মন কারিগর পর্ব-১২+১৩

0
71

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১২]
~আফিয়া আফরিন

সেদিন রাফি স্টুডিওর উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। আজকে একটা গানের রেকর্ডিং আছে। তবে গানের ওখানে যাওয়ার আগে একবার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে হবে, মাস্ট। আদনান সকাল সকাল ফোন করেছিল, জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে বলেছে। রাফি বলেছিল, দুপুরের খানিক পর দেখা করবে। সেই অনুযায়ী রাফি ঠিকানাও দিয়ে দিয়েছে।
আদনান আর প্রান্ত অনেকক্ষণ যাবৎ অপেক্ষা করছিল। অবশ্য অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না, মাত্র স্কুল কলেজের ছুটি হল। ছেলে মেয়েরা যাচ্ছে আসছে। আদনান পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বেঞ্চিতে হেলান দিল। হাসতে হাসতে বলল, ‘শালা জীবনে খালি মানুষের প্রেম দেখেই গেলাম, নিজের কপালে একটা প্রেম জুটল না। যা জোটে সবটাই ভুজুং ভাজুং।’

প্রান্ত বলল, ‘মাম্মা, সিঙ্গেল থাকার মজ্জা বুঝো? এই যে সারাদিন ঘুরছ, ফিরছ, আনন্দ করছ, মজা করছ, ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করছ— একটা প্রেম কপালে জুটলে এগুলো কখনো পারতে? জীবন একেবারে জাহান্নাম করে ছেড়ে দিত। আমার তো ছিল এককালে, আমি জানি জানি।’

‘কিন্তু মানুষেরটা দেখলে এত জ্বলে কেন? শালা, ক্লাস সিক্সের পোলাপান প্রেম করে বেড়ায়। আর আমি?’

এমন সময় রাফির আগমন ঘটল। আদনানের শেষ কথাটা শুনতে পেয়ে হাসতে হাসতে পাশে এসে বসল। তারপর বলল, ‘তাহলে ভাব তুই কত ইউসলেস? যেখানে তোর হাঁটুর বয়সী পোলাপান প্রেম করে বেড়ায়, সেখানে তুই বুড়ো-দামড়া হয়েও একটা প্রেম করতে পারলি না।’

আদনান সোজা হয়ে বসে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রাফিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই নিজে প্রেম করিস?’

রাফি ইতস্তত বোধ করল। প্রেম! এই জিনিসটা তো তার জীবনেও এসেছে কিন্তু সেটা শুধুমাত্র একপাক্ষিক। অবশ্য এটাকে প্রেম বলাও ভুল, প্রেম জিনিসটা অন্য রকম। লোক দেখানো একটা ব্যাপার থাকে প্রেমের মধ্যে। কামুকতা, চাহিদা থাকে এখানে। গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড নামক দুটি প্রাণী থাকে, যারা দিনশেষে ছোটে সোশ্যাল মিডিয়ার নানান সাইটে নিজেদের কাপল হিসেবে প্রমাণ করতে। কিন্তু রাফি তো এই জিনিসগুলো একদম পছন্দ করে না। সে চায় শুধুমাত্র জুহির একটুখানি সান্নিধ্য। দিনশেষে একটা মানুষের ভালোবাসায় ছুটতে চায় সে এবং তার মন।
তাই আদনানের প্রশ্নের পিঠে ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘না।’
তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘এখন বল? হঠাৎ জরুরি তলব কিসের জন্য?’

‘দোস্ত চল আমরা একটা ট্যুরে যাই। অনেকদিন বসে থাকতে থাকতে একদম বোর হয়ে গেছি। পরীক্ষাও শেষ, হাতে বহুত সময়। চল চল, ঘুরে আসি কোথাও থেকে।’ প্রান্ত বলল।

রাফি খানিক ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ যাওয়া যায়। তবে আমি কতটা সময় দিতে পারব জানি না। তবে ব্যবস্থা করব কিছু একটা। আর যাচ্ছি যখন তখন বড় ভাইদেরও বলি। সবাই মিলেই ঘুরে আসি। তো কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছিস?’

