মন কারিগর পর্ব-১০+১১

0
102

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১০]
~আফিয়া আফরিন

নাটক রিলিজ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই রাফির গাওয়া গানটা রিলিজ হল। বেশ জনপ্রিয়তা পেল সেই গান। সামাজিক সাইট থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল। রাফির বাড়ির পাশের এক প্রতিবেশী বললেন, ‘তুমি যে এত সুন্দর গান গাও সেটা তো জানতাম না বাবা। আর তোমার বাসার পাশে এতদিন আছি, কখনো তোমার গান শুনিও নাই। আজ শুনলাম, অসাধারণ বললেও কম হবে!’
রাফি নিজের মনোভাব ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে এটা এক নিছক স্বপ্ন, ঘুম ভাঙলেই হয়ত স্বপ্নটা কেটে যাবে।
এত আনন্দ উত্তেজনায় রাফির কাছে তার বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের ফোন আসছে একের পর এক। সবাই পরবর্তী কাজের জন্য শুভকামনা জানাল এবং বর্তমান কাজের জন্য তাকে স্বাগতম জানাল। কিন্তু রাফি যার ফোনকলের জন্য অধীর আগ্রহে, সকল সীমারেখা পেরিয়ে অপেক্ষা করে রয়েছে, রাত পেরিয়ে গেলেও তার তরফ থেকে একটা ফোন এল না। তবে কি জুহি এখনো গান শুনে নাই? না শোনারও তো কথা না, গানটা যেভাবে ছড়িয়েছে ইতিমধ্যে সবার কাছেই তো পৌঁছে যাবার কথা। সময় পেরিয়ে গেলেও জুহির একটা ফোন কলের জন্য সে তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় অপেক্ষা করতে লাগল।
তবে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পরদিন দুপুর পেরোতেই কাঙ্খিত ফোন এল। রিসিভ করতেই রাফি প্রথমে কথা বলবে কী, জুহি নিজেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল, ‘আরে আরে কংগ্রাচুলেশন! এইবার তাহলে অটোগ্রাফ পাচ্ছি আমি। আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন। দেখেছেন চেষ্টা কী জিনিস? প্রথম দিন ৫ ঘন্টায় পারেননি, আর আজ তো আপনার গান সবার ঘরে ঘরে পৌঁছাতে ৫ মিনিটও বোধহয় লাগে নাই।’

রাফি একটু লজ্জা পেল বোধহয়। জুহি তাকে নিয়ে সত্যিই এতো মাতামাতি করছে? কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
জুহি পুনরায় বলল, ‘আমি কাল একদম অনলাইনে ছিলাম না। ইভেন আজ সকাল থেকেও ছিলাম না। একটু আগে আমার টিউশনি ছিল, সেখানে বাচ্চাটা আমায় বলল ম্যাম নতুন একটা গান এইবার হিট হয়েছে‌। তো আমি গানটা ইউটিউবে দেখলাম, সেই সূত্র ধরে আপনাকে খুঁজে পেলাম। আপনার নাম উল্লেখ করা ছিল, আর কন্ঠ তো আমার আগে থেকেই চেনা। তারপর দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মিলাতেও বেশি সময় লাগল না। আর আপনিও তো নিজ থেকে জানালেন না, কেন বলেন তো?’

‘আমি কী জানাব? আমার তো নিজেরই লজ্জা লাগছে। একের পর এক আত্মীয় স্বজনদের ফোন, তার মধ্যে মা-বাবাও যে মাতামাতি করছে লজ্জায় মাথা কাটা গেছে আমার একেবারে।’ কিঞ্চিৎ লাজুক কণ্ঠে বলল রাফি।

‘তা তো করবেই, স্বাভাবিক ব্যাপার। লজ্জার কী হল?’
রাফি এইবার সত্যিই লজ্জায় মিইয়ে গেল। পরক্ষণেই মনে পড়ল এত দৃঢ় লজ্জা মেয়ে মানুষের ভূষণ, এটা তাকে শোভা পায় না। তাই যথেষ্ট শান্ত এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘শুনেন, দেখা করতে পারবেন একদিন?’

