মনোহারিণী পর্ব-১২+১৩

0
245

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
রাজ ভাইয়ের পছন্দের মেয়েকে আম্মির খুব পছন্দ হয়েছে। নূর আঙ্কেলের কাছেও ছবি পাঠিয়েছিল। তিনিও আপত্তি জানাননি। অবশেষে আমাদের বাকি সবার ভাগ্যেও ছবি দেখা জুটেছে। রাজ ভাইয়ের পছন্দের তারিফ করতে ভোলেনি কেউ। সবাই জানামাত্রই রাজ ভাইকে ফোনে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিয়েছে। রাজ ভাই দূরে থেকেও এতে খুব লজ্জায় পড়ে গেছেন। বেচারা আম্মি আর তাজ ভাই ছাড়া এখন আর কারো ফোনই রিসিভ করছেন না। পাত্রী ঢাকাতেই থাকে, তাই আম্মি বেশি দেরী করতে চাইছে না। তার তাড়া দেখে মনে হচ্ছে সে পারলে একদিনের মধ্যেই ঘরে বউ তুলে আনবে। নূর আঙ্কেল জানিয়েছেন, পাত্রীর পরিবারের সাথে কথা বলে তারপর গিয়ে পাত্রী দেখে আসতে। সব ঠিকঠাক হলে তবেই আঙ্কেল দেশে ফিরবেন। ইতোমধ্যে আম্মি পাত্রীর পরিবারের সাথে কথাও বলে ফেলেছে। হিমেল কাকাকে তাড়া দেখিয়ে বলেছে আজই গাড়িতে উঠতে। আগামীকাল সবাই মিলে পাত্রী দেখতে যাওয়া হবে। এই নিয়ে আজ বাসায় হট্টগোল বেঁধে গেছে। আমিরা আপুদের পুরো পরিবার এ বাসায় গেড়ে বসে এই নিয়েই আলোচনা করে চলেছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে স্বয়ং আম্মি। গোবেচারি আমাকেও ছাড় দেওয়া হয়নি। তখন থেকে বসিয়ে রেখে তাদের বিয়ে নিয়ে যত অগ্রিম আলোচনা কানে ঢালা হচ্ছে। অসহায় মুখ করে চুপচাপ এ অত্যাচার গলধঃকরন করছি আমিসহ আমিরা আপু, মিনহা আপু, জুম্মান ভাইয়া আর সৌরভ ভাইয়া। জুম্মান ভাইয়া বিয়ে নামক শব্দ শুনে আজই একপ্রকার উড়ে ফিরে এসেছেন নিজের নানাবাড়ি থেকে। এরপর এলেন সৌরভ ভাইয়া। এসেই খুব উৎফুল্ল চিত্তে জানালেন, রাজ ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে তার পক্ষে হলে শ্বাস নেওয়া আর সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না। তাই আজই ছুটে এসেছেন।‌ যেন বিয়েটা আজই হয়ে যাচ্ছে। অথচ রাজ ভাই জানিয়েছেন, পাত্রী দেখাদেখির ঝামেলা শেষ হলে তারপর উনি আসবেন। বলা চলে, ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া‌ পড়শির ঘুম নেই।’ ওদিকে গ্রাম থেকে মিনিটের আগায়-মাথায় ফোন আসছে। আম্মির মাঝে আজ ন্যূনতম বিরক্তিটুকুও নেই। কী সুন্দর অতি ধৈর্য সহকারে সে প্রত্যেকটা ফোন কল রিসিভ করে খুশিমনে কথা বলছে! পরিবারের বড়ো ছেলের বিয়ে বলেই সবার এত-এত উত্তেজনা। মাঝখান থেকে দুই ভাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
পরদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে পাত্রী দেখতে গেলাম। গাড়ি নেওয়া হলো দুটো। একটার ড্রাইভার তাজ ভাই, আরেকটার জুম্মান ভাইয়া। কিন্তু যখন ছোটোরা সবাই তাজ ভাইয়ের গাড়িতে উঠে বড়োদের জুম্মান ভাইয়ার গাড়িতে ঠেলে দিলো, তখনই জুম্মান ভাইয়া বেঁকে বসলেন। অর্থাৎ সে একা কেন বড়োদের মাঝে থাকবে? এই অবিচার কোনোভাবেই মানতে রাজি নন জুম্মান জহির। শেষে তাকে তাজ ভাইয়ের গাড়িতে পাঠিয়ে হিমেল কাকা ড্রাইভিং সিটে বসলেন। হিমেল কাকা, তার স্ত্রী নাসিমা কাকি, আমিরা আপুর বাবা-মা আর আম্মি এক গাড়িতে। অপর গাড়িতে তাজ ভাই, জুম্মান ভাইয়া, সৌরভ ভাইয়া, আমিরা আপু, মিনহা আপু, হিমেল কাকার ছোট্ট মেয়ে অলি আর আমি। আমিরা আপু আগেভাগেই অলিকে কোলে নিয়ে সামনের সিটে উঠে বসেছিল, তাজ ভাইয়ের পাশে বসার জন্য। তারপর আর তাকে জোর করেও পেছনে বসাতে পারেনি জুম্মান ভাইয়া। শেষমেষ পেছনের সিটে চারজন বসতে গিয়ে জুম্মান ভাইয়ার কোলো সৌরভ ভাইয়াকে বসাতে বাধ্য হয়েছে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে যত খোঁচাখুঁচি চলছে শুরু থেকেই। সৌরভ ভাইয়া মাঝে-মাঝে ইচ্ছে করেই শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে বসছেন জুম্মান ভাইয়ার কোলে। আর জুম্মান ভাইয়া প্রতিবারই চেঁচিয়ে উঠছেন। একবার বলছেন,
“এই ড্রামকে কোলে তুলে গন্তব্য অবধি পৌঁছানোর আগেই আমার দশ থেকে বারো কেজি ওয়েট লুজ হয়ে যাবে। ভাই তুই কী খেয়ে দিন-দিন এমন শরীর বানাচ্ছিস?”
আবার আফসোসের সুরে বলছেন,
“এখন তোর জায়গায় একটা সুন্দরী মাইয়া থাকলে কি আমার এত আফসোস করা লাগত? দম বন্ধ কইরা সব কষ্ট সহ্য কইরা নিতাম। আহা, তবু তো একটু শান্তি মিলত। শা’লার গ’ন্ডারটা আমার পুরো জার্নিটাই নষ্ট কইরা দিলো। ধুর।”
সৌরভ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আরে ভায়া, ভাবি দেখতে গিয়ে তো দু-একটা সুন্দরী বেয়াইনও কপালে জুটে যেতে পারে। অন্তত ওই আশায় ধৈর্য ধরে এটুকু কষ্ট করো। কষ্টের ফল অতি মিষ্ট হয়।” আমাদের যাত্রাপথের বিনোদন ছিল এই দুজন। মাঝ থেকে অলি বলে উঠল,
“অ্যাই, সৌরভ আলী ডিমের হালি। তুমি ফোনের দিকে তাকিয়ে কথা বলো কেন? সবার দিকে তাকাও।”
সৌরভ ভাইয়া ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রুকুটি করে অলিকে বললেন,
“আবার তুই আমাকে এসব বলছিস? আন্টিকে বলব?”