আদনান বলল, ‘সাজেক যাব।’

প্রান্ত বলল, ‘উহু রাঙ্গামাটি না হয় বান্দরবান যাব। সাজেক আমি এর আগে বহুবার গেছি।’

আদনান সাপের মত ফণা তুলে কিলবিল করে বলল, ‘তুই গেলে যেতেই পারিস কিন্তু আমি এইবার সাজেক’ই যাব।’

‘এতো সাজেক যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে বিয়া কইরা বউ নিয়া হানিমুনে যা ব্যাটা।’

আদনান অদৃশ্য একটা লাথি মেরে বলল, ‘যা শালা। যেখানে গার্লফ্রেন্ড নাই সেখানে তুই আমারে বউ নিয়ে খোঁটা মারোস? ঠ্যাঙায়ে হাত-পা ভাইঙ্গা দিমু। এত সোজা? আমি একবার যখন বলছিস সাজেক যাব তার মানে আমি সাজেক যাব।’

রাফি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে দুজনের ঝগড়া দেখছিল। দুজনে দুই সতীনের মত চুলোচুলি শুরু করছে। এমন ঝগড়া তো মেয়ে মানুষের দ্বারাও সম্ভব না। রাফি পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে সময়টা দেখে নিল। তারপর দুইজনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোদের ঝগড়া শেষ হলে এইবার আমরা আসল কথায় আসি?’

আদনান প্রান্ত দুজনেই চুপ করে রাফির দিকে তাকাল। রাফি বলল, ‘তোদের দুজনের বোধ হয় এই দেশে ঘোরার জায়গা পোষাচ্ছে না। তোরা বরং অন্য একটা গ্রহে চলে যা। সেটাই তোদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো হবে, আই থিঙ্ক।’

আদনান মেজাজ গরম করে অন্যদিকে চেয়ে রইল প্রান্তও কিছু বলল না। মিনিট দুয়েক বাদে আদনান হঠাৎ করে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠল, ‘আরে মাম্মা, আইতাছে রে।’
প্রান্তর সাথে মাত্রই আদনানের এক দফা ঝগড়া হয়ে গেল। তাই সে আদনানের কথার জবাব না দিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। আর রাফি জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

‘আরে পাশের বাড়ির মাইয়াডা। কি জানি নাম? ফিতা না মিতা?’
টাস্কি লাগা দৃষ্টিতে এইবার রাফিও পাশ দিকে ঘুরল। আর তখনই মিতাকে চোখে পড়ল। সে এই দিকেই আসছে। পরনে কলেজ ড্রেস, কলেজ ছুটির পর এইখান দিয়ে যাচ্ছিল আর তাদের দেখতে পেয়ে চলেও এসেছে।
রাফি অসহায় দৃষ্টিতে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল। তাদের চোখে মুখে চাপা হাসি খেলা করছে।
মিতা তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এল তিনজনের দলটার দিকে। এসেই ন্যাকা সুরে হাত নেড়ে বলল, ‘হাই। কেমন আছ তোমরা সবাই? কতদিন পর তোমাদের সবার সাথে দেখা হল। তোমরা তো আমাকে ভুলেই গেছ।’

আদনান এগিয়ে এসে টানা সুরে জবাব দিল, ‘মি—তা, তোমার দেখা পাওয়ার পর আমরা কখনো খারাপ থাকতে পারি মি—তা? তুমি ভালো আছ মি—তা?’

