মনোহারিণী পর্ব-৮+৯

0
256

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
ঢাকা শহরে চব্বিশ ঘন্টা সজাগ রাস্তার মতো মানুষগুলোও বোধ হয় অক্লান্ত। কেমন এক মুহূর্তের জন্যও রাস্তাগুলো ফাঁকা পাওয়া যায় না! মানুষগুলোও যেন যান্ত্রিক। প্রতিটা মুহূর্তে ছুটে চলছে তো চলছেই। পেটের তাগিদ যে বড়ো তাগিদ। তার কাছে বুড়ো থেকে গুঁড়ো, সবাই হেরে যায়। কোলাহলে মুখরিত এই ব্যস্ত শহরে আমার ভালোলাগার মুহূর্ত হচ্ছে মধ্যরাত থেকে রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত। মানুষজনের ছোটাছুটি না থামলেও, এই সময়টাতে কোলাহল থেকে অনেকটা নিস্তার মেলে। জনমানুষের হৈচৈ থাকে না, থাকে শুধু সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলা যানবাহনগুলোর হর্ন। রাস্তা পেরোতে গিয়ে অন্তত অন্যান্য সময়ের মতো জানের দফারফা হয় না। মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই শহরে এটুকু সময়েই আমি একটু শান্তি খুঁজে পাই। অন্য সময় বাইরে বেরোলেই মনে হয় এই নিরন্তর ছুটে চলা জনমানব আর যানবাহনের মতো আমাকেও বুঝি ছুটতে হবে। এই ছুটোছুটির পাল্লায় পড়ে আমার আর বাইরের জগতের শান্তি উপভোগ করা হয়ে ওঠে না। মধ্য রাতের ওই শান্তির সময়টুকুও উপভোগ করার সুযোগ নেই। সময়টাই যে বিশ্রামের। আজ যখন শ্রেয়ান ভাইয়ার অছিলায় ঘুরাঘুরির সুযোগ মিলল, তখন আমার খুব করে ইচ্ছে করল মধ্যরাতে ঘোরাঘুরি করার। কিন্তু হায়! এতগুলো মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সন্ধ্যায় ঘুরাঘুরি করার, তখন আমার একার ইচ্ছে সেখানে ফলাই কী করে? সবাই হয়তো সমর্থনও করবে না। আম্মুর সেই বিখ্যাত ভাষণটি মনে পড়ে গেল। দূরের কোনো জায়গার নাম মুখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা দিত, ‘বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে যাস।’ সুতরাং মধ্যরাতের শহর ঘোরার ইচ্ছেটাও এবার আমি আম্মুর কথামতোই জামাইয়ের আশায় তুলে রাখলাম। বাধ্য মেয়ে আমি, হাহ্। সবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমার এখন ওই যানবাহন আর ব্যস্ত মানুষদের ভীড়ে একদমই নামতে ইচ্ছে করছে না। এখন মনে হচ্ছে শ্রেয়ান ভাইয়ার প্রস্তাবে রাজি হওয়াটাই উচিত হয়নি। মন যেখানে সায় দেয় না, সেখানে গিয়েও কোনো শান্তি নেই। মনের সঙ্গে একধাপ লড়াই করে বেচারা মনটার অবস্থাও যা-তা করে ফেলেছি। এই মহা ঝামেলার মধ্যে আবার সর্বোচ্চ বিরক্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল আমিরা আপু আর মিনহা আপুর সাজগোজ। আমি রেডি হয়ে প্রায় আধঘন্টা যাবত তাদের বাসায় গিয়ে বসে রইলাম। এসে হতেই দেখলাম দুই বোন মেকআপ নিয়ে টানাটানি করছে। ড্রেস নিয়ে কনফিউজড হয়ে তব্দা খেয়ে বসে আছে। জুতা ম্যাচিং করতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচ্ছে। বান্দাদের রেডি হওয়া আর হয়ে উঠছে না। গোবেচারা আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গালে হাত দিয়ে বসে-বসে টানা আধঘন্টা তাদের চুলোচুলি দেখলাম। অতঃপর যখন বিরক্তির সীমা অতিক্রম হলো, তখন উঠে আবার তাজ ভাইদের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। আম্মি আমাকে দেখে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে? মুখ অন্ধকার কেন?”
আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“ভালো লাগছে না।”
“কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
“নাহ্, এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“শ্রেয়ান বলার পর না কি তুমিই যেতে চেয়েছ? তাহলে এখন যেতে ইচ্ছে করছে না কেন?”
“রাস্তায় যেই জ্যাম! বাইরে গেলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
“সবার সাথে ঘুরলে ভালো লাগবে। আমিরা আর মিনহা রেডি হয়নি এখনও?”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এত তাড়াতাড়ি হবে না কি? সবে তো মেকআপ ঘঁষছে।”
আম্মি হাসল। বলল,
“তুমি সাজলে না কেন?”
আমি মুখে বিরক্তি ভাব টেনে বললাম,
“ধুর! আমি কি বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি না কি, যে ঘন্টা লাগিয়ে সাজব? আমার ওসব ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে।”
পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
“সাজ ছাড়াই তুমি কিউট, ইলোমিলো। কিউট মেয়েদের অত সাজা লাগে না।”
পেছন ফিরে শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখে মৃদু হেসে প্রশ্ন করলাম,
“আপনি কখন এলেন, ভাইয়া?”