অলি মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“তুমি পচা, সারাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকো। আম্মু আমায় বলেছে, ভালো ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ ফোন নিয়ে থাকে না, পড়াশোনা করে। তার মানে তুমি ভালো ছেলে না।”
আমি ফিক করে হেসে উঠে বললাম,
“এক জ্ঞানীকে আরেক জ্ঞানী জ্ঞান দিচ্ছে। অলি, সৌরভ ভাইয়া কিন্তু পড়াশোনায়ও খুব ভালো, তুমি জানো না?”
অলি কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বেশ ভাবুক গলায় প্রশ্ন করল,
“পড়াশোনা কখন করে?”
সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“ওই বুড়ি, তোর পাকা কথা বন্ধ কর। পাকা বুড়ি।”
অলি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“সৌরভ আলী ডিমের হালি।”
অলি রেগে গেছে বুঝতে পেরে সবাই হেসে উঠল। সবার হাসি দেখে অলি আরও রেগে গেল। পুনরায় চিৎকার করে বলল,
“তোমরা সবাই পচা। আমি আর তোমাদের সাথে গাড়িতে উঠব না। বাবার সাথে উঠব।”
তারপর তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ তুলল,
“অ্যাই ভাইয়া, ওদের বকা দাও। ওরা পচা।”
তাজ ভাই এক হাতে অলির গাল টেনে দিয়ে বললেন,
“আচ্ছা বকে দেবো। সবাই পচা, অলি বুড়ি‌ একা ভালো। এখন ভালো মেয়ের মতো চুপটি করে থাকো তো। ভালো মেয়েরা চেঁচামেচি করে না, সোনা।”
ব্যস, অলি পুরোপুরি শান্ত বনে গেল। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সদা চঞ্চল বাচ্চা মেয়েটার দিকে। অলির বয়স পাঁচ বছর। নূর আঙ্কেলের বংশের সবচেয়ে ছোটো সদস্য সে। কথা বলা শেখার পর থেকেই এই মেয়েটা খুব চঞ্চল। সবার আদরে-আদরে তার চঞ্চলতা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। বাবা পাগল মেয়ে সে। কিন্তু মান্য করার বেলায় একমাত্র নিজের মা ছাড়া আর কারোর পাত্তা নেই তার কাছে। যাকে ভালো লাগে তার কথা শোনে মাঝে-মাঝে। তাজ ভাই সুইডেন যাওয়ার পর ওর জন্ম হয়েছিল। সেক্ষেত্রে সুইডেন থেকে ফেরার পর গ্রামে গিয়ে অলির সাথে তাজ ভাইয়ের প্রথম দেখা হয়, আর এবার দ্বিতীয়। এরইমধ্যে মেয়েটা এই পাজি লোকের এত ভক্ত হয়ে গেছে দেখে একটু বেশিই অবাক হলাম। আমার সাথে বাকি সবার-ও একই অবস্থা। আমিরা আপু বলেই ফেললেন,
“এই ধানি লঙ্কাকে কীভাবে বশ করলেন, তাজ ভাই?”
আমিও তাল মিলালাম,
“অলিকে বশ করা অত সোজা না। যা মেয়ে!”
তাজ ভাই বেশ গর্বিত ভাব নিয়ে বললেন,
“ইন্টেলিজেন্স, বুঝলি? এটাও একটা প্রতিভা, যা আমার প্রচুর আছে। গাধাদের এসব থাকে না। তাই তোরা বুঝবিও না।”
আমি ফুঁসে ওঠার আগেই আমিরা আপু গাল ফুলিয়ে বললেন,
“গাধাদের মানে কী, তাজ ভাই? আপনি আমাদের সবাইকে গাধা উপাধি দিলেন?”
“সবাইকে কেন? এখানে যারা সত্যিকার অর্থে গাধা, তারা এমনিতেই বুঝে গেছে। নাম মেনশন করার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
আমি আপন মনে ফুঁসে উঠে স্বগতোক্তি করলাম,
“আসছে বুদ্ধির জাহাজ। সে ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবাই শুধু গাধা। ফা’জিল লোক।”
গন্তব্যে পৌঁছে তবেই সবার স্বস্তি মিলল। পাত্রীর পরিবার বাড়ির সামনে থেকে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। তিন তলার ফ্ল্যাটে থাকে তারা। আপ্যায়ন করল জম্পেশ। জুম্মান ভাইয়া এসে হতে শুধু খেয়েই চলেছেন। মাঝে-মাঝে আবার দুঃখী মুখ করে ফিসফিস করছেন,
“কিরে ভাই, এখনও তো একখান সুন্দরী বালিকাও চোখে পড়ল না। বেয়াইন কি কপালে নাই? এমন হইলে কিন্তু রাজ ভাইয়ের বিয়েতে আমি ভিলেন হয়ে দাঁড়াব। বেয়াইনহীন ভাবি চাই না আমার।”
এদিকে তার মা বার-বার চাপা স্বরে ধমকাচ্ছেন,‌ “জুম্মান, তোর কি আক্কেল-জ্ঞান নেই? পাত্রী দেখতে এসে মানুষ এভাবে খায়?”
জুম্মান ভাইয়া অবাক হয়ে উত্তর দিলেন,
“কী আশ্চর্য! খাবার কি না খেয়ে সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছে, আম্মু? ওনারা এত আদর করে খেতে দিয়েছে, আদরের অসম্মান করি কীভাবে?”
