘কেউ তোকে বঞ্চিত করেনি এসব থেকে। তুই নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিস। প্রতি মুহূর্তে সকলে এটাই চায় তুই ফিরে আয়। কিন্তু তুমি তো সেই একটা জেদ ধরেই বসে থাকবি!’ তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। নিমা ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি সবকিছু থেকে দূর হয়ে গিয়েছি তোর জন্য। ভুলে যাইস না উনি কেন আমাকে বোর্ডিং এ পাঠিয়েছিল। এখন আমি আর ফিরে আসতে চাই না!’ বলেই ফোন কেটে দিল। নিনা সেল ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। কান্না দলা পাকিয়ে গলা অব্দি উঠে আসছে। নিনা মেঝেতে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসেছে। কতক্ষণ হাঁটু জোরা এক করে মুখ বুঁজে বসে থাকল। যখনই নিমা ফোন দেয় তখনই দিনটা নিনার জন্য বিষন্নতায় ভরে উঠে। অবশ্য সবসময় তেমনটা হয় না। প্রায়ই ওদের স্বাভাবিকভাবেও কথা হয়, গল্প হয়। তবে তা কদাচিৎ। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওর খেয়াল হলো ওকে বেরোতে হবে। ইভানের সাথে দেখা করার কথা। আসলে ও রেডি হয়ে বেরোতেই যাচ্ছিল। ঘড়ির দিকে তাকাল পাঁচটা চল্লিশ বাজে। চমকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইতোমধ্যেই দশ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে ঝড়েরবেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেল বের করল। ওদের গ্যারাজে ওর ফোর্ড গাড়িটা আছে। তবে এখন সেটা বের করার সময় নেই। সাইকেলে উঠে চলতে শুর করল কি করল না পুনরায় ফোন বেজে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইকেল থামাল। ‘যত বারই আমার ফোনটা বাজে ততবারই একটা গন্ডোগোল লাগে! না জানি আবার কার ফোন?’ বিড়বিড় করে বলতে বলতে ফোন হাতে তুলে নিল। অমিত ফোন করছে। নিনা অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ফোন রিসিভ করে কানে ধরল। তবে ও কিছু বলার পূর্বে অমিত বলল,
‘নিনা তুই বিশ্বাস করবি না এখানে কী হচ্ছে!’

‘কোথায় কী হচ্ছে?’ বিরক্তি ভুলে কৌতূহলি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।

‘টনির বাসায়।’

‘কীহ! টনির বাসায়? তুই ওখানে কেন?’

‘আরে বাবা আমি ওর বাসায় নেই। আমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি হারিন এবং অরল্যান্ডো টনির বাসার গ্যারাজের পাশে যে স্টোররুমটা আছে সেখানে গিয়ে ঢুকেছে।’

‘ ওরা ওখানে কী করছে?’

‘আমি জানি না শুধু এতটুকু জানি বাড়িতে সম্ভবত আর কেউ নেই। কিন্তু এই দুটো মানুষের এখানে আসাটা কী সন্দেহজনক না? তারওপর স্টোররুমে ঢোকা?’

‘হ্যা অবশ্যই। দাঁড়া আমি আসছি।’ বলে নিনা ফোনটা ব্যাগে রেখে দ্রুত গতিতে প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করল। টনির বাড়ি আরেকটা নেইবারহুডে কাজেই সেখানে পৌঁছতে কিছু সময় গেল। নিনা বাড়ির সামনে থামল না। এই নেইবারহুডে প্রতিটা বাড়ি কিছুটা দূর দূর। প্রতি দুইটা বাড়ির বাউন্ডারির মাঝে বড় বড় পাইন গাছ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। নিনা গাছগুলোর সামনে এসে সাইকেল থামাল। আবারও অমিতকে ফোন দিল। ফোনটা রিসিভ হতেই বলল, ‘তুই কোথায় আছিস?’
‘এই যে নিনা আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি। আমি তোর ডানে একটু পেছনে আছি।’ নিনা ওর কথা অনুযায়ী পেছনের দিকে তাকাল। ডানে বামে পেছনে দূর দূর পর্যন্ত কেউ নেই। শুধু সারি সারি বিশালাকার গাছ। ফোন কানে ধরা ছিল। নিনা বলল,
‘কোথায় তুই আজব তো!’

‘আরে ভাই আমি যখন পেছনে বলেছি, তখন পেছন দিকে তো ডান বাম ছাড়াও উপর নিচও আছে তো নাকি?’
নিনা অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকাল। এবার খুঁজে পাওয়া গেল অমিতকে। সে গাছের ওপর বসে আছে। নিনা কন্ঠে বিরক্তি ভরে বলল, ‘অমিত তুই গাছের ওপর কী করছিস?!’

‘নিনা এটা ছাড়া আমি আর কোন জায়গা পাইনি যেখান
থেকে নিরাপদে নজর রাখা যায়। তুই ওপরে আয়।’

‘কিন্তু ওত দূর থেকে ওখানে বসে কীই বা দেখা যাচ্ছে?’

‘আরে আমার কাছে বাইনোকুলার আছে।’

‘বাইনোকুলার? সেটাও তোর আছে? তোর কাছে তো কখনো কাজের সময় কাজের জিনিস থাকে না।’

‘আরে মেয়ে! বেশি ঘ্যান ঘ্যান না করে উপরে আয়।’
নিনা ফোনটা কেটে দিল। ফোনটা সাইলেন্ট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। ওপরে অমিতের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গাছে উঠতে পারে তবে উঠা হয়নি অনেকদিন যাবত। কারই বা গাছে ওঠার প্রয়োজন পরে রোজরোজ? ভাগ্যিস এমন একটা গাছে উঠেছে যার শরীরটা এবড়োখেবড়ো। এটা পাইন নয়। পাইন হলে এত সোজা হত না বেয়ে ওঠা। নিনার পায়ে স্নিকার্স। ও সহজেই উঁচু নিচু অংশ গুলোতে ভর দিয়ে উঠে গেল। অমিত সবচাইতে নিচের দিকের ডালটিতেই বসে ছিলো। নিনা সেখানে উঠে অমিতের পাশে বসল। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘দুজন বসছি, এটা ভেঙে যাবে না তো?’

