মন কারিগর পর্ব-৮+৯

0
89

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৮]
~আফিয়া আফরিন

জুহিকে ফোন করা যায় একবার, ফোন নাম্বার তো রয়েছেই। কিন্তু এমনিতেই যা রাগী স্বভাবের মানুষ, সামনাসামনি কথা বলে কী কাঠ-খোট্টা ভাবে! ফোন করলে আবার ধমক দিয়ে বসবে না তো?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন করেই ফেলল রাফি। প্রথমবার ফোন বাজতেই ধরল জুহি। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল কে? এদিকে রাফি তো আরেকদফা বাকরুদ্ধ! একটা মানুষের কণ্ঠ এতো সুন্দর কীভাবে হয়? সে তো আগেও কতবার জুহির কণ্ঠ শুনেছে তার সাথে কথা বলেছে, কখনো তো এতটা আকর্ষণীয় মনে হয় নাই। নাকি সবটাই তার ভ্রম? প্রেমে পড়ছে বলে এরকম উদ্ভট ব্যাপার স্যাপার মাথায় আসছে? আসতেই পারে। প্রেমে পড়লে মানুষের মন মস্তিষ্ক এমনিতেই এলোমেলো হয়ে যায়।
জুহি বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে গেল।
এইবার রাফি আমতা আমতা করতে করতে উত্তর দিল, ‘আমি—আমি বলছিলাম। চিনতে পেরেছেন?’

‘পরিচয় না দিলে চিনব কিভাবে? কে আপনি?’ ধমকের সুরে বলল জুহি।
বাবারে মেয়ের কথার কী ধার। কথা দিয়েই অন্তরাত্মা একদম ফালাফালা করে দিবে। রাফি ধীর কণ্ঠে জবাব দিল, ‘রাফি বলছিলাম। চিনতে পেরেছেন এখন?’

রাফি নামটা শুনে জুহি ভুরু কুঁচকাল। এই ছেলে তার ফোন নাম্বার কোথায় পেয়েছে? আর এইরকম চিনা জোকের মতো লেপ্টে রয়েছে কেন? আশ্চর্য!
‘আপনি আমায় ফোন করেছেন? ফোন নাম্বার কোথা থেকে পেয়েছেন আপনি?’

‘আসলে আপনার সাথে খুব দরকারী একটা কথা ছিল এই জন্য ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করেছিলাম। তবে এখন ফোন করেছি অন্য একটা কাজে।’

জুহি বেশ বিরক্ত হল। তবে কথায় সেটা প্রকাশ করল না। বলল, ‘আচ্ছা বলুন।’

‘ক্যাম্পাস থেকে চলে এসেছেন নাকি? আশেপাশে কোথাও দেখছি না যে, খুঁজলাম অনেকক্ষণ আপনাকে।’

‘হ্যাঁ। চলে এসেছি আরও বেশ কিছুক্ষণ আগেই।’

‘ওহ। আমি একটা নাটকের জন্য গানের অফার পেয়েছি আজকে। তাই ভাবলাম আপনাকে জানাই।’

জুহি বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘ও মা তাই নাকি? এটা তো খুবই ভালো খবর। আপনার যে গানের গলা, সামনে আরো বড় কিছু করার সুযোগ পাবেন, ইনশাআল্লাহ।’

‘দোয়া রাখবেন।’

‘জি অবশ্যই। তো গানের শ্যুট কবে? দিন তারিখ ঠিক হয়েছে?’

‘না এখনো ঠিক হয় নাই। ঠিক হলে আপনাকে জানাব।’

‘আচ্ছা। তবে, এত বড় একটা সুসংবাদ উপলক্ষে মিষ্টি পাওনাটা কিন্তু তোলা রইল। জানেন না, সুসংবাদ খালি হাতে দিতে নেই!’

রাফি হেসে বলল, ‘সুদ সাময়িক ফেরত দিব!’
তারপর জুহি আরো দুই এক কথা বলে ফোন রেখে দিল। রাফি মনখোলা আনন্দে হেসে উঠল। সে নিজেই নিজেকে বলল, এই আনন্দ তোমার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হোক রাফি!

