মনোহারিণী পর্ব-১০+১১

0
245

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
আকাশে আজ মস্ত বড়ো এক চাঁদের রাজত্ব। চারপাশের মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো প্রজার মতো চান্দ্ররাজকে ঘিরে রেখেছে। রাজা হাসছে, প্রজারাও হাসছে। এ যেন এক ঝলমলে হাসির রাজ্য। এই মনকাড়া হাসির রাজ্যটা কি কিছু সময়ের জন্য দূরত্ব কমাতে পারে না? এই যে পৃথিবী থেকে তার দূরত্ব প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার। এতটা দূর থেকে তাকে কেবল দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ইচ্ছে করলেই তার রাজ্যে অবতরণ করা যায় না। এর থেকে আফসোসের বিষয় আর কী আছে? তবু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এত দূর থেকে এ রাজ্যের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই। কতশত জল্পনা, কল্পনা, স্বপ্ন সাজাই! ওই আকাশ কি জানে, তার কত কদর? হয়তো জানে, হয়তো জানে না। তবু তো সে সৌন্দর্য বিলাতে এক ফোঁটাও কার্পন্য করে না। আহ্, কী নিঃস্বার্থ সৃষ্টি! মাথা তুলে বহুদূরের ওই আকাশ দেখা খুব বেশি সময় স্থায়ী করতে পারলাম না। পথ চলছি, কখন না আবার হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আকাশ থেকে মাটিতে দৃষ্টি ফেরাতেই চারদিকের অজস্র বৈদ্যুতিক বাতির ভীড়ে চাঁদের আলোর বড্ড অভাব বোধ করলাম। এই বাতিগুলোর কারণে চাঁদের আলো উপভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ইচ্ছে করছে এসব বৈদ্যুতিক বাতিগুলো বন্ধ করে দিতে। চারদিকে শুধু চাঁদের ঝকঝকে আলো ছড়িয়ে থাকত। দুহাত মেলে সে আলো কুড়িয়ে নিতাম। জ্যোৎস্না স্নানে গা জুড়াতাম। শরীর, মন স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যেত। কিন্তু হায়! এ সবের সাধ্য তো আমার নেই। নিছক কল্পনা করেই তুষ্ট থাকতে হবে। এসবের পরেও কিন্তু আজ আমার মন ফুরফুরে। মন খারাপ তাকে একদমই ছুঁতে পারছে না। এই যে গত আধঘন্টা যাবত পায়ে হেঁটে মধ্যরাতের শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি, মন খারাপের ফুরসত পাই কীভাবে? দিনবেলার সেই কানে তালা লাগানো কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ বলে বুঝানোর মতো নয়। রাস্তায় সাঁই-সাঁই করে একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে। পথচারীদের মধ্যে দিনবেলার মতো বাড়াবাড়ি রকমের তাড়া নেই। প্রত্যেকটা শপ, মার্কেট, রেস্ট্রন্টে ভীড় কিন্তু কমেনি। জায়গায়-জায়গায় লোকজনের আড্ডা। রাস্তার পাশের বিলবোর্ড, নিয়ন বাতির ঝকমকে আলোর নিচে আমরা পাশাপাশি পথ চলছি। মধ্যরাতের শহর ভ্রমণ। আহ্! কত কালের স্বপ্ন পূরণ হলো আজ! ভাবতেই তাজ ভাইকে ইয়া বড়ো একটা ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু না, জানাব না। আমি কি বলেছিলাম নিয়ে আসতে? নিজ ইচ্ছায় যখন নিয়ে এসেছে, তখন এসব ধন্যবাদ না পেলেও চলবে তার। আমি বরং উপভোগ করি। হুট করে মানসপটে অতিশয় সুন্দর এক মুহূর্ত ভেসে উঠল। এই যেমন, ঠিক এমন একটা মুহূর্তে আমি শাড়ি পরিহিতা আর ভ্রমণ সঙ্গী পাঞ্জাবি পরিহিত। দুজন হাতে হাত রেখে গন্তব্যহীন হাঁটব। কারো মুখে কোনো কথা থাকবে না। মনে-মনে হবে যত কথা। চোখে-চোখে হবে অনুভূতি আদান-প্রদান। দুজন চুপটি করে সুন্দর মুহূর্তটাকে উপভোগ করব। আম্মুর ভাষ্য অনুযায়ী, এসব জল্পনা-কল্পনা বাস্তবে রূপ দিতে জামাইয়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে। কপাল! আজকের ভ্রমণ সঙ্গী পাঞ্জাবি পরিহিত হলেও, আমি বেচারি শাড়ির অভাবে ভুগছি। হতে-হতে পূরণ না হওয়া আরেক স্বপ্নের জন্য মায়া হলো। আহারে! পাশে চোখ পড়তেই তাজ ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওনার দৃষ্টি দেখে আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। হঠাৎ এভাবে তাকানোর কী হলো?‌
“গোবরগাদা মাথাটা আজাইরা চিন্তায় নষ্ট না করে, সময়টা উপভোগ করতে শেখ। বলদ মাইয়া। আর তোর ধন্যবাদের আশায় আমি ম’রে যাচ্ছি না। দয়া করে নিয়ে এলাম বলে এত সুন্দর সময়টা উপভোগের সুযোগ পেলি। নষ্ট করলে তো পরে আফসোসে ম’রে যাবি।”
আমি অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঠোঁট উলটালাম। এই মহাবিপদ যে মাইন্ড রিডিংয়ের প্রতিভার অধিকারী, তা ভুললে চলবে কী করে? তবু বললাম,
“প্রথমত আমার মাথা গোবরগাদা না। দ্বিতীয়ত আমি বলিনি আপনাকে দয়া দেখাতে।”
সঙ্গে-সঙ্গে তাজ ‌ভাই পা থামালেন। তাকে দেখে আমিও থামলাম। উনি সোজাসাপ্টা বলে দিলেন,
“তাহলে যা, বাড়ি ফিরে যা। আর নিব না তোকে। দয়া উঠিয়ে নিলাম।”
আমি হকচকিয়ে উঠে বললাম,
“এতদূর থেকে আমি একা ফিরব কীভাবে?”