‘হ্যাঁ ভালো আছি। তোমাদের দেখতে পেয়ে চলে এলাম।’ তারপর সে রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার রাফি তুমি তো বোধহয় আমাকে একদম ভুলেই গেছ। গান বাজনার মধ্যে ডুবে গেছ আর আমার সাথে দেখাও করো না।’

রাফি খাবি খাওয়া মাছের মত উল্টে পাল্টে তাকাল। সে কেন এই মেয়েটার সাথে দেখা করবে? হোয়াই? কোনো কারণ আছে? অসহ্য। রাফি কিছু বলার আগেই প্রান্ত এগিয়ে এসে বলল, ‘ওর কথা বাদ দাও তো আপাতত। ও তোমাকে মনে করে কি করবে? এইতো আমি যে দিন দুপুরে, প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে মনে করি, সেটা বুঝি কিছু নয়?’

মেয়েটা আবার ন্যাকা সুরে বলল, ‘যাক তবুও তুমি আমায় মনে করো। শুনে ভালো লাগল।’

রাফি মনে মনে হাসল। ওই তো টিভিতে অথবা ইউটিউবে আমরা যে শাকচুন্নি পেত্নীদের ভিডিও দেখানো হয়, এই মেয়েটার কণ্ঠ একদম ওইরকম। একটুও কোন দিকে কোন কমতি নেই।
মিতা দু’জনের সাথে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছিল। রাফি নির্বিকার দর্শক হয়ে সবটাই পরখ করছিল। একপর্যায়ে সে রাফিকে বলল, ‘হেই রাফি! হোয়াই আর ইউ সাইলেন্ট?’

‘আসলে ভেবে পাচ্ছি না, আমার কি বলা উচিত।’

‘আর্শ্চয। কথা বলার আবার অভাব হয় নাকি? আমি কি ভেবেছি জানো?’

রাফি মনে মনে বলল, ‘তোমার ভাবনা জেনে আমার কোন কাজ আছে? এসব জেনে আমার লাভ কি? কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে মুখে বলল, ‘কী?’

মিতা চোখে মুখে অদ্ভুত মুদ্রা ফুটিয়ে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল। মুখে হাত দিয়ে চাপা হেসে বলল, ‘আমি তোমার এই বন্ধু দুজনের সাথে প্রেম করব।’

রাফি বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘দুইজনের সাথেই?’

‘হু হু।’

এইদিকে আদনান আর প্রান্ত একে অপরের দিকে তাকাল। দুজনের দৃষ্টিতেই বিভ্রান্তি খেলা করছে। এই মেয়ে তো ভীষণ সাংঘাতিক! তারা দুইজন জাস্ট টাইম পাসের জন্য তার সাথে ফ্লার্ট করছিল, আর সে কি না উল্টো চাল দিয়ে দিল? মেয়ে আবার বড় মুখ করে বলে, দুইজনের সাথেই প্রেম করবে। ও মাই গড!
সহসা আদনান প্রান্ত দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। কী বুঝল কে জানে? কিন্তু দু’জনেই ছিঁড়ে কেটে দু’দিকে দৌঁড়াল।
মিতা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আদনান দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলল, ‘আমি কিছুতেই এই উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ের সাথে প্রেম করে আমার সতীত্ব খোয়াতে চাই না।’
কথাটা অবশ্য মিতার কান পর্যন্ত এল না। সে রাফির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হল? ওরা দৌঁড়ে পালাল কেন?’

রাফি হাসতেও পারছে না, আবার চুপ করেও থাকতে পারছে না। তাই কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল, ‘আসলে ওদের মাথায় সমস্যা আছে। গতবছর পাগলা গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছে। মাঝে মাঝে পাগলামি টা একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে।’

মিতার চোখ মুখ থেকে এখনও বিস্মিত ভাবটা কাটে নাই। সে বলল, ‘দুজনের একসাথে?’