‘বাবাহ আমার কী সৌভাগ্য! একজন ভবিষ্যৎ স্টারের সাথে দেখা করব আমি, ওয়াও! এখন রাস্তায় বের হলেও মুখঢাকা দিয়ে বের হতে হবে।’ সুছন্দে বলল জুহি।

‘আপনি কিন্তু আমায় লজ্জা দিচ্ছেন।’

‘মোটেও না, আমি সত্যিই বলছি। সামনের মাসে আমার পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষ হলে দেখা করব একদিন। ততদিনে আপনার আরো গানের অ্যালবাম জমা হোক, গান শুনব কিন্তু!’

‘আমার সৌভাগ্য ম্যাডাম!’ মুচকি হেসে বলল রাফি।
এই গান রিলিজ হওয়ার পর রাফি আর আগের মত উন্মুক্ত সময় পেল না। একের পর এক নাটক আর শর্ট ফিল্মের গানের অফার তার দ্বারে এসে কড়া নাড়তে লাগল। এর মধ্যে নাটকের গানগুলোই বেশি থাকে। আর প্রতিটা গানেই তোলপাড় সৃষ্টি হয়!
বেশ কিছুদিন বাদে রাফির গানের অবস্থা বুঝে আজাদ মল্লিক একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন সময় করে রাফিকে নিয়ে স্টুডিওতে বসলেন। দু’য়েক কথা বলার পর তারপর বললেন বললেন, ‘রাফি! আমি তো একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। এবার পরবর্তী সিনেমায় প্লে ব্যাকের জন্য তৈরি হও। কোনো ছোটোখাটো নাটক না, সিনেমার জন্য গান করতে হবে। আমি নিশ্চিন্ত তুমি এটাও পারবে। আমি তোমার গান শুনে প্রথমেই বুঝে নিয়েছিলাম, এই ছেলের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিভা আছে।’
পরবর্তী দিনগুলো স্বপ্নের মত কেটে গেল। জীবন যে এতটা শান্তির হয়, এতটা সুখের হয় তা রাফি হারে হারে টের পেল। কিন্তু তার এই পরিপূর্ণ জীবনেও একটা শূন্যতা ছিল, যেটা জুহি। ইদানিং খুব অল্প হলেও জুহির সাথে কথা হয়, কিন্তু এতে রাফির মন ভরে না, কী করলে তার মন ভরবে এটাও সে জানেনা। তবে অনেকদিন তো হল, এইবার জুহিকে ভালোবাসার কথাটা বলে দেওয়া উচিত! আর কতো পোড়াবে মেয়েটা?

আজ সময় করে বন্ধুদের সাথে দেখা করল রাফি। ইদানিং ব্যস্ততার জন্য তাদের সময়টা কম দেওয়া হয়। তবে সামনে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা, এখন ওইদিকে ব্যস্ততা কম দিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হবে। ক্যাম্পাসের মাঠে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল রাফি। সময়টা সন্ধ্যা বিকেলের মাঝামাঝি। রাফির পাশে তার বন্ধুরা এসে বসতে লাগল। সকলে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রাফি মনোযোগ শ্রোতা হয়ে সকলের কথাই শ্রবণ করছিল। এমন সময় পাশ থেকে এক বন্ধু প্রান্ত রাফির উদ্দেশ্যে বলল, ‘কি দোস্ত তোর মুখে কোনো কথা নাই কেন? কি এতো ভাবনার রাজ্য ডুবে আছিস।’

রাফি সহসা উত্তর দিল, ‘না না। তেমন কিছু না। আমি তো তোদের কথা শুনতেছি। বলতে থাক।’

পাশ থেকে আদনান নামে আরেক বন্ধু টিপ্পনী কেটে বলে, ‘না মাম্মা। তোমার ভাবসাব তো ঠিক সুবিধার লাগতেছে না। কাহিনী কী বলো তো।’

রাফি ফের দায়সারা ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘আরে ভাই আমার কথা বাদ দে তো। তবুও যদি শুনতেই চাস, তাহলে বলব আমার কিছুই হয় নাই। অনেকদিন পর তোদের সাথে দেখা হল, তাই মনোযোগ দিয়ে তোদের কথা শুনছি।’
আদনান আর প্রান্ত দুজনেই ভ্রুকুটি করে রাফির দিকে তাকাল। তারপর আর কিছু না বলে নিজেদের আড্ডায় মনোনিবেশ করল। গল্প চলছে অবিরাম…. সাথে কাপের পর কাপ চা শেষ হচ্ছে। রাত বাড়ার তালে তালে কথাবার্তাও কমে আসছিল। উঠে যাওয়ার একপর্যায়ে আদনান রাফিকে বলল, ‘মাম্মা পাশের বাড়ির ওই মাইয়াডার কথা তো কিছু বললি না? ওর আপডেট দে, আমরাও শুনি একটু।’

রাফি কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘শী প্রপোজড মি!’ এটুকু বলেই আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। রাফির বন্ধুরা চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল।
তারপর একজন বলল, ‘ওয়াহ, সিরিয়াস? মেয়ের মতিগতি দেখে আমি মনে করছিলাম কখনো না কখনো এই কান্ড ঘটাবেই। তারপর তুই কি করলি?’

