মনোভূমির ছায়া পর্ব-১৬১+১৭+১৮

0
81

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১৬
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

‘কি আজব! বাগানের মধ্যে এমন গাছ কেউ লাগায়?’
নিনার পায়ের পাতা পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল এ্যাভরিল। এখন আবারও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। অগত্যা সকলকে ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। ওরা রান্নাঘরের কাউন্টার টপের সামনে থাকা উঁচু স্টুল গুলোয় বসে আছে। অরল্যান্ডো ও কাইলি এসে ওখানে দাঁড়াল।

‘কিছু হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল অরল্যান্ডো।

‘না তো।’ বলল নিনা।

‘এ্যাভরিল তুমি তো স্কুলেই আসো না৷ তুমি নিউ গার্লের ফ্রেন্ড কিভাবে হলা?’ জিজ্ঞেস করল কাইলি।

‘হয়ে যায়। তার জন্য প্রতিদিন দেখা হওয়াটাও জরুরি নয়।’
বলল এ্যাভরিল।
একটা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে এসে ক্যাবিনেটগুলোর মধ্যে থেকে কুকি জার খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ওকে সাহায্য করতে এ্যাভরিল এগিয়ে গেল। নিচের একটা ক্যাবিনেট থেকে জার বপর করল।

কাইলি ওকে থামিয়ে বলল, ‘ওহ লেসলি ওয়েট। আমি একটা কুকি নেব।’ ও থেমে গেল। কাইলি একটা ক্যারামেল কুকি নিয়ে অরল্যান্ডোর দিকে ইশারা করে বলল, ‘নিবা একটা কুকি? ওহ সরি বিস্কিট। হ্যা বিস্কিট নিবা?’ হালকা টিটকারির সুর মিশে ছিল ওর কথায়।

অরল্যান্ডো বিরক্ত হয়ে ওর পাশ থেকে সরে দাঁড়াল।
‘আমি নেব একটা কুকি।’ বলল নিনা। কাইলি ওর দিকে এগিয়ে দিল।
বলল, ‘হেই তোমরা কেউ কী ন্যাসভিল সামার ফেস্টিভ্যাল এ গিয়েছ?’

‘না। কার সময় আছে এত?’ বলল নিনা।

‘আমিও না। কয়েকদিন ধরে সব নেইবারহুড গুলোয় কী ঘোরা যে ঘুরল। কি লাভ হলো?’ বলল কাইলি।

‘জাস্ট পাবলিসিটি।’ বলল অরল্যান্ডো।

‘বাট আমাদের স্কুলের বেশ ভালো সংখ্যক শিক্ষার্থীরা ওখানে পার্ট টাইম জব করে।’ বলল নিনা।

‘হ্যা। কারো কারো পরিবার স্টলও দেয়।’ বলল এ্যাভরিল।

এমিলি একটা ট্রে হাতে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকলকে নিজ হাতে জুস পরিবেশন করছে। কাইলি সেদিকে ইশারা করে বলল, ‘মাঝে মাঝে আমি ওকে বুঝি না। এই বিলাসিতা এই বুঝদারি।’

‘ ব্যবহারের দিক দিয়ে অন্তত আমার ওকে খুব ম্যাচিউরই মনে হয়েছে। যদিও ওকে আসলে অতটা কাছেপিঠে দেখাও যায় না। নিজের বান্ধবীদের সাথেই থাকে।’ বলল অরল্যান্ডো।

‘আন্তরিকতা এবং দয়াটা ওর স্বভাব। এর সাথে বিলাসিতার সম্পর্ক নেই।’ বলল এ্যাভরিল।

‘সেটাই। এই যেমন ডেসটিনেশন বার্থডে পার্টি, সপ্তাহে সপ্তাহে বাসায় পার্টি দিয়ে টাকা ওড়ানো এসব বিলাসিতা নয় তো কী?’ বলল কাইলি।

‘টিপিক্যাল এভারেজ আমেরিকান কিড। যাই হোক ওর কথা বাদ দেই।’ নিনা হালকা বিরক্তির সঙ্গে বলল কথাটা।

‘বাই দ্যা ওয়ে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমাদের বাস্কেটবল ম্যাচ। আবার সামনেই রাগবিও আছে। তখনই এমিলি ওর জন্মদিনের পার্টিটা ফেলছে। দেখিও এন্টোনি, ইভান ও লি সঙ যাবে না। ওরা আর যাই হয়ে যাক ম্যাচ ছাড়বে না।’ বলল অরল্যান্ডো

‘এখন ওর জন্মদিন ওই সময়ে পরলে আর কী করার।’ বলল এ্যাভরিল।

‘টনি থাকলে খেলাও বাদ দিত বোনের জন্য। সে তো সেই।’ বলল কাইলি।

‘ওরা সকলে একসঙ্গেই খেলত?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘হ্যা। সমস্যা হতো কিনা জানতে চাইছ তো? না হতো না। ওদের দেখে মনেই হতো না যে ওরা কোন কালেরও শত্রু হতে পারে। অবশ্য সেটা শুধু খেলার সময়টুকুর জন্য। আর টনি তো আবার খেলার সুযোগ গত বছরই পেল।’ বলল অরল্যান্ডো।

‘নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যার প্রভাব খেলায় পরতে দিত না আরকি।’ বলল এ্যাভরিল।

নিনা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা টনি বাস্কেটবল থেকে সাসপেন্ড কিভাবে হয়েছিল?’

ওরা তিনজনই নিশ্চুপ হয়ে গেল ক্ষণকালের জন্য। অবশেষে অরল্যান্ডো বলল,
‘ওকে ফাঁসানো হয়েছিল….ম্যাচ ফিক্সিংয়ে।’

‘মানে!? কিভাবে?’ বিস্ফারিত কন্ঠে বলল নিনা।

অরল্যান্ডো পুনরায় উত্তর দিতে যাচ্ছিল তখনই,
‘হেই! তোমাদের কেউই দেখি জুস নাওনি।’ বলে এগিয়ে এলো এমিলি। অরল্যান্ডোর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তো ব্রেন্টউডে আসছ তো?’ যদিও কথাটা এ্যাভরিলের দিকে তাকিয়ে বলল তবুও উদ্দেশ্য করেছে সকলকেই।

‘আমি নিশ্চিত নই।’ ইতস্তত ভাবে বলল এ্যাভরিল।

‘চেষ্টা করো। অলওয়েজ তোমাকে পাশে পাওয়ার অভ্যাস আছে। তুমি না থাকলে কেমন লাগবে না?’
বলে এ্যাভরিলকে কোন উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘নিনাও তো আসছ তাই না?’ বলে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকাল ওর পানে।

‘চেষ্টা করব।’ উত্তরে বলল সে। আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘লিজা কোই?’

‘ওপরে। ওহ তোমরা এখনো ওপরে যাওনি না?’ তখনই একটা মেয়ে এসে কাইলিকে ডেকে নিয়ে গেল। ও যেতেই অরল্যান্ডোও আর দাঁড়াল না। নিনা স্টুল থেকে ধপ করে নেমে বলল, ‘চলো ওপরে যাই।’

এমিলি পুলকিত হয়ে উঠল। যদিও এতে এত আনন্দিত হওয়ার মতো কিছু পেল না এ্যাভরিল। ও বলল, ‘আমি এখানেই ঠিক আছি।’ এমিলি আর জোর করল না। পায়ে আর জ্বা*লা করছে না। তবে কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে জায়গাটায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পূর্বেই ইভানের সামনে পরল। ইভান সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল। ওর রাগটা ভেঙেছে কিনা বোঝ গেল না। ভাবসাব গম্ভীর। তবে নিনাকে পাশ কাটানোর সময় নরম কন্ঠে বলল,
‘পায়ের ব্যাথা কমেছে?’
‘হ্যা। এখন হাঁটতে পারছি।’
ইভান শুধু মাথা দুলিয়ে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই এমিলির কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে নিনা বলল, ‘সেদিন তোমার কামরাটা দেখাই হয়নি। আজ না দেখে যাব না।’
এমিলি মুচকি হাসল। ভেতরে লিজা একটা মেয়ের সঙ্গে বসে গল্পে মশগুল ছিল। মেয়েটাকে সবসময় ওদের সাথে দেখা যায়। কালো চুলের অর্ধেকটা গাঢ় বেগুনি রঙা। হলদেটে ফর্সা শীর্ণকায় শরীর। ওরা কথা থামিয়ে একবার এদিকে চাইল। আবারও নিজেদের কথায় মন দিল।
‘ওফ আজই এত বৃষ্টি হওয়া লাগতো? অনেকেই বৃষ্টির জন্য আসেনি।’ বিরক্তি মাখা স্বরে বলল এমিলি।

‘বৃষ্টি তো ভালোই লাগে। আবহাওয়াটা ঠান্ডা ঠান্ডা থাকে।’ বলল নিনা।

‘তা ঠিক। কিন্তু বছরের অর্ধেক দিনই বৃষ্টি হলে ভালো লাগে বলো? চারিদিক যেমন মন ম*রা, স্যাতস্যাতে, অন্ধকার হয়ে থাকে। মন খারাপ হয়ে যায় এসব দেখলে।’

দরজার পাশেই দেয়ালে টাঙানো ম্যাগনেট ফ্রেমটার দিকে চোখ রাখল নিনা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করতেই দেখল সেই মাকড়সার জাল ওয়ালা প্রজাপতির ম্যাগনেটটা পূর্বের স্থানেই রয়েছে। নিনা সেদিকেই তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ম্যাগনেট কালেক্ট করা তোমার হবি তাই না?’