‘না না ভাঙ্গবে না। বেশ শক্ত পোক্ত আছে ডালটা।’
অমিত বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে বসে আছে। নিনা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যা এবার বল বাইনোকুলার তোর কাছে আসলো কোথা থেকে? তুই তো পথের মাঝে হঠাৎ ওদের দেখেছিলি তাই না?’

‘হ্যা। কিন্তু তুই এই বাড়ি পার হয়ে সামনের দিকে কখনো যাইসনি না? পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসপত্রের দোকান আছে। ওদের দেখার পর বুঝলাম বাইনোকুলার ছাড়া কাজ হবে না। তাই ওখান থেকে আমার ছয় ডলার গচ্ছা দিয়ে এটা কিনেছি।’ শেষের কথাটা আফসোস ভরা কন্ঠে বলল।

‘ছয় ডলার!? সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস আবার এত দাম কিসের?’

‘আর বলিস না। ডাকা*তি কারবার।’

‘আচ্ছা আমাকে দে। কী দেখা যাচ্ছে এখন?’
অমিত বাইনোকুলারটা ওর হাতে দিল। বলল,’ওরা স্টোররুমে ঢুকেছিল এখনো বের হয়নি।’
নিনা বাইনোকুলারে চোখ রাখলো। চারিদিকের কালোর মাঝে দুটো বৃত্তাকার জানালা দিয়ে বড় বড় করে দেখা যাচ্ছে মেইন গেট এবং গ্যারাজে যাওয়ার পথটা। স্টোররুমের সামনের অর্ধাংশ দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি গার্বেজ বিনটাও দেখা যাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দুজন মানুষকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল৷ অরল্যান্ডোর হাতে কয়েকটা কাগজ। ওরা দ্রুত গতিতে হেঁটে পেছনের দিকে চলে গেল। আর দেখা যাচ্ছে না। মিনিট না পেরতেই ডানদিকের বড় বাগানে বেরিয়ে আসল। যেখানে টনির ফিউনেরাল হয়েছিল। বাগানের সঙ্গে লাগোয়া যেই কাঁচের স্লাইডিং ডোর ছিলো। সেটা খোলার জন্য দরজার নবে হারিন হাত রাখতেই এলার্ম বেজে উঠল। নিনা বাইনোকুলারটা অমিতের হাতে দিয়ে বলল, ‘ওরা কিন্ত সামনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলো না। অর্থাৎ বাড়িতে কেউ নেই। বাই দ্যা ওয়ে শুনছিস এলার্ম বাজছে?’

‘হুম শুনেছি কিন্তু বাড়িতে তো কেউ নেই। এলার্ম বেজেও বা লাভ কী? আর ওরা খুঁজছে টা কী?’ অমিত বাইনোকুলারে চোখ রেখে বলল। নিনা কিছু বলার পূর্বেই ওর দিকে বাইনোকুলারটা পুনরায় এগিয়ে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,’এই দেখ দেখ।’

নিনা সেটা চোখে দিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না। বলল, ‘কোথায় কী?’

‘দুই তলার জানালায় দেখ। ওটা টনির কামরা সম্ভবত।’
নিনা ওর কথামতো দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পেল খোলা জানালা দিয়ে হারিনকে দেখা যাচ্ছে। জানালার সামনে টেবিলের মতো কিছু একটা আছে যেখানে হারিন কিছু একটা খুঁজছে। চরম অস্থিরতার সাথে সবকিছু ঘাটাঘাটি করছে। জানালাটা টানা জানালা। সম্পূর্ণটাই ছোট ছোট অংশে ভাগ করে কাঁচের পাল্লা দেওয়া। অরল্যান্ডোকে আংশিক দেখা গেল। কিছু একটা সেও খুঁজে বেড়াচ্ছে। নিনা বলল, ‘ওরা কিছু একটা খুঁজছে। প্রথমে স্টোররুমে। তারপর টনির কামরায়। কিন্তু কী সেটা? ওরা যদি কোন ভাবে খু*নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তাহলে এর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ এই বাড়িতেই আছে।’

‘কেউ সেটা পেয়ে যাওয়ার পূর্বেই ওরা সরিয়ে নিতে চাচ্ছে।’

‘কিন্তু তাই বলে ওরা দুজন একসাথে? ওরা দুজন?’ অবিশ্বাস্যের সঙ্গে বলল নিনা।

‘টনির খু*ন হওয়ার ব্যাপারটাই কী কম আশ্চর্যজনক ছিলো না? সেখানে ওদের একসাথে হওয়াটা আর কতটাই বা আশ্চর্যজনক।’ বলল অমিত।
নিনা সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। অরল্যান্ডোকে টনির কামরাতেই ঘাটাঘাটি করতে দেখা যাচ্ছে তবে হারিনকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পাশের কামরায়ও খোঁজাখুজি করছে ওরা। ঠিক তখনই একটা শব্দে চমকে উঠল নিনা। গাড়ির শব্দ। বাইনোকুলার ছাড়া খালি চোখেই দেখা যায় বাড়ির সামনে ড্রাইভওয়েতে একটা সাদা এসইউভি এসে ঢুকলো। অমিত জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওরা এখন বিপদে আছে।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ৯
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

পরন্ত বিকেলের সোনালি রোদ এসে পরছে কনক্রিটের শুভ্র ড্রাইভওয়েতে। সাদা গাড়িটা এসে থামল মাত্র। সাথে সাথে পেছনের দুটো দরজা খুলে লিজা ও এমিলি বেরিয়ে এলো। ড্রাইভিং সিটে ওদের পারিবারিক শোফার বসে। এমিলির কপালে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। অস্থির ভাবে ছুটে গেল মেইন দরজার দিকে। লিজা পেছন পেছন আসছিলো তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল,
‘লিজা তুই পৌঁছে গিয়েছিস?’