“রিকশায় চড়ে।”
আমার উৎফুল্ল মনটা নিমেষেই খারাপ হয়ে গেল। কত দিনের ইচ্ছা আজ পূরণ হলো, অথচ এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে? আমার তো আরও অনেকটা সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। বাড়ি ফিরলে মনের অবস্থা যা-তা হয়ে যাবে। উনি সত্যি সত্যিই একটা রিকশা দাঁড় করালেন। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মামা, যাবেন?”
“কই যাইবেন?”
“ডি ব্লক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স বিল্ডিংয়ের সামনে।”
“না মামা, যামু না,” নাকচ করে দিলেন রিকশাওয়ালা।
আমি কাঁদো-কাঁদো মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রিকশাওয়ালা চলে যেতেই ভদ্র মেয়েটির মতো বললাম,
“এসেই যখন পড়েছি, তখন ঘুরেফিরেই যাই। এখন ফিরলে যেখানে যাব, পরে ফিরলেও সেখানেই যাব। তাছাড়া এই মধ্যরাতে একা ফিরতে আমার ভয় লাগে।”
উনি আমার মাথায় চাটি মে’রে শ্লেষের সুরে বললেন,
“ঢং শিখেছিস? সারা শহর টাইটাই করে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে, তা বলতে লজ্জা করছে? ফাজিল। চল, হাঁটা দে।”
ওনার ঝাড়ি শোনার পরও আজ আমার রাগ উঠল না। বরং বাড়ি ফিরতে হবে না বলে খুশি হয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু এবার খানিকটা পথ হাঁটা দিতেই বুঝলাম আমি হাঁপিয়ে উঠছি। এতটা পথ হাঁটার অভ্যাস নেই যে। হাঁটতে না পারলে ঘুরব কী করে? ধীরে-ধীরে আমার হাঁটার গতি মন্থর হয়ে পড়ার সাথে মনটাও খারাপ হতে চলল। তাজ ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“এ পিচ্চি, হাঁটতে জানিস না, অথচ ঘোরাঘুরির শখ মাথায় ঢুকিয়ে বসে থাকিস কোন আক্কেলে? আমি তোর বয়ফ্রেন্ড লাগি না যে, কোলে তুলে হাঁটব। হাঁটতে যখন পারিস না, তখন বাইরে বেরোনোর সময় ওয়াকার সাথে নিবি। বাচ্চা পোলাপান নিয়ে যত জ্বালা!”
“আমার অভ্যাস নেই বলে হাঁপিয়ে গেছি। এটা নিয়েও আপনার পচাতে হবে?”
“ভালো পিচ্চিদের পচানো যায়। তোকে আর কী পচাব? তুই কি নিজেকে ভালো ভাবিস?”
“আমাকে কোন দিক থেকে খারাপ মনে হয় আপনার?”
“বলব?”
“শুনি।”
উনি চোখ ঘুরিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
“থাক, বললে এই পাবলিক প্লেসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসতে পারিস। তারপর দেখা গেল পাবলিক তোকে পাগল ভেবে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আর সব ঝামেলা এসে পড়েছে আমার মাথার ওপর। আমি এসব মেয়েলি ঝামেলায় জড়াতে চাই না। আমি অতি ভদ্র, নির্ভেজাল একটা ছেলে। তোর জন্য নিজের প্রেস্টিজ পাংচার করার প্রশ্নই আসে না। সো, অফ যা পিচ্চি।”
আমি ত্যাড়াভাবে প্রতিবাদ করে বললাম,
“ফালতু কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? আমাকে কেন খারাপ বললেন, তা আমাকে শুনতে হবে না? আপনার কোন অ’নিষ্ট করে বসে আছি আমি?”
উনি ভ্রু দ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে মুখটা খানিক এগিয়ে এনে বললেন,
“বলব?”
আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মাথা ঝাঁকালাম। উনি হাসিমুখে বললেন,
“ভেবে বলিস কিন্তু। হতে পারে কথাটা শোনার পর তুই লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে পড়বি। রিস্ক নিতে রাজি নই আমি।”
“ধুর!”
আমার চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে উঠতেই উনি হাসির রেখা দীর্ঘ করলেন। মাথাটা আরও একটু এগিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“ওই পিচ্চি, দুনিয়ার সব মানুষের সামনে তো সাধু সেজে থাকিস। আমার সাথে ঝগড়া করিস কোন মতলবে, হুঁ? আসলেই কি তুই সবার বেলায় চেঞ্জ হয়েছিস, না কি কেবল আমার বেলাতেই?”