‘আমার না। টনির ছিল।’

‘টনির? তাহলে এগুলো টনির?’

‘হ্যা। ফ্রেমটা লিভিং রুমেই ছিল। আমি আমার কামরায় আনিয়েছি। ভালো লাগে দেখতে।’

‘ওহ তো এসব টনি কালেক্ট করেছে?’

কাঠের ফ্রেমের ভেতর স্টিলের জমিন। সেখানে প্রায় শখানেক বর্নিল ম্যাগনেট লাগান।

‘না বেশ কিছু উপহারও পেয়েছে। আসলে যেই শুনতো ওর এই ম্যাগনেটের প্রতি অবসেশনের কথা সেই ওকে কখনো না কখনো ম্যাগনেট উপহার দিত।’

ছোট ছোট লাল পুঁতি দিতে গাঁথা টমেটো নকশার একটা ম্যাগনেটের দিকে চোখ আঁটকে গেল নিনার। সঙ্গে সঙ্গে কিছু স্মৃতিরা চনমনে হয়ে উঠল। যখন ফ্রুট সপে কাজ করত ওরা নিনা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ওর ম্যাগনেট দিয়ে বড় রেফ্রিজারেটরে আঁটকে রাখত। পুঁতি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকম সবজির নকশার ম্যাগনের ছিল ওর। সেখান থেকেই একদিন টনি টমেটোর ম্যাগনেটটা নিয়েছিল। কিন্তু দোকানে রাশ থাকার কারণে ওর শখের কথাটা আর কখনো শোনা হয়ে ওঠেনি।

‘এর মধ্যে বেশির ভাগ উপহার ও বাবা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে। কারণ তাদের বিভিন্ন দেশে যাওয়া আসা লেগেই থাকে।’

নিনা মাকড়সার জাল ওয়ালা প্রজাতির ম্যাগনেটটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘এটা অন্য রকম সুন্দর। এটা কোথা থেকে এনেছে?’

‘এটা টনি আনেনি। এটা উপহার পেয়েছিল।’

‘ওহ কার কাছ থেকে?’

‘হারিন। আমার যতদূর মনে পরে হারিন বোস্টনের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে নাকি এটা কিনেছিল।’

নিনা অবাক না হয়ে আর পারল না। যেখানে যেরকমই সূত্র মিলুক না কেন শেষমেশ এর গোড়ায় গিয়ে পাওয়া যায় হারিনকে। বাহ! হারিনের নাম শুনেই যেন লিজা তৎপর হয়ে উঠল। অথবা ওদের গল্পের ইতি টেনেছে বোধহয়। এদিকেই এগিয়ে আসল। নিনা তখনই পুঁতির টমেটো ওয়ালা ম্যাগনেটের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আর এটা?’

‘এটা হ্যা এটা একদম অন্য রকম না? এটা ঠিক নিশ্চিত জানি না কে দিয়েছে। কোন একটা কোকোনাট নামক ফ্রেন্ড।’

‘ওহ সেই কোকোনাট। অনেকটা তোমার মতোই।’ তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলল লিজা।

‘আমার মতো মানে?’ ভ্রু সুচালো হলো ওর।

‘না না মাইন্ড করো না। বলতে চেয়েছি বাইরে থেকে শক্ত তবে ভেতরে ভেতরে নরম। তোমার সাথে মেলে আরকি।’

নিনা মাথা নাড়ল। এক মুহূর্তের জন্য হৃদয়টা কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এই বুঝি ধরা খেয়ে গেল। টনিই নিনার নিকনেম দিয়েছিল কোকোনাট।

‘ওই পরির ম্যাগনেটটা কোই এমিলি?’ জিজ্ঞেস করল লিজা।

এমিলি কিছু একটা ভাবছিল। চমকে উঠল ওর কথায়,
‘কী?’

‘তুমি এক সেকেন্ডের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেলা?’

‘না কিছু না।’

‘বলছিলাম পরির ম্যাগনেটটা কোথায়?’

‘ওহ। ওটা আমার একটা কাজিন নিয়ে গিয়েছে।’

নিনা আপন ভাবনায় ডুবে গিয়েছে, ‘হারিন যদি সেই ম্যাগনেটটা দিয়ে থাকে। তাহলে ওটা নিশ্চয়ই এক পিসিই দিয়েছিল। একই জিনিস তো আর ডজন ডজন দিবে না। সেটা যদি এখানেই থাকে তাহলে কাজটা এমিলির করার সম্ভাবনা নেই। তাহলে কী? হারিন করেছে? হারিন অমিতকে স*ন্দেহ করে হু*মকি দিয়েছে? দিয়ে থাকলেও অবাক হব না। যতই প্যাঁচ খুলতে যাচ্ছি ততই প্যাঁচ লাগছে আরোও বেশি। এবং সুতাগুলোর ডোর গিয়ে থামছে হারিনের কাছে। অথচ মানুষটির সঙ্গে এখনো অব্দি কথাও হয়নি আমার।’

নিনা ভাবতে ভাবতেই কামরা থেকে বেরিয়ে এলো। ধীর গতিতে হাঁটছে আর ভাবছে, ‘আরেকটা হিসেব মিলানো তো এখনো বাকিই রয়েছে। হেমলকের মতো বি*ষাক্ত একটা গাছ কেন টনি নিজেই নিজের বাগানে লাগিয়ে রাখতে বলবে? আর যদি ও নাও জেনে থাকে যে এটা বি*ষাক্ত তারপরও এর মাধ্যমে ও মা*রা যেতে পারে না। এই যেমন আমি আঁ*চড় খেলাম। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু মা*রা যেতে হলে গাছের কোন না কোন অংশ ওর শরীরে প্রবেশ করতে হবে। মৃ*ত্যুর পূর্বে শেষবার খেয়েছিল ওই স্ট্রবেরি শেইক টা। যদিও ওটার বোতলে কিছুই পাওয়া যায়নি কিন্তু ওটা অন্য কোন গ্লাসে ঢেলে খেয়েছিল ও। তাই তো গ্লাসে কিছু ছিলো কিনা তা বের করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু টনির হেমলকের বি*ষেই মৃ*ত্যু হয়েছে। একই সময় লিজার হাতে হেমলকের ইনফেকশন। ব্যাপারটা অবশ্যই কাকতালীয় হতে পারে না। তাও আবার সেদিনই ইভান এই বাড়ি এসেছিল যেখানে ও কখনোও আসে না। কিন্তু তাই বলে দুজন ভাইবোন মিলে তো আর একটা মানুষকে মা*রতে পারে না। অপর দিকে লিজা সেদিন এমিলির সঙ্গে স্লিপ ওভারে অন্য কোন ফ্রেন্ডের বাড়ি গিয়েছিল।
আর ওরা এসেছিল কিনা তাও তো রহস্য। কারণ সিসিটিভি আবার ঠিক ওই সময়টাতেই বন্ধ ছিল। ওফ আমার মাথা ঘুরছে! এত কেন জট পাকাচ্ছে এসব?’

ভাবতে ভাবতেই নিনা গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই কারো সঙ্গে ঢা*ক্কা খেল। সিঁড়ির অপর পাশ থেকে কেউ আসছিল যাকে খেয়াল করেনি। হারিনের সঙ্গে মাথায় ঢা*ক্কা লেগেছে। হারিন কপালে হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে বলল, ‘এত তাড়া কিসের?’

‘কোথায় তাড়া? আমি খেয়াল করিনি।’

‘ওহ না যেভাবে ঝড়ের গতিতে নামছিলা ভাবলাম কিনা কি।’

সদ্য এতকিছু গোলমেলে সূত্র ঘাটার পর আবার সেই স*ন্দেহভাজন মানুষটির সামনেই পরল বলে অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে নিনা। হারিন বলল, ‘তুমি কী বেরিয়ে যাচ্ছ?’

‘না তো। কেন?’

‘এমনি। কয়েকদিন ধরেই একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সবসময়েই তোমার আশেপাশে অমিত থাকে অথবা তোমাকে খুঁজেই পাই না।’

‘কী এমন জরুরি কথা?’ ভ্রু সূচালো হলো নিনার।

‘না মানে আসলে জরুরি নয়। তুমি যেমন ভাবছো তেমন কিছু না।’ কিছুটা বিভ্রান্ত ফুটে ওঠল ওর চোখে।

‘কথাটা কী? বলবা তো?’

‘তুমি কী কোন কারণে আমাকে পছন্দ করো না?’

হঠাৎ এমন প্রশ্ন করবে তা ভাবতে পারেনি নিনা। অপ্রস্তুত হলো। বলল,
‘আজব তো। এই প্রশ্নটা উঠছে কেন? তোমার সঙ্গে তো আমার কখনো পরিচয়ই হয়নি তাহলে আলাদা করে তোমাকে অপছন্দই বা করতে যাব কেন আমি?’

‘না আমার মনে হলো।’ মৃদুস্বরে বলে চুপ হয়ে গেল।

‘কেন মনে হলো? কোন কারণ তো থাকবে?’

‘জানি না। জাস্ট মনে হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।’ বলেই একটু বিরতি দিয়ে আবারও ফট করে বলল,
‘অবশ্য আমিও বোকার মতো কথা বলছি। তুমি পছন্দ না করলেও সেটা বলবাও বা কেন?’