‘কী আবার করব? আমার যেটা করার দরকার ছিল সেটাই করেছি। আমি নিশ্চয়ই ওর তালে তাল মিলিয়ে নাচব না।’

‘তোদের অ্যাপার্টমেন্টই তো থাকে, দেখা হয় এখনো?’

‘হয়, তবে আমি এভয়েড করার চেষ্টা করি। এসব ঘটনার পর থেকে রাত ব্যতীত অন্য সময় আমি ছাদেও যাই না। আমি ছাদে গেলে কীভাবে কীভাবে জানি ও খবর পেয়ে যায়, আশ্চর্য!’

‘মেয়ে চরম সাংঘাতিক! আমরা যখন গিয়েছিলাম তখনকার কথা মনে আছে? ডিরেক্ট এসে আমাদের ফোন নাম্বার চাচ্ছে। আবার বলে কিনা, আপনার বন্ধুকে পটাতে হলে আগে আপনাদের হাতে রাখতে হবে।’

রাফি জিগাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘ফোন নাম্বার কি দিয়েছিলি তোরা?’

‘না। পাগল নাকি নিজেদের ফোন নাম্বার দিব তাই ওই লাফাঙ্গা মেয়েরে? দিয়েছিলাম তবে সেটা রং নাম্বার।’ মিচকি হেসে বলল প্রান্ত।
তারপর সে রাফির কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘ভাই! প্রপোজাল এক্সেপ্ট করলি না কেন? মাইয়া তো হেব্বি সুন্দর আছিল।’
রাফি আর বন্ধুদের কথায় কর্ণপাত করল না। কেউ যতই সুন্দর হোক না কেন, যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, রাফির মনে ধরে না। তার মনের গতি গিয়ে আটকেছে জুহির কাছে। এর থেকে নিস্তার পাওয়া সহজ নয় মোটেও—আর রাফিও নিস্তার পেতে চায় না।

এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে রাফির স্বপ্নের দিন আরও দুটো মাস অতিক্রম করল। তার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটাও শেষ হল কোনরকম ভাবে। এরই মাঝে সে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। আগের মত বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিতে গেলে, সেখানেও ভিড় জমে যায়। কয়েকজন পাগল পারা গানের ভক্ত রয়েছে, তারা সেলফি নেওয়ার জন্য একদম ব্যতিব্যস্ত করে ফেলে। তাদের মধ্যে কয়েকজন অটোগ্রাফ পর্যন্ত চেয়েছিল, কিন্তু রাফি এই ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্মতার সাথে এড়িয়ে গেছে। জুহি চেয়েছিল তার কাছে প্রথম অটোগ্রাফ, জুহিকে না দিয়ে আর কাউকেই দেওয়া যাবে না সেটা।

অবশেষে একদিন জুহিকে নিজের ভালোবাসার কথা বলে দেওয়ার মত দুঃসাহসটা সে করেই ফেলল। এতে করে এখন যে রাফি আর জুহির মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা স্থাপন হয়েছে, পরবর্তীতে টিকে থাকবে কিনা এই বিষয়টা রাফির মাথাতেই এল না। জুহিকে ভালোবাসার কথা বলবে—এটা নিয়েই সে বেশ উত্তেজিত।
অনেক ভেবেচিন্তে সে নিজের মনের শান্তির জন্য অনেকদিন পর শরনাপন্ন হয়েছে জুহির নিকট। এই মেয়েটার মধ্যে যে তার সমস্ত শান্তি লুকায়িত।
রাফি জুহির ক্যাম্পাসের সামনে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার শেষ পরীক্ষা, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো অপেক্ষার প্রহর শেষ করে বেরিয়ে আসবে। জুহিকে মেইন গেটে দেখতে পেয়ে ওকে ফোন দিয়ে সাইডে আসতে বলল। জুহি যেতেই রাফিকে নজরে পড়ল। তৎক্ষণাৎ হেসে বলল, ‘আরে আরে গায়ক সাহেব যে, আপনি?’