জুহিদের অফিসে কয়েকদিন ধরে বেশ বড়ো একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। গতবছরের শেষের দিকেই কমিশনার সাহেবের সাথে কথা বলেছে একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠনের বিষয়ে। কমিশনার অনুমতি দিবেন দিবেন করেও ঝুলিয়ে রেখেছে, এইদিকে ‘আমি নারী’ সংস্থার সব সদস্যদের প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠনও হয়ে গেছে, শুধু অনুমতির অপেক্ষায়।
জাহিনের সাথে কথা বলে জুহি সিদ্ধান্ত নিল, সে নিজে গিয়ে কমিশনারের সাথে দেখা করে আসবে। এই নিয়েই বেশ ব্যস্ত সময় কাটছে।
একদিন সময় সুযোগ বের করে জুহি কমিশনার সাহেবের বাড়ি গিয়ে হাজির হল। অনেকক্ষণ যাবত সে বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। এরা বড়ো বড়ো পদস্থায়ী মানুষ বোধহয় সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করাতে ভালোবাসে।
অবশেষে একঘন্টা পর কমিশনার সাহেবের দেখা মিলল। তিনি প্রথমেই জুহিকে দেখে রগরগে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘তোমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠনের অনুমতি তো দিতে পারছি না। আসলে উপরমহল থেকে অনুমতি আসছে না।’

জুহি বিস্মিত হল। এতোদিন অপেক্ষা করে তাদের এই কথা শুনতে হবে, এটা কল্পনাতেও আসে নাই। সামনে থাকা লোকটাকে অনুরোধ করতেও তার রুচিতে বাঁধছে। কেমন চোখের চাহনি, ভাবভঙ্গি অন্যরকম।
সে কাঠকাঠ কণ্ঠে বলে, ‘তাহলে আপনি বলছেন আমরা অনুমতি পাব না?’

‘না পাবে না। চেয়ারম্যান সাহেব অনুমতি দিতে নারাজ। তোমরা বাচ্চা মানুষ, বয়স কম; কী থেকে কী করবে? তিনি তোমাদের ভরসা করে এতোবড়ো দায়িত্ব দিতে পারছেন না।’

জুহির গলার স্বর ফের কঠিন হল। ‘আমরা বাচ্চা মানুষ? যেখানে আপনারা বুড়ো মানুষ হয়েও হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন, সেখানে তো আমাদের বাচ্চাদের ই দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। সমাজের অবস্থা তো আপনাদের চোখে পড়ে না? পড়বে কী করে, খেঁটে তো আর খেতে হয় না। তিনবেলা দশতলা বিল্ডিং এর নিচে এসিরুমে শুয়ে বসে আপনাদের দিন কাটে, মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা একাউন্টে জমা হয়। ব্যাস, আর চিন্তা কিসের? আপনাদের লাইফ সেটেল।’
জুহি কমিশনারকেও আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হনহন করে হাঁটা দিল।
কমিশনার সেই দিকে চেয়ে ওষ্ঠকোণে ক্রুদ্ধ হাসি বলল, ‘মেয়ের তেজ!’