“কিছুক্ষণ আগে।‌ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমিরাদের রেডি হওয়া হয়নি? তাজ কিন্তু ভীষণ রেগে গেছে। আমার ওপর চেঁচাচ্ছে এখন। আর একটু দেরী হলে বাইরে বেরোনোটাই ভেস্তে দিবে।”
আমি হতাশ গলায় বললাম,
“এত তাড়াতাড়ি তাদের রেডি হওয়া হবে না কি? সবে তো মেকআপ করছে।”
আম্মি বলল,
“আমি গিয়ে ডেকে নিয়ে আসছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বাঁধা দিয়ে বললেন,
“তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না, আন্টি।‌ আমি যাচ্ছি।”
“আচ্ছা যাও।”
শ্রেয়ান ভাইয়া চলে গেলেন আমিরা আপুদের ডাকতে। আমি বিরক্তিতে হাত-পা তুলে সোফায় বসে রইলাম। তাজ ভাইয়ের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়ার ওপর অনবরত চেঁচাচ্ছেন উনি। সঙ্গে আমিরা আপু আর মিনহা আপুর মেকআপের গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করতেও ভোলেননি। ওনার এক কথা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে না বেরোলে আজকের পর আর কোনোদিন এই দল নিয়ে উনি বাইরে বেরোবেন না। জুম্মান ভাইয়া বোনদের সাজের পাল্লায় পড়ে বিরক্ত হয়ে চেঁচামেচি করে নিচে চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। গিয়ে হতে একটু পরপরই ফোন করে রওয়ানা দেওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন। আমি ফোনটাকে কুশনের নিচে চাপা দিয়ে ফেলে রেখে সোফায় মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। ফ্যানের বাতাসে শীতল আরামে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। প্রায় চার মিনিট পর হঠাৎ দুই কানের ওপর কিছুর স্পর্শ পেয়ে ফট করে চোখ খুললাম। চোখ খুলতেই সামনে তাজ ভাইকে নজরে পড়ল। একহাতে কানে ফোন ধরে, আরেকহাতে আমার চোখে চশমা পরিয়ে দিচ্ছেন। আমি হাত তুলে চশমা ধরার আগেই উনি একহাতে চশমাটা ঠেলে ঠিক করে দিলেন। তারপর আর আমার দিকে না তাকিয়ে নিজের ধ্যানে ফোনে কথা বলতে-বলতে পাশের সোফায় বসলেন। রেডি হওয়ার পর চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিলাম। চশমা ছাড়া বাইরে গেলে চোখের বারোটা বাজিয়ে ফিরতে হত আজ। যা ধূলিকণা! কিন্তু আমার চশমা তো রুমে ছিল। হয়তো ড্রয়িংরুমে এসে চোখে চশমা না দেখে নিজেই গিয়ে নিয়ে এসেছেন। বাব্বাহ্! কী যত্ন! আমি কি বলেছি আজাইরা যত্ন দেখাতে? আমাকে বললে নিজেই গিয়ে পরে নিতাম। এখন ভালোমানুষী করে যত্ন দেখাল; অথচ কান থেকে ফোনটা নামিয়েই নিশ্চিত এই নিয়ে দশ লাইনের একটা বয়ান শোনাতেও ভুলবে না। ব’দ লোক! আমি একবার আড়চোখে ওনার আপাদমস্তক পরখ করলাম। নতুন পাঞ্জাবি পরেছে! অফ-হোয়াইট পাঞ্জাবি। গতকাল এনেছিল সেগুলোর মধ্য থেকেই পরেছে বোধ হয়। পাঞ্জাবিটা এই বিলাই মার্কা শরীরে অমনভাবে না মানালে কি হত? সুইডিশ সুন্দরী রেখে এখন আবার বাংলাদেশী সুন্দরী পটানোর ধান্দা। মেয়েবা’জ লোক! মহাশয়কে দেখে যে আজ আমিরা আপু বিস্ময়ে হা করে আর মুখ বন্ধ করতে পারবে না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। আমিরা আপুর মুখে এই লোকের রূপের প্রশংসা শুনেই আজ আমার কানের অকালমৃ’ত্যু হবে। আহারে আমার বেচারা কান! তাজ ভাই কথা শেষ করে কান থেকে ফোন নামাতেই আমি তার বয়ান শোনার অপেক্ষা করলাম। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে উনি আমার চশমা নিয়ে কোনো কথাই তুললেন না। উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে উঁচু গলায় আম্মিকে ডাকলেন। তৎক্ষণাৎ আম্মি ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো। তাজ ভাই বললেন,
“আসছি।”
আম্মি সাবধানী সুরে বলল,
“আচ্ছা যা। ইলোকে দেখে রাখিস। ও কিন্তু একা রাস্তা পেরোতে পারে না।”
তাজ ভাই ত্যাড়াভাবে বললেন,
“আমাকে কি কোনোভাবে ওর বডিগার্ড মনে হয়? না কি নিয়োগ দিতে চাইছো? ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ারের অত আজাইরা সময় নেই, বডিগার্ড চাইলে বিজ্ঞাপন দিতে পারো।”
“ফাজলামি রাখ। বের হ তাড়াতাড়ি, বেশি রাত যেন না হয়।”
তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ‘চল’ বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আমিও আম্মিকে বলে ওনার পেছন-পেছন বেরোলাম। লিফটের সামনেই দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া, আমিরা আপু আর মিনহা আপু দাঁড়িয়ে আছে। দুই বোনের ঝাকানাকা সাজ দেখে রীতিমতো আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে জুম্মান ভাইয়ার সাথে সৌরভ ভাইয়াকেও দেখা গেল। তাকে দেখে আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম। তাজ ভাই সৌরভ ভাইয়ার পেটে হালকা করে ঘু’ষি মে’রে বললেন,
“কিরে ব্যাটা? মুখ্যম সময়ে কেমনে টপকালি?”
সৌরভ ভাইয়া হেসে বললেন,
“জুম্মান ভাইয়া ফোন করে আসতে বলল। সবাই না কি ঘুরতে বের হচ্ছে, আমি কেন বাদ যাব? সুযোগটা লুফে নিলাম।”
তাজ ভাই জুম্মান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুই ওকে ফোন করে হল থেকে ডেকে এনেছিস? এক কাজ কর, বড়ো একটা মাইক নিয়ে পুরো শহর অ্যানাউন্স করে দে।”
জুম্মান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আরে ভাই, আমরা আমরাই তো।”
সিদ্ধান্ত হলো গাড়ি নেওয়া হবে না। পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে। সিদ্ধান্ত মতোই আমরা নেমে পড়লাম রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে চেনা কোলাহলে আমার মাথাটা দপ-দপ করতে লাগল। আবার বিরক্ত লাগছে। তাজ ভাই আমার পাশাপাশি হাঁটছেন। আমিরা আপু ওনার পাশাপাশি হাঁটতে চেয়েও পারছেন না। এই জনমানুষের ভীড়ে তো আর সারিবদ্ধভাবে হাঁটা যায় না। তবে সুযোগ বুঝে আমিরা আপু আমার কানের কাছে তাজ ভাইয়ের রূপের প্রশংসা করতেও ভুলছে না। সাথে আছে মিনহা আপুর মুখে শ্রেয়ান ভাইয়ার প্রশংসা। দুই বোন একটু পরপরই কানের কাছে এসে মাছির মতো ভনভন করছে। উচ্ছাসে যেন ফেটে পড়ছে। আমি বিরক্তি বোধ করলেও মিনহা আপু আমার সাথে আগের মতো মনখুলে কথা বলায় অনেকটা হালকা বোধ করলাম। পরিচিত মানুষগুলো কথা বন্ধ করে দেওয়ার অনুভূতিগুলো আমার কাছে খুবই তিক্ত মনে হয়। শ্রেয়ান ভাইয়া ফুচকার দোকানের সামনে এসে জানালেন ওনার পক্ষ থেকে সবাইকে ফুচকা খাওয়ানো হবে। এক্ষেত্রে যে যত প্লেট ইচ্ছে খেতে পারবে। কোনো বাঁধা নেই। এ কথা শুনে সবাই আনন্দে হৈ-হৈ করে উঠলেও মাঝখান থেকে বেঁকে বসলেন ঘাড়ত্যাড়া সাহেব। শ্রেয়ান ভাইয়াকে ধমকে উঠে বললেন,