উনি ভ্রু নাচালেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কপট রাগত স্বরে বললাম,
“আপনার বেলায় আমি চেঞ্জ হয়েছি, এমনটা ভাবার কোনো মানে হয় না। সাড়ে পাঁচ বছর আগের মতো আপনার আজাইরা বকা শুনে বোকার মতো কেঁদেছিলাম বলেই যে এখনও কাঁদব, এমনটা ভাবছেন বুঝি? বয়সের সাথে পরিবর্তনটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মিথ্যে বিষয় নিয়ে কষ্ট পাওয়ার সময়টা এখন আর নেই, ডিটেকটিভ সাহেব।”
কয়েক মুহূর্ত তাজ ভাইয়ের কোনো জবাব পাওয়া গেল না। পেছন ফিরে তাকাতেও ইচ্ছে করল না। উনি কি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? ভাবতে ভাবতেই মাথায় গাট্টা পড়ল। সেই সাথে তাজ ভাইয়ের ব্যঙ্গপূর্ণ বাক্য।
“যতই জ্ঞানী-জ্ঞানী কথা বলিস, আসলে তুই আজীবন বলদই থেকে যাবি। গাধি।”
আমি হাতের তালুতে মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে বিরক্ত চোখে চাইলাম। তাতে ওনার ভ্রুক্ষেপ নেই। উনি পাশের শপের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,
“কিডন্যাপ হতে না চাইলে চলে আয়।”
অগত্যা ওনার পিছু নিলাম। বিরক্তিটা এড়ানোর চেষ্টা করলাম। এই সুন্দর মুহূর্তটা ভেস্তে দেওয়ার জন্য ওই তাজ নামক আপদ একাই যথেষ্ট। জীবনে প্রথমবারের মতো একটা জামাইয়ের ভয়াবহ অভাববোধ করলাম। মহাশয় থাকলে নিশ্চয়ই আজ আমায় এই বিপজ্জনক লোকের জ্বালাতন সহ্য করতে হত না। মধ্যরাতের এই ভ্রমণটাতে বিরক্তি আসত না। যে শপটাতে ঢুকলাম সেটা বাইরে থেকে সাধারণ মনে হলেও, ভেতরে রেস্ট্রন্টের মতো ব্যবস্থা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এখানে চিপস, বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট জাতীয় খাবারগুলো বিক্রি করা হয়। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ফাস্টফুডের সমাহার দেখে আমি মনে-মনে দারুণ খুশি হলাম। খাবার দেখেই পেট জানান দিলো সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। এখানকার টেবিলগুলো গোল আকৃতির এবং ছোটো। এক টেবিলে দুজন কিংবা তিনজন বসতে পারবে। আমরা একটা টেবিল দখল করে বসলাম। খাবার অর্ডার দেওয়া হলো আমার পছন্দমতো। আজ আর তাজ সাহেব তেমন বাঁধা দিলেন না। ছেলে ভালো হয়ে গেছে, হুঁহ্। খেতে-খেতে উনি বললেন,
“কদিন আগেই দলসুদ্ধ সবকটাকে খাওয়ালাম, আজ আবার তুই। নাহ্, তোদের মতো খাদক নিয়ে আর বাইরে বেরোনো যাবে না। দেখা যাবে অচিরেই আমাকে থালা নিয়ে পথে বসতে হবে।”
আমি ঝোপ বুঝে কো’প মা’রলাম। ভাবলেশহীন উত্তর দিলাম,
“আমি কিন্তু যেচে আসিনি, আর যেচে খেতেও চাইনি। দায়টা আপনার নিজেরই। আমাকে দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই।”
“হ্যাঁ, দায়টা আমার নিজেরই। দশ দিনের অনাহারীর মতো দোকানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে পেটে হাত দিয়ে ঠোঁট উলটেছিলাম তো আমি। তাই না? তোর কি ক্ষুধা পায় না কি? তুই তো মানুষ না, এলিয়েন,” বিদ্রুপ করে বললেন উনি।
আমি দপ করে নিভে গেলাম। চোখ দুটো ছানাবড়া করে লজ্জায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। উনি এটাও খেয়াল করেছেন! কী লজ্জার ব্যাপার! কিন্তু আমি তো ড্যাবড্যাব করে দোকানের দিকে তাকাইনি। আড়চোখে তাকিয়ে ছিলাম। লোকটা আমাকে পচানোর সময় মুখে লাগাম টানতে জানে না। খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার শুরু হলো পথ চলা। একসময় আমি ইতস্তত করে বললাম,
“এতরাতে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর কথা আম্মি জানলে কী ভাববে?”
“কী ভাববে?”
ওনার ভাবলেশহীন উত্তরে আমি কেবল কাঁধ ঝাঁকালাম। উনি পুনরায় স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
“ভাবার মতো বিশাল কিছু হয়নি যে ভাববে। আর আমার আম্মি সস্তা মেন্টালিটির মানুষ না।”
আসলেই কি ভাবার মতো কিছু হয়নি? এ খবরটা আমিরা আপু পেলে কি সে সহজভাবে নিতে পারবে? অবশ্যই বিশাল কিছুই ভাববে। সবকিছু কেবল এই অদ্ভুত মানবের ক্ষেত্রেই অতিশয় সহজ। হাঁটতে-হাঁটতে আমি রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাজ ভাই প্রয়োজন ব্যতীত তেমন কোনো কথা বলছেন না। ফলস্বরূপ মুহূর্তটা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারছি। আমার অবস্থা দেখে তাজ ভাই উলটো পথ ধরলেন। অর্থাৎ এবার ফেরার পালা। আমার মোটেও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সারারাত যদি এভাবে কাটাতে পারতাম, অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হত। কিন্তু তা হবার নয়। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া মেয়ে আমি। আজকের মতো এতটা দীর্ঘ পথ শেষ কবে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলাম, মনেও নেই। তাজ ভাইয়ের মধ্যে ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। সেই প্রথম থেকে এই অবধি ফুল এনার্জি সমেত হেঁটে চলেছেন। মর্নিং ওয়াকে অভ্যস্ত উনি। তাছাড়া যে পেশায় আছেন, তাতে এটুকুতেই ক্লান্তি আসা দুরূহ ব্যাপার। এদিকে আমার হাঁটার গতি মন্থর হতে-হতে ঠেলাগাড়ির মতো অবস্থা। এত হাঁটার ফলে গরম তাপমাত্রাটাও বেশ গায়ে লাগছে। রীতিমতো ঘামছি আমি। তাজ ভাই দুটো আইসক্রিম কিনে একটা আমাকে দিলেন, আরেকটা নিজে নিলেন। ভেবেছিলাম ফিরতি পথে ঠেলাগাড়ির মতো পা ঠেলে ঠেলেই ফিরতে হবে। ভাগ্যিস দয়ালু মহারাজ একটা সিএনজি নিয়েছেন। নইলে আমার পা দুটো আজ অকালে অক্কা পেত। আইসক্রিম খেতে-খেতে ফিরতি ভ্রমণটাও মন্দ কা’টেনি। মনে হচ্ছে পথটা এবার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা? এটাই শুরু, এটাই শেষ? এই পথটা কি কোনোকালে আরও একটু দীর্ঘ হতে পারে না?