‘আচ্ছা ওসব বাদ দাও। কী অপছন্দ পছন্দ লাগিয়ে রেখেছ?’

অমিত করিডর ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ নিনার মি.মালিকের দেয়া সেই চিপটার কথা মনে পরল। এই সুযোগ!
নিনা বলল, ‘আচ্ছা শোন আমাকে একটা সাহায্য করবা? আমার ফোন থেকে কল যাচ্ছে না। নেটওয়ার্কে কোন প্রবলেম হচ্ছে মনে হয়। তোমার ফোনটা দিবা আমার একটা জরুরি কল করতে হবে।’

হারিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জানে যে এখানে অমিতও উপস্থিত রয়েছে। তবুও একটু ভেবেই হাতের মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল। নিনা হালকা হেসে মোবাইলটা নিয়ে একদিকে সরে গেল। যাওয়ার সময় অমিতকে পাশ কাটাতে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘হারিন কে ব্যস্ত রাখ।’ অমিত কোন প্রশ্ন করল না। কথাটা শুনেছেও কিনা বোঝা গেল না। তবে ও গিয়ে এদিক ওদিক তাকাল যেন কিছু খুজচ্ছে। তারপর হারিনকে কিছু একটা বলল। নিনা দূরে সরে গিয়েই মোবাইলের পেছনের খাপটা খুললো। আলাদা কোন কভার লাগানো ছিলো না। ব্যাগ থেকে ছোট্ট চিপটা বের করে সিমের নিচে আলগাভাবে আটকে রেখেই খাপটা লাগিয়ে দিল। এখন এটা না খুললেই হলো। মোবাইলটা অফ হয়ে গিয়েছিল। অন করে কনট্যাক্ট বের করল। কোথাও তো কল দিতে হবে। কিন্তু কোথায়? অমিতকে দেওয়া যাবে না। এ্যাভরিলকেও না। হারিনের নম্বর বলে কথা। একটাই নম্বর মাথায় আসল ওর। ল্যান্ড লাইন। নিজের বাড়ির নয়। অমিতের বাড়ির। ল্যান্ড ফোনটা থাকে ওর দিদার কামরায় যেটা কখনোই রিসিভ করা হয় না। কেন যে অকেজো জিনিসটা কামরায় ফেলে রাখা হয়েছে এই রহস্য কখনোই নিনার মাথায় ঢোকেনি। নিজের মেবাইল থেকে নম্বর দেখে ডায়াল করে কল দিল, বেশ কিছুক্ষণ বেজে কেটে গেল। তারপর ফিরে গিয়ে হারিনের দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে ধরল। বলল, ‘ধরল না। কি যে সমস্যা জানি না।’

তারপর অমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ্যই তোকে পাচ্ছিলামই না। কোথায় ছিলি?’

‘লিভিং রুমে ছিলাম। আমিই তো তোর দেখা পাচ্ছিলাম না।’

‘আচ্ছা যাই হোক তোর মোবাইলটা দে। দেখি এখান থেকে ফোন করে।’ বলতে বলতে ওরা এগিয়ে গেল। হারিনের স*ন্দেহ হয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও এখনো অব্দি ওকে নিয়ে যত কিছু শুনেছে সে অনুযায়ী ও অত্যন্ত চালু মেয়ে।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব ১৭
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

পরিষ্কার আকাশের এক কোণে ঝুলে রয়েছে আলোর টুকরো চাঁদ। ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, গাছপালা, মানুষজন। জানালার পাশে টেবিলময় বই খাতা ছড়িয়ে রাখা। ল্যাপটপে ব্রাউজার খুলে রেখে সামনে বসে প্র্যাক্টিক্যাল তুলছে নিনা। এ্যাভরিল কিছুক্ষণ পূর্বেই বাসায় ফিরেছে। ক্লান্তির ঠেলায় সোজা গিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পরেছে। রাত জেগে কাজ করছে বলে রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে আনল নিনা। এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। অবশ্য এটাকে রাত না বলে সন্ধ্যাও বলাই যায়।
সাধারণত এত রাত অব্দি ও জেগে থাকে না। কফি বানিয়ে ফিরে এসে যখন চেয়ারে বসল তখন কলমটা আর খুঁজেই পাচ্ছে না। কেন যে গেল? দুনিয়ার কাগজ জড় হয়ে আছে টেবিলে। সেগুলো সরাতে গিয়ে কী যেন ছি*ড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো ঘেটে দেখতেই বুঝল ইভানের দেওয়া সেই একটা পাতা প্র্যাক্টিকেলটাই ছিড়েছে। নিনা সেটা সামনে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক বসে রইল। এখন কী করা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারল না। এত সুন্দর প্র্যাক্টিক্যালটা ওকে দিল, আর ও সেটা ছিঁড়ে ফেললো? এত বেখেয়াল কেন ও? নিজেকে ভৎর্সনা দিতে যখন ব্যস্ত নিনা ঠিক তখনই গুগল ম্যাপ সোচ্চার হয়ে উঠল। ব্রাউজারে গুগল ম্যাপের ট্যাবটাও অন ছিলো। সেদিকে নজর দিয়ে ট্যাবটা খুলতেই দেখল লোকেশন অন হয়ে গিয়েছে। লোকেশনটা ডাউনটাউন ন্যাশভিলেরই। লাল মতো একটা বিন্দু ক্যাম্বারল্যান্ড ব্রিজ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। নিনা সেটা জুম করল। বিন্দুটা আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ন্যাশভিল লোকাল হাই স্কুলের সামনে থামল। নিনার কপালে গভীর ভাজ।
‘হারিন এত রাতে স্কুলে কেন যাচ্ছে? স্ট্রেঞ্জ!’, বিড়বিড় করে বলল। যেহেতু চিপটা হারিনের মোবাইলে লাগানো হয়েছিল কাজেই সেটা এখন স্কুলের ভেতর ঢুকেছে। কিছুক্ষণ বাইরে স্থির ছিল। নিনা ল্যাপটপ বন্ধ করে লাফ দিয়ে উঠল। রাতের পোশাক পরে ছিল। পোশাক পাল্টে বাড়ি থেকে যেনতেন ভাবে বেরিয়ে গেল। মোবাইলে ম্যাপ খোলা আছে। হারিনের লোকেশন এখনো স্কুলের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরেছে নিনা। রাত বাড়ার সাথে সাথে নেইবারহুড গুলো নির্জন, নিরব হয়ে পরে। সাই সাই করে বাতাস কে*টে সাইকেল ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ডাউনটাউন এ এসে ক্যাম্বারল্যান্ড ব্রিজ পার হওয়ার সময় নদীর ধার ধরে শুধু আলো ঝলমলে ন্যাশভিল দেখা গেল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদে চোখ ধাধান আলোয় জমজমাট হঙ্কি টঙ্ক রোড। দূরে রাস্তার পাশের বর্ণিল আলো গুলো নদীর পানিতে পরে ঝলমল করছে। নেইবারহুড গুলো নিরব হয়ে পরলেও ডাইনটাউনে যেন মাত্র সন্ধ্যা নেমেছে। এদিক ওদিক মানুষের ভির। পর্যটকরাও রাতের ন্যাশভিল দেখতে বেরিয়েছে।
এসব কোন দিকে দৃষ্টি পাত না করে সোজা এসে স্কুলের সামনে থামল নিনা। গেইটের পাশে ছোট্ট সিকিউরিটি বুথে বসে গার্ড গভীর ঘুমে নিমগ্ন। নিনা সন্তর্পণে পকেট গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকল। বড় গেটটা স্কুলের পর বন্ধ থাকে। মোবাইলে ম্যাপ এ স্কুলটা আর খুলছে না তবে হারিন যে একেবারে দক্ষিণে রয়েছে সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। নিনা দ্রুত পায় স্কুল বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করল। লাল বিন্দুটা অনেকক্ষণ যাবৎ সেই দক্ষিণেই স্থির হয়ে আছে। তবে সেটা কয় তলা এটা বোঝা সম্ভব নয়। নিনা অন্ধকার শূন্য করিডোরে দাঁড়িয়ে। ভাবল, ‘নিচ তলায় দক্ষিণে অফিস। দুই তলায় ক্লাস রুম। তিন তলায়ও ক্লাস রুম। চার তলায় কাউন্সিলরের অফিস।’