জুহি বাহিরে বের হতেই ফোন বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রাফির নাম্বার দেখে সপ্তমে চড়ে থাকা মেজাজ অষ্টমে পদার্পন করল। বিরক্তি রাগ সব মিলিয়ে ফোন রিসিভ করল। রাফি ফোন করেছিল আগামীকাল তার গানের ফাইনাল কার্যক্রম, এই ব্যাপারটা জানানোর জন্য। কিন্তু জুহি ফোন ধরেই যে রামধমক দিল, তাতে সে আর কিছু বলার অবকাশ পেল না। চুপচাপ জুহির কথা শুনল। রাফির নির্বিকার ভাবভঙ্গি দেখে জুহি নিজেই ফোন রেখে দিল। হ্যাঁ, এখন বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। কমিশনারের উপর করা রাগ অনায়াসে রাফির উপর ঝেড়ে দিল। আর রাফি সেটা চুপচাপ হজম করে গেল। তারপর জুহির যখন হুঁশ ফিরল, তখন বারবার নিজের উদ্দেশ্য বলল, এটা আমি কী করলাম? কার রাগ কার উপর দেখালাম?
নিজের প্রতি বিরক্তির মাত্রা আরও দ্বিগুন হল। তপ্ত মেজাজ নিয়ে অফিসে পৌঁছাল। সবাই যেন জুহির অপেক্ষাতেই ছিল। কিন্তু জুহির কথা তাদের নিরাশ করে দেয়। অনুমতি না দেওয়ার কারণ সম্পর্কে কেউ অবগত হতে পারছিল না। জুহির আর সেদিন কোনো কাজে মন বসল না। অকারনেই রাফির সাথে খারাপ ব্যবহার করে নিজের কাছে এখন খারাপ লাগছে। ফোন করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত মন শান্ত হবে না।

এইদিকে রাফি জুহির ভাবভঙ্গি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। কখন রেগে থাকে, কখন খুশি থাকে এটা বোধহয় আল্লাহ ছাড়া কেউ ভালো জানে না। আজকের এই রামধমকের পর রাফি কি পরবর্তীতে আর জুহির কাছে ফোন করার সাহস পাবে? না করেও তো উপায় নেই। ওই সর্বনাশী দেবীর কণ্ঠে যে মাদকীয়তা বিস্তার করছে।

ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরল জুহি। গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে ফ্রেশ মন নিয়ে রাফির কাছে ফোন দিল। রাফি জুহির ফোনে আশ্চর্য বনে গেল। এই প্রথম, হ্যাঁ আজকে এই প্রথম জুহি নিজ থেকে তাকে ফোন করল। রাফি এতটাই বিস্মিত হয়েছিল যে পরপর দুইবার ফোন বেজে যাওয়ার পরও তার হুঁশ হল না। হুঁশ হল তিনবারের বার।
ফোন রিসিভ করে কানে তুলেই বলল, ‘হ্যালো, হ্যালো!’

জুহি যথেষ্ট গম্ভীর স্বরে বলল, ‘জুহি বলছিলাম। চিনতে পেরেছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। চিনব না কেন? ফোন নাম্বার তো সেভ করেই রেখেছি।’

‘সকালে ফোন করেছিলেন না? আসলে মনমেজাজ ভালো ছিলো না বিধায় খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। আসলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত!’

‘ওহ সমস্যা নেই। বুঝতে পেরেছি, আপনার মন খারাপ ছিল। তো মন খারাপের কারণ জানতে পারি? বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ নাকি?’ আগ বাড়িয়ে বলল রাফি।

জুহির হাসি পেয়ে গেল রাফির কথায়। যেখানে বয়ফ্রেন্ডের ‘ব’ ও নাই তার জীবনে সেখানে আবার ব্রেকআপ? হাস্যকর!
‘না। অফিসে একটা বিষয় নিয়ে সমস্যায় ছিলাম এইজন্য।’

‘সমস্যা মিটেছে?’

‘উহু, মিটবে বলেও মনে হয় না। যাইহোক, আপনার কথা বলুন। ফোন করেছিলেন হঠাৎ? গানের কী খবর?’

‘ওই খবর দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম। আগামীকাল যাচ্ছি গানের ওখানে। গত কয়েকদিন ধরেই চর্চা করছিলাম, কাল ফাইনালের জন্য ডেকেছে।’

‘ওহ আচ্ছা। শুভকামনা রইল। কি গান গাইবেন?’