‘হ্যাঁ। আচ্ছা আজ আমি আসছি, আমার একটু জরুরী কাজ আছে।’
এই বলে রাফি আর একমুহূর্তও ওখানে অপেক্ষা করল না। তড়িঘড়ি করে ছুট লাগাল। এই মেয়ের সাথে স্বেচ্ছায় কথা বলা আর কুমির ভর্তি নদীতে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।

রাফি সোজা স্টুডিওতে চলে এল। আজ রেকর্ডিং বাদেও সে একটা বিশেষ কাজে এসেছে। কিন্তু সেই সুযোগটা কতটুকু উপযুক্ত হবে রাফি সেটা জানে না। জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। সে শুধু জানে, তার সুযোগটা চাই’ই চাই। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে চাই।
তবে আজ আর ডিরেক্টরকে পাওয়া গেল না। একজন জানাল, সে একটা শুটিংয়ে বান্দরবান গেছে।
তাই আজ আর রাফির কথা বলার সুযোগ টা হল না। সে গানে মনোনিবেশ করল।
.
জুহির সকল কাজ সম্পন্ন করতে করতে রাত প্রায় আটটা বাজল। সে ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখতেই জাহিন এসে উপস্থিত হল। জুহিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ও তুমি এখনো রয়েই গেছ? আমি ভাবলাম চলে গেছ বুঝি।’

‘না জাহিন ভাই, কাজ শেষ না হতে যাই কিভাবে? আপনি কখন যাবেন?’

‘এইতো বের হব এক্ষুনি। চলো তোমাকে পৌঁছে দেই। একা যেতে হবে না।’

জুহি কিছু একটা ভেবে বলল, ‘আচ্ছা চলুন।’
দুজনে বের হয়েছে একসাথেই। এমন সময় রাফিও বের হয়েছে স্টুডিও থেকে। পথিমধ্যে জুহিকে একটা ছেলের সাথে দেখতে পেয়ে অদৃশ্য কিছু একটা বুকের মধ্যে কামড় দিল। ছেলেটা কে হতে পারে? এই রাতে জুহি’ই বা ওর সাথে কেন? বিক্ষিপ্ত ভাবনা মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিল। রাফি একআকাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফিরে কারো সাথে কোন কথা বলল না, সোজা ঘরে এসে দরজায় খিল আঁটল। এরই মধ্যে মা যে কতবার খেতে ডাকতে এসেছিল তার হিসেব নেই, বাবাও এসেছিল একবার— রাফি ঘুমের ভান ধরে মটকা মেরে শুয়েছিল।
কিছুক্ষণ বাদে সে সটান উঠে বসল। এভাবে উল্টাপাল্টা ভেবে মাথা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। সে ফোন হাতে নিল।
কোন রূপ ভণিতা বিহীন জুহিকে মেসেজ করল, —“সাথের ছেলেটা কে ছিল?”

জুহি সবে মাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবে, এমন সময় মোবাইলে টুংটাং আওয়াজ কানে ভেসে এল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাফি মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজটা দেখেই তার ভুরু কুঁচকে গেল। তৎক্ষণাৎ মেসেজের মানে বুঝতে না পেরে সে পাল্টা লিখল, —“আমাকে বলছেন? নাকি ভুল করে মেসেজ পাঠিয়েছেন?”

রাফি তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই দিল, —“আপনাকেই বলছি। একটু আগে একটা ছেলের সাথে আপনাকে আসতে দেখলাম। সে কে?”

জুহির মনে পড়ল জাহিনের কথা। একটু আগে তার মানে জাহিনের সাথে জুহিকে রাফি দেখেছিল। আর তার ভিত্তিতেই এসব কথা বলছে।
সে লিখল, —“আজকাল বোধহয় খুব নজরদারি করছেন? আমার পিছু নিয়েছিলেন কেন? সমস্যা কি, হু?”

—“অনেক সমস্যা কিন্তু আপনাকে সেসব বলতে বাধ্য নই আমি। আপনি বলুন ছেলেটাকে ছিল?”