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করেই নিনা যখন কিছুই আন্দাজ করতে পারল না। তখন সিদ্ধান্ত নিল প্রতি তলারই দক্ষিণ দিক দেখে যাবে। প্রথম তলায় অফিস রুম ঘুরে গেল কিছুই নেই। সিঁড়ি মাত্র দ্বিতীয় তলায় উঠেছে এমন সময় খালি করিডর পদশব্দের প্রতিধ্বনি হলো। নিনা সতর্ক হয়ে দুই পাল্লা বিশিষ্ট আলমিরার পাশে দাঁড়াল। হারিন যদি এদিকেই আসে তাহলে আলমারির অপর পাশ দিয়ে চলে যাবে। নিনাকে দেখার সম্ভাবনা নেই। আলমারির পেছনেই জানালা ছিল। হঠাৎ জানালায় চোখ পরতেই দেখল মেইন গেইট দিয়ে একটা কৃষ্ণকায় অবয়ব দ্রুত গতিতে ভেতরে ঢুকে গেল। দেখতে চিকন, খুব বেশি লম্বা নয়। মনে হয় না কোন শিক্ষার্থী ভিন্ন অন্য কেউ হতে পারে। নিনা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। চাঁদের আলোয় যা একটু দেখা গেল। ভেতরে তাকাল এবার। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো চুইয়ে পরছে মেঝেতে। এছাড়া গোটা করিডোরে ঘুটঘুটে আঁধার। সিঁড়ি দিয়ে পুনরায় নামতে নামতে ভাবল, ‘হারিন এত তাড়াহুড়োয় নিচে গেল কেন? আর যে আসলো সেটাই বা কে? ও কী হারিনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে? কে হতে পারে? অরল্যান্ডো? না না, ওদের দেখা করার জন্য এত রাতে এই স্কুলে আসার দরকার পরত না।’ ভাবতে ভাবতেই আবারও ম্যাপ দেখল। বিন্দুটি পুনরায় দক্ষিণে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ হারিন অফিস রুমেই গিয়েছে। নিনা আঁধারে ঢাকা করিডরের দেয়াল ধরে হাঁটছে। মোবাইলের আলোরও সাহায্য নিতে পারবে না। পেছনে একটা খসখস শব্দ হলো। নিনা থেমে গেল। পেছনে ঘুরেই অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। শব্দটাও আর হলো না। নিনা আবারও হাঁটতে শুরু করল। কেন জানি ভেতর থেকে মনে হচ্ছে ও এখানে একা নয়। কেউ আছে। এটা কী সে হতে পারে যে মাত্র ভেতরে ঢুকলো? দরুণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।
নিনা অফিস রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। অফিস রুমের সামনে সম্পূর্ণ দেয়ালটাই কাঁ*চের। তবে মেঝে থেকে বুক পর্যন্ত উচ্চতায় কাঁ*চটা ঘোলা প্রকৃতির। নিনা সামনা সামনি গেল না। দেয়ালের পাশে দাঁড়াল। কাঁ*চের দেয়ালে দুটো কালো মূর্তি স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। কাঁ*চের দেয়াল বিধায় ভেতরের কোন শব্দ বাইরে এসে পৌঁছবে না৷ কাজেই নিনা সাবধানে হাতে থাকা ছোট্ট ব্যাগটা থেকে একটা টিস্যু বের করল। সেটা মুড়িয়ে দরজাটা ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করে সেখানে রাখল। এখন শব্দ আসছে। নিনা নিজের ফোনে রেকর্ডার চালিয়ে দরজার মুখে ধরল। ওরা এতটাও আস্তে কথা বলছে না। অথবা রাতের পিনপতন নিরবতায় স্বাভাবিক কথাই তীব্র শোনাচ্ছে। হারিনের কন্ঠই শোনা গেল,
‘হুম আমার আসলে অতটাও বেগ পেতে হবে না এটা প্রমাণ করতে। অথবা বলা যায় সকলকে বিশ্বাস করাতে।’ বলে থেমে গেল। অপরজন কিছু বলল হয়তো। সে এত মৃদুস্বরে কথা বলছে যে তা দরজার বাইরে পর্যন্ত আসছে না।

‘জানো তো ওর সাথে আমার ঠিক ওই সময় টেক্সটে কথা হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই আমি যা জানি তা অন্য কেউ জানে না। আর তোমার কীর্তিকলাপের কথাও আমি খুব ভালো করেই জানি।’ শীতল কন্ঠে বলল হারিন। আবারও নিরবতা। হারিন আবার বলল,

‘তুমি সেদিন সন্ধ্যায় আবারও ওই বাড়ি গিয়েছিলে যেটা সিসিটিভিতে রেকর্ড হয়নি। আর কী লাগে? আর কী আশ্চর্য না যে তুমি খুব সুন্দর করে নিজের ব্রেসলেটটাও সেখানেই ফেলে চলে এসেছ। তাছাড়া….তখনই করিডোরে খসখসে কোন শব্দ হতেই নিনা চমকে উঠল। সাথে সাথে হাতে থাকা মোবাইলটা কাঁচের দরজায় টুং করে বাড়ি খেল। ঝট করে হাতটা সরিয়ে ফেললো সে। ভেতরে ওদের কথা থেমে গিয়েছে। নিনা উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত লকারগুলোর পাশে এসে দাঁড়াল। তখনই দরজাটা খুলে দুজন বেরিয়ে এল। হারিনের পেছনে থাকা অপরজন একটা হুডি পরে আছে। কাজেই চেহারা দেখা দায়। অফিস রুমের পাশেই পেছনের দরজা। হারিন সামনের দিকে নিনাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এবং অপর জন পেছনের দরজার দিকে চলে গেল৷ হারিন হেঁটে গিয়ে বাক নিতেই নিনা পেছনের দরজার কাছে চলে গেল। জায়গাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সাবধানে দরজাটা খুলল। বাইরে চাঁদের আলোয় প্রায় পরিষ্কার দেখা যায় সবকিছু। এটা একদম পেছনের দিক বলে শিক্ষার্থীরা কদাচিৎ আসে এদিকে। এখানে ঘাস নেই। লাল মাটি এত নরম যে একটু বৃষ্টি হলেই কয়েকদিন পর্যন্ত কাঁদা কাঁদা হয়ে থাকে। এই জায়গা ভিন্ন ন্যাশভিলে আর কোথাও কখনো লাল মাটি দেখেনি। আশা করা যায় কেউ এদিক থেকেই গিয়ে থাকলে তার জুতায় লাল মাটির চিহ্ন অবশ্যই থাকবে। হঠাৎ নিনা স্থির হয়ে গেল। এবার স্পষ্ট ভাবেই মনে হলো পেছনে কেউ আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে এল। যদিও ওরা দুজন হলে তেমন একটা বিপদের আশঙ্কা ছিলো না। তবে ওরা না হয়ে অন্য কেউ যদি হয়। তাহলে বিপদ হতেও পারে। অবশ্য ওরাও যে বিপদের কারণ হতে পারে না সেটাও কেউ বলেনি। নিনা ঘুরে দাঁড়াতেই একটা আলো জ্বলে উঠল। সেটা জ্বলেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার হাতেই। মোবাইলের আলো। প্রথমে আলোর তোরে নিনার চোখ বুঝে এলো। আলোটা চোখে সয়ে আসতেই নিনা চোখ মেলে তাকাল। দেখল সামনে ইভান দাঁড়িয়ে আছে। যদিও আশা করেছিল যে অপরজন ইভানই হবে তবে ওকে এভাবে ধরে ফেলবে সেটা আশা করেনি। কাজেই হতভম্ব হয়ে গেল নিনা। ইভান শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এত রাতে কী করছ এখানে?’

নিনা লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আমার ফোন…নিতে এসেছিলাম। লকারে ফেলে থুয়ে গিয়েছিলাম।’

‘তোমার সারাদিন বাদে এই রাতের বেলা মনে হয়েছে যে ফোন হারিয়ে গিয়েছে?’ ইভানের ভ্রুু সূচালো হলো।

‘না। সারাদিন যাবৎ খুঁজছিলামই। যখন মনে হলো লকারে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে তখন রাত হয়ে গিয়েছে।’ এবার ইভানের গাম্ভীর্য যেন কিছুটা কাটলো। ছোট করে বলল, ‘ওহ।’ মোবাইলের আলোটা সরাসরি নিনার মুখের দিকে ধরে ছিল। নিনা ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘চোখে লাগছে।’
তারপর একটু থেমে ওকে জেরা করে কঠোরভাবে বলল,
‘আর তুমি এখানে কী করছ?’

ইভান যেন থতমত খেয়ে গেল। নিনার চোখের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বলল, ‘পিছু নিয়ে এসেছি।’

‘মানে? আমার?’

ইতস্ততভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যা।’

‘তুমি আমার খোঁজ পেলা কোথা থেকে?’

‘রাতে মাঝেমাঝে আমি সাইকেল চালাতে বের হই। আজ তোমাকে চোখে পরে গেল স্কুলের কাছাকাছি।’

নিনার স*ন্দেহ এখনো কাটেনি। জানে আসল কথা এটা নয়। আসলে ও হারিনের সঙ্গে কথা বলতেই এখানে এসেছিল।

‘তো আমাকে সাইকেল নিয়ে ধরলে কিভাবে? আমার আর তোমার গতিতে তো বেশ ফারাক।’ অন্ধকারে ঢিলটা ছুড়লে দিল নিনা। ইভান থমকালো। ওর জানার কথা না নিনা কিসে করে বা কিভাবে এসেছে। কারণ নিনা নিশ্চিত ইভান মোটেও ওর পিছু নিয়ে আসেনি। ইভান একটু ভেবে বলল, ‘সাইকেল দিয়ে সাইকেলের পিছু নেওয়া কী খুব কঠিন কিছু?’