‘হ্যাঁ চলে এলাম। ভালো আছেন? পরীক্ষা কেমন হলো?’ নার্ভাস হয়ে জিজ্ঞেস করল রাফি।

‘সব আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?’

‘জী।’ ছোট্ট করে বলল রাফি।

‘এখন তো আপনার ভালো থাকারই দিন। গতকালের রেকর্ডিং কেমন হল? নেক্সট আবার কবে আছে?’

‘আজকেই ছিল কিন্তু সেটা ক্যান্সেল করে এসেছি। আসলে আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিল।’

জুহি একগাদা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমার সাথে আপনার কী এমন জরুরী কথা যেটার কারণে আপনার রেকর্ডিং ক্যান্সেল করে আসতে হল? বলার ফোনেই তো বলতে পারতেন।’

‘সব কথা কি আর ফোনে বলা যায়?’

জুহি ভাবুক কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা বলুন।’
সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। আজকের দিনের এই সৌন্দর্য রাফির প্রেমিক হৃদয়কে মাতোয়ারা করে দিল নিমিষেই। মনোলোকে তৈরি করল আশ্চর্য এক জগৎ যেখানে ভালোবাসা-ই মূল শক্তি।
কিন্তু রাফি ভেবে পেল না জুহিকে এই কথাটা কিভাবে বলবে? প্রেমের নিবেদন দিবে কিভাবে, হাঁটু মুড়ে নাকি হাতে হাত রেখে? নাহ, হাতে হাত কোনোভাবেই রাখা যাবে না। আজকের এই ঠান্ডা প্রকৃতিতেও রাফি ঘামছিল। বারবার জিভ দিয়ে ওষ্ঠ্যদ্বয় ভিজিয়ে নিচ্ছিল। কন্ঠনালীতে শব্দের জোয়ার বিচারণ এতক্ষণ কিন্তু এখন তাতেও ভাটা পড়ে গেছে‌। জুহি রাফির দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো করে লক্ষ্য করল তাকে। সবল, শক্তপোক্ত, লম্বা চওড়া এক যুবক। তবে সবসময় তার চেহারার মধ্যে কৈশোরের লাবণ্যতা খেলা করে। ছোট বাচ্চাদের মতো চোখে মুখে লেগে থাকে আদুরে এবং আহ্লাদের চিহ্ন। তবে এই মুহূর্তে রাফির চেহারায় বেশ উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জুহি রাফির এমন‌ অসহায় চাহনি দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘এনিথিং রং?’

রাফি উত্তর না দিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যে করেই হোক আজকে এবং এই মুহূর্তে কথাটা তাকে বলতেই হবে। তাই জুহির সামনেই ধপাস করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তীব্র ভালোবাসায় উচ্চারণ করল, ‘হাতের অনামিকা অন্য আঙ্গুলগুলো থেকে একটু বিশেষ। শুধুমাত্র জীবন সঙ্গী সেই আঙ্গুলে আংটি পড়াতে পারে। আমি চাই আপনার সেই অনামিকাতে পূর্ণতা দিতে।’
.
.
.
চলবে….

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১১]
~আফিয়া আফরিন

জুহি রাফির কথা শ্রবণ করা মাত্র হাঁ হয়ে গেল। সে বোধহয় এমন আচানক কথা জীবনেও শোনে নাই। সে একবার নিজের হাতের দিকে আরেকবার রাফির দিকে তাকাল। রাফি এইমাত্র যে কথাটা বলল, সে কি ঠিক শুনেছে?
জুহির মুখের বিস্মিত ভাবভঙ্গি দেখে রাফি ঠাওর করতে পারল জুহির ভেতরটা। তারপর উপর নিচ মাথা নাড়ল। পুনরায় বলল, ‘আপনাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন আপনাকে পরবর্তীতে আর দেখতে পাব না এই সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম। প্রথম সেই মুহূর্তে আপনার চোখের মায়ায় ডুব দিয়েছিলাম। তারপর যখন দেখা হল একটা ভালোলাগা তৈরি হল। সেই ভালোলাগা যে কখন আমার সর্বনাশ করল আমি নিজেও বুঝতে পারি নাই। কীভাবে যেন ভালোবেসে ফেললাম আপনাকে! পুরো শরৎ ঋতুটা অতিক্রম করে গেল, হেমন্তও শেষের দিকে; বলব বলব করে কথাটা বলা হচ্ছিল না!’
জুহির মুখের ভাবভঙ্গি ক্রমশ গম্ভীর হল। রাফিকে কী বলবে এটা তার মাথাতেই এল না। তবুও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘উঠে দাঁড়ান।’