_________________

সকাল-সকাল মিনহা আপু এল। ধপ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমিই আগে প্রশ্ন করলাম,
“কী হয়েছে, আপু? মন খারাপ?”
“তাজ ভাইয়ের কাছে নালিশ করাটা কি তোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে, ইলো?”
আমি বুঝতে পারলাম আপু গতকালের কথা বুঝাচ্ছে। কিন্তু আমি কখন ওনার কাছে নালিশ করলাম?
“আমি ওনার কাছে কিসের নালিশ করেছি, আপু? বুঝলাম না।”
“না বুঝার কী আছে? গতকাল আমার ফ্রেন্ডসরা তোর সাথে মজা করেছে বলে তুই তাজ ভাইয়ের কাছে নালিশ করিসনি?”
আমি দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“না।”
মিনহা আপু চটে গেল। এক পা বিছানায় তুলে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“মিথ্যে বলবি না, ইলো। তুই নালিশ না করলে তাজ ভাই ওসব জানল কীভাবে? তুই আমাদের বাসা থেকে চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তো তাজ ভাই গেল। আগেরবারের শুধু আমাকে বলেছিল। আর এবার আমার পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলসহ বকেছে। আমাকে ওদের কারো সাথে মিশতে দিবে না বলে দিয়েছে। কত কথা বলে অপমান করেছে ওদের, জানিস? এখন আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে লাগাতার কথা শুনিয়ে চলেছে। কেউ আর আমার সাথে মিশবে না জানিয়ে দিয়েছে। সব তোর জন্য হয়েছে। তোকে কি আমি ডেকে নিয়েছিলাম? তুই যেচে গেলি কেন? গেলি তো গেলি, আমি তোকে চলে আসতে বলিনি? প্রথমেই তো বলেছিলাম। তুই নিজেই শুনিসনি। যেচে ওদের সামনে গিয়েছিস, তারপর ওরা একটু মজা করেছে বলেই এসে নালিশ করতে হলো?”
আমি হতবাক হয়ে মিনহা আপুর কথা গিলছি। উনি যে এই কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছেন, তার ক্ষুনাক্ষরও তো আমি জানতাম না। কিন্তু এখানে নালিশের কথা এল কোত্থেকে? আমি তো ওনাকে বলিইনি মিনহা আপুর বন্ধুরা আমার সাথে আবার খারাপ ব্যবহার করেছে। এমনকি উনি নিজেও এ ব্যাপারে কিছু জানতে চাননি। তাহলে? উনি ভেতরের কথা জানলেন কীভাবে? আশ্চর্য! মিনহা আপু বেশ ক্ষেপেছে। আমি কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে ভাবুক গলায় প্রশ্ন করলাম,
“তাজ ভাই কি বলেছেন যে, আমি ওনার কাছে নালিশ করেছি?”
“বলা লাগবে? আমি কিছু বুঝি না?”
আমি মাথা নেড়ে ঠোঁট উলটে বললাম,
“আমি সত্যিই ওনাকে কিচ্ছু বলিনি।”
“ঢং করবি না তো। তুই না বললে উনি জানলেন কীভাবে? স্পাই লাগিয়েছিলেন তোর পেছনে? আমাকে কি বোকা মনে করিস?”
মিনহা আপু না চাইতেও জোরে চেঁচিয়ে ফেলছে। আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। মিনহা আপু পুনরায় মুখ খুলতে যেতেই দরজার ফাঁক দিয়ে হুট করে একটা মাথার উদয় হলো। বিরক্ত ঝাড়ল,
“কী সমস্যা? সকাল-সকাল মাছের বাজার বসেছে? আরেকটু আগে বসালে তো মাছের জন্য কষ্ট করে বাইরে যেতে হত না।”
মিনহা আপু সটান উঠে দাঁড়াল। কাঁদো-কাঁদো মুখে করে আপনমনে কী যেন বিড়বিড় করল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ফটাফট বলে উঠল,
“ভার্সিটি যেতে হবে রে ইলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার, টাটা।”
দরজার সামনে গিয়েও আবার দুপা পিছিয়ে এল। যাওয়ার পথ না পেয়ে বেচারির মুখে অসহায়ত্ব। তাজ ভাই যে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে একটু ফাঁক দিয়ে শুধু মাথাটা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তা-ও আবার মিনহা আপুর দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভয়ে বেচারির মরি-মরি অবস্থা। না চোখ তুলে তাকাতে পারছে, আর না পালাতে পারছে। বাধ্য হয়ে আমিই বলে বসলাম,
“আপনি সরছেন না কেন, তাজ ভাই? মিনহা আপুর দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
তাজ ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মিনহা আপুর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। জিজ্ঞেস করলেন,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে?”
মিনহা আপু আড়চোখে তাকিয়ে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
“ওই ব’দমাশগুলোর সাথে আবার মিশতে যাবি?”
অগত্যা মিনহা আপু দুদিকে মাথা দোলালো।
“সত্যি?”
এবারে আবার ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
“মনে থাকবে?”
ভুলবশত মিনহা আপু দুদিকে মাথা দুলিয়ে ফেলল। পরক্ষণেই খেয়াল হতেই চোখ দুটো ছানাবড়া করে দ্রুত ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল।
তাজ ভাই বাঁকা হেসে দরজা আরেকটু খুলে সরে দাঁড়ালেন। মিনহা আপু যেন প্রাণ ফিরে পেল। ডানে-বায়ে না তাকিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে প্রস্থান করল। আমি ভাবলাম তাজ ভাইও চলে গেছেন। এগিয়ে গিয়ে আধখোলা দরজাটা বন্ধ করতে যেতেই পূর্বের ন্যায় আবার হঠাৎ সেই মাথাটা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মা’রল। অকস্মাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি বুকে হাত দিয়ে দুপা পিছিয়ে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই কটাক্ষ করে হেসে বললেন,
“ওরে সাহসী নারী রে! ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের বাসায় কি না আস্ত এক গাধা বাস করে, কী লজ্জার ব্যাপার!”