সৌরভ ভাইয়া মুখ টিপে হেসে বললেন,
“এই লোক মনে হয় এমনভাবে খাওয়ার জন্য পেটে রা’ক্ষুসে ক্ষুধা নিয়ে এসেছে।”
পাত্রীকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে আসা হলো। বেবি পিংক কালার খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে সে। এসে হতে লজ্জায় মাথা নত করে বসে আছে। সালাম জানিয়েছে, কিন্তু আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ছবিতে যেমন মিষ্টি দেখতে ছিল, বাস্তবেও সে ততটাই মিষ্টি। বড়োদের মুখের হাসিই বলে দিলো এই মেয়েকেই তারা ছেলের বউ বানাবে। পাত্রীর নাম জেনিফার আনাম। পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে। তার নত মুখের লাজুক হাসিটা খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলাম আমি। এই হাসিটাই হয়তো রাজ ভাইয়ের মন কেড়েছে। কী মিষ্টি! বড়োরা কয়েকটা প্রশ্ন করেই পাত্রীকে ছেড়ে দিলো। তারা এখন পাত্রীর অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চলেছে। ছোটোদের মুখে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম বড়োদের এই আলোচনার মাঝে এরা কেউই আগ্রহী নয়। অবশ্য আমি নিজেও খুব একটা আগ্রহী নই। এখান থেকে বেরোতে পারলেই সবাই বাঁচে। আমিও মনে-মনে এটাই চাইছিলাম। আমাদের মনের কথা হয়তো পাত্রীর বাবা বুঝতে পারলেন। আমাদের সবাইকে বললেন আমরা এখানে বিরক্ত হলে যেন ভেতরে গিয়ে বসি। জেনিফার ভাবি নিজেই আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। নিয়ে বসালেন তার নিজের রুমে। বসার মুহূর্তেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড ঘটে গেল। বেলকনি থেকে এক অতীব সুন্দরী রমণী ছুটে এসে একপ্রকার হামলে পড়ল তাজ ভাইয়ের গায়ে। গলা জড়িয়ে ধরে অতিরিক্ত উৎফুল্ল হয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“হানিইইই…ওহ্ মাই গড! হোয়াট অ্যা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ! আই ক্যান্ট বিলিভ…আপ্পিইইই?”
আমি বসতে গিয়েও তড়াক করে পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমিসহ উপস্থিত সবাই মোটামুটি ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে। রসগোল্লার মতো চোখ করে তাকিয়ে আছে অচেনা গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েটির দিকে। তাজ ভাই নিজেও কম অবাক হননি। দুহাত কিছুটা ওপরে তুলে সে মেয়েটির মুখ দেখার চেষ্টা করলেন। মেয়েটা অবশ্য বেশিক্ষণ গলায় ঝুলে থাকল না। সঙ্গে-সঙ্গেই ছেড়ে দিলো। মেয়েটার চেহারা দেখতেই তাজ ভাইয়ের মুখের ভাব পালটে গেল। বিস্ময়ের সাথে কিঞ্চিত খুশিও যোগ হলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,
“জেসি! তুমি এখানে কীভাবে?”
“আমার বাসায় আমি থাকব না?”
“তোমার? মানে, তুমি ওনার কে হও?” জেনিফার ভাবিকে ইশারায় দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন তাজ ভাই। জেসি নামক মেয়েটার আগে জেনিফার ভাবি বলে উঠলেন,
“তোমরা একে অপরকে চেনো?”
তাজ ভাই উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ, জেসিকার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সুইডেনে। একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম আমরা। দেশে ফেরার পর আর যোগাযোগ হয়নি।”
জেসিকাও তাল মিলিয়ে বলল,
“আরে আপ্পি, ও তাজ। তোমাকে বলেছিলাম না তাজ আর শ্রেয়ানের কথা?”
জেনিফার ভাবি হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলালেন। হেসে তাজ ভাইকে বললেন,
“বেশ তো! জেসিকা আমার ছোটো বোন। ভালোই হয়েছে তোমরা কেউ ব্যাপারটা জানতে না। তাহলে আর এমন সারপ্রাইজ পাওয়া হত না।”
“ইয়াহ্, আই ওয়াজ অলসো সারপ্রাইজড,” মাথা দুলিয়ে বললেন তাজ ভাই।
জেসিকা আপু প্রশ্ন করল,
“তাজ, রাজ ভাইয়া তোমার কে হয়?”
তাজ ভাই দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশন, ইউ উইল বি মাই ওয়ান অ্যান্ড অনলি বেয়াইন সাহেবা।”
জেসিকা আপু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
“তার মানে তুমি রাজ ভাইয়ার ছোটো ভাই, অ্যাম আই রাইট?”
তাজ ভাই ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন। জেসিকা এবার জেনিফার ভাবিকে জাপটে ধরে গদগদ কন্ঠে বলল,
“আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, আপ্পি। কত, কত সারপ্রাইজ পেলাম আজ! তাজের আম্মির অনেক গল্প শুনেছি ওর মুখে। অসাধারণ মানুষ সে। কয়েকবার কথাও হয়েছিল আমার সাথে। আমি বরং আন্টির সাথে দেখা করে আসি। তোমরা গল্প করো।”
বলা মাত্রই জেসিকা আপু এক ছুটে বাইরে চলে গেল। আড়চোখে আমাদের গ্যাংয়ের দিকে তাকালাম। জুম্মান ভাইয়ার মুখটা এখনও হা হয়ে আছে। অতীব সুন্দরী বেয়াইনের সাক্ষাৎ পাওয়ার ধাক্কাটা ঠিক সামলাতে পারছেন না বেচারা। সৌরভ ভাইয়া তাকে কনুই দিয়ে খোঁচা মা’রছেন। আমিরা আপুর কপালে ভাঁজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে জেসিকা আপুর গায়ে পড়া স্বভাবের ওপর সে চরম বিরক্ত। তা-ও আবার তাজ ভাইয়ের গায়ে পড়েছে মেয়েটা। ভাবা যায়! আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। বিরক্তিতে গা রি-রি করলেও, তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ করছি না। ভেতরে-ভেতরে কেমন এক তিক্ত অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠল। সম্পূর্ণ বিরক্তিটা গিয়ে পড়ল তাজ নামক অসভ্য লোকটার ওপর। সুইডেনে বসে আর কত সুন্দরীদের হাত করেছে কে জানে? দেশে ফিরে সাধু সেজে থাকলেও, বিদেশে নিশ্চয়ই লোকটা নিজেই গায়ে পড়া স্বভাবের অধিকারী ছিল। নইলে এত সুন্দরী মেয়ে পটালো কী করে? এই তো কিছুক্ষণ আগেই জেসিকা আপুর সাথে কেমন দাঁত কেলিয়ে কথা বলছিল। কী মধুর সুরে কথা, হাহ্! ইচ্ছে তো করছে গলা টি’পে মধু বের করে দিই। জেনিফার ভাবি আমাদের সবার হাতে একটা করে কোকাকোলার ক্যান ধরিয়ে দিলেন। এটাই হলো আমার আজকের দিনের সবচেয়ে বড়ো আপদ। ক্যানের ক্লিপ খুলতে গিয়ে পড়লাম চরম বিপত্তিতে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে জোরেশোরে এক টান দিতেই, ক্লিপ খোলার সাথে-সাথে আমার ঠোঁটেরও বারোটা বেজে গেল। নিচের ঠোঁটের একপাশ কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। উপস্থিত কেউই অবশ্য ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। সবাই জেনিফার ভাবির সাথে গল্পে মগ্ন। ব্যথা পেলেও আমি কাউকে টের পেতে দিলাম না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চুপ মে’রে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসিকা আপুও চলে এল। সে আসার পর গল্প আরও একধাপ জমে উঠল। সুইডেনে তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে কাটানো সময় নিয়ে বিভিন্ন গল্প বলতে শুরু করেছে সে। ঠোঁটের ব্যথা ভুলে আমি চরম বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। জেসিকা আপু আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই সে আলগোছে আমার পাশে এসে বসল। কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
“হেই কিউটি, আর ইউ ম্যারিড?”