রাফি বাধ্য ছাত্রের মতো উঠে দাঁড়াল। জুহি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল, ‘আপনি শুধু গায়ে গতরে বড় হয়েছেন মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে নাই তাই না? মোহ, মায়া এসব বোঝেন তো? আমার প্রতি আপনার যে অনুভূতি সেটা সাময়িক। আমার জীবনটা আসলে এলোমেলো, দুইদিন পর আপনি নিজেই বোরিং হয়ে যাবেন। আপনার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, দয়া করে আমার জন্য সেটা নষ্ট করবেন না।’

‘শুনেন, আমি মায়া আর ভালোবাসার মধ্যে তফাৎ বুঝি। আমি তো নিজের অনুভূতি সম্পর্কে নিজে জানি তাই না! আপনার প্রতি আমার মোহ বা মায়া কোনোটাই…..!’ স্বাগতিক্ত করল রাফি।

জুহি রাফিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাই হোক না কেন আপনার প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না।’

রাফি আগে থেকেই জানত জুহির উত্তর কখনোই ইতিবাচক হবে না। কিন্তু তবুও সে আশা রেখেছিল। ভালোবাসার কথাটা মনের অবাধ্য হয়েই বলে দিয়েছে। তাই জুহির উত্তর শুনে এই মুহূর্তে খুব একটা হতাশ হতে দেখা গেল না তাকে। সে সামান্য হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আমি অপেক্ষা করব। তবুও নিজের জীবনটাকে আপনি ব্যতীত অন্য কারো সাথে কখনো জড়াব না।’

জুহি বাঁকা হাসল। তারপর বলল, ‘আপনার সুন্দর সাবলীল জীবনটাকে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে অসহণীয় যন্ত্রণা ভোগ করবেন না। আর অপেক্ষার কথা বলছেন? যেখানে শহরের শেষ ট্রেনটা মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না, সেখানে আপনি তো পুরো আস্ত একটা মানুষ! মানুষ কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করতে পারে না।’

রাফি ফের হেসে বলল, ‘আপনি দেখে নিয়েন। যতদিন পর্যন্ত না মানবেন আমি আছি। আর মেনে নিলে আমি থেকে যাব।’

জুহি উদভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ হাসল। তারপর বলল, ‘আপনি আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন? দুই এক দিনের আলাপে একটা অচেনা মেয়েকে কীভাবে ভালবাসতে পারেন? জানেন, যেদিন আমি আমার মা-বাবার বিচ্ছেদ দেখেছি সেদিনই সব সম্পর্কের উপর আমার বিশ্বাস নির্মমভাবে উঠে গেছে। তারপর যেদিন মা মারা গেল, তার আগে আমায় কয়েকটা কথা বলেছিল, যার ফলে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে আমি নিজের জন্য প্রেম ভালোবাসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করি।’

‘সবাই এক হয় না জুহি।’ জুহির চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল রাফি।

‘আমি জানি কিন্ত আমার কপালে যে লেখা আছে সেও যে আমার বাবার মতো হবে না, তার কী লিখিত কোনো দলিল আছে?’

‘আপনি আপনার বাবাকে খুব ঘৃণা করেন?’

‘ভালোবাসা এবং ঘৃণা এসবই একটা অনুভূতি। আর আমার কারো প্রতি এসব অনুভূতি আসে না। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে বেঁচে আছি। যাইহোক, আপনার কথা শেষ?’

‘হ্যাঁ…. কিন্ত আপনার উত্তর?’

‘এতকিছু বলার পরও একপাক্ষিক ভাবে উত্তর চাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ চাই।’ জেদ ধরা কণ্ঠে বলল রাফি।

‘আমি আপনার জন্য না। ভুল মানুষকে মন দিয়েছেন মনে করে ভুলে যান।’
রাফি ওষ্ঠকোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। এতদিন জুহির সাথে কথা বলতে কেমন ভয় ভয় লাগত, কেমন যেন একটা দূরত্ব ছিল! কিন্ত আজ ওমন লাগছে, কোথা থেকে জানি অদৃশ্য সাহস ভর করেছে।
‘আমি জানি আপনিই আমার সে। কারণ আপনি যদি আমার সে না হতেন, তাহলে আপনাকে দেখতে পেয়ে এতো প্রশান্তি পাই কেনো আমি!’