—“আমি কী আপনাকে সেই ছেলেটার পরিচয় দিতে বাধ্য?”
রাফি জুহির শেষ মেসেজটা পড়ে একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। মনটা বড্ড বিষাদ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে নিমিষেই। সে ধীরগতিতে বেশ বড়সড় একটা মেসেজ টাইপ করে সেন্ড করল কাঙ্খিত ঠিকানায়।
জুহি মেসেজটা দেখল, —“আমি জানিনা কিছু। শুধু জানি, তখন দেখা সবটাই আমার ভ্রম। এটাও জানি, আপনার জীবনে কেউ নেই, আমিও না। কিন্তু সত্যি আমার খুব কষ্ট লেগেছে। একটা মানুষ যাকে আমি… না আমি না— আমার মন নিজের বলে দাবি করে সেই মানুষটা অন্য করো সাথে থাকবে কেন? কেন তার হাঁটার পাশের খালি জায়গাটায় অন্য কেউ স্থান পাবে? আমি হয়ত অনেক বেশি বিরক্ত করি আপনাকে, ভিত্তিহীন সব যুক্তি দাঁড় করাই আপনাকে ভালোবাসার। কিন্তু আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবেসেছি বলেই তো অকপটে ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছি। যখন ভালোলাগা ছিল, যখন মোহ ছিল তখন তো ভালোবাসার কথা বলি নাই। আমি আপনার সর্বনাশা হাসি ভালোবাসি, আপনি মাঝে মাঝে চোখে মুখে অদ্ভুত মুদ্রা ফুটিয়ে আমার দিকে তাকান আমি সেই দৃষ্টিকে ভালোবাসি, আমি আপনার রাগ ভালোবাসি। তবে হ্যাঁ, আমি কিন্তু আপনার থেকে আপনার বৈশিষ্ট্য গুলোকেই বেশি ভালোবাসি…. এবং ভালোবাসবো। সেটা যেমনই হোক না কেন আর যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন!”
.
.
.
চলবে….

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-১৩]
~আফিয়া আফরিন

রাফি পরদিন সরাসরি আজাদ মল্লিকের সাথে দেখা করল। আবদার করে বসল একটা প্রায় অসম্ভব কাজের।
তিনি রাফির কথা শুনে প্রথমেই কিছু বলতে পারলেন না। পরে থেমে থেমে বললেন, ‘মানে তুমি যা বলছ ভেবে বলছ তো? তুমি করতে পারবে এই কাজটা? যতটা সোজা ভাবছ এটা কিন্তু ততটা সোজা না।’

রাফি দৃঢ় গলায় উত্তর দিল, ‘ততটা কঠিনও না। আমার চাওয়া যে আপনাকে পূরণ করতে হবে ব্যাপারটা তো এমন নয়, আমি বলেছি আমি একটা সুযোগ চাই। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তবে, ঠিক না থাকলে আমি নিজেই সরে আসব।’

এইবার তিনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। রাফিকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘দেখো রাফি তুমি বাচ্চা মানুষ…..।’

রাফি তার কথা কেড়ে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি পারব।’

পরিচালক হতাশ ভঙ্গিতে তাকালেন। তার সাথে রাফির সম্পর্কটা একটু অন্যরকম, সবার চেয়ে আলাদা—বিশেষ ধরনের। নানান দিক ভেবেচিন্তে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। রাফি ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবছে, এটা আসলে তার চেয়েও কঠিন। গান গাওয়া আর গান লিখে তাদের সুর দেওয়া দুটো সম্পন্ন আলাদা বিষয়। তবুও, একটা সুযোগ দেওয়া যায়।
বেশ ভাবনা-চিন্তা করে তিনি রাফির উদ্দেশ্য বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি চেষ্টা করো নিজের সাধ্য মত। তারপর আমি দেখি কী করা যায়।’
কথাটা তিনি মুখ দিয়ে বললেন ঠিকই কিন্তু রাখি তার কথায় ভরসার ইঙ্গিত খুঁজে পেল না। অর্থাৎ তিনি এখনো রাফিকে ভরসা করতে পারছেন না। ঠিকই আছে। এই কাজে ভরসা করার মত যোগ্যতা হয়ত এখনো রাফির হয়ে ওঠে নাই। তবে সে পারবে, এটা নিজের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস।
সে উঠতে উঠতে বলল, ‘আমি আপনাকে নিরাশ করব না।’