‘ভাই আল্লাহর ওয়াস্তে ঘন্টায় ঘন্টায় আমার খবর নেওয়া লাগবে না তোমার৷ আমি ছোট বাচ্চা নই!’

‘তোর আচরণ এখনো বাচ্চার মতোই। সে যাই হোক ওখানে ঠিকঠাক পৌঁছেছিস কিনা সেটা বল?’

‘না আমরা যাই নি।’

‘কেন?’

‘পথিমধ্যে পরিকল্পনা পাল্টেছি। এখন আমরা গ্রেউড বাড়িতে এসে পৌঁছলাম মাত্র। সন্ধ্যার পর বাসায় এসে পরবো।’

‘ওহ ঠিক আছে।’
লিজা ফোন কানে ধরেই দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ফাঁকা বাড়িতে থমথমে একটা ভাব। ড্রইংরুমের খোলা স্লাইডিং ডোর দিয়ে বাতাসের ঝাঁপটা এসে পর্দাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে। লিজা বলল,
‘তুমি কোথায়? বাসায় যাওনি এখনো?’

‘না। পরে যাব।’

‘ওহ নোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে?’

‘না।’

‘কেন?’

‘ওই মেয়েটা পরিকল্পনা বাতিল করেছে অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি।’ তীব্রভাবে বলল ইভান

‘ফোনও করেনি?’ অবাক কন্ঠে বলল লিজা।

‘ফোন করা তো দূরের কথা আমি যে এতগুলো কল দিলাম একটাও ধরলো না পর্যন্ত। আমার সারাজীবনে কখনো এতটা অপমানিত বোধ হয়নি।’ শেষের কথাগুলো অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল। লিজার স্নায়ু টনটন করে উঠল। শান্ত কন্ঠে বলল, ‘শান্ত হও। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসছি। কোথাও উধাও হয়ে যেও না। রাখি।’ বলে রেখে দিলো। কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপাশের বাগানের দিকে তাকিয়ে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ তারপর ব্যস্ত পায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। টনির কামরায় ঢুকতেই দেখলো এমিলি প্রতিটা জিনিস পরখ করে দেখছে তবে কোন কিছুই সেভাবে ছুঁয়ে দেখছে না। লিজা এসে ধপ করে বিছানায় বসে ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘কিছু পেলি?’

‘না কিন্তু আমি নিশ্চিত বাড়িতে কেউ না কেউ ঢুকেছিল।
এলার্ম যেহেতু বেজেছে। আর সে অবশ্যই টনির কামরায় একবার ঢু মেরেছে।’ ভাবুক কন্ঠে বলল এমিলি।

‘এত নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?’ অলস ভঙ্গিতে বলল লিজা।

‘কোন পশু পাখির ছোঁয়ায় এলার্ম বেজে উঠতে পারে তবে এত বছরে কখনো সেটা হয়নি। তাহলে আজকেই কেন হবে? ঠিক যখন বাড়িতে কেউ নেই এবং এমন একটা ঘটনার পরপরই?’

লিজা শ্রাগ করল। ও আনমনে বেড টেবিলে রাখা কলম দানিটা ধরতেই এমিলি তীব্র ভাবে বলল,
‘ধরিস না ওটা।’

‘কেন ধরলে কী সমস্যা?’

‘কে ধরেছে সেটা তো আর মম জানবে না বকাটা আমাকেই খেতে হবে।’ গাঢ় কন্ঠে বলল।

‘কি আশ্চর্য নিজের বাসায়ও কোন কিছু ধরার স্বাধীনতা টুকুও নেই তোর।’ টিটকারির সুরে বলল লিজা।

এমিলি লিজার দিকে ঘুরে উল্টো খোঁটা দিয়ে বলল,
‘অন্তত আমার ভাগ্য তোর মতো এতটাও খারাপ নয় যে বাসায় বন্দি হয়ে থাকতে হয়।’
বলেই কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। লিজা গোমড়া মুখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। বড় বড় দুটো জানালা দিয়ে তরল সোনার মতো রোদ এসে সারা কামরা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কামরাটা অত্যন্ত সাধারণ ভাবে সাজানো গোছানো। পর্দা, কার্পেট, বিছানার চাদর সোফা সবকিছুই সাদা। শুধু আসবাবগুলো কালো কাঠের তৈরি। বুকসেলফ ভরা রঙিন প্রচ্ছদের বই ঠেসে রাখা। লিজা বিছানার পেছনের দেওয়ালে দৃষ্টি ফেরাল।

“And I’ve heard of a love that comes once in a lifetime
And I’m pretty sure that you are that love of mine”

বাক্যগুলো ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলানো। সোনালী রোদে লিজার ঝাপসা এক প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে গ্লাসের ফ্রেমটায়। লিজা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো৷