ঐ নাটকেরই একটা গান। ফেরারি প্রেম….! এই গান।’

‘ওহ। ভালো করে গাইবেন।’

‘হু। তো একদিন দেখা করেন সময় করে। যাকে রক্ত দিয়েছেন সে তো আপনাকে একটা ধন্যবাদ জানানোর সুযোগই পেল না, মাহিদ ভাইকে গতকাল বলল দেখা করানোর কথা। আর আমার থেকেও আপনার পাওনাটা পেয়ে গেলেন।’

জুহি ভুরু কুচঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার থেকে আবার কিসের পাওনা আমার?’

‘ঐ যে মনে নাই, মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন? ভুলে গেলেন নাকি এত তাড়াতাড়ি? বলেছিলাম তো, সময় হলে সুদ সাময়িক ফেরত দেব।’

‘মনেই আছে আপনার? আমি কিন্তু ফাজলামি করে বলেছিলাম।’ জুহি খানিকটা হেসে জবাব দিল।

‘কিন্তু আমি ফাজলামি করে কথাটা নেই নাই। আচ্ছা বলেন কবে সময় হবে আপনার? কবে দেখা করছেন?’ ফের জিজ্ঞেস করল রাফি।

‘সময় কখন হবে সেটা তো আগে থেকেই বলতে পারব না। তবে সময় হলে একদিন হঠাৎ করেই দেখা করব। আচ্ছা, আজ রাখছি তাহলে। আগামীকাল খুব সুন্দর করে গান গাইবেন, কেমন!’
জুহি ফোন রেখে দিলে রাফি বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর ঝাটপট একটা ডায়েরি বের করে তাতে আজকের দিন তারিখ লিখে রাখল। আজকের দিনটা যে একটু বেশিই স্পেশাল, জুহি নিজে থেকে ফোন করেছে তার ওপর পাক্কা ১৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথাও বলেছে। এটা কী কম? জীবনের সেরা প্রাপ্তির স্থানে আজকের দিনটাকে রেখে দিল রাফি।
.
জীবনের প্রথম এমন একটা মুহূর্ত। রাফি খুব নার্ভাস ফিল করছে। এতদিন খুব ভালো করেই গানের চর্চা করে গেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তীরে এসে তরী ডুবে যাবে! এইবার তার ভাবনা বিফলে গেল না। কয়েক ঘন্টা চেষ্টা করেও সে ঠিকঠাক মতো গান তুলতে পারল না। তার জীবনে প্রথম এত বড় একটা সম্মাননা, স্নায়ু এতটাই উত্তেজিত হয়েছিল যে রাফি গানে মনোযোগ দিতে পারল না। মস্তিষ্ক তাকে বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছিল। যেখানে তার সমস্ত ধ্যান জ্ঞান গানে দেওয়ার কথা ছিল, সেখানে সে বারবার সবকিছু এলোমেলো করে ফেলছিল। শেষমেষ পরিচালক হতাশ হয়ে বললেন, ‘সেদিন তো দেখলাম খুব কনফিডেন্টলি গান গাইছিলে, আজকে হঠাৎ এরকম এলোমেলো করে ফেলছ কেন? দেখো তো, আরেকটু চেষ্টা করো। হলে হবে না হলে ছেড়ে দাও।’

হ্যাঁ, রাফি চেষ্টার কমতি রাখে নাই। বরং নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করেছে। একটা গান সে পাঁচ ঘন্টায় তোলার চেষ্টা করেছে, পরিশেষে ব্যর্থতা! অথচ অন্যান্য সময়ে একটা গান তুলতে দশ মিনিটের বেশি দরকারই হয় না, আর এখন? হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল রাফি‌। আপন মনেই নিজেকে আহাম্মক বলে ধিক্কার জানাল। কত স্বপ্ন, কত আশা, কত বড় মুখ নিয়ে এসেছিল; সবাইকে বলেও রেখেছিল। এখন মানসম্মান বোধকরি সব গেল। পরিচালক রাফিকে সময় দিলেন সাথে এটাও বললেন, ‘এটা তো তোমার প্রথম কাজ তাই তুমি খুব বেশি এক্সাইটেড। নরমাল থাকো, উত্তেজিত হয়ে যেও না। সব ক্ষেত্রে উত্তেজনা মানায় না। সময়ে অসময়ে যেভাবে মন খুলে গান গাও সেভাবেই গাইবে। মনে রাখবে, তোমাকে কিন্তু এখানে কেউ জোর করে নাই। সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজার খানেক লোকের সামনে গান গাইতে পেরেছ, আজ হঠাৎ কী হল? বি নরমাল রাফি।’
.
.
.
চলবে…..