‘না। কিন্তু আমার যতদূর মনে পরে আমার পেছনের ত্রিশ হাতের মধ্যে কেউ ছিলো না। তাই বলছিলাম।’

‘হ্যা আমি তোমার থেকে বেশ দূরে দূরে ছিলাম।’

নিনা নিশ্চুপ রইল। যদিও সে ইভানকে বিশ্বাস করেনি তবে সেটা প্রকাশ করল না। ইভান আবার বলল, ‘আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি লাভ? চলো বের হই।’
নিনা আলতো করে মাথা নাড়ল। ওরা সামনের করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল। ইভান মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। নিনা ভাবছে, ‘আমি জানি তুমি সত্যটা বলো নি। তুমি অবশ্যই আমার পেছনে এখানে আসোনি। মাঝে কয়েকদিন আমি তোমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। এখন আর করব না। এখন তোমার কাছাকাছি থাকব। কারণ আমি নিশ্চিত হয় তুমিই খু….খু*নি অথবা তুমি এর সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। তোমার মাধ্যমেই আমি রহস্যের কিনারায় পৌঁছতে পারব।’ ভেবে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সেটা খেয়াল করল না। ওরা স্কুল বিল্ডিং থেকে বের হচ্ছে। ইভান আলো নিভিয়ে দিল। ও গভীর ভাবনায় মগ্ন, ‘নিনা যা বলেছে সেটা সত্যি নয়। ও এখানে মোটেও ফোন নিতে আসেনি। এসেছে অন্য কারণে। আমি নিশ্চিত ও কিছু একটা করছে। কিছু একটা গোপন করছে। কিন্তু কী? ওর কি…সত্যিই আমাকে স*ন্দেহ হচ্ছে?’

সামনের বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা ছিল নিনার সাইকেল। ইভান আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে ওর সাইকেল আনল। নিনা সাইকেলে উঠে বসে বলল,
‘এখনও ঘুরে বেড়াবা?’

‘ঠিক ঘুরে বেড়ানো নয়। একটা বিশেষ জায়গায় যাওয়ার উদেশ্যেই মূলত আজ বেরিয়েছিলাম। সেখানেই যাব।’ ইভানও নিজের সাইকেলে উঠে বসে বলল।

‘ওহ কোথা….ইভান ওর কথা কেটে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি কী সরাসরি বাসায় যাবে এখন?’

‘হ্যা।’

‘ওহ। তো শুভ রাত্রি।’

‘হুম বাট এটা তো বললে না কোথায় যাচ্ছ?’ কৌতূহলী কন্ঠে জানতে চাইল নিনা।

ইভান ফিচেল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘ডার্লিং কাম ইউথ মি এন্ড আ’ল শো ইউ।’

নিনা ভ্রু উঁচু করল। বলল, ‘এমনি বলতে কী সমস্যা?’

‘না না এমনি বলতে গেলে জায়গাটার তাৎপর্য প্রকাশ পাবে না। আর যেতে তো কোন সমস্যা দেখছি না শুধু সময়টা একটু অড।’

নিনা হাসল। বলল, ‘সোজা ভাবে বললেও তো পারো যে তুমি আমার সাথে যেতে চাচ্ছ। এত প্যাঁচ লাগানোর কী দরকার?’

‘তুমি যা ইচ্ছা ভাবতে পারো। তো কী ভাবলা?’

‘এটাই যে তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাচ্ছ।’

‘আরেহ না জিজ্ঞেস করেছি তোমার উত্তরটা নিয়ে কী ভাবলা? যাবা নাকি যাবা না?’

নিনা আসলেই এবার ভাবল, ‘প্রায় সোয়া নয়টা বাজে। বাবা এবং এ্যাভরিল বাসায় ঘুমচ্ছে। জানি না কোথায় নিয়ে যাবে তবে আমার যদি ওর কাছাকাছি থাকতে হয় তাহলে এখন যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু লজিক্যালি ভাবলে এই কাজটা একটা বোকার কাছেও বোকামিই মনে হবে। এত রাতে আমি বিশ্বাস করি না এবং খুব সম্ভবত একজন খু*নি অথবা খু*নের সাথে অন্য ভাবে জড়িত এমন একটা ছেলের সাথে কোথাও যাওয়া, তাও জানিও না সেটা কোথায়, কত দূর বা কী রকম জায়গা?

‘তুমি মনে হয় ভাবতে ভাবতেই রাতটা পার করে দিবা। তার চাইতে আমি একাই যাই।’ পানসে কন্ঠে বলল ইভান।’

‘চলো।’ ফট করে বলে ফেললো নিনা।

‘কী? যাচ্ছ সত্যি?’ খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল ইভান।

‘তুমি কী ভাবছিলা আমি এতক্ষণ ফাজলামো করছি?’

‘না না। তা নয়।’ নিজের সাইকেলে উঠে বসল ইভান।
আবারও বলল, ‘আমার থেকে পিছিয়ে যেও না। পাশাপাশি থাকবা।’

নিনা ঘাড় নাড়ল। ওরা স্কুল থেকে সোজা রাস্তা ধরে সাই সাই করে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে গেল। ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে। সাই সাই করে পার হয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশের বাতি এবং কিছু কিছু দোকানের ভেতর থেকে আসা টিমটিমে আলো। এখনো মানুষের কোলাহলে জমজমাট ডাউনটাউন।
ক্যাম্বারল্যান্ড নদীর তীরের দোকানগুলোর বর্ণিল বাতি গুলো আবছা আবছা আলোর প্রতিবিম্ব তৈরি করেছে কালো পানিতে। ইভান যখন হ্যারিসন স্ট্রিট ধরে সোজা ডাউনটাউন এ ঢুকল তখনই নিনা জিজ্ঞেস করল, ‘বাই এনি চান্স আমরা বাইসেনটেনিয়াল মল পার্কে যাচ্ছি না তো?’

ইভান কিছু বলল না। নিগূঢ় হাসল শুধু। আজ সারাদিন আকাশ পরিষ্কার ছিল। কড়া রোদ উঠেছিল তবুও পরিবেশ ঠান্ডা। শক্ত করে খোঁপা করা নিনার চুল। সামনের অল্প কিছু চুল থুতনি পর্যন্ত লম্বা। সেগুলো উড়ে এসে চোখের ওপর পরছে। ওদের সাইকেল থামল বাইসেনটেনিয়াল স্টেট পার্কের সামনেই। নিনা বলল, ‘এত রাতে এই পার্কে কী করবা? এখানে তো কতবার এসেছি।’

‘রাতে কখনো এসেছ?’

‘না।’

‘তাহলে আজ চলো। এই জায়গাটায় রাত এবং দিনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাতের চেহারা নির্ঘাত যে কাউকে তাক লাগিয়ে দিবে।’

নিনা ভ্রু নাচাল। গেট খোলাই ছিল। সাধারণত গেট বন্ধ থাকে না। সাইকেল বাইরে পার্ক করে রাখল। ওরা দুজন ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। দুপাশে আঁধারে ঢাকা বন। ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে। আকাশে চাঁদের উপস্থিতিতে বড় চওড়া রাস্তা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে ইভান বলল,
‘সবকিছুরই একের অধিক চেহারা থাকে। কখনো কখনো সাধারণত যে চেহারা গুলো দেখতে আমরা অভ্যস্ত তার থেকেও বেশি সুন্দর হতে পারে অন্য চেহারা গুলো।’

‘তাই নাকি? তো তুমি গোটা ন্যাশভিল রাত জুড়ে ঘুরে বেড়াও বাকি চেহারা গুলো দেখার জন্য?’

‘সবসময় নয়। আমার ঘুম এত ফেলনা না।’ মুচকি হেসে বলল।

‘তো আঙ্কেল আন্টি জানেন তোমার এই লিটল মিড নাইট এডভেঞ্চারের কথা?’

‘হাহ! তোমার কী মনে হয় আমি এমনি এমনি বিল্ডিং বেয়ে ওঠা নামা শিখে গিয়েছি? আমার কামরার জানালা যতটা ব্যবহার করি যাওয়ার আসার জন্য অতটা বাড়ির মেইন দরজাও ব্যবহার করি না। মা বাবা তো জানে ওনাদের ভদ্রসদ্র ছেলে ঘরকুনো। ঘর থেকে বেরই হই না।’

নিনা হেসে উঠল,
‘বাওরে বাপ কী ফাজিল তুমি!’
ইভান হাসল। বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে আমি ভাবছি আমার মিডনাইট এ্যাডভেনচার গুলোয় তুমি ভালো পার্টনার হতে পারবা।’

‘হ্যা? একা একা ভালো লাগে না?’

‘ওয়েল অ্যালেক্স আসতে চায় না ওর ঘুম বাদ দিয়ে। লিজাও আসতে চায় না। লিজাকে অবশ্য এই কাহিনী বলাটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। কিছু হলেই থ্রেট দেয় মাকে বলে দিবে। তাছাড়া এমনিতে শুধু রাতে নয় অন্য সময়ও আমি কোন এডভেঞ্চারে বের হলে আমাকে কেউ সঙ্গ দেয় না।’ উদাসীন কন্ঠে বলল।

ওর বলার ভঙ্গিতে নিনা না হেসে পারল না,
‘কিসের এডভেঞ্চার?’