————————-

‘ওরা বুঝলো কিভাবে যে, বাড়িতে কেউ ঢুকেছে?’ প্রশ্ন করল অমিত। নিনা আপন ভাবনায় বুদ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পূর্বে গাছ থেকে নেমে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছে। পাইন গাছ গুলো পার করে বাউন্ডারি দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে হাঁটছে ওরা।
‘নিনা!’ কিছুটা জোরালো ভাবে বলতেই নিনা চমকে উঠল। বলল,’আমি কিচ্ছু জানি না অমিত! আমার মাথা কাজ করছে না।’ বিরক্তি সহকারে বলে এগিয়ে যেতে থাকল। টনির বাড়িটা পার করে বাউন্ডারি দেয়ালও যখন প্রায় শেষ করে এসেছে তখন একটা শব্দ ভেসে এলো। শব্দটা এলো দেওয়ালের ওপাশ থেকে। নিনা থমকে দাঁড়াল। অমিত গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘শুনেছিস?’
নিনা আলতো করে মাথা দোলালো। একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা৷ কোন কথা বলার শব্দ নয়। শব্দ ছিলো অন্য কিছুর। দেওয়ালের ওপাশেই ঠিক গ্যারাজ এবং বড় গার্বেজ বিনটা থাকার কথা৷ মাথার ওপর গাছের ঝাকড়া ডাল পালা ছাউনি দিয়ে রেখেছে। পাশেই গাঢ় রুপালি রাস্তায় পরন্ত বিকেলের সোনালি রোদ ঝলমল করে এসে পরছে।
বেশ খসখসে শব্দ শোনা গেল যেন অনেকগুলো কাগজ ঘাটা হচ্ছে। আবার দুমড়েমুচড়ে থাকা কাগজ খুললে যেরকম খরখর করে একটা শব্দ হয় তেমনটাও হচ্ছে। অমিত ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোর কী মনে হয় কিসের শব্দ?’

নিনা ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ওকে নিশ্চুপ থাকতে ইশারা করল।কয়েক মিনিটের মাথায় সকল শব্দ কোথাও হারিয়ে গেল যেন। চারিদিকে পাখিদের কলকলানি ব্যতিত আর কোন শব্দ পাওয়া গেল না। অমিত পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আমাদের লুকানো উচিৎ। বলা যায় না ওরা কোনদিক দিয়ে বের হবে।’ দেয়ালের শেষ প্রান্তেই দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। কাজেই আরেকটু এগিয়ে বড় বড় গাছগুলোর আড়ালে দাঁড়াল। মিনিট না পেরোতেই দেয়ালের ওপর অরল্যান্ডোর মাথা দেখা গেল। বাউন্ডারি দেওয়াল অতটাও উঁচু নয়। হবে ছয় ফিটিরে মতো৷ অরল্যান্ডো দেয়াল টপকে এপাশে লাফিয়ে নামলো। এরপর হারিন উঠে এসে দেওয়ালে বসলো। এপাশে লাফ দিয়ে নামার সময় অরল্যান্ডো ওকে সাহায্য করল। হারিন নেমে যেতেই ওরা দ্রুত পায়ে চলে গেল। ওদিকে পশ্চিম আকাশে সূর্য তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর কিছুক্ষণ বাদে আকাশের বুক থেকে এই উজ্জ্বল নক্ষত্র হারিয়ে যাবে। নিনা ও অমিতও আর দেরি না করে বেরিয়ে পরল৷ কিছুদূর যাওয়ার পর নিনা সাইকেলটা যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে বের করে নিলো। এসব নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করবে বলে ঠিক করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের নিজেদের পথ ভাগ করে নিয়ে চলে গেল। নিনা যখন বাড়ির পথ ধরল তখন হঠাৎ কী মনে হতে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল৷ মোবাইল অন করতেই হতভম্ব হয়ে গেল। স্ক্রিনে উঠে আছে ইভানের আটটা মিসকল। নিনা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘আল্লাহ আল্লাহ! আমি তো আলবাত ভুলে গিয়েছিলাম ওর কথা।’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছয়টা পঞ্চাশ বাজে। হতাশা ভরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। বাড়ি না ফিরে দ্রুত গতিতে প্যাডেল ঘুরিয়ে জার্মান টাউন ক্যাফের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললো। সেখানে পৌঁছে ইভানকে কোথাও চোখে পরল না। অবশ্য নিনা আশাও করেনি যে প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ সে এখানে ওর মতো কেয়ারলেস মেয়ের অপেক্ষায় বসে থাকবে। একজন পরিচিত ওয়েট্রেস কে জিজ্ঞেস করল,
‘এখানে কী কোন ছেলে এসে অপেক্ষা করছিল?’

‘এখানে তো অনেক ছেলেই আসে।’

‘মানে একদম একা বসেছিল কেউ?’

‘হ্যা করছিল। অনেকক্ষণ বসে ছিলো। কিছুক্ষণ পূর্বেই চলে গেল।’ নিনা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসল। নিজেকে শতবার বকতে ইচ্ছে করল। একটা ফোন করেও তো জানিয়ে দিতে পারতো। অথবা গ্রেউড বাড়ি না গেলেও তো পারত। অমিত একাই সামলে নিত সব। এমনিতেও ইভানের সাথে ওর বনছেই না। তারওপর পরিস্থিতিটা আরোও খারাপ করে ফেললো। এখন অনুতপ্ত বোধে পুরে যেতে যেতে ইভানের নম্বর ডায়াল করা ভিন্ন আর কিছুই করার নেই। প্রথমে বাজতে থাকল ফোন৷ ধরলো না কেউ। পরপর আরোও দুইবার কল দিলো৷ ধরলো না। নিনা রাস্তার পাশের ফুটপাথে থাকা একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসল। সূর্য ডুবে গিয়েছে। আকাশে এখন রঙের মেলা বসেছে। নানান রঙের একটু আধটু ছোঁয়া গায়ে মেয়ে ভেসে যাচ্ছে ছিন্ন ভিন্ন মেঘ গুলো।
নিদারুণ উদাসীনতা পেয়ে বসেছে নিনাকে। বুকের ভেতরটা শূন্য ঠেকল। ভাবল, ‘এর আগে অনেকজনকে অনেক তিক্ত কথা শুনিয়েছি। রুক্ষ ব্যবহার করেছি। কখনো পরোয়া করিনি তাদের কেমন লেগেছে। এখন চাইলেও না পরোয়া করে থাকতে পারবো না।’