#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৯]
~আফিয়া আফরিন

তারা ভরা বিস্তর গগনের নিম্নপানে নেত্রপল্লব আবৃত করে বসে আছে রাফি। মৃদু হাওয়া সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। রাফি সন্ন্যাসীর ন্যায় ধ্যানে বসেছে। সবসময় যে অতিরিক্ত আশা করতে নেই, এটা তার জীবনে আজ আরেকবারও প্রমাণ হয়ে গেল। এতো আশা আকাঙ্ক্ষা সব এভাবে মূর্ছা যাবে কে জানত? হতাশা আর ব্যর্থতা ছাড়া আজকের দিনে তার জন্য আর কিছুই মিলল না।
আজ গিটারেও সুর উঠল না। শেষে রাফি একপ্রকার বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিল, শখ নামক জিনিসটাকে শখের মধ্যেই আবদ্ধ করে রাখা উচিত। এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলেই সমস্যা। আজকে তো দুঃসাহস দেখিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করতেই গিয়েছিল সে, তার ফলাফলও নিজ হাতে পেয়েছে। এমনি চুপচাপ আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ছাদে পা ছড়িয়ে বসে ছিল রাফি।
হঠাৎ কর্ণকুহরে ভেসে এল নারী কণ্ঠে কারও কথার আওয়াজ।
‘কিরে বাবা এখানে একা একা বসে আছিস? ঘরে ফিরছিস না বলে তোর বাবা আর আমি কী চিন্তা করছিলাম। কতক্ষন অপেক্ষা করে তারপর ছাদে এলাম।’
তৎক্ষণাৎ না দেখলেও রাফির বূঝতে অসুবিধে হল না, এটা তার মা। পিছন ফিরে তাকাল রাফি। মাকে দেখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওষ্ঠকোণে।
হাসিমুখেই বলল, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না মা। আমি ঠিক আছি। রাত হয়ে গেছে তো, তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়ো না!’

সায়রা হক রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মন খারাপ করিস না বাবা। জীবন তো সবে মাত্র শুরু। বেঁচে থাকলে কোন না কোন একদিন তোর স্বপ্ন ঠিক পূরণ হবে। আজ পারিসনি তো কি হয়েছে? চেষ্টা করতে থাক, দশ দিন পর হলেও তো পারবি।’

রাফি উদাস ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি আর কখনোই পারব না মা, এইসব আমার জন্য নয়। আমি আমার বন্ধুদের মাঝে, আত্মীয় পরিজনদের মাঝে গান করি; এটাই আমার জন্য পারফেক্ট। হাজার খানেক দর্শকের জন্য আমি না। আজকের দিনটা এতোটা খারাপ বলে বোঝাতে পারব না তোমাকে। কী ভাবে যেন সবকিছু অগোছালো হয়ে গেলে। অথচ সবকিছু কিন্তু আমার গোছানোই ছিল।’

‘আমার ছেলে হয়ে তুই এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলি? নাহ, এটা তোর কাছ থেকে আশা করি নাই রে। মায়ের কথা শোন, কিছুদিন নিজেকে সময় দে। তারপর আবার শুরু কর, সৃষ্টিকর্তা আর তোকে নিরাশ করবে না।’

‘তোমরা বারবার ভরসা দাও বলেই হয়ত আমি সাহস পাই।’