‘এক্সপ্লোরিং এর। ন্যাশভিলের আশে পাশের যা কিছু আছে সব খুঁজে বের করেছি। কোথায় কোন পরিত্যক্ত বাসা, হসপিটাল, অ্যাসাইলাম আছে এগুলোও খুঁজে বের করেছি।’

‘তুমি রাতের বেলা পরিত্যক্ত বাসা, অ্যসাইলাম এগুলোতে যাও? তাও আবার একা?’ অবাক কন্ঠে বলল নিনা।

ইভান হাসল। বলল, ‘এইজন্যেই তো দিনের আলোয় যাই৷ রাতে কেউ সাথে আসতে চায় না।’

‘এমন জায়গায় রাতে গেলে কেউ সাথে আসবেও না।’

‘তুমি…ওকে থামিয়ে দিয়ে নিনা বলল, ‘আমার অত কাজ নেই বাবা রাতের বেলা পরিত্যক্ত বাসা বাড়িতে যেয়ে। তোমার সাথে বের হওয়াটা কেন বিপদজনক বুঝেছি।’

‘আহ ভয় পাচ্ছ?’ দুষ্টু হাসি মেখে বলল ইভান।

‘না। ঘুম বাদ দিয়ে রাতবিরাতে পরিত্যক্ত বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর মানুষ আমি, আমাকে দেখে মনে হয় তোমার?’ চোখ সরু করে শুধালো নিনা।

ইভান অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নিনার দিকে তাকাল। ওকে ভালো করে পরখ করে বলল, ‘হুম হয়তো নয় তবে তুমি খুব ডেয়ারিং সেটা বুঝেছি। আমার সাথে পাল্লা দিয়ে তোমার চাইতে পার্ফেক্ট পার্টনার আর কেউ হতে পারে না।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১৮
লেখনী – #মাহীরা_ফারহীন

বড় বৃত্তাকার খালি জায়গাটার চার দিকে মোট ৯৬ টা কলাম। এগুলো মূলত ক্যারিলন বেল। প্রতিটির মাথায় বড় বড় ঘন্টা। বৃত্তাকার জায়গাটার বাইরে চারদিকে ঘন গাছপালা। কনক্রিটের মেঝেতে বড় বড় তিনটি তারার নকশা। লক্ষ লক্ষ জ্বল জ্বলে তারার সুতো দিয়ে কাপড় বুনে সারা আকাশ জুড়ে বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। তারাদের ভিরে কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী রুপালি চাঁদ যেন ছোট্ট মেয়ের মতো মিয়ে গিয়েছে। অপরুপা কান্তিময় আকাশের নিচে বড় ঐতিহাসিক ক্যারিলন বেলগুলোর মাঝে মেঝেতে বসে আছে নিনা ও ইভান। মেঝেটা বেশ ঠান্ডা।

‘এত সুন্দর দৃশ্য! এত সুন্দর পরিবেশ আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ইভান।’ মুগ্ধ কন্ঠে বলল নিনা।

ইভান আমুদে স্বরে বলল, ‘ধন্যবাদ দেওয়ার অভ্যাস করো না৷ পরে ক্লান্ত হয়ে যাবা।’

‘তোমার সব ট্রাভেল লিস্টে আমিই কেন আছি?’

ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল, ‘তোমার ফিলোসোফি, কবিতা, গল্প, প্রকৃতি এসব একেবারেই ভালো লাগে না, না?’

নিনা হতাশ হলো,
‘তুমি আমার সম্পর্কে জানোই না কিছু।’ বলে মেঝের দিকে তাকাল।

‘তুমি আমাকে না বললে কীভাবে জানব? তুমি তো আমার সাথে ঝগড়া করেই কুল পাও না।’

নিনা আর তর্ক করল না৷ কিছুক্ষণ মৌণ থাকল।
কিছুক্ষণ পর বলল,
‘তাহলে শোন, আমার প্রিয় একটা গল্প বলি তোমাকে।
আমার মায়ের স্মৃতিগুলো সব পুরোপুরি আমার মনে নেই। কিন্তু অনেক কিছুই আবার স্বচ্ছ পানির মতো মনে পরে। আমরা একবার কলোরাডো ঘুরতে গিয়েছিলাম। রকি মাউন্টেনে একটা কটেজে ছিলাম। সেই পাহাড়ের চুরায় একদম ভোর বেলায় শুধু আমি আর মা ট্রেকিং করে উঠেছিলাম। মা আমাকে একটা গল্প বলেছিলেন সেদিন। জানি না কেন সেটা খুব ভালো করেই এখনো মনে আছে আমার।’ বলে একটু বিরতি দিল। মাথা উঁচু করে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেললো। ইভান আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জিজ্ঞেস করল,
‘কী গল্প ছিল?’

নিনা ইভানের চোখে চোখে তাকাল। বলল, ‘অনেক বিশাল এক সামরাজ্যের রাজা হঠাৎ একদিন মা*রা গেল। স্বাভাবিকভাবেই তার একমাত্র ছেলে অল্পবয়সেই সিংহাসনে বসতে বাধ্য হলো। প্রিন্সের মা-বাবা তখন কেউই আর বেঁচে নেই। সে নিজের প্রকৃত ভূখণ্ড ব্যতিত যত জায়গা যু*দ্ধ করে জয় করত সেগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠু*রতার সঙ্গে পরিচালনা করত। সেসব অঞ্চলে কারোও স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে হলে ম*রতে হত। সে অনেক নিষ্পাপ পরিবার এভাবে শেষ করে দিল৷ একদিন হঠাৎ আরেকটি রাজ্য তাদের রাজ্যকে আক্রমণ করে। এযাত্রায় প্রিন্স হেরে গিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সে তারই স্বৈরাচারী শাসনের অধিনে থাকা একটি অঞ্চলে গিয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একদিন একটা মেয়ে তাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়।’ এতটুকু বলে আবার থামল।

প্রবলবেগে বাতাস সুউচ্চ কলামগুলো গলে বয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা মেঝেতে বসে নিনার ঠান্ডায় গা শিরশির করে উঠল। ইভান মনোযোগ সহকারে শুনছিল। নিনা
বলে গেল, ‘মেয়েটা ছিল একা, গরিব এবং দুঃখী। ওকে কখনো হাসতে দেখা যেত না। বেশি কথা বলত না। চুপচাপ বিষন্ন ভাবে বসে থাকত। কিন্ত তার যাই অল্প কিছু পুঁজি ছিল তা দিয়েই সে প্রিন্সের সর্বোচ্চ যত্নআত্তি করতে লাগলো। এমন ভালোবাসা ও মায়া মিশ্রিত যত্ন প্রিন্স নিজের বিলাসবহুল প্রসাদে থেকেও পায়নি। ধীরে ধীরে সে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেললো। একদিন সে জানতে চাইল তার পরিবার কোথায়? কী হয়েছিল তাদের সাথে? মেয়েটা তখন বলল, ‘সেই রাজ্যের যে রাজা ছিল সে অন্যায়ভাবে তার বাবা-মাকে মিথ্যাে জালি*য়াতির অভিযোগে মৃ*ত্যুদন্ড দিয়েছিল।’ প্রিন্স এটা শুনে বুঝতে পারে সে নিজেই মেয়েটার এতিম হওয়ার কারণ। এখন সে যখন সাধারণ ভাবে থাকতে অভ্যস্থ হয়েছে, মেয়েটাকে ভালোবেসেছে তখন সে তাকে হারানোর চেয়ে বেশি ভয় পেল কী হবে যদি মেয়েটা সত্যটা জানতে পেরে তাকে ঘৃণা করে? এই ঘৃণা সে সহ্য করতে পারবে না। কারণ সে নিজের ভালোবাসার কাছ থেকে দূরে থাকা মেনে নিতে পারবে কিন্তু মেয়েটা ওকে ঘৃণা করুক সেটা ও মেনে নিতে পারবে না। পাশাপাশি তার আশেপাশের দুঃখী মানুষের জীবনযু*দ্ধের চিত্র দেখে মায়া হলো। অনুশোচনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তাই একদিন সকালে হঠাৎ সে গায়েব হয়ে গেল। এরপর আর কেউ তাকে কখনো দেখেনি।’
বলে থামল নিনা। ইভানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার কী মনে হয় এর মোরাল অফ দ্যা স্টোরি কী?’

ইভান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবল। ভেবে বলল, ‘সে মানুষের সুখ কেড়ে নিয়ে অজান্তেই নিজের সুখের পথও ধ্বংস করেছে। অপরকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো নিজে সুখী হতে পারে না।’

নিনার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখেই জিজ্ঞেস করল,
‘কিন্তু এই গল্পটা শোনানোর পেছনে কী কোন বিশেষ কারণ ছিল?’

‘তোমাকে শোনানোর ক্ষেত্রে হয়তো নেই কিন্তু মা আমাকে একটা কারণেই শুনিয়েছিলেন। সে গল্পটা শেষ করতেই আমি কাঁ*দতে শুরু করেছিলাম। তখন মা বলেছিল,
‘জীবন এই গল্পের মতো। মানুষের জীবনে সেই রুপকথার “হ্যাপিলি লিভড এভার আফটার” বলতে কিছু নেই। জীবন যতদিন চলবে ততদিন এর সংগ্রহও চলতে থাকবে। এখানে আসলেই হ্যাপি এন্ডিং আর স্যাড এন্ডিং বলতেও কিছু নেই।
যেমনটা তুমি মানুষকে দেবে ঠিক তেমনটাই গ্রহণ করবে।

ইভান বলল, ‘বুঝতে পারছি কিছুটা, তোমার এমন রসকষহীন হওয়ার কারণ। গল্পটার মোরালটা খুব জোড়ালো ভাবেই অ্যপ্লাই করেছ নিজের জীবনে।’

‘ব্যাপারটা এতটাও ওরকম নয় যতটা তুমি ভাবছ। শুধু একটা গল্পের ওপর তো আর সারাজীবন নির্ভর করে না।’
ইভান মাথা নাড়ল। বাতাস ওর ছোট ছোট চুলে ঢাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। নিনা ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। গাছের পাতারা ঝনঝন শব্দে বাতাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইভান পেছনে মেঝেতে হাত ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বলল,
‘তোমার প্রিয় লেখক কে?’