জুহি রাফির কথার উত্তর দিল না এবং উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করল না। নিজের গন্তব্য পা বাড়াল। রাফি ওখানেই কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আপনমনেই বলল, ‘আপনাকে পাওয়ার জন্য যদি যুদ্ধ করতে হয়, তাহলে আমি তাতেও প্রস্তুত! কিন্ত যুদ্ধের উপসংহারে আমি শুধু আপনাকেই চাই।’
রাফি জুহির বাসার সামনে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। জুহি যেহেতু নিচতলায় থাকে, তাইতো না সে একটা চিরকুট লিখে দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে অনায়াসেই কাগজটা ছুঁড়ে মারল। জুহি বিচক্ষণ মেয়ে, সে এগুলো অপ্রয়োজনীয় কাগজ ভেবে নিশ্চয়ই ফেলে দিবে না।

জুহি কিছুক্ষণ বাদেই বারান্দায় কতগুলো মোচড়ানো কাগজ দেখে আশেপাশে তাকাল। নিশ্চয়ই পাশের ফ্লাটের বাচ্চা গুলোর কাজ। তাই বলে এতগুলো কাগজ কেন ছুঁড়ে মারবে? প্রথম একটা কাগজ হাতে নিয়ে খুলে দেখল, ভেতরটা শূন্য। এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ কাগজটাও শূন্য দেখল। তবে পঞ্চম কাগজে চোখ আটকে গেল। স্পষ্টভাবে সেখানে লেখা রয়েছে,

—“পার্ট ০১ এ আপনাকে না পেলে পার্ট ০২ নিয়ে আসব!
মনের দখলে নয় বরং হৃদয়ের দখলে রয়েছেন আপনি। ক্ষণিকের দেখায় চোখ ভরে না, প্রতিনিয়ত দেখে যেতে চাই। সেই দেখার সুযোগ টা কী দেবেন আমায়?
জুহি! আপনাকে আমি ভালোবাসি।”

জুহিকে কেউ বলে দিলনা, কিন্তু সে বুঝতে পারল এটা রাফির কাজ। সে হতাশ দৃষ্টিতে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়েও কোথাও রাফিকে দেখতে পেল না। মনে হয় চলে গেছে।

পরবর্তী দিনগুলো এভাবেই কাটতে লাগল। রাফি তার জীবনের নিয়মে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রচুর ব্যস্ততায় সময় কাটছিল। এই স্বপ্ন পূরণে যে তাকে এত দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হবে, এটা রাফি আগে টের পেলে হয়তো এই দিকে আগাতোই না। মাঝে মাঝে অযাচিত কারণে খুব বেশি বিরক্ত অনুভব হয়। বিরক্তির প্রধান কারণ টা হচ্ছে, জুহির ইগনোর। এরই মধ্যে এমনও কিছু দিন গেছে, জুহি রাফির সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এইদিকে জুহির সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে রাফির ছন্নছাড়া দশা! যে করেই হোক জুহির সাথে তার দেখা করতেই হবে, কিন্তু মাঝখানে বাঁধা পরে রেকর্ডিং। তখন রাফি দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হারিয়ে সব রেকর্ডিং ক্যান্সেল করে জুহির কাছে ছুটে যায়। জুহি বারবার বিরক্ত হয়, বারবার রাফিকে অনধিকার চর্চা করতে নিষেধ করে দেয়। কিন্তু কে শোনে কার বারণ?
রাফি জুহিকে হাজার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারেনা, যে সর্বনাশিনীর অন্তরালে সে হৃদয় স্থাপন করেছে, সেই সর্বনাশের চিরন্তন প্রশান্ত থেকে সে কোন কালেই বের হতে পারবে না। এই সর্বনাশ তার জীবনের সমৃদ্ধি, এই সর্বনাশ তার জীবনের প্রাপ্তি, এই সর্বনাশ তার ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি।
কবে বুঝবে জুহি এসব? কে জানে? আর কত প্রতীক্ষার প্রহর পেরোলে সর্বনাশিনী তার মনের ঘরে উঁকি দিবে?