“স্ট্রিট ফুড গলা অবধি খাইয়ে পেট খারাপ করানোর ধান্দা নিয়ে এসেছিস? সব কটাকে খালি মুখে বাসায় রিটার্ন পাঠাব।”
এই নিয়ে তাজ ভাইয়ের সাথে শ্রেয়ান ভাইয়ার একদফা তর্কযু’দ্ধ হলো। আমরা অসহায় মুখে দুই বন্ধুর যু’দ্ধ উপভোগ করলাম। শেষমেষ সবার জন্য এক প্লেট করে ফুচকা অর্ডার করা হলো। তা-ও আবার কড়া ঝাল দিয়ে। তাজ ভাই ঝাল খেতে পারেন না বলে উনি ওনারটাতে ঝাল দিতে বারণ করলেন। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। পরক্ষণেই লোকটা আমার প্লেটে কম ঝাল দিতে বলে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে আমি বললাম,
“আমি ঝাল খেতে পারি।”
আমিরা আপুও আমার সাথে তাল মিলাল। লাভ বিশেষ হলো না। উনি কটাক্ষ করে বললেন,
“তোর ওই হালকা ঝাল আর কড়া ঝাল এক না, পিচ্চি। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কড়া ঝাল খেয়ে রাস্তায় নেমে লাফালাফি করে মানসম্মান বাসের তলায় পি’ষ্ট করতে চাস? যেমন বলছি তেমন না খেলে বাড়ি গিয়ে ভাত খা, যা ভাগ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া এ পর্যায়ে এসে আর আমার পক্ষে কথা বললেন না। তাজ ভাইকে সমর্থন করে আমাকে বললেন,
“থাক ইলোমিলো। কড়া ঝাল যখন খেতে পারো না, তখন সবার সাথে পাল্লা দিয়ে এত ঝাল খেয়ো না। নিজেরই ক্ষতি হবে। হালকাই খাও।”
আমি গাল ফুলালাম। ঘুরতে এসেও শান্তি নেই। অবশ্য শান্তি প্রথম থেকেই পাইনি। এই বেত্ত’মিজের সাথে বাইরে এসে শান্তির আশা করা, আর ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় গ্রামের মেঠো পথের শান্তি অনুভবের আশা করা একই ব্যাপার। দুটোই অসম্ভব। বাধ্য হয়েই আমি ওনাদের কথাই মেনে নিলাম। ফুচকা খাওয়ার সময় আমিরা আপু হঠাৎ আমার আর মিনহা আপুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এই দেখ, দেখ। তাজ ভাই বাড়তি ঝাল না নিয়েও মসলার সামান্য ঝালও খেতে পারছেন না। দুটো খেয়েই ঠোঁট কেমন লাল হয়ে গেছে। উফ্! কী লাগছে রে ভাই! আমার তো এখন উলটা-পালটা ভাবনা মাথায় আসছে।”
আমি আর মিনহা আপু চোখ দুটো ছানাবড়া করে আমিরা আপুর দিকে তাকালাম। তার মুখে লাজুক হাসি। আমি আহাম্মকের মতো একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সত্যি সত্যিই উনি দুটো ফুচকা খেয়ে এখন প্লেট হাতে নিয়ে ঝাল কমার অপেক্ষা করছেন। আমার হাসি পেলেও এই মুহূর্তে আমিরা আপুর কথা শুনে হাসতে পারলাম না। মিনহা আপু শ্লেষের সুরে বলেই বসল,
“ছিহ্! কী অশ্লী’ল চিন্তা-ভাবনা তোর! নজর সংযত রাখ আপু। দেখ, আমি কত ভদ্র মেয়ে। শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে কি আমি এমন অশ্লী’ল চিন্তা-ভাবনা করেছি? এই তুই তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকা।”
আমি এই অতি সাধু দুই বোনের পাশ থেকে আলগোছে কে’টে পড়লাম। সৌরভ ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি ফুচকা চিবোতে-চিবোতে নিচু স্বরে বললেন,
“কী আপু? ওই দুই পিশা’চিনী শান্তি দিচ্ছে না? তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়াকে যেভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে, কখন যেন ফুচকা গলায় আটকে রাস্তায় গড়াগড়ি খায়।”
আমি মুখ টিপে হাসলাম। বললাম,
“এভাবে বলছেন কেন, ভাইয়া? আপনারই তো হবু ভাবি।”
জবাবে সৌরভ ভাইয়া এমনভাবে মুখ লটকালেন যে, আমি ফিক করে শব্দ তুলে হেসে উঠলাম। সবাই খুব মজা করে ফুচকা সাবার করলেও, তাজ ভাই পারলেন না। টেনেটুনে তিনটা খেয়েই দমে গেলেন। ফুচকার দোকান থেকে বেরিয়ে আবারও চলল পথ চলা। আমিরা আপু আর মিনহা আপু মাঝে-মাঝে সেলফি তুলছে, আবার সৌরভ ভাইয়াকে ফটোগ্রাফার বানিয়ে দিচ্ছে। সৌরভ ভাইয়া এতে দারুণ বিরক্ত। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের সবার হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিলেন। ঘোরাঘুরি চলল বেশ। সবার সাথে গল্প করতে-করতে আমার বিরক্তি ভাবটা কখন উবে গেছে টেরই পাইনি। এরমধ্যে তাজ ভাইয়ের একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। বাসা থেকে বেরোনোর সময় আম্মির কথায় ত্যাড়ামি করলেও, প্রত্যেকবার রাস্তা পেরোনোর সময় ঠিকই স্ব-ইচ্ছায় আমার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে অতি সাবধানে রাস্তা পার করে দিয়ে, আবার আলগোছে ছেড়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত লোক! ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে ডিনারের উদ্দেশ্যে সবাই ঢুকে পড়লাম রেস্ট্রন্টে। যে যার মতো খাবার অর্ডার দিয়ে সবাই মিলে আকস্মিক চেপে ধরল তাজ ভাইকে। সবার দাবি, আজকের সম্পূর্ণ বিল তাজ ভাইকে দিতে হবে। এক কথায় তার থেকে ট্রিট আদায় করার ধান্দা। উনি নতুন ডিটেকটিভ হয়েছেন, অথচ ট্রিট দেননি; এ অবিচার কেউ মানতে নারাজ। তাজ ভাই বেঁকে বসে বললেন,
“কোন হিসেবে তোরা ট্রিট পাবি? টাকা খরচ করে পাড়ালো আমার বাপ, প্রত্যেক ধাপে টাকা খরচ করল আমার বাপ, আর ট্রিট নিবি তোরা! ফাজলামি পাইছোস? আমার বাপ এই পর্যন্ত আমার পেছনে যত টাকা খরচ করছে, তা সব কড়ায়-গন্ডায় হিসাব করে আগে তাকে ফেরত দে, তারপর ট্রিটের আশা করিস। শুধু ট্রিট না, পুরো রেস্ট্রন্টটাই তোদের জন্য ফ্রি করে দেবো, প্রমিস। রাজি হলে এক চাপ, না হলে রাস্তা মাপ।”
জুম্মান ভাইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“এটা কোনো কথা বললেন, তাজ ভাই? আপনি ডিটেকটিভ হয়ে আমাদের গোষ্ঠীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, আর ছোটো-খাটো একটা সেলিব্রেশন করে ট্রিটটুকু দিবেন না? এ-ও মানা যায়?”