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘ফিওদোর দস্তয়েভস্কি?’ ফট করে বলল ইভান।

নিনা অবাক হলো,
‘কী? তুমি কিভাবে জানো?’

‘ওহ আমি ঠিক বলেছি?’ মুচকি হেসে বলল ইভান।

‘হ্যা। কিন্তু তোমার দস্তয়েভস্কির কথাই কেন মনে হলো?’

‘ইউ নো ওয়াট ক্রিঞ্জ স্লাটি পার্টি গার্লরা দস্তয়েভস্কি পড়ার মানুষ না।’

নিনা হেসে উঠল। ইভান আবারও বলল,
‘তোমাকে দেখলে আমার কার কথা মনে পড়ে জানো?’

‘কার কথা?’

‘নব্বই দশকের সমি কাইসার।’

‘কীহ? সমি কাইসার? আমাকে দেখে সমি কাইসারের মতো লাগবে কেন?’

‘না না চেহারার দিক থেকে নয়। ডার্ক সেভেজ পার্সোনালিটির অওরার একটা ব্যাপার আছে। সেটার মধ্যে মিল আছে।’

‘ওহ।’ নিনার মুচকি হাসল। আবার বলল,
‘কিন্তু তুমি সমি কাইসারকে কিভাবে চিনো?’

‘তুমি যেভাবে চিনো।’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিরতির করে তীব্র আলোর সরু ঝলকানি আকাশ চিরে গেল। ক্ষণিকের জন্যে চারিদিক ফর্সা হয়ে উঠল। সেকেন্ড পরেই বিকট শব্দে আকাশ গর্জন করল। ইভান বা নিনা কেউই চমকাল না। তবে দুজনেই চিন্তিত হলো। বাতাস পাগলাটে বেগে ঝাপটা দিচ্ছে গাছপালায়। মৃদু সা সা শব্দ কানে বাজে। ইভান তটস্থ হয়ে উঠল। চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘আর বসা যাবে না। বৃষ্টি আসার আগেই বাসায় পৌছতে হবো।’

নিনা উঠে দাঁড়াল। ‘ঠিক আছে। এত চিন্তার কিছু নেই। আমরা পৌঁছে যাব।’ ইভানের তুলনায় অধিকতরে শান্ত শোনাল ওর কন্ঠ।

ইভানও উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগল ওরা। যতক্ষণে গেট দিয়ে বের হচ্ছে ততক্ষণে কয়েকবার আকাশ গর্জেছে। আর কোন তারার মুখ দর্শন সম্ভব নয়। বজ্জাত কালো মেঘগুলো এসে সব আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি চাঁদটাও কোন মেঘের পেছনে লুকিয়ে পরেছে।
সাইকেল বের করে দুজনেই প্রস্তুত যাত্রা আরাম্ভ করতে। সাইকেল দ্রুত চলায় বাতাস যেন চা*বুকের মতো শপাং শপাং করে আ*ঘাত করতে লাগলো গায়। নিনা ঠান্ডায় কুঁকড়ে গিয়েছে। ওরা ক্যাম্বারল্যান্ড ব্রিজ পার করছে তখনই কৃষ্ণ মেঘের দল দলগত শোক পালন করতে মন উজাড় করে কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে নিনা ও ইভান সেভাবে ভিজল না। হঙ্কি টঙ্কস রাস্তার একটা বন্ধ দোকানের সামনে এসে সাইকেল থামাল ইভান। দোকানের সাটার লাগানো। তবে পাশে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে ব্যানারটা ঠিকই জ্বলছে। বৃষ্টি ভেজা চকচকে রাস্তায় আলোর প্রভাবে আলতার ছিটা পরেছে। দোকানের সামনে সেড দেওয়া। ইভান বলল, ‘বৃষ্টি বাড়ছে। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াই৷ বৃষ্টি কমলে আবার যাওয়া যাবে।’

‘না ইভান যদি বৃষ্টি না কমে? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবা এখানে? এখনো অতটাও বাড়েনি। চলো যাই।’

‘বেশি ভিজে গেলে ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।’

‘ভুলে যাচ্ছ আমরা থাকি বৃষ্টির শহরে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই বড় হয়ে গেলাম। আর ঠান্ডা লাগা!’

ইভানের চোখে দ্বিধা। নিনা সাইকেল থেকে নামেনি। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘চলো ভিজে যখন গিয়েছি, ভালো ভাবেই ভিজে বাড়ি যাই।’

‘বৃষ্টি তোমার প্রিয়। বুঝতে পারছি।’

নিনা হাসল। ইভান আর দোনোমোনো করল না। চুপচাপ সাইকেলে এসে উঠল। এবার সত্যিই ঝমঝম করে বৃষ্টি হতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা ইভানের বাড়ি পেরোলে। তবে ইভান থামল না৷ ও নিনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। নিনার বাসার সামনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি আচমকাই কমে এলো। নিনা সাইকেল থেকে নেমে ইভানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কাঁক ভেজা অবস্থা ওদের। নিনা বলল,
‘ধন্যবাদ এখান পর্যন্ত আসার জন্য যদিও কোন দরকার ছিলো না।’

‘আবার ধন্যবাদ!’ মুচকি হেসে বলল ইভান। মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিনা হালকা হাসল। সামনের ভেজা চুলগুলো গালের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। স্নিগ্ধ সতেজতা ছলকে উঠছে ওর সুষমা ফর্সা মুখ থেকে। নিনা ঘুরে দাঁড়াতে যাবে তখনই ইভান বলল, ‘নিনা’।
নিনা থেমে গেল। প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান প্রমত্ত কন্ঠে বলল,
‘একটা কথা বলা হয়নি।’
নিনার গালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে গালে হাত রাখল। মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
‘তুমি হাসো না কেন বলো তো? হাসলে তোমার সুন্দর মুখের সোভা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়।’

ততক্ষণাৎ লালচে আভা নিনার সারা মুখে ব্যাপিত হলো। লজ্জায় এক মুহূর্তের জন্য মুখে কোন কথা এলো না। এমন কথা সচরাচর কেউ ওকে বলে না ওকে৷ বুঝতে পারল না কিভাবে উত্তর দেওয়া উচিৎ। অস্বস্তি কাটাতে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
‘ধন্যবাদ। গুড নাইট।’ বলেই প্রায় ঝড়েরবেগে ভেতরে ঢুকে গেল। ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, ‘আহা ধন্যবাদ!’

———————–

দালানকোঠা, গাছপালা দীর্ঘ সময় নিয়ে নেয়ে ওঠার পর সতেজতায় ঝলমল করছে। সকালের উষ্ণ কমল রোদের পরশে পাতার কোণায় ও ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি হিরের মতো ঝিকমিক করছে। কোথাও থেকে কার্ডিনাল ও রবিন পাখির মিলিত সুর ভেসে আসছে।

– Kiss me, close your eyes
and miss me, close your eyes
and kiss me
I can read your lips
on your finger tips
and Happiness on your eyes

ক্যাডবেরির গান চালিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের স্টুলের ওপর বসে কাউন্টার টপে ভর দিয়ে ড্যারিমিল্ক খাচ্ছিল নিনা। পাশাপাশি জানালা ভেদ করে রোদ ঝলমলে বাগান দেখছে মুগ্ধতার সঙ্গে। জানালা দিয়ে আংশিক দৃষ্টিগোচর হয়।

‘এত প্যাশোনেটলি ডেইরি মিল্ক খাওয়া যায় আজ জানলাম।’
ভ্রু নাচিয়ে আমুদে কন্ঠে বলল এ্যাভরিল। কাউন্টার টপের ওপর হেলান দিল। নিনার ধ্যান ভগ্ন হলো। চকলেটের প্যাকেট টা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমিও খাও….বলতে বলতে হাঁচি দিল। এ্যাভরিল এক টুকরো চকলেট মুখে পুরে বলল, ‘সকাল থেকে হাঁচি দিচ্ছ। এত ঠান্ডা কিভাবে লাগলো?’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গতরাতের কথা মনে পরল। বৃষ্টিতে ভিজার ভালোই মাশুল দিতে হচ্ছে। এ্যাভরিল জানালার দিকে তাকাল। বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘সব ভিজে টিজে শেষ!
এত বৃষ্টি ভাল্লাগে না।’

‘তোমার বৃষ্টি ভাল্লাগে না?’ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল নিনা।

‘বৃষ্টি তো পছন্দ। কিন্তু বছরের আশি ভাগ সময় বৃষ্টি হলে কেমনটা লাগে বলো তো। বিরক্তিকর।’

‘ওহ। আমার তো ভালোই লাগে। অন্তত ভালো একটা বাহানা হিসেবে কাজ করে।’

হাসল এ্যাভরিল। তখনই একটা রিংটোন বাজতে লাগল। এ্যাভরিল কল রিসিভ করে ফোন কানে দিল। নিনা কাউন্টার টপকে থেকে ফল কেটে রাখা একটা প্লেট তুলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখল। ক্ষণকাল পরেই মি.মালিক এসে নাস্তা করতে বসে যাবেন। মূলত ওনার জন্যেই অপেক্ষা করছে ওরা। ফাতিমা আপা ইদানীং অসুস্থ হয়ে পরেছেন। কাজেই কয়েকদিনের ছুটি দেয়া হয়েছে। এ্যাভরিল ফোনটা রাখার সাথে সাথে নিনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এমিলির বার্থডে তে যাচ্ছ না?’