‘তাহলে এখন চল তো বাবা। ছাদে এতো রাত করে বসে থাকিস না পরে আবার ঠান্ডা লাগবে। গলা বসে গেলে তখন কি করবি? তোর বাবা আমাকে তোকে নিয়েই ফিরতে বলেছে। উঠ দেখি। এত বড় ছেলেকে কী এখন আমি কোলে করে উঠাব?’ আহ্লাদী সুরে বললেন তিনি্
মায়ের কথার অবাধ্য হল না রাফি। হাসি হাসি মুখ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এল।

গতকাল রাতেই কাজ শেষে রাফির কথা মনে পড়েছিল একবার। রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফোন করে নাই জুহি। গানের বিষয়ে একটাবার খোঁজ নেওয়া উচিত। কাল তো স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং সম্পন্ন করার কথা ছিল। হয়েছে মনে হয়। না হওয়ার কোনো কারন দেখতে পেল না জুহি।
তবে সকাল সকাল ৮ টা নাগাদ জুহি ফোন করল রাফিকে। রাফি তখনও ঘুমে। ফোনের বিকট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল জুহির তিনটা মিসড কল উঠে আছে। চোখে যা ঘুম ছিল, মুহূর্তেই তা কর্পূরের মত উবে গেল। তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করল।
জুহি ফোনের আশেপাশেই ছিল যার কারণে সে তৎক্ষণাৎ ফোন রিসিভ করল এবং জিজ্ঞেস করল, ‘গতকালের আপডেট দিলেন না যে?’

রাফির হাসি মুখটা নিমিষেই বিষন্নতায় রুপ নিল। থেমে থেমে বলল, ‘গানের রেকর্ডিংটা করতে পারি নাই। জীবনের প্রথম এত বড় একটা দায়িত্ব, আমি আসলে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পাঁচ ঘন্টা চেষ্টা করেও গানের একটা লাইন ঠিকঠাক মতো তুলতে পারি নাই।’

‘ওহ। তাহলে আবার কবে ডেট দিয়েছে?’

‘সেটা আমাকে এখনো সিওর জানায় নাই। বলেছে, বেশি করে চর্চা করতে। আমার মনে হয় না, এসব আমার দ্বারা হবে। আমি যেমন আছি তেমনই ঠিক আছি!’

জুহি বিস্মিত স্বরে বলে ‘হবে না কেন বলছেন? আপনার গান তো শুনেছি বেশ কয়েকবার। মনের জোর রাখবেন, আর সব সময় একটা কথা মনে রাখবেন যে আপনাকে পারতেই হবে। আপনার নিজস্ব স্বপ্ন হল সম্পদের মত। সেটাকে তো নিজ দায়িত্বেই আগলে রাখতে হবে। হাল ছেড়ে দিবেন না, চেষ্টা করতে থাকেন। আর হ্যাঁ, প্রথম অটোগ্রাফটা কিন্তু আমি নিব!’
রাফি হাসল। জুহি কত তাড়াতাড়ি অটোগ্রাফের কাছে চলে গেল। এ জীবনে কাউকে অটোগ্রাফ দেওয়ার ভাগ্য বোধহয় তার কপালে নেই।
তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আপনার অফিস নেই আজকে?’

‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু আপনাকে যা বললাম সেটা কিন্তু একেবারে ফেলে দিবেন না। ডিরেক্টরের সাথে কথা বলেন, আরেকবার চান্স নেন। মনের জোর রাখবেন, আত্মবিশ্বাস হারাবেন না, তাহলেই হয়ে যাবে। একটা কথা জানেন তো, ধীরে ধীরে আপনি যদি উপরের দিকে ওঠেন তাহলে সেই ওঠাটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। আর এক লাফে যদি সপ্তমে পৌঁছে যান, তাহলে হয়ত কিছুদিন আপনি ঐ সপ্তমে উড়ে বেড়াতে পারবেন। তারপর কেউ ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবে না হয় আপনি নিজেই নিচে পড়ে যাবেন। তাই ধীরে ধীরে ধৈর্য ধরে নিজের স্বপ্নটাকে দীর্ঘস্থায়ী করুন!’
জুহির কথাটা ভালো লাগল রাফির, মনেও ধরল। যে রাফি রাত পর্যন্ত হতাশায় ভুক্তভোগী ছিল এখন তার মন মেজাজ নিমিষেই ফুরফুরে হয়ে গেল। শরীরের মধ্যে শীতল ভাব বিরাজ করল। কাল রাতে মায়ের যোগানো সাহস, আর আজ সকালে জুহির কথাগুলো তার সিদ্ধান্ত নিমিষেই পাল্টে ফেলল। আজকের সকালটা এত সুন্দর হবে এটা গতকাল পর্যন্তও ভাবনাতে ছিল না রাফি। জুহি নামক এই সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মেয়েটায় এত রিফ্রেশমেন্ট কেন?