“গোষ্ঠীর মুখ উজ্জ্বল করার মতো মহান কাজ করার বিনিময়ে তোদের সবার উচিত আমাকে আলাদা করে স্পেশাল ট্রিট দেওয়া। বাট’পারের দল।”
মিনহা আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“এমন করেন কেন, তাজ ভাই? আপনি কত বছর পর দেশে ফিরেছেন, অথচ ছোটো ভাই-বোনদের একটু আদর করে খাওয়াবেন না?”
উনি সকৌতুকে বললেন,
“ছোটো ভাই-বোনদের রেস্ট্রন্টে খাওয়াব কেন? তাদের তো কোলে তুলে ফিডার খাওয়াব। তুই খাবি?”
মিনহা আপু লজ্জা পেয়ে চুপ মে’রে গেল। পাশ থেকে আমিরা আপু ফট করে বলে বসল,
“আপনি কোলে বসিয়ে খাওয়াতে পারলে আমরা কেন খেতে পারব না?”
তাজ ভাই ভ্রুকুটি করলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“তাই না কি? দুই বাচ্চার মা হওয়ার বয়সে এসে ফিডার খাওয়ার শখ জাগছে তোর? এই সৌরভ, বাসায় ফেরার সময় মনে করিস তো। আমাদের আমিরা বাবুর জন্য একটা ফিডার আর ল্যাকটোজেন কিনে নিয়ে যাব। সবাই মিলে কোলে তুলে খাওয়াতে পারবি না?”
তাজ ভাইয়ের কথা শুনে টেবিল জুড়ে হাসির হিড়িক পড়ে গেল। হাসতে-হাসতে একজন আরেকজনের ওপর ঢলে পড়ার জোগাড়। আমিরা আপু মুখটা পাংশুবর্ণ করে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। বেচারি নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেল। মনে-মনে হয়তো অপমান বোধ করল। খাবার থামিয়ে রাগ ঝাড়ল আমাদের ওপর। ধমকের সুরে বলল,
“রাক্ষসের মতো হি-হি করছিস কোন দুঃখে? হাসি থামাবি, না উঠে চলে যাব আমি?”
এতেও কারোর হাসি যেন থামতেই চাইল না। এরমধ্যে আবার শ্রেয়ান ভাইয়া বলে উঠলেন,
“আহা আমিরা! রাগ করছো কেন? বাচ্চাদের এত রাগ করতে নেই। ললিপপ খাবে, বাবু?”
ব্যস, এতেই সবার দমফাটা হাসিতে ঘি ঢালা হয়ে গেল। আমি হাসি থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালালাম। ঠিক তখনই পাশ থেকে তাজ ভাই হুট করেই চটাস করে আমার মাথায় এক চা’টি মে’রে বসলেন। হাসির পাল্লায় পড়ে সবাই তা খেয়াল করল না। সঙ্গে-সঙ্গে আমি হাসি থামিয়ে হাতের তালুতে মাথা ঘঁষতে-ঘঁষতে মুখ কুঁচকে বিরক্ত চোখে ওনার দিকে চাইলাম। ওনার তাতে হেলদোল নেই, নির্দোষ ব্যক্তির মতো আমার দিকে তাকালেনও না। তবে আমার দিকে পানির গ্লাসটা ঠেলে দিয়ে চাপা স্বরে কড়া গলায় আদেশ করলেন,
“পানি খা। হাসতে-হাসতে হেঁচকি উঠলে চা’পড়ে মুখের সবকটা দাঁত ফেলে হাসি শিখিয়ে দেবো।”
আমি পানির গ্লাস ছুঁয়েও দেখলাম না। গাল ফুলিয়ে খাবার গলধঃকরন করলাম। ততক্ষণে হাসির হিড়িক কমেছে। তাজ ভাই সবার অগোচরে কড়া চোখে পানি খাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এবারেও আমি ত্যাড়ামি করলাম। কথায়-কথায় চুল টেনে ধরবে, চা’টি মা’রবে, আর আমি বাধ্য মেয়ের মতো তার আদেশ পালন করব? কখনোই না, হুঁহ্। তাজ ভাই আর আমায় জোর করলেন না। টেবিলের সবাই এখনও আমিরা আপুকে নিয়ে বিভিন্ন কথায় মজা করতে ব্যস্ত। বেচারি আমিরা আপু থেঁতো মুখে সবার সাথে লড়ে চলেছে। খাওয়ার আগে বিল নিয়ে মল্লযুদ্ধ করলেও, শেষে ঠিকই বিলটা তাজ সাহেবই দিলেন। এই লোকের কথার সাথে কাজের যদি এক ফোঁটাও মিল থাকত! অযথাই সবার সাথে ঝামেলা করল। সেই নিজেই তো দিলো। তো ঝামেলাটার কি দরকার ছিল? এন্টারটেইনমেন্ট এখানেই! রেস্ট্রন্ট থেকে বেরিয়ে আমিরা আপু জানাল তার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু মার্কেটে ঢুকতে একজনও রাজি নয়। আমিরা আপুর মুখটা চুপসে গেল। কাঁদো-কাঁদো মুখে সে বহু অনুনয়-বিনয় করে সবাইকে রাজি করল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সাথে সবার মার্কেটে ঢুকতে হলো। তবে তাকে দশ মিনিটের মধ্যে কেনাকাটা শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হলো। আমিরা আপু তাতেই সম্মতি জানাল। মার্কেটে ঢুকে অবশ্য একেকজন একেকটা নেড়েচেড়ে দেখতে ভোলেনি। কিনুক বা না কিনুক, মার্কেটে যখন ঢুকেছে তখন নেড়েচেড়ে দেখতে তো হবেই। শেষে দেখলাম শ্রেয়ান ভাইয়া, তাজ ভাই, জুম্মান ভাইয়া আর মিনহা আপুও কিছু জিনিস কিনল। সৌরভ ভাইয়া হেসে আমাকে বললেন,
“আপু, খেয়াল করেছেন? একমাত্র আমরা দুজনই কিন্তু সাচ্চা ভদ্রলোক।”
জবাবে আমিও হাসলাম। এই ছেলেটা আমার চোখে সবসময়ই চমৎকার। বাসায় যখন ফিরলাম তখন কাঁটায়-কাঁটায় রাত বারোটা। দীর্ঘ সময়ের ঘোরাঘুরিতে মন ফুরফুরে হলেও, শরীর ক্লান্ত। আম্মি আমাদের দেখেই ছুটল ঠান্ডা শরবত বানাতে। তাজ ভাই নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে-বাড়াতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
“সোফায় টাকা ফেলে রেখেছিস কেন? টাকা-পয়সা উথলে পড়ে না কি?”