নিনা ইতস্তত কন্ঠে বলল, ‘উম..না আই গেজ।’

‘গেজ করার আবার কী আছে? আমি তো জানতাম যাচ্ছ।’

‘ওইতো মানে ভেবেছিলাম যাব কিন্তু এর মাঝে আবার ঠান্ডা লেগে গেল। তাছাড়া আমার এমন পার্টি টার্টি ভাল্লাগে না।’

‘ওহ।’ ছোট করে বলল এ্যাভরিল।

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন? কে ফোন দিয়েছিল?’

‘এমিলি।’

‘কেন?’

‘ওর জন্মদিনে দাওয়াত দিল। মানে আগামীকালই এত দূর যেতে হবে আর আজ বলছে। এটা কোন কথা?’

‘ওহ তো যাও। তোমার তো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না।’

‘না না আমার ওখানে গিয়ে মোটেও ভাল্লাগবে না। বেশির ভাগ এমিলির ব্যাচের ছাত্র ছাত্রীরা থাকবে ওখানে।’

‘কেন তুমি তো দেখলাম সবারই বান্ধুবি। ইভানও তো থাকবে।’

‘ধুরও ওই মুখে মুখে তো আমি সবারই বান্ধুবী কিন্তু ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কারোরই নই। আর ইভান যাবে কে বলেছে?’

‘কেন যাবে না?’

‘না। মাথা খারাপ! দুদিন বাদে আমাদের স্কুলে ম্যাচ আছে। ধরো লিজা যদি কিডন্যাপ হয়ে যায় ওকেও বাদ দিয়ে ইভান আগে যাবে ম্যাচ খেলতে।’
নিনা শব্দ করে হেসে উঠল। মি.মালিক ডাইনিং এ আসলেন। হাসি মুখে বলল, ‘দুই বান্ধবী সকাল সকাল কী নিয়ে হাসাহাসি করছে?’

‘কিছু না বাবা। বসো সব রেডি আছে।’

নিনা টেবিলে বসল। মি.মালিক বললেন,
‘আচ্ছা নিনা আমার ট্যাক্সের খাতাটা কোথায়? তুমি কী রেখেছিলা?’

‘হ্যা ওটা আমার কাছে। আলমারিতে আছে। দাঁড়াও আনছি।’

‘থাম থাম তোমার ওঠা লাগবে না। আমি যাচ্ছি।’ বলল এ্যাভরিল। ও তখনও বসেনি। নিনা বা মি.মালিককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। উপরে উঠে নিনার কামড়ায় ঢুকলো। ওর জানা আছে আলমারির চাবি কোথায় থাকে। চাবি ঘুড়িয়ে আলমারির পাল্লা খুলে ড্রয়ারগুলো হাতিয়ে দেখতে লাগল। তখনই চোখে পরল, হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড় গুলোর পেছনে সাদা মতো কি যেন। কৌতুহল বসত সেটা টান দিয়ে বের করে আনল। বড় কাগজের জিনিসটা কী সেটা বুঝতে পেরেই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। সাদা কাগজের ওপর একে একে বেশ কয়েকজনের ছবি লাগানো। ওপরে লেখা সাস*পেক্টস। প্রতিটি ছবির নিচে স*ন্দেহের কারণ সমূহ তালিকাবদ্ধ করা। দরজা খোলার শব্দ হলো। নিনা দ্রুত পায় ভেতরে ঢুকলো। এ্যাভরিলকে ওর সাস*পেক্ট লিস্ট নিয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো না। ওর মনেই হয়েছিল আলমারি খুললে ওর হাতে এটা পরা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ্যাভরিল বিস্ময়াবিষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘টনিকে তুমি চেনো না। তারপরেও এসব কেন করছ!?’

এ্যাভরিল মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসেছিল। নিনা এসে ওর পাশে বসে বলল, ‘আমি ওকে চিনি এ্যাভরিল।’

‘ওয়েট! থাম থাম মানে হঠাৎ করে ওর মৃ*ত্যুর পরেরদিনই আমাদের স্কুলে এডমিশন নেওয়াটা কোন তাৎকালিয় ঘটনা নয়?’ আশ্চর্য হয়ে বলল ও।

‘না।’ শান্ত কন্ঠে বলল নিনা।

‘কিন্তু কিভাবে? তুমি টনিকে কিভাবে চেনো?’

‘টনি আমার ফ্রেন্ড ছিল এবং খুব ভালোই ফ্রেন্ড ছিল। শুধুমাত্র এজন্যেই আমি এসব করছি।’

‘তাহলে তুমি ইভানকে কেন স*ন্দেহ করো? আমি তো ভেবেছিলাম…বলে থেমে গেল ও।

‘কী ভেবেছিলা?’

‘যে তুমি ওকে পছন্দ করো।’

‘তোমার মাথায় এমন ভাবনা কিভাবে এলো?’

‘জানি না।’ বলে থামল। উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। নিজেকে শান্ত করে সংযত কন্ঠে বলল, ‘অরল্যান্ডো কে স*ন্দেহ করা মানা যায়। ইভানকেও মানলাম। লিজা তো ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল। ওর সাথে কী সমস্যা?’

‘তুমি এটা কিভাবে জানো?’

‘টনি আর ইভান দুজনই আমার ছোট বেলার বন্ধু। জানবো না আমি?’

নিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুঝতে পারল যখন গাছের আগা দেখেই ফেলেছে এখন আর গোড়া লুকিয়ে লাভ নেই। কাজেই একে একে সব খুলে বলল। এর মাঝে মি.মালিক কয়েকবার নিচ থেকে ডাক দিলেন ওদের। সব শোনার পর এ্যাভরিল বলল, ‘আরে পাগলি তোমার তো সবার আগে এমিলির বার্থডে তে যাওয়া উচিৎ। এখানে যাওয়া কতটা লাভজনক হতে পারে তুমি বুঝতে পারছ না?’

আবারও দরজা খুলার শব্দ হলো। মি.মালিক কামরায় প্রবেশ করলেন। ওনার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। উনি বললেন, ‘একটা ট্যাক্স বই খুঁজতে তোরা সারা সকাল পার করবি? আর আমি এত ডাকছি, কোন উত্তর দিস না কেন?’

‘আঙ্কেল আগামীকাল এমিলিরা ব্রেন্টউড যাচ্ছে। প্লিজ নিনাকেও যাওয়ার অনুমতি দিন।’ বলল এ্যাভরিল।

‘হ্যা!?’ মি.মালিক থতমত খেয়ে গেলেন। হতবাক হয়ে একবার নিনার দিকে একবার এ্যাভরিলের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আমি তো ওকে মানা করিনি। ওই তো যাবে না।’

‘আমি জানি আঙ্কেল আপনি সবটা জানেন। ওখানে লিটারালি যাদের সাস*পেক্ট হিসেবে নিনা ধরে রেখেছে তারা সবাই যাচ্ছে। তাহলে? ওখানে না যাওয়াটা তো লস!’

নিনা লম্বা শ্বাস ফেললো। মি.মালিক আরেক দফা হতবাক হলেন। বললেন, ‘তুমি জানো এসব?’

‘মাত্র জানলাম।’ বলল এ্যাভরিল।

‘আচ্ছা দেখ ওখানে আসলেই সকলে এমিলির ব্যাচের। আমি এমনিতেও এই স্কুলে নতুন। আমার ফ্রেন্ড বলতে অমিত আর তুমিই আছ। অমিতও বলছে যাবে না। ওখানে একা একা ভালো লাগবে আমার?’ যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল নিনা।

‘অমিত কেন যাচ্ছে না?’ জিজ্ঞেস করল এ্যাভরিল।

‘কারণ আমি যাচ্ছি না।’

মি.মালিক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘তো তুই গেলে তো ও এমনিতেই যাবে। সাথে এ্যাভরিলও যাও। হয়ে গেল কাজ।’

এ্যাভরিল বিবশ কন্ঠে বলল, ‘আই এ্যাম সরি। আমি চাইলেও কাজে অফ দিতে পারবো না। অলরেডি নাইকির সপটাতে একজন কলিগ অফ নিয়েছে। তার এক্সট্রা কাজটাও আমি করছি। বাট তুমি প্লিজ যাও।’

‘বাট লুক ইভান তো এখানেই থাকবে। আমি যতদূর জানি লিজাকে নাকি একা যেতে দেবে না। সো? আমার তো এখন
লিজা আর ইভানের দিকে বেশি নজর দেয়া উচিৎ। আর আর অরল্যান্ডোও তো টিমে আছে। মানে সেও যাবে না। তাহলে এমিলি বাদে বেশির ভাগ মানুষই এখানেই থাকবে।’

‘হুম তাও ঠিক। তাহলে তো আমাদের ম্যাচই দেখতে যাওয়া উচিৎ।’ বলল এ্যাভরিল।

‘হ্যা সেটাই তো বলছি।’

‘দয়া করে তোরা এবার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া খাবার গুলোকে সিটকা লেগে যেতে দিস না।’ বললেন মি.মালিক।

ওরা দুজন হাসল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।