————————

কামরার বাতি নেভানো। জানালা গুলোর কপাট বন্ধ। মোবাইল সাইলেন্ট করে বিছানায় ফেলে রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। অন্ধকারে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
‘মাত্র চার পাঁচ দিনের পরিচিত একটা মেয়ের জন্য আমি কেন এমন চিৎপটাং হয়ে পরে আছি?’ ভেবেই লাফ দিয়ে উঠে বসল। এবার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

‘কিন্তু আমার সাংঘাতিক বিরক্ত লাগছে। আমাকে এভাবে অপমান করল কেন? আমাকে যে ও পছন্দ করে না অনেক আগেই পরিষ্কার ভাবে তা বুঝিয়ে দিয়েছে তাহলে এত মানুষ থাকতে আমাকেই পেল প্র্যাক্টিক্যাল নেয়ার জন্য? আশ্চর্য!
ও আসলে চায় টা কী? কেন আমার আর লিজার পেছনে পরে আছে? আমি কেমন মানুষ, আগে কী কী করেছি। কার সাথে কী গন্ডোগোল ছিল বা ছিল না সেসব তো ওর মাথা ঘামানোর বিষয় না। ওর জানারও কথা নয়। তাছাড়া ওর ওই বেস্ট ফ্রেন্ড অমিতও তো তখন এই স্কুলে ছিলোই না যখন এসব শুরু হয়েছিল। কিন্তু যাই হোক, যেকারণেই হোক নিনা আমাকে ঘোল খাওয়ানো ব্যবস্থ করছে। নাহ ওকে খোঁচাখোঁচি না করে ওর সাথে কোন সম্পর্ক না রাখাটাই ভালো। এমনিতেও ও যেমন মেয়ে! ওর জন্য আমার কাছে এসে ক্ষমা চাওয়াটা কল্পনারও বাইরে।আর ও ক্ষমা চাইতেও বা যাবে কেন? আমি ওর কেই বা হই? আমার রাগে ওর কী এসে যায়!।’

অন্ধকার কামরায় মৃদু এক আলোর ফুলকি ছড়িয়ে মোবাইলের স্ক্রিনটা জ্বলে উঠল। ইভান সেদিকে তাকাল। স্ক্রিনে ‘ডার্লিং সানসাইন’ নামটা লেখা। ফোনটা নিরবে বাজছে। ইভান বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবল,
‘ওর নাম এটা রাখার কোন মানেই হয় না। “নিউ ট্রাবলমেকার” দিয়ে সেভ করব এবার।’
.
.
.
.
.
লকার ভরা করিডরে ভির করছে সকলে। ক্লাস শুরু হয়নি এখনো। সকলে প্রথমে এসেই কাঁধের বোঝা গুলো লকারে ফেলে রেখে যায়। নিনা নিজের লকারটা বন্ধ করতেই একটা মেয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটা এ্যাভরিল।
‘তুমি হঠাৎ স্কুলে?’ ঠোঁট হালকা প্রসারিত করে বলল নিনা।

‘হ্যা। আজ কাজ ছিলো না তাই।’ হাসি মুখে বলল এ্যাভরিল।

নিনা বলল, ‘তোমার পা? ঠিক হয়েছে?’

‘হয়েছে হয়েছে বাট মাঝে মাঝে একটু টনটন করে।’ বলে এ্যাভরিল হাঁটা থামিয়ে দিল। নিনার দিকে মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘নিনা তোমাকে যতই ধন্যবাদ দেই না কেন কম হয়ে যাবে। সেদিন এভাবে আমাকে সাহায্য করলে এমনকি গাড়ির… নিনা ওকে থামিয়ে দিল মাঝপথে। বলল,
‘এসব কথা তুলে আমাকে লজ্জায় ফেলো না।’ এ্যাভরিল মিষ্টি করে হাসলো। হাঁটতে শুরু করে নিনা আবার বলল,
‘তুমি যে বেশির ভাগ স্কুলেই আসো না এতে তোমার কোন সমস্যা হয় না?’

‘উম তেমন একটা না। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা সব এটেন্ড করি এবং বাকি পড়াগুলো নোট হিসেবে সংগ্রহ করি। এই যে যখন স্কুলে আসি তখন বাছাই করা কয়েকজন কে যন্ত্রণা দেই নোটের জন্য।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল, ‘আর তোমার কী অবস্থা? অন্যদের সাথে কেমন বন্ধুত্ব হলো?’

‘এইতো বন্ধুত্ব আর কী? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আগে থেকেই এখানে পড়তো।’

‘ওহ আচ্ছা আগেই থেকেই একটা বেস্ট ফ্রেন্ড থাকলে অন্যদের কোন চান্স নেই।’
ওরা দোতলার করিডর ঘেরা অর্ধ রেলিঙের ওপর উঠে বসল। তখনই সামনে দিয়ে ইভান হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের দেখে থেমে গেল। তবে ও নিনার দিকে নয় এ্যাভরিলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আরে আরে দেখো কে এসেছে! কী খবর তোর? এবার কিন্তু অনেকদিন পর এসেছিস। এটা কিন্তু ঠিক না।’

‘ধুর! কোথায় অনেক দিন পর? কয়েক দিন আগেই তো এসেছিলাম। তুই-ই তো সেদিন স্কুলেই আসিসনি।’

‘ওহ আচ্ছা। হ্যা মাঝে তিনদিন স্কুলে আসিনি আমি।’

‘দেখেছিস খালি খালি আমাকে দোষারোপ করা।’ বলে থামল। নিনার মনে হলো এখানে ওদের কথার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকাটা সমীচীন নয়। কাজেই ঘুরে দাঁড়াতে যাবে তখন এ্যাভরিল ওর বাহু আঁকড়ে ধরে হাসি মুখে বলল,
‘পরিচিত হও আমার নতুন বান্ধুবীর সাথে। নিনা। ওহ জানিস সেদিন আমার একটা এক্সি*ডেন্ট হয়েছিল, তখন ওই সাহায্য….নিনা মাঝখান থেকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘থাক না। আবার এসব কথা তুলার কী দরকার?’