সেদিনই রাতে যোগাযোগ করলেন ডিরেক্টর আজাদ মল্লিকের সাথে। তিনি রাফিকে আগামীকাল দেখা করতে বললেন এবং এইবার ভালো করে প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও মনে করিয়ে দিলেন। রাফি নির্দ্বিধায় তাকে কথা দিল, এইবার আর কোন ভুল হবে না।
পরদিন রাফি একা গেল না। রাফির সাথে রিয়াদ, মাহিদ, রাব্বি, তন্ময়ও স্টুডিওতে চলে এল।
গিটার, ড্রামস এবং অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে অন্য কোন গানের মিউজিক ট্রাক বানানোর কার্যক্রম চলছে।
রাফির গানের মিউজিক ট্রাক বাজানো হচ্ছে। এইবার গায়ক সাহেব সুর অনুসরণ করে মুহূর্তে এই গানটা খুব নিখুঁত ভাবে গেয়ে ফেলল। আজাদ মল্লিককে এইবার হতাশ হতে হয় নাই, তিনি নিশ্চিত ছিলেন রাফিকে দিয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব। অনেক বছর ধরে সিনেমা জগতে কাজ করতে করতে মানুষ চেনার ক্ষমতা তার খুব ভালো করেই হয়েছে। রেকর্ডকৃত গান মাষ্টারিং করার কার্যক্রমে পৌঁছে গেল। আজ রাফি দুটো বিষয় মাথায় রেখে ছিল।
প্রথমত, মায়ের পাশে থাকাটা তাকে ভেতর থেকে সাহস জুগিয়েছে। দ্বিতীয়ত, জুহির একটা কথা; ধীরে ধীরে ধৈর্য ধরে নিজের স্বপ্নটাকে দীর্ঘস্থায়ী করুন! এইবারের কাজে ডিরেক্টর খুব খুশি হলেন। গানের এডিট শেষে সে নিজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গানের গলা পরখ করলেন, তাতে মনে মনে রাফির প্রশংসা করতেও ভুললেন না। রাফিকে কংগ্র্যাচুলেট জানালেন ফোন করে আর বললেন, ‘নাটকের মাত্র কিছু দৃশ্য রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী দুই দিনের মধ্যে সেটাও কমপ্লিট হয়ে যাবে। আর তোমার গানের কাজ এদিকে শেষ। আমি তোমার কাজে মুগ্ধ হয়েছি। আশা করছি, তুমি আমাদের সাথে থাকবে!’
রাফি সম্মতি জানিয়েছে। মনের মত গান গাইতে পারলে এবং সেই গান লোকে পছন্দ করলে সে অবশ্যই থেকে যাবে। এই খবরটা এখন জুহিকে জানানো দরকার। তৎক্ষণাৎ ফোন করে জুহিকে খবরটা দিয়ে দিল। শত ব্যস্ততার মধ্যেও জুহি এইবার রাফিকে ধমক দিল না। বরং তাকে কংগ্রাচুলেশন জানাল, এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কতগুলো অনুপ্রেরণামূলক বাক্যও শুনিয়ে দিল।
.
জাহিন, জুহি আর তামিম তিনজন মিলে অনেক ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল তারা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলবে। একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য কত দিন আর ঝুলে থাকতে হবে? তবে জাহিন মাঝপথে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আরে থামো তোমরা সব। এই ব্যাটা কয়েকদিন পরই পদত্যাগ করবে। এনার পর যে চেয়ারম্যানের আসনে বসবে, তাকে বলে দেখব। আর নির্বাচন তো সামনেই। এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছি আর কয়টা দিন পারব না?’