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। বললাম,
“আপনি এভাবে ভয় দেখালেন কেন? আমি কি জানতাম আপনি এখনও যাননি?”
উনি গলা উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“আম্মি, বাসায় পানি পড়া রাখো না? ঢালীর মেয়ে বাঘ দেখে ভয়ে বেহুঁশ হয়ে গেছে। থাকলে কাজে লাগাও তাড়াতাড়ি।”
আম্মি হয়তো ডাইনিং রুমেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো,
“তুই আবার ওকে ক্ষেপাচ্ছিস? খেতে আয় বাপ। ইলোকেও আসতে বল।”
উনি দাঁত কেলিয়ে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালেন। ঠাট্টার ছলে বললেন,
“মহারাজ আতাহার ঢালীর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা ইলু ঢালী থুক্কু, রাজকন্যা ইলোরাবতী, আপনার আহার গ্রহণের ডাক পড়িয়াছে। আহার গ্রহণ করিয়া আমার মমতাময়ী আম্মিজানকে উদ্ধার করুন।”
আমি ওনার বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে ফেললাম। পরক্ষণেই আবার হাসি থামিয়ে বললাম,
“আপনি কি মাইন্ড রিড করতে জানেন, তাজ ভাই?”
উনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“কেন রে? তোর বয়ফ্রেন্ডের খবর জেনেছি বলে এখন কৌশলে জানতে চাইছিস, আমি কীভাবে ওই গোবেচারার খবর জানলাম?”
আমি হতাশ গলায় বললাম,
“আবার বয়ফ্রেন্ড?”
উনি দরজাটা পুরোপুরি খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মাথা দুলিয়ে কাছে ডাকলেন,
“এদিকে আয়।”
আমি কিছু না বুঝে এগিয়ে গেলাম। ওনার মুখোমুখি দাঁড়াতেই মাথায় ভয়ানক এক চা’টি মে’রে নিচু স্বরে বললেন,
“নেক্সট টাইম চোখে চোখ রেখে কথা বললে চোখ তুলে নেবো, ডাকাত রানি।”
ওনার ওপর রাগ দেখানোর আর সময় দিলেন না। দ্রুত সরে গেলেন। আমি বিরক্ত হওয়ার সাথে অবাকও হলাম। মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখটা আয়নার একদম কাছাকাছি নিয়ে চোখ দুটো বড়ো করে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলাম। আবার একটু দূরে দাঁড়িয়ে পলকহীন চেয়ে রইলাম। কই? ডাকাতের মতো তো লাগছে না। অত বেশি বড়ো না কি আমার চোখ? সবাই তো আমার চোখের কত প্রশংসা করে। আমার প্রশংসা করতে গিয়ে অনেকেই সর্বপ্রথম আমার চোখের প্রশংসাটা আগে করে। সবার প্রশংসা তো মিথ্যে হতে পারে না। এমনকি আমার নিজের কাছেও তো খারাপ লাগে না। জীবনের প্রথম কেউ আমার চোখের ব’দনাম করল। ব’জ্জাত লোক! আমার চোখ ডাকাতের মতো হলে, আপনার চোখ রা’ক্ষসের মতো। রা’ক্ষস ডিটেকটিভ। আচ্ছা, রাক্ষসের চোখ দেখতে কেমন হয়? বিছানায় বসা জেমির দিকে তাকালাম। ও নিজেও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এগিয়ে গিয়ে মেঝেতে বসে বিছানায় থুতনি ঠেকালাম। জেমির চোখ দুটো মায়াবী। দেখলে মনে হয় গোল-গোল চোখ দুটোতে কেউ খুব যত্ন করে কাজল টেনে দিয়েছে। ও যখনই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, তখনই ওর সুন্দর চোখ দুটো দেখলেই ওকে আদর করতে ইচ্ছে করে। পাজিটা বোধ হয় আদর পাবার লোভে সারাক্ষণ আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। আমি জেমির মুখটা তর্জনী আঙুলে ছুঁয়ে বললাম,
“জিমজিম, আমার চোখ সত্যিই কি ডাকাতের মতো? তোর মতো সুন্দর না?”
জেমির উত্তর,
“মিয়াও।”
“ওহ্, তুই তো কথাই বলতে পারিস না। বল না রে।”
“মিয়াও।”
“এটা ‘হ্যাঁ’ ছিল, না কি ‘না’ ছিল?”
“মিয়াও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যেহেতু তোর মালকিন, সেহেতু তুই নিশ্চয়ই আমার বিপক্ষে কথা বলবি না, তাই না?”