ইভান এ্যাভরিলকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
‘হুম দেখছি তো। তোর সর্বজনীন বান্ধুবী।’

এ্যাভরিল ভ্রু কুঁচকাল, ‘কী?’
‘এ্যাভরিল আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি।’ বলে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিনা দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে আসল। এ্যাভরিল হতবাক হয়ে ওর পানে চেয়ে রইল। তারপর ইভানের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
‘তোরা একে অপরকে আগে থেকে চিনিস তাই না? কী হয়েছে তোদের মধ্যে?’

‘কী আবার হবে কিছুই না।’

‘এত ভালো এবং মিষ্টি একটা মেয়ে, ওকেও তুই ছাড় দিলি না? ওর সাথেও তোর ঝামেলা বাঁধানো লাগতো?’ বলে এ্যাভরিল কঠিন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ তারপর বলল,
‘ওকে তোর মিষ্টি মনে হয়!?’

‘ইভান এমন ভান করিস না যেন তুই কিছুই জানিস না৷ অন্তত আমার সামনে না। তুইও জানিস আমিও জানি আগে কী কী হয়েছিল। কেন অহেতুক নতুন নতুন মানুষকে যোগ করতে থাকিস তোর ঝামেলার লিস্টে?’ তীব্রভাবে বলল এ্যাভরিল।

‘এ্যাভরিল বারবার একই কথা তুলে এনে কী বলতে চাইস? তুই তো জানিস আগে কী কী হয়েছিল। আর কত বার সবাইকে বোঝাবো যে আমি তখন আমি কিছুই করি নি!’

‘তাহলে পরে জড়ালি কেন? আমি জানি প্রথমে তুই নি*র্দোষ ছিলি। কিন্তু কেউ তোকে বাধ্য করেনি পরে এসব উল্টা পাল্টা কাজ করতে। ভেবেছিস স্কুলে আসি না বলে এখানে কী হচ্ছে কিছুই আমার কানে আসে না? যেটা সত্য সেটা বলতে আমি দুবার ভাবি না। সকলেই তোকে অনেক বার মানা করেছে। কিন্তু নাহ! তুই তো শুনবি না। এখন পরিস্থিতি কোথায় গড়িয়েছ নিজেই বোঝ।’
ইভান ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। ক্রোধে ওর গালে লালচে আভা দেখা গেল। কিছুক্ষণ মৌণ থেকে আত্মসংযম করে কিছুটা শান্ত কন্ঠে বলল,
‘প্রথমত আমার কোন দোষ ছিলো না কিন্তু পরে যা করেছিলাম তার জন্য আমার কোন আফসোস নেই। ও এটা ডিজার্ভ করত। অনেক বড় একটা ঝা*মেলায় যে জড়িয়ে গিয়েছি সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমার মোটিভগুলো যদি না বুঝিস তাহলে প্লিজ এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা বলিস না।’ বলে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। এ্যাভরিল বিরক্তি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কনক্রিটের রেলিঙে উঠে বসল।

———————-

‘এত বছর আমেরিকায় থাকার পরও তোমার ব্রিটিশ এ্যাকসেন্ট ঠিক হয় না কেন?’ কাইলি নামক একটা মেয়ে টিটকারির সুরে বলল। অরল্যান্ডো নিজের ব্যাগটা নিজের ডেস্কে ছুঁড়ে ফেললো। বলল, ‘এটা কোন রোগ বা সমস্যা নয় যেটা ঠিক হওয়া দরকার। তাই এটা কখনো ঠিক হবেও না।’
বলে সিটে বসলো। ওর পাশের সারির এক বেঞ্চ আগেই নিনা বসেছিল। ও কিছুটা আনমনা হয়ে আছে। কাইলি আবারও বলল, ‘বাট ইউ নো এটা শুনতে অড লাগে। এটা ইউএসএ, ইউকে না। এন্ড অনলি আমি না আমাদের কারোরই ভালো লাগে না।’
‘তো? তাতে আমার কী? একই কথা বলতে বলতে ক্লান্তি লাগে না? তোমার বা টনি যে কারোরই ভালো লাগুক না লাগুক আই ডোন্ট কেয়ার। আমার এ্যাকসেন্ট নিয়ে আমি অনেক ভালো আছি। থ্যাঙ্কিউ ফর ইউর কাইন্ড এডভাইস।’ মেয়েটা আর কিছু না বলে গটগট করে হেঁটে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
নিনা পেছনে ঘুরে বসলো। অরল্যান্ডোকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমার এ্যাকসেন্টে খারাপ কী? ব্রিটিশ এ্যকসেন্ট তো শুনতে ভালোই লাগে। ওরা এমন করে কেন?’

‘ব্রিটিশদের দেখতে পারে না সোজা কথা।’ কৃত্রিম হেসে বলল অরল্যান্ডো।

‘কী আজব। তোমার সকল ফ্রেন্ডরাই কী একই মাইন্ডসেটের নাকি?’

‘সকলে বলতে আর কী কাইলি আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। টনি ছিলো আর, এ্যাশলি আর অনেকেই আছে তবে সমস্যাটা মূলত ওদেরই বেশি ছিলো।’

‘মানে টনিও পছন্দ করতো না?’