আমি ভ্রুকুটি করলাম। সোফায় কখন টাকা ফেললাম? বাসা থেকে বেরোনোর আগে পার্স থেকে পড়েছে না কি? পার্স চেক না করেই আমি দ্রুত পা চালিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম। সোফায় টাকার ট-ও পেলাম না; তবে ছোটো একটা প্যাকেট পেলাম। এখানে তো কোনো প্যাকেট ছিল না। প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্যাকেটটা হাতে নিতেই ভেতরের বস্তুর মৃদু শব্দ কানে আসতেই আমার আগ্রহ দ্বিগুণ বাড়ল। দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলতেই অতিশয় সুন্দর এক মুঠো চুড়ি পেলাম। কালো রংয়ের চুড়ি। মার্কেটে ঢোকার পর আমি এই চুড়িগুলো একবার নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম; তবে কিনব-কিনব ভেবেও শেষে কিনিনি। হুট করেই মনটা ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠল। প্যাকেটটা নিয়ে রুমে এসে চুড়িগুলো হাতে পরে দেখার সময় চোখ পড়ল প্যাকেটের গায়ে। কলমের কালিতে সেই গুটি-গুটি অক্ষরে লেখা তিনটা লাইন,
“ওই হাত প্রিয় জিনিস ছুঁয়ে দিয়েও এড়িয়ে যাবার জন্য নয়, আঁকড়ে ধরার জন্য। প্রিয় জিনিস আঁকড়ে ধরতে শেখো, পিচ্চি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
প্রকৃতিতে ঝকঝকে দিনের বিদায়বেলার আয়োজন চলছে। সারাদিন ধরে প্রখঢ় তাপে উত্তপ্ত সূর্যটার তেজ কমে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। তেজবিহীন কমলা রংয়ের সূর্যের কিরণে ধরণীতেও কমলা রংয়ের আভা ছড়িয়েছে। অদূরেই পাশাপাশি দুটো বিল্ডিংয়ের মুখোমুখি বারান্দায় দুজন যুবক-যুবতি দেখা যাচ্ছে। চেহারা অস্পষ্ট হলেও তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা গল্পে মেতে উঠেছে বেশ। হাত নেড়ে কথা বলছে, কখনও মাথা কিংবা শরীর দুলিয়ে প্রাণখোলা হাসির পসরা সাজাচ্ছে। নিজের অজান্তেই কতটা সময় ধরে একলা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি এ দৃশ্য উপভোগ করছি হিসেব নেই। তাদের হাসতে দেখে অযথাই আমিও মুচকি হাসছি। অবচেতন মন সেই প্রথমেই ভেবে নিয়েছে ওই সুখী যুবক-যুবতী যুগল নিশ্চয়ই কপোত-কপোতী। পরিবারের চোখে ফাঁকি দিয়ে দারুণ আনন্দে দুজন প্রণয়ালাপনে মত্ত। আর তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে আমি মত্ত তাদের প্রণয়ালাপন উপভোগে। বিকেলের লুকোচুরি গল্প। কথাটা ভাবতেই আমার ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসির রেখাটা দীর্ঘ হলো।
“অন্যের প্রেমে বদ নজর না দিয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে ফোন লাগালেই পারিস।”
আমি খানিক চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালাম। তাজ ভাই সূক্ষ্ম চোখে সামনের বিল্ডিংয়ের কপোত-কপোতীদের দেখছেন। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
“কথায়-কথায় এই বয়ফ্রেন্ডটা কোত্থেকে টপকে আনেন আপনি?”
“বয়ফ্রেন্ড নেই বলে পনেরো বছর বয়সে যার আফসোসের অন্ত ছিল না, উনিশে এসে কি তার আফসোস শেষ হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?”
এই একটা কথাই আমার এত সুন্দর মুহূর্তটাকে গুড়েবালি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিরক্তির সুরে বললাম,
“আমার এসব আফসোস কোনোকালেই ছিল না। ভালোও লাগত না এসব।”
উনি এবার আমার দিকে ফিরে তাকালেন। চোখের পলকে পকেট থেকে সেই অভিশপ্ত চিরকুট বের করে মেলে ধরলেন। এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“আমি কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না।”
আমার মেজাজ এবার সপ্ত আসমান ছুঁলো। ওনার হাত থেকে চিরকুটটা কেড়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনি চিরকুটটা হাতের মুঠোয় মুড়িয়ে সরিয়ে নিলেন। আমি গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। থমথমে গলায় বললাম,
“এই ফালতু চিরকুট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান কেন? আপনি এখনও বিশ্বাস করেন, আমি এটা লিখেছি?”
“না করার কারণ আছে?”