“মিয়াও।”
“যাহ্, তোর উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ ধরে নিলাম। আমার পোষা বিড়াল হয়ে তুই আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তো আরেক বিপদ। অলরেডি এক বিপদ আমার জীবন বিপদে-বিপদে বিপদময় করে তুলেছে। এর বেশি আর চাই না, ভাই।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

#মনোহারিণী
লেখনীতে —ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
মনোহারিণী,
নিশ্চয়ই ভাবছো তোমার ওই হরিণীর মতো সুন্দর চোখ জোড়া ডা’কাতের সাথে কেন তুলনা করা হলো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ সেদিন চৈত্র মাস ছিল কি না জানি না; কিন্তু ডাগর-ডাগর চোখের মিশমিশে কালো দুটি মণির গভীরে আমার সর্বনাশ ছিল স্পষ্ট। সুদূর সুইডেনের ভিন্ন রংয়ের হাজারটা চোখের মণির ভীড়েও ওই মিশমিশে কালো দুটি মণি আমায় প্রতিটি মুহূর্ত তাড়া করে বেড়াত। তার কাছে যেন সুন্দরী বিদেশিনীদের আকর্ষণীয় চোখও ছিল অতিশয় তুচ্ছ। হরিণীর মতো গভীর চোখ জোড়ায় যে আমি কতশত বার ডুব দিয়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গভীর রজনীর তদ্রাঘোরেও যে চোখ জোড়া কাউকে তাড়া করতে সক্ষম, সে ডা’কাত না তো কী? ডা’কাত বলেই তো সে আমার এতবড়ো সর্বনাশের কারণ হলো। তবু ওই সর্বনাশা চোখেই আমার ভীষণ, ভীষণ দুর্বলতা। ওই ডাকাতের মতো চোখে চোখ রেখে আমি সেই দুর্বলতা প্রকাশ করতে বরাবরই ব্যর্থ। তবু এ আমার ব্যর্থতা নয়, ভীষণ প্রিয় এক স্বার্থকতা।
ইতি,
ডা’কাত রানির চোখের মায়ায় খু’ন হওয়া
এক নীরব মুগ্ধতা

চিঠিটা যতবার পড়লাম, তারচেয়ে বেশি পড়লাম ভীষণ আশ্চর্যজনক ওই লাইনটা, ‘সেদিন চৈত্র মাস ছিল কি না জানি না; কিন্তু ডাগর-ডাগর চোখের মিশমিশে কালো দুটি মণির গভীরে আমার সর্বনাশ ছিল স্পষ্ট।’ এই সেদিনটা আবার কোন দিন? তার ভাষ্য অনুযায়ী ভীষণ দুর্বলতা নিহিত চোখ দুটো দিয়ে বুঝি কেউ সজ্ঞানে অশ্রু ঝরাতে পারে? যে ইতিঃপূর্বে পেরে দেখিয়ে দিয়েছে, তার সর্বনাশের সেদিনটা ঠিক কবে ছিল? সময়টা কখন ছিল? ঠিক কোথায় ঘটেছিল? কীভাবে ঘটেছিল? আদৌ এটা কয়েক বছর আগে ঘটা সম্ভব? যতবারই আমার মনে নানান সন্দেহজনক প্রশ্ন উঁকি মা’রছে, ততবারই এই চিরকুটের প্রতিটা শব্দ জানান দিচ্ছে তারা কেউ ভুল নয়। ভুল-সঠিকের অনুসন্ধানে পড়ে আমার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। একটা মানুষের ভেতর এতটা প্যাঁচ কীভাবে থাকে? এ তো জিলাপির প্যাঁচের চেয়েও ঝামেলাযুক্ত। হুট করে ভাবলাম এক্ষুনি গিয়ে সামনে দাঁড়াব। এই চিরকুট দেখিয়ে মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবো। তাহলে উত্তর না দিয়ে পালাবে কোথায়? মনে বেশ সাহস জুগিয়ে হনহনিয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। আরও একবার প্রমাণ পেলাম আমি আসলে মনে-মনে বাঘের সাথেও যু’দ্ধ করে জয়লাভ করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে ওই চিড়িয়াখানার খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে দশহাত দূর থেকে ড্যাবড্যাব করে বাঘ মামার দিকে তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই আমার দৌড়। মূলত মনে-মনে আকাশ-কুসুম চিন্তা করলেও, বাস্তবে তার কিছুই ঘটাতে পারি না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, জড়তা আর লজ্জা আমার অন্যতম সমস্যা। বহু চিন্তা-ভাবনার পর ফলাফলের স্থানে ইয়া বড়ো এক শূন্য বসিয়ে চিরকুটটা ভাঁজ করে পূর্বের চিরকুটগুলোর সাথে রেখে দিলাম। তারপর এটা ভাবতে ভাবতেই কপাল চাপড়ালাম যে, এত বড়ো একটা প্রমাণ পেয়েও মামলায় সেই হেরেই গেলাম! এই দুঃখ রাখার জায়গা কোথায় পাই আমি? হায় রে! বাইরে থেকে আম্মির ডাক পড়তেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইরে ছুট লাগালাম। ভার্সিটি যেতে হবে। আম্মি আমাকে দেখে বলল,
“নিচে চলে গেছে। তাড়াতাড়ি যাও।”
অগত্যা আম্মিকে বিদায় জানিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলাম। গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল।গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসতেই আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। পাশ ফিরে তাকালেই হয়তো ভয়ানক কোনো কাণ্ড ঘটে যাবে। চোখে চোখ পড়লেই কিছুক্ষণ আগের ওই চিরকুট বিষয়ক প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে। মস্তিষ্ক বারংবার বিপদ সংকেত দিয়ে চলেছে। তারমধ্যে এক টিপ্পনীপূর্ণ বাক্য কানে এল,
“কাকে পছন্দ হয়েছে? রিকশাওয়ালা, না কি ফেরিওয়ালা?”
আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। তাজ ভাই হেসে বললেন,
“যেভাবে তাকিয়ে ছিলি, মনে তো হচ্ছিল নিজের জন্য জামাই পছন্দ করছিস। তো কাকে পছন্দ হলো?”
“আপনার কেন মনে হলো আমি রিকশাওয়ালা বা ফেরিওয়ালা দেখছিলাম?”