‘কাইলির মতো পার্সোনাল এটাক করতো না হাসি ঠাট্টা করতো আরকি।’ ম্লান কন্ঠে বলল ও।

নিনা কপালের হালকা রেখার ভাজ।
‘এই কথায় তুমি এতটা চিন্তায় কেন পরে গেলা বুঝলাম না।’

‘না না চিন্তায় পরিনি। ব্যাপারটা অদ্ভুত তাই ভাবছিলাম।’

‘ইট’স ওকে। সবাই কম বেশি এমন হয়ই।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল, ‘পরিস্থিতি ভেদে অনেক কিছুই করেছে ও। বাট সেসব মনে রাখতে হয় না।’

‘লাইক ইভানের সাথে ঘটা ঘটনা গুলো?’ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

অরল্যান্ডো ওর মুখের দিকে চাইল। বলল,
‘হুম অনেকটা। ওদের আর কী বলব। দুইজনই কম ছিলো না। বাট টনি তো আর নেই, কার সাথে ঝামেলা লাগবে বলো?’

‘বাই দ্যা ওয়ে আই এম সরি। তুমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড হারিয়েছ।’

‘হুম কয়েক দিন একটু খালি খালি তো লাগবেই। যেহেতু অনেক বছর যাবৎ বলতে গেলে সব জায়গায় এক সাথে যেতাম। সারাদিন একসাথে ঘুরতাম। ওকে খুব মিস করছি।’

‘আমিও।’ বিরবির করে বলল নিনা।

‘কিছু বললা?’ জিজ্ঞেস করল অরল্যান্ডো।

‘কিছু না।’ বলে ম্লান হাসল। সামনে ঘুরে বসল। ওর বলা কথা গুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।

——————–

‘আমরা যেই মানুষগুলোকে চিনি বলে ভাবি, তাদের আসলে আমরা কতটুকুই বা চিনি? ভেবে দেখেছিস কখনো?’ বলল অমিত।

‘আমি জানি না। তবে মোটেও আমি অন্যরা কী বললো না বললো তার ভিত্তিতে এত সহজে টনিকে বিচার করতে যাবো না।’ বিচলিত কন্ঠে বলল নিনা। ওরা করিডর ধরে হাঁটছে। এদিকে হাতে গোনা দুএকজন ছেলেমেয়েদের চোখে পরছে।এটা লাইব্রেরি ভবন।

‘নিনা ওদের দুজনেরই একে অপরের ওপর খুব জোড়ালো একটা রাগ ছিলো। কে জানে আসলে কী হয়েছিল বাট ওরা একদমই একে অপরকে দেখতে পারতো না। আমার সত্যিই মনে হয় ইভানকে সবাই যতটা দোষী বলে ঠিক ততটাই দোষী টনিও ছিলো।’

নিনা হাঁটতে হাঁটতে নিশ্চুপ ভাবে ওর কথাগুলো শুনছে। নিনার মনে কৃষ্ণ কালো মেঘের ভির জমেছে। মনটা ভারি হয়ে আছে সেই আগের দিন থেকে। অচেনা এক অস্থির অনুভুতি ওকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। ওরা নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছে গিয়েছে। থেমে গিয়ে অমিত বলল,
‘নিনা আমি যেই আইডিয়াটা দিয়েছিলাম সেটা সম্বন্ধে আরেকবার ভেবে দেখিস।’
নিনা একবার ওর দিকে তাকাল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা তাহলে কেন ইভানকেই সকলে এতটা দোষী ভাবে? কেন সবকিছুর জন্য ওকে শাস্তি পেতে হয়? কেন!?’

অমিত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। নিনার চোখে মুখে বিরক্তি বা রাগের লেশ মাত্র দেখতে পেল না। কাজল কালো চোখে জায়গা করে নিয়েছে কৌতূহল এবং উদাসীনতার কৃষ্ণ মেঘ।
অমিত কিছুক্ষণ মৌন থেকে ধীরে ধীরে বলল,
‘ ইভান এবং টনির মধ্যে পার্থক্য টা হলো টনি ছিল ঠান্ডা মাথার মানুষ। সহজে রেগে যেত না। অপর দিকে ইভানের সর্ট টেম্পার। কথায় কথায় মাথায় র*ক্ত উঠে যায়। ফলে ওদের মধ্যে হওয়া সকল গন্ডোগোল গুলোই বারাবাড়ি পর্যায়ে ইভানের কারণেই পৌঁছত বলা যায়। তাছাড়া আমি শুনেছি ওদের বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়েছে ইভানের কারণে।’

‘ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল!?’ অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘ওয়েল সবই আমার শোনা কথা। তখন তো এই স্কুলে ছিলাম না। যাই হোক।’ বলে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে আবার বলল,
‘যা এখন যেই ঝামেলাটা পাকিয়েছিস সেটা সামলা।’