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে আমি খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“না তো। কেন আপু?”
“ওপস্, সরি। তোমার লিপস দেখে ভেবেছিলাম-”
সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে সরে পড়ল। আমার ঠিক পেছনেই তাজ ভাই বসে ছিলেন। আড়চোখে তাকাতেই উনি ঠোঁট টিপে হাসলেন। বুঝলাম উনি জেসিকা আপুর প্রশ্নটা শুনে ফেলেছেন। তাই আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,
“বুঝলাম না, আপু হঠাৎ এমন প্রশ্ন করল কেন? বিবাহিতদের সাথে ঠোঁটের কী সম্পর্ক?”
তাজ ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো উনি খুব মজা পেয়েছেন আমার প্রশ্নটায়। কেমন ভ্রু বাঁকা করে মুচকি হেসে বললেন,
“বুঝতে চাস?”
আমি ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম।
“বুঝাব?”
“বুঝান।”
“শিওর?”
আমি এবার ভ্রুকুটি করলাম। তাজ ভাই অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“আ’ম পিওর ভার্জিন, ইউ নো? বুঝতে চাইলেও এখন বুঝাব না। অযথা আমার নিষ্পাপ, কিউট ঠোঁট দুটোর ভার্জিনিটি হারাতে চাই না। তারপরও বুঝতে চাইলে জরুরী ভিত্তিতে বিয়ে করে ফেল। অটোমেটিক বুঝে যাবি।”
আমি আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আসল ব্যাপারটা বুঝে উঠতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। হুট করে সেটা মাথায় আসতেই লজ্জায় আমার মাথা কা’টা গেল। হুড়মুড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে দম বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। ভুল করেও দ্বিতীয়বার আর পেছন ফিরে তাকানোর সাহস করলাম না। কী বিশ্রী ব্যাপার! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! জেসিকা আপু হঠাৎ কথাটা তোলায় আসল অর্থটা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। তাজ ভাইয়ের কথা মস্তিষ্কে ঢুকতেই খেয়াল হলো কতটা বোকামি করে ফেলেছি আমি। এখন তো লজ্জায় আমার মাথা তুলতেও অস্বস্তি হচ্ছে। পারলে এক্ষুনি এখান থেকে ছুটে পালাতাম। কিন্তু তারও যে জো নেই। এরইমধ্যে আবার পেছন থেকে বেশ ঠান্ডা কন্ঠ ভেসে এল ,
“যা পারবি না, তা নিয়ে পাকামো না করলে চলত না? না কি অন্য কাউকে বললে খুলে দিত না? বেশি পাকামো করার ফল এমনই হয়, গাধি।”
কথাগুলো আমার কানে ঢুকলেও আমি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া তো দূর, নড়চড়ও করতে পারলাম না। একইভাবে শক্ত হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। লজ্জা বাবাজি আজ ভালোভাবেই জব্দ করেছে। মনের ভেতর তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। রীতিমতো দ্বিধাদ্বন্দ্বের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এমন অযাচিত ঘটনার পর আমি এই লোকটার সামনে দাঁড়াব কী করে? তার দিকে তাকাব কী করে? চোখে চোখ পড়লেই তো লজ্জায় ম’রে যাব। ওনার সাথে কথা তো বাদই দিলাম, মুখোমুখি হওয়া নিয়েই তো আমি বিপদে পড়ে গেলাম। শেষমেষ কি না তাজ ভাইয়ের সামনেই এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হলো! এবার আমার কী হবে? এই পাজি লোকটা যদি এই নিয়ে সারাক্ষণ মজা নেয়, তখন? এত-এত লজ্জা আমি কোথায় রাখব? ইয়া মাবুদ, অদৃশ্য একটা সুরঙ্গের খুব বেশি প্রয়োজন বোধ করছি। প্লিজ হেল্প মি। হায়! আমার অসহায় মনের আকুতি কেউ শুনল না। বাড়ি ফেরার সময় তাজ ভাই আগেভাগেই হুকুম জারি করলেন, অলিকে নিয়ে যেন আমি সামনে বসি। আমিরা আপুর ড্যাবড্যাব চাহনি তার বিরক্তির কারণ হয়। যার ফলে ড্রাইভিং করতেও সমস্যা হয়। কিন্তু আমি সে কথা শুনেও শুনলাম না। মোটকথা মাথা তুলেও তাকালাম না। ত্যাড়ামি তো আছেই, সাথে নিজের লজ্জা লুকাতে আগেভাগে গাড়িতে উঠে সেই পেছনের সিটেই বসে পড়লাম। ফলস্বরূপ আমিরা আপু পুনরায় তাজ ভাইয়ের পাশে বসার সুবর্ণ সুযোগটা পেয়ে গেল। পুরো জার্নিতে ভুল করে মাত্র একবার ফ্রন্ট মিররে চোখ চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে এক জোড়া রক্তলাল চোখ আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিলো। নিমেষেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলেও, ক্ষণিকের ওই চাহনি বুকের ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। মস্তিষ্ক সতর্ক বার্তা পাঠাল, “সাবধান ইলোনি, ভুল করেও আর ওই রা’ক্ষসের সামনে পড়ো না। পড়লেই তুমি শেষ।’

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