ওনার ত্যাড়া উত্তর শুনে আমি আর ফিরেও তাকালাম না। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলাম। কন্ঠনালিতে হাজারো শব্দের ভীড় জমেছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি উগড়ে দিতে। সবটাই চিরকুট বিষয়ক। এই পর্যন্ত তো আমার কাছে কম চিরকুট জমা পড়ল না! প্রেরক চিনেও চিনি না ভান ধরে পড়ে আছি দিনের পর দিন। মাঝেমাঝে নিজেকে সেই ছয় বছর আগের মতোই হাঁদারাম মনে হয়। প্রথম পাওয়া চিরকুটটার প্রেরক খুঁজতে গিয়ে কী বোকাটাই না হয়েছিলাম! তারপর অবশ্য ওই হাতের লেখা চিনতে আমার বেশি দেরী হয়নি। প্রতিটা চিরকুটে ওই হাতের লেখা দেখে-দেখে এখন আর বিভ্রান্ত হতে হয় না। আজকাল ওই হাতের লেখা চিরচেনা মনে হয়। এক নজর দেখলেই চিনে ফেলার মতো। সোজা কথায় বলতে গেলে মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রেরক চেনার পর আমার শান্তশিষ্ট মস্তিষ্কটা যতটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছে, তার চেয়ে বেশি জড়তায় আড়ষ্ঠ হয়েছে। একের পর এক কনফিউশন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। ওনার চিরকুট আর কর্মকাণ্ডের যে অদ্ভুত অর্থ আমার মন খুঁজে বের করে, তা বেপরোয়া মস্তিষ্ক মানতে নারাজ। এই অদ্ভুত লোকের, অদ্ভুত মনের, অদ্ভুত অর্থের সত্যতা কি আদৌ বিশ্বাস করার মতো? এই তো, বরাবরের মতো মাত্রই আবার কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিলো সে আজও আমায় অবিশ্বাস করে। তার মনে আজও আমায় নিয়ে ভুল ধারণা জেঁকে বসে আছে। সর্বোপরি সে আজও আমায় কিছুটা হলেও অপছন্দ করে। ঠিক কোন রূপটা বিশ্বাস করা উচিত আমার? প্রশ্নটা মাথায় এলেই ইচ্ছে করে সবকটা চিরকুট ওনার মুখের ওপর ছুঁড়ে মে’রে উত্তর জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু পরক্ষণেই আর সাহসে কুলায় না। একা মনে হাজারটা কথার ফুলঝুরি সাজালেও, ওনার সামনে দাঁড়াতেই সব গুলিয়ে ফেলি। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি, লজ্জা আর সংকোচে প্রশ্ন গুলিয়ে ফেলি। উত্তর আর আমার পাওয়া হয়ে ওঠে না। ইদানিং আর ওসব প্রশ্ন নিয়ে ভেবে ম’রি না। সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমি খুব করে টের পাই, এটাই হয়তো আমার কাল হবে। ওনার অদ্ভুত কর্মকাণ্ড আর জ্বালাতনের মাত্রা বাড়ার সাথে-সাথে যে আমার পুরোনো অনুভুতিটাও হুটহাট উঁকি মে’রে সাবধান বাণী ছুঁড়ে মা’রছে, এসব ঠেকানোর সাধ্য কি আমার আছে? সামনের বিল্ডিংয়ের কপোত-কপোতীদের মান-অভিমানের পালা এসেছে বোধ হয়। আগের হাসি, গল্প বন্ধ করে মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, আর ছেলেটা বোধ হয় প্রেয়সীর অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। মেয়েটা অভিমানের ঝুলি নিয়ে বারান্দা থেকে রুমে চলে গেছে। ছেলেটা তাকে বার কয়েক উঁচু গলায় ডেকে সাড়া না পেয়ে চুপ মে’রে তাকিয়ে রইল প্রেয়সীর বারান্দায়। পাশ থেকে তাজ ভাইয়ের মৃদু হাসির শব্দ শুনে আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম। উনি সামনে দৃষ্টি রেখে হাসছেন। প্রশ্ন করলাম,
“হাসছেন কেন?”
উনি উত্তর দিলেন না। সময় নিয়ে হাসি থামালেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললাম,
“আজকাল খুব পাঞ্জাবিপ্রেমী হয়ে গেছেন। এখন যদি বলি আপনার গার্লফ্রেন্ড পরতে বলেছে বলে সব ছেড়ে হুট করে পাঞ্জাবির প্রেমে পড়ে গেছেন?”
উনি ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। তাচ্ছিল্য মিশে আছে বোধ হয়। দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আমার মুখে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। বেশ অ্যাটিটিউড নিয়ে বললেন,
“ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার কারো মর্জিতে লাইফ লিড করে না। মাই লাইফ, মাই চয়েস।”
আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে মাথা দোলালাম। মুখ বাঁকিয়ে পুনরায় সামনে দৃষ্টি ফেরালাম। সামনের বিল্ডিংয়ের বারান্দা থেকে প্রেমিক পুরুষটাও চলে গেছে। পাশ থেকে তাজ ভাই চলে যাচ্ছেন টের পেয়ে ফিরে তাকালাম। ততক্ষণে উনি চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। স্লাইডিং ডোরের পাশের ফাঁকা চেয়ারে দৃষ্টি আটকাল। চকলেট বক্স। এগিয়ে গিয়ে বক্সটা হাতে তুলতেই চেয়ারে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখলাম। নিশ্চিত আরও একটা চিরকুট যোগ হলো। বক্সের নিচে চাপা দেওয়া ছিল। কাগজটা মুঠোয় নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। চকলেট বক্সটা কোলের ওপর রেখে চিরকুটের ভাঁজ খুলে চোখ বুলিয়ে চললাম।

চকলেট লাভার,
টিভিতে চকলেটের বিজ্ঞাপন দেখে ওভাবে ঠোঁট উলটে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকো না। বেচারা বিজ্ঞাপনদাতাদের পেটব্যথা হলে দায় কে নিবে? এবার চকলেট গলধঃকরন করে বেচারাদের উদ্ধার করো। বলা তো যায় না, যদি ওই বদ নজর লেগে যায়? সাবধান, সব একসঙ্গে সাবার করা নিষেধ।
ইতি
চকলেট হেটার্স

চিরকুট পড়ে আমি দাঁতে জিব কা’টলাম। ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। চকলেট লাভার, চকলেট হেটার্স! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! তাড়াহুড়ো করে চকলেট বক্স খোলা ধরতেই স্লাইডিং ডোরে টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দরজার ওপাশে দাঁড়ানো তাজ ভাই আদেশ জারি করলেন,
“আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ। কথার হেরফের যেন না হয়।”
আমি পালটা প্রশ্ন করার সুযোগটুকুও পেলাম না। উনি হুট করে যেভাবে এসেছিলেন, সেভাবেই চলে গেলেন। আমার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। আদেশের মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে বসে ভাবতে লাগলাম আগামী দুই ঘন্টার মধ্যে বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ কেন। দুই ঘন্টা বাসার বাইরে কী হবে? আজব! তাছাড়া আমি তো বাসা থেকে বেরোলে আমিরা আপুদের বাসা ছাড়া একা কোথাও যাই না। তা-ও তো আমিরা আপুদের বাসা এই ফ্লোরেই। তাহলে? অনেক ভেবেচিন্তেও সন্তোষজনক কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। আমিরা আপুদের বাসায় গেলে কি জানতে পারব? তারা নিশ্চয়ই জানে বাইরে কী হচ্ছে। বেলকনি থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। দরজা বন্ধ, মানে বিপজ্জনক লোক এখন বেরোবে না। ছুটে গিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে চকলেট বক্স আর চিরকুটটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আবার ছুট লাগালাম। সদর দরজা খুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। বাসা থেকে বেরোনো নিষেধ মানে তো বাসার বাইরে পা রাখা যাবে না। আমিরা আপুদের বাসায় যেতে হলে তো বাইরে পা রাখতেই হবে। পরক্ষণেই ভাবলাম আমিরা আপুদের বাসায় গেলে কিছু হবে না। দরজা খুলে দ্রুত চললাম তাদের বাসায়। দরজা খুলে দিলো মিনহা আপু। আমাকে দেখে দরজার সামনে থেকে সরেও দাঁড়াল না। কেমন অসন্তুষ্ট সুরে বলল,
“আপু বাসায় নেই। কেন এসেছিস?”