জুহি আর তামিম সম্মতি জানাল। তামিম কিছু একটা ভেবে সন্দিহান গলায় বলল, ‘চেয়ারম্যান সাহেবের সমস্যা আছে। বাড়ির মধ্যে শুধু মেয়ে মানুষের আসা-যাওয়া ভাই। তারপর, ভেতরে ভেতরে আরোও কাহিনী আছে। এতো কাহিনীর সূচনা কই? আমি তো লোকমুখেও নানান ধরনের কথা শুনি।

‘তুমি এখন গিয়ে তার ভেতরের কাহিনী উদঘাটন করে আসো।’

জাহিনের কথা শুনে তামিম গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘ঘরে বউয়ের রহস্য উদঘাটন করতে পারছি না, আর আমি যাব ওই চেয়ারম্যানের রহস্য উদঘাটন করতে! হাসালে ভাই।’

জুহি দু’জনের কথার মাঝখানে বলল, ‘আমার কাছেও এই ব্যাপারটা কেমন জানি লাগে। চেয়ারম্যান সাহেবের অবশ্যই কোনো রহস্য আছে। শুধু মেয়ে মানুষ না, আমি আরোও বিভিন্ন ধরনের মানুষের আনাগোনাও লক্ষ্য করি।’

জাহিন বলল, ‘ওরা বড় বড় মানুষ, আমাদের বলার সাধ্য আছে কিছু? আর তারা কী করে, তার কোনো উপযুক্ত প্রমাণও নাই আমাদের কাছে। চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া আর কী—ই বা করার আছে?’

জাহিনের কথার উত্তরে তামিমও ফের কিছু বলল। এভাবেই পাল্টা কথা চলতে লাগল। জুহির আর এসব কথা কানে তুলতে ইচ্ছে করছে না।
দুজনের আলাপ আলোচনার মাঝখান থেকে সে উঠে গেল। মামা তখন ফোন করেছিলেন কিন্তু ব্যস্ততার জন্য কথা বলতে পারে নাই। তাই বাড়ি ফিরে ফোন করল, এবং জানতে পারল তারা মাহিদের জন্য পাত্রী দেখছে খুব শীঘ্রই মাহিদের বিয়ে দিবে। জুহির মতামত জানার জন্য ফোন করেছিল তখন। জুহি অবাক হয়ে ভাবল তার, মতামত দেওয়ার কী আছে? পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল, মামা মামীর কাছে সে আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। ছোটোখাটো যেকোনো কিছুর ব্যাপারে তারা জুহির সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেন। এমনকি ওই বাড়িতে থাকাকালীন কখন কী করা হবে, এটাও মামী জুহির থেকে জেনে নিতেন। মামা মামী যেটাই করে, জুহিকে আগে ভাগে জানিয়ে রাখে অথবা তার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়। এইবারও তার ব্যতিক্রম হয় নাই।
জুহি এসব চিন্তা করে মনে মনে হাসল। কী অমূল্য তাদের এই ভালোবাসা। যেখানে এই সময়টা মা-বাবার আদরে ভরপুর থাকার কথা ছিল, সেখানে এখন এই মানুষগুলোই জুহির সব। এদের ব্যতীত জুহি কখনো তার এক জীবন কল্পনা করতে পারে না, সম্ভবই না। মানুষগুলো প্রচন্ড ভালোবেসে আগলে রেখেছে তাকে—প্রচন্ড।
এতো ভালোবাসাল দাম কী দিয়ে শোধ করবে জুহি?
.
.
.
চলবে…..

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]