মেয়েদের কাছে লজ্জা এক ভয়ানক শব্দ। তারা লাজুকতা। অল্পতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু তা কা’টিয়ে উঠতে দ্বিগুণ সময় নেয়। এজন্যই বোধ হয় এই লাজুকলতাদের কেবল স্ত্রী বাচক শব্দই আবিষ্কার হয়েছিল। লজ্জাবতী। গত দুদিন ধরে লাজুকতা আমায় এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে যে, কোনোভাবেই সেই প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। কবে হবে তা-ও জানি না। শুধু জানি ভুল করেও ওই নির্লজ্জ মানুষটার মুখোমুখি হওয়া যাবে না, একদমই না। সেদিনের সেই কথাগুলো মনে পড়লেই লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে হয় আমার। এ কারণেই গত দুদিন ধরে ইচ্ছে করেই তাজ ভাইয়ের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থেকেছি। ভুল করে সামনে পড়ে গেলেও এড়িয়ে গেছি। উনি বাসায় ফেরার আগেই রাতের খাবার খেয়ে রুমের দরজা লাগিয়েছি। সকালেও ওনার আগে খাবার খেয়ে নিয়েছি। বরাবরের মতো অর্ধেক পড়া উপন্যাসের বই গায়েব হবার পরও তা খুঁজতে ওনার রুমে যাইনি। এড়িয়ে চলার এত পন্থা অবলম্বন করার পরও শেষ রক্ষা হলো না। হুট করে আজ জুম্মান ভাইয়া জানালেন উনি আজ ভার্সিটি যাবেন না। তার না কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ আছে। অথচ তখন আমি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছি। আম্মি বলল আজ তাজ ভাই আমাকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে সে তাজ ভাইকে বলেও রেখেছে। কথাটা শুনেই আমি ঢোক গিলে না, না করে উঠলাম। বললাম,
“জুম্মান ভাইয়া না যেতে পারলে আজ আমিও যাব না। একদিন কামাই করলে কোনো ক্ষতি হবে না। তার চেয়ে বরং আজ বাড়িতেই থাকি।”
কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। তাজ ভাই রুম থেকে বেরিয়ে আমার কথাটা শুনে ফেললেন। ফলস্বরূপ ভাগ্যে জুটল এক রামধমক। অসহায় মুখে আম্মির দিকে তাকিয়েও রক্ষা মিলল না। বাধ্য হয়ে আমি তাজ ভাইকে পেছনে ফেলে আগেভাগেই নিচে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। উনি এলেন তার মিনিট পাঁচেক পর। কিন্তু ওনাকে ড্রাইভিং সিটে না বসে ঘুরে এসে আমার সিটের পাশের দরজা খুলতে দেখে অবাক হলাম। আমার অবাক মুখশ্রী তোয়াক্কা না করে উনি চোখের পলকে আমার হাতের বাহু ধরে একপ্রকার টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনলেন। হকচকিয়ে উঠে ‘কী হয়েছে’ উচ্চারণ করতে-করতেই আবার পেছনের দরজা খুলে আমাকে ঠেলে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব আমি পূর্বের সকল লজ্জা ভুলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বিস্মিত কন্ঠে শুধালাম,
“এটা কী হলো?”
“পেছনের সিট খুব পছন্দ না তোর? পছন্দের সিটেই বোস, সমস্যা কী?”
সোজাসাপ্টা উত্তর। লোকটার মুখে কিঞ্চিত রাগের আভাসও নেই। একদম স্বাভাবিক মুখোভাব। তবে এমন রূঢ় আচরণের মানে কী? আশ্চর্য! ওনার উত্তর শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না সেদিনের রাগের শোধ আজ এভাবে তুললেন। দুদিন ধরে রাগ পুষে রেখেছেন নিশ্চয়ই। আমার বিস্ময়ের মাঝেই উনি গিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করেছেন। আমি আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। এত সহজ পদ্ধতিতে রাগের শোধ তুলে অবশ্য আমার নিজেরই সুবিধা করে দিয়েছে। ওনার পাশে বসে ভার্সিটি অবধি যাওয়ার আগেই হয়তো আমি পূর্বের লজ্জায় ম’রে যেতাম। রাগকুমার নিজের অজান্তেই আমার উপকার করল। আহারে! গাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতার ছড়াছড়ি। উনি চুপচাপ ড্রাইভিং করছেন। এদিকে আমি পেছনে বসে ওনার বোকামির কথা ভেবে আপন মনেই হাসছিলাম। অতিশয় বুদ্ধিমান ডিটেকটিভ সাহেবও তবে এত সামান্য বিষয়ে বোকামি করে! ইশ্! আমার খুশির স্থায়িত্ব খুব বেশি হলো না। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে হুট করেই গাড়িটা থেমে গেল। উনি ভরাট গলায় বললেন,
“সামনে আয়।”
আমি চুপসানো বেলুনের মতো মুখ করে প্রশ্ন করলাম,
“কেন?”
“খুশির মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গেছে দেখলাম। সামনে এসে ভাগাভাগি করে নে। আমিও একটু ভাগ নিই। জলদি আয়।”
বাঁদরটা নিশ্চয়ই লুকিং মিররে আমার হাসিটা দেখে ফেলেছে। তা-ও সহ্য হয়নি। ঠিকই ব্যাঘাত ঘটিয়ে বসেছে।
“একবার পেছনে, আরেকবার সামনে, কী শুরু করলেন? বসলেই হয় এক জায়গায়। আমি পেছনেই ঠিক আছি। চলুন আপনি।”
ঈষৎ বিরক্তিতে আপত্তি জানালাম আমি। সঙ্গে-সঙ্গেই সেই অতি পরিচিত ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হলো। কাঠ-কাঠ গলায় ছুঁড়ে মা’রা হলো এক বাক্য।
“এক্ষুনি সামনে এসে বোস, নইলে এখানেই ফেলে রেখে চলে যাব। তারপর মাঝ রাস্তা থেকে কিডন্যাপ হলে তার দায়ভার আমার না।”
চোয়াল শক্ত করে পেছনের সিট থেকে নেমে, ধুপধাপ পা ফেলে পুনরায় গিয়ে সামনের সিটে ধপ করে উঠে বসলাম। চোয়াল শক্ত করে ওনাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বিড়বিড় করলাম,
“সুযোগ বুঝে বাঁশ সব আমাকেই দেয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার, হুঁহ্। এর চেয়ে বাসে ঝুলে একা যাওয়াও হাজার গুণ ভালো ছিল।”
“হ্যাঁ, খুবই ভালো ছিল। যে কোকাকোলার ক্যান খুলতে গিয়ে সামান্য ঠোঁট সামলাতে পারে না, সে আস্ত নিজেকে সামলাবে! হাস্যকর!”