“কারণ তোর মতো গাধির কপালে এর চেয়ে ভালো জামাই জোটার সম্ভাবনা নেই।”
আমার ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত দূরত্ব সৃষ্টি হলো। কী অপমান রে ভাই! এই অপমানের প্রতিশোধস্বরূপ আমার উচিত এই গাড়ির নিচেই গর্দান দিয়ে সাধু ডিটেকটিভকে ফাঁ’সিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমি তা করব না। কারণ আমার ঘাড়ে কেবল একটাই মাথা। অকালে ম’রার সাধ নেই আমার। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকা অতীব জরুরী। এই ডিটেকটিভ নামক মা’ফিয়ার বউ বেচারির চাঁদপনা মুখখানি দেখার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে। বিরক্তি ঝেড়ে বললাম,
“সবসময় আপনার মুখে আজগুবি কথা ছাড়া ভালো কথা আসে না? আজকাল আপনি খুব বেশি অদ্ভুত হয়ে গেছেন, তাজ ভাই।”
“প্রতিভা, বুঝলি? অদ্ভুত হতেও প্রতিভা লাগে। সবার এই প্রতিভা থাকে না। আমি গ্রেট বলে আমার প্রতিভাও গ্রেট। তুই তো এক বলদ। এসব গ্রেট প্রতিভার মর্ম বুঝবি না।”
“বুঝতে চাইও না, ভাই। আপনি বুঝলেই হলো।”
ওনার সাথে তর্কযু’দ্ধ থেকে বাঁচতে ফোনে মনোযোগ দিলাম। অনলাইনে ঢুঁ মা’রতেই ভিডিয়ো কল এল। রিসিভ করে সামনে ধরলাম। স্ক্রিনে মিথির বিধ্বস্ত মুখটা ভেসে উঠল। ওকে নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন করলাম,
“কী সমস্যা? অনাহারীর মতো মুখ করে আছিস কেন?”
“মজা করিস না রে আপু। ভীষণ দুঃখে আছি।”
ওর দুঃখের ধরণ যে কেমন হতে পারে, তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। অলস ভঙ্গিতে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
“আবার কে ছ্যাঁকা দিলো?”
“অটোওয়ালা।”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম।
“আমি ভার্সিটি যাচ্ছি, এখন তোর ফালতু কথা শুনতে পারব না। ফোন রাখ।”
মিথি ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আরে শোন না। তুই যদি ছেলেটাকে দেখতি, তাহলে বুঝতি। কী হ্যান্ডসাম, ভাই রে ভাই! প্রথমে দেখে তো আমি স্টুডেন্ট ভেবেছিলাম। একদম ফিদা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার কোমল মনটাকে ভেঙে চুরমার করে হতচ্ছাড়া বলে বসল, ‘কোথায় যাবেন, আপা? ভাড়া কম নিব, আসেন।’ বিশ্বাস কর, আমার ইচ্ছে করছিল ওই অটোতেই মাথা ঠুকতে। এ-ও কী মানা যায়? একটা ক্রাশও ঠিকমতো খেতে পারি না আমি। মাঝপথেই ছ্যাঁকা খেয়ে বসে থাকি। এ দুঃখ কাকে বুঝাই?”
মিথির কাঁদো-কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে আমি খিলখিল করে হেসে চলেছি। হাসির মাঝেই একবার বললাম,
“শেষমেষ অটোওয়ালা?”
তাজ ভাই হঠাৎ ছোঁ মে’রে আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। একহাতে ড্রাইভ করতে-করতে মিথিকে বললেন,
“দুঃখ করিস না, মিথি। তোকে আমার মতো কিউট একটা বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে দেবো। আপাতত ওই অটোওয়ালাকে তোর এই মাথামোটা বোনের জন্য ঠিক করে রাখ। কষ্ট করে আর ওর জন্য ভালো জামাই খুঁজতে হবে না। নইলে পরে বিজ্ঞাপন দিয়েও পাওয়া যাবে না, বুঝলি? এবার গ্রামে গিয়েই শুভ কাজটা সেরে ফেলা যাবে। কী বলিস?”
সঙ্গে-সঙ্গে আমার মুখ থেকে হাসি উবে গেল। ওদিকে এবার মিথি আমার মতো হাসতে শুরু করেছে। হুঁ-হা করে হেসে বলছে,
“একদম ঠিক বলেছেন, তাজ ভাই। এটাই করতে হবে। এত সুন্দর একটা সাজেশন দেওয়ার জন্য এবার গ্রামে এলে আপনাকে খুব বড়ো একটা গিফট দেবো।”
“তুই আবার আমাকে কী গিফট দিবি, পুঁচকি?”
“সে দেখা যাবে সময়মতো। এখন রাখছি। আমার অনেক কাজ। আল্লাহ্ হাফেজ।”
“ঠিক আছে, ব্যস্ত আপা। আল্লাহ্ হাফেজ।”
কল কে’টে উনি আমার দিকে ফোন এগিয়ে ধরলেন। আমি না তাকিয়েই ওনার মতো ছোঁ মে’রে ফোনটা কেড়ে নিলাম। তারপর গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। মনে-মনে জুম্মান ভাইয়াকে কয়েক দফা বকাঝকা করলাম। বেড়াতে যাওয়ার আর সময় পেলেন না উনি? আমাকে এই আপদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নানাবাড়ি বেড়াচ্ছেন। কবে ফিরবেন খোদা জানে। না ফেরা পর্যন্ত ভার্সিটি যাওয়ার সময়টুকুও আমার শান্তি জুটবে না। জীবন ভাজা-ভাজা করে ফেলবে এই বিপজ্জনক লোক। হঠাৎ মাঝপথে তাজ ভাই গাড়ি থামালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছনের সিটে হুড়মুড়িয়ে দুজন লোক উঠে বসল। গাড়ি পুনরায় আগের মতো চলতে শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়েই উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলাম,
“আরে শ্রেয়ান ভাইয়া! কেমন আছেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া স্বভাবসুলভ হেসে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে।”
“ব্যস্ত ছিলাম একটু।”
“আপনাদের ব্যস্ততা মানেই তো ইনভেস্টিগেশন। ওই বাহানায়ও তো একবার বাসায় যেতে পারতেন।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে পাশের লোকটাও সশব্দে হেসে উঠল।
“তা ইলোমিলো, ওই বাসায় গিয়ে কোন কেসের ইনভেস্টিগেশন করতাম আমি?”