রাফি ওখান থেকে বেরিয়ে মাহিদের কাছে এল, অজানা কারণেই। মাহিদের সাথে টুকটাক গল্প করল, জুহির প্রসঙ্গ টেনে আনতে চেয়েও বারবার পিছিয়ে গেল। জুহির কথা বলতে গেলেই কেমন কন্ঠ আরষ্ট হয়ে যায়, জড়তা এসে ভর করে। মাহিদ ভাই যদি কোনোভাবে বুঝে যায়?
কিন্তু জুহির কথা জানতে ইচ্ছে করে তো! জুহি তো ইদানীং নিজ থেকে কথাও বলে না। আর রাফি যে একটুখানি কথা বলার জন্য চাতকের ন্যায় তৃষ্ণার্ত থাকে সেটা বোঝে না।
তবে এই যাত্রায় জুহির কথা রাফিকে নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতে হল না। মাহিদ নিজেই বলল, ‘হ্যাঁ রে জুহির সাথে তোর দেখা সাক্ষাৎ হয়?’

রাফি ঘাবড়ে গেল। হঠাৎ জুহির প্রসঙ্গ? তাও আবার এত অযাচিত ভাবে? যদি আবার কোনভাবে রাখির কথা বলে দেয় নাই তো? আর দিলেও বা কী? সে থোরাই কেয়ার করে এসব? তবুও রাফি আমতা আমতা করতে লাগল, ‘না তো। আমার সাথে আবার ওনার কোথায় দেখা হবে? ওইযে একবার রাব্বি ভাইকে রক্ত দিতে এলো তখন হাসপাতালে দেখা হয়েছিল, এরপর আর না। কিন্তু হঠাৎ এই কথা কেন ভাই?’

‘এমনি জিজ্ঞেস করলাম। তবে তুই ভুল বললি। তোর সাথে জুহির শেষ দেখা হয়েছিল তোদের ক্যাম্পাসের একটা গানের অনুষ্ঠানে। জুহি আমাকে বলেছিল তোর গানের কথা।

রাফি মাথা চুলকে বলল, ‘ও আচ্ছা ভুলে গেছিলাম আমি।’
তারপর মাহিদ রাফির পিঠ চাপড়ে বলল, ‘তো কি খবর? যেখানে তোর সাথে আমাদের টিকেট কেটে দেখতে যাওয়ার কথা, এখানে তুই নিজে দেখা দিতে এসেছিস? ব্যাপার কি ছোট ভাই?’

‘পর করে দিচ্ছ নাকি?’

‘কে আমি? দুইদিন পর দেখা গেল তুই’ই আমাদের চিনলি না। রাস্তাঘাটে দেখা হলেও বলবি, পরিচয় হয়ত ছিল একসময় কিন্তু এখন তো আর নেই।’

রাফি হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বলল, ‘ধুর যতসব ফালতু কথা। বড় ভাই হিসেবে তোমরা আছ সবচেয়ে উপরে। আমার সবকিছুতেই তোমাদের অবদান। তোমাদের এত সহজে ভুলব তাই?’

মাহিদ হাসতে হাসতে বলল, ‘জানি রে ভাই জানি। আমার আরেকটা বোন থাকলে কিন্তু আমি তোর সাথে বিয়ে ফাইনাল করতাম।’
কথাটা শোনা মাত্র রাফির পিলে চমকে উঠল। সে কিয়ৎক্ষণ যাবত হা করে চেয়ে রইল। রাফির মুখটা তখন খাবি খাওয়া মাছের মত হয়েছিল। সেটা দেখে মাহিদ পুনরায় বলল, ‘আরে ভাই হা করে আছিস কেন?….’