ওনার ঠাট্টার ছলে কটাক্ষ শুনে মেজাজ তিরিক্ষি হলেও, তা মুহূর্তেই লজ্জার নিচে পি’ষ্ট হয়ে গেল। অসভ্য লোকটা আবার সেই কথা মনে করিয়ে ইচ্ছে করে আমাকে লজ্জায় ফেলল। ওই কথা কর্নগোচর হওয়ার পর সেই যে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম, ভার্সিটি গেইটের সামনে গাড়ি থামার পরও আর দৃষ্টি ফেরালাম না। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমেই কোনোদিকে না তাকিয়ে পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। দুটো চোখ এই যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে, না কি দৃষ্টি ফিরিয়ে চলে গেছে তা দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগল। কিন্তু সব ইচ্ছেকে যে আশকারা দিতে নেই। তাই না চাইতেও ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিতে হলো।
ভার্সিটি শেষে আমাকে নিতে এলেন জুম্মান ভাইয়া। ওনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ। ফেরার পথে আমি জানতে চাইলাম কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলেন উনি, যা দুপুরের আগেই শেষ হয়ে গেল। জুম্মান ভাইয়া কোনোরূপ ইতিউতি করলেন না। সত্যি বললেন।
“রাজ ভাই আসার পর ওনার সাথে জুয়েলারি শপে গিয়েছিলাম, ভাবির জন্য আংটি কিনতে।”
রাজ ভাইকে সাথে নিয়ে আজ বড়োরা গিয়ে জেনিফার ভাবিকে আংটি পরিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলে আসবে। কিন্তু আমার জানামতে রাজ ভাইয়ের সাথে আংটি কিনতে যাওয়ার কথা ছিল তাজ ভাইয়ের। কারণ রাজ ভাই নিজেই তাজ ভাইকে বলেছিলেন, ওনার পছন্দ খুব একটা ভালো না। তাজ ভাইয়ের পছন্দ ভালো, বিধায় ওনাকেই সাথে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ কথা আমি গতকাল রাতেই আম্মির মুখে শুনেছিলাম। তাহলে ওনার বদলে জুম্মান ভাইয়া গেল কেন? প্রশ্নটা মুখে প্রকাশ করতেই তারও উত্তর মিলে গেল। জুম্মান ভাইয়া বললেন,
“বড়ো ভাইয়েরা হয় ধান্দাবাজ, বুঝছিস? ছোটো পেয়ে আমাদের খাটিয়ে নিজেদের কাজ উসুল করে নেয়। রাজ ভাইয়ের সাথে জুয়েলারি শপে যাওয়ার কথা ছিল তাজ ভাইয়ের। অথচ সে নিজের কাজের বাহানায় আমাকে রাজ ভাইয়ের সাথে লাগিয়ে দিয়ে নিজে কে’টে পড়েছে। মাঝখান থেকে আমার ক্লাস মিস গেল। অথচ আবার সেই ভার্সিটিতে আসতেই হলো তোকে নিতে। দৌড়ানিগুলো সবই আমার ওপর পড়ল। না জানি রাজ ভাইয়ের বিয়েতে আমাকে কত খাটিয়ে মা’রে! কেন যে ছোটো হলাম!”
জুম্মান ভাইয়ার আতঙ্কিত বদন দেখে আমি বেশ মজা পেলাম। শব্দ করে বিস্তর হাসলাম। জুম্মান ভাইয়া প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ হাস, হাস। তোদেরই তো দিন। সবকটা রানি সেজে ঘুরে বেড়াবি, প্রজাগিরি তো করতে হবে আমাদের। আহারে জীবন! আহারে! কেউ দুঃখ বোঝে না। এই দুঃখের সঙ্গী বানাতে হলেও জরুরী ভিত্তিতে একটা বউ দরকার।”
“চাপ কিসের? বিয়েতে রাজ ভাইয়ের সুন্দরী শ্যালিকাদের মধ্যে একটাকে বেছে একই মজলিসে নিজের শুভ কাজটাও সম্পন্ন করে ফেলবেন। খরচ কম, লাভ বেশি।”
জুম্মান ভাইয়ার পুরোনো ক্ষ’ত যেন তাজা হয়ে উঠল। আফসোস করে বললেন,
“ধুর! রাজ ভাইয়ের আপন শ্যালিকাটাই তো সেরা। অথচ আমার দিকে একটু অ্যাটেনশন দিলো না। উলটো তাজ ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়ল।”
গত দুই দিনে জুম্মান ভাইয়ার মুখে এই এক বাক্য হাজারবার শোনা হয়ে গেছে। জেসিকা আপু তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়নি বলে ও বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর হতে আহাজারি শুরু হয়েছিল। আহাজারি শুনতে-শুনতে আমাদের কানে তালা লাগার জোগাড়। এদিকে আমরা যখনই বলি জেসিকা আপু তার সিনিয়র, তখনই আরও শক্ত গলায় বলে, ‘চেষ্টা করতে দোষ কী? সিনিয়র আপুর সাথে প্রেম দ্বিগুণ মিষ্টি হয়।’ বিকেলের দিকে রাজ ভাইসহ বড়োরা গেল জেনিফার ভাবিদের বাসায়। এবার আমাদের ছোটোদের গ্যাং পুরোটাই ফেলে রেখে গেল। কারো অনুরোধ ধোপে টেকেনি। উলটো ধানি লঙ্কা অলি বুড়িকেও আমাদের কাছে আমানত রেখে গেছে। অবহেলিত হবার দুঃখে সবাই যার-যার মতো দুঃখ বিলাস করছে। সৌরভ ভাইয়া নিজের কুখ্যাত স্বভাব বজায় রেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় উপুড় হয়ে পড়ে ফোনে ডুবে ম’রছেন। জুম্মান ভাইয়ার হদিস নেই। হয়তো বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুর-ঘুর করছেন। আমিরা আপু পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছে। আর মিনহা আপু তার রুমের মেঝেতে এক গাদা নোটস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তার মাঝে অসহায়ের মতো বসে আছে। কারণ সামনে তার পরীক্ষা। ভাইয়ের বিয়ে আর নিজের পরীক্ষা, দুইয়ের চিন্তায় এখনই তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। বিয়ের প্ল্যানিং করতে বসলে পরীক্ষার চিন্তায় পাগলপ্রায়, আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বসলে বিয়ের চিন্তায় পাগলপ্রায়। এই পাগলদের ভীড়ে আমি আর অলি পড়ে গেলাম একাকীত্বে। তা-ও অলি একটু পরপর টিভি দেখছে, সৌরভ ভাইয়ার পিঠের ওপর চড়ে বসে তাকে নানাভাবে বিরক্ত করছে, আবার এসে যত ঘ্যান-ঘ্যান সব আমার কানে ঢালছে। ওর ঘ্যান-ঘ্যান রীতিমতো আমাকে বিরক্ত করে তুলেছে। বিরক্তিতে যৎসামান্য স্বস্তি মিলল তাজ ভাইয়ের আগমনে। উনি আসামাত্রই অলি ওনার রুমে ছুটেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি নিশ্চিন্তে বসে একটু অনলাইনে ঢুঁ মা’রতেই আবার অলি এসে উপস্থিত হলো। এবার আমার হাত আর ওড়না টানতে-টানতে চেঁচানো গলায় তাড়া দিলো,
“ইলোপু, ছাদে নিয়ে চলো। মেজো ভাইয়া ছাদে গেছে। আমিও যাব। তাড়াতাড়ি চলো।”
“তোমার মেজো ভাইয়ার সাথে গেলে না কেন?”