আমি হেসে দাঁতে জিব কে’টে বললাম,
“তা-ও কথা।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার পাশের লোকটাকে চুপচাপ দেখে বললাম,
“ওনাকে তো চিনলাম না।”
তাজ ভাই বলে উঠলেন,
“শ্রেয়ান বাদে গোয়েন্দা বিভাগের কজনকে তুই চিনে বসে আছিস, শুনি?”
আমি চোখ দুটো সরু করে বললাম,
“আমি কি করে জানব উনি আপনাদের টিমের লোক? ভেবেছিলাম অন্য কেউ।”
পেছন থেকে লোকটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ম্যাম, আমি নাসের।”
আমি মুখটা ছুঁচলো করে বললাম,
“ওহ্, আমাকে ম্যাম ডাকছেন কেন, ভাইয়া? আমি আপনার অনেক জুনিয়র।”
নাসের ভাইয়া হেসে বললেন,
“তাহলে কী বলে ডাকব?”
তাজ ভাই ফট করে বলে বসলেন,
“আপাতত ডাকাডাকি বন্ধ করো, নাসের। বেশি কথা শুনলে আমার ড্রাইভিংয়ে প্রবলেম হয়।”
নাসের ভাইয়া অনুগত ছাত্রের মতো বললেন,
“সরি স্যার।”
শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইকে বললেন,
“তোর এই নতুন সমস্যার জন্ম আবার কবে থেকে শুরু হলো? আমি জানতাম না তো।”
তাজ ভাই জবাব দিলেন না। আমি মুখ বাঁকালাম। অযথা ঢং। নাসের ভাইয়ার সাথে একটু পরিচিত হতে চলেছিলাম, তা-ও দিলো না। খারাপ লোক। হুট করে শ্রেয়ান ভাইয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত এক প্রশ্নে আমি বেশ অবাক হলাম। উনি ফোন ঘাঁটতে-ঘাঁটতে প্রশ্ন করে বসলেন,
“পাত্রীকে তোর কেমন লেগেছে রে তাজ?”
চকিতে গোলগোল চোখে তাকিয়ে আমি ফট করে বলে উঠলাম,
“তাজ ভাই বিয়ে করছেন না কি?”
তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,
“কথার আগামাথা না শুনে আগেই প্রশ্ন করে বসলে, স্টেয়ারিংয়ের সাথে গোবরগাদা মাথাটা এক বাড়ি মে’রে ফা’টিয়ে দেবো, ননসেন্স।”
আমি চুপসানো মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি হো-হো করে হেসে বললেন,
“রাজ ভাইয়ের আগে তাজ কেন বিয়ে করতে যাবে, ইলোমিলো?”
“তাহলে কি আপনার বিয়ে?”
“আরে না। রাজ ভাইয়ের।”
এবার আমি আরও বেশি অবাক হয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,
“কিহ্! রাজ ভাইয়ের বিয়ে? কই? আম্মিকে তো কিছুই বলতে শুনলাম না।”
“আন্টি জানলে তো বলবে।”
“অ্যাঁ! রাজ ভাইয়ের বিয়ে, অথচ আম্মিই জানে না!”
ভীষণ বড়ো কনফিউশন পড়ে আমি তব্দা খেয়ে বসে রইলাম। অসহায় চোখে এক ঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে একবার তাজ ভাই, তো আরেকবার শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখের দিকে তাকালাম।
তাজ ভাই স্টেয়ারিং সামলাতে-সামলাতে বললেন,
“শ্রেয়ান, কাকে কী শোনাচ্ছিস? ওভার থিংকিংয়ে পারদর্শী সে। এক্ষুনি বুঝিয়ে বল, নইলে পা’গল হতে দু মিনিটও লাগবে না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে বললেন,
“রাজ ভাইয়ের পছন্দের এক মেয়ে আছে, বুঝলে? রাজ ভাই আন্টি-আঙ্কেলের কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তাজকে দিয়ে বলাতে চাইছে। ছবি পাঠিয়েছে তাজের কাছে। সেজন্যই ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম ওর কেমন লেগেছে। আমি এখনও দেখিনি।”
আসল ঘটনা জেনে আমি খুশিতে প্রশস্ত হাসলাম। দারুণ উৎসাহে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ না খুলতেই পা’জি লোকটা গম্ভীর গলায় ঘোষণা দিলেন,
“ছবি দেখতে চেয়ে লাভ নেই। দেখাব না। বাড়ি ফিরে আম্মিকে দেখাব। তার পছন্দ হলে তারপর সবাই দেখবে।”
আমি বিরস মুখে বললাম,
“আমাকে দেখালে কী হবে? রাজ ভাইয়ের বউ আমি দেখব না?”
“দেখবি না কখন বললাম? সময় হলে সবাই দেখবে। সাথে তুইও।”
শ্রেয়ান ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
“আমাকেও দেখাবি না?”
“না,” তাজ ভাইয়ের স্পষ্ট উত্তর।
“অল রাইট। তাহলে তোর কেমন লাগল তা তো অন্তত বলতে পারিস।”
“কেন রে? বিয়ে কি আমি করব? না কি সংসার আমি করব? যে করবে তার পছন্দ হলেই হয়। আর তার কথামতো শুধু আম্মির পছন্দ হলেই হবে।”
আমি অনুরোধের সুরে বললাম,
“আমি দেখি না একটু। একটু দেখান, এই একটু। একবার দেখব শুধু।”
কোনো অনুরোধই ধোপে টিকল না। শেষমেষ হতাশ হয়ে আমি কপাল কুঁচকে, গাল ফুলিয়ে রইলাম। আরে ভাই একটা ছবিই তো দেখতাম। একবার দেখালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমি বুঝি খেয়ে ফেলতাম? যতসব ঢং!

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