এমন সময় মাহিদের ফোন বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর রাফি তখন মাহিদের ওই কথাতেই স্থির। জুহির মুখটা অকপটে চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে।
.
জুহির জীবনটা আসলেই একটু অন্যরকম, একটু না পুরোটাই অন্যরকম। অদ্ভুত জীবন যাপন তার। পাশের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে থাকে সীমা নাম, মাঝে মাঝে এসে জুহির সাথে গল্প গুজব করে। মেয়েটা গত ৮ মাস আগে বিয়ে করেছে পরিবারের অমতে, যাকে পছন্দ করে তার সাথে পালিয়ে এসেছিল। দুজনের রংপুর থেকে ঢাকা শহরে এসে ছোট্ট একটা সংসার পেতে ছিল। আজ হঠাৎ মেয়েটা এসে কী কান্নাকাটি! তার স্বামী নাকি বদলে যেতে শুরু করেছে। তার অফিসের এক কলিগের সাথে নাকি সম্পর্কে জড়িয়েছে।
জুহি বোঝেনা, মানুষগুলো এমন কেন? যে মানুষটার জন্য একটা মেয়ে ঘর ছেড়েছে, তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বেছে নিয়েছে, সেই মানুষটার প্রতি এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কেন? কেন সেই এক নারীতে আসক্ত হওয়া যায় না? কেন তাকে নিজের মতো করে মানিয়ে নেওয়া যায় না? একটু চেষ্টা করলেই তো হয়। নারী ভালোবাসার কাঙ্গাল। তাকে এক বিন্দু ভালোবাসা দিলে, সে এক সমুদ্রের পরিমাণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিবে। এই ক্ষমতা নারীর আছে।
জুহির অফিসে আরেকজন মেয়ে, নাম সাথী। সেও বিয়ে করেছে প্রায় এক বছর আগে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, তবুও সংসারে কোন অশান্তি নেই। সে মাঝে মাঝে নিজের সুখের গল্প শোনায়। তার জীবনে আসা মানুষগুলো কতটা ভালো, সেগুলো নিয়ে গর্ব করে।
এই ঘটনাগুলোই জুহির মাথায় ধরে না। একটাই পৃথিবী অথচ দুটো ভাগ হয়ে গেছে। একদিকের মানুষ কত সুখী, আর এক দিকের মানুষ নিঃস্ব। তারা চেয়েও কিছু পায় না। সৃষ্টিকর্তা তাদের ভাগ্যে কি লিখেছে কে জানে?
এত কিছুর পরেও জুহি ভালোবাসা বিশ্বাস করবে? যদিও ভালোবাসায় ভালো খারাপ দুটোই আছে। তবুও! সে তো ঘর পোড়া গরু। পৃথিবীর নিঃস্বতার দিকের সদস্য তো সে নিজেও। তারপরেও ভালোবাসার সাহস দেখাবে? অসম্ভব!
সাথী অথবা সীমা, দুজনের কাহিনী শুনেই জুহির চোখ ভিজে উঠেছে। বুক ধুকপুক করেছে। একজনের মধ্যে নিজের বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখেছে আর একজনের মাঝে নিজের বাবা-মায়ের সুখ খুঁজেছে। তাহলে তো বলাই যায়, অনুভূতিরা এখনও একেবারে মরে যায় নাই।

সেদিন জুহি অফিস যেতেই তামিমের কাছে শুনল চেয়ারম্যান সাহেব নাকি তাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। জুহি মানা করে দিল। বলল, ‘আমি এসব লো মেন্টালিটির মানুষজনের সাথে দেখা করতে পারব না। আপনাদের দেখা করার দরকার হলে, আপনারা নিজেরাই যান।’
জুহি গেল না বলে কারোরই আর যাওয়া হল না। কেউ আগ্রহী নয়।
জুহি বারবার জাহিনকে বলল, ‘দেখেন ভাই, ডেকেছে যখন যান। কী বলে, শুনে আসেন। ব্যক্তিগতভাবে উনাকে আমার পছন্দ নয়, তাই আমি যাব না। আপনারা যান। সমস্যা কি?’