“মেজো ভাইয়া ফোনে কথা বলতে-বলতে আমাকে রেখে চলে গেছে। মনে হয় ভুলে গেছে,” ঠোঁট ফুলিয়ে থেমে-থেমে বলল অলি।
এই মেয়েকে নাকচ করলে যে কেঁদেকেটে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট মাথায় তুলবে, তাতে বিন্দুমাত্র অনিশ্চয়তা নেই। এই মুহূর্তে ছাদে যাওয়ার ন্যূনতম ইচ্ছে আমার নেই। তাই কায়দা করে বুঝাতে চাইলাম।
“সৌরভ ভাইয়াকে দিয়ে আসতে বলো, অলি বুড়ি। ভাইয়া দিয়ে আসবে। ইলোপুর পা ব্যথা করছে।”
অলি গোল-গোল চোখে একবার আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“লিফটে গেলে পা ব্যথা হয় না। সৌরভ আলী ডিমের হালি পচা। কথা শোনে না। চলো নাআআআ।”
কোনোভাবেই অলিকে বুঝানো গেল না। সে কিছুতেই সৌরভ ভাইয়ার সাথে যাবে না। ঘাড়ত্যাড়া বংশের মেয়ে যে! শেষে বাধ্য হয়ে অলিকে নিয়ে ছাদে চললাম।‌ ভেবেছিলাম অলিকে পৌঁছে দিয়েই আমি ফিরে যাব। কিন্তু ছাদে পা রেখে এক দৃশ্য দেখামাত্রই ফিরে যাওয়ার কথা মাথা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গেল। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত তাজ মশাই। অথচ তার কয়েক হাত দূরেই এক নির্লজ্জ মেয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। কে জানে? হয়তো খেয়াল করেও ঢং করে ফোনে ডুবে থাকার নাটক করছে। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী। পরনে একটা শার্ট আর ট্রাউজার। কাঁধের নিচ অবধি খোলা চুলগুলো ছড়ানো। চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে অচেনা, অজানা এক পুরুষকে। হুট করেই আমার মেজাজ অত্যধিক খারাপ হয়ে গেল। ছাদে এসে এত সুন্দর গোধূলি বেলার প্রতি মুগ্ধ হতেও ভুলে গেলাম। প্রকৃতির প্রতি নজর না দিয়ে সম্মুখের মানব দুটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর নিক্ষেপ করলাম। অলি ততক্ষণে তাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে অদূরে যে তিনটা বাচ্চা খেলা করছে, ওদের কাছে চলে গেল। আমি দ্রুত পা চালিয়ে গিয়ে তাজ ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটা হয়তো আমার এহেন কান্ডে অনেকটাই বিরক্ত হলো। তবু দমে না গিয়ে ঘাড় কাত করে তাজ ভাইকে দেখতে লাগল। তাজ ভাই ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আড়চোখে ওপাশের মেয়েটার দিকেও একবার তাকালেন। তারপর ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দুহাত রেলিংয়ে ঠেকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
“আয়নায় চেহারা দেখে এসেছিস? পেত্নীর মতো লাগছে। ভাগ্যিস ছাদে অন্য কোনো ছেলে নেই। থাকলে নির্ঘাত ভয়ে বেহুঁশ হত, কিংবা দৌড়ে পালাতে গিয়ে উ’ষ্ঠা খেয়ে পড়ত।”
আমি আড়চোখে ওপাশের মেয়েটার হাবভাব লক্ষ্য করছিলাম। উনি ঝুঁকে দাঁড়ানোর দরুন মেয়েটা পুনরায় নির্দ্বিধায় চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। চরম বিরক্তি নিয়ে আমি উত্তর দিলাম,
“শহুরে মেয়েদের মতো ওভার স্মার্ট হয়ে কারো নজর কাড়ার সাধ নেই আমার। কার কাছে পেত্নী, কার কাছে পরী এসব নিয়েও মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো ফা’লতু কাজটা অন্তত আমাকে দিয়ে হয় না।”
উনি হয়তো আমার টিপ্পনীপূর্ণ কথাটার উদ্দেশ্য ধরতে পারলেন। কেমন ভ্রু বাঁকিয়ে একবার আমার দিকে, আরেকবার ওপাশের মেয়েটার দিকে তাকালেন। ঠোঁট কামড়ে হেসে আমার মাথায় মৃদু চাটি মে’রে বললেন,
“গাধা প্রকৃতির মেয়েদের কোনো প্রতিভাই থাকে না। তুই তাদের মধ্যে অন্যতম। দেখা যাবে বিয়ের পর তোর কপালপোড়া জামাই বাসর ঘরে বসেও দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে জীবন বরবাদ করে দিবে। আর যাই হোক, চুমু খেতে গিয়ে ঠোঁট কা’টার রহস্য না বোঝা বউকে নিয়ে তো আর বেচারা আজীবন পার করতে পারবে না। প্রথম ধাপেই বউয়ের গাধামি দেখে হয়তো সেঞ্চুরি মা’রার আগ্রহ হারিয়ে বসে থাকবে। আহারে! অগ্রীম সমবেদনা বেচারার গাধা মার্কা সোহাগ রাতের জন্য।”
লজ্জায় আমার কান ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল। মনে হচ্ছে কান দিয়ে উত্তপ্ত ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ কুঁচকে ঢোক গিললাম। এতটা নির্লজ্জ স্বভাব বোধ হয় একমাত্র এই মানুষটাকে দিয়েই আশা করা যায়। নির্দ্বিধায় ফটাফট কী বা’জে কথা আওড়াল! ভাগ্যিস ওই মেয়েটা দূরে দাঁড়ানো। নয়তো এতক্ষণ ধরে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার তার সুদর্শন পুরুষের মুখে এই কথা শোনার পর, বেচারি হয়তো নিজের মুগ্ধতাকে বলি দিতে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ত। আমি নিজেই যে মুখ লুকানোর জায়গার অভাবে ভুগছি। পূর্বের আর এখনকার, উভয় লজ্জার সংমিশ্রণে এই নির্লজ্জ ব্যক্তির সামনে টিকে থাকা আর সম্ভবপর হলো না। বিধায় এই মুহূর্তে মানে-মানে কে’টে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ভাবতে-ভাবতেই চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা ক্ষুনাক্ষরেও টের পাইনি। আমার চমকিত মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,
“সরি, সরি। ভয় পেলে?”