রাফি জুহির সাথে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু জুহির তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় না কোনো কালেও। সে যেন রাফিকে চেনেই না, দেখলেও এড়িয়ে চলে যায়। জুহির জীবনটা কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সে একচ্ছ্ব ভাবে নিজের কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করছে। আর ওইদিকে রাফিও জুহিকে বোঝানোর কাজ নিদারুণ ভাবে করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। জুহির পাথরের ন্যায় শক্ত মনে রাফির ভালোবাসার প্রলেপ কিছুতেই কাজে দেয় না।
ইদানিং তার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গও ভালো লাগেনা। সবকিছুতে বিরক্তি উদ্রেক হয়। রাফির আনমনা ভাব দেখে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে রাফি কোন সমস্যা? তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।’

তখন রাফির কড়া ধমক দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বহুত সমস্যা। আপনি কয়টা সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন? পারবেন আমার ভালোবাসার রহস্য উন্মোচন করতে? পারবেন আবার আমার হারিয়ে যাওয়া মনটাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে? পারবেন কখনো আমার জীবন থেকে জুহি নামক অস্তিত্বটাকে মুছে দিতে? আমার এখন এবং এই মুহূর্তে জুহিকে লাগবে, এনে দিতে পারবেন? পারবেন না তো। তবে কেন আমায় সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করেন?’
কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে রাফিকে সামাজিকতা রক্ষা করে চলতে হয়। সে চাইলেও মনের ঝাঁজ এভাবে কারো ওপর মেটাতে পারে না।
ইদানিং রাতে বাড়ি ফিরতেও আলসেমি লাগে। ফুটপাতের ধারের নিয়ন আলোয় বসে সারা রাতটা কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সম্ভব হয় না। তার জীবনও একটা নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে চলে। রাফির অনিয়ম কর্মকান্ডে তার বাবা খুব মনঃক্ষুণ্ণ হন, এটা তিনি মুখে না বললেও রাফি বুঝতে পারে।
তাই এখন আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গানের আড্ডা আসর জমাতেও আর ইচ্ছে করেনা। ইচ্ছে গুলো কেমন হঠাৎ করেই দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। সব জুহির মত, হাতের কাছেই থাকে অথচ ধরা ছোঁয়ার কত বাহিরে!

জুহি যেন রাফির এসব উদ্রেক বুঝেও বুঝে না। শুধুমাত্র বুঝে, এই ভালোবাসা রাফির সাময়িক আবেগ। আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ তো কত কাজই করে ফেলে। তার মাও তো আবেগের বশবর্তী হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করে ফেলল। তারপর টিকল সেই সংসার? অপর প্রান্ত থেকে সামান্য একটা ঝড় এসে তাসের ঘর ভেঙেচুরে মাড়িয়ে নিঃশেষ করে দিল। জুহি নিজে চোখে দেখার পরও এরকম সস্তা আবেগকে পাত্তা দিবে? কখনোই না।

শুধু রাফিকে সাবধান করে বলেছে, ‘আমার অভিধানে প্রেম ভালবাসা বলতে কোন শব্দ নেই। দয়া করে আমার পিছু ছাড়বেন। আমি আপনার এসব কার্যক্রমে সত্যিই খুব অপ্রস্তুত বোধ করি।’
রাফি বোধহয় এবার কোমর বেঁধে নেমে পড়ল জুহির অপ্রস্ততা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। জুহির সামনে হঠাৎ করেই উদয় হবে, হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে আবার ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে যাবে। সর্বশেষ যে চিরকুটটা দিয়েছিল তাতে লেখা ছিল,
—“ভালোবেসে আমি স্বস্তি দিতে চাই, অস্বস্তি নয়! আপনাকে ভালোবেসেছি বেঁচে থাকার জন্য, তিলে তিলে মরে যাওয়ার জন্য নয়। আপনি বলেছেন আপনার অভিধানে প্রেম ভালোবাসা নামক কোন শব্দ নাই। আচ্ছা ঠিক আছে মেনে নিলাম, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমারও তো একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে তাই না? বাংলাদেশের একজন নাগরিক প্রেম ভালবাসার অভাবে শুকিয়ে চিমসে হয়ে যাবে, আর আমি এদেশের নাগরিক হয়ে এসব নিজের চোখে দেখব? তাই আবার কখনো হয় নাকি, আমি বরং আপনার মধ্যে প্রেম ভালোবাসা সঞ্চার করব কেমন!”
.
.
.
চলবে….