জাহিন ব্যাপারটা পাত্তাই দিল না। উল্টো হাত নাড়িয়ে এড়িয়ে গেল। জুহিও আর ঘাটাল না। এরপর কিছু সময় চোখের পলকেই কেটে গেল। জুহির কাজের গতি বাড়ছিল। পড়াশোনা আর টিউশনি মাঝখানে। দুইদিকে সময় দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে একটা টিউশনি ছেড়ে দিল। কারণ, ওইটা একটু দূরে ছিল। সারাদিনের কাজকর্মের পর এত জার্নি আর শরীরে সয় না। এরই মধ্যে একদিন শোনা গেল তাদের দু’টো মেয়ে নিখোঁজ। পুলিশও খোঁজখবর চালাচ্ছে, কিন্তু কোনোভাবেই সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ এই সম্পর্কেও সন্ধিহান যে, মেয়ে দু’টো কি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে নাকি কেউ তাদের কিডন্যাপ করেছে‌। কিডন্যাপ যদি করে, তবে মুক্তিপণ আসার কথা। কিন্তু সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়ার পরও কোনো মুক্তিপণের জন্য ফোন এল না। তাই পুলিশ একপ্রকার বাধ্য হয়েই কেছ অফ করে ছিল।
.
রাফি আজ বাড়ি ফিরল রাত করে। তার কাছেই ডুপ্লিকেট একটা চাবি ছিল। দরজা খুলে মাকে দেখতে পেল। অপেক্ষা করতে করতে সোফায়’ই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাফি ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত প্রায় দুইটা। এতো রাত করে বাড়ি ফেরাটা আসলেই উচিত হয় নাই। বাবা এসব একদম পছন্দ করে না। রাফি চোরের মত পা টিপে টিপে ডাইনি ক্রস করতেই মা পেছন থেকে ডেকে উঠলেন।
রাফি থমকে দাঁড়াল। আজ নিশ্চিত কপালে দুঃখ আছে।
মা এগিয়ে এসে বললেন, ‘কি ব্যাপার? আজ এত দেরি করে বাড়ি ফিরলি যে?’

রাফি হাই তুলে বলল, ‘একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম।’

‘কাজ? এত রাতে তোর কি কাজ? ইদানিং দেখি প্রায় রাত করে বাড়ি ফিরেছিস। তোর বাবাকে বলব নাকি?’

রাফি মুচকি হেসে বলল, ‘কী দরকার বলতো? আমাদের সিক্রেট আমাদের মধ্যেই থাকুক। বাবাকে কেন টানছ?’

‘হুঁ। ঘরে একটা বউ থাকলে সব ঠিক হতো‌। তোকে বিয়ে দিয়ে বাড়িমুখো করতে হবে বুঝেছি।’
রাফি কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হা‌সতে হাসতে ঘরে গেল। মাকে জানিয়ে দিল, সে খেয়ে এসেছ। তাই আর খাবে না।
রাফি ঘরে গিয়ে দক্ষিণ দিকে বারান্দায় গিয়ে বসল। শব্দ সাজানো দরকার। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেসব কিছুই হয়ে উঠছে না। কিন্তু সাজানো প্রয়োজন। রাফি মনে করতে লাগল তার স্বপ্নের দিনগুলো। দখিনা হাওয়া খুব আলতো ভাবে তার শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করে ভাবছে……ভেবেই যাচ্ছে। স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে প্রিয় মুখ, প্রিয় মানুষ।
রাফি চলছে, তার সাজানো স্বপ্ন চলছে খুব ধীর গতিতে…..আবার স্বপ্ন চলছে তড়িৎবেগে। রাফির ওষ্ঠ্যদ্বয় আপনাআপনি হাসিতে প্রসারিত হয়ে উঠল। সে চোখের সামনে তার প্রতিক্ষীত কল্পনার রাজ্যে দেখতে পাচ্ছে।
.
.
.
চলবে……