আমি ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে বললাম,
“না, ঠিক আছি।”
“আমি এসে দাঁড়ানোমাত্র তুমি ঘুরে দাঁড়িয়েছ তো, সেজন্যই হয়তো চমকে উঠেছ। যাইহোক, তোমরা কয় তলায় থাকো?”
“সাত তলায়।”
“আমি পাঁচ তলায় থাকি। এখানে নতুন এসেছি। তোমরা কবে থেকে থাকছো?”
“এক বছর।”
“ওহ্! উনি কি তোমার ভাই?” তাজ ভাইকে ইশারায় দেখিয়ে প্রশ্ন করল মেয়েটি।
আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম। উনিও তখন ফিরে তাকিয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, হয়তো উত্তর শোনার অপেক্ষা। এ পর্যায়ে এসে হঠাৎ আমার মনে এক পৈশাচিক আনন্দ জাগল। মিষ্টি হেসে আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
“হ্যাঁ, আপনি একা এসেছেন?”
মেয়েটার হাসি এবার আরও দীর্ঘ হলো। আমার ভাইয়ের প্রতি নিশ্চিত একটা চান্স পাবে ভেবে হয়তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। মিষ্টি হাসি মুখে ঝুলিয়ে বাচ্চাদের দিকে আঙুল তাক করে একজনকে দেখিয়ে বলল,
“ওই তো আমার বোন। খেলতে নিয়ে এসেছি ওকে। তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”
“অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। আপনি?”
“ফাইনাল ইয়ার। আর ভাইয়া কী করেন?”
তাজ ভাইকে প্রশ্ন করতেই উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। বললেন,
“কোনোরকমে নাম লেখা শিখেছিলাম।”
মেয়েটা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
“ধুর! মজা করছেন আপনি।”
আমি বললাম,
“ডিটেকটিভ।”
মেয়েটা বোধ হয় এবার আরও বেশি গলে গেল। চোখ বড়ো করে চমৎকৃত হয়ে বলল,
“ওয়াও! বিশাল ব্যাপার। তোমার ভাইয়াকে নিয়ে আমাদের বাসায় যাবে একদিন। এখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই তো। আম্মু খুব খুশি হবে।”
আমি হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম,
“যাব, আপনারাও যাবেন আমাদের বাসায়।”
“অবশ্যই যাব। কিন্তু তোমার ভাইয়া তো তেমন কথাই বলছে না।”
তাজ ভাই এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। অলিকে একবার কাছে ডেকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,
“মিস, সম্পর্কের জগাখিচুড়ি করবেন না। আপনি কি খেয়াল করেছেন আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির ঠোঁটে কা’টা দাগ?”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। এই মেয়েকে এসব কথা বলছে কেন? ওনার কথা বলার সাথে আমার ঠোঁটের কা’টা দাগের কী সম্পর্ক? আচমকা বাঁ হাতের বাহুতে শক্ত হাতের স্পর্শে হকচকিয়ে উঠলাম। উনি আলতো করে এক হাতে আমাকে আগলে ধরেছেন। আমার হাত-পা জমে গেল। এভাবে কখনও স্পর্শ করেননি যে। ওনার ভাবলেশহীন দৃষ্টি সামনের মেয়েটির দিকে। মৃদু হেসে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললেন,
“আপনাকে দেখে অতটাও বোকা মনে হচ্ছে না। অবিবাহিতা মেয়েদের ঠোঁট কা’টার রহস্য নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না? ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার শুধু একটা বড়ো ভাই আছে। এই ল্যামব্রেইন মেয়েটা আমার আব্বুর বন্ধুর মেয়ে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
আমি রসগোল্লার মতো চোখ করে কিঞ্চিত হা করে ওনার দিকে তাকালাম। বিস্ময়ে কথা বলতেও ভুলে গেলাম। মেয়েটাও চুপ মে’রে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমি মিথ্যে বলেছি ভেবে ভীষণ অবাক হয়েছে বা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু তার দুঃখ দেখার অভিলাষ নেই আমার। লজ্জায়, জড়তায় আমি ওনার কাছ থেকে প্রায় ছিটকে সরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে পা চালালাম। একবারের জন্যও আর পেছন ফিরে তাকালাম না। সোজা ফ্ল্যাটে চলে এলাম। ওনার কথার অর্থ বুঝে যতটা লজ্জা লাগছে, তার চেয়ে বেশি রাগ লাগছে। মেয়েটার থেকে নিজেকে বাঁচাতে এভাবে একটা মিথ্যে ইঙ্গিতে আমার মান-সম্মানের ফালুদা করে দিলো। ছিঃ! কোন কথা ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কোন কথায় নিয়ে গেল! মেয়েটা কী ভাববে আমায়? নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে-মনে হাজারবার নির্লজ্জ ট্যাগ দিয়ে বকে চলেছে। ইয়া খোদা, ওই মেয়ের সাথে এটাই যেন প্রথম এবং শেষ দেখা হয় আমার। দ্বিতীয়বার আবার মুখোমুখি হলে মুখ লুকানোর জায়গা কোথায় পাব আমি? লোকটার এই ঠোঁট কা’টা স্বভাবের জন্য গত দুদিন পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম। আজ যা একটু স্বাভাবিক হয়েছি, তারও মাথা কামিয়ে দিলো। ঘুরেফিরে সেই আগের পরিস্থিতিতেই ফিরিয়ে দিলো। আবার তবে শুরু হবে লুকোচুরি খেলা। আমি যে তার মতো নির্লজ্জ হতে পারি না। ওই মানুষটা নির্লজ্জ বলেই হয়তো সমস্ত লজ্জারা এসে আমার ঝুলিতে মুখ লুকিয়েছে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এই লুকোচুরি খেলা আমার কাছে অতিশয় বিরক্ত লাগে। এক বাসায় থেকে কারো থেকে পালিয়ে বেড়ানো কারই বা ভালো লাগবে? লোকটা আর আমায় শান্তি দিলো না। নিজের এই নির্লজ্জ স্বভাবের কারণে কবে যেন আমার সম্পূর্ণ শান্তির থলেটাই কেড়ে নিবে।
হিমেল কাকারা ফিরে এলেন রাতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে আগামী সপ্তাহে। আজ থেকে ঠিক আট দিন পর। এরমধ্যে আম্মির হাস্যোজ্জ্বল মুখের আরও এক ভয়ানক সংবাদ আমার অর্ধ শান্তির মস্তিষ্কে সুনামি বয়ে আনল। আগামী তিন দিনের মধ্যে আফরা আপু তার পরিবারের সাথে ঢাকায় আসছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।