নিনা কিছুই বলল না৷ অমিত ঘুরে চলে গেল। নিনা ভেতরে ঢুকলো। এখন ক্লাস হচ্ছে কিন্তু ওরা কেউই ক্লাসে যায়নি। অবশ্য ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার আসল কারণ ইভানও ক্লাসে যায়নি। ওর নাকি যুগ যুগ পূর্বে পাওয়া কোন এসাইনমেন্ট এখনো জমা দেওয়া বাকি। সেটা পরের ক্লাসে জমা দিতে হবে বলে তাড়াহুড়ো করে লাইব্রেরিতে এসে বসেছে এসাইনমেন্ট করতে। এ পর্বে নিনা অত্যন্ত আত্নবিশ্বাসের সমেত গটগট করে হেঁটে যেতে ব্যর্থ হলো। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে ওর অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত বিচলতা। ইভান একটা টেবিলে একা বসে গভীর মনোযোগে একটা খাতায় কিছু লিখছে। কত জনকে কত তিক্ত কথা বলেছে, রুক্ষ ব্যবহার করেছে। কখনো তো ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। অবশ্য আজকাল নিজের কান্ড দেখে নিজেই অবাক বনে যাচ্ছে নিনা। ইভানকে দেখে থেমে গেল। হৃদয়ের ওপর আরেক বোঝা ভারি পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হলো। নিঃশ্বাসও হঠাৎ ঘন হয়ে এলো। ইভান সম্পূর্ণ মনোযোগ ঢেলে দিয়ে একটা টেবিলে একা বসে লিখছে। ওর ডার্ক চকলেট রঙের চুলের এক গোছা কপালে এসে পরছে। সবসময় ওর চেহারায় যে স্বাভাবিক চাঞ্চল্যকর উচ্ছাস, উৎফুল্লতা থাকে তা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। এখন সামনে বসে আছে শুধু একজন শীতল, গম্ভীর মুখো, রুক্ষ মানুষ। নিনা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবল,
‘হ্যা আমি এটা করবো। আমাকে করতেই হবে। আমি তোমাকে নিয়ে আর কোন রিস্ক নিতে পারবো না। আমি কোন নাটক করতে পারব না। কিন্তু অন্তত নিজের রুড বিহেভিয়ার, তিক্ত কথাবার্তা থেকে তোমাকে দূরে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। সর্বোচ্চ চেষ্টা টুকু করব তোমার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করার।’ ভেবে এগিয়ে গিয়ে ইভানের সামনের সিটে না বসা পর্যন্ত ইভান ওকে খেয়াল করেনি। ইভান ওকে খেয়াল করেও অবাক হলো না৷ যদিও হয়তো নিনাকে আশা করেনি এখানে। চেহারায় গম্ভীর ভাব বিরাজমান রইল। একবারও চোখ তুলে নিনার দিকে তাকাল না। যেভাবে লিখছিল সেভাবেই লেখায় ব্যস্ত রইল।
নিনা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল, ‘দেখো….আমি… আমি আসলে যেটা করেছি সেটা….ঠিক হয়নি। আমি আসলে তোমাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে বা ইচ্ছা করে অবশ্যই করিনি। সেক্ষেত্রে আমাকে দায়িত্ব জ্ঞানহীন মনে হতেই পারে। আমি জানি যত সমস্যাই আসুক আমার একবার তোমাকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো…ইভান ওকে থামিয়ে দিয়ে শীতল স্বরে বলল,
‘আমার সময় তো তোমার সময়ের মতো সস্তা নয়। গতকালও যেমন আমার সময়ের দাম ছিলো এখনো আছে। এখন অত্যন্ত ব্যস্ত আছি। আশা করি সেটা নিজে থেকেই দেখতে পাচ্ছো।’
নিনা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো গিলতে বাধ্য হলো। তবুও ঠায় বসে রইল নিজের স্থানে। বলল, ‘তা দেখতেই পাচ্ছি। তাহলে তুমি শান্তিতে কাজ করো। আমি এখানেই বসে থাকি ততক্ষণ যতক্ষণ না তোমার কাজ শেষ হয়।’
যেই বলা সেই কাজ। ইভান কিছুই বললো না। নিনাও চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে বসে রইল না। ও নিজের বই খাতা বের করে পড়া শুরু করল। প্রায় বিশ মিনিট পর শেষ হলো ইভানের কাজ। ও দ্রুত গতিতে সবকিছু গুছিয়ে নিলো। নিনাও বই ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। ইভান উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল। নিনা প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর সাথে সাথে আসলো। তারপর শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘গতকাল আমি যখন রেডি হয়ে বাড়ি থেকেও বেরিয়ে গিয়েছিলাম তখন আমার একটা ফোন এসেছিল।’ বলে একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল,
‘খুব এমারজেন্সিতে আমাকে একটা স্থানে পৌঁছতে হতো। সেই সময় তাড়াহুড়োয় কিভাবে যে আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল তোমার কথা জানি না আমি। তবে এই ভুলে যাওয়ার কারণে যেই গন্ডোগোলটা হয়েছে সেটা তো আর ঠিক করতে পারবো না বা কালকের দিনটাও ফিরিয়ে আনতে পারবো না। এখন আমার হাতে যেটা আছে তা হলো মাফ চাওয়া।’ বলে থামলো। নিনা ইভানের দিকে তাকাল।
ইভান সামনের দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে হাঁটছে। যেন পাশে নিনার উপস্থিতি ও টেরই পায়নি। নিনা বলল, ‘আই এম রিয়েলি সরি। এন্ড আই মিন ইট।’ বলে শেষ করল। এরপর বেশ কয়েক মুহূর্ত কেউই কিছুই বললো না। নিনার মনে হলো যখন ইভান কিছু বলছেই না এভাবে ওর সাথে এগিয়ে চলার কোন মানে হয় না। কাজেই ও মৃদুস্বরে বলল,’আসছি’ বলেই হঠাৎ থেমে গেল। ইভান ভ্রুক্ষেপহীন এগিয়ে চললো। নিনা পাশের করিডোর দিয়ে চলে গেল। ইভান অবশেষে যখন পাশে দৃষ্টি ফেরাল তখন নিনা সেখানে নেই। অবাক হয়ে থেমে গিয়ে আশেপাশে তাকাল। গোটা করিডোর জুড়ে আর কেউ নেই। ভ্রু কুঁচকে ভাবল, ‘কিছু না বলেই হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল? ও কী আসলেই এসেছিল নাকি সবটা আমার কল্পনা ছিল?’

ইনশাআল্লাহ চলবে।