আমি খানিকটা নয়, অনেকটাই অবাক হলাম। ইতঃপূর্বে কোনোদিন এই বাসায় আসার কারণ থাকা লাগেনি আমার। অযথা এলেও কেউ প্রশ্ন করেনি। অপ্রস্তুত হেসে বললাম,
“তোমাদের কাছেই এসেছি। সামনে থেকে সরবে না?”
মিনহা আপু একবার ভেতরে তাকিয়ে চুপসানো মুখে সরে দাঁড়াল। তাকে পাশ কা’টিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমার পা থেমে গেল। ড্রয়িংরুমে বসা মিনহা আপুর বন্ধুরা সবার দৃষ্টি তখন আমার দিকে। এদিকে আমি না পারলাম এগোতে, না পারলাম পেছোতে। ততক্ষণে মিনহা আপুর দুজন বন্ধু সোফা ছেড়ে উঠে হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে-করতে এগিয়ে এল। অগত্যা আমি কাঁচুমাচু মুখে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করলাম। আড়চোখে একবার মিনহা আপুর দিকে তাকালাম। সে এখনও চুপসানো বেলুনের মতো মুখ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনহা আপুর একজন বন্ধু কেমন অদ্ভুত হেসে বলল,
“শুনলাম আমাদের নামে নালিশ করেছ মিনহার ভাইয়ার কাছে? কেন গো সুইটি? তোমার কী ক্ষতি করেছি আমরা?”
আরেকজন সকৌতুকে বলল,
“ড্রিংকসই তো করেছি বাবু। এটুকুতেই নালিশ করে মিনহাকে বকা শুনালে? কিছু করলে না হয় মানা যেত।”
সোফায় বসা আরেকজন টিপ্পনী কে’টে বলল,
“এখন করে দিলে?”
সঙ্গে-সঙ্গে সবাই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। মিনহা আপু দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে বলল,
“তুই এখন বাসায় যা। পরে আসিস।”
সুযোগটা হাতছাড়া না করে আমি সায় জানিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই পেছন থেকে মিনহা আপুর উদ্ভট বন্ধুটা চোখের পলকে সামনে এসে দাঁড়াল। আমি হকচকিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলাম। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা বাড়ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। বাসায় কি আর কেউ নেই? আন্টিকেও তো দেখছি না।
“আররে সুইটি, কিউট মুখটার এই অবস্থা হয়ে গেল কেন? ভয় পাচ্ছ না কি?”
এবার আমার পা-ও কাঁপতে লাগল। মিনহা আপু ব্যস্ত হয়ে বন্ধুদের থামতে বলল‌। তবু কেউ থামল না। অসভ্যের মতো বিভিন্ন কথা বলাবলি করতে লাগল। আমি অসহায় মুখে মিনহা আপুর দিকে তাকালাম এই আশায় যে, সে তার বন্ধুদের ধমক দিয়ে হলেও থামাবে। কিন্তু সে শান্ত স্বরে বুঝানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আমি কিছু বলতে পারছি না এই ভেবে যে, মিনহা আপু আবার আমার ওপর রেগে থাকবে। তার চেয়ে বরং এখান থেকে বেরিয়ে যাই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা সরছেও না। বেশিক্ষণ সুযোগ খুঁজলাম না। ছেলেটা পাশ কাটিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে ছেলেগুলো ডাকাডাকি করছে। সেদিকে আর কান দিলাম না। রাগে শরীর রি-রি করছে। এই অসভ্য ছেলেগুলোর সাথে মিনহা আপুর ফ্রেন্ডশীপ করার কি দরকার ছিল? দুনিয়াতে কি আর কোনো মানুষ ছিল না? বাসায় ঢুকতেই দ্বিতীয়বারের মতো আমার পা থমকাল। মুখের রাগী ভাব উধাও হয়ে কেমন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। সোফায় বসা ডিটেকটিভ মহাশয়ের অগ্নিদৃষ্টি মুহূর্তেই বুকের ভেতর দামামা বাজাতে শুরু করল। অথচ মহারাজ না মুখ খুলছেন, না চোখ ফিরাচ্ছেন। গোবেচারা আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চোরের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে চলে যাওয়া ধরতেই উনি ঠান্ডা গলায় বললেন,
“নিষেধ করেছিলাম বাইরে বেরোতে।”
আমার আর পালানো হলো না। অপরাধীর মতো মুখ করে নিচু স্বরে বললাম,
“অন্য কোথাও যাইনি তো। ওই বাসায় গিয়েছিলাম।”
“তা কি এই বাসার ভেতরে?”
আমি অসহায় মুখে না-বোধক মাথা নাড়ালাম। এবার উনি উঠে দাঁড়ালেন।‌ দু’পা এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বললেন,
“লাফালাফি না করলে শান্তি পাওয়া যায় না? দুটো ঘন্টা বাসায় থাকতে বলেছি, তাতেও কৌতুহল সামলানো যায়নি? সমস্যা কী তোর? মিনহার ভদ্র বন্ধুগুলোর প্রতি এত টান?‌ তা, এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো কেন? কোলে তুলে আদর না করেই ছেড়ে দিলো?”
আমি মাথা নিচু করে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে আছি। উত্তর দিলেই নিশ্চিত মাথায় তুলে আছাড় মা’রবে। তবে এবার বুঝতে পারলাম যে, মিনহা আপুর বন্ধুরা এসেছে বলেই আমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। কারণটা তখন বললে কি আর আমি যেতাম? ব’দ লোক। এখন আবার আমাকেই ধমকাচ্ছে। আমার কী দোষ? ওনার ধমকা-ধমকির শব্দে আম্মি ছুটে এল। সঙ্গে-সঙ্গে আমি দ্রুত আম্মির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মি তাজ ভাইয়ের ধমকা-ধমকির কারণ জানতে চাইলে উনি বেশ রেগেমেগে কারণ বললেন। তবে মিনহা আপুর বন্ধুদের আমার সাথে করা আগের আচরণের কথাটা চেপে গেলেন। আম্মি তাজ ভাইকে থামানোর চেষ্টা করে বললেন,
“হয়েছে, এবার রাগ কমা। ও কি জানত তুই কেন বারণ করেছিস? জানলে তো যেত না। শুধু-শুধু মেয়েটাকে এভাবে বকিস না বাবা। ওর আব্বু-আম্মু শুনলে কষ্ট পাবে।”
উনি ত্যাড়াভাবে বললেন,
“আন্টি-আঙ্কেলকে আমি নিজেই জানাব। তারপর দেখব ও আঙ্কেলের বকা থেকে কীভাবে বাঁচে। আগামী দুই দিনে একবারের জন্যও বাসার বাইরে পা রাখলে পা ভেঙে রেখে দেবো।”
“আচ্ছা বলিস। এখন চুপ কর না।”
“কিসের চুপ করব? একটা কথাও শোনে তোমাদের আদরের দুলালি? ওকে তো দু ঘা লাগানো উচিত। দেখি সরো, পেছনে পালিয়েছে কোন সাহসে?”
“কে বলেছে শোনে না? ও এমনিতেই শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ইলো, চলো তো এই বাঁদরের কাছ থেকে।”
আম্মি আমার হাত ধরে টেনে ড্রয়িংরুম থেকে রুমে নিয়ে এল। বলল,
“তাজ রেগে গেলে ভুলেও আর কখনও ওর কাছে থাকবে না। জানো না ও কেমন? কখন এটা-ওটা ধরে ছুঁড়ে মা’রে, ঠিক নেই। একেকটা ভিন্ন প্রজাতির মানুষ নিয়ে আমার সংসার। সামনে যেয়ো না এখন। দেখি গিয়ে কী করছে।”
আম্মি চলে যেতেই আমি অন্ধকার মুখে গাল ফুলিয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লাম। পা দুটো বিছানায় উঠিয়ে থম মে’রে রইলাম। মন খারাপ লাগছে। অকারণে এত বকার কী ছিল? ওনারই তো দোষ। ছোটো পেয়ে আমার ওপরেই অযথা রাগ ঝাড়ে। যাবই না আর সামনে। বিছানার একপাশে পড়ে থাকা চকলেট বক্স আর চিরকুটের দিকে তাকালাম। চিরকুটটা খুলে আবার পড়লাম। আমি কীভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম তা উনি দেখেছেন ভেবেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। কী বাজে ব্যাপার! চকলেট বক্সটা হাতে নিয়ে পরক্ষণেই আবার দুটো জিনিসই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম পূর্বের জায়গায়। এখন আমি খাবোও না, লজ্জাও পাব না। এটা অভিমানের সময়। চকলেট খেলে অভিমান কমে যাবে। ওসব পরে খাব। অনেকটা সময় পার হবার পর আর একভাবে বসে থাকা সম্ভব হলো না। পা দুটো ধরে গেছে। আম্মিও আর এল না। ড্রয়িংরুমে কুরুক্ষেত্র হলেও এ মাথায় আমার রুমে বসে তা শোনা যায় না। বাইরে যেতেও আর ইচ্ছে করছে না। পড়তে বসলে মনোযোগ আসবে না। ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটার পর ঘুমে দুচোখ বুজে এল। কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি হিসেব নেই। শেষে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ বন্ধ করেই মুখের আর গলায় ঘাম মুছতে লাগলাম। ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। লোড সেডিং হলো না কি? গরমটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পায়ের কাছে ওপাশ ফিরে বসে থাকা ব্যক্তিকে দেখেই লাফিয়ে উঠে বসলাম। উনি পেছন না ফিরেই বলে উঠলেন,
“দুই মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বের হ। কুইক।”
ঘুম থেকে উঠেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ধমকা-ধমকি করে এখন আবার নিজেই এসেছে আদেশ দিতে। তার ওপর আবার দেখলাম ফ্যানের সুইচ অফ করা। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করলাম। কপট রাগ দেখিয়ে আপন মনে বকবক করতে লাগলাম,
“খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই। গরমে অতিষ্ঠ করে আদেশ দিতে আসে। মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে।”
বিছানায় ফিরে এসে ফোনে সময় দেখলাম। রাত এগারোটা ছাব্বিশ বাজে। এতটা সময় ঘুমিয়েছি! আম্মি জাগাল না কেন? খেতেও ডাকেনি না কি? এমনটা তো কখনও হয় না। না কি আমিই ডাক শুনিনি? তা-ই হবে হয়তো।
“দুই মিনিট পার হয়ে যাচ্ছে। বসে থাকতে বলিনি।”
তাজ ভাইয়ের কথায় আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কিঞ্চিত রাগত স্বরে বললাম,
“রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যাচ্ছে। এখন আমি আবার ঘুমাব। ফ্রেশ হয়ে কি করব এখন? ডিনার করব না আমি। আপনি এখানে বসে আছেন কেন?”
“যেতে বলেছি।”
আমি উত্তর না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। উনি মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন। তারপর হঠাৎ এগিয়ে এসে আমাকে টেনে বিছানা থেকে নামালেন। নামিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি মোচড়া-মুচড়ি করেও ছাড় পেলাম না। ভেবেছিলাম খাওয়ার জন্য টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছে। অথচ উনি আমাকে নিয়ে ডাইনিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলেন। সদর দরজা খুলতে দেখেই আমি অবাক হলাম। ছাড় পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাবে। ব’জ্জাত লোক মুখে কুলুপ এঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে সোজা লিফটে ঢুকে পড়লেন। অতঃপর আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার বিরক্তি, রাগ সব উগড়ে দিয়ে বারবার করে বললাম আমায় বাসায় রেখে আসতে। এই রাত-দুপুরে ওনার সাথে কোথাও যাওয়ার শখ নেই আমার। আমার হাজারটা কথায় উনি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। উলটো আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে আমার পরনের ওড়নার একপাশ মাথায় তুলে দিতে-দিতে শান্ত স্বরে বললেন,
“চু’রি করতে নিয়ে যাচ্ছি না। নিশাচর হতে যাচ